আকাশে তারার মেলা ২ পর্ব-৩৪+৩৫

0
656

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_৩৪

” প্রিয় ডাক্তার সাহেব, আমার জীবনের সুদর্শন পুরুষ,
ভালোবাসি আমি আপনাকে অবাধ,অন্তহীন। ”

আদ্রর ঘুমন্ত চেহারায় মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় অপলক চেয়ে রইল তুলি। বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে খুব আলতোভাবে চুমু খেল আদ্রর ললাটে। সারা রাত নিদ্রাহীন কাটিয়ে নতুন কয়েকজন পেশেন্টের ফাইল চেইক করেছে আদ্র। ফজর নামাজের পর স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে তুলা কে বুকে জড়িয়ে পাড়ি জমিয়েছে ঘুমের রাজ্যে। এখনও গভীর তন্দ্রায় কাটছে আদ্রর সকাল। এটাই তো মুখ্য সুযোগ তুলির জন্য আদ্র কে মন ভরে অবলোকন করার। আদ্রর মুখ টা নিজের হৃদয় পিঞ্জিরায় বন্দি করে নেওয়ার। জাগ্রত অবস্থায় তুলির এই সুযোগ হয়ে উঠে না। হবে কিভাবে আদ্র যে একরাশ লজ্জায় রাঙিয়ে তুলে প্রতিটি মুহুর্তে, প্রতি ক্ষণে। তুলির মন জুড়ে প্রশান্তি ছেয়ে গেল। স্মিত হেসে আদ্রর চোখে পুর্নবার অধর ছোঁয়ানো মাত্র কানে আলতো স্পর্শ অনুভব হলো। সতর্ক হয়ে উঠল মস্তিষ্ক। জানান দিল স্পর্শ টা গাঢ় থেকে গাঢ় হচ্ছে। দ্রুত গতিতে সরে আসার প্রয়াস চালাল তুলি। কিন্তু তা আর হলো কই!কানের পিঠে অতি যত্নের সহিত কপালে আসা অবাধ্য চুল গুলো গুঁজে দিল আদ্র। ঠোঁটে বিস্তর হাসি লেগে আছে তার। তুলি শুকিয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো,

” ছাড়ুন আদ্র। ”

এক কথায় ছেড়ে দিল আদ্র। উঠে হেলান দিয়ে বসল খাটের কিনারায়। তুলির দিকে নজর পড়তেই সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল কপালে। লহু স্বরে বলে উঠল,

” আজ থ্রি পিস পড়লে যে?শাড়ি কোথায়?”

” আজ মন চাইল থ্রি পিস পড়ি। শাড়ি তো রেগুলার পড়া হয়। ”

কোনো প্রকার জড়তা ছাড়া জবাব দিল তুলি। আজকাল আদ্রর সাথে কথা বলতে জড়তা-সংকোচ ঘিরে ধরে না তুলি কে। কিন্তু লজ্জার কমতি কোনো কালেই কম হয় না। তুলির এই লজ্জাবতী গুণ তো আদ্রর পছন্দ। তাই তো ক্ষণে ক্ষণে লজ্জার চাদরে মুড়িয়ে দেয় তুলি কে। কালো সুতি ওড়না টা দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে নিল তুলি। আঁড়চোখে চাইতেই মন আঁটকে গেল আদ্রর নিষ্পলক চাহনিতে। কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। অনুভূতিরা বেসামাল ভাবে তুলি কে গ্রাস করতে শুরু করল। মুহুর্তেই কর্ণগোচর হলো আদ্রর শান্ত স্বরের ডাক।

” তুলি!”

” জ্বি!”

” কিস টা মিষ্টি ছিল।”

তাজ্জব বনে গেল তুলি। মনে পড়ে গেল আদ্রর বলা ফুলশয্যায় ঘাটতি ছিল কথাটা। এই কথা শোনার পর তুলি মুখ লুকিয়ে আদ্রর থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছে। সারাদিন মিন মিন করে বলেছে একজন ডাক্তার এমন অসভ্য কি করে হয়!না জানি এখন আবার কোন উদ্দেশ্যে এমন কথা বলছে। আমতা আমতা করে বললো,

” মানে?”

” কপালে তোমার ওষ্ঠের স্পর্শ টা মিষ্টি ছিল। একদম কুমিল্লার রসমালাই এর মতো।”

তুলি লজ্জা পেয়ে ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকিয়ে ফেলল তড়িঘড়ি করে। বিছানা ছেড়ে উঠে নিঃশব্দে তুলির পাশে এসে দাঁড়াল আদ্র। চিবুকে আঙ্গুল রেখে তুলির নত মুখ তুলতেই উতলা হয়ে উঠল ভিতর টা। শ্যামলা মেয়েদের বুঝি এমন অন্তরস্থল কাঁপানোর ক্ষমতা থাকে!থাকে। নয়তো এই মেয়ে কে পাওয়ার জন্য, স্পর্শ করার জন্য সারাক্ষণ বিচলিত হতো না মন। আদ্র ঘোমটা টা ভালো করে টেনে দিল। ক্ষীণ হেসে,গাঢ় স্বরে বললো,

” আমার ঘুমের সুযোগে প্রতিদিন নিজের চক্ষু তৃষ্ণা নিবারণ করে নাও। কিন্তু আমার তৃষ্ণা যে মিটে না তুলা। সমাপ্তি ঘটে না হৃদয়ের গহীনে সৃষ্ট ঝড়ের আর না মিটে চক্ষুদ্বয়ের তোমাকে দেখার তৃষ্ণা। ”

মৌন মুখে ঠাঁই স্থির হয়ে রইল তুলি। আদ্রর উচ্চারিত প্রতিটি বাক্য সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে হৃদপিণ্ডে। অনুভূতিরা জানান দিচ্ছে,তড়তড় করে বেড়ে চলেছে আদ্রর জন্য ভালোবাসার অনল।

ভাবান্তর রমণীর দিকে গাল এগিয়ে দিল আদ্র হঠাৎ। এতে অবাকের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল তুলি। সামান্য সরে এলো পিছনে। বুক টা কাঁপছে। খুব করে ইচ্ছে হচ্ছে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাতের স্পর্শ এঁকে দিতে। তুলির হাত টা টেনে নিজের গালে ছোঁয়াল আদ্র। চোখ বুঁজে উৎকন্ঠা কন্ঠে অনুরোধ করে বললো,

” লুকোচুরি বিহীন একটা কিস কি পেতে পারি বউ?”

তুলি বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকালো আদ্রর দিকে। আদ্রর অনুরোধ যেন ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ল পুরো রুমে। চার দেয়ালের প্রত্যেক টা কোণায় যেন বারংবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আদ্রের অনুরোধ সূচক বাক্য টা। তুলির মন তৎক্ষনাৎ তাড়া দিয়ে বলে উঠল-” তোর ডাক্তার সাহেব অনুরোধ করেছে তুলি। ফিরিয়ে দিলে কষ্ট পাবেন,ফুলের মতো মূর্ছে যাবে মন। ”

হাত সরিয়ে চুমু খেল তুলি গালে। নিমিষেই তুলি কে নিজের আলিঙ্গনে বেঁধে নিল আদ্র প্রগাঢ়ভাবে। অতঃপর তুলির সুযোগ মিলল প্রিয় মানুষের বুকের হৃদস্পন্দন পরিমাপ করার।
_______

কিচেনে এসে নাস্তা বানানোর প্রস্তুতি নিল তুলি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ৭ টা বাজে। আদ্র হয়তো ফ্রেশ হয়ে এখনই নিচে এসে পড়বে। রাতে বলেছিল ১০ টার দিকে একটা ওটি আছে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাবে। না খেয়ে বের হয়ে যাবে এতে তুলির কষ্ট হবে। তাই নাস্তা বানাতে চলে আসল নিজেই। সায়েরা বেগম তাকে কোনো কাজ করতে দেয় না। নিজেই রান্নার কাজ টা করেন যত্ন করে। তুলির কোনো কাজই করতে হয় না এ বাড়িতে। আদ্রর কাপড় গুলো পর্যন্ত ধোঁয়ার সৌভাগ্য হয় নি এতো মাসে। নিজের সব কাজ নিজে করে ফেলে আদ্র। এহেন কান্ডে তুলির মাঝে মাঝে ভীষণ অভিমান হয়। বিয়ের পর রাঁধবে, বরের সেবা করবে এটাই তো নিয়ম। কিন্তু তুলির বেলায় একদম ব্যতিক্রম। এ বাড়িতে তার যা করতে হয় তা হলো দিন রাত স্টাডি। মাঝে মাঝে তুলির মনে হয় অতিরিক্ত পড়ার ফলে প্রাণ হারাবে সে। এই দুঃখে কত যে ফ্যাসফ্যাস করে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে তা অগণিত। তবুও আদ্র এক রত্তি দয়া করে নি পড়ার ক্ষেত্রে। সামনে বলার সাহস নেই বলে একলা রুমে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে পাষাণ, নিষ্ঠুর বলে সম্বোধন করেছে আদ্র কে। তুলির হুট করে মনে পড়ে গেল আজ ক্লাস টেস্টের রেজাল্ট দিবে। আদ্র ম্যাম কে ফোন করে সব খবরাখবর নেয় তুলি ও আমরিনের স্টাডি রিলেটেড। না জানি কি এসেছে রেজাল্ট। মনে পড়তেই ভয়ে কলিজা একটুখানি হয়ে গেল তুলির।

” একি তুই কিচেনে কি করছিস তুলি?”

” নাস্তা বানাচ্ছি খালা মণি। ”

রুটি বেলতে বেলতে নিষ্প্রভ স্বরে উত্তর দিল তুলি। সায়েরা বেগম এগিয়ে এসে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলতে লাগলেন,

” তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু আদ্র দেখলে তুমুল কান্ড বাঁধাবে। রেগে যাবে তোর সাথে। সরে আয়। আমি বানাব নাস্তা। পরে হাত পা পুড়লে আমার ছেলে টা কষ্ট পাবে তোর জন্য। ”

” তুমি হাত পা পুড়লে তোমার জন্যও তো কষ্ট পাবেন উনি। আমার জন্য যতটা টা না পাবে,তোমার জন্য এর চেয়েও দ্বিগুণ পাবেন। কারণ পৃথিবী তে উনাকে সবার আগে চেনা মানুষ টা তো তুমি। তুমি উনাকে নয় মাস গর্ভে রেখেছ তাই তো উনার সাথে তোমার সম্পর্ক প্রথম,পরিচয় প্রথম। অতএব,আমার চেয়ে তোমার জন্যই কষ্ট বেশি পাওয়া টা কি স্বাভাবিক নয়?এছাড়া আজ বললেও শুনছি না,নাস্তা আমিই বানাবো। তুমি শুধু দেখবে।”

সায়েরা বেগমের চোখের কার্ণিশে বেয়ে এক ফোঁটা জল গাল স্পর্শ করল। শাড়ির আঁচল দিয়ে জল বিন্দু মুছে তুলি কে জড়িয়ে নিল নিজের বুকে। আদুরে কন্ঠে বললেন,

” তুই কত বড় হয়ে গেছিস তুলি। এই তো সেদিনের কথা ছোট্ট তুই কাঁধে স্কুল ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে বাড়িতে এসেছিলি। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলি খালা মণি তোমাকে দেখলে আমার অনেক শান্তি লাগে। বিশ্বাস কর বারো বছর বয়সে যখন তুই আমায় এই কথা বলেছিলি সেদিন তোকে চিরদিনের জন্য আমার কাছে নিয়ে আসার ইচ্ছে জেগেছিল। কিন্তু বললেই কি অন্যের মেয়ে নিয়ে আসা যায়?তাই তো মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম ছেলের বউ করে এনে আমার বাড়িতে রাখবো তোকে। বড় হয়ে গেলি চোখের পলকেই। কত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলাও শিখে গেলি মা। ”

তুলি একটু হেসে বললো,

” বুড়িও তো হবো খালা মণি। এতো চোখের জল এখন ফেললে হবে?আমার বুড়ি রূপ দেখেও তো খুশিতে অনেক কাঁদতে হবে তোমার।”

তুলির মাথায় চুমু খেলেন সায়েরা বেগম। তুলি কিছু একটা ভাবলো। চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,

” তোমার ছেলে বুঝি তোমার পছন্দে বিয়ে করেছে আমাকে? ”

” আরে না। তুই তো আমার ছেলের ভালোবাসা। ভালোবেসে বিয়ে করেছে তোকে।”

তুলির হাসিটা তৃপ্তিদায়ক হাসিতে পরিণত হলো। টুকটাক কথা বলতে বলতে শাশুড়ী, বউ মিলে নাস্তা বানিয়ে ফেলল৷ দ্রুত।

টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছে তুলি। পাশে চেয়ার টানার শব্দে ফিরে তাকালো। একদম রেডি হয়ে নেমে এসেছে আদ্র। তুলি কয়েক পলক স্থির দৃষ্টিতে আদ্রর দিকে তাকিয়ে রইল। আজকাল চোখ দুটো ভীষণ বেহায়াপনা করছে। সারাক্ষণ আদ্র কে দেখার জন্য ছটফট করছে অন্তর। আদ্র তুলির দিকে না তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো,

” আমরিন,ঝুমু, মা কোথায়?”

বলতে বলতে ঝুমু, আমরিন চেয়ার টেনে বসল। তিন দিন অতিবাহিত হয়েছে ঝুমু এখানে বেড়াতে এসেছে। সায়েরা বেগম জুসের গ্লাস রেখে বসে পড়ল। কিন্তু তুলি রোবটের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। আঁড়চোখে আদ্র কে দেখে যাচ্ছে। এই দেখার শেষ যেন তুলি স্বয়ং চায় না। আস্তে চেয়ার টেনে আদ্র নিচু স্বরে বললো,

” বসো। তোমাকে ছাড়া তো খাবার নামবে না গলা দিয়ে। ”

তুলি চুপচাপ চেয়ারে বসলো আদ্রর দিকে দৃষ্টি রেখে। তুলির প্লেটে খাবার দিয়ে আদ্র নরম গলায় বলে উঠল,

” আমাকে পরে দেখো,আগে খেয়ে নাও। শক্তিশালী হতে হবে তো।”

একরাশ বিস্ময়তা নিয়ে তুলি চোখ সরিয়ে নিল। মুখে খাবার দিতেই চোখ পড়ল সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করা নিবিড় কে। তাৎক্ষণিক হাসি মুখে বলে উঠল,

” আসুন ভাইয়া।”

আমরিনের পাশের চেয়ার টেনে ধপ করে বসল নিবিড়। সবার অগোচরে আমরিনের হাত টা শক্ত করে চেপে ধরল। মুহুর্তেই গত কালের রাগ টা মাথা চারা দিয়ে উঠল আমরিনের। চোখ রাঙিয়ে তাকালো নিবিড়ের দিকে। বিনিময়ে বাঁকা হাসল নিবিড়। সায়েরা বেগমের দিকে চেয়ে বললো,

” আসসালামু আলাইকুম আম্মু। কেমন আছো?”

” আলহামদুলিল্লাহ। জানিয়ে আসবি না?তাহলে তো তোর পছন্দের নাস্তা বানিয়ে রাখতাম। পায়েস রাঁধতাম। ”

” তোমাদের দেখতে ইচ্ছে হলো,তাই সকাল সকাল চলে এলাম। ”

” তবুও। তুই তো এখন এই বাড়ির জামাই। তোর খাতির যত্নে কি ত্রুটি রাখা যায় বল?”

” আজ সারাদিন থাকব। কোথাও যাব না। তুমি বরং আজ সারাদিন আমাকে রেঁধে খাওয়াবা।”

নিবিড়ের কথায় বেশ খুশি হলেন সায়েরা বেগম। কিন্তু আমরিন মনে মনে রাগে ক্ষোভে জ্বলে উঠল। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল অনবরত। কিন্তু পারল না। আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে নিজের মুষ্টিমেয় নিয়ে নিল নিবিড়। কানের কাছে মুখে নিয়ে ফিচেল স্বরে বললো,

” যোগাযোগ বন্ধ করে দূরে রাখার চেষ্টা করছিলেন মিসেস আমরিন?কিন্তু ভুলে যাবেন না রাগ আমারও আছে এবং আজ তা ভালো ভাবে প্রদর্শন করবো আপনার নিকট।”

তুলি জানে না সব কেন কেবল তার চোখেই বিঁধে। ঠোঁটে হাসির রেখা দেখা দিল আমরিন, নিবিড়ের ভঙ্গিমা দেখে। মনে মনে দোয়া করল, সবাই সুখী হোক নিজের প্রিয় মানুষটা কে নিয়ে।
_________

আদ্রের সম্মুখে বসে আছে পায়েল। হাতে ঝলমল করছে বিয়ের রঙিন কার্ড টা। ক্লান্তিমাখা নিঃশ্বাস ছাড়ল আদ্র। মাত্র ওটি শেষ করে কেবিন ফিরেছে। এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে পায়েলের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

” বিয়ে টা তাহলে হচ্ছে পায়েল?”

পায়েল ঠোঁট মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলল। শান্ত স্বরে বললো,

” হবেই না কেন?বিয়ে তো একদিন না একদিন হবে। সেটা অভিক হলে মন্দ কি?বাবার যেহেতু অভিক কে পছন্দ অভিকের সাথেই হবে। তুই তো জানিস বাবা-ই আমার সবকিছু। মা কে হারিয়েছি সেই ছোট বেলায়। মা দেখতে কেমন সেটা তো আমার মনেই ছিল না আদ্র। থাকবে কি করে উনি তো দুই বছরের মাথায় আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন চিরকালের জন্য। ছবি দেখে দেখে মনের পাতায় মায়ের মুখ টা সজীব রেখেছি। বাবা আমার জন্য নিজের পুরো জীবন একাকীত্বে কাটিয়েছে। বাবা কে কষ্ট দিলে যে অপরাধ হবে,বেইমানি হবে। ”

” আমি কথা বলবো আংকেলের সাথে। ”

পায়েল আঁতকে উঠল। ব্যগ্র কন্ঠে বললো,

” না আদ্র। বাবা কষ্ট পাবে। অভিক কে চোখে হারায় বাবা। আমি কিভাবে কষ্ট দিব উনাকে?সম্ভব না রে।”

কয়েক মিনিটের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এল রুমে। সেই নিস্তব্ধতা কাটিয়ে কার্ড টা এগিয়ে দিল পায়েল। একটু হাসার ভান করে বললো,

” বাসায় গেলাম না। অবশ্যই পুরো পরিবারকে বলবি বিয়ে তে আসতে। তুলি কে নিয়ে হলুদের আগেই উপস্থিত হবি তোরা। তোদের ছাড়া আমার বিয়ের খুশি টা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এখন আসি। ৩টার দিকে ওটি আছে আমার।”

পায়েল উঠে দাঁড়াল। আদ্র বিয়ের কার্ড টা হাতে নিয়ে বলে উঠল,

” অন্তু কে জানিয়েছিস? ”

মাথা নেড়ে না বুঝাল পায়েল।

” বিয়ের কার্ড টা আন্টির হাতে দিস। অন্তু কে এখন জানাস না। ”

যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আদ্র পুনরায় ডাকল। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বিষাদ মাখা স্বরে জিজ্ঞেস করল,

” ভালোবাসা আছে তোর মনে অভিকের জন্য? ”

ধারালো বর্শার ফলার মতো সূচালো কিছু একটা গেঁথে মুহুর্তে পায়েলের হৃদয় রক্তাক্ত করে দিয়ে গেল। চোখ ভর্তি হল জলে। গড়িয়ে পড়ার আগেই পায়েল হাসি মুখে বললো,

” ভালোবাসা আছে। বছরের পর বছর ধরে মনের সুপ্ত কোণে একটু একটু করে তৈরি হয়েছে ভালোবাসার পাহাড়। তবে সেটা অভিকের জন্য নয়। অভিকের ভাগ্য নেই এই ভালোবাসা পাওয়ার। আর আমার সাধ্য নেই সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষ টা কে সবটুকু ভালোবাসা বিলিয়ে দেবার।”

এক মুহুর্তও দাঁড়াল না পায়েল। চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল কেবিন হতে। সেদিকে চেয়ে থেকে আদ্র চোখ বুঁজে নিল। গা এলিয়ে দিল চেয়ারে।

# চলবে,,,

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_৩৫

আমরিন ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে ভিতরে ঘাপটি মেরে বসে আছে এক ঘন্টা যাবত। খোলার নামই নিচ্ছে না। ডেকে ডেকে গলা শুকিয়ে এসেছে নিবিড়ের। রাগে কপালের রগ গুলো ভেসে উঠেছে। আমরিন কে কষে থাপ্পড় লাগিয়ে ক্ষান্ত হবে আজ। দরজায় বাড়ি মেরে রাগী কন্ঠে বলে উঠল,

” আমি চলে যাচ্ছি। এবার বের হয়ে শান্তির নিঃশ্বাস নে। বাথরুমে থাকলে তো দম বন্ধ হয়ে মারা যাবি।”

আমরিন নাক ফুলিয়ে বিড়বিড় করল,

” আমাদের বাথরুম দেখেছেন আপনি?একবার দেখলে বলবেন বাহিরে নিঃশ্বাসের চেয়ে এখানে শান্তি বেশি।”

দরজায় কান পেতে অনুমান করার চেষ্টা করল আমরিন সত্যিই নিবিড় গেল কিনা রুম থেকে। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। নতজানু হয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে যেই না সামনে তাকালো চক্ষু যুগল চড়কগাছ। ভয়ে ঠেসে দাঁড়াল দেয়ালের সাথে। সাধ্য হলে দেয়াল ভেদ করে পেরিয়ে যেত আমরিন। চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে নিবিড়। চোখে রাগের ছাপ স্পষ্ট। শুকনো ঢোক গিলে আমরিন ফের ওয়াশরুমে ঢোকার জন্য অগ্রবর্তী হলো। তবে ব্যর্থ হল তার ইচ্ছা। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিল নিবিড়। পা ছুড়তেই চোখ রাঙিয়ে বললো,

” আছাড় দিয়ে গুঁড়া করে বোতলে ভরে রাখব,যদি আর একটুও নড়েছিস তবে।”

ভয়ে চুপসে গেল আমরিন। বোকা বনে গেল একদম। কই গেল তার এতো সময় অব্দি পোষে রাখা রাগ!এ কেমন রাগ ভয়ের চোটে পালালো। আমরিন কে বিছানায় ফেলে শক্ত করে চেপে ধরল নিবিড়। টকটকে লাল চোখ জোড়া নিক্ষেপ করে বললো,

” সমস্যা কি তোমার?এতো বড় সাহস আমাকে ব্লক করো সবকিছু থেকে। আবার ওয়ার্নিং দাও আমার শশুড় বাড়িতে আমি পা রাখলে পা কেটে দিবা। তোমার সামনেই হাজির আছি কাটো পা। কষ্ট করে পা টা বাড়িয়ে দিব?”

আমরিন মুখ ফিরিয়ে বললো,

” আপনার এসিস্ট্যান্ট রিয়ার কাছে যান। আমার কাছে কি আপনার?গতকাল দুপুরেও তো ওই মেয়ের সাথে মধুর আলাপ করছিলেন। আমার কাছে এসেছেন কেন এখন?আমি মধুর আলাপ করতে জানিনা। আর হ্যাঁ। সরি। সরি আপনাদের আলাপে বাঁধা হয়ে কেবিনে ঢুকে পড়েছিলাম।”

নিবিড় আহত চোখ চাইল আমরিনের দিক। আমরিনের কথা গুলো মনে কষ্টের দাগ কেটে গেল নিমেষ। দুই হাতে আমরিনের মুখ টা কাছে টেনে নিল।

” এই আমার দিকে তাকাও তুমি।”

” দেখতে চাই না আমি আপনাকে।”

আমরিনের কাঠ কাঠ গলা নিবিড়ের বুকে ভারী পাথর চেপে ধরল যেন। উত্তেজিত সুরে বললো,

” তোমার টাইমিং টা ভুল ছিল আমরিন। আই মিন তুমি যখন রুমে আসলে তখন রিয়া পেশেন্ট দের ফাইলগুলো চেইক করানোর জন্য এসেছিল। আই নো তুমি খুব জেলাস। তাই বলে এতোটাই যে আমাকেই দূর করে দিবে!”

পলকেই ক্ষিপ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আমরিন। কন্ঠে এক রাশ তেজ ঢেলে বলে উঠল,

” আমি জেলাস?ওকে আমি জেলাস। হবই জেলাস। কেন হব না?আমি বাঙালি মেয়ে। সুতরাং আমার হাসবেন্ডের আশেপাশে মেয়ে মানেই প্রকৃতিতে সন্দেহ সন্দেহ ভাব। অভিমানের কারণ নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে। তবুও বলছি, কোনো ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরিধান করা মেয়ে আপনি এসিস্ট্যান্ট হিসেবে রাখতে পারবেন না। না মানে না।”

বড় রকমের একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল নিবিড়ের শ্বাসনালী বেয়ে। আমরিন কে জড়িয়ে ধরে গলায় মুখ গুঁজে ছোট্ট ছোট্ট চুমু খেল। অকস্মাৎ এমন স্পর্শে ধুক করে কেঁপে উঠল আমরিনের হৃদপিণ্ড। বিয়ে হয়েছে দু’মাস। কখনও এতোটা কাছে আসা হয় নি দু’জনের। অনুভব করা হয় নি মাতাল করা এই স্পর্শটুকু। এই তো সেদিনের কথা মা কে নিয়ে হুট করেই হাজির হয়েছিল নিবিড়। বিয়ের প্রস্তাব রাখতেই কেউ নাকচ করে নি। করবেই বা কোন মুখে, ফিরিয়ে দেবার মতো কোনো খারাপ বৈশিষ্ট্য যে নিবিড়ের মাঝে বিদ্যমান নেই। তাছাড়া এতে আদ্রর মতামত ছিল একশ পারসেন্ট। রাদিফ সাহেবও ছেলের মতামতে, যুক্তিতে অমত করেন নি। আমরিন চমকিত নয়ন নিয়ে স্তব্ধ হয়ে ছিল কয়েক সেকেন্ড। ধরা গলায় শুধু এটুকু বলেছিল,

” বিয়েতে অমত নেই আমার। তবে আমি এখন প্রস্তুত না ভাইয়া। প্রস্তুত নই এই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার জন্য। ”

ক্রমে ক্রমে হেসে উঠেছিল সবাই। আমরিনের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে প্রকাশ করেছিল নিজেদের মনের কথা। সেদিন শুধু কাবিন হওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল দুই পরিবার। আমরিনের ইচ্ছে, চাওয়া বিবেচনা, প্রাধান্য দিয়ে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে ঘরোয়া ভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছে নিবিড় -আমরিন কে এক পবিত্র বন্ধনে। নতুনভাবে, অভিনবত্ব নিয়ে ভালোবাসার সম্পর্ক পরিণতি লাভ করেছে স্বামী -স্ত্রীর সম্পর্কে। হঠাৎ বিয়ে,হঠাৎ নতুনত্ব। সেই দিনটায় ছিল প্রকৃতির রোমাঞ্চকর বর্ষণমুখর দিন।

কপালে উষ্ণ পরশে স্মৃতি চারণের সমাপ্তি ঘটিয়ে চোখ নির্মলিত করে নিল আমরিন। সহসা ধড়াস করছে বক্ষস্থল। চোখ বন্ধ রেখেই আঁকড়ে হাতের মুঠোয় পুরে নিল নিবিড়ের শার্টের কিছু অংশ। যতটুকু নেওয়া যায় ততটুকুই মাত্র। প্রেমে আবদ্ধ থেকেও তো এমন অনুভূতি আসে নি৷ তবে কি স্বামীর প্রতি অধিকারবোধ থেকেই এমন নির্লজ্জ, বেহায়া ইচ্ছে মনে জেগেছে!আমরিনের গলা শুকিয়ে এলো। তৃষ্ণায় খা খা করছে কন্ঠনালি। নিবিড়ের প্রশস্ত বুকে নিবিড়ভাবে লেপ্টে থাকার তীব্র আশা জাগ্রত হলো মনের মাঝে। বয়সের তুলনায় খুবই বিচক্ষণ আমরিন। স্পষ্ট জানা আছে তার আশাবাদী হওয়া ভালো। তবে খুব বেশী আশাবাদী হওয়া নিজের জন্য ঢের অন্যায়। তাই অপেক্ষা অথবা আশাবাদীর লিস্টে থাকতে রাজি নয় সে। তৎক্ষনাৎ মনের বাসনা কে মুখে আনল,ব্যক্ত করল নিবিড়ের কাছে।

” আমাকে একটু আপনার বুকে জায়গা দিবেন নিবিড়?”

বলতে কিছু সেকেন্ড ব্যয় হলেও বুকে নিতে ব্যয় করে নি নিবিড়। মাথা বুকে চেপে ধরে ঠোঁট বুলালো আমরিনের চুলের ভাঁজে। আবেগী স্বরে বলে উঠল,

” এই বুকে তোমার স্থান পার্মানেন্ট এবং চিরকাল।”

কথাটা শুনে আনন্দে অশ্রু ভরে এল আমরিনের দু চোখে। গাল দুটো তে লাল রঙের প্রলেপ পড়েছে। মনে মনে বললো,তুলি তোর সঙ্গদোষ পেয়েছে আমায়,নয়তো লজ্জা আমাকে স্পর্শ করার সুযোগ পেত নাকি!” আচমকা কিছু একটা মনে পড়তেই উৎকন্ঠা হয়ে বললো,

” আপনি কবে যাবেন অস্ট্রেলিয়া? ”

” ক্যান্সেল করে দিয়েছি। সম্ভব না আমার পক্ষে কোথাও যাওয়া।”

নিমিষে তীক্ষ্ণ চাহনি ছুঁড়ে দিল আমরিন নিবিড় কে লক্ষ্য করে। কড়া সুরে বললো,

” আপনি তো সেমিনারের জন্য অস্ট্রেলিয়া যাবেন বলেই এতো তাড়াহুড়া করে বিয়ে হলো। এখন যাবেন না কেন?”

” অনেক ভেবেছি। ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যাব না। কারণ আমরিন বিহীন প্রতিটা মুহুর্ত মরুভূমির উত্তাপের মতো। এতো তেষ্টা সহ্য করার শক্তি যে আমার নেই মিসেস আমরিন।”

কপট রাগ প্রদর্শন করলেও মনে মনে প্রচন্ড খুশি হলো আমরিন। কারণ একটাই আজকাল বছর খানেক আগের চেয়েও বেশি ভালোবাসা অনুভব হয় নিবিড়ের জন্য।
_______

গোধূলি বেলার সৌন্দর্য উপভোগ করতে কাঁচের দরজা ঠেলে বেলকনিতে এসে দাঁড়াল তুলি। মৃদুমন্দা বাতাস বইছে চারদিকে।
আদ্রর রুমের বারান্দা বিয়ের আগেই তুলির ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। মনে জেগেছিল প্রতিদিন এখান থেকে গোধূলি লগ্নতে মন মাতানোর। তখনও তুলি জানত না তার ইচ্ছে টা এতো অবলীলায় পূর্ণতা পাবে। ক্ষীণ শব্দে কর্ণ খাড়া করে বেলকনির একসাইডে ঠেসে দাঁড়াল তুলি। নিজেকে লুকিয়ে ফেলল এক কোণায়। রক্ত হিম হয়ে গেল তুলির রুমে উঁকি দিতেই। হাতে খাতা নিয়ে আদ্র বসে আছে বিছানায়। চোখে মুখে ক্রোধের চিহ্ন লেগে আছে। কাউকে সামনে পেলে অনাসয়ে পিষে ফেলবে রাগ দ্বারা প্রহার করে। ভয়ে কুঁকড়ে গেল তুলি। মিন মিন করে বললো,

“দরকার হলে আজ সারারাত বেলকনিতে লুকিয়ে থাকব। তবুও যাবো না রুমে। মেরে ফেলবেই আমাকে উনি।”

আরেকটু উঁকি দিতেই কর্ণপাতে ভেসে এলো,

” গর্দভ একটা। অলওয়েজ আমার কথার খেলাপি। আজ ছাদ থেকে ফেলেই দম নিব। বেলকনিতে লুকিয়ে না থেকে বেরিয়ে আসো জলদি।”

মাত্রই তো এলেন। উনি কিভাবে জানলেন আমি বেলকনিতে? আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে নি তো?এরূপ আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে তুলি না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইল এক কোণ ঘেষে। কয়েক মিনিট পার হওয়ার পর আদ্রর উপস্থিতি বারান্দায় না পেয়ে উল্টো ঘরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। এমন সময় দমকা হাওয়া হু হু করে তুলির সারা অঙ্গে হিম ধরিয়ে গেল। সূক্ষ্ম কম্পন ধরলো তুলির মনে। মাথার ঘোমটা সরে গিয়ে চুল গুলো অবাধে উড়তে শুরু করল। তুলি আকাশ পানে চাইতেই প্রচন্ড অবাক হলো। এখনই তো কি সুন্দর কমলা,লালচে রঙ ধারণ করেছিল আকাশ টা। হুট করেই নিকষ কালো আঁধারে আবৃত হয়ে গেল। শরীর কাটা দিয়ে উঠল তুলির। বাতাস বইছে এলোমেলো। এক্ষুনি বোধহয় ঝড় উঠবে। বৃষ্টি রূপে পতিত হবে ধরিত্রীতে। ধুয়ে নিবে সকল আবর্জনা, আবার কারও কারও মনের বিতৃষ্ণা। হয়ত বা ঘটতে পারে উল্টো। ঝড়ের সাথে সাথে ছিন্ন, দ্বিখণ্ডিত হতে পারে কারো হৃদয়, অন্তর।

আনমনে আর কিছু ভাবার আগেই বারান্দার দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। মুহুর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল তুলির বুকের ধুকধুকুনি। শরীর টা থরথর করে কাঁপতে লাগল মুষলধারে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়া বর্ষণ ছোঁয়ায়। আদ্র সামনে দাড়িয়ে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে রেখেছে। মুখভঙ্গি নিরলস যা তুলির ভয় বাড়িয়ে দিল। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো আদ্রের কাছে।

” বিশ্বাস করুন ডাক্তার সাহেব আমি ইচ্ছে করে ফেইল করি নি। কিভাবে ফেইল হয়ে গেছি নিজেও জানিনা। আমি পড়েছি তো। আপনি যখন রাতে ঘুমোতেন, আড়ালে আমি অনেক পড়তাম। বায়োলজি, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি সব দশ দশবার পড়েছি, মানে শেষ করেছি বইগুলো। আমাকে ছাদ থেকে ফেলবেন না প্লিজ। ”

অশ্রুসিক্ত কন্ঠে তুলির এক নাগাড়ে বলা কথা গুলো শুনেও আদ্রর ভঙ্গিমায় কোনো রূপ পরিবর্তন এলো না। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তুলির হাত টা টেনে খাতা গুলো ধরিয়ে দিল। ভ্রঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

” তুমি ফেইল করেছো?”

চমকালো তুলি। কাঁপা কাঁপা পাল্টা প্রশ্ন করল,

” করি নি?”

” নিজেই দেখে নাও।”

খাতা মেলতেই বড় বড় হয়ে গেল নেত্র যুগল। বায়োলজি তে পয়তাল্লিশ পেয়েছে যা তুলি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করে নি। আগে তো তিন তিন বার ফেইল করেছিল। বিয়ের পর আদ্রর ভয়ে দিন রাত কেঁদে কেঁদে পড়তে পড়তে নাস্তানাবুদ অবস্থা হয়েছিল মেয়েটার। খুশি তে এক লাফ দিয়ে হামলে পড়ল আদ্রর বুকে। তুলি কে জড়িয়ে ধরে আদ্র মুচকি হাসল। কিছু বলবে তার পূর্বেই মোবাইলের শব্দ বৃষ্টির ঝমঝম শব্দকে হার মানিয়ে কানে আসল আদ্র তুলি উভয়ের। পকেট থেকে ফোন টা বের করে রিসিভ করলো আদ্র। চোখের পলকেই মুখ টা আঁধারে ছেয়ে গেল। কথা জড়িয়ে এল গলায়। কোনো রকমে প্রতুত্তরে জানালো,

” আমি আসছি।”

কলটা কেটে তুলি কে সরিয়ে দিল আদ্র। অজানা আশঙ্কায় প্রখর আর্তনাদ করে উঠল তুলির ভিতরটা। মনোক্ষুন্ন হলো কিঞ্চিৎ। হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে যাওয়া আদ্রর পিছনে পাগলের মতো ছুটে এলো। চিৎকার করে ডাকল আদ্র কে। জবাব না পেয়ে দৌড়ে এসে আদ্রর পাশে বসে পড়ল গাড়ি তে। ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,

” কি হয়েছে আদ্র?”

ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে দু’জন। আদ্রর চুল থেকে টপাটপ পানি ঝরে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটার ন্যায়। কিছু সেকেন্ডের ব্যবধানেই সারা মুখে নেমে এসেছে বিষাদের ছায়া। তুলি ফের উৎকন্ঠিত হতেই আদ্রর মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এল,

“অন্তু!”

#চলবে,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)