একজন রূপকথা পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0
781

#একজন_রূপকথা
#শেষ_পর্ব
#নুশরাত_জেরিন

সকালের নাস্তাটা প্রতিদিনই কথা নিজের হাতে বানায়। যদিও বাড়িতে রান্নার জন্যই দুজন কাজের লোক আছে, তবুও শোভনের এক জেদ, কথার হাতের নাস্তা ছাড়া সে অন্য কিচ্ছু খাবে না। কথাও মেনে নিয়েছে, লোকটা মাঝেসাঝে একটু আধটু পাগলামি করে, মিষ্টি দুষ্টু পাগলামি। এতটুকু সহ্য করাই যায়।
কিচেনে বসে সে শোভনের আওয়াজ শুনলো। সে গলা উঁচিয়ে ডাকছে,
“আজ খবরের কাগজ আসেনি কথা? কোথায় রেখেছো?”

কথা বিরক্ত হলো। লোকটা চোখের সামনে থাকা জিনিসও খুজে পায় না। সবকিছুতেই তার কথাকে দরকার। সে কিচেন থেকেই বলল,
“একটু ভালো করে খুজে দেখুন না, টি টেবিলের উপরই তো থাকার কথা।”

তার কন্ঠে রাগের আভাস।
শোভন মৃদু হাসলো। মেয়েটার কন্ঠ শোনার জন্য এত কাহিনি অথচ সে বোঝেই না। শোভনকে কিচেনে ঢুকতেও নিষেধ করে দিয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই কথাকে খুজতে কিচেনে দাড়িয়ে থেকেছিলো বলে মেয়েটার সেকি রাগ। কাজের লোকেরা নাকি শোভনের বউ পাগল স্বভাব দেখে মুখ টিপে হেসেছে, কথার ভীষন লজ্জা লেগেছে।

সে চশমা চোখে পরে আবার ডাকলো,
“চা কোথায় কথা?”

কথা ততক্ষণে চায়ের কাপ হাতে ড্রয়িং রুমে এসে দাড়িয়েছে। শোভনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আপনি ইদানীং আমায় খুব জ্বালান, এতটা শোভাও আমায় জ্বালায় না।”

শোভন শব্দ করে হেসে উঠলো। কথা বলল,
“আস্তে, এত জোরে শব্দ করছেন কেনো? মা অসুস্থ না?”

“ঘুম থেকে ওঠেনি?”

“উহু, শরীরটা দিনকে দিন আরো খারাপ হচ্ছে, দেশের বাইরে ভালো ডক্টর দেখাবেন?”

শোভন চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দুলালো। তার মায়ের শরীরে নানা রোগে বাসা বেধেছে। সেই যে তাকে জেলে থাকতে হলো কয়েকটা মাস, তখন কীভাবে থেকেছে তারা সেসব তো শুনেছে শোভন। বৃদ্ধ শরীর সেই ধকল সহ্য করতে পারেনি বোধহয়। শোভন বলল,
“আমার জন্যই মায়ের এই দশা হলো, তাই না কথা?”

কথা চোখ রাঙালো,
“উল্টো পাল্টা কথা বলবেন না, আমার রাগ হয়।”

শোভন হেসে ফেললো,
“আশ্চর্য! তুমি আমায় চোখ রাঙাচ্ছো কথা? তোমার মত বড় ব্যবসায়ী নই, মেয়েদের অনুপ্রেরণার আইডল নই তাই কী আমার সাথে এত বড় অবিচারটা করছো?”

কথা রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেললো।
“আপনি দিন দিন এত দুষ্টু হচ্ছেন, কেনো বলুন তো?”

“একটা শোভা দিয়ে পোষাচ্ছে না, শোভা ২ কে পৃথিবীতে আনার জন্যই বোধহয়! ”

কথা আবারও হাসলো। বলল,
” ওঠেনি সে?”

“উহু, ঘুমোচ্ছে। তাছাড়া উঠলেও তোমার সাথে কথা বলবে না বলেছে, তুমি কাল তার জন্মদিনে সবার শেষে উইশ করেছো।”

কথার অসহায় কন্ঠ শোনা গেলো,
“কী করবো, কাল সেমিনারে বক্তব্য দিতে গিয়ে এত দেরি হয়ে গেলো…!”

শোভন এক হাতে তাকে আগলে ধরলো।
“পাগলি, মন খারাপ করছো কেনো? তোমার মতো একহাতে এতদিক সামলাতে কে পারে বলোতো? সংসার, সন্তান, ব্যবসা… স্বামী! ”

শেষের কথাটা সে দুষ্টুমী করেই বলল। কথা মৃদু ধাক্কা দিয়ে উঠে এলো।
শোভন বলল,
“যেইজন্য ডেকেছিলাম সেটা শুনবে না?”

কথা আগ্রহ নিয়ে তাকালো। শোভনের হাতের খবরের কাগজ তখন তার দিকে ফেরানো। ফ্রন্ট পৃষ্ঠায় তার ছবিটা যেনো জ্বল জ্বল করছে।
শোভন পড়লো,
“কখনও রুপকথার গল্প শুনেছেন? সিনড্রেলা, রাপানজেল অথবা স্নো হোয়াইটের গল্প? ঐ যে সেই সিনড্রেলা, যে সৎ মায়ের অত্যাচারে পিষ্ট হয়ে বাড়ির মালিক হয়েও চাকরের মতো দিন নিপাত করে! অবশেষে যার কষ্টের অবসান হয় রাজকুমারের আগমনে।
আর রাপানজেল! ডাইনীর কাছে বন্দি হয়ে যে জঙ্গলের মাঝে ভবনের উচ্চ শৃঙ্গে বসে কোনো এক রাজকুমারের অপেক্ষা করে! রাজকুমার এসে তাকে মুক্ত করে ফিরিয়ে দেয় তার আসল বাবা মায়ের কাছে! শুনেছেন?
আচ্ছা মনে কখনও প্রশ্ন ওঠেনি, সিনড্রেলা কেনো মুখ বুঝে তার সৎ মায়ের অত্যাচার সহ্য করতো? কেনো প্রতিবাদ করতো না সে?
রাপানজেল কেনো ঐ উচ্চ শৃঙ্গ থেকে একা নেমে আসেনি? স্নো হোয়াইটকে জাগাতে কেনো কোনো রাজকুমারকেই দরকার? কেনো সে একা ঘুম থেকে জাগেনি?
‘রূপকথা নামক মেয়েটির গল্প কিন্তু এমনই এক রাজকন্যার গল্প। উহু ভুল বললাম, এমন নয় একটু অন্যরকম এক ঘুটে কুড়ানির গল্প। যাকে রাক্ষসপুরী থেকে মুক্ত করতে রাজপুত্র আসেনি বরং সে রাজপুত্রকে মুক্ত করে এনেছিলো।
রাক্ষসদের সাথে শুধু রাজপুত্র একাই যুদ্ধ করেনি, সেই রাজকন্যাও রাজপুত্রের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তলোয়ার তুলে নিয়েছিলো…..

কথা বলল,
” আর শুনতে ইচ্ছে করছে না, থামুন।”

“আর্টিকেলটা কে লিখেছে বলোতো, আমার খুব পছন্দ হয়েছে।”

“মালোতি লিখেছে।”

“বলো কী! তোমরা সবাই তো সেলিব্রিটি হয়ে যাচ্ছো! একজন ব্যবসায়ী, অন্যজন সাংবাদিক। দু’দিন পর রাস্তায় দেখা সাক্ষাৎ হলে আমায় চিনতে পারবে তো?”

কথা শোভনের পিঠে মৃদু ধাক্কা মারলো। লোকটা কেমন ধারা কথা যে বলে। চিনতে পারবে না কেনো? সে কী অকৃতজ্ঞ? শোভন পাশে না থাকলে বুটিকের ব্যবসাটা সে এতদুরে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতো? দেশজুড়ে এত নাম ডাক হতো? যদিও শুরুটা সে নিজেই করেছিলো।
ঐ যে শোভনকে জেলে নিয়ে গেলো। তারপর থেকেই তো শুরু হয়েছিলো তার সংগ্রামী জিবন। ফ্লাটটি ছেড়ে বস্তিতে গিয়ে উঠতে হয়েছিলো তাদের। কত জায়গায় না কাজের চেষ্টা চালিয়েছিলো সে! রোজিনা বেগম তখন ছিলের ছাদের মতো। মাতৃছায়া হয়ে পাশে থেকেছেন, সাহস জুগিয়েছেন। আরেকজনও ছিল বৈকি! মালোতি! মেয়েটি বোনের মতো শক্ত খুটি হয়ে আশ্রয়,জুগিয়েছিল।
আসিফ তখন হয়ে উঠেছিলো আরও বেপরোয়া। গয়নাগাটি বিক্রি করে যখন ছোট্ট বুটিকের দোকানটা খুলেছিলো ঠিক তখনই বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছিলো আসিফ। রাস্তা ঘাটে যখন তখন বিরক্ত করতো, আজে বাজে কথা বলতো। একদিন তো সীমা অতিক্রম করে ফেললো। হাত টেনে ধরলো। কথা সহ্য করতে পারেনি। গাল বরাবর কয়েকটি চড় বসিয়ে দিয়েছিলো। আসিফ হতভম্ব হয়েছিল বৈকি। যে মেয়েটা তার সাথে উচু গলায় কথা অবদি বলেনি সে তাকে চড় মারলো! কথা নিজেও নিজেকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করলো। এক সাহসী প্রতিবাদী কথা হিসেবে।
রাকিবের খুনিকেও সে নিজেই খুজে বের করলো। রাকিবের সেই দু’জন রুমমেট। যাদের ঠকিয়ে কয়েক লাখ টাকা সরিয়েছিলো রাকিব, তারাই সুযোগ বুঝে খুন করেছিলো তাকে।
দুজনে যখন আপন মনে আলাপে মত্ত ছিলো তখনই এসব কিছুই কথা রেকর্ড করেছিলো নিজ ফোনে, অবশেষে তুলে দিয়েছিলো পুলিশের হাতে।

মালোতিও ভালো আছে, নিজের সংসার হয়েছে। আগের স্বামী যদিও ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলো, পায়ে অবদি পড়েছিলো। মালোতি যায়নি। সে তখনও বলেছে,
“সেকি, তোমার সাথে এখন বুঝি আমায় মানায়?”

শোভন নিজেও ভালো পজিশনের চাকরী পেয়েছে। তার বন্ধু আশরাফ, বিদেশ থেকে ফিরে শোভনকে নিজ কম্পানিতে চাকরীর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো।
কথা নিজেও ততদিনে অনেকটা এগিয়ে গেছে, মেয়েদের অনুপ্রেরনার চিরচেনা মুখ হয়ে দাড়িয়েছে।

শোভন বলল,
“মালোতি মেয়েটা কেমন হুট করেই আপন হয়ে গেলো তাই না?”

কথা আনমনে বলল,
“হু।”

শোভন আর কিছু বলতে পারলো না। মালোতির কথা বললেই কবিতার কথা মনে পরে। মেয়েটা নিজের জায়গাটা নিজে নষ্ট করে চলে গেলো, কথাকে কষ্ট দিতে গিয়ে নিজের ক্ষতি করে ফেললো।
আসিফের সাহায্য নিয়ে বাড়ি থেকে পালানোর পর আসিফের কামনার স্বীকার হতে হয়েছিলো তাকে, তারপর? তারপর আত্নহত্যা… কথা জেনেছে কিছুদিন আগে। কোনো প্রতিক্রিয়াই সে দেখায়নি। কেমন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো।
শোভন চেয়েছিলো কবিতার মৃত্যুর জন্য আসিফকে শাস্তি দিতে, প্রমাণ জোগাড় করার চেষ্টাও করেছিলো। কিন্তু তার আগেই… আসিফের এক্সিডেন্টটা হয়ে গেলো। এখন তো হুইল চেয়ার ছাড়া চলতেও পারে না।
শোভন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এটাকেই হয়তো রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার বলে।

শোভার ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ। দরজার সামনে এতক্ষণ দাড়িয়ে ছিলো সে, আর সম্ভব হচ্ছে না। সে ডাকলো,
“বাবা!”

মেয়েকে দেখেই শোভনের মুখে হাসি ফুটলো,
“জ্বি আম্মা, ওখানে দাড়িয়ে আছো কেনো, এদিকে আসো।”

শোভা মুখ ফুলালো,
“উহু, মায়ের কাছে আমি যাবো না। আমার বার্থডেতে মা কেনো দেরিতে এলো।”

“সেটা জানতে হলে পত্রিকাটা পড়তে হবে তো। আসো।”

শোভা গুটিগুটি পায়ে বাবার কোল ঘেঁষে দাড়ালো। পত্রিকায় মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে এতক্ষণে তার মুখের অমাবস্যা কাটলো। তবুও রাগ করার ভান করলো।
“এসবে আমি একদম গলবো না।”

“একবক্স চকোলেট দিলেও না?”

শোভা লাফিয়ে উঠলো,
“কোথায় চকোলেট? ”

“তোমার টেবিলের ড্রয়ারে।”

শোভা চলে যেতেই কথা মুখ খুললো,
“এসব আবার কেমন কথা, মেয়েটা জেদ করলেই তাকে এটাওটা দিতে হবে কেনো? অভ্যাস খারাপ হয়ে যাচ্ছে না?”

শোভন উঠে এসে পেছন থেকে জাপটে ধরলো। ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমি তোমায় একটুও ভালবাসি না কথা।”

কথা মৃদু হাসলো।
“আমিও তো বাসি না, একটুও না।”

কথাটা বলতেই আনন্দে তার চোখ ভিজে উঠলো। আশ্চর্য! সেতো কাদতে পারে না, কতদিন তার চোখে জ্বল আসে না৷ আজ হঠাৎ হলো টা কী চোখের!

সমাপ্ত