আকাশে তারার মেলা ২ পর্ব-৩৬+৩৭

0
646

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব__৩৬

ঝড় বিদায় নিয়েছে। শুকিয়ে গেছে তুলির চোখের নোনাজল। বুকে কেবল বিরাজমান তীব্র আর্তনাদ। এই আর্তনাদ তুলির নিজের জন্য নয়। এই বুক ফাটা আর্তনাদ মাঠে বসে আর্তচিৎকার করা অন্তুর জন্য। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে হারানোর বেদনায়। প্রকৃতির নিরবতা ভেঙে বিলিয়ে দিচ্ছে চাপা কষ্ট গুলো কে। অহরহ অল্প তে চোখের জল ঝরানো তুলির ডাগর আঁখিতে এক ফোঁটাও অশ্রু নেই। চোখ দুটো শান্তভাবে অপলক দেখে যাচ্ছে অন্তু কে। ছেলে টা দুই পা ভেঙে আনত মস্তকে বসে আছে। চোখ থেকে টুপ টুপ করে গড়ানো অশ্রু ধরা দিচ্ছে তুলির দু’নয়নে। লাল তরল চোখে বিঁধতেই পাশে উপস্থিত আদ্রর হাত টা খামচে ধরল তুলি। আঁতকে উঠা গলায় বললো,

” র,,রক্ত ঝরছে আদ্র। অন্তু ভাইয়ার চোখের পাশ থেকে রক্ত ঝরছে। কপাল থেকেও,,”

তুলি কে আর বলতে দিল না আদ্র। টেনে বুকে চেপে ধরল শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে। তুলির ব্যথা হচ্ছে তবে দেহে আদ্রের চাপে নয়,অন্তুর ঝরে পড়া রক্ত দেখে। এত বিরহ প্রণয়ে!পায়েল কি এক ফোঁটাও ভালোবাসে নি অন্তু কে? ভেসেছে তো। তুলি স্পষ্ট ভালোবাসা দেখেছে পায়েলের অক্ষিপটে। মুখ যদি মনের দর্পণস্বরূপ হতো তবে মুখে কিছু প্রকাশ করার প্রয়োজন পড়ত না,আর না মনে চাপা পড়ে থাকত হাজারো অব্যক্ত অনুভূতি। আদ্রর বুকে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে উঠল তুলি। এতো সময় অব্দি এক বিন্দুও জল গড়ায় চক্ষু কোটর হতে। পাথরের ন্যায় নির্জীব রূপ ধারণ করে রেখেছিল। আদ্রর বুকে যেতেই সমস্ত কষ্ট উগড়ে উঠলো। মনটা নেতিয়ে পড়ল প্রকটভাবে। ফুঁপানো, অস্পষ্ট স্বরে বললো,

” ডাক্তার সাহেব, কিছু করুন প্লিজ। কিছু করুন। আমি পারব না এই কষ্ট সহ্য করতে। অন্তু ভাইয়া মরে যাবে তো। দেখতে পাচ্ছেন না আপনি কতটা কষ্ট হচ্ছে উনার। কেমন করে কাঁদছে, আপনার বন্ধুর জন্য, আপনার বুকটা কাঁপছে না? ব্যথা করছে না,,”

চোখের পাতায় ভেজা অনুভব করতেই তুলি তড়িৎ গতিতে মুখ তুলে চাইল আদ্রর পানে। সঙ্গে সঙ্গেই আকাশ চিরে ঝলক দেওয়া বিদ্যুতের আগুনের ন্যায় তুলির বুক চিরে বিষাক্ত যন্ত্রণা সর্বাঙ্গ দেহে বিস্তার লাভ করল। তার ডাক্তার সাহেবের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েছে এই জল টুকু। আদ্র কন্ঠ নরম রেখে বললো,

” গাড়িতে গিয়ে বসো। আমি অন্তু কে নিয়ে আসছি।”

মলিন,বিবর্ণ মুখে সম্মতি জানিয়ে তুলি মন্থরগতিতে হেঁটে এসে গাড়িতে বসল। চারদিকে অন্ধকারে থৈ থৈ করছে। বৃষ্টি না থাকলেও কালো মেঘের ছায়ায় ঢেকে পড়েছে নীল বর্ণী গগণ। গাড়ির হেডলাইটের আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেকখানি জায়গাজুড়ে। সেই আলোতে তুলি নিমেষ চেয়ে আছে আদ্রর যাওয়ার পথে। মৃদু বাতাসে শিরশির করে উঠল তুলির দেহ। বৃষ্টি একা যায় নি বরং সাময়িক সময়ের জন্য হলেও সঙ্গী করে নিয়ে গেছে আগুন ঝরানো উত্তাপ কে। ধরণীতে ঢেলে দিয়েছে শীতলতা। একটু জড়োসড়ো হয়ে বসল তুলি। ব্যথিত নয়ন জোড়া স্থবির করল পাশাপাশি বসে নিরবতায় মুহূর্ত কাটানো দুই বন্ধুর দিক।

‘দৈবক্রমে যদি বেড়ে যায় অন্তরস্থ পীড়ন,তবে তা সহ্য করতে নেই। সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে নিজের প্রাণ ত্যাগ করা বোকামি, নিহাতই বোকামি। ‘

অন্তু এক পলক তাকালো আদ্রের মুখের দিকে। আনতস্বরে বললো,

” একটু পানি খাওয়াবি আদ্র?”

জবাবে হ্যাঁ বা না কোনো রূপ প্রতুত্তর করল না আদ্র। উঠে গেল পাশ থেকে। বড় বড় পা ফেলে তুলির কাছে এসে ঝুঁকল। অত্যন্ত শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,

” ঠান্ডা লাগছে তুলা?”

” হুম।”

” গাড়িতে পানির বোতল আছে। দাও তো।”

নিঃশব্দে পানির বোতল টা আদ্রর হাতে তুলে দিল তুলি। মুহুর্তেই সূক্ষ্ম কম্পন অনুভত হলো হৃদপিণ্ডে। হাত টা মুঠোয় আঁকড়ে শুষ্ক অধর যুগল পুনরায় বুলালো আদ্র। গালে ঠান্ডার হাতের ছোঁয়া দিয়ে স্মিত হেসে বলে উঠল,

” সব ঠিক করে দিব ইনশাআল্লাহ। গাড়ির জানালা লাগাও। জ্বর বাঁধালে কষ্ট পাব তো। এতগুলো কষ্ট আদৌ কি মানতে পারবে মন!তুৃমি আমার অস্তিত্ব। অন্তু,রিমি,সাগর,পায়েল,নিবিড় আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।”

অপলক চেয়ে রইল তুলি। চেয়ে রইল নির্নিমেষ দৃষ্টি ফেলে। প্রশান্তিরা জড়ো হয়ে বাসা বেঁধেছে মনের সবটুকু অংশ জুড়ে। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবগত নয় সে, তবে তার ডাক্তার সাহেবের কথায় তার অগাধ বিশ্বাস।

ঢকঢক করে বোতলের প্রায় অর্ধেক পানি পান করে ফেলল অন্তু। চোখে মুখে পানি ছিটানো মাত্রই প্রকট জ্বলনে দাঁতে দাঁত চেপে ধরল। সহ্য করে নিল কিছুটা সময় নিয়ে। পকেট থেকে রুমাল টা এগিয়ে দিল আদ্র। অন্তু হাতে নিয়ে ধরা গলায় বললো,

” পায়েলের বিয়ের কথা শুনে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি নি। বিয়ে তো আগেই ঠিক করা তবু আজও সেটা মেনে নেওয়া হয়ে উঠে নি আমার। শুধু এটুকু মনে হয়েছে পায়েলের চলে যাওয়াতে আমার জীবনের হাসি টা হারিয়ে যাবে। ঝড়ের তান্ডবের চেয়েও আমার ভিতরের তোলপাড় অত্যাধিক ছিল। চোখ ঘোলা হয়ে আসছিল বার বার। তারপর ছোটখাটো এক্সিডেন্ট। সামনের গাড়ির ড্রাইভার টা ভালো ছিল,হয়তো মায়া হচ্ছিল তাই কল লিস্টে তোর নাম্বার পেয়ে তোকে জানাল। তবে আমি খুশি হতাম আমার অবস্থা যদি খুবই বিধস্ত হতো,শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেত। ইচ্ছাকৃত তো মৃত্যুবরণ করতাম না। অনিচ্ছাকৃতই যদি হয়ে যেত,মুক্তি মিলতো আমার। মুক্তি মিলত হৃদয়ে দানা বেঁধে রাখা যন্ত্রণার।”

” হার মেনে নিলি?তুই আসলেই একটা ফালতু লোক অন্তু।”

তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে বললো আদ্র। বিনিময়ে অন্তু আদ্রর কাঁধে হাত রেখে স্মিত হাসল। অবিশ্রান্ত নিঃশ্বাস কে মুক্তি দিয়ে বললো,

” আই নো ভাই। শুধু মাত্র তোদের জন্য, পায়েলের জন্য অন্তু চিরকালই ফালতু উপাধিতে ভূষিত হতে রাজি। আমার হার মানার মাঝে অসম্ভব শান্তি লুকিয়ে আছে,কারণ আমার পায়েল বাবার রাজকন্যা হিসেবে জিতে গিয়েছে। আমি জানি পায়েল আমাকে ভালোবাসে। আমি ততটাও বোকা নয় যে কারো নেত্রে ভাসমান ভালোবাসা আমার চোখে পড়বে না। আমি এটাও জানি পায়েল মেডিক্যাল এর প্রথম থেকেই আমার মনে ওর জন্য সদ্য জন্ম নেওয়া অনুভূতিটা আঁচ করতে পেরেছিল। কিছু ক্ষেত্রে বাস্তবতা এমন হয় দু’টো মানুষের অপ্রকাশিত ভালোবাসা জীবনের সমীকরণে চিরকাল অপ্রকাশিত রয়ে যায়। অভিক পায়েলের জীবনে আগে এসেছে আমি নয়। পায়েল তো ভুলবশত মন দিয়ে ফেলেছে আমায়। আজ যদি আমরা দু’জন একসাথে হয় তবে অন্যায় হবে অভিকের সাথে। বিশ্বাসঘাতক হয়ে যাবে পায়েল তার বাবার কাছে। অভিকের বাবার সাথে ওনার বন্ধুত্বে ফাটল ধরবে। এসব উনি মানতে পারবেন না। তাই নিতে পারলাম না রিস্ক। কিছু সম্পর্ক ঠিক রাখতে বিসর্জন হোক মনের হাজারো অব্যক্ত অনুভূতি। আমি জানি পায়েল একদিন অনেক সুখী হবে,অনেক। আমিও হব। পায়েলের সুখীতে সুখী।”

শেষ কথা টা বলতে গিয়ে অন্তুর কন্ঠ জড়িয়ে এলো। তাৎক্ষণিক উঠে দাঁড়াল। আদ্র বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অন্তুর দিকে। অন্তুর এই রূপ তো কেউ দেখে নি। কারোই চোখে পড়ে নি এতো বছরের বন্ধুত্বে। সেখানে আর না দাঁড়িয়ে অন্তুর সাথে হেঁটে আসল গাড়ি পর্যন্ত। ড্রাইভিং সিটে বসতেই অন্তু পিছনে উঠে বসল। দাঁত কেলিয়ে বললো,

” আমার গাড়ি তো অক্কা পাওয়ার পথে। তোদের সাথেই যায়।”

হতভম্ব চোখে তাকাল তুলি। তার বিশ্বাস হচ্ছে না এটা কি সেই ছেলে যে কিনা না পাওয়া ভালোবাসা হারানোর বেদনায় চিল্লিয়ে কাঁদছিল!এক আকাশ অবাকতা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল তুলি কে। আদ্র গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে ফাস্ট এইড বক্স টা বাড়িয়ে দিল অন্তর দিকে। একটা ফাস্ট এইড বক্স গাড়িতে থাকে সবসময়। প্রয়োজন হতে পারে ভেবে রেখে দেয় আদ্র। সাথে সাথেই এক প্রকার ছিনিয়ে নিল অন্তু বক্সটা। ভাব এমন যেন ব্যাথা সহ্য হচ্ছে না তার। কিন্তু কিছু সময় আগে এই ছেলেটাই বৃষ্টি তে ভিজে দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সহ্য করেছে। তুলির হতবিহ্বল দৃষ্টি দেখে আলতো হাসল অন্তু। হেসে উঠে বললো,

” আমাকে কি খুব খারাপ দেখাচ্ছে তুলি?গেল আমার এতো সুন্দর চেহারা টা। শীগ্রই ঠিক করতে হবে নয়তো পায়েলের বিয়েতে সুন্দর সুন্দর রমনী পটানো হবে না আমার। জীবন টাই আমার বৃথা।”

তুলির কি হলো সে নিজেও জানেনা। অন্তুর দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে বললো,

” আপনি খুব স্ট্রং ভাইয়া।”

” তবুও তোমার জামাইয়ের চোখে আমি ইডিয়ট, ফালতু।”

অন্তুর হাসিমুখের কথা শুনে তুলির ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল। পুরোপুরি পিছনের দিকে ঘুরে ব্যান্ডেজ লাগাতে খানিকটা সাহায্য করল অন্তু কে।
__________

হলুদে কালো শাড়ি কে পড়ে!তুলির মুখে লেপ্টে আছে দুঃখ দুঃখ ভাব। এক তো পায়েলের বিয়ে নিয়ে মনে সৃষ্ট হয়েছে দুঃখের সাগর তার উপর কালো শাড়ি পড়ার আবদার করে আদ্র দুঃখের সাগরে দুই ফোঁটা দুঃখ ঢেলে দিল। এমনিতেই গায়ের রং শ্যামলা। কালো শাড়ি পড়লে মনে হবে গায়ে হলুদে ভূতের আগমন ঘটেছে এটাই তুলির বর্তমান ধারণা।

#চলবে,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।)

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব__৩৭

আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে বিস্ময়ে হতবাক তুলি। এতক্ষণের মন খারাপের রেশ হুট করেই উবে গেল। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের উপর হাত রেখে মিনমিন করে বললো,

” কালো জামদানি তে শ্যামলা মেয়েদের এতো অমায়িক লাগে!এতো কাল কেন চোখে পড়ে নি আমার?আমি তো কখনও কালো শাড়ি পড়ি নি। তবে কি আমার ডাক্তার সাহেবের কল্পনায় এতোটা সুন্দর আমি?”

আনন্দপূর্ণ হাসি ফুটে উঠল তুলির চোখে মুখে। চুল গুলো খোঁপা করে বকুল ফুলের মালা টা পেঁচিয়ে নিল। দু’হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি তুলির হাত নাড়বার তালে তালে রিনঝিন আওয়াজ তুলছে পুরো উদ্যমে। আমরিন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। একটু থেমে হেসে বললো,

” ঠিকি তো পড়লি। শুধু শুধু আমার ভাই কে এতো সময় যাবত গালাগাল করলি। এখুনি নিচে যাবো এখুনি গিয়ে ভাই কে বলব।”

আমরিনের কথায় আঁতকে উঠল তুলি। তড়িঘড়ি করে বললো,

” আমি কিন্তু তোর বেস্ট ফ্রেন্ড, ভাবী,খালাতো বোন। পারবি এই তিন তিনটে সম্পর্কের সাথে বেইমানি করতে?এতো বেইমান তুই আমরিন!ভাবতেই ভীষণ কান্না পাচ্ছে আমার। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।”

” হয়েছে আমাকে দমানোর জন্য আর নাটকের প্রয়োজনীয়তা নেই ভাবী সাহেবা। চলুন এবার। পায়েল আপু কে নিচে নিয়ে যেতে হবে।”

তুলি ও আমরিন দু’জনে একসাথে রুমে প্রবেশ করে স্তব্ধ। পায়েলের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টি তাক রেখেই পার হল কয়েক মুহুর্ত। শুভ্রতার রঙে মুড়ানো পায়েল কে দেখে চোখ ধাঁধিয়ে আসছে সকলের। মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। তবুও চেহারায় মায়ার ছড়াছড়ি। হাসি টা থাকলে বোধহয় চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়ত সকলের পক্ষে। সাদা একটা সিল্কের শাড়ি পড়েছে পায়েল। পুরো মেকআপ সাউথ ইন্ডিয়ান নায়িকাদের বিয়ের সাজের মতো। তুলি ভেবেই কুল পাচ্ছে না গায়ে হলুদে কেউ অমন করে সাজে!কি অপরূপ সৌন্দর্য্য ফুটে আছে পায়েলের মধ্যে, তা বলেও প্রকাশ করা কঠিন তুলির জন্য। সন্ধ্যা থেকে একটা শব্দও উচ্চারণ করে নি পায়েল। পাথরের মতো স্থির বসে আছে। রিমি,তুলির নিকট পায়েলের এই মৌনতা পালনের কারণ অজানা নয়। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছেড়ে তুলিসহ সবাই পায়েলকে নিয়ে দরজার কাছে আসতেই পা থেমে গেল। মুখশ্রী তে দৃশ্যমান হলো উৎসুকভাব।

আদ্র,নিবিড়, সাগর,অন্তু দাঁড়িয়ে আছে অভিমুখে। হাতে সাদা একটা ওড়না। সাগর,অন্তু,নিবিড় সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে। আদ্রর ফর্সা শরীরে কালো রঙের পাঞ্জাবি টা ফুটন্ত কালো গোলাপের মতো। তুলির প্রখর স্পৃহা জাগল ফুটন্ত গোলাপ কে ছুঁয়ে সবটুকু সুবাস নিজের মধ্যে টেনে নিতে। কেমন হবে সুবাস টা?নিশ্চয়ই উম্মাদ করে তুলার মতো। ঠোঁটে স্মিত হাসি ফুটিয়ে অন্তু পায়েলের কাছে এসে দাঁড়াল। দাঁত দেখিয়ে বললো,

” মাশাল্লাহ। আমার কথা শুনার ফায়দা পেয়েছিস?আয়নায় দেখেছিস নিজেকে?সাউথ ইন্ডিয়ান নায়িকাদের মতো হহহ,,,”

পায়েলের তীক্ষ্ণ চাউনিতে থমকে গেল অন্তু। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে বললো,

” এভাবে তাকালে কলিজা ছোট্ট হয়ে যায় রে পায়েল। অত্যন্ত বিয়ের আগের রাতে একটু রহম কর আমার উপর। এতগুলো বছর তো বেশ টর্চার করলি। তোর তো আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত আমার সাজেশনে তুই ডাকিনী থেকে সাদা পেত্নী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিস।”

অগ্নিকুন্ডের ন্যায় জ্বলে উঠল পায়েল। দীর্ঘ সময় আঁকড়ে ধরা মৌনতা ভেঙে গেল নিমিষেই। উঁচানো স্বরে দাঁত কিড়মিড় করে প্রতিবারের ন্যায় ঝাঁঝের সহিত বলে উঠল,

” অন্তুর বাচ্চা সন্তু। খুন করব তোকে।”

” আমার আত্মার খুন তো করেছিস তুই বহু আগে।”

আনমনে,ক্ষীণ স্বরে আওড়ালো অন্তু। ঠোঁটে বহমান হাসি নিয়ে বললো,

” তোকে রাগিণী রূপে ভীষণ ভালো লাগে। এটার অভাব ছিল তোর মাঝে। পূর্ণ করে দিলাম। আবার অতিরিক্ত জ্বলে উঠিস না পরে আবার দেখবি তোকে হনুমান,হনুমান লাগছে।”

শেষমেশ পায়েলের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেই গেল। ধুম করে কিল বসিয়ে দিল অন্তুর বুকে। ব্যাথায় আহ্ করে মৃদু চিৎকার করে উঠল অন্তু। সেই সাথে চারদিকে পড়ে গেল হাসির রোল। অন্তুর চিৎকারে কর্ণপাত করছে না পায়েল। পিছন থেকে পিঠে কিল বসানো মাত্র সুপুষ্ট হস্তে আটকানোর প্রয়াসে কিছু টা কাছে টেনে নিল অন্তু। চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছে বেচারার। তবুও হাসতে হাসতে বললো,

” মেরে মেরে মাংস খুবলে নিয়ে কংকাল বানানোর ধান্ধা?ব্যাথায় চিৎপটাং হয়ে থাকলে তোর বিয়েতে মেয়ে পটাবো কেমন করে? তুই চিরকালই আমার সাথে শত্রুতা করে গেলি। পারলে অভিক কে মেরে দেখাস। দেখব সহ্য করে কিনা। লাথি যদি না খেয়েছিস তবে আমার অন্তু না,সন্তু হবে।”

” কিভাবে করবে?অভিক তো অন্তু নয়। কোনো কালে হতেও পারবে না। ”

মনে উচ্চারিত প্রতিটা শব্দ, বর্ণ পায়েল মনেই সুপ্ত কোণে সঞ্চিত রেখে দিল। মুখে বললো,

” বেশি ব্যাথা লেগেছে?”

” মেরে মেরে ঢং দেখানো হচ্ছে। আমি কি বুঝিনা?যদি বলি পেয়েছি তাহলে তুই তো আরও কষিয়ে দিবি।”

এবার আর না হেসে পারল না পায়েল। ঠোঁট ছড়িয়ে হেসেই দিল। অন্তু নিচু স্বরে বলে উঠল,

” এটারও অভাব ছিল। অবশেষে মনের শেষ চাওয়া টা পূর্ণ হল। দেখার সৌভাগ্য হল তোর গোলাপি ঠোঁটের স্নিগ্ধ,নির্মল হাসি টুকু।”

তুলি নিষ্পলক তাকিয়ে রইল পায়েল ও অন্তুর দিকে। অপ্রকাশিত, খুনশুটিময় ভালোবাসার ইতি ঘটবে এই রাত টা পোহালেই,মনে পড়লেই তুলির বুক ফেটে কান্না বেড়িয়ে আসতে চায়। এই যে,এই মুহুর্তে চোখ দুটো জলে টুইটুম্বুর হয়ে উঠেছে,অশ্রু কণারা গলায় আটকে আছে অথচ চেয়েও তুলি মুক্তি দিতে পারছে না তাদের। দম টা বন্ধ হয়ে আসছে তুলির। কোমরে আকস্মিক স্পর্শে শিউরে উঠল। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। পাশ ফিরে দেখল আদ্র দাঁড়িয়ে। চক্ষুদ্বয়ের প্রখর দৃষ্টি কেবল তার দিকেই নিবদ্ধ। লজ্জা অনুভব করল তুলি। চোখ এদিকে সেদিকে বুলিয়ে দেখল সবার দৃষ্টি পায়েল,অন্তুর দিক। তবুও পাছে যদি কেউ দেখে ফেলে? তাই তুলি সংকোচ নিয়ে কিছু একটা বলার নিমিত্তে উদ্যত হলো। কিন্তু কন্ঠস্বর বাঁধা পড়ল আদ্রর কাছে। তুলির রক্ত হিম হয়ে গেল। ক্রমশই তার দিকে ঝুঁকে আসছে আদ্র। ভয়ে তিরতির করে কাঁপছে তার ঠোঁট দুটো। আদ্র কি পাগল হয়ে গেল?সবার সামনে?আঁতকে উঠল তুলি। মুখ ফিরিয়ে নিল তৎক্ষনাৎ। কর্ণে এলো আদ্রর লহু স্বর।

“সুন্দর লাগছে তুলা।”

অতি সামান্য একটা বাক্য। অথচ কি মারাত্মক ভাবে প্রভাব ফেলল তুলির ছোট্ট মনে। হৃদয়ের গহীনে তোলপাড় সৃষ্ট করল নিমেষ। বক্ষস্থল কেঁপে উঠল সাংঘাতিকভাবে। অতঃপর তুলির মনে হলো শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে, ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে নিঃশ্বাস। এবং ভয়ংকরভাবে তাকে লজ্জায় ডোবানোর জন্য প্রস্তুত থাকে তার ডাক্তার সাহেব। তৎপরে মনে হলো তুলির অন্তস্থলে প্রতি প্রহরে কম্পন ধরানোর দায়িত্ব নিয়েছে আদ্র।

সাদা ওড়না টা মেলে ধরল আদ্র,সাগর,নিবিড়,অন্তু। চারকোণায় চারজন দাঁড়িয়ে পায়েল কে দাঁড় করাল মাঝে। এতো কষ্টের মাঝেও বন্ধুদের ভালোবাসায় তার অক্ষিকোটর হতে অশ্রু ঝরে পড়ার অভিপ্রায়। সিঁড়ি বেয়ে একে একে নেমে এল সবাই। পায়েলের বাবা দাড়িয়ে ছিলেন সিঁড়ির মুখে। মেয়ের কপালে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন। প্রত্যেক বাবার নিকট তার মেয়ে রাজকন্যা কিন্তু পায়েল শুধু রাজকন্যা নয় বরং উনার প্রাণ।
বাবা মেয়ের ভালোবাসা দেখে সবার মন টা প্রশান্তিতে ভরে গেল।

বাহির থেকে পায়েলের চাচাতো বোন নিহা দ্রুত গতিতে ছুটে আসল। রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল,” অভিক ভাইয়াদের বাড়ি থেকে লোকজন চলে এসেছে ছোট আব্বু।”

কথাটা শোনামাত্র ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। আদ্র দের উদ্দেশ্যে বললেন, ” তাড়াতাড়ি পায়েল কে নিয়ে স্টেজে বসাও আদ্র। উনাদের পায়েল কে হলুদ লাগানোর জন্য আসার কথা ছিল। এসে গেছেন। বরণ করতে হবে তো। তাড়াতাড়ি করো বাবা।”

পায়েল কে স্টেজে বসিয়ে তুলি একবার দেখে নিল সব ঠিকঠাক আছে কিনা। আদ্র খাবারের দিক টা দেখে আসল। যেহেতু পায়েলের অভিভাবক বলতে শুধু তার বাবা তাই নিজেদের উপর সব দায়িত্ব নিয়েছে আদ্ররা। প্রাণ প্রিয় বান্ধবীর বিয়ে বলে কথা। পায়েলের বড় চাচা বছর খানেক আগে হৃদরোগে মারা গেছেন। বাবার শরীরটাও খুব একটা ভালো না। দু’ দুই বার কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়েছে উনার। তাই তো পারে নি পায়েল এই বিয়ে হতে পিছিয়ে যেতে। ভয় হয়। ভয়ংকর ভয় হয় বাবা কে হারানোর। একদিকে বাবা, অন্যদিকে অন্তু। বাবার মন জিততে পারলেও অন্যদিক থেকে নৃশংসভাবে হেরেছে সে। ছুরি গেঁথেছে হৃদপিণ্ডে নিজের হাতে।

আদ্র স্টেজে এসে তুলির পাশে দাঁড়াল। পায়েল,অন্তু,রিমি,নিবিড়, সাগরের দিকে নজর যেতেই দেখল সবাই বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সামনের দিকে। হুট করে সবার এমন দৃষ্টি পাতের কারণ তুলি পর্যন্ত ঠাওর করতে ব্যর্থ হলো। সবার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাল আদ্র। মুহুর্তে ভ্রুঁ কিঞ্চিত কপাল স্পর্শ করল। সামনের মানুষ টা হলুদ লেহেঙ্গা টা আঁকড়ে ধরে দৌড়ে উপস্থিত হল আদ্রর কাছাকাছি। কেউ কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই মেয়েটা আদ্রর হাত ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বিস্তর হেসে জিজ্ঞেস করল,

” কেমন আছো আদ্র?”

মুহুর্তেই তুলির মনে হলো কেউ তার গলা টিপে ধরেছে। আকস্মিক হৃদপিণ্ডের প্রবল ধাক্কায় পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিল। বিষাক্ত যন্ত্রণার বিষ দেহের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল ইতিমধ্যে। আদ্রর দিকে ব্যথিত নয়ন জোড়া স্থবির করতেই বক্ষে কাটা হয়ে বিঁধল ঠোঁটের কার্ণিশে বহমান হাসি। না চাইতেও তুলির চোখের কোল ভিজে উঠতে লাগল বারংবার। ঠোঁট ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর খুব চেষ্টা তার। কিন্তু অশ্রু কণা তুলি কে ভেঙে চুরমার করে,দুর্বল করে ছুটে আসতে চাইল এবং তা গড়িয়েও পড়ল গাল বেয়ে অতি সন্তর্পণে।

#চলবে,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)