কাননবালা পর্ব-২৪+২৫

0
639

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২৪

সাথির সাতোসা প্রোগ্রাম শুরু হলো খুবই ভালোভাবে।কাঠের ট্রেতে কয়েকপদের খাবার সাজানো হলো।কয়েক রকমের পিঠা বানানো হলো।শরীফুল কাকা আর রুশিয়া বেগম দুজনেই সবার প্রথমে সাথিকে উপহার দিয়ে দোয়া করলো।তারপর একে একে সবাই ছোটখাটো উপহার আর প্রাণঢালা দোয়ায় মা আর সন্তানের জন্য শুভকামনা জানালো।প্রেগন্যান্সি মুড সুইংয়ের কারণে সাথি খুশিতে কতক্ষণ কাঁদলো-হাসলো, রিপনের উপর অভিমান করলো,মা-বাবার জন্য মনখারাপ করলো।এতসবের পরে গাপুসগুপুস পেট পুরে খেলো।সাথির কান্ডে সবাই হেসে ফেললো।
রুমি অনুষ্ঠান এনজয় না করলেও ওতটা বিরক্তও হচ্ছিল না।অভীক সবকিছুর ছবি তুলছিল।মিতু পানের থালা সাজিয়ে নিয়ে আসলো।সাথিকে নিখুঁত একটা পান বেছে মুখে দিতে হবে। অভীক ক্যামেরা তাক করলো।অনীক অবাক হয়ে দেখলো তার ভাই অন্য কারো ঘরোয়া অনুষ্ঠানে এতটা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নিজেকে প্রকাশ করছে।যা অভীকের আচরণের সম্পূর্ণ বিপরীত। নীতু অভীকের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,”আমি সাথিকে একটা পান খাওয়াবো, আপনি কি আমাদের ছবি তুলে দিবেন?”

অভীক হেসে বললো,”শিওর। ”
তাজের চোখ জ্বলে উঠলো। জায়েদ,মিলন থাকতে কেন নীতু অভীককে বেছে নিল?ভেবে পেলো না।
অভীকের মনে লাড্ডু ফুটছে।নীতুর খোলামেলা ব্যবহার তার খুবই ভালো লাগছে।অভীক ফটাফট ছবি তুললো।সাথি বিভিন্ন পোজে ছবি তুললো।কোনটা ভালো হচ্ছে তা নীতু অভীকের পাশে দাঁড়িয়ে ঠিক করে দিলো।দুজনের আচরণ দেখে বাসার প্রতিটা সদস্য বিস্মিত।
তাজ খুবই করুণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলো নীতু যখন অভীকের দিকে তাকিয়ে কথা বলে তখন অভীকের চোখের দৃষ্টিতে কেমন মাদকতা দেখা যায়! চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসে।আর নীতু? সে যেন আজ চঞ্চল হরিণীর মত!অভীকের সংস্পর্শ যে সে খুব পছন্দ করছে তা নীতুর মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।

তাজের বুক ফুঁড়ে তপ্ত নিঃশ্বাস বের হয়।হাসফাস লাগে।অভীক আর নীতুকে অসহ্য লাগে।তাজ অস্থির দৃষ্টিতে এদিকওদিক চাইলে সেতু দৌড়ে এসে বলে,”আপনার কি খারাপ লাগছে?”

“আমাকে একটু পানি খাওয়াও সেতু,কলিজাটা কেমন খাঁ খাঁ করছে তৃষ্ণায়! ”
সেতু দৌড়ে পানি আনতে চলে গেলো।

*********
সাথিকে বিশ্রামে পাঠিয়ে নীতু সবার জন্য টেবিলে খাবার সাজালো। সবাই টেবিলে বসতেই মিতু বললো,”নীতু তুই বসে যা, আমি বেড়ে খাওয়াচ্ছি। ”
বড় টেবিলের অপর সাইটে ইতু মিলন তাজ সেতু রুমি বসেছে।এ পাশে জায়েদ, অভীক অনীক বসেছে।টেবিলের দু মাথায় শরীফুল কাকা আর রুশিয়া বেগম বসেছে। অনীকের পাশের চেয়ারটা খালি।নীতু সেখানে বসতে গেলে অভীক আঙুল দিয়ে খোঁচা দেয় ভাইকে।অনীক দ্রুত সরে পাশের চেয়ারটায় বসে।নীতু কতক্ষণ আহাম্মকের মত অনীকের দিকে তাকিয়ে থেকে অভীকের পাশে বসে পরে।

খাবার টেবিলে খাওয়া দাওয়া চলছিল খুব নিরবে।তাজের সামনে বসে থাকা নীতুর মধ্যে কোন ভাবান্তর ঘটালো না।নীতু স্বাভাবিক থাকলো পুরোটা সময়। তাজ কিছুই খেতে পারছিল না।সবকিছু তিতকুটে লাগছিল।খাবারে আঁকিবুঁকি করছিল শুধু।পাশে সেতু অস্থির ভঙ্গিতে এটা সেটা খাবার সেধে যাচ্ছিল।
রুমির প্লেটে চিংড়ী মাছ দিতে নিলে রুশিয়া বেগম বললেন,”রুমি চিংড়ী খায়না মিতু।ওর এলার্জি আছে। ”
রুমির কেমন মনখারাপ হলো।তার শাশুড়ী যে তাকে এতটা পর্যবেক্ষণ করে জানা ছিল না।
নীতু হুট করে বিষম খেলো।নাক মুখ লাল হয়ে গেলো।চোখে পানি এসে গেলো।ইতু ব্যস্ত কন্ঠে বললো,”আপা তুমি ঠিক আছো?”
সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো।নীতুর বিষম কমছিলোই না।তরকারির ঝালে নাক মুখ ঝা ঝা করতে লাগলো।জায়েদ চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে নীতুর মাথায় হালকা চাপর দিতে লাগলো।মিতু পানি এগিয়ে ধরলো নীতুর মুখের কাছে।পানি পান করে নীতু কিছুটা শান্ত হলো। টেবিলের উপরে রাখা নীতুর হাতের উপর অভীক নিজের হাত রাখলো। বিষমের ঝাজে রক্তিম হওয়া মুখশ্রী নিয়ে নীতু থমকানো দৃষ্টিতে চাইলো অভীকের দিকে।অভীক করুণ স্বরে বললো,”আপনি ঠিক আছেন মিস নীতু?”

নীতু চোখের পলক ফেলে মাথা দুলালো।তাজ রক্তাভ চোখে নীতুর হাতের দিকে চেয়ে রইলো।শক্ত হয়ে আসলো নিজের হাতের মুঠো। অভীক সঙ্গে সঙ্গেই হাত সরিয়ে নিলো।নীতু ঠিক হতেই আবার সবাই খাওয়া শুরু করলো। গলার কাছে আবার ঝাঁজালো বোধ হলে নীতু সামনে রাখা গ্লাস থেকে অল্প একটু পানি খেলো।অভীক হাত বাড়িয়ে সেই আধখাওয়া পানিটুকু এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেললো।নীতু গোল গোল চোখে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,”আমার এঁটো পানি ছিল!”
অভীকও নীতুর মত ফিসফিসিয়ে বললো,” তো?ছোঁয়াচ রোগ আছে নাকি আপনার,মিস নীতু?ও মাই গড! মরে টরে যাবো না তো আবার!”
অভীকের কথার ভঙ্গিতে নীতু প্রথমে কপাল কুঁচকে তাকালো পরে মুখ চেপে হেসে দিলো।অভীকও হাসলো।
রুশিয়া বেগম ছেলের কান্ডে লজ্জিত হলেন।জায়েদের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে হাসলেন।অনীকও ঠোঁট টিপে হাসলো। শুধু হাসতে পারলো না তাজ।চেয়ার ঠেলে উঠে পড়লো।সেতু চেচিয়ে বললো,”সে কি! আপনি তো কিছুই খেলেন না?”
তাজ শীতল কন্ঠে জায়েদকে বললো,”ভাইয়া আমার জরুরী কাজ আছে।আমাকে এখুনি যেতে হবে।”…….তারপর সেতুর দিকে তাকিয়ে বললো,”পাঁচ মিনিটের মধ্যে নিচে আসবে সেতু,আমি এর বেশি একটুও অপেক্ষা করবো না।”….. বলেই তাজ হনহনিয়ে চলে গেলো। সেতু বিভ্রান্তের মত তাকিয়ে থেকে একছুটে রুমে চলে গেলো ব্যাগ আনতে।কেউ কোন বাঁধা দেবার সময়ই পেলো না।একটু পরেই সেতু চলে গেলো তাজের সঙ্গে নিজের সংসারে। ওরা চলে যেতেই নীতুর ঠোঁটে মুচকি হাসি দেখা দিলো।সেই হাসির দিকে জায়েদ আর ইতু বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিয়ে রইলো!

*************

ব্যস্ত শহরে ঝুপ করে রাত নেমেছে।রাতের নিস্তব্ধতায় মোড়া কোলাহলে ভরপুর জনপদ।
অভীক রুমের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়াছে রেলিংয়ে হাতে ভর দিয়ে।ঠোঁটে লেপ্টে আছে মৃদু হাসির ছটা! নীতুর তাকানো,হেসে কথা বলা, হাঁটা সবকিছু চোখের সামনে ভাসছে।আজকে নীতু নিজ থেকেই অনেকটা ফ্রী ভাবে কথা বলেছে সঙ্কোচহীন ভাবে।অভীক এতটুকু বুঝতে পেরেছে, এর পিছনে স্ট্রং কোন কারণ আছে।যাই থাক তাতে অভীকের কিছু এসে যায় না।নীতুর কাছে আসাটাই তার কাছে মুখ্য!
অনীক এক মগ কফি হাতে ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়ালো।
“বড়ো, ভাবি কি করছে?”…ভাইকে দেখে অভীক বললো।
“কাজিনদের সাথে গ্রুপে ভিডিও কলে কথা বলছে।”
অনীক এক চুমুক কফি খেয়ে ভাইয়ের দিকে মগ বাড়িয়ে ধরে বললো,” আমার এঁটো রোমাঞ্চকর না হলেও মন্দ হবে না আশাকরি?”
ভাইয়ের স্পষ্ট খোঁচা হজম করে অভীক হেসে কফিমগে ঠোঁট ছোঁয়ালো। অনীক বললো,”অবশেষে প্রেমে পরলি?”

“কি জানি!”… অভীকের উদাসীন উত্তর।

” যদি কারণ টা জানতে চাই বলতে নিশ্চয়ই আপত্তি নেই? কারণ এই নীতুকেই তুই রিজেক্ট করেছিলি অযোগ্য বলে,আজকে সেই মেয়ের প্রতি তোর মুগ্ধতা আমাকে অবাক করছে!”

অভীক অনীককে কফির মগ ফিরিয়ে দিতেই অনীক তাতে চুমুক দিয়ে ভাইয়ের উত্তর শোনার আশায় চেয়ে রইলো। অভীক বারান্দার রাখা সোফায় বসলো শরীর এলিয়ে। এরপর বললো,” বড়ো, সেদিন আমি নীতুকে ফিরিয়ে দেয়নি দিয়েছি নিজেকে! আমি প্রেমে পরেছি কিনা জানি না তবে নীতুকে ভালো লাগে আমার! বড়ো, আমি সবসময় নিজের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েছি।আমার উপর কেউ কিছু জোর করে চাপিয়ে দিক আমি চাইনি।সেদিন আমি রিজেক্ট করেছিলাম মায়ের প্রস্তাবকে,নীতুকে নয়।মা আমাকে না জানিয়ে হুট করেই আমার বিয়ে ঠিক করলো,তারউপর আমার মতামত ছাড়াই আংটি পড়িয়ে দিলো।কেন যেন বিষয় টা মানতে পারছিলাম না।তখন ক্যারিয়ার গুছানোটাই আমার কাছে অধিক গুরুত্ব পেয়েছে।তাই নীতুকে রিজেক্ট করা আমার রিয়েকশন ছিলো।নীতুর স্থানে অন্য কোন মেয়ে থাকলে আমি এটাই করতাম! তবে আজ বুঝতে পারছি মা কেন এত পছন্দ করেছিলো নীতুকে? বড়ো, নীতু কিন্তু সেই আগের মতই দেখতে আছে।কোন বাড়তি সৌন্দর্য যোগ হয়নি।কালো নীতু রাতারাতি ফর্সা হয়ে যায়নি,যা দেখে আমি পাগল হবো।তবুও নীতু আমাকে মুগ্ধ করেছে।কেন জানো? নীতুর ব্যক্তিত্ব!নীতুর প্রেমে আমি না পরলেও তার ব্যক্তিত্বের প্রেমে আমি পরেছি!বলতে এতটুকু দ্বিধা নেই!বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধতার রেশ একটা সময়ে শেষ হয়ে যায়…কিন্তু ব্যক্তিত্বের মুগ্ধতা থেকে যায় আমৃত্যু! বড়ো, সংসার নয়,আমার নিজের একটা মানুষ চাই!বার্ধক্য পর্যন্ত পাশে থাকার জন্য মানুষের বাহ্যিক রুপ সৌন্দর্য থাকা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব,গুণ! গুণহীন সৌন্দর্য কোন কাজেই আসে না! নীতু যখন আমার অফিসের পিয়নের সাথে বসে তার অভাবের গল্প শুনে,সেই দুঃখে যখন নীতুর চোখ ছলছল করে তখন আমি মুগ্ধ হই!বড় বড় ক্লায়েন্টের সামনে যে নীতু আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজের চিন্তা চেতনাকে প্রেজেন্ট করে তখন আমি মুগ্ধ হই!ষাটোর্ধ মিজানুর সাহেব স্ত্রীবিয়োগের পরে বুয়ার রান্না খেতে পারে না বলে যখন রোজ খাবার নষ্ট করে তখন নীতুর তার সাথে খাবার শেয়ারিং আমাকে মুগ্ধ করে! নীতুর চোখের স্বচ্ছতা, শান্ত অথচ দৃঢ় ওপিনিয়ন,হাসিমুখে ত্যাগ করার ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করে!….. আর নাকের ডগার রাগটুকু আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে!”

অনীক অবাক হলো।তার ভাই যে শেষ তা বুঝতে বাকি নেই।তাই ভয় ভয় কন্ঠে বললো, “যদি নীতু তোকে ফিরিয়ে দেয়?”

অভীক কোন জবাব দিল না শুধু ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ভাইয়ের দিকে!

**************
সবাই ক্লান্ত তাই যে যার মত রেষ্ট নিচ্ছে।জায়েদ নীতুর কাছে চা চাইলো।নীতু এক কাপ চা তৈরি করে জায়েদের সামনে রাখলো।জায়েদ টিভি দেখছিলো।চা দিয়ে নীতু চলে যেতে নিলে জায়েদ বললো,”বস নীতু, কথা আছে।”

নীতু আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসলো।জায়েদের মুখ কঠিন হয়ে আছে।নীতু ভয় পেলো।দাদাভাই কে কখনো এভাবে কঠিন মুখো দেখেনি নীতু!

“কোন ভণিতা করবি না নীতু,সোজাসাপ্টা উত্তর দে, এসবের কারণ কি?”

নীতু মিনিট পাঁচেক মাথা নত করে বসে রইলো।এরপর যখন জায়েদের দিকে তাকালো তখন নীতুর চোখে পানি টলমল করছে দেখতে পেলো জায়েদ। জায়েদ থমকালো।ঠিক সেইসময় ইতু এসে বসলো পাশে। নীতু কিছু বলার পূর্বেই বললো,”আপা আমি সব জানি।আমারো একই প্রশ্ন, কেন করছো?তুমি তো এমন নও।”

নীতু কাঁদলো না।দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো কেবল।টলমল করতে থাকা জলটুকু যেন শুষে নিল তপ্ত নিঃশ্বাস! নীতু ধীর কন্ঠে বললো,”দাদাভাই আমি চাই তাজ জানুক,আমি মুভ অন করেছি।আমি তাজ নামক গন্ডিতে আটকে নেই!তাজ বিয়ে করেছে রাগ করে কিন্তু ভালো নেই একটুও। এখন আবার ভেবো না তাজের জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে। তাজের প্রতি অনুভূতি টুকু থাকলেও কষ্ট নেই আমার কোন!আজ তাজ যদি অন্য কাউকে বিয়ে করতো আমি একচুল ভাবতাম না কিন্তু সেতুর ভালো থাকা তাজের উপর ডিপেন্ড করছে।তাজ ভালো না থাকলে তা সম্ভব নয়।সেতু পাগলের মত ভালোবাসে তাজকে।যা তাজ বুঝতে পারছে না কারণ একমাত্র আমি!তাই আমি চাই সে জানুক আমি তাকে ছাড়া ভালো আছি।তখনই তাজ সেতুর ভালোবাসা বুঝতে পারবে।……”….এই পর্যায়ে এসে নীতুর কথা জরিয়ে আসে…এরপর বলে,”দাদাভাই আ..আমার কালো ছায়া ওদের উপর না পড়ুক,ওরা ভালো থাকুক!”

ইতু ঝাঁঝালো স্বরে বলে,”আর অভীক?যে তোমাকে অযোগ্য বললো তাকে কেন এত সহজে তুমি ক্ষমা করছো?”

নীতু ম্লান হাসলো।এরপর বললো,”অপমান কাকে বলে জানিস?যখন আমাকে দেখতে এসে মিলন তোকে বিয়ে করে তাকে বলে অপমান!যখন কেউ আমাকে শিখায়,সবার আগে নিজেকে ভালোবাসতে হয়।আর সেই মানুষটাই যখন মায়ের কথায় গায়ের রঙ দেখে আমার ছোট বোনকে বিয়ে করে তাকে অপমান বলে!যখন আমার অযোগ্য কোন পাত্র এসে আমাকে গায়ের রঙ কালো বলে অযোগ্য বলে আর তার জন্য নিজের মায়ের গালমন্দ শুনতে হয় অপমান তাকে বলে!যখন আত্মীয় স্বজন বয়স হয়ে যাচ্ছে বলে বুড়ো বা পূর্ব বিবাহিত পুরুষের জন্য আমার সম্বন্ধ নিয়ে আসে অপমান তাকে বলে!এই তুলনায় মি.অভীকের অপমান আমার কাছে তেমন কিছু নয়!…..হ্যা আমি ভুল করছি।আমি জানি মি.অভীক আমাকে পছন্দ করে কিন্তু আজ তার সুযোগ নেওয়া ছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না।তাজকে জানতে হবে আমিও হাসতে পারি অন্য কারো সাথে, তার কোন প্রয়োজন নেই আমার!”

ইতু আর জায়েদ স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নীতুর দিকে। একটা সময় জায়েদ নীতুর মাথায় হাত রেখে বললো,”তুই এতটা ভালো না হলেও পারতি নীতু?তোর সকল সিদ্ধান্তে আমাকে পাশে পাবি আর কেউ থাকুক আর না থাকুক!”

নীতু হেসে বললো, “হয়েছে, এবার এই টপিক বাদ।শোন আজ কি হয়েছে..সাথির খাওয়ার ভিডিও দেখে রিপন মজা করে বলেছে, সাথি সত্যি করে বলতো?তোমার কয়টা বাচ্চা হবে?যেভাবে খাচ্ছিলে.. তাই নিয়ে দুটিতে লেগেছে… “……. বলতে বলতে নীতু হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরলো।

জায়েদ আর ইতু শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো নীতু কত সুক্ষ্ম ভাবে হাসির আড়াল নিজের কষ্ট গুলো লুকাচ্ছে! কি আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য ! কৃষ্ণবতী মেয়েটির চোখ হাসছে না কিন্তু ওষ্ঠদ্বয় হাসছে খিলখিল করে !

*********
সেতু ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে আছে তাজের মুখপানে।তাজ বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে সিগারেট টানছে।এই পর্যন্ত কতগুলো সিগারেট খেলো? সেতু সঠিক সংখ্যা জানে না।কিন্তু তা যে অগণিত তা জানে।সেতু কয়েক বার নিষেধ করেছে তার বদলে রাম ধমক খেয়েছে।
সেতুর চোখে জল এসে গেলো।আসার পথেও সিগারেট টেনেছে।দুপুরে কিচ্ছু খায়নি।রাস্তায় সিএনজিতে বসে কলকল করে বমি করেছে দুবার। সেতুর ভয় হচ্ছে! এভাবে চললে তো মরে যাবে মানুষটা!

দরজার পর্দার পাশে রাবেয়া বেগম এসে দাঁড়ান।উদাসীন দৃষ্টিতে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ! একসময় বুঝতে পারলেন চোখের কার্ণিশে জল জমেছে। ছেলের করুণ পরিস্থিতি আর সহ্য করতে পারলেন না, চলে গেলেন সেখান থেকে।নিজের পায়ে কুড়াল মারা কি তবে একেই বলে?

সেতু অনেক সাহস সঞ্চয় করে তাজের কাছে এগিয়ে যায়।ঠোঁট থেকে জ্বলন্ত সিগারেট টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে ফ্লোরে।তাজের মেজাজ খারাপ হয়।রাগের বশে হাত জাগায় মারতে কিন্তু পরক্ষণেই উদ্ধত হাত গুটিয়ে ফেলে।সেতু ভয়ে দূরে সরে না গিয়ে তাজকে জরিয়ে ধরে।বুকের মাঝে মাথা রেখে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলে,”তাকে নিয়ে আসুন, আমি চলে যাবো।সত্যি বলছি।বিশ্বাস করুন তবু নিজেকে এভাবে শেষ করবেন না।মরে যাবেন আপনি।”…..সেতু পরক্ষণেই চিৎকার করে বলে,”আপনার শরীর তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কেন বলেন নি।ইয়া আল্লাহ!আমি কি করি?”…..বলে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে সেতু।

তাজ ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে,”দূরে সরো, সরো বলছি।আমাকে ছুঁইও না।শেষ হয়ে যাবে তুমি।আমার অভিশপ্ত ছোঁয়ায় মরে যাবে তুমি!”

সেতু ঝড়ের গতিতে ওয়াশরুমে যায়।বালতি ভরে পানি এনে তাজকে শুইয়ে দেয়।মাথায় পানি ঢালতে শুরু করে।তাজ লম্বা লম্বি হয়ে শুয়ে আছে।খোলা চোখ দুটো টকটকে লাল।জ্বরের তাপে মুখ কালচে হয়ে আছে।সেতু উদ্ভ্রান্তের মত কাঁদছে আর মাথায় পানি ঢালছে। তাজের কানে পানি পড়ার শব্দ আর নীতুর হাসির শব্দ একসাথে বাজছে।কি বিভৎস!নীতু!তার কৃষ্ণবতী….আজ অন্য কারো!ভাবতেই তাজের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। নীতুর লাজুক দৃষ্টি, মিঠে রোদের মত পেলব হাসি,মায়া মায়া কথা আজ অন্য পুরুষের জন্য! তার জন্য নয়!ভাবতেই চোখ জ্বলে ওঠে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে নীতুর হাতটি ধরে আছে অন্য কেউ! উফফ! তাজ চোখ বন্ধ করে ফেলে। হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পানি ভরতি মগ ছুঁড়ে মারে ফ্লোরে।সেতু হতভম্ব! শব্দ শুনে রাবেয়া বেগম দৌড়ে আসেন।ভয়ে কাঁপতে থাকা সেতুকে নিয়ে চলে যান রুম থেকে।

কয়েক ঘন্টা পর এসে সেতু দেখে তাজ ঘুমাচ্ছে।সেতু আস্তে আস্তে ফ্লোর পরিষ্কার করে। তাজের শরীর ঢেকে দেয় মোটা কাঁথা দিয়ে। তারপর এসে শুয়ে পরে তাজের পাশে।সেতুর বুকের ভিতর হু হু করে!মনে প্রশ্ন জাগে,কে সেই সৌভাগ্যবতী?যাকে এতটা ভালোবাসেন আপনি?

ঘুমন্ত তাজের দিকে আরো একটু এগিয়ে আসে সেতু।কপালের উপর ছড়িয়ে পরা চুলগুলো সরিয়ে দেয় যত্ন করে।সেতুর হাত পুড়ে ওঠে যেন জ্বরের প্রকোপে। তবুও হাত সরায় না।তাকিয়ে থাকে পলকহীনভাবে! হুট করে সেতু নিজেকে আবিষ্কার করে তাজের বাহু বন্ধনে।ভারি উত্তপ্ত ছোঁয়ায় সেতুর নরম তুলতলে শরীর পুড়ে যায়!টকটকে লাল চোখে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাজ!কোন কিছু ভাবার সময় পায় না সেতু।তার আগেই সেতুর ফিনফিনে পাতলা ঠোঁট দুটো তাজের পৌরষালী ঠোঁটের দখলে চলে যায়!আকস্মিক এই ঘটনায় সেতু স্তম্ভিত! ভেবে পাচ্ছে না কি করা উচিত?তাজ যখন তার দখল থেকে সেতুর ওষ্ঠদ্বয় মুক্ত করলো তখন সেতুর মনে হলো তার ঠোঁট এই মাত্র গরম তাওয়ায় রেখে ফ্রাই করা হয়েছে!সেতু কেঁদে ফেললো। সরে যেতে চাইলো।কিন্তু পারলো কি?পারলো না।
জ্বরের ঘোরে উন্মাদ, অচেতন তাজ শক্ত বাহুডোরে বেঁধে ফেললো সেতুকে।টুনটুনির মত ছোট্ট শরীর নিয়ে সেতু তাজের পৌরষালী আগ্রাসী চাওয়া পত্যাখ্যান করতে পারলো না।চোখের সামনে নিজেকে বিলীন হতে দেখলো! ভালোবাসাহীন চাওয়ার কাছে নিজেকে সঁপে দিলো। সেতু বুঝতে পারলো না যা হচ্ছে তা কি ভুল হচ্ছে না কি সঠিক?শুধু বুঝতে পারলো, এই পথ থেকে ফিরবার ঠিকানা তার জানা নেই।তাজের আগ্রাসী চাওয়ায় যখন সেতু পুরোপুরি নিজেকে ঢেলে সাজিয়েছে ঠিক সেই সময় তাজের মুখ থেকে নির্গত একটা নাম সেতুকে স্তম্ভিত, ব্যথিত,বিস্মিত করে তুললো।চোখের সামনে ভালোবাসার নামে গড়ে ওঠা ঠুনকো কাঁচের শার্সিটা ঝনঝন শব্দে ভেঙে পরলো!
এই গল্পে পরাজিত কে সেতু বুঝতে পারলো না!

চলবে,

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২৫

জানালা গলে ভোরের পেলব রোদ এসে তাজের মুখে পড়লো, তাজ কপাল কুঁচকে চোখের উপর হাত রাখলো।পাশ ফিরতে গিয়ে অনুভব করলো শরীরের উপর ভারি কিছু।ভালো করে তাকাতেই তাজের দৃষ্টিতে বিস্ফোরণ ঘটলো যেন।সেতু লেপ্টে আছে তার শরীরের সাথে!দু’জনের পরিস্থিতি বিধ্বস্ত। তাজ বড় করে দম ফেললো। এটা না হলেই পারতো? বুক ভার হয়ে আসলো।আস্তে করে সেতুকে সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে পরলো।সারা রাতের জ্বরের কারণে মাথা ভার হয়ে আছে।তাজ ধীর পায়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে কটাক্ষ করে বললো,”তুমি এরপরও নিজেকে মানুষ বলে দাবী করো?এতটা অধপতন কবে হলো তোমার!”

ফ্রেশ হয়ে শার্ট প্যান্ট পরে তাজ বেড়িয়ে পরলো।শনিবার অফিস নেই। তবুও বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো।একরকম পালিয়ে বেড়ানো যাকে বলে!নিজেকে চোর চোর মনে হতে লাগলো তাজের!এর থেকে মৃত্যুও বরং ভালো!
তাজ চলে যেতেই সেতু চোখ মেললো।চোখের কার্নিশে জল জমেছে! তাজের প্রস্থানে সেতুর মধ্যে কোন ভাবান্তর ঘটালো না!

বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে কল করলো একটা নম্বরে।
নীতু চা করছিল।এই সময়ে সেতুর কল দেখে গ্যাসের আঁচটা কমিয়ে কল রিসিভ করে বললো,”হ্যা বল!এতো ভোরে কি মনে করে?”
সেতু শীতল কন্ঠে বললো,”আপা, একটা জীবন কাটিয়ে দিতে ভালোবাসা থাকা কতটা জরুরী? ”

নীতুর কপাল কুঁচকে গেলো।এরকম উদ্ভট প্রশ্ন শুনে।তবুও বললো,”সেতু, একটা জীবন কাটিয়ে দিতে ভালোবাসার থেকেও ভালো থাকাটা জরুরী! ”

“আপা রাখছি।”….. বলে সেতু কট করে লাইন কেটে দিলো।নীতু কিছুই বুঝলো না সেতুর আগামাথা হীন বক্তব্যের! ফ্যালফ্যাল করে করে তাকিয়ে রইলো টগবগ করে ফুটতে থাকা চায়ের পানির দিকে।

তাজ সারাদিনে বাসায় ফিরলো না।রাতে ফিরলো ক্লান্ত শরীরে! সিগারেট আর চা ছাড়া সারাদিন কিছুই খায়নি।পেটের ভিতর মোচড় দিচ্ছে। সেতু পড়ছিল।তাজকে দেখে খুবই স্বাভাবিক স্বরে বললো,” ভাত দিবো আপনাকে?”
তাজ একবার চাইলো সেতুর দিকে।অভিযোগ বিহীন স্বাভাবিক ব্যবহার। মনে হচ্ছে নিত্য নৈমেত্তিক ঘটনা।এতটা স্বাভাবিকতা কি আদৌও আছে এই সম্পর্কে? তাজ নিজেও স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,”দাও।”

দুটো মানুষ টেবিলের দুপাশে বসে আছে।রুম জুড়ে পিনপন নিরবতা। সামনে খাবার।খিদে থাকা স্বত্বেও দুজনের কেউই খেতে পারছে না।একজন চাচ্ছে অপরপক্ষ আত্মসমর্পণ করুক,দুটো কৈফিয়ত দিক!আর একজন চাইছে কিছু না বলুক অপর পাশের মানুষটা! সবকিছু থেকে পালাতে ইচ্ছে করছে।
খাবার নাড়াচাড়া করে গেলো দুজনেই।কেউই খেতে পারলো না।একটা সময়ে সেতু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।কান্নার দমকে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে! তাজ দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। দুচোখের পাতা বন্ধ করে বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।এর শেষ কোথায়?চেয়ার ঠেলে তাজ উঠে পরলো।সদর দরজা পেরিয়ে নেমে পরলো রাস্তায়! সারারাত বাহিরে কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।দমবন্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে মুক্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো!

************
নীতু নিখিলের কাছে ভিডিও কল দিয়ে বললো,” ভাইয়া বাবার সাথে কথা বলিয়ে দাও।বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।”

বাবা ছলছল চোখে তাকিয়ে নীতুকে দেখছে।ঘড়ঘড় করে আওয়াজ বের হচ্ছে কন্ঠ থেকে।কিছুই বলতে পারছে না। নীতু বাবার কষ্ট দেখে কেঁদে ফেললো। মহিমা বেগমও পাশে বসে মুখে আঁচল চেপে কাঁদছে।বাবার চোখের মিনতি বলছে,”কবে আসবি মা?”
“আসবো বাবা।একদিন এসে তোমাকে চমকে দিবো।”
মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে নীতু কল কেটে দিলো।নীতুর ফিরতে ইচ্ছা করলেও মন সায় দেয় না।বাড়িতে গেলেই সবার এক প্রশ্ন,”বয়স তো পেড়িয়ে যাচ্ছে, বিয়ে করবি কবে?”
আত্মীয়রা মাকে নানান কথা বলে অতিষ্ট করে ফেলবে তখন মা নামক মানুষটা বিষন্ন চোখে নীতুর দিকে তাকিয়ে থাকবে।কান্নাকাটি করবে।তার থেকে দূরে থাকাই ভালো!

**********
রাত দশটা।জায়েদ বাসার নিচে নেমেছিল ফ্লেক্সিলড করতে।অভীক তখন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে ফিরছিল।জায়েদকে হাঁটতে দেখে পিছন থেকে অভীক বলে উঠলো,” দাদাভাই,একটু দাঁড়াবেন। আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।”

জায়েদ থমকে দাঁড়ালো।অভীক বড় বড় পা ফেলে জায়েদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,”কেমন আছেন দাদাভাই? ”
জায়েদের শান্ত মেজাজ গরম হয়ে গেলো। গতকাল মেহমান ছিল বলে কিছু না বললেও আজ মেজাজ ঠিক রাখতে পারলো না।কিড়মিড়িয়ে বললো,”আমাকে দাদাভাই ডাকার অধিকার কেবল একজন মানুষের।আর সেই মানুষটা এবং তার দাদাভাই ডাক দুটোই আমার প্রিয়। বাহিরের কেউ আমাকে দাদাভাই বলে ডাকুক তা আমার একদমই পছন্দ নয়।”
অভীক জায়েদের থমথমে মুখ দেখে হাসলো।এরপর বললো,”আজ থেকে না হয় সেই একজন মানুষের সংখ্যা বেড়ে দুজন হলো।মন্দ কি দাদাভাই? ”
জায়েদ মনে মনে বেয়াদব বলে গালি দিয়ে বসলো অভীককে।
অভীক এবার সিরিয়াস কন্ঠে বললো,”দাদাভাই আপনার আমার সাথে রাগ করা যৌক্তিক। কিন্তু আমাকে আমার বিষয়টা কনফেস করতে দিন।”
জায়েদ অভীকের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললো,”তুমি নীতুকে পছন্দ করো?”
অভীক এমন সোজাসাপটা প্রশ্নে খানিক চমকালো কিন্তু কিছু বলার পূর্বেই জায়েদ আবার বললো,”উত্তরটা আমি বলছি শুনো,তুমি নীতুকে পছন্দ করো। এবং তুমিই নীতুকে অযোগ্য বলেছিলে।সেই অযোগ্য মেয়েটাকে আজ তুমি পছন্দ করো,কি হাস্যকর তাইনা?”
চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে আসলো অভীকের।করুণ নেত্রে বললো,”দাদাভাই আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন! ”

জায়েদ মৃদু হেসে অভীকের কাঁধে নিজের ডান হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়ে বললো,”নীতু সবাইকে খুব সহজে মাফ করে দিতে পারে।নীতুর প্রিয় জিনিস কেউ কেড়ে নিলেও নীতু তাকে ক্ষমা করে দিবে।কিন্তু আমি নই!আমার নীতুকে আবার কেউ দ্বিতীয়বার ভেঙে গুড়িয়ে দিতে আসুক আমি তা চাই না।অনেক কষ্টে নীতু নিজেকে সামলিয়েছে,গাঢ় আধারে ডুবে যেতে যেতে নতুন ভোরের আলোয় নিজেকে রাঙিয়েছে!এবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে আমি তাকে খুন করতে দু’বার ভাববো না!”…..বলে জায়েদ হনহন করে হেঁটে চলে গেলো।

অভীক এমন শান্ত কন্ঠের থ্রেট প্রথমবার শুনলো। মুখটা চুপসানো বেলুনের মত হয়ে আসলো। বাসায় প্রবেশ করতেই অনীক বললো,”কিরে কি হয়েছে তোর?কেমন চিন্তিত মনে হচ্ছে। ”

অভীক সোফায় ধপ করে বসে বললো,”বড়ো, খুব কঠিন হবে নীতুকে পাওয়া! ”

অভীকের কন্ঠে হালছাড়া ভাব! অনীক ভাইয়ের পাশে বসে বলে,”আমিও চাই পথটা কঠিন হোক!”
অভীক কপাল কুঁচকে বলে,”বড়ো, তুমি কি ভাই নাকি শত্রু?”
“খুব সহজে অনেক আকাঙ্খিত কিছু পেয়ে গেলে আমরা তার মূল্যায়ন করতে জানি না! তাই নীতুকে জয় করতে না হয় খানিক কষ্টই করলি?”

অভীক সোফায় শরীর এলিয়ে বলে,”বড়ো,পথটা কঠিন হোক তবুও নীতু আমার হোক।কঠিন পথটা পাড়ি দিয়ে যদি আমায় শূন্য হাতে ফিরতে হয় তবে আমি শেষ হয়ে যাবো!স্রেফ মরে যাবো ভাই!মেয়েটা কখন আমায় এতটা কাবু করলো?আমার অজান্তে কখন এতটা কাছে আসলো?”

অনীক ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইলো মায়া মায়া চোখে! অভীক ফের বললো,”আজ নীতুর দাদাভাই একটা ভয়ংকর কথা বলেছে বড়ো!অনেক কিছুই আমার অজানা!কেন দ্বিতীয়বার শব্দটা উচ্চরিত হলো জানি না?তবে এতটুকু জানি, নীতুকে আমার পেতে হবে!”

ঠিক সেই সময় রুমি সোফায় এসে বসলো।দুজনের দিকে তাকিয়ে আশাহত কন্ঠে বললো,”কালো একটা মেয়ের মাঝে তোমরা কি পেলে বলতো?যার জন্য এতটা মরিয়া হলে?অভীকের মত সুদর্শন পুরুষের পাশে নীতু নামের মেয়েটি বড্ড বেমানান!”

অনীক গরম চোখে চাইলো বউয়ের দিকে!অভীক শীতল কন্ঠে বললো,”ভাবি আমার অনুরোধ থাকবে দ্বিতীয়বার আর তুমি এমন কোন কথা বলবে না।না হলে আমি ভুলে যেতে বাধ্য হবো, তুমি আমার ভাইয়ের বউ।”…….বলে অভীক হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।

***************
দিন রবিবার। সবাই ব্যস্ত যার যার কাজে।নীতু নিজের ডেস্কে কাজ করছিল।অভীক নিজের কেবিনে প্রবেশ করার সময় আড়চোখে একবার লক্ষ্য করেছে নীতুকে।নীতুর মুখটা থমথমে!কিছু হয়েছে কি?প্রশ্ন জাগলো অভীকের মনে। মেরুন রঙের থ্রি পিস পরা নীতু। লস্বা চুলে এলানো বেণী।অলংকার বিহীন চোখের কাজলটুকুই অভীককে ঘায়েল করতে যথেষ্ট! অভীক দ্রুত পায়ে নিজের কেবিনে প্রবেশ করলো। কেবিনে বসতেই মানিক নামে একটা আঠারো উনিশ বছরের ছেলে অভীকের কেবিনে নক করলো।অভীক তাকে আসতে বলে নিজের কোটটা খুলে চেয়ারে রাখলো।পানি পান করলো। মানিক এই অফিসে ফাইল এক টেবিল থেকে আর এক টেবিলে আনা নেয়ার কাজ করে আর সবাইকে চা বানিয়ে দেয়।ছেলেটা খুবই চটপটে স্বভাবের! অভীক হাসি মুখে বললো,”কিছু বলবে মানিক?”
মানিক ঘটনা হুবহু বলতে প্রস্তুতি নিল।হাত নেড়ে নেড়ে বলতে শুরু করলো, “স্যার ঘটনা প্রথম থেইকাই বলি।হইলো কি নীতু আফায় অফিসে এসে বসলো।ওয়ার্কিং আওয়ার তখনো শুরু হয়নি।তখনি পলাশ ভাই এসে হাজির।নীতু আফারে হাসিমুখে কইলো,” নীতু আজ আমার জন্মদিন। ”
আপনেই বলেন হের জন্মদিন তা দিয়ে আফায় কি করবো?
অভীক বললো,”মূলটুকু বলো।কাহিনী পড়ে শুনবো।”

মানিক বলতে লাগলো, “এরপর নীতু আফায় হাসি মুখে বললো,শুভ জন্মদিন পলাশ ভাই। পলাশ ভাইয়ে তো খুশিতে গদগদ।এরপর বললো, নীতু জন্মদিনের ট্রিট চাই।
নীতু আফায় বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো।পলাশ ভাই ফের কইলো,বেশি কিছু না।কফি খাওয়াতে হবে। নীতু আফায় মুখে জোর করে হেসে কইলো, আজ তো সম্ভব না পলাশ ভাই।আমার পরিবার এসেছে।তারা আজ সন্ধ্যায় চলে যাবে।আমার সেখানে থাকাটা জরুরী।
আপনে বিশ্বাস করেবন না স্যার, এরপরও পলাশ ভাই কইলো, ঠিক আছে নীতু।আজ না হলেও হবে।আমরা না হয় আগামীকাল বসবো।
নীতু আফায় খাবি খাওয়া মাছের মত হাসফাস করতে করতে রাজি হলো।

পলাশের কান্ডে অভীকের মেজাজ গরম হলেও মানিকের বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেললো।মানিব্যাগ থেকে দুটো দু’শ টাকার নোট মানিকের হাতে দিয়ে বললো,” গুড জব।চোখ কান এভাবেই খোলা রাখবে।”
মানিক কচকচা টাকার দিকের তাকিয়ে হাসি মুখে বললো,”আপনার কথার নড়চড় হবে না।”
মানিক চলে যেতে যেতে ভাবতে থাকলো, স্যারে নীতু আফার কাছে কি পাইছে আল্লাহ জানে?তবে আমার জন্য যে আফায় লক্ষী তা নিশ্চিত!

অফিসে বসে অভীকের নীতুর দিকে লক্ষ্য রাখা মুশকিল।তাই মানিককে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে।অভীকও দেখতে চায় নীতু কি করে পলাশের সাথে কফি খেতে যায়!
যাকে নিয়ে এই দ্বন্দ সে কি আদৌও এই খবর রাখে?

চলবে,