একজন রূপকথা পর্ব-১৩

0
365

#একজন_রূপকথা
#পর্ব_১৩
#নুশরাত_জেরিন
,

পরদিন শোভন রাকিবের মেসে গেলো। দুজন রুমমেট থাকে তার সাথে৷ দুজনেই রাকিবের সমবয়সী। শোভনকে দেখেই বিরক্তিকর মুখ বানালো, বলল,
“কাকে চাই?”

“রাকিব আছে?”

“কোন রাকিব?”

শোভন বিস্মিত হলো। রাকিব তাকে এখানকার ঠিকানাই দিয়েছিলো, বলেছিলো সে এই মেসেই তার বন্ধুদের সাথে থাকে। এরা তার ব্যবসায়ীক পার্টনারও বটে।
সে বলল,
“রাকিব সত্যি এখানে থাকে না? সে যে আমায় এই ঠিকানা দিয়েছিলো..”

দুজনার মধ্যে লম্বা করে লোকটা বলল,
“আপনি রাকিবের কে হন? পাওনাদার? ”

“পাওনাদার কেনো হবো? বরং দেনাদার। ”

লোকদুটোর গম্ভীরতা কমে এলো। মুখটা একটু স্বাভাবিক ও লাগলো শোভনের কাছে।
তারা বলল,
“ভেতরে যান, রাকিব ভেতরে আছে।”

শোভনের কাছে বিষয়টি অদ্ভুত লাগলেও সে কিছু বললো না। রাকিব ঘরেই ছিলো, বিছানায় শুয়ে আছে। শোভনকে দেখে উঠে বসলো। একগাল হাসলো। এইতো দুটো দিন আগেও তার হাসিকে কতটা পবিত্র লেগেছিলো শোভনের কাছে। অথচ আজ? শোভন দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
রাকিব উঠে বসলো,
“আরে শোভন যে, এত সকাল সকাল আমার কাছে? কী চাই? ঋন পরিশোধের সুযোগ?”

তার চোখমুখে ভীষন কৌতুকতা। শোভন দাতে দাত চাপলো,
“তুই এসব বলতে পারিস না রাকিব, কথা আমার স্ত্রী হয়। তার সম্পর্কে এসব তুই বলতে পারিস না। তাছাড়া আমি তো বলেছি তোর টাকা শোধ করে দেবো।”

রাকিব উচ্চস্বরে হাসলো,
“রেগে যাচ্ছিস কেনো, আমি কী তোর বউকে একেবারের জন্য চাইছি নাকি? জাস্ট একটা রাতের জন্য।”

আচমকা উত্তেজিত হয়ে পড়লো শোভন। সে অনেকক্ষণ যাবত রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, আর সম্ভব না। কাল রাতেও নিজেকে বহু কষ্টে সামলেছে। কথার চোখে চোখ রাখতে পারেনি। যদিও কথা এসবের কিছুই জানে না। তবে সন্দেহ করেছে।
কাল শোভন যখন বলল সে রাতের খাবার খাবে না তখন কথা বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। পরমুহূর্তেই বলেছিলো,
“আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছেন আপনি?”

শোভন ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল,
“কী সব বলো তুমি, কী লুকাবো বলোতো?”

“সেটা আপনিই ভালো জানেন।”

কথাটা বলেই সে আর দাড়ায়নি। গটগট হেটে চলে গিয়েছিলো।

রাকিব ছেলেটা কথা সম্পর্কে এসব কীভাবে বলতে পারে, ভাবতেও বা পারে কিভাবে।
সে রাকিবের কলার চেপে ধরলো।
“আর একবার এসব কথা মুখে আনলেই তোকে আমি খুন করে ফেলবো রাকিব।”

রাকিব আবারও হাসলো। শোভনের হাত থেকে সাবধানে নিজের কলার ছুটালো।
শোভনও ততক্ষণে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছে। সে বলল,
“কথাকে তুই কিভাবে চিনিস?”

রাকিব চমকে উঠলো, তবে প্রকাশ করলো না।
শোভন আবারও বলল,
“তুই সবার কাছে থেকে টাকা ধার নিয়ে পালিয়ে বেড়াস, আমার বেলায় কেনো উল্টো কাজ করলি? কথার জন্য? ওকে পাবার জন্য?”

রাকিব বলল,
“বাহ্ তোর তো অনেক বুদ্ধি, আমিই তোকে বোকা ভেবে বসেছিলাম।”

“হেয়ালি না করে উত্তর দে।”

“কিসের উত্তর? ”

শোভন কড়া চোখে তাকালো। রাকিব এবার উচ্চস্বরে হাসলো।
“বাব বাহ ভয় দেখাচ্ছিস নাকি? তোর কী ধারণা, এতটুকুতে আমি ভয় পাবো? যেই আমি কিনা পুলিশের চোখ লুকিয়ে মেয়ে পাচার করি।”

শোভন চমকে উঠলো,
“তুই নারী পাচার করিস?”

“তো তুই কী ভেবেছিলি, কী ব্যবসা করি আমি? যে এত কম সময়ের মধ্যেই এত টাকার মালিক হয়ে গেলাম? যদিও তোর টাকাটা…”

রাকিব কথা শেষ করতে পারলো না, আচমকা শোভন বলল,
“আসিফ দিয়েছে?”

“ভালোই তো গেইজ করলি, তোর বউয়ের প্রাক্তন প্রেমিককে চিনিস তাহলে?”

“একরাতের জন্য কথাকে সেই চেয়েছে, তাই না?”

রাকিব বলল,
“আসলেই তোর বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারছি না। এত সহজে সব বুঝে গেলি? ”

শোভন উত্তর না দিয়ে আবার বেরিয়ে গেলো। কথাগুলো সে আন্দাজের উপর বলেছিলো, তবুও কিভাবে যে মিলে গেলো। যদিও পরশু রাকিবের সাথে শুকনো মতো এক ছেলেকে দেখেছিলো সে। কাছে যায়নি, দুর থেকেই দেখেছে। ছেলেটা আসিফ ছিলো।
কথা তার কথা বললেও ছবি দেখায়নি, শোভন নিজ কৌতুহলে তার বিষয়ে খোজ খবর নিয়েছে।
কথাকে সন্দেহ করে নয়, কবিতার চিঠিটা পাবার পর।
এইতো সপ্তাহ খানেক আগে কথা চিঠিটা তাকে দেখিয়েছিলো। শোভনের ঠিক তক্ষুনি মনে হয়েছে কথার কাছের কেউ বলতে কবিতা আসিফকে বুঝিয়েছে। তাদের বাড়ির সামনে প্রায়ই কবিতার সাথে কথা বলতে দেখেছে সে।
শোভনের সন্দেহ হতেই খোজ নিয়েছিলো।

বাড়ি ফিরে সে কারো সাথে কথা বলল না। তার মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। এতগুলো টাকার ব্যপার। রাকিবকে এই মুহূর্তে টাকাগুলি ফেরত দিতে পারলে বেশ হতো, কিন্তু কোথা থেকে পাবে? গ্রামের বাড়ি তার বাবার কিছু জমি ছিলো, সেগুলো বিক্রি করলে হবে?
রোজিনা বেগমকে বলতেই তিনি বললেন,
“রাকিব কী এখনই টাকা ফেরত চাইছে? দু’দিন আগেই না দিলো।”

শোভন বলল,
“সেরকম কিছু না মা।”

“তাহলে জমি বিক্রি করতে চাইছিস কেনো?”

“না মানে।”
শোভন আমতাআমতা করলো।
রোজিনা বেগম বললেন,
“না চাইলে বলতে হবে না, তবে কোনো সমস্যায় যে পড়েছিস ঠিকই বুঝতে পেরেছি।”

শোভন উত্তর দিলো না।


রাত বারোটা নাগাদ খবর এলো রাকিব খুন হয়েছে, শরীর থেকে মাথাটা বিশ্রী ভাবে কুপিয়ে আলাদা করা হয়েছে, শরীরেও জখমের দাগ। কথা শুনেই বলল,
“কে মারলো লোকটাকে?”

শোভন বলল,
“জানি না, আজ সকালেও দেখা করে এলাম সুস্থ সবল ছিলো।”

কথা আঁতকে উঠলো,
“আপনি আজ গিয়েছিলেন? কেনো? এই নিয়ে পুলিশ আপনাকে সন্দেহ করবে নাতো?”

শোভনকেও আতঙ্কগ্রস্ত দেখালো।
“জানি না।”

তাদের আতঙ্ক সত্যি করে পরদিন সকালেই পুলিশ এলো। রোজিনা বেগম দরজা খুললেন। কথা আর মালোতি রান্না ঘরে।
শোভন নিজের রুমে ঘুমোচ্ছিলো। রাতভর দুশ্চিন্তায় সে ঘুমোতে পারিনি। একটু পর পর বিরবির করে বলেছে,
“আমাদের জিবনেই এত সমস্যা কেনো কথা? এত এত বিপদ কেনো একবারেই হানা দিচ্ছে? একটু রূপকথার মতো গোছানো পরিপাটি সুখি জীবন কেনো হলো না?”

কথা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছে,
“চুপ করুন, একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করুন।”

ভোর রাতের দিকে তার চোখে ঘুম এসেছে। হয়তো ক্লান্তিতে।
রোজিনা বেগম পুলিশ দেখেই বললেন,
“কাকে চাই?”

“শোভন সাহেব আছেন?”

কথাটা রান্নাঘর অবদি পৌঁছে গেলো। কথার তখন অবস্থা শোচনীয়। তার হাত পা কাঁপছে।
মালোতি শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ভেঙে পরবেন না আপা, শক্ত হোন। মনের জোর হারাবেন না।”

শোভনকে গ্রেফতার করার পরদিন কথার ফোনে ম্যাসেজ এলো। ম্যাসেজটা পাঠিয়েছে আসিফ।
লিখেছে,
“তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাইনি ঠিকই, কিন্তু তোমার বিয়ে অন্য কারো সাথে হোক সেটাও চাইনি। কেনো জানো? অন্য মেয়েদের মতো তোমায় ব্যবহার করার সুযোগ তখনও পাইনি বলে।
তুমি কী ভোবেছো রূপকথা, আমায় পায়ে পিষে তুমি অন্য কাউকে নিয়ে সুখি হবে? এত সহজে?”

কথা ফোন হাতে নিয়ে হতভম্ব দৃষ্টিতে বসে রইলো। আসিফকে সে ধোঁকা দেয়নি, আসিফ নিজে দিয়েছিলো। কথার সম্পর্কে তার বন্ধুদের কাছে বাজে কথা বলে বেড়িয়েছে। তাছাড়া মামা তো তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলো, সে নিজে ফিরিয়ে দিয়েছে। এরপরও কথার দোষ থাকে কোথায়?

,
চলবে…..