কাননবালা পর্ব-২২+২৩

0
622

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২২

মধ্য দুপুরের সময় নিখিল এসে হাজির হলো নীতুর অফিসে।নীতু নিজের ডেস্কে কাজ করছিল।হুট করে ভাইয়াকে অফিসে দেখে নীতু চমকালো।বাবার কিছু হলো না তো?এই চিন্তায় কলিজা ধ্বক করে উঠলো।নিখিল নীতুর আতংকিত চাহনি দেখে বললো,”কারো কিছু হয়নি নীতু।সবাই ভালো আছে।অফিসের কাজে ঢাকা আসলাম।তাই ভাবলাম তোর সাথে দেখা করে যাই।”

নীতু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,”খুব ভালো করেছো ভাইয়া।এবার বলো কেমন আছে বাড়ির সবাই?

নিখিল ভালো আছে বলতেই নীতু ব্যস্ত স্বরে বললো,”দুপুরের খাবার খেয়েছো ভাইয়া?”

নিখিল হোটেলের খাবার খেতে পারে না।রুটি কলা কিনে খেয়েছে।তাই মিথ্যে করে বললো,”খেয়েছি।”

নীতু গভীর দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ফের উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো,”তুমি একটু বসো ভাইয়া।আমি আসছি।”

নীতু অভীকের কেবিনে নক করে প্রবেশ করে দেখলো অভীক আর পলাশ বসে কি একটা প্রজেক্ট নিয়ে ডিসকাস করছে।অভীক এই সময়ে নীতুকে দেখে বিরক্ত হলো।চোখ মুখ খিচিয়ে বললো,” কোন প্রবলেম মিস নীতু? ”

নীতু চোখের দৃষ্টিতে অনুনয় করে বললো,”স্যার ইভেনিং শিফটে আমার ছুটির প্রয়োজন ছিল।প্রমিজ নেক্সট ডে আমি আজকের সময়টা এক্সট্রা করে পুষিয়ে দিবো।”

পলাশ আর অভীক দুজনেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো।অভীক কিছু বলার পূর্বেই পলাশ বলে উঠলো,”তোমার শরীর ঠিক আছে তো নীতু?”

নীতু পলাশের করা প্রশ্নে বিরক্ত হলো।এই বেটার অতিরিক্ত আহ্লাদে অভীক খেপে গিয়ে ছুটি ক্যানসেল করে দিতে পারে।পলাশকে সম্পূর্ণ ইগনোর করে অভীক নীতুর দিকে শীতল চাহনিতে তাকিয়ে বললো,”হটাৎ এত ইমার্জেন্সী?”

“স্যার ভাইয়া এসেছে।আবার আজই চলে যাবে। তাই…..”

নীতু কথা শেষ করার আগেই পলাশ অতি দ্রুত বলে উঠলো, “নীতু তোমার ভাই এসেছে আগে বলবে না।তার সাথে আলাপ করতাম।”
নীতু মনে মনে ফের নিজের কপাল চাপড়ালো। অভীক গরম দৃষ্টিতে পলাশের দিকে তাকালো।পলাশ চুপ হয়ে গেলো। নীতুর দিকে না তাকিয়েই বললো,”আপনি এখন আসতে পারেন মিস নীতু। আপনার ছুটি মঞ্জুর করা হলো।”

নীতু ধন্যবাদ বলেই কাচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসলো।নিখিলকে নিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে একটা সিএনজিতে উঠে পড়লো।নিখিলের হাজার বারণ কিছুই শুনলো না।গাড়িতে বসেই সাথিকে ফ্রিজ থেকে মাছ মুরগী বের করে ভিজিয়ে রাখতে বললো।

নিখিল শুধু অবাক চোখে দেখলো তার শান্ত বোনটা কেমন চঞ্চল হরিণীর মত ছুটছে।অফিসের ড্রেস চেঞ্জ না করেই চুলগুলো হাত খোঁপা করে রান্নাঘরে ঢুকে পড়লো।কিছুক্ষণ পরেই নিখিলকে শুকনো খাবার সামনে দিয়ে রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।কাঁচকি মাছের চড়চড়ি, মুরগী ভূনা,ডিম বেগুন ভাজি করলো।সবটাই নিখিল দেখলো।

খেতে বসে নিখিলের চোখে পানি এসে গেলো।নীতু খুব যত্নের সাথে ভাইয়ের জন্য খাবার পরিবেশন করলো।নিখিলের মনে হলে মায়ের পরে তার এই বোনটার যত্নে কেমন যেন মা মা গন্ধ আসে!অথচ সব বোনের মধ্যে নিখিল সবসময় নীতুর বেলাই ভীষণ উদাসীন ছিল, নীতুকেই সবচেয়ে বেশি অবহেলা করেছে। অন্যমনষ্কতার কারণে ভাতের পাতে নিখিল হুট করে বিষম খেলো।নীতু দিগবিদিক ভুলে নিখিলের মাথায় পিঠে চাপড় দিলো।পানির গ্লাসটা ধরে বসলো মুখের কাছে।উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠলো,”ভাতের পাতে এত কিসের তাড়া তোমার ভাইয়া?”

নিখিল গাঢ় অপরাধবোধে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো।ভাতের পাতেই হু হু করে কেঁদে দিলো। ভাইকে ছোটো বাচ্চাদের মত কাঁদতে দেখে নীতু মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে রইলো!

**********

সময়টা যেন দ্রুতই গড়িয়ে যাচ্ছে।দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেলো।সেতুর পরিক্ষা শেষ হয়েছে।রাবেয়া বেগম বার বার ফোন করে ঢাকা যেতে বলছেন।সেতু নিজের সিদ্ধান্তে দ্বিধান্বিত! তাজ সেদিন স্ল্যাং ইউজ করে তার সাথে কথা বলেছে।সেতু সে রাতে সারা রাত কাঁদলো।শেষ রাতের দিকে তাজ ছোট্ট একটা টেক্সট পাঠালো,”সরি!”

সেই পর্যন্তই, আর তাজ কোন কল দেয়নি সেতুকে।সেতু নিজেও কোন কল দেয়নি। যে মানুষটার কাছে সেতুর থাকা আর না থাকায় কোন মাথা ব্যথা নেই,তার কাছে সেতুর ফিরতে ইচ্ছা হলো না।
কিন্তু মন নামক বেহায়া স্বত্বাটা যেন সেই সিদ্ধান্ত মানতে ঘোর বিরোধিতা করছে।সেতু যখন নিজের টালমাটাল মন নিয়ে অস্থির ঠিক তখনই নীতু কল করে জানালো তার বাসায় ছোট একটা প্রোগ্রাম আছে। ইতু আপারা নাকি যাচ্ছে তাদের সাথে চলে আসতে।

সাথির প্রেগ্ন্যাসির সাত মাস চলছে।নীতু ঠিক করলো সাতোসা করবে।বাবা মাকে মেয়েটা কাছে পাচ্ছে না।তাই ছোট খাটো একটা আয়োজন করে সাথিকে শুভেচ্ছা জানাবে।
এই কথা জানার পর থেকেই সাথি অরবরত কেঁদে চলছে।রিপন কল করে নীতুকে অসংখ্য বার ধন্যবাদ দিয়ে ফেলেছে।নীতু যতই বলছে এটা সাথির প্রাপ্য, তবুও তারা নীতুকে ধন্যবাদ দিয়েই যাচ্ছে!

**************-
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জায়েদ,বড় আপা,বাচ্চারা ইতু মিলন,তুতুন,সেতু, শরীফুল কাকা এসে হাজির হলো।নীতু সবাইকে ভীষণ মিস করছিল।কিন্তু খুলনা যাওয়া সম্ভব নয়,অফিস আছে।তাই এই উপলক্ষে সবাইকে ডেকে নিলো।বড় আপা আর ইতু আসার পর থেকে নীতুকে জরিয়ে ধরে বসে আছে।অভিমানী বোনটার অভিমান ভাঙাবার চেষ্টা আর কি! নীতু বলে উঠলো,”মা বাবাকে খুব মনে পড়ছে।”
নীতুর কথায় দু’বোন শব্দ করে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। সেতু অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিল।নীতু দুই হাত প্রসারিত করে চোখের ইশারায় কাছে ডাকলো।সেতু ছোট্ট বিড়াল ছানার মত এসে নীতুর কোলে মুখ গুজলো। জায়েদ হাই তুলতে তুলতে বললো,”মেয়েরা এত কাঁদতে পারে!বাবারে বাবা! চোখের জলে ভেসে যাওয়ার উপক্রম! ”
মিলন আর শরীফুল কাকা হেসে দিল।ইতু ফোঁস করে বলে উঠলো,”ভাইয়া আপনার ইচ্ছা হলে আপনিও কাঁদতে পারেন, আমরা মাইন্ড করবো না।”

সাথি ফোলা পেট নিয়েই তাদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসলো। নীতু ধমকে উঠে বললো,”তোকে এসব করতে বলেছে কে?সারাক্ষণ ছুটাছুটি।”
সাথি মৃদু হাসলো। সেতু ব্যাঙাচির মত লাফ দিয়ে সাথির কাছে এসে বললো,”তোমাকে তো খুব কিউট লাগছে!”

সাথির চোখে পানি এসে গেলো।এই মানুষ গুলো কত সহজে তাকে আপন করে নিয়েছে।শরীফুল কাকা এসে সাথিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে কাছে বসালো।সাথি বললো,”মামা আপনাকে দুটো ধন্যবাদ দেওয়ার আছে আমার।এক রিপনের সাথে আমার বিয়ে দেবার জন্য দুই নীতু আপুর মত একটা মানুষকে আমার কাছে পাঠাবার জন্য আমার বোন করে!”
শরীফুল কাকা কেবল হাসলো।কিছু বললো না।

রাতটা কাটলো গল্প করে আর পরের দিনের প্রোগ্রামের আয়োজন সম্বন্ধে কথা বলে।

*********
অনীক এসেছে তার বউকে নিয়ে দুদিন হলো।মা আর বউয়ের সমোঝোতা করাতে।রুমি অবশ্য আসতে চায়নি।অনেক কাঠখোর পোহাতে হয়েছে তার জন্য। রুশিয়া বেগম সকাল সকাল উঠেই অভীককে ঘুম থেকে টেনে তুললো।অভীক ঘুম জড়িত কন্ঠে বললো,”উফ মা,কি করছো?ছুটির দিনেও ঘুমাতে পারবো না?”

রুশিয়া অনুরোধের স্বরে বলে,”আজ আর ঘুমাতে হবে না।পাশের ফ্লাটে গিয়ে দেখ তাদের কিছু লাগবে কিনা?মেয়েটা একা একা সব করছে।”

মায়ের কথা কানে যেতেই অভীক তড়িৎ গতিতে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে ওয়াশরুমে দৌড় দেয়।ছেলের এহেন আচরণে রুশিয়া বেগম সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

রুশিয়া বেগম অভীকের রুম থেকে বের হয়ে দেখেন অনীক কিচেনে।
“কি করছিস?”

“চায়ের পানি চড়ালাম মা।তুমি খাবে?”…. অনীক শান্ত কন্ঠে বলে।

রুশিয়া বেগম চোখ মটকে বলেন,” তুই সর।আমি করছি।তোর বউ এখনো ওঠেনি? ”

অনীক প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ে। রুমির ঘুম কখনো কি এত সকালে ভাঙে? তারপর বলে,”মা রাতে ঠিকমত ঘুম হয়নি তাই ঘুমাচ্ছে,ছোটো কই?”

চায়ের কেটলিতে চা-পাতা দিতে দিতে রুশিয়া বেগম বলেন,”হয়েছে হয়েছে বউয়ের জন্য আর মিথ্যে বলতে হবে না।অভীক আসছে।”

অনীক মায়ের কথায় মৃদু হাসে।একটু পরেই অভীক এসে হাজির হয়।”মা আমি বেরোচ্ছি। “….বলে চলে যেতে নেয় দ্রুত পায়ে।
” আরে কই যাচ্ছিস?চা খেয়ে যা।”…অনীক বলে।

“সময় নেই বড়ো,ফিরে ব্রেকফাস্ট করবো একসাথে। “… বলে অভীক চলে যায়।
অনীক ভাইয়ের যাওয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে,” এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছে মা?”

রুশিয়া বেগম নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,”তোকে না বললাম, আজ দুপুরে পাশের ফ্লাটে দাওয়াত আমাদের।সেখানেই যাচ্ছে। যদি কোন হেল্পের দরকার হয় তো।”

অনীক বিস্মিত কন্ঠে বলে,”মা তুমি ফাজলামো করছো?আমাদের ছোটো বাহিরের কারোর জন্য হেল্পিং হ্যান্ড হতে যাচ্ছে।সিরিয়াসলি?তাও এত আগ্রহ নিয়ে, কাহিনী কি বলতো?”

রুশিয়া বেগম ছেলের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে নিজেও একটা তুলে নেন।তারপর মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলেন,”কাহিনী না হয় নিজেই দেখে নিস,দুপুরে তো যাচ্ছি সেখানে আমরা।”

অনীক মায়ের হেয়ালীপূর্ণ কথায় ভুরু কুঁচকে তাকালো।রুশিয়া বেগম বলে উঠলেন,”দুপুরে তোর বউকে শাড়ি পড়তে বলিস,ওসব মডার্ণ ড্রেস যেন না পড়ে।”

অনীকের কপালে ভাঁজ পড়লো। রুমি আর শাড়ি?ভাবতেই শুকনো ঢোক গিললো।

**********
অভীক ফ্লাট থেকে বের হতেই দেখলো নীতু মিষ্টি রঙের একটা জামা পড়ে দরজায় তালা দিয়ে বের হচ্ছে।চুলে এলানো খোঁপা।চোখে মুখে ঘুমের স্নিগ্ধতা। ওড়নাটা শালের মত জরিয়ে পড়েছে,পায়ে দু বেল্টের স্লিপার, হাতে পার্স ব্যাগ।এত সাধারণের মাঝেও অসাধারণ অভিব্যক্তি!
“কোথাও বেরোচ্ছেন মিস নীতু?”….. আকস্মিক শব্দে নীতু চমকে উঠলো।নীতুর ভয় পাওয়া মুখ দেখে অভীক হেসে ফেললো।
” আপনি এত সকালে?”….নীতু বলে।

“মা আপনাদের এখানেই পাঠালো,যদি কোন হেল্প লাগে তাই আর কি।”…. ট্রাউজারের পকেটে দুই হাত পুরে বলে অভীক।

” ধন্যবাদ, কিন্তু এসবের প্রয়োজন ছিল না।”…..নীতু মৃদু হেসে বলে।

“সেসব পরে দেখা যাবে,এত সকালে কোথায় যাচ্ছেন?”

রাত জাগার ফলে সবাই ঘুমাচ্ছে,তারউপর প্রত্যেকে জার্নি করেছে।তাই নীতু তাদের ঘুম থেকে না উঠিয়ে নিজেই যাচ্ছে।

“ফুল কিনতে।”…..

” মিস নীতু আপনার সঙ্গী হতে পারি?”

নীতু সরাসরি না বলতে চাইলো কিন্তু অভীকের আগ্রহী চাহনি দেখে আর না করলো না।মৃদু হেসে সম্মতি জানালো।

**********

দুটো মানুষ রিকশায় বসে আছে।একজন ভীষণ অস্বস্তি ফিল করছে আর একজন পাশে বসা মানুষটার অস্বস্তি উপভোগ করছে।ফুল কিনতে দুজনে হেঁটে গেলেও আসার পথে রিকশা নিতে হয়েছে।দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই।নীতুকে সরে বসতে দেখে অভীক ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেললো। নীতু বিস্মিত আর অস্বস্তি ভরা দৃষ্টি নিয়ে বললো,”হাসছেন কেন?”
অভীক এবার শব্দ করেই হেসে ফেললো।নীতু রাগ নিয়ে বললো,”ভালো হবে না বলছি,এত হাসির কি হলো?”

অভীকের ত্যাড়া উত্তর, “আমার দাঁত দিয়ে আমি হাসলে আপনার সমস্যা কি?”

“হাসির একটা কারণ লাগে।বিনে কারণে হাসে পাগলে।আপনি কি নিজেকে পাগল বলে আখ্যায়িত করাতে চাইছেন ?”….. ঝাঁজালো স্বরে বলে নীতু।এত কাছ থেকে অভীকের এমন জ্বলন্ত হাসি নীতুর সহ্য হচ্ছে না।

নীতুর হাতে থাকা ফুলের ব্যাগ থেকে একটা সাদা গোলাপ নিয়ে অভীক নীতুর কানে পাশে গুজে দেয় সংকোচ বিহীন হাতে,সরাসরি নীতুর পদ্মদিঘির ন্যায় চোখের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে বলে,” পাগল হলে মন্দ হয় না, বলুন মিস নীতু? ”
নীতু ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় অভীকের আচরণে।নীতুর চাহনি দেখে অভীক পুনরায় হেসে ফেলে।চোখের সামনে সুদর্শন পুরুষের সুদর্শন হাসি দেখে নীতু বারকয়েক চোখের পলক ফেলে। অভীক একই ভাবে তাকিয়ে বলে,”এত অস্বস্তির কি আছে?”

ঠিক তখনই রিকশায় ঝাকি লাগলে অসাবধানতা বশত নীতু পড়ে যেতে নিলে অভীক নীতুর হাত ধরে বসে।নীতু চমকায় অভীকের স্পর্শে।এর থেকে পড়ে যাওয়াই ভালো। অভীকের কেন যেন নীতুর হাত ছাড়তে মনে চাইলো না।নিজের হাতের মুঠোয় আলতো করে ধরে বসে থাকলো বাকিটা পথ। নীতুও হাত সরালো না। কিন্তু আশ্চর্য দৃষ্টি নিয়ে দেখলো শুভ্র পৌরষালী হাতের মাঝে তার কালো হাতটি কেমন মিলেমিশে গেছে।অভীক নীতুর বিস্মিত চাহনী উপেক্ষা করে নিজের আঙুলের ভাঁজে নীতুর আঙুল গুজে রাখলো।
কৃষ্ণ মুখশ্রীর ডান পাশে থাকা সাদা গোলাপটাও যেন বিস্মিত হয়েছে অভীকের আচরণে!

চলবে,

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২৩

জীবনে কিছু কিছু মুহূর্ত বা ঘটনার সম্মুখীন আমাদের হতে হয় যার কোন সঠিক ব্যাখ্যা থাকে না। আকস্মিক সেই মুহুর্তগুলো কখনো আমাদের কাঁদায়-হাসায় , অনুভুতির জোয়ারে ভাসায় বা ফেলে দেয় গহীন অন্ধকার গহ্বরে!
নীতুর এখন ঠিক সেই মুহুর্ত চলছে।অভীক খুব সহজেই নীতুর হাত ধরলো অথচ নীতু কোন রিয়েকশন দেখালো না।নীতুর তখন কি হয়েছিল নীতু নিজেই জানে না।ওই যে, কোন কোন মুহুর্তের কোন ব্যাখ্যা থাকে না!

রিকশাটা বাসার সামনে থামতেই নীতুর হাত ছেড়ে দিল অভীক।নীতুর মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না। অভীক পকেটে দু হাত পুরে দাঁড়ালো।নীতুর কপাল কুঁচকে গেলো।নীতু সেই কুঁচকানো কপাল নিয়েই রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটালো।নীতু খানিকটা আশ্চর্যই হলো!অভীক সেদিনও ভাড়া দেয়নি, আজও দেয়নি।সাধারণত পুরুষ কেউ সঙ্গে থাকলে তারাই যেচে ভাড়া দেয়।কিন্তু অভীক যেন তার উল্টো।

*****
নীতু বাসায় ফিরে দেখলো সবাই উঠে পড়েছে।দাদাভাই কতক্ষণ গজগজ করলো।কেন তাকে না বলে নীতু বাহিরে গেলো?এতটুকু সে পারতো না?
নীতু আপনমনেই হাসলো।দাদাভাই পারলে তাকে গোটা পৃথিবীটা এনে সামনে ফেলে।
সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলো।সেতু সাথিকে সাজাতে লেগে পরলো।ইতু মিতু দুজনেই রান্নার প্রিপারেশন করছে।নীতু বসার ঘরটা ফুল দিয়ে সাজালো। ছেলেদের কোন কাজ না থাকলেও সবাই টুকটাক কাজ করে এগিয়ে দিচ্ছিল।রিপন গোটা দশেক কল করে নীতুর মেজাজ খারাপ করে দিয়েছে।সাথি তৈরি হচ্ছে বলে কল রিসিভ করেনি তাই নীতুর জ্বালাতন সহ্য করতে হচ্ছে।

নীতু এক কাপ চা করে শরীফুল কাকার সামনে রাখলো।তিনি মনোযোগ সহকারে টিভি দেখছিলেন।চায়ের কাপটা হাতে তুলে তিনি মৃদু হাসলেন।নীতু তার পাশে বসে বললো,”কাকা আপনি কি রিশার কোন খবর জানেন?”

শরীফুল কাকা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।তারপর বললেন,”মা রে যে নিজ থেকে হারিয়ে যায় তাকে খুঁজে পাওয়া কি এতই সহজ?”
নীতুর চোখ ছলছল করে উঠলো।ঢাকা আসার পর রিশার সাথে তার হাতে গোনা কয়েকদিন কথা হয়েছে।মেয়েটা কল করলে রিসিভ করে না। যা ফোন দেয়ার নিজ থেকেই দেবে।এই একটা সপ্তাহ কতবার যে ফোনে ট্রাই করেছে? কিন্ত তার কোন খবর নেই! নীতুর চোখে পানি দেখে শরীফুল কাকা নীতুর মাথায় হাত রেখে বললেন,”কাঁদিস না মা।ওই উড়নচণ্ডীকে যেমন তুই ভালোবাসিস তেমনি ও তোকে ভালোবাসে,দেখবি নিজে থেকেই তোর সাথে যোগাযোগ করবে।”

নীতু ছলছল চোখেই ম্লান হাসলো,কোন কথা খুঁজে পেলো না।

**********

কারেন্টের মোটা থামের উপর তাজ বসে আছে।চোখের দৃষ্টি রক্তাভ ,হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।অনবরত সিগারেট ফুঁকছে তাজ।নিজেকে মাঝে মাঝে তার চেইন স্মোকার মনে হয়। সামনের বাড়িটির দিকে তাকিয়ে তাজ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।ওয়াক থু বলে একদলা থুতু ফেলে ধুলোপড়া রাস্তায়! কালসিটে পড়া ঠোঁটে আবার সিগারেটের টান মারে।গতকাল রাতে জায়েদ তাকে কল করে নীতুর বাসায় যাওয়ার নিমন্ত্রণ করেছে।পাশে নীতুও ছিল।সেও সৌজন্যের খাতিরে তাজ কে যেতে বলেছে।তাজ মনে মনে নীতুকে বিশ্রী একটা গালি দেয়।এই মেয়ের কতবড় সাহস তাকে বোন জামাই হিসেবে ট্রিট করছে? তাজ তখন কোন জবাব না দিলেও ভেবেছিল নীতুদের বাসায় যাবে না।কোনমতেই না।কিন্তু তাজ সে ভাবনা বাস্তবে পরিণত করতে পারেনি।সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে সকালে হাঁটতে হাঁটতে নীতুর বাসার সামনে চলে এসেছে।তাজ যে এটা ইচ্ছা করেছে তা কিন্তু নয়।নিজের অজান্তেই চলে এসেছে।আসার পরই বুঝতে পেরেছে এখানে আসাটা ঠিক হয়নি।চলে যেতে চেয়েও পারছে না।নীতুকে একপলক দেখে যেতে মনে চাইছিল।এইসব আবোল তাবোল ভাবনায় তাজ নিজের মনটাকেও কতক্ষণ বিশ্রী গালি দিলো।ঠিক সেই মুহুর্তেই দেখতে পেলো নীতুর হাত ধরে একটা ছেলে বসে আছে রিকশায়। রিকশাটা যখন বাসার সামনে থামলো তাজ স্তব্ধ হয়ে দেখলো।নীতুর কৃষ্ণ মুখটার ডান কানে একটা সাদা গোলাপ জ্বলজ্বল করছে আর হাত ধরে রেখেছে একটা ছেলে যত্ন করে।তখন থেকেই তাজের মন বিক্ষিপ্ত! মেজাজ চড়ে আছে সপ্তমে।কে এই ছেলে? গত তিন ঘন্টা যাবত এই ভাবনাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে!

“তুমি কি অসুস্থ? ”
কারো আৎকে উঠা প্রশ্নে তাজ কপাল কুঁচকে তাকালো। সামনে বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটিকে প্রথমে চিনতে না পারলেও পরে চিনতে পারলো।স্মৃতি শক্তির যাচ্ছে তাই অবস্থায় খানিকটা বিরক্তও হলো তাজ।
তুতুন কান্না করছিল বলে মিলন তাকে নিয়ে বাসার নিচে হাঁটাহাঁটি করছিল।তখনই নজরে আটকায় তাজ বসে আছে থামের উপর। মিলন বিস্মিত দৃষ্টিতে এখনও তাজের দিকে তাকিয়ে আছে।তাজকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে দীর্ঘদীন অনিদ্রায় ভুগছে, চোখের কোলে কালি,গালে কয়েকদিনের না কামানো দাঁড়ি,চুলগুলো বড় বড়,চোখের মণি টকটকে লাল।মিলন তাজের পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলালো। এ্যাশ রঙের শার্ট হাতা গুটিয়ে পরেছে, যা কয়েক স্থানে কুঁচকে আছে।উপরের দুটি বোতাম খোলা,টাইট জিন্স, পায়ে স্লিপার, হাতে সিগারেট। মিলন চুপিসারে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পুনুরায় বললো,”তুমি কি অসুস্থ? শরীরের একি অবস্থা? ”

তাজ ফ্যাকাসে হাসলো।সিগারেট টা ছুঁড়ে মারলো রাস্তায়। এরপর বললো,”অসুস্থ নয়,একটু কাজের প্রেসার যাচ্ছে।আপনি কেমন আছেন?”

মিলন অসন্তোষ কন্ঠে বললো, “ভালো আছি,আগে নিজের শরীর তারপর কাজ।তোমার দিকে তো তাকানোই যাচ্ছে না।”
তাজ এসব আহ্লাদী কথায় মনে মনে বিরক্ত হলো।আজকাল বড় অল্পতেই বিরক্ত এসে যায়।
মিলন ফের বললো, “চলো উপরে চলো।নিচে বসে আছো কেন?নাকি চিনতে পারছিলে না?”

তাজ বাঁধা দিয়ে বললো,”ভাইয়া এখানে একটা কাজ ছিল তাই এসেছি।আর অগোছালো ভাবে অনুষ্ঠানে যাওয়া ঠিক হবে না।আমি না হয় তৈরি হয়ে আসি।”

মিলন সন্দেহের চোখে তাকালো।তার কেন যেন মনে হলো তাজ এখান থেকে চলে গেলে আর আসবেনা।তাই বললো,”পুরুষের আবার গোছালো আর অগোছালো কি?এসব নিয়ে চিন্তা করে মেয়েরা।চলতো ভাই।”

একপ্রকার জোর করেই মিলন উপরে নিয়ে গেলো তাজকে।কলিং বেলের শব্দে নীতু দরজা খুলেই চমকে গেলো সামনে দাঁড়ানো তাজকে দেখে।চোখের দৃষ্টি কেপে উঠলো।নিজেকে সামলাতে দরজার কপাট চেপে ধরলো।তাজকে দেখে শুধু নীতু নয় বাসার প্রতিটা সদস্যই চমকালো।সবার চমকানো দৃষ্টি দেখে তাজ বড় অস্বস্তিতে পরলো।সেতু মাত্রই নিজে তৈরি হয় রুম থেকে বের হয়েছে।বসার রুমে তাজকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে চোখে পানি এসে গেলো।উজ্জ্বল গাত্রের মানুষটাকে কেমন ফ্যাকাশে নিষ্প্রাণ দেখাচ্ছে। এতদিনের অভিমান, ফিরে না যাওয়ার প্রতিজ্ঞা সব কিছু মুহুর্তেই জলের স্রোতের ন্যায় ভেসে গেলো।বিড়বিড় করে বলে উঠলো সেতু,”এত ভালোবাসলেন কেন তাকে?একটু কম বাসলে কি ক্ষতি হতো?তার শূন্যতায় যদি এতটাই ক্ষতবিক্ষত হবেন তবে কেন চলে যেতে দিলেন?আপনার এই রুপ যে আমার চোখে সহ্য হয় না।”

সেতু টলমল পায়ে তাজের সামনে এসে দাঁড়ালো।নীতু তখনও দাড়িয়ে আছে দরজার পাশে।তাজকে দেখেই বুঝে ফেলেছে ভালো নেই তাজ।নীতু দুচোখের পাতা বন্ধ করে বড় করে দম ফেললো।নিজেকে সামলে নিল খুব সহজে। ‘অপূর্ণতার স্বাদ পেয়ে যারা বড় হয় তারা খুব অল্পতেই সকল পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে কিন্তু অপূর্ণতা যাদের কখনো ছুঁতে পারে নি তাদের জন্য অপূর্ণতা আসে অভিশাপ হয়ে!’
নীতুর ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।তাজকে না পাওয়া সে যতটা সহজে মেনে নিতে পেরেছে ততটা সহজে তাজ পারেনি।

বসার রুমে যেন গুমোট ভাব তৈরি হয়েছে।সবাই চুপচাপ। জায়েদ সবাইকে স্বাভাবিক করতে বলে ওঠে, “ভায়রাভাই তোমার অবস্থা দেখি বউ বিরহে দেবদাস! ”

মিলন এই কথায় হাসলেও আর কেউ হাসতে পারলো না।ইতু চিন্তিত দৃষ্টিতে জায়েদের দিকে তাকালো।জায়েদ চোখের পলকে ইতুকে শান্ত হতে বললো।মিতু বলে উঠলো,”সেতু তাজকে নিয়ে রুমে যা।ফ্রেস হোক ও।আমি নাস্তা দিচ্ছি।”

নীতু চুপচাপ এগিয়ে আসলো।সেতুকে বললো রুমে যেতে।এরপর নিজ হাতেই তাজের জন্য নাস্তা সাজালো। তাজ একবারো নীতুর দিকে তাকালো না।তাজ অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বে উঠে পড়লো।এখানে আসাটা যে চরম বোকামি হয়েছে তা বুঝতে পেরে নিজের কাছেই খারাপ লাগছে।তাজ রুমে ঢুকতেই সেতু হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করলো আর সাথে সাথেই ঝড়ের গতিতে তাজকে জরিয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললো।তাজের নিজেকে সামলাতে বেগ পেতে হলো।তাজ নড়লো না একচুল।সেতুকে ঠিক হতে সময় দিল।সেতু কেঁদে কেটে নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলেছে। তাজ শান্ত স্বরে বলে, “আমাকে ছাড়ো সেতু।”
সেতু আরো আঁকড়ে ধরে বলে,” ছাড়বো না।”

“আমার শরীরে সিগারেটের গন্ধ। ছাড়ো!”

“থাকুক তবুও ছাড়বো না”

তাজ হালছাড়া কন্ঠে বলে,”বাপের বাড়ি থেকে খেয়ে দেয়ে ভালোই তো সবল হয়ে এসেছো।তোমাকে ছাড়াতে এখন আমার ঘাম ঝরাতে হচ্ছে।”

সেতু শাসানোর সুরে বললো,”একদম ফালতু কথা বলবেন না,বরং আপনি দূর্বল হয়ে গেছেন।”

“আচ্ছা ঠিক আছে,এখন ছাড়ো।খিদে পেয়েছে।ফ্রেস হতে হবে তো।”
এই কথায় কাজ হলো। সেতু ব্যস্ত পায়ে সরে দাঁড়ালো।ছটফটিয়ে রুম থেকে চলে গেলো খাবারের ব্যবস্থা করতে।

*********
রুমি শাড়ি পরেছে কিন্তু এলোমেলো ভাবে।তাই ঠিক মত হাঁটতে পারছে না।বারবার শাড়ি পায়ের সাথে পেঁচিয়ে যাচ্ছে।রুমি বিরক্ত হলো।বিরক্তির মাত্রা কয়েক ডিগ্রি বাড়িয়ে দিলো অনীকের গা জ্বালোনো হাসি।রুমি চোখ কটমটিয়ে তাকালে অনীক ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে মৃদু হাসতে থাকে।রাগে রুমি শাড়ি খুলতে নিলে অনীক রুমিকে জাপটে ধরে কাছে টেনে নেয়।রুমির রাগি মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”কে বলেছে সবসময় পরিপাটিরূপই ভালো লাগে, এলোমেলো সজ্জাও মাঝে মাঝে পুরুষকে ঘায়েল করতে যথেষ্ট। ”
রুমির মধ্যে লাজুক ভাব কম, তবুও কেন যেন লজ্জায় গাল লাল হয়ে আসলো।অনীক হেসে ফেললো।

ঠিক তখনই রুশিয়া বেগম দরজা নক করলেন।অনীক রুমিকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালো।রুশিয়া বেগম রুমে প্রবেশ করেই আৎকে উঠে বললেন,”শাড়ি উল্টো পরেছো কেন?”
রুমি অনীকের দিকে চোখ গরম করে তাকালে অনীক শুকনো ঢোক গিললো। রুশিয়া বেগম হাজার বিরক্তি মুখে একত্রিত করে বললেন,”শাড়িটাও পরতে জানো না অথচ মুখের বুলি দিয়ে ফটরফটর কথা বলতে পারো।দেখি কাছে আসো।….আর তুই এখানে বলদের মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন?যা অভীকের কত দূর হলো দেখ গিয়ে। এমনিতেই লেট হয়ে যাচ্ছে।”

অনীক চলে যেতেই রুমি গোমড়া মুখে শাশুড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো।রুশিয়া বেগম মুখে বিরক্তির কপট ছাপ নিয়ে পরম যত্নে ছেলের বউকে শাড়ি পরিয়ে দিলেন।

অনীক অভীকের রুমে ঢুকে দেখে অভীক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।মেদহীন পিটানো শরীরে শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি, হাতে কালো ঘড়ি,চুল জেল দিয়ে সেট করা, ট্রীম করা খোঁচা খোঁচা দাড়িতে যেন আরো সুদর্শন লাগছে অভীককে।
অনীক বিছানায় বসে বলে,”মাইয়া মানষের মত সাজতেছিস কেন ছোটো?কাহিনী কি?”

অভীক ভ্রু কুঁচকে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”ছি!ভাষার কি অবস্থা! ”
অনীক সবজান্তার ভঙ্গিতে হাসে,এরপর বলে, “মাঞ্জা মারা শেষ হইলে চল যাই।”

অভীক পারফিউমের বোতলটা সমস্ত শরীরে ঘুরিয়ে স্প্রে করে রুম থেকে বের হয়।পিছু পিছু অনীকও ফলো করে তাকে।

**********
কলিং বেলের শব্দে মিতু দরজা খুলে বিস্মিত কন্ঠে বলে, “খালাম্মা আপনি?”
রুশিয়া বেগম মৃদু হেসে বলেন,”ভিতরে এসে বলি।”
মিতু চমকানো অবস্থায় পাশে সরে দাঁড়ায়। অভীক অনীক রুমি প্রবেশ করে ধীর পায়ে। সাথি তাদের দেখে হাসি মুখে এগিয়ে আসে।ভরন্ত পেটে গ্রাম্য ভাবে শাড়ি পড়া,মাথার দুপাশে ফুল ছেড়ে দেওয়া, হাতে গলায় গহনা। মাতৃত্বের স্নিগ্ধ রুপ! রুশিয়া বেগম সাথির কপালে চুমু খেয়ে বলেন,”মাশাল্লাহ! ”
সাথি মিষ্টি করে হাসে। অনীক অবাক নেত্রে ফিসফিসিয়ে
মাকে বলে,”মা ব্যাপার কি?এরা আমাদের না মেরে সমাদর কেন করছে?”
রুশিয়া বেগম ছেলের কথায় বিরক্তবোধ করেন।মিতু সবাইকে সোফায় বসতে বলে নীতুকে ডাকতে চলে যায়।
জায়েদও অনেকটা চমকেছে তবে নিজেকে খুব দ্রুত সামলে নিয়েছে।অভীক হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে জায়েদ, মিলন, শরীফুলের সাথে। তাজের সাথে হাত মিলাতে গিয়ে অভীকের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে যায়। তাজ নীতুর বোন জামাই শোনার পর কপালে ভাঁজ পড়ে।মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে একটা প্রশ্ন, “নীতু কেন বোন জামাইয়ের সাথে অতোটা রাফ বিহেভ করেছিল সেদিন?”

তাজের ইচ্ছে হলো হাতের মুঠোয় থাকা অভীকের হাতটা পিষে ফেলতে!আফসোস তা পারলো না, বরংচ মুখে সৌজন্যমূলক হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হলো।

নীতু যখন কিছুক্ষণ পরে রুমে প্রবেশ করলো তখন ক”জোড়া চোখে মুগ্ধতা ভর করলো।সকলের মনে একটা প্রশ্নই বার বার বাজতে লাগলো,”কে বলে কৃষ্ণবতীরা সুন্দর হয় না? কৃষ্ণবতীরা যতটা মায়াবতী হয় ততটা আর কেউ কবে হতে পেরেছে?”

সাদা স্লিকের শাড়ি গ্রাম্য ভাবে পরা,বড়নেকের লাল রঙা ব্লাউজ, ব্লাউজের হাতায় কুচি দেওয়া, খোঁপা করা চুলে বেলিফুলের মালা, ডাগর ডাগর চোখে মোটা করে কাজলের প্রলেপ, ফিনফিনে ঠোঁটে হালকা রঙের ছোঁয়া, হাতে সাদা লাল মিশেলের রেশমি চুড়ি,নাকে এন্টিকের চাপা নাকফুল!যেন স্রোতস্বিনী পাহাড়ি নদী!
তাজের বুকে হু হু করে নীল রঙা ব্যথার বিষ ছড়িয়ে পরলো।চোখের দৃষ্টি গাঢ় রক্তাভ!
অভীকের চোখে মুগ্ধতা,মাদকতা একসাথে ভর করলো,ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো,
” কাননবালা!একান্তই ব্যক্তিগত আমার কাননবালা!”

অনীক সুচারু দৃষ্টিতে দেখলো তার ভাইয়ের মুখ দুপুরী রোদের মত জ্বলজ্বল করছে! অনীক হাসলো।অবশেষে মাঞ্জা মারার কারণ জানতে পেরে মনে মনেই হেসে নিলো একচোট!

চলবে,