#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১২
পলাশ হাসান বসে আছে কোম্পানির চেয়ারম্যান তথা বড় স্যারের রুমে।কাঁচা পাকা ভ্রুর নিচে মোটা নাকের উপর হাই পাওয়ারের চশমা পরা বড় স্যার!টেবিলের উপর রাখা ফাইলে মনোযোগী দৃষ্টি! পলাশ ফাইলের ইন্সট্রাকশন বুঝিয়ে দিয়েছে কিছুক্ষন আগে।বড় স্যার ফাইলটা পুনরায় রিচেক করলো।তারপর কিছুটা বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,” পলাশ নতুন এন্ট্রি নেয়া মেয়েটার কি খবর?পারফরম্যান্স কেমন?অভিজ্ঞতাহীন কর্মী কোম্পানির জন্য হুমকি।তবুও নিতে হলো অনুরোধ রক্ষাত্রে।তোমার আন্ডারেই তো মেয়েটির গ্রুমিং চলছে।পারফরম্যান্স ভালো না হলে জবে তো রাখা যাবে না।”
বত্রিশ বছর বয়সী অত্যান্ত যোগ্যতা সম্পন্ন পুরুষ পলাশ।বর্তমানে কোম্পানির মিড টার্মে প্রোগ্রামিং সেকশনে আছে। সাথে নতুনদের গ্রুমিংটাও সে শিখিয়ে থাকে।পলাশ শিরদাঁড়া সোজা করে কন্ঠে বিস্ময় প্রকাশ করে বলে,” স্যার মিস নীতু এক আশ্চর্যজনক মেয়ে! সবকিছু এতটা পারফেক্টলি করে তা একদম অবিশ্বাস্য! মাত্র দেড় মাসেই অনেক কিছু বুঝে ফেলেছে কোম্পানির। আমার আন্ডারে যত নতুন এন্ট্রি এসেছে তার মধ্যে মিস নীতু অন্যরকম।ভীষণ কর্মোঠ আর মনোযোগী!সাধারণ ডিপ্লোমা করা একজনের থেকে এটা আমি আশা করিনি।স্যার আপনাকে আমি শিওর করতে পারি মিস নীতু আমাদের কোম্পানির জন্য একদম পার্ফেক্ট!”
বড় স্যার মাথা নাড়িয়ে বলেন,”আই সি।তুমি এখন আসো পলাশ।আর ডাটা সেকশনের প্রজেক্ট গুলো একবার চেক করো।”
পলাশ বড় স্যারের কেবিন থেকে বেড়িয়ে পরে।নীতুকে নিয়ে সে যা এতক্ষণ বলেছে তা একটুও বাড়িয়ে বলেনি।মিস নীতুর কর্মদক্ষতা পলাশকে সত্যিই অবাক করেছে।
পলাশ অন্যান্য এন্ট্রির মত নীতুকেও সেই ভাবে ট্রিট করছিল।ওয়ার্ক স্পৃহা ভালো দেখে কাজ বাড়িয়ে দিত।দিন কয়েক আগ পর্যন্ত নীতু তার কাছে একজন সাধারন মেয়ে হিসেবেই গন্য হয়েছে কিন্তু পাঁচ দিন আগে নীতু সার্ভার প্রজেক্টে মারাত্মক রকম ভুল করে ফেলে।তা দেখে পলাশের মাথা গরম হয়ে।ভীষণ রাগারাগি করে। নীতু চুপচাপ রাগ হজম করে নেয়।পলাশ একটা ফাইল আনতে যেই না উঠে গেলো পাশের ডেস্কের মেয়েটা নীতুর সাথে পলাশের সম্বন্ধে আজেবাজে কথা বললো।মেন্টর হিসেবে পলাশ অযোগ্য তাও বুঝাতে চাইলো।পলাশ আড়ালে থেকেই শুনতে পেলো নীতু মেয়েটিকে হাসিমুখে বলছে,” আপু মেন্টর হিসেবে তিনি আমাকে বকা দিতেই পারেন।তাছাড়া এই সেকশনটা তিনি আমাকে আগেই বুঝিয়ে দিয়েছেন তারপরও আমি ভুল করেছি।তাই আমি মনে করিনা পলাশ স্যার এখানে কোন অন্যায় করেছেন।”
নীতুর এমন মন্তব্যই পলাশকে নীতু সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করেছে।তার পাঁচ বছরের ক্যারিয়ারে মেন্টর হিসেবে অনেকের কাছ থেকেই অনেক তিক্ত মন্তব্য শুনেছেন।কাজ শিখে অমূল্যায়ন করতে দেখেছে।নীতু তার বিপরীত। মেয়েটা শ্যামবর্ণের।এভারেজ বাঙালি রুপ।নাক ঠোঁট সবকিছুই সাধারণ কেবল চোখ দুটো ভীষণ মায়াকারা।পলাশ সেদিনের পর থেকে নীতুকে পর্যবেক্ষণ করেছে।নীতুর বিহেভিয়ার সত্যিই তাকে মুগ্ধ করেছে।
লাঞ্চ টাইমে নীতু কেন্টিন এড়িয়ায় বসে খাবার খেতে শুরু করলো।একটু পরই পলাশ এসে নীতুর সামনের চেয়ারে বসলো।নীতু পলাশকে দেখে আড়ষ্টভাবে চেয়ে মৃদু হাসলো। পলাশ পাল্টা হাসি দিয়ে বললো,”রিল্যাক্স মিস নীতু।আমি এখনে তোমার বস নই তাই এমন ভয়ে জড়সড় হওয়া বন্ধ করো।নিজেকে কেমন স্কুলের রাগী মাস্টার মনে হচ্ছে। ”
নীতু পলাশের কথায় মাথা নত করে হেসে ফেললো।পরক্ষণেই বললো,”স্যার মাটন বিরিয়ানি খাবেন?”
পলাশ চেয়ে দেখলো নীতুর টেবিলের পাশে একটা বাটিতে অর্ধেক বিরিয়ানি রাখা। বাকিটা নীতু নিজে খাচ্ছে। পলাশ বললো,”আরে তোমার কম পড়ে যাবে।”
“মোটেই না।আমি এর বেশি এমনিতেই খেতাম না।”
“তুমি রেঁধোছো?”….কৌতুহলী কন্ঠে বলে পলাশ।
নীতু প্রতিত্তোরে মিষ্টি হেসে পলাশকে বাকি খাবার টুকু সার্ভ করে দেয়।পলাশ বুঝে যায় নীতুই রান্না করেছে।তাই খাওয়ার আগ্রহটা যেন মন ছেঁয়ে পাকস্থলীর সীমানা ছুঁয়ে হু হু করে বেড়ে গেলো!
**************
সেতু এলোমেলো ভাবে বিছানায় শুয়ে আছে।চোখের দৃষ্টি জানালা গলে দূর আকাশে নিবদ্ধ! সদ্য বিবাহিত সেতুর মনে কালো গমগমে মেঘের ভেলা! কোথাও এক ফোটা ঝলমলে রোদ্দুর নেই।সেতু প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ে! ঠিক সেই মুহুর্তে রাবেয়া বেগম রুমে প্রবেশ করে।সেতু শাশুড়ীকে দেখেও উঠে বসে না।ওভাবেই পড়ে থাকে।রাবেয়া বেগম কপাল কুঁচকে বলেন,” বউ মা এই ভরদুপুরে না খেয়ে এভাবে শুয়ে আছো কেন?শরীর খারাপ নাকি?”… বলে সেতুর কপালে হাত রাখে।
সেতু কিছু বলে না।তার আসলে এই মহিলাকে ভালো লাগছে না সেদিনের পর থেকে।রাবেয়া বেগম আবার বলেন,”শরীর তো ভালোই আছে তবে এভাবে পড়ে আছো কেন?”
সেতু এবার উঠে বসে।নিজের কুঁচাকানো পড়নের কাপড়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “মা আপনি কেন এই কাজটা করলেন?নিজ হাতে তিনটে জীবন ধ্বংস করে দিলেন।কি হতো উনার পছন্দের মানুষটাকে মেনে নিলে?মাঝখান থেকে আমার জীবনটাও তছনছ করে দিলেন।”
রাবেয়া বেগমের চোখের দৃষ্টি মুহুর্তেই কঠিন হয়ে গেলো।ঝামটা মেরে বলে উঠলো, “মুখ সামলে কথা বলো।বিয়ের আগে ওমন দু চারটা সম্পর্ক সব ছেলেদেরই থাকে।কেমন বউ তুমি? নিজের বরকে নিজের দিকে ফিরাতে পারো না।তিন কবুল পড়া বউ তুমি।তোমার অধিকার ওই কালীর থেকে বেশি।বরের মন থেকে কেমন করে অন্য মেয়ের ছবি মুছাইয়া ফেলতে হয় তাও তোমাকে শিখিয়ে দিতে হবে।”
সেতুর শরীর রাগে হিসহিসিয়ে ওঠে।নিজের ক্রোধ সামলে বলে,”মা কি করে বরকে নিজের দিকে ফিরাতে হয়? এই যৌবন ভরপুর শরীর দিয়ে? সব পুরুষ কি আকৃষ্ট হয় শরীরে? একই ঘরে একই বিছানায় থেকেও আপনার ছেলের মনে জায়গা করতে পারছিনা। আপনি কি তবুও বুঝতে পারছেন না সেই মেয়েটি আপনার ছেলের কতটা জুড়ে থেকে গেছে?”
রাবেয়া বেগম কি বলবেন ভেবে পেল না।সেতুর দু’চোখে জল টইটম্বুর হয়।শাশুড়ীর হাত খপ করে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে, “মা আপনি জানেন?আপনার ছেলে রাত হলে ঘুমায় না।ঘুমাতে পারে না মানুষটা!সারারাত ছটফট করে!বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাতের অন্ধকার দেখে।আপনি তো মা!আপনি কেমন করে এতটা কঠোর হলেন?আপনার ছেলের চোখের কোলে নির্ঘুম রাতের ছাপ পড়েছে।তা দেখে আপনার বুক কাঁপে না?সেই মেয়েটা এই ঘরে না এসেও আপনার ছেলেকে ঠিক জয় করে ফেলেছে।আপনি, আমি দুজনেই উনার ভালোবাসার কাছে হেরে গেছি!”
রাবেয়া বেগম বিস্মিত দৃষ্টিতে ছেলের বউয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।বুকের উপর কেমন চাপ অনুভব করলেন ধীর পায়ে উঠে নিজের রুমে গিয়ে শব্দ করে দরজা আটকে দিলেন।সেতু সেই শব্দে কেঁপে উঠলো।পরক্ষণেই দু হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ফেললো।
*************
সাথি অনবরত বকবক করে যাচ্ছে মোবাইলে রিপনের সাথে। নীতু তা দেখে আলতো হাসে।মেয়েটা এত কথা বলতে পারে?নীতু একটা বোলে আমড়ার আচার বানিয়ে সাথির সামনে রাখে। সাথি আচার দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠে নীতুর গালে চুমু দেয়। নীতু নিজেও কিছুটা আচার একটা পিরিজে নিয়ে বসে খাটে। সাথি কল কেটে আচার খাওয়ায় মনোনিবেশ করেছে।নীতু খেতে খেতেই বলে,”সাথি সবসময় দেখি আমাদের সামনের ফ্লাটটা তালা দেওয়া। ওখানে কেউ থাকে না?”
“আপু ওখানে একজন হ্যান্ডসাম পুরুষ থাকে।যাকে বলে চোখ ঝলসানো হ্যান্ডসাম!তিনি আপাতত বাসায় নেই।”
নীতু আচারের বাটি হাতে নিয়েই বারান্দায় গিয়ে বসে।যতদুর চোখ যায় সবখানে উঁচু উঁচু দালান । যেন এক একটা দালান ঐ আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে!
নীতু ভালো আছে।সারাদিন অফিস করে।রাতে টুকটাক রান্না করে।ইদানীং নিজের যত্ন অনেকটা নেয়া হয়।সাথি তো জোর করেই পার্লারে নিয়ে গিয়েছিল।মেনিকিওর,পেডিকিওর, ফেসিয়াল সব করে এসেছে।সকাল হলে কতক্ষণ হাঁটাহাঁটি করা নীতুর রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেকে পুরোটা গুছিয়ে নেয়ার পরও কোথাও যেন একটা কিছুর শূন্যতা থেকে যায় নীতুর !চোখজুড়ে একজনকে দেখার তীব্র হাহাকার!একই শহরে বাস করা সেই মানুষটার জন্য বুকের কোণে তীব্র ব্যথা অনুভব হয়!
চলবে,
#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১৩
অনিক দুই হাতে মাথা চেপে বসে আছে।নাক মুখ রাগে লাল হয়ে আছে!রোজ রোজ অফিস থেকে ফিরে বউ আর মায়ের রাগান্বিত মুখ দেখতে আর ভালো লাগে না।পুরুষ মানুষ কোন দিকে যাবে?মায়ের রাগ ভাঙালে বউ আরো রাগ করে আর বউয়ের রাগ আগে ভাঙালে মা কষ্ট পায়!
অনিক নিজেকে যথাসম্ভব ঠান্ডা করে মাকে বললো,”মা চলো খাবে।সারাদিন কিছু খাওনি।”
রুশিয়া বেগম জ্বলন্ত আগুনের মত তেতে উঠেন। সারাদিন তিনি কোমড়ের ব্যথায় বিছানা থেকে উঠতে পারেন নি।বড় ছেলের বাসায় তিনি যতদিন থাকেন ততদিন নিজেই রান্না করেন।ছেলের বউয়ের আশায় ফেলে রাখেন না।তাছাড়া ছেলেটাও মায়ের রান্না পছন্দ করে।বয়স হয়েছে মাঝে মাঝে শরীর সায় দেয় না।তার শরীর খারাপ তবুও ছেলের বউ সকালে বের হয়েছে আর সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছে।
বউয়ের রাগ ছেলের উপর ঢেলে বলেন,”তুই খা। সঙ্গে তোর বউরে খাওয়া। তুই চোখের সামনে থেকে দূর হ!”
অনিক ব্যর্থ পায়ে উঠে রুমিকে গিয়ে বলে,”মা তোমাকে বলেনি তার শরীর খারাপ?আজ কি রান্নাটা তুমি করতে পারতে না?তোমার কাছে আমি বা আমার মার থেকে তোমার বন্ধু আর কাজিন মহল বেশি ইম্পর্টেন্ট?কি হত আজ তাদের সাথে আউটিংয়ে না গেলে?সারাদিন বুড়ো মানুষটা না খেয়ে আছে।এতটা দায়িত্বহীনতা কেন রুমি?”
রুমি বাইরে থেকে ফিরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মেকাপ তুলছিল। অনিকের করা প্রশ্নে খুবই দায়সারা ভাবে বলে,”ফিরতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওরা আসতে দিল না।”
অনিক চিল্লিয়ে ওঠে, “তুমি কি চাও রুমি?আমার মা এখানে না থাকুক?সে অসুস্থ, পুত্রবধূ হিসেবে তোমার উচিত ছিল না তার পাশে থাকা?”
রুমি বিরক্তি স্বরে বলে,”ওহ অনিক!আমাকে শাবানা টাইপ বউ ভেবো না।আমি কারো ইচ্ছায় চলি না এটা তুমি ভালো মতনই জানো।সো এসব ফালতু কথা বন্ধ করো।”
“আমার মা অসুস্থ! এটা ফালতু কথা?”
“অফকোর্স। হাট্টা খাট্টা একটা মানুষ হুট করে এভাবে অসুস্থ কি করে হয়?যত্তসব ড্রামা!”…… বিরক্তি কন্ঠে বলে রুমি।
অনিক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।তার আসলে কি বলা উচিত ভেবে পায় না!নিজেকে বড় অকর্মাণ্য মনে হয়।
অনিক ফের নিজের রাগ চেপে রুমির কাছে গিয়ে শান্ত স্বরে বলে,” রুমি আমার সাথে চলো।মাকে খেতে বলবে।আমি খাবার নিয়ে এসেছি বাহির থেকে।সে বৃদ্ধ মানুষ রুমি! তাছাড়া অভীক আর সাতদিন পরই ফিরবে তখন তো মা চলেই যাবে!এ কয়টা দিন আর ঝামেলা বাড়িয়েও না!”
রুমি আবার ত্যাড়া ভাবে বলে,”তো সে চলে যাবে দেখে তার পা ধরবো আমি।আমি রুমি কখনো কারো কাছে ছোট হইনা।তার ইচ্ছা হলে খাবে নতুবা খাবে না।”
“তুমি যাবে না?”
“না না! “….. রুমি ঘাড় বাকিয়ে বলে।
অনিকের মন চাচ্ছে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে রুমিকে কিন্তু বউয়ের গায়ে হাত তোলা অনিক পছন্দ করে না। নিজের রুম থেকে বেড়িয়েই দেখে অনিক মা ব্যাগ হাতে ড্রয়িং রুমে বসে আছে।অনিককে দেখে তিনি ফ্যাকাশে হেসে বলেন,” বড়ো আমার পাশে এস বস।”
অনিক মায়ের কোল ঘেসে বসে।রুশিয়া বেগম অনিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,”ভালো থাকিস বাবা।তোর ফুপুকে আসতে বলেছিলাম। সে নিচে অপেক্ষা করছে।আমি তার কাছে চলে যাচ্ছি।তাকে নিয়ে পরশু ঢাকা ফিরবো।নিজের খেয়াল রাখিস।”
অনিকের চোখে জল এসে যায়।মাকে এখন কোন ভাবেই এখানে রাখা যাবে না তা অনিক বুঝে গেছে।খাবারের প্যাকেট সেভাবেই অবহেলায় পড়ে থাকে টেবিলে, রুশিয়া বেগম না খেয়েই ছেলের বাসা থেকে চলে যান।অনিক মাকে এগিয়ে দিয়ে আর বাসায় ফিরলো না।গোটা রাতটাই রাস্তায় কাটিয়ে দিলো।আর রুমি সে দিব্যি খেয়ে দেয়ে ঘুম দিলো।স্বামী শাশুড়ীর রাগ অভিমান কোন কিছুই তাকে ছুঁতে পারলো না!
********
সেতু মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত! কোন কিছুই তার ভালো লাগে না।সারাটাদিন ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে।চোখে মুখে বিষন্নতার ছোঁয়া। পরিবারের ছোট হওয়ায় সবসময়ে আদরের ভাগ তার জন্য বরাদ্দ ছিল।কোন কিছু পাওয়ার হলে জেদ করে হলেও আদায় করতো।কিন্তু আজ সেতু ব্যর্থ।জেদ করে কি ভালোবাসা পাওয়া যায়?যায় না তো।সেতু ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।তাজকে ভালোবেসে ফেলেছে সেতু।বড় অন্যায় করে ফেলেছে।যে মানুষটা সকাল সন্ধ্যা ওকে অবহেলা করে কি করে তাকে ভালোবাসতে পারে সেতু?ভেবে পায় না কিছুতেই! কারো অবহেলা যে এতটা কষ্টদায়ক তা সেতু জানতো না।হুট করেই নীতুর কথা মনে হয় সেতুর।আপা চিরকাল অবহেলা পেয়ে এসেছে।তারও তো ভীষণ কষ্ট হত? নীতুর কথা মনে হতেই বিছানার উপর পড়ে থাকা ফোনটা ছোঁ মেরে তুলেই কল করে বসে।
নীতুর ওয়ার্কিং আওয়ার চলছে।ভীষণ ব্যস্ত! খটখট করে কম্পিউটার কি বোর্ডে হাত চালাচ্ছে। সাদা আর গোলাপি মিশ্রণের একটা কুর্তি কৃষ্ণবর্ণ শরীরে অন্যরকম আভা ছড়াচ্ছে।গলায় দু প্যাচে স্কার্ফ জড়ানো, লম্বা চুলে বেণী আর চোখের কোণে ছড়ানো কাজলে নীতুকে আরো স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। পলাশ নীতুর দিকেই তাকিয়ে ছিল।মেয়েটা দিনকে দিন তার ব্যক্তিত্ব দিয়ে তাকে মুগ্ধ করছে।হুট করেই নীতুর ফোনটা বেজে ওঠে। ফোন কলের শব্দে পলাশ দ্রুত দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়।নীতু পলাশকে স্কিউজ মি বলে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ে ফোন হাতে।স্ক্রীণে সেতু নামটা দেখে নীতুর কপালে ভাজ পড়ে। হ্যালো বলে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সেতু ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে আপি বলে। নীতুর বুকের ভিতর ধ্বক করে ওঠে বোনের কান্নামিশ্রিত কন্ঠ শুনে। সেতু অনবরত কেঁদে যাচ্ছে।নীতু সময় দেয় সেতুকে কান্না থামার জন্য। পরে আদুরে স্বরে বলে ওঠে, “আমার সেতু বাবু কাঁদছে কেন?শাশুড়ী বকেছে বুঝি?”
সেতু কাঁদো স্বরে বলে,”আপি আমাকে নিয়ে যাও।আমার দমবন্ধ লাগে এই বাসায়! আমি মরে যাবো এখানে থাকলে।”
নীতু আৎকে উঠে বলে,”কিসব বলছিস?কান্না থামিয়ে বল কি হয়েছে?”
“আপি এত অবহেলা আমি নিতে পারছি না।আপি,উনি আমাকে একটুও ভালোবাসে না।একটুও না!আমার দিকে ফিরেও তাকায় না।উনি অন্য কাউকে ভালোবাসে আপি!”
নীতুর মনে হচ্ছে, নীতুর বুকে পাথর চাপা পড়েছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তাজ কি তবে তাকে ভুলতে পারে নি?তবে কি তাজ তাকে সত্যিই ভালোবেসেছে?এসব প্রশ্ন মাথায় আসতেই নীতু নিজেকে ধিক্কার দেয়।তাজ এখন তার জন্য বোনের হাসবেন্ড ছাড়া আর কিছু নয়।হ্যা সে নিজেও তাজকে ভুলতে পারেনি। তাই বলে কি স্বাভাবিক ভাবে লাইফ লিড করছে না।তাজের উপর মুহুর্তেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।প্রথমে তাকে এখন আবার সেতুকে কষ্ট দিচ্ছে। কি চায় মানুষটা?
নিজেকে সামলে নীতু পাল্টা প্রশ্ন করে,”ভালোবাসিস? ”
সেতুর ফোনের ওপাশে মাথা দুলিয়ে হ্যা বলে। নীতু হেসে ফেলে।অথচ নীতুর চোখের কোণে জল!
পরক্ষণেই সেতুকে বলে,” সেতু, তাজবীদ একজন ভিন্ন মানুষ আর তুইও।দুটো ভিন্ন স্বত্তা বিয়ের মাধ্যমে এক হয়েছিস।তার মানে এই নয় যে তুই তাজবীদকে জয় করেছিস বা সে তোকে।সময় দে সেতু।যেকোন সম্পর্ক সুন্দর করতে সময় দিতে হয়!যেহুতো তাজবীদ কনফেস করেছে সে কাউকে ভালোবাসতো।তবে তাকে ফিরে আসতে সময় দে।আর তোকে বুঝতে, জানতেও তো সময় প্রয়োজন।তাইনা?ভেঙে পড়িস না।তাজবীদ তোকে আজ ভালোবাসে না কিন্তু ঠিক একসময় বাসবে।””মানুষ অতীত আঁকড়ে ধরে বাঁচে না।মানুষ বসবাস করে বর্তমানে! “”পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে কোন লাভ নেই বরং ফেস কর।আর সারাক্ষণ বিয়ে, ভালোবাসা এসব নিয়ে না ভেবে নিজের জন্য ভাব।তাতে তুইও ঠিক থাকবি আর তাজবীদও নিজেকে সামলে উঠবে পুরানো আঘাত থেকে।পড়াশুনাটা শুরু কর।ঢাকায় ভর্তি হ।তারা যদি বাধা দেয় আমিই পড়ার টাকা দিবো চিন্তা করিস না।মনে রাখবি, কখনো নিজের সাথে কম্প্রোমাইজ করবি না!”……….নীতু একবারো মুখে তাজ নামটি উচ্চারণ করলো না।
সেতু বিড়বিড় করে বলে,”আই লাভ ইউ আপি।তুমি এত ভালো কেন?আমি তোমার কথা মেনে চলবো।দেখি কি হয়।”
“গুড গার্ল।…..বলে নীতু কল কেঁটে দেয়।নীতু ফোন রেখে চোখের কোণে জমা জলটুকু আঙুল দিয়ে মুছে নেয়। ঠোঁট প্রসারিত করে হাসির রেখা টানে।বড় করে শ্বাস ছেড়ে নিজের নির্ধারিত আসনে বসে।পলাশ নীতুর দিকে তাকিয় বলে,” এনিথিং রং মিস নীতু? ”
” নাথিং।”….নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে বলে নীতু।
*************
তাজ অফিস থেকে ফিরে দেখে সেতু ফ্রেশ মুডে মোবাইলে গেমস খেলছে।তাজ খানিকটা অবাক হয়।এতদিন বাসায় ফিরে সেতুকে সবসময় গম্ভীর মুখেই দেখেছে।তাজের অবাক লাগলেও প্রশ্ন করে কৌতুহল মিটালো না।তাজ ফ্রেশ হয়ে আসতেই সেতু বলে ওঠে, “আমি পড়াশোনাটা কন্টিনিউ করতে চাইছে।আপনার আপত্তি আছে? ”
তাজ কপাল কুঁচকে বলে, “আমার আপত্তি থাকবে কেন?”
“পরিক্ষাটা কম্পিলিট করতে খুলনায় যাবো পরিক্ষার সময়।তারপর এখানে ভর্তি হব।আসার সময় তো বই নিয়ে আসে নি।আমার কিছু বই কেনা লাগবে।আমি টাকা দিলে আপনি কি আমাকে বই কিনে দিতে পারবেন?”
তাজ সেতুর কথায় বিস্মিত হলো।তাজের অবাক চাহনি দেখে সেতু বলে,”যেহুতো আমাকে আপনি বউ বলে স্বীকারই করছেন না তাই আপনার খরচ দিতে হবে না।”
তাজ ব্যঙ্গ করে বলে,”তো কে দিবে?”
“নীতু আপি দিবে।সে আমাকে বলেছে আমার পড়াশোনার খরচ তার।”
নীতুর নামটা শুনতেই তাজের চোখে কাঁপন দেখা দেয়।বুকের স্পন্দন বেড়ে যায়।বিস্মিত কন্ঠে বলে,”নীতু?”
“হ্যা আপি তো ঢাকায় থাকে।এখানে জব করে না।তাই কোন সমস্যা হবে না।”
“কোথায় থাকে তোমার বোন?”……. সাবধানী স্বরে বলে তাজ।তাজের ভয় হচ্ছে বুকের ভিতরে উথাল ঝড়ের ধ্বনি সেতু টের না পেয়ে যায়।
” মিরপুরে।”…..মোবাইলে গেমস খেলতে খেলতে বলে সেতু।
তাজ চোখের পাতা বন্ধ করে ফেলে।নীতুকে একপলক দেখার আশায় শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে উত্তেজনা দেখা দেয়!
***************
দিন কয়েকপর,
অভীক মাত্রই জার্মান থেকে ফিরেছে।এতবড় জার্নিতে ক্লান্ত শরীর। বাসায় ফিরেই ফুপিকে কাঁদতে দেখে কলিজা ধ্বক করে ওঠে। ফুপু সহসা কাঁদেন না।তিনি নিঃসন্তান মানুষ।স্বামীকে দ্বিতীয় বিবাহ দিয়ে সারাদিন তালিম দাওয়াত করে বেড়ান।খুলনার তিনতলা বাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়ে তার চলে যায়।শত বিপদেও অভীক ফুপিকে শান্ত থাকতে দেখেছে।সেই মানুষটা আজ কাঁদছে।অভীককে দেখেই ফুপি বলে ওঠেন,”অভীক তোর মা বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে।কোমড়ে ব্যথা পেয়েছে।তাকে নিয়ে পাশের ফ্লাটের মেয়ে দুটো হসপিটালে গেছে বাবা।”
অভীকের মনে হলো একমুহূর্তের জন্য তার নিঃশ্বাস আটকে গেছে।মাকে ভীষণ ভালোবাসে অভীক।অভীক হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি মাড়িয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা দেয়।
এতবড় জার্নির ক্লান্তি মুছে গিয়ে সেখানে মায়ের জন্য একরাশ উৎকন্ঠা দেখা দেয় অভীকের মনে।অভীক চলে যেতেই ফুপি অযু করে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে পড়েন প্রিয় ভাবির মঙ্গল কামনায়।
***——
মেডিনোভা হসপিটালের করিডোরে অভীক বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে কাঁচের অপর পাশের দৃশ্যের দিকে।অভীক যেন চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছে।যেই মেয়েটা মায়ের বেডের পাশে মায়ের হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে সেই মেয়েটা অভীকের চেনা।এই পরিচিত মুখটা দেখে অভীক যেন এক মুহুর্তের জন্য শ্বাস ফেলতেও ভুলে গেছে।
অভীকের মন মস্তিষ্ক উভয়ই মুহূর্তের জন্য চলে যায় তিন বছর পূর্বের ফ্লাশব্যাকে।একটা ছোট খাটো রুম….বিদ্যুৎ ছিল না সেদিন।চার্জারের মৃদু আলো ঘরটাকে আলোকিত করে রেখেছে।চারপাশে ভ্যাপসা গরম…সেই তপ্ত সন্ধ্যায় মৃদু আলোতে অভীকে দেখলো জরিটরি মিশ্রিত রঙ বেরঙের একটা শাড়ি পড়া মেয়ে জড়োসড়ো হয় বসে আছে।যার চোখের দৃষ্টি নিমজ্জিত! ঠোঁটের কোণে একরাশ লজ্জা!
সেদিনের সেই এক পলকের একমুহূর্তের দেখা মুখটি কি করে এখনো মনে গেথেঁ আছে অভীক ভেবে পেলো না!
সেদিনের সেই জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা মেয়েটির সাথে আজকের দেখা মেয়েটির মধ্যে অনেক তফাৎ থাকলেও অভীক ঠিকই চিনে ফেললো।কৃষ্ণবর্ণ মেয়েটিকে দেখে মুহূর্তেই অভীক ভুলে গেলো এখানে কেন সে এসেছে? কোথা থেকে একরাশ সংকোচ, লজ্জা, দ্বিধাবোধ এসে অভীককে আঁকড়ে ধরলো।ঠিক সেদিনের সেই জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা রমণীটির মত!
চলবে,