আকাশে তারার মেলা ২ পর্ব-২৬+২৭

0
679

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_২৬

তুলি কে টেনে হল রুমে নিয়ে আসল আদ্র। সায়েরা বেগম আমরিন কে খাইয়ে দিচ্ছিলেন নিজ হাতে। যেই না এক লোকমা ভাত আমরিনের মুখে পুড়ে দিল দেখতে পেল আমরিনের মুখভঙ্গি হঠাৎ করেই পরিবর্তন হয়ে গেছে। বহু কষ্টে লোকমা টা গিলে নিল আমরিন। চোখের ইশারায় সামনে তাকাতে বললো সায়েরা বেগম কে। দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে চাইতেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ছেলের পিছনে নত মস্তকে থাকা তুলি কে দেখে হাত ধুয়ে উঠে আসলেন তড়িঘড়ি করে। মেয়েটার চেহারায় ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। আতঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

” কি হয়েছে আদ্র?তুলি কে এভাবে ধরে এনেছিস কেন?”

” কিছু হয় নি। বউ কে নিয়ে এলাম একেবারে। আর দিচ্ছি না। তোমার বোন কে জানিয়ে দিও।”

নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিয়ে তুলির হাত টা ছেড়ে দিল আদ্র। টি টেবিলের উপর থেকে রিমোট নিয়ে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিল। কয়েক সেকেন্ড ঠাঁই দাড়িয়ে থেকে সিঁড়ি বেয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই সায়েরা বেগম পিছু ডাকলেন। হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে এসে বললেন,

” একেবারে নিয়ে এসেছিস মানে?”

“আমার বউ উড়তে শিখে গেছে,বুঝতে শিখে গেছে,অন্যের দুঃখ কষ্টের ভাগিদার হওয়া,সহানুভূতি দেওয়া শিখে গেছে। সব মিলিয়ে খুব বড় হয়ে গেছে। তাই আমি আমার বউ কে নিয়ে এসেছি। কোনো শর্ত সহ্য করতে রাজি নয় আমি।”

তাচ্ছিল্যের স্বরে তুলির দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে কথাগুলো বললো আদ্র। তুলির চোখে জল টলমল করছে। ভয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে ঝটপট। এতো ভয় কখনও পায় নি এর আগে আদ্র কে। হয়তো আগে আদ্রর এমন রূপের সম্মুখীন হতে হয় নি তাই। সায়েরা বেগম ইতস্তত কন্ঠে বলতে লাগলেন,

” কিন্তু,,। ”

” কিন্তু কি?শর্ত ছিল ইন্টার ফাইনাল দেওয়ার পর তুলি কে এই বাড়িতে, আমার হাতে তুলে দেওয়া হবে। কারণ খালা-খালু,বাবার দৃষ্টিতে তুলি এখনও ছোট। আমি যদি আমার বউ কে খাইয়ে পড়িয়ে,যত্ন দিয়ে বড় করতে পারি তাহলে কি এই শর্ত নিছক নয়?আমার পক্ষে আর এক মুহুর্তও কোনো শর্ত মানা সম্ভব না। বউ আমার। তাই আমি নিয়ে এসেছি। ”

একটু থামলো আদ্র। কন্ঠে এক রাশ গম্ভীরতা ঢেলে বাঁকা হেসে বলে উঠল,

” তোমার মনে আছে মা?নাও থাকতে পারে। স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। তোমার পিছনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা কে চার বছর আগে নিজের ছেলের বউ করে আনার জন্য অন্য একটা মেয়ে কে আমার জীবন থেকে সরিয়েছিলে অন্যায়ভাবে। আজ যখন আমি তুলি কে চাইছি কেন দূরে সরিয়ে রাখছো?আমি ধৈর্যশীল তবে ততটাও নয় যতটা ধৈর্য্য ধরলে আমার নিজেরই নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হবে।”

আদ্রের কথায় আঁতকে উঠলেন সায়েরা বেগম। পিছন ফিরতেই চোখে পড়ল তুলির বিস্ময়কর দৃষ্টিপাত। তুলির চোখের জল শুকিয়ে গেছে। অন্য এক চিন্তা হানা দিয়েছে মনের মধ্যে। অন্য একটা মেয়ে মানে?সূক্ষ্ণ বিষাদ অনুভব করল তুলি। সায়েরা বেগম ফের ছেলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। আদ্রর ঠোঁটের কোণের হাসি টা প্রগাঢ় হলো। শান্ত শোনালো কন্ঠস্বর।

” অন্যায়কারী তুমি একা নও,সেও ছিল। তবে আমি কৃতজ্ঞ তোমার প্রতি মা। তুমি আমাকে সুন্দর একটা পৃথিবী দেখিয়েছ, আমার অস্তিত্বের সন্ধ্যান দিয়েছ। তুলি কে যদি কেউ এই বাড়ি থেকে নিয়ে যায়, তাহলে আমার ছায়াও এই বাড়িতে দেখবে না তোমরা।”

আদ্রর শান্ত কন্ঠের হুমকি শুনে বুক টা হাহাকার করে উঠল সায়েরা বেগমের। তিনি আর কোনো ভুল করতে চান না। একটা ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে চার টা বছর ধরে। এক মুহুর্তও দাঁড়ালো না আদ্র। তুলির দিকে একবার চেয়ে সোজা চলে গেল সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে। ছেলের যাওয়ার দিকে চেয়ে ভিতর থেকে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো সায়েরা বেগমের। তুলির কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

” আদ্রর রুমে যা মা। ”

তুলি বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে গেল। চোখের পলকেই শ্যাম বরণ চেহারাটা কেমন রাঙা হয়ে উঠল। আলতো হাসলেন সায়েরা বেগম। আদুরে কন্ঠে বললেন,

” তুই এখন না গেলে আমার ছেলেটা ভীষণ রেগে যাবে। ”

লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ল তুলি। মাথা নাড়িয়ে নত মস্তকেই সিড়ি বেয়ে উঠে গেল। আমরিন চিন্তাগ্রস্ত স্বরে আওড়ালো,

” ভাইয়া বোধ হয় কোনো বিষয় নিয়ে রেগে আছে আম্মু। তুমি রাতে আব্বু আসলে বিয়ের বিষয় টা নিয়ে কথা বলো। আমি চাই না ভাইয়া এই বাড়ি ছেড়ে আবারও চলে যাক। শূন্য শূন্য লাগে বাড়ি টা।”

মেয়ে কে বুকে জড়িয়ে নিলেন সায়েরা বেগম। হেসেই বলে উঠলেন,

” তোর ভাইয়া কে আঁটকে রাখার জন্য তুলিই যথেষ্ট। ”
_________

কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা ঠেলে আদ্রর রুমে ঢুকল তুলি। নিরবতার ছড়াছড়ি পুরো রুম জুড়ে। তুলির বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। বেলকনি থেকে একটা শীতল হাওয়া ছুঁয়ে দিয়ে গেল। এলোমেলো করে দিয়ে গেল কয়েকটা চুল। চারদিকে নজর বুলিয়ে তুলি বেলকনির দিক পা বাড়াল। বাতাসের দাপটে সাদা পর্দা গুলো উড়ছে বাধাহীন। আকাশ টা হুট করেই কালো মেঘে ঢেকে গেছে। হয়তো বর্ষণ হবে। তুমুল বেগে বর্ষণ। শীতল হাওয়া তারই বার্তা বয়ে চলেছে। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিল তুলি। বেলকনির দরজা লাগিয়ে রুমে আসতেই চোখে পড়ল সদ্য শাওয়ার নিয়ে আসা আদ্র কে। সাদা একটা গেঞ্জি পরে আদ্র চুলের পানি ঝাড়ছে হাত দিয়ে। রুমে কারো উপস্থিতির আভাস পেয়েও ফিরে তাকাল না। বাধ্য হয়ে তুলি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এগোতেই আদ্র কতগুলো জরুরি ফাইল নিয়ে বসে পড়লো চেক করতে। গতকাল হসপিটাল থেকে ফাইল গুলো নিয়ে এসেছিল। ফাইলে নজর রেখেই দুর্বোধ্য হেসে বললো,

” আজ হসপিটাল থেকে লেকের পাশের রাস্তা দিয়ে ব্যাক না করলে কখনোই জানতে পারতাম না আমার তুলা আমাকে মিথ্যে বলে।”

যন্ত্রণা দায়ক পীড়ন ছড়িয়ে পড়ল তুলির সারা শরীরে। আদ্রর অভিমান মিশ্রিত দৈবাৎ বাক্য টা তার মন মেনে নিতে পারল না। হাউমাউ শব্দ করে প্রচন্ড জোরে কেঁদে উঠল। ছুটে এসে সবকটা ফাইল ফেলে দিল ফ্লোরে। বাচ্চাদের মতো গুটি শুটি মেরে জায়গা খুঁজতে লাগল আদ্রর প্রশস্ত বুকে। হতভম্ব হয়ে গেল আদ্র। কয়েক পলক স্তম্ভিত থেকে নিজেই তুলির কোমল দেহ টা কে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। ভেজা অনুভব করল বুকের এক পাশে। তুলির মাথায় হাত রেখে কানের কাছে করুন স্বরে ফিসফিস করে বললো,

” হৃদপিণ্ড বরাবর মাথা রেখে কাঁদছো তুমি তুলি। আমার রক্তাক্ত হৃদপিণ্ডের আর্তনাদ কি শুনতে পাচ্ছো তুমি?যদি পারো তাহলে কাঁদবে না প্লিজ। ভীষণ কষ্ট হয় আমার। ”

কথাগুলো কর্ণগোচর হতেই তুলির কান্নার বেগ কমে এলো। থেমে গেল একটা সময়। অশ্রু সিক্ত কন্ঠে বুকে মুখ গুঁজে বলে উঠল,

” কোনোদিনও আর মিথ্যা বলবো না আদ্র। কোনোদিনও না। আপনি আমার সাথে রাগ করে থাকবেন না। ভালোবাসা বন্ধ করবেন না।”

তুলির অশ্রু ভেঁজা কন্ঠে বোকা বোকা কথা শুনে স্মিত হাসল আদ্র। ফ্লোরের দিকে নজর ঠেকতেই দৃষ্টি করুন হয়ে এলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফাইলগুলো। প্রত্যেক টা ফাইল খুবই জরুরি। আদ্র ফাইলগুলোর দিকে তাকিয়েই তুচ্ছ করে মনে মনে বললো,

” আমার বুকে থাকা মেয়েটা আমার কাছে তোদের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তোদের নাহয় কষ্ট করে আবার গুছিয়ে নিব কিন্তু আমার তুলা কে ছাড়া আমি অগোছালো হয়ে পড়ব।”

তুলি কে বুকে জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল আদ্র। আদ্রের হাতে মাথা রেখে লজ্জায় চোখ বুঁজে রইল তুলি। আবেগের বশে যেন হুঁশ হারিয়ে ফেলেছিল কিছুক্ষণের জন্য। এখন লজ্জায় বুকে হাতুড়ি পেটা শব্দ হচ্ছে। নিজ থেকে আদ্রর এতোটা কাছে এসেছে যা তুলির জন্য এভারেস্ট জয় করার সমান।নিজের হাতের মুঠোয় তুলির একটা হাত পুড়ে নিল আদ্র। পুরো রুমে শীতলতা। বৃষ্টি ইতিমধ্যে ধরনীর বুকে আছড়ে পড়ছে প্রবলভাবে। তুলির সারা শরীর শিউরে উঠল। ছোট্ট দেহে কিছুটা ভার অনুভব করল। ঠান্ডার মাঝেও ঘামতে লাগল দেহ। কলেজ ড্রেস টা পুনরায় ঘামে ভিজতে লাগল। এইবার টনক নড়ল তুলির। আদ্রর গা থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ নাকে দোলা দিতেই লজ্জায় চুপসে গেল। এতোক্ষণ অব্দি ঘর্মার্ত ড্রেস নিয়ে আদ্রর সাথে মিশেছিল ব্যাপারটা কেমন জঘন্য। আদ্র বোধ হয় মনে মনে তাকে খাটাশ উপাধিও দিয়েছে। তুলি উঠে যাওয়ার প্রয়াস করতেই আদ্র হাত চেপে ধরল। কপালে সূক্ষ্ণ ভাজ পড়ল তার।

” কোথায় যাচ্ছো?”

তুলি আমতাআমতা করে জবাব দিল,

” ফ্রেশ হবো।”

” আরেকটু পরে যেও।”

” কলেজ ড্রেস টা ময়লা হয়ে আছে ঘ,,ঘামে ভিজে।”

“তো?”

কপট রাগ দেখিয়ে প্রশ্ন করল আদ্র। হাত টেনে তুলি কে নিজের কাছে নিয়ে আসল। গালে শুষ্ক ঠোঁট ছুয়ে দিতেই তুলি কম্পমান হাতে খামচে ধরল আদ্রের বুকের কিছু অংশ নিষ্পলক চেয়ে রইল আদ্র তুলির অস্থিরতা মাখা মুখশ্রী তে। ক্ষীণ স্বরে আওড়ালো,

” ঘামে চুপচুপে স্কুল ড্রেসে পড়ন্ত এক দুপুরে তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম তুলা। ”

অতিশয় বিস্মিত হলো তুলি। চোখ বুঁজে থেকেই বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল। নিঃশ্বাসের উত্তাপে কন্ঠনালি শুকিয়ে এলো আদ্রর। শিরদাঁড়া বেয়ে গড়িয়ে গেল শীতল স্রোত। তুলির কোমর আঁকড়ে ধরে একদম কাছে টেনে নিল। গম্ভীর স্বরে ডাকল,

” লুক এট মি তুলা।”

পলক ঝাপটিয়ে আঁখিদ্বয় মেলল তুলি। নিমিষেই আঁটকে পড়ল আদ্রর চোখের মাদকতায়। দু’চোখে অদ্ভুত মুগ্ধতা ফুটে আছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। গভীর চাউনি আদ্রর। অন্তর টা কেমন ভয়ংকর অনুভূতিতে নড়ে উঠছে। চোখ সরাতেই আদ্র নেশা মিশ্রিত স্বরে বলে উঠল,

” যদি তোমাকে একটু গভীরভাবে ছুঁয়ে দিই তোমার মন কি কষ্ট পাবে তুলা?”

বাক্য হারা হয়ে গেল তুলি। বক্ষস্থল কেঁপে উঠল নিদারুণ ভাবে। এ কেমন হৃদয় নিংড়ানো প্রশ্ন করে বসল আদ্র!

#চলবে,,,

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_২৭

দ্বিপ্রহর কাটিয়ে প্রকৃতি সায়াহ্ন রূপে সেজে উঠেছে। দুপুর থেকে তুমুল বেগে হওয়া বর্ষণ নিজের তেজী রূপ কমিয়েছে বেশ কিছু সময় পূর্বে। ফলস্বরূপ গাছের পাতা বেয়ে ঝড়ে পড়ছে জলধারা। হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে রুমে আসল আদ্র। দৃষ্টি বিছানার দিকে ফেলতেই চক্ষে ফুটে উঠল তুলির এলোমেলো রূপ। পড়নের শাড়ি টা গায়ের কিছু অংশ থেকে সরে গিয়ে ফ্লোর ছুঁয়ে আছে। চোখ বুঁজল আদ্র। অনুভব করল হৃদয়পটে হানা দেওয়া কাল বৈশাখীর তান্ডব। কীয়ৎক্ষণ বুঁজে রাখা নেত্রযুগল মেলে খাবারের প্লেট টা টি টেবিলের উপর রাখল।ফ্লোর হতে শাড়ির আঁচল টা হাতে নিয়ে তুলির শরীরে জড়িয়ে দিল অতি সন্তর্পণে। নয়তো মেয়েটা ঘুম থেকে জেগে নিজেকে এমতাবস্থায় দেখলে আঁতকে উঠতো। লজ্জায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতো। এছাড়াও মেয়েটার বিধস্ত, এলোমেলো রূপে ঘোর লেগে আসছিল আদ্রর। ঘুমন্ত তুলি কে সম্মতি ব্যতীত স্পর্শ করার অপরাধ সে করতে চায় না। তুলির তৈলাক্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ হাসির ঝলক দেখা দিল আদ্রর ঠোঁটের কোণে। লজ্জা যেন মেয়েটা নিজের মধ্যে প্রখরভাবে বহন করে চলেছে প্রতিনিয়ত।

তুলি দুর্বল প্রকৃতির। খুবই দুর্বল। গভীরভাবে ছুঁয়ে দেওয়ার কথা শুনে কেমন চুপসে গেল। লজ্জায় ঢলে পড়েছিল আদ্রর বুকে। জ্ঞান হারিয়েছিল অতিরিক্ত চিন্তায়। আদ্রর তখন পাগলপ্রায় হওয়ার অবস্থা। সায়েরা বেগম, আমরিন দৌড়ে এসেছিল রুমে। তুলি কে অচেতন অবস্থায় আবিষ্কার করে আঁতকে উঠেছিল। জ্ঞান ফেরার পর তুলি জড়তা-সংকোচ, লজ্জায় আবারও জ্ঞান হারানোর পথে। শেষমেশ সে কিনা লজ্জায় হুঁশ হারিয়ে বসল? সবাই কি না কি ভাবলো। আর আদ্র!আদ্রর মনোক্ষুণ্ণ হয় নি তো?চিন্তায় তুলি কারো সাথেই একটা কথাও বলে নি। ক্লান্ত শরীর নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিল ঘুমের রাজ্যে।

কানের কাছে মুখ নিয়ে নরম স্বরে ডাকল আদ্র। বার কয়েক ডাকার পর তুলি নড়েচড়ে উঠল। নিজের অতি কাছে আকস্মিক আদ্র কে দেখে হকচকিয়ে গেল। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল শাড়ি ঠিক আছে কিনা। যখনই দেখল একদম ঠিকঠাক তুলি খুব করে চমকাল। কারণ শাড়ি পড়ে ঘুমানো এই প্রথম। নিজেকে এতোটা গোছানো দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছতে বাকি নেই। আদ্র রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিল। নীল আকাশটা লালিমায় ছেয়ে গেছে। কিছুটা দূর থেকে আযানের শব্দ ভেসে আসছে। শাড়ি সামলে ধীর পায়ে বিছানা ছাড়ল তুলি। ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখল আদ্র সোফায় বসে আছে দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে। অন্তর টা মুচড়ে উঠল তুলির। আদ্রর পাশে বসে ব্যাকুল কন্ঠে ডাকল,

” ডাক্তার সাহেব। ”

“হুঁশ! ”

ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তুলি কে চুপ করিয়ে দিল আদ্র। নরম ঠোঁটে আদ্রর স্পর্শে তুলির রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ বয়ে চলেছে। ওষ্ঠদ্বয় এগিয়ে আনল আদ্র। তুলির হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক হতে লাগলো কাছে আসতে দেখে। আদ্রর হাতে নখ বিঁধিয়ে আঁকড়ে ধরল শক্ত করে। একটা শব্দও করল না আদ্র বরং অধর যুগল গভীরভাবে ছুঁয়ে দিল তুলির ললাটে। ধপ করে চোখ মেলল তুলি। লজ্জায় মাথা নত করতেই চোখে পড়ল আদ্রর ফর্সা হাতের পিঠে বিন্দু বিন্দু রক্ত। তুলির হৃদয়ে ব্যাথার সঞ্চার হলো। নিজের নখের দিকে চাইতেই স্তব্ধ হয়ে গেল। নখ গুলো খুব বড় হয়ে আছে। যে কেউ দেখলে বলবে কতকাল হয়তো নখ কাটে না মেয়েটা। মন খারাপ করে আদ্রর দিকে তাকালো। চক্ষুদ্বয়ে আটকালো আদ্রর মুগ্ধকর হাসি। মন জুড়িয়ে গেল নিমিষেই। পরক্ষণেই হাতের কথা ভেবে প্রশান্তি টা উবে গেল। অথচ আদ্র হাসিটা ধরে রেখেছে। তুলির পাশ থেকে উঠতে উঠতে বললো,

” মন খারাপ করো না বউ। ব্যাথা লাগে নি আমার। দুপুরের জন্যও রাগ করি নি আমি। হাত টা ধুয়ে আসি তোমাকে খাইয়ে দিব। খাওয়ানো শেষে তোমার ডাইনি নখ গুলোও কেটে দিতে হবে। এই নিয়ে দুই দু’বার হামলা করলো আমার উপর।”

মুহুর্তেই তুলির ঠোঁটে লজ্জালু রেখা দেখা দিল। মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে হাসল সে,যা আদ্রর চক্ষুগোচর হলো অনাসয়ে। হাত ধুয়ে এসে তুলির পাশে বসলো আদ্র। প্লেট হাতে নিয়ে ভাত মাখিয়ে এক লোকমা তুলির মুখের সামনে ধরলো। তুলি একবার ভাবলো এই অসময়ে খাবে না। কিন্তু তার ডাক্তার সাহেবের হাতে খাওয়ার সুযোগ টা সে কখনোই মিস করতে চায় না। হা করে মুখে পুড়ে নিল খাবার টা। কিছু একটা মনে পড়তেই চিবোতে চিবোতে বললো,

” আপনি খেয়েছেন?”

” না।”

আদ্রের জবাবে তুলি করুন চাহনি নিক্ষেপ করল। আর আদ্র উপহার দিল ঠোঁটের উষ্ম ছোঁয়া। তুলির গালে পরশ বুলিয়ে বলে উঠল,

” হসপিটালের ক্যান্টিনে নাস্তা খেয়েছিলাম। রাতে খেয়ে নিব।”

তুলি মৃদু হাসল। আদ্রর হাতে প্লেটের পুরো ভাত খেয়ে শেষ করল। প্লেট নিচে রেখে এসে আদ্র নেইল কাটার নিয়ে তুলির সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। যত্নসহকারে সবগুলো নখ কাটতে কাটতে বলে উঠল,

” আমাকে দেখার তৃষ্ণা যেন তোমার কখনও না ফুরায় তুলা। ”

তুলি স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। এতোক্ষণ তার নয়ন দু’টো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল আদ্র কে। ইশ!ধরা পড়ে গেল।
_______________

ড্রইংরুমে পিনপন নীরবতা। রাদিফ সাহেব, সায়েরা বেগম, আমরিন,আফসানা,তৌফিক সাহেব বসে আছেন। তুলি আড়ষ্টতা নিয়ে বসে আছে মায়ের পাশে। দশ মিনিট অতিবাহিত হয়েছে আদ্র কে ডেকে পাঠানো হয়েছে এখনও আসার কোনো নাম নেই। আদ্র তো এমন উচ্ছৃঙ্খল নয়,এটা সবারই জানা। তবুও কেন আসছে না বুঝতে পারছেন না রাদিফ সাহেব। সায়েরা বেগম ফের ডাকতে যাওয়ার জন্য উঠতে যাবে,ঠিক তখনই সিঁড়ির দিকে চোখ গেল সবার। বড় বড় পা ফেলে নেমে আসছে আদ্র। সিংগেল সোফা টায় বসে বলে উঠল,

” সামান্য লেট করার জন্য দুঃখিত আমি। কয়েকটা পেশেন্টের ফাইল গুলো চেক করা খুব জরুরি ছিল,শেষ না করে উঠতে পারছিলাম না।”

তৌফিক সাহেবের কপট রাগ হলেও মুখে কিছু বললেন না। ওনার রাগ একটা জায়গায় এভাবে কেন নিয়ে আসলো তার মেয়ে কে। যদিও আদ্রর সম্পূর্ণ অধিকার আছে তার মেয়ের উপর তবুও তার রাগ হচ্ছে। আদ্র ভালো ছেলে হলেও ওনার কাছে এখন আদ্র কে একরোখা, ঘাড়ত্যাড়া মনে হচ্ছে। সবাইকে মৌন মুখে বসে থাকতে দেখে আদ্র নিজেই সবার উদ্দেশ্যে বললো,

” আপনাদের সিদ্ধান্ত কে আমি শ্রদ্ধা জানিয়েছি। আপনাদের কি উচিত নয় এখন আমার অতি সামান্য একটা সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার? আমি চাই কালই আমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি হোক।”

উপস্থিত সকলে চমকিত নয়নে চাইল আদ্রর দিকে। কাল মানে!সবার চমকপ্রদ দৃষ্টি দেখে আদ্র তুলির দিকে তাকাল। ঝটপট দৃষ্টি সরিয়ে নিল তুলি। তৌফিক সাহেব কিছুটা উঁচানো স্বরে বলে উঠলেন,

” এতো জলদি!মেনে নিতে পারছি না তোমার সিদ্ধান্ত আদ্র।”

বুকে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করল তুলি। বাবার দিকে কাতর চোখে চাইতে গিয়েও পারল না সংকোচে। আদ্র দু’ ঠোঁট প্রসারিত করে বললো,

” কেন পারবেন না খালু?আপনার কি আমাকে আপনার মেয়ের জন্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না?যদি নাহয় তবে আমি আজ আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনার মেয়ে কে আমি নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখব। একটা মেয়ের জন্য তার বাবা-ই রাজা। আমি না-হয় আপনার রাজকন্যার রাজপুত্র হয়ে দেখাবো। সর্বশেষে এটাই বলবো আমার কাছ থেকে তুলি কে আর দূরে রাখবেন না প্লিজ।”

প্রচন্ড অবাক হলো সবাই। আদ্রের শান্তস্বরের কথাগুলো তৌফিক সাহেবের মন গলিয়ে দিলেন। ঠোঁট ছাড়িয়ে হাসলেন তিনি। তুলির সুখে কাঁদতে ইচ্ছে করলো। আদ্রর মতো একটা পুরুষ তার কল্পনায়ও ছিল না। অথচ না চাইতেও পেয়ে গেল। ভাগ্য! তুলির ভাগ্যে এতো সুখ তুলির কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত। আদ্রর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। তৌফিক সাহেব, রাদিফ সাহেব কালকের অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনায় বসে পড়লেন। কম সময়ে বিরাট আয়োজন করতে হবে। একমাত্র ছেলে ও মেয়ে বলে কথা। আজ তুলির বাবা,মা-ও এখানে থাকবেন। অনুষ্ঠান এ বাড়িতেই হবে। নিকট আত্মীয় স্বজন সবাইকে ফোন করে কাল সকালে উপস্থিত হতে বলা হয়েছে। রেজিস্ট্রি হবে কাল রাতে। ইনশিতা কে এখনই চলে আসার জন্য বলে দিয়েছেন সায়েরা বেগম। মেয়েটা তো শুনেই খুশিতে আত্মহারা। ড্রাইভার কে নিয়ে বেরিয়েও গেছে। রনক কে বলে দিয়েছে ব্যাগ প্যাক নিয়ে যেন পরে চলে আসে। শুনেই সায়েরা বেগম কয়েক দফা বকেছে ইনশিতা কে। কিন্তু বিশেষ লাভ হয় নি। প্রিয় মানুষ, প্রিয় ভাইয়ের বিয়ে এটা তার জন্য জীবনের সবচেয়ে বড় খুশির খবর। ইনশিতা ও আমরিনের জীবনে ভালোবাসার মানুষ থাকলেও প্রিয় মানুষ কেবলই তাদের ভাই।
_________

সারা বাড়িতে উৎসব মুখর পরিবেশ। সময় এগারোটার কাটায় এসে স্থির হলো মাত্র। পায়েল,অন্তু,সাগর,রিমি সব দশটার দিকে এসে হাজির। আসা মাত্রই অন্তু,সাগর কাজে লেগে পড়েছে।রিমি,পায়েল আমরিনের রুমে আড্ডা জমিয়েছে জমপেশ। উপর থেকে হাসির কলরব ভেসে আসছে খুব। সাগর ডেকোরেশনের কাজ দেখছিল। অন্তু আফসোসের সহিত বিড়বিড় করল,

” ছেলে হয়ে ফেঁসে গেলাম। নয়তো আমিও আড্ডা দিতে পারতাম। ”

কথাটা কর্ণগোচর হলো সাগরের। ফিক করে হেসে উঠল। অন্তুর কাঁধ চাপড়িয়ে বললো,

” পায়েল ডাকিনীর মতো কেউ না আসুক তোর জীবনসঙ্গী হয়ে। নাহলে বউয়ের হাতে মার খেতে খেতে পটল তুলতে হবে তোর।”

মাথা দুলিয়ে হাসল অন্তু। কাজ দেখতে দেখতে আনমনে আওড়ালো-” ডাকিনী টা-ই ভীষণ প্রিয়।”

স্টেজ সাজানোর আয়োজন দেখে ঘরে আসল আদ্র। রুমের কোথাও তুলি কে দেখতে পেল না। আমরিনের রুম থেকে শোরগোল কানে আসতেই সেদিকে পা বাড়াল। দরজার সাথে হেলান দিয়ে গাঢ় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো পা গুটিয়ে বসে থাকা তুলির পানে। রিমি ব্যঙ্গ স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

” কি চাই? ”

“বউ চাই।”

আদ্রর নির্বিকার জবাবে চোখ কপালে উঠে গেল সবার। তুলি লজ্জায় পা দিয়ে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরল। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো ডাক্তার সাহেব আপনি এতো লজ্জাহীন, বেহায়া কেন?পায়েল ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,

“নিতে হলে আমাদের ট্যাক্স দিতে হবে।”

” ওকে ডান। চোখ বন্ধ কর তোরা সবাই। সারপ্রাইজ আছে তোদের জন্য। ঠিক পাঁচ মিনিট পর খুলবি।”

সবাই খুশিতে গদগদ হয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। আঁখিদ্বয় বুজতেই তুলি শূন্যে ভাসতে লাগল। ঠাওর করে নিল আদ্রর চাল। আদ্রর গলা জড়িয়ে ধরে আমতাআমতা করে বলে উঠল-

” এটা ঠিক হয় নি ডাক্তার সাহেব। ”

” তোমার জন্যই বেঠিক নিয়মে চলতে হলো বউ।”

#চলবে,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)