#একজন_রূপকথা
#পর্ব_১২
#নুশরাত_জেরিন
মাসখানেক পার হবার পরও কবিতার কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না। অদৌ সে পালিয়েছে? নাকি কেউ তুলে নিয়ে গেছে সে বিষয়েও কেউ সিউর হতে পারলো না।
শুধুমাত্র কথাই একমাত্র কবিতাকে নিয়ে আর টু শব্দটিও করলো না। সে রোজকার মতো সকালে মালোতির হাতে হাতে কাজ সামলায়, রোজিনা বেগমের সেবা যত্ন করে।
মালোতি একদিন তাকে প্রশ্ন করে বসলো,
“বোনটার জন্য আপনার কষ্ট হয় নাকি রাগ হয় আপা?”
কথা উত্তর দিতে পারলো না। রাগ কী না সে জানে না। তবে কবিতাকে তার নিজের বোন বলতে লজ্জা করে। এতকিছুর পরও সে কবিতাকে ছুড়ে রাস্তায় ফেলেনি, ভালো ঘরে বিয়ে দিয়ে তার জীবনটা গুছিয়ে দিতে চেয়েছিলো। অথচ কবিতা কী করলো? আর কেউ না জানুক, কথা ঠিকই জানে, কবিতা নিজ ইচ্ছায় পালিয়েছে। কথার কাছে হার না মানার জেদ নিয়ে পালিয়েছে। এমন মেয়েকে বোনের জায়গা দেওয়া যায় না।
তবুও মাঝেমধ্যে বুকের কোথাও যেনো ব্যথা করে ওঠে, কবিতার সেই বাচ্চামো মাখা আবদার, ভয়ে ভীত হওয়া মুখ চোখের সামনে ভাসে।
কথা বিরবির করে,
“আগের কবিতাটা আমার বোন ছিলো, হঠাৎ সে হারিয়ে গেছে, তার মতো দেখতে এক নিষ্ঠুর, স্বার্থপর মেয়ে কোথা থেকে যে চলে এলো।”
কবিতার জন্য তাদের কম ধকল তো পোহাতে হচ্ছে না। ম্যানেজারকে বিয়ের আসরে অপমানিত করা হয়েছে এমন দায় এসে পড়েছিল শোভনের কাধে৷ অতঃপর? চাকরীটা হারাতে হলো।
যেদিন চাকরীটা চলে গেলো সেদিন শোভন সারাদিন ঘরে চুপচাপ শুয়ে ছিলো।
কথা এসে বলল,
“আজ ছুটি পেয়েছেন? অফিস গেলেন না?”
শোভন উত্তর দেয়নি, শুধু একপলক কথার দিকে চেয়ে আবার চোখ বন্ধ করেছিলো। সেই চাহনীতে কী ছিলো? অসহায়ত্ব?
কথা বলল,
“চাকরীটা নেই?”
শোভন মাথা নাড়লো। ধীরে সুস্থে উঠে বসে বলল,
“এবার কী করবো কথা? সংসার কীভাবে চালাবো? অফিস থেকে লোন নিয়েছিলাম, একমাস সময় দিয়েছে শোধ করবার জন্য! এত টাকা কোথায় পাবো?”
“কবিতার বিয়ের জন্য গয়না কিনেছিলেন, সেগুলো বিক্রি করলে কিছু হবে না?”
শোভন মাথা নিচু করে ফেললো। কবিতা যাওয়ার সময়,গয়নাগুলো সাথে নিয়ে গেছে৷ একথা কথাকে বলা হয়নি৷ রোজিনা বেগম নিষেধ করেছিলেন। মেয়েটা এমনিতেই এত ভেঙে পড়েছে, কবিতার লোভের কথাগুলো জানলে আরও ভেঙে পড়তো না?
কথা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো,
“কবিতা সেগুলো নিয়ে গেছে?”
শোভন কথাকে বুকে টেনে আনলো৷ মেয়েটা কাঁদে না কেনো? বুকটা হালকা করার জন্য হলেও একটু কান্না করা উচিত নয় কী?
সে বলল,
“কষ্ট পেও না কথা।”
কথা সে কথার উত্তর দিলো না।
“আমার মায়ের কথা শুনেছেন আপনি? স্বার্থপর এক মহিলার কথা? যে কিনা নিজের ছোট্ট দুটো মেয়েকে পথে ভাসিয়ে অন্য পুরুষের হাত ধরে পালিয়েছিলো!
মামি প্রায়ই আমাকে তার সাথে তুলনা করতো জানেন? বলতো মায়ের মেয়েরা তো মায়ের মতোই হবে। কবিতা তার ব্যাপারে কিছুই জানতো না। আমার বিয়ের পরে জেনেছিলো। কী কান্নাটাই না কেঁদেছিলো মেয়েটা। পরবর্তীতে যখন পুরো ঘটনা জানলো মায়ের কথা তুললেই রেগে যেতো। মাকে ঘৃনা করতে শুরু করেছিলো আমার মতো।
কিন্তু সেই মেয়েটা মায়ের থেকেও নিকৃষ্ট কাজটা কীভাবে করতে পারলো? মামির কথা প্রমান করতে? যে সে ঐ মায়েরই মেয়ে?”
শোভন উত্তর না দিয়ে আরও শক্ত করে আকড়ে ধরলো।
মালোতির সাথেও কথার বেশ খাতির হয়েছে।
কী মিষ্টি অথচ দুঃখী মেয়েটা। কতই বা বয়স হবে তার? এ বয়সে এসেই জীবনের কঠিন বাস্তবতায় পিষে যাচ্ছে।
মালোতিও কথার সামনে নিজেকে গুটিয়ে রাখে না। নতুন করে আর কাউকে বিশ্বাস করতে না চাইলেও সে কথা রাখা যায় না, বিশ্বাস এসে যায়। কথাও বিশ্বাস অর্জন করে নিয়েছে।
আগের বাড়িতে যখন কাজ করতো সেই বাড়ির মালকিন কথায় কথায় যা তা ব্যবহার করতো, মালিক কুদৃষ্টিতে তাকাতো। সে তুলনায় এ বাড়ির মানুষগুলো আলাদা।
মালোতি জিবনে কম ঠকেনি, আজকাল সেও মানুষ চিনতে শিখে গেছে।
—
লোন শোধ করার আর দুটো দিন মতো সময় আছে। এরমাঝে শোভন একজন অপরিচিত ভদ্রলোককে বাড়িতে নিয়ে এলো। চোখে মুখে তার উৎফুল্লতা। এতদিন কেমন মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়াতো, চাকরীর চেষ্টা চালাতো। কিন্তু চাকরী পাওয়া কী এত সহজ? তার উপর যদি মামা চাচার জোড় না থাকে!
এর আগের চাকরীরা ভাগ্যগুনে পেয়ে গিয়েছিলো।
রোজিনা বেগম বললেন,
“লোকটা কে শোভন? তোর পরিচিত?”
শোভন উৎসাহ নিয়ে বলল,
“ওকে চিনলে না মা? ও রাকিব! ঐ যে ছোটবেলায় একসাথে কত খেলেছি আমরা, মনে নেই তোমার? তোমার হাতের খিচুড়ি খাবার জন্য পাগল ছিল।”
রোজিনা বেগম শত চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না। বয়স বাড়ছে বৈ কমছে না। স্মৃতি শক্তিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। আগের কত স্মৃতি মন থেকে মুছে গেছে।
তিনি বললেন,
“ঠিক মনে করতে পারছি না।”
রাকিব অভিমানের সুরে বলল,
“সেকি আন্টি, আমায় তুমি ভুলে গেলে? আমি খুব রাগ করেছি।”
রোজিনা বেগম হেসে উঠলেন।
রাত বাড়লে রাকিব চলে গেলো। বসার ঘরে এতক্ষণ তুমুল আড্ডা চলেছে। শোভন নিজেও বেশ খোজমেজাজে গল্প করেছে৷ ছোটবেলার স্মৃতি… তাছাড়া আজ একটা বোঝাও ঘাড় থেকে নামলো।
রাকিব ব্যবসা বানিজ্য করে ভালো অর্থ উপার্জন করেছে। শোভনের সাথে দেখা হতেই খোজ খবর নিলো। শোভনের এমন অবস্থা শুনে নিজে যেচে বলল,
“এত বড় বিপদে আছিস, প্রথমেই বলবি না? আমি তোকে সাহায্য করবো। কত টাকা লাগবে বল?”
শোভন নিতে চায়নি। অনেক জোড়াজুড়ির পর ধার হিসেবে নিয়েছে।
কথাকে সে কথা বলতেই সে মুখ গম্ভীর করে ফেললো। বলল,
“সেধে সাহায্য করবে কেনো সে? এর পেছনে তার কী উদ্দেশ্য? ”
শোভন হেসে ফেললো,
“আশ্চর্য! উদ্দেশ্য কেনো থাকবে? বন্ধুকে সাহায্য করেছে মাত্র, আর কিছু তো না। তাছাড়া আমি তো শোধ করে দেবো।”
কথা তবুও নিশ্চিন্ত হলো না। বারবার বলল,
“আপনি আগে এত বোকা ছিলেন না, এবার এত বোকামী করছেন কেনো? যদি আবার কোনো বিপদে পরি?”
—-
কথার চিন্তাকে বাস্তব রুপ দিতেই হোক বা অন্য কারনে, এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই রাকিবকে এ বাড়িতে দেখা গেলো। একদিন মালোতি বলল,
“লোকটার মতিগতি আমার ভালো লাগে না আপা, আমি তার সামনে যাই বা আপনি, কেমন লোভাতুর চোখে তাকিয়ে থাকে।”
কথা চমকে উঠলো।
“সত্যি বলছিস?”
“মিথ্যা কেনো বলবো? আপনি নিজেও একবার পর্যবেক্ষন করে দেখেন।”
সেদিন দুপুরে রাকিব এ বাড়িতে খাবার খেলো। রান্না করেছে কথা নিজে। রোজিনা বেগমের শরীর খারাপ। মালোতিও আজ ছুটি নিয়েছে।
রাকিব খেতে খেতে বলল,
“ভাবির হাতের রান্নার তুলনা নেই রে দোস্ত, এত ভালো রান্না করে সে। ইস ভাবীর তো একটা পুরস্কার পাওনা হয়ে গেলো।”
শোভন কিছু না বলে শুধু হাসলো।
রাকিব আবার বলল,
“তো ভাবীকে কী দেওয়া যায় বলতো, ফুচকা খেতে নিয়ে যাবো?”
শোভন বলল,
“সে ফুচকা টুচকা পছন্দ করে না রে, সে অন্যরকম মানুষ। সাধারণে তার অরুচি।”
“সে কি রে, তবে তোর সাথে এই অসাধারণী কী করছে, তুই ও তো সাধারণ। ভাবীর তো দরকার আমার মতো মানুষ।”
কথাটা শোভনকে যতটা না স্তম্ভিত করলো তার থেকেও বেশি চমকালো কথা। খাবার ঘরের ঠিক দরজার পাশে সে দাড়িয়ে ছিলো। মালোতির কথাটা ঠিক তখুনি তার কানে বাড়ি খেলো। মালোতি তো মিথ্যা বলার মেয়ে না।
রাতে সে কথার সত্যতাও প্রমাণ হলো।
শোভন ফোন দিয়ে বলল,
“তুই এমন একটা কথা কিকরে বলতে পারলি রাকিব, আমি খুব মনোক্ষুণ্ণ হয়েছি!”
রাকিব হাসলো,
“আরেহ্, মনোক্ষুণ্ণ হবার মতো কী বলেছি আমি? এসব কথা বাদ দিয়ে একটা জবরদস্ত কথা শোন।”
“কী?”
“তোকে যেই টাকাগুলো দিয়েছিলাম না আমি? ঐ যে ধারে? সেই ধারটা চাইলে তুই এখনই শোধ করতে পারবি!”
শোভন অবাক হলো,
“কীকরে?”
“তোর বউকে একরাত আমার বাড়িতে ডিনার ডেটে পাঠা, ধারের টাকা আর পরিশোধ করতে হবে না। আমাকে খুশি করতে পারলে বরং বাড়তিও কিছু পাবি।”
শোভন ফট করে কল কেটে দিলো। তার শরীর খারাপ লাগছে নাকি মন?
,
চলবে…..