#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ ১৪
অভীকের ওষ্ঠদ্বয় অতি আশ্চর্যে এখনো আলাদা হয়ে আছে।না চাইতেও অভীক নিজের বিস্ময় লুকাতে পারছে না।
অনেকক্ষণ পর অভীক নিজেকে সামলে কেবিনে প্রবেশ করে।নিজের ভিতরের অস্থিরতা কিছুতেই অভীক লুকাতে পারছে না।সবসময় স্ট্রেইট কথা বলা অভীক আজ বড় নার্ভাসনেসে ভুগছে।ঘামে ভিজে গেছে শার্ট! অভীককে দেখে সাথি এগিয়ে এসে বলতে শুরু করে কি করে রুশিয়া বেগমকে হসপিটালে নিয়ে আসলো।অভীক যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না।ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি আর অপরাধ বোধে ভুগছিল! নীতু খুবই স্বাভাবিক ভাবে অভীকের দিকে ফিরে তাকালো।কৃষ্ণবর্ণ মুখটিতে মৃদু হাসির রেখা টেনে বললো,”মি.অভীক আন্টি এখন ঠিক আছে। ডক্টর দেখে গেছে।মাথায় দুটো স্টিচ আর কোমড়ে ব্যথা পেয়েছে।কিছুদিন রেষ্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। ”
অভীক চোখের পলক ফেলে মাথা নাড়লো।মায়ের সুস্থতায় আলহামদুলিল্লাহ বললো মনে মনে। সাথি ফের বলে উঠলো,”ভাইয়া আজ যে ভয় পেয়েছিলাম।আন্টির মাথায় রক্ত দেখে তো আমিই বেহুশ হতে গিয়েও হয়নি।নীতু আপু ছিল বলে রক্ষে।সে দারোয়ানকে ডেকে গাড়ি ঠিক করেছে।তারপর দুজনে মিলে আন্টিকে চারতলা থেকে নামিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। হসপিটালিটির যেখানে যা সবকিছু আপুই করেছে। আমি কেবল বোকা বোকা চোখে সবকিছু দেখে গেছি।এতটা নার্ভাস হয়ে পরেছিলাম!”
অভীক কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে নীতুর দিকে তাকালো।নীতু কিছুই বললো না।রুশিয়া বেগমের পাশে ঠায় বসে রইলো।অভীক কেবিন থেকে বেড়িয়ে আবার ডাক্তারের সাথে কথা বললো। পুরো দু’ঘন্টা নীতু বসে রইলো, রুশিয়া বেগমের জ্ঞান ফিরার অপেক্ষায়।
অভীক পুরোটা সময়ই ভীষণ আরষ্ট হয়ে রইলো।নিজেকে কেমন খুনী দাগি আসামী মনে হতে লাগলো। রুশিয়া বেগম জ্ঞান ফিরে নীতুকে দেখে হু হু করে কেঁদে দিলো।নীতু নিজ হাতে চোখ মুছে দিল তার।অভীক এসে মায়ের পাশে বসলে তিনি ছেলেকে জরিয়ে ধরে কেঁদে দিলেন ফের।অভীক মাকে তার বুকের সাথে জরিয়ে রাখলো।সাথি খাবার কিনে আনলে নিজ হাতে নীতু খাবার খায়িয়ে ঔষধ খাওয়ালো।অভীক সবটা চুপচাপ চেয়ে চেয়ে দেখলো।নীতুকে এত স্বাভাবিক ভাবে সবটা করতে দেখে অভীক গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।অভীক আবারো বিশ্বাস করলো, আল্লাহর সৃষ্টির সেরা রহস্যময় সৃষ্টি হলো নারী!
*********
মহিমা বেগমের শ্বাস কষ্ট শুরু হয়েছে।বুকের উপর চাপ অনুভব করছেন।বুকের কাছে আঁচল সরিয়ে অনবরত সরিষার তৈল মেজে যাচ্ছেন। একটু পর শ্বাস কষ্ট কমলেও চোখে জল এসে গেল।নীতু… আমার নীতু বলে কেঁদে উঠলেন।নীতু কখনোই মহিমা বেগমকে বেশি কাজ করতে দিত না।সব কাপড় চোপড়, থালা বাসন নিজে ধুয়ে দিতো।পাছে মায়ের ঠান্ডা না লাগে।বাসার সব কাজ ধরতে গেলে এখন মহিমা বেগমই করেন।সুরভি আগের মতই ছাড়া হাত পা নিয়ে কাজ করে। নিখিল অফিস থেকে ফিরেই দেখে মা বিছানায় বসে কাঁদছে। নিখিলকে দেখে মহিমা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।এই সেই ছেলে যার জন্য নিজে কত কষ্টই না করেছেন।ছেলেটা হওয়ার সময় কিছুই খেতে পারতেন না তিনি।খুবই রুগ্ন ছিলেন।এরপর তো একটু বড় হওয়ার পর সেরা জামাটা ছেলেকে পড়িয়েছেন।ভালো স্কুল, কলেজ ছেলের জন্য। মেয়েদের ভাগের আদরটুকুও ছেলের জন্য বরাদ্দ ছিল।নীতু কোলের মাছ পছন্দ করতো আর নিখিলও।তিনি নিখিলকেই সবসময় বেশিই দিতেন।মেয়েরা অভিযোগ করলে মহিমা বেগম বুক ফুলিয়ে বলতেন,”শেষ বয়সে দেখলে আমার ছেলেই দেখবো তোরা তো সব পরের ঘর করবি।আমার আব্বার সাথে তোদের তুলনা করিস না!”
আজ মনে হলো তিনি ভুল ছিলেন।মেয়েরা তার যতটা খোঁজ নেন ছেলে তার এক আনাও নেন না।
নিখিল মাকে শান্ত কন্ঠে বলে,”মা ঔষধটা তো নিয়মিত খেতে পারো।তাহলে আর শরীর খারাপ হয় না।কতগুলো টাকার ঔষধ অথচ তুমি নষ্ট করো।!”
ছেলের চোখে বিরক্তি দেখে মহিমা বেগমের বুকের ভিতর হু হু করে ওঠে। অনেক সময়ই মনে থাকে না ঔষধ খাওয়ার কথা।অসুস্থ স্বামী আর সংসার সামলে নিজের কথা ভুলে যান তিনি। পাশে বসে কেউ মনে করিয়ে দেয় না। নীতু থাকলে ঠিকই হাতে ধরিয়ে দিত। নিখিল কথা বলে চলে গেলো।মহিমা বেগম ফের কাঁদতে শুরু করলেন।ছেলেকে কি করে বুঝাবেন?বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবার ঔষধের থেকেও সন্তানের সঙ্গের বেশি প্রয়োজন হয়!
**********–
ইতুর সকাল থেকেই মেজাজ গরম।আজো তার শাশুড়ী উল্টা পাল্টা কথা বলেছে তার নামে পাশের ফ্লাটের আন্টির সাথে। ইতু মাথা গরম নিয়েই সন্ধ্যার পর থেকে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিটা কাজ করছে শব্দ করে।মিলন চুপিসারে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।ইতু যতই বদমেজাজী হোক কখনো মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেনা এটা মিলনের ভালো লাগে।অবশ্য তার ঝাল ঠিকই মিলন ভোগ করে।মিলন তাতে অসন্তোষ হয় না।ইতু কাপড় ভাজ করছিল।মিলন পাশে বসে নিজেও কাপড় ভাজ করতে শুরু করে।ইতু বিরক্ত চোখে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। তুতুন মেঝেতে বসে খেলছে আর বারবার মায়ের দিকে অসহায় চোখে তাকাচ্ছে।তুতুনও মায়ের মেজাজের আঁচ বুঝে গেছে। মিলন ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলে,”ইতু এরকম আচরণ কেন করছো?তুতুন ভয় পাচ্ছে তো।”
ইতু চোখ রাঙিয়ে মিলনের দিকে তাকায়। মিলন চুপিসারে উঠে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়ে।
তুতুনকে ঘুম পাড়িয়ে ইতু ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে দেখে বিছানার এক কোণে একটা প্যাকেট রাখা।সাথে ছোট্ট চিরকুট। “আমি তোমাকে ভালোবাসি ইতু।কে কি বললো তাতে কিছু যায় আসে না আমার।আমার বদমেজাজী ইতুকেই আমি প্রচন্ড ভালোবাসি!ম্যাডামের রাগ কমানোর ঘুষ হিসেবে এই অধম চটপটি নিয়ে এসেছে।রাগ কমিয়ে এবার আমায় উদ্ধার করুন।”
ইতুর মুখে হাসি ফুটে ওঠে।চটপটি দুটো বাটিতে ঢেলে বারান্দায় বসা মিলনের কাছে নিয়ে যায়।মিলন ইতুকে দেখে একগাল হেসে দেয়। ইতু কপট রাগ নিয়ে বলে,”আমি বদমেজাজী? ”
মিলন একচামচ চটপটি মুখে পুরেই বলে,”একটু! ”
*************–
রুশিয়া বেগমকে একদিন হসপিটালে রাখার নির্দেশ দিয়েছে ডাক্তার। সাথির খারাপ লাগছিল বলে নীতু তাকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে।রাত বাজে নটা।সারাদিন হসপিটালে থাকার কারণে নীতুর চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে।চোখের কাজল লেপ্টে রয়েছে।আজ সকালে নীতু মায়ের দেয়া একটা সুতি শাড়ি পড়েছিল।এত দৌড় ঝাপের কারণে পরনের পোশাক কুঁচকে এলোমেলো হয়ে আছে।চুলের খোপাটাও এলিয়ে পড়েছে!তারপরও নীতুর মধ্যে কোন আরষ্টতা দেখা গেলো না। সবটাই অভীক পর্যবেক্ষণ করে! নীতুর এরকম ব্যক্তিত্বে অভীক অনেকটাই অবাক হয়েছে। রুশিয়া বেগম ঘুমিয়ে পরতেই নীতু অভীককে বললো,”মি.অভীক আমি এখন আসি।”
অভীক খেয়াল করলো এই সামন্য বাক্যটা বলার সময়ও নীতুর ঠোঁটে মৃদু হাসি ছিল। অভীক ঠিক সেই সময় আরো একটি বিষয় অনুধাবন করলো। প্রথম থেকেই নীতু তাকে নাম ধরে ডাকছে।তারমানে নীতুর মনে আছে ওই বিদঘুটে সময়টা। অভীকের আবার হাসফাস লাগে! অভীক কখনোই কারো সামনে এতটা উইক ফিল করে নি।তবে আজ কেন?
অভীক নীতুকে এগিয়ে দিতে কেবিন থেকে বের হয় একসাথেই। করিডোর প্যাসেজে দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে।পকেটে হাত ঢুকিয়ে অভীক হাঁটছে।চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ পাশে হাঁটতে থাকা কৃষ্ণবর্ণ মেয়েটির দিকে।কৃষ্ণবর্ণ মুখটিতে ফুটে উঠেছে অন্যরকম এক আত্মবিশ্বাস! নিরবতা ভেঙে অভীক বললো,”মিস নাকি মিসেস বলবো?”
নীতু কপালে ছড়িয়ে পড়া ছোট ছোট চুলগুলো কানের পাশে গুজে দিয়ে বলে,”মিস..!”
অভীক এবার দাঁড়িয়ে পড়ে নীতুর দিকে ফিরে।নীতুও থেমে যায় মুখোমুখি হয়ে।অভীক পুরুষালী গমগম স্বরে বলে,”মিস নীতু আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আজ যদি আপনি সময়মত মাকে নিয়ে হসপিটালে না আসতেন তবে সত্যিই অনেকবড় ক্ষতি হয়ে যেতো আমার।”
নীতু সরাসরি অভীকের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,” মি.অভীক, কারো জন্যই কোন কিছু আটকে বা থমকে থাকে না।।সৃষ্টিকর্তা কারো না কারোর মাধ্যমে শূন্যস্থান পূরণ করে দেন। তাই এসব ফর্মালিটির কোনই প্রয়োজন আমি দেখছি না।
অভীক নীতুর বাচনভঙ্গিতে মুগ্ধ হলো।চোখে একরাশ অস্বস্তি নিয়ে বললো,”ধন্যবাদ না নিলেও সরি টুকু গ্রহণ করলে আমি কৃতজ্ঞ হবো।”
নীতু বুঝতে পারলো কেন অভীক তাকে সরি বলতে চাইছে।কেননা অভীকের চোখে মুখে অনুতপ্ততার রেশ!তাই চোখে মুখে ধারালো অভিব্যক্তি ফুটিয়ে বললো,”মি.অভীক আমরা বড় স্বার্থপর গোছের মানুষ। আমরা যতটা সহজে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি ততটা সহজে অনুতপ্ত হই না।অনুতপ্ত আমরা তখনই হই যখন কৃতজ্ঞতার ভার অধিক হয়ে যায়! আসি ভালো থাকবেন।”
নীতু ব্যস্ত পায়ে হাঁটা শুরু করলো।অভীক ব্যথিত, বিহ্বল ও নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো নীতুর চলে যাওয়ার দিকে।কৃষ্ণবর্ণ মেয়েটির চলার মাঝেও কেমন রুক্ষতা! অভীক আবার অপরাধবোধে বিদ্ধ হলো।হ্যা আজকে নীতুকে দেখার পর থেকে অভীক নিজ কাজে অনুতপ্ত। আজকের আগ পর্যন্ত না নীতুকে মনে ছিল তার, না ছিল কোন অনুতপ্ততা!কৃতজ্ঞতাই যেন অভীককে অনুতপ্ত হতে বাধ্য করলো!অভীকের মনে হলো নীতুর সাথে তার দেখা না হওয়াই ভালো ছিল।
চলবে,
#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১৫
তাজ সকাল থেকেই অলসভাবে বিছানায় শুয়ে ছিল।শরীর মন দুটোই ভীষণ অস্থির তার।সেতুর দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী গতকাল তাজ নীতুর অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে।একটা পলক দেখার আশায় কিন্তু কোথাও নীতুকে দেখতে পায়নি।তাজের ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। নীতু শান্ত ও সরল ধরনের মেয়ে। কোন বিপদ হয়নি তো আবার?এই ঢাকার শহরে নীতু নিজেকে মানিয়ে চলতে পারছে তো?
সেতু প্লাজো আর টপস পড়ে চেয়ারে দু পা উঠিয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ছে।তাজ অবহেলিত চোখে একবার সেতুর দিকে তাকায়। প্লাজো খানিকটা উঠে গিয়ে সেতুর ফর্সা পায়ের গোড়ালির উপরের ভাগটা দেখা যাচ্ছে। তাজ দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।সেতুর এই অষ্টাদশী সৌন্দর্য তাকে পুলকিত করে না।তিন কবুলের মায়া তাজকে জড়াতে পারে না!
তাজ সাবধানী স্বরে সেতুকে বলে,”বাড়ির সবার সাথে তোমার কথা হয়?কেমন আছে তারা?”
সেতু পড়া থামিয়ে কপাল কুঁচকে বলে,”হয়তো।ভালোই আছে সবাই।”
“আর তোমার নীতু আপি কেমন আছে?”
সেতু বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলে, আপি ভালোই আছে।সকালেই তো কথা বললাম।”
“রোজ কথা বলো তোমরা?”
সেতু এবার তাজের দিকে সম্পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।বিয়ের পর থেকে তাজকে সে গম্ভীর ধরনের পুরুষ হিসেবে জানে।আলগা ভাব সে করে না।আজকে তাজকে এত কথা বলতে দেখে কিছুটা অবাকও হয়।মনের কৌতুহল দমিয়ে রেখে বলে,”হ্যা রোজই তো হয় কথা।তবে কাল কথা হয়নি।আপি সারাদিন হসপিটালে ছিলো তো!”
তাজের বুকের রক্ত ছলাৎ করে ওঠে।চোখে নেমে আসে মেঘের ছায়া!ঘাবড়ানো স্বরে বলে,”কি হয়েছে নীতুর?”
“কিছুই হয়নি আপির।পাশের ফ্লাটের আন্টিকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিল!”
সেতু লক্ষ্য করলো না তাজের স্বস্তিদায়ক নিঃশ্বাস! মুখে ফুটে ওঠা মৃদু হাসি। সেতু আবার পড়ায় মনোযোগ দিলো।
শুক্রবার বলেই তাজ সকাল থেকে ঘরে শুয়ে ছিল।জুমার নামাজের সময় হওয়ায় তাজ ট্রাউজার আর গেঞ্জি নিয়ে ওয়াশরুমে যায়।সেতু পড়া শেষ করে নিজের আলমিরায় কাপড় ভাজ করে রাখছিল। কতক্ষণ পর তাজকে ফ্রেশ হয়ে বেড়োতে দেখে সেতু আঁড়চোখে তাজের দিকে তাকায়! কি স্নিগ্ধ একটা বর তার!ভেবেই সেতু আপনমনে লজ্জা পায়।
হুট করে রাবেয়া বেগমকে তাদের রুমে ঢুকতে দেখে সেতু নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।রাবেয়া বেগম উচ্চস্বরে বলে উঠেন,”সকাল থেকে একবারও রুম থেকে বের হওনি শুধু খাওয়া ছাড়া বউমা।আমিই যদি সব কাজ করি তবে তুমি কিসের বউ?”
সেতু নাক মুখ কুঁচকে বলে,”আমি পড়ছিলাম মা।”
রাবেয়া বেগম সেতুর কথায় তেতে উঠে বলেন,”সংসার ধর্ম পালন না করে তুমি পড়াশোনা করছো?এত পড়াশোনা করতে তোমাকে কে বলেছে?যতদূর পড়েছো এটাই ঠিক আছে আমার নাতি নাতকুর মানুষ করতে।পড়াশোনার নামে ফাঁকিবাজি করা লাগবে না।!”
তাজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবি পড়ছিল।সবটাই সে শুনতে পেলেও কোন প্রতিত্তোর করলো না।খুব যত্ন করে হাতে পায়ে লোশন মাখা শুরু করলো।
সেতু আলমিরার দরজা ঠাস করে লাগিয়ে দিয়ে বলে,”মা আপনি যদি ভেবে থাকেন আমি পড়াশোনা করছি বা করেছি আপনার ছেলের ট্যা ট্যা বাচ্চাদের পালন করতে তবে আপনি ভুল ভাবছেন।আমার নিজের জন্য আমি পড়াশোনা করছি।দেখা গেলো কিছুদিন পর আমাকে আপনার ভালো লাগলো না তখন আবার আপনার একমাত্র ছেলেকে বিয়ে দিবেন।তখনকার মাটি শক্ত করছি আমি।”
রাবেয়া বেগম কি বলবেন বুঝতে পারলেন না।রাগান্বিত চোখে ছেলের দিকে তাকালেন।ছেলেকে চুপ থাকতে দেখে রাবেয়া বেগম ফের বললেন,”তোমাকে ছেলের বউ করে এনেছি কেন?পূজা দিবো আমি তোমাকে?বুড়া মানুষ হয়ে একা একা রান্না করি আর ছেলের বউ হয়ে পা তুলে খাবে তুমি।”
সেতু এবার হা হা করে হেসে দিয়ে বিছানায় বসে পরে।শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,”মা মিথ্যে বলবেন না।গত সপ্তাহে আমি রান্না করলাম। আপনি শত ভুল ধরে আমার সাথে গজর গজর করলেন।অথচ আপনি আমাকে বুঝিয়ে দিলেই হতো।আমার রান্না যখন খেতেই পারেন না তবে কিসের জন্য রান্না করবো?”
“ছি ছি কেমন মেয়েমানুষ তুমি?আমার এভাবে কপাল পুড়লো।কিরকম বউ চাইলাম আর পেলাম কি?”‘….রাবেয়া বেগম আর্তনাদ করে বলেন।
সেতু লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে বলে,” কপাল আমারো পুড়েছে।আমি যা এক্সপেক্ট করেছি তা কি পেয়েছি তবে আপনারা পাবেন কেন?আপনাদের বেলা ষোলকলা আর আমার বেলা কাঁচকলা হবে কেন?”……এই কথা বলে সেতু আঁড়চোখে একবার তাজের দিকে তাকিয়ে ফোঁস ফোঁস করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে যায়।
তাজ মাথায় টুপি পড়ে বের হচ্ছিল মসজিদের উদ্দেশ্যে।রাবেয়া বেগম চিল্লায়ে বলে উঠলেন,”দেখলি তোর বউয়ের ব্যবহার?কেমন বেয়াদবি করলো আমার সাথে। তুই মুখে কুলুপ এঁটেছিস কেন?কিচ্ছু বললি না কেন ওকে?”
তাজ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মায়ের দিকে ঘুরে বললো,”মা সেতুকে এই ঘরের বউ করে তুমি এনেছো।ওর ভুলের দায় তো আমার না!আমি যাকে চিনতাম না, জানতাম না তাকে হুট করে কি করে বদলাবো?আর যেখানে আমি ওর স্বামী হয়েই উঠতে পারিনি সেখানে ওকে শাসন করার অধিকারও আমার নেই।আজ এখানে যদি নীতু থাকতো তবে তোমার সাথে বেয়াদবি করার শাস্তি আমি নিজেই দিতাম।অবশ্য নীতুর দ্বারা মুরব্বিদের সাথে বেয়াদবি করা কখনোই হত না!আমার নীতু এরকম মেয়েই নয়!”…….এই কথাগুলো বলে তাজ দপদপ পা ফেলে চলে গেলো। রাবেয়া বেগম ধপাস করে খাটের উপর বসে পড়লো।তার মাথা ঘুরাচ্ছে! নিজের সিদ্ধান্তের কারণে আজ ছেলে এবং ছেলের বউ দুজনের কাছেই সে খারাপ! এ কষ্ট তিনি সইবেন কি করে?
**************
সকাল থেকেই নীতু ভীষণ ব্যস্ত।শুক্রবার দিনটা ফ্রি থাকে বলে সব কাজ গুছিয়ে রাখে।এক সপ্তাহের জন্য মশল্লা ব্লেন্ড করে রাখে,কাপড় চোপড় সব পরিষ্কার করে রাখে। কোনদিন কোন কাপড়টা পড়বে তাও আয়রণ করে ভাজ করে রাখে।ঘর মুছে ঝকঝকে তকতকে করে রাখে। সাথি সোফায় বসে টিভি দেখছিল।নীতুকে এত কাজ করতে দেখে সাথির মেজাজ খারাপ হয়।এত কাজ কিভাবে করে মানুষটা?
সাথি হেলেদুলে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে নীতু পিঠা বানাচ্ছে। সাথি চোখ চোখ বড় বড় করে ফেলে।সাথি এখন বিশ্বাস করে নীতুর দ্বারা সব সম্ভব ।সাথি দেয়ালে হেলান দিয়ে বলে,”আপু তোমার ক্লান্ত লাগে না এত কাজ করতে?”
নীতু পিঠা ভাজতে ভাজতে বলে,”ক্লান্তি কিসের?নিজের কাজে ক্লান্তি আছে?”
“তারপরও আমার ভাগের কাজটুকুও তুমি করো।ছয়টা দিন অফিস করার পর এই একটা দিন তুমি রেষ্ট নাও না।আমার প্রচুর খারাপ লাগে।”….. সাথি মুখ অন্ধকার করে বলে।
নীতু সাথির অভিমানী মুখটার দিকে তাকিয়ে বলে,” পুচকুটা আসুক তখন আমি আর পুচকু আয়েশ করবো আর তুই কাজ করবি।এখন ছুটি কাটিয়ে নে!”
” পিঠা বানাচ্ছো কেন?”
নীতু একটা প্লেটে সাজের পিঠা আর কাঁচামরিচ, সরষে ভর্তা সাজিয়ে সাথির সামনে রেখে বলে,”সেদিন শুনলাম রিপনকে ফোনে বলতেছিলি তোর এই পিঠা খেতে ইচ্ছে করছে।তাই আজ বানিয়ে দিলাম।খেয়ে দেখতো কেমন হয়েছে?”
সাথির চোখে জল এসে যায়। নীতু আপু এত ভালো কেন?একদম মা মা আদর কেন তাকেই করতে হবে?
নিজের চোখের জল মুছে বলে,”আমার সাথে তুমি না খেলে আমি কিন্তু খাবো না।”
নীতু সাথির পাগলামো কথায় হেসে দেয়।
*************
অনীক তখন রুমির সাথে একটা কমিটমেন্টে। অভীক নিজের নতুন অফিসে পাকা পোক্ত ক্যারিয়ার গড়তে ব্যস্ত।সেই ব্যস্ত সময়ই নীতুর সাথে দেখা হয়েছিল অভীকের।
নীতুর বড় বোনের বাসা তখন ছিল চিত্রালীতে।সেখানেই অভীকের ফুপুর বাসা।রুশিয়া বেগম ননদের বাসায় থাকতেই নীতুর সাথে আলাপ হলো।এক আলাপেই তার নীতুকে খুব ভালো লেগে গেলো।ঠিক করলেন ছেলের বউ করবেন।কিন্তু অনীক রাজি হলো না।তার নিজস্ব পছন্দ আছে।তারপরও রুশিয়া বেগম দমলেন না।ছোটছেলের উপর অগাধ বিশ্বাস নিয়েই নীতুর বাসায় হাজির হলেন কয়েক পদের বাহারি মিষ্টি আর ফলমূল নিয়ে। ননদের কোন বারণ শুনলেন না।ছেলেকেও জিজ্ঞেস করলেন না।এক সন্ধ্যায় মোটামুটি কথা পাকা করে নীতুর হাতে এক হাজারের পাঁচটা নোট দিয়ে ছেলের বউ পছন্দ করে রেখে এলেন।
অভীক তখন অফিসের কাজে এতটাই ব্যস্ত যে দম ফেলবার ফুসরৎ নেই!তারপরও রুশিয়া বেগম হাল ছাড়লেন না।পাঁচ আনা স্বর্ণের আংটি তৈরি করলেন নীতুর অনামিকা আঙুলের মাপে।মহিমা বেগমও যেন নীতুর এত ভালো সম্বন্ধ পেয়ে খুশিতে আত্মহারা।যে কৃষ্ণবর্ণ মেয়েটির বারবার বিয়ে ভেঙে যায় তার এত ভালো সম্বন্ধ পেয়ে মহিমা বেগম দুজন এতিম খাওয়ালেন।আত্মীয় স্বজন সবাইকেই মোটামুটি জানিয়ে দিলেন এই সু সংবাদ।
নীতু সবকিছুতেই ছিল নির্বাক।তার একটা বিয়ে যেন এই পরিবারের কাঙ্খিত খুশি।সেটা হোক পিয়নের সাথে বা কোন চাকুরিজীবীর সাথে। তা কোন ম্যাটার করে না,ম্যাটার করে কেবল নীতুর একটা বিয়ে! এত কিছুর মধ্যেও নীতুর মনে খটকা হতে লাগলো।এত দ্রুত কি সব ভালো হয়?হয় না তো।
তাই হলো।রুশিয়া বেগম মিথ্যে বলে ছেলেকে ঢাকা থেকে টেনে হিঁচড়ে খুলনা নিয়ে এলেন।আর নীতুর পরিবারে জানানো হলো,আজ ছেলে আসছে নীতুকে দেখতে আর আজই আংটি বদল।রুশিয়া বেগম, অনীক আর ফুপু তারা আগেই নীতুর বাসায় উপস্থিত হলো। অভীক আসলো একটু দেরিতে।অভীক তখনো জানতো না তার জন্য পাত্রী ঠিক করা হয়েছে।সে নিতান্ত দাওয়াত এটেন্ড করতে এসেছে।অভীক আসার আগেই রুশিয়া বেগম চরম আশ্চর্য কাজটি সেরে ফেললেন।নীতুকে ভারী শাড়ি আর অলংকৃত দেখে আবেগে ভেসে গিয়ে নীতুর অনামিকায় আংটি পড়িয়ে একগাদা দোয়া করে দিলেন।নীতুকে তার কেন এত ভালো লেগেছে সেই কারণ স্বয়ং বিধাতা ছাড়া কেউ জানে না!
অভীক যখন সেই সন্ধ্যায় নীতুদের বাসায় পৌঁছালো তখন হুট করেই বিদ্যুৎ চলে গেলো।নিজেকে আবিষ্কার করলো এক রুম লোকালয়ের সামনে।টেবিলে সাজানো হরেক রকমের পিঠা আর নাস্তার আইটেম দেখে অভীক বুঝে গেলো আজকের আয়োজনের বলির পাঠা সে! মুহুর্তে মেজাজের পারদ থইথই করে বেড়ে গেলো।তার সামনে বসা ঝকমকে শাড়ি পড়া নত মস্তকে বসা মেয়েটিকে বড়ই অসহ্য মনে হতে লাগলো!
অভীক মাকে বুঝাতে পারলো না সে এই মুহুর্তে বিয়ের জন্য রাজি না।তার জবটা আরো গুছিয়ে বিয়ে করতে ইচ্ছুক সে।তা আর হলো না।কালো শার্ট প্যান্ট পড়া অত্যাধিক সুদর্শন পুরুষ টিকে সবারই পছন্দ হলো!নীতুর মা মনে মনে হাজার খানিক দোয়া করে ফেললেন।কিন্তু সেই দোয়া কোন কাজে আসলো না।
অভীক প্রচন্ড রাগে সেখান থেকে প্রস্থান নিলো।রুশিয়া বেগম আহত ও হতভম্ব দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছেলেকে আটকে ধরলেন।হাজার খানিক কসমও দিয়ে ফেললেন ছেলেকে।কোন কিছুতেই অভীকের সিদ্ধান্ত বদলালো না।মায়ের মিথ্যা, অফিসের কাজ,আর অযাচিত নীতু সবকিছুই অভীকের কাছে বিরক্ত লাগছিল।মাকে কোন মতেই বুঝাতে না পেরে শেষতক অভীক বলে ফেললো,”একবারো ভাবলে না মা তোমার পছন্দ করা মেয়ে আমার পছন্দ হবে কিনা?দেখেছো মেয়েটিকে?আমার পাশে যায় তাকে?”
রুশিয়া বেগম ছেলের ব্যবহারে কষ্ট পেলেন।তার ছেলেদের কখনো তিনি অহংকারী বলে জানতেন না।কালো রঙ দেখে ছেলের বিবেচনায় তিনি আহত হলেন।অভীক চলে গেলে কষ্ট পেলেন তিনি।
আর নীতু?নীতু তো গোটা আত্মীয় মহলের কাছে ফের অপমানিত হলো!অভীক যখন চলে গেলো নীতু চোখে টলমল করা জল আর মুখে শ্লেষাত্মক হাসি নিয়ে অনামিকায় জ্বলজ্বল করা আংটির দিকে তাকিয়ে রইলো।কেউ বুঝলো না নীতুর কতটা কষ্ট হলো?অভীকের পরিবার চলে যাওয়ার পর মা নীতুর উপর চাউর হলো।অতি দুঃখে তিনি জনম দুঃখী মেয়েটিকে কুৎসিত কুৎসিত গালি দিলো।
অভীক যখন বুঝতে পারলো তার ভুল হয়েছে।তার আচরণে মা এবং সেই মেয়েটা অপমানিত হয়েছে।ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।মাস পার হয়েছে।নীতুর কাছে অভীকের মাফ চাওয়া হলো না।কিন্তু একটা অপরাধ বোধ হতে লাগলো।অভীক কখনো গায়ের রঙ দিয়ে মানুষ বিচার করেনি।অভীকের কাছে ব্যক্তিত্ব বড়।কিন্তু রাগের মাথায় ভুল করে ফেলেছে।নীতুর কাছে তার মাফ চাওয়া হলো না কিন্তু রুশিয়া বেগমের হাতে পায়ে ধরে ঠিকেই মাফ চাওয়া হয়েছিলো।এবং সেদিনই ঠিক করেছি মায়ের পছন্দেই বিয়ে করবে সে!
আজ এতদিন পর নীতুকে দেখে পুরানো সেই অপরাধ বোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। পড়ন্ত সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে অভীক আনমনে এসবই ভাবছিল ঠিক তখনই ফুপু এসে অভীকের পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,”এত কিসের চিন্তা করছিস বাবা?”
অভীক প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,”মা ঘুমিয়েছে ফুপি?”
“কথা ঘোরাস না বাবা।বল কি হয়েছে? ”
অভীক ফুপুর হাতটা মুঠো করে ধরে।ভীষণ অস্থিরতা নিয়ে বলে,”আমার ভীষণ অস্থির লাগছে ফুপি।এক ধরনের অপরাধ বোধ আমার বুকের ভিতর কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে! এই শিক্ষা তো ফুপু আমি পাইনি।তবে কি করে আমি কাউকে এতটা কষ্ট দিলাম?নিজেকে বড় অমানুষ মনে হচ্ছে! ”
ফুপু নিরবে হাত বুলালেন অভীকের চুলে।তারপর মৃদু স্বরে বললেন,”অনুতপ্তের থেকে বড় শাস্তি হয় না।অভীক, এটা কি শুধুই একটা মেয়েকে সমাজে হেনস্তা করার জন্য অপরাধ বোধ নাকি অন্য কিছু?”
অভীক বারান্দার রেলিং দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরে বলে,”আমি জানি না ফুপি।আমি কিচ্ছুটি জানি না!আমার বড় অস্থির লাগছে ফুপি!দমবন্ধকর অনুভূতি হচ্ছে। ”
********
নীতু সকালে অফিসে গিয়ে দেখলো সবাই ভীষণ তটস্থ! হুড়োহুড়ি করে কাজ করছে।এমনকি বড় স্যারকেও বলতে শুনলো,”সবকাজ সুন্দর মত করো।যেন কোন ভুল না ধরতে পারে!”
নীতু তার এক মেয়ে কলিগকে প্রশ্ন করলো,”কি ব্যাপার আজ কেউ আসছে নাকি?এত ব্যস্ততা সবার?”
মেয়েটি গড়গড় করে বলতে শুরু করলো,”আজ এসএম স্যার আসছে।সে ভীষণ কঠোর!বড় স্যার পর্যন্ত তাকে সমঝে চলে এমন ব্যক্তিত্ব তার!”
নীতুর ভীষণ আগ্রহ হলো এই নতুন স্যারটিকে দেখার।কে সে?নীতুরও কেমন ভয় হতে লাগলো!
চলবে,