#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৪৯
আফনান লারা
.
অর্ণবের কাড়ি কাড়ি প্রশ্নের একটা জবাব ও কুসুম দিতে পারেনি।বাংলার পাঁচের মতন মুখ করে টেবিলের সাথে কোমড় ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির ন্যায়।অর্ণব আশ্চর্য হলোনা।কুসুম প্রায়শই এমন উদ্ভট আচরণ করে।সে ভাবলো হয়তবা বই পেয়ে খুশিতে আত্নহারা হয়ে এখন কি বলবে না বলবে তা বুঝে উঠতে পারছেনা।সে নিচে তোষকের উপর গোল হয়ে বসে পড়ে বললো,’পাতিল এনেছি,চাপাতা,চিনি,মিল্ক পাউডার ও এনেছি। ফটাফট চা বানিয়ে ফেলো।’
কুসুম এবার মুখ খুললো।বললো সে দুধ চা বানাতে জানেনা।বাড়িতে রঙ চা খেতো সবসময়।অর্ণবদের বাড়িতে আসার পর মিশু ভাবী কিংবা মা চা বানিয়ে দিলে সে হাতে করে নিয়ে আসতো অর্ণবের জন্য।যেটা সে অর্ণবের জন্য বানিয়েছিল একবার, সেটা ছিল রঙ চা।
অর্ণব ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,’কথা বললে তাহলে।আমি তো ভাবলাম আজ বুঝি কথাই বলবেনা’
—
পাঞ্জাবির হাতা কুনুই অবধি টেনে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছে অর্ণব।পাতিল হাতে নিয়ে বললো,’কি ঝামেলা!এটাকে তো মাজতে হবে।ধুর!!!চা ‘ই খাবোনা’
পাতিল রেখে অর্ণব চলে গেলো।
—
কলিংবেলের গুনে গুনে তিনবার আওয়াজ কানে আসায় কাজলের কৌটো ফ্লোরে গুছিয়ে রেখে জাহান ছুটে এসে দরজা খুলে দিলো।কুসুম এসেছে।হাতে একটা স্টিলের বাটি।বাটিটা এগিয়ে ধরে সে বললো,’কিছুটা পাউডার দেবে?হাঁড়ি পাতিল মাজবো’
জাহান কপাল কুঁচকে বললো,’মাজবেন কি দিয়ে?মাজুনি আছে তো?’
-‘থাকলে একটা দাও।না থাকলে হাত দিয়ে চালিয়ে নেবো।’
জাহান বাটি নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে হুইল পাউডার ঢেলে একটা মাজুনি সহ এনে বললো,’হাত দিয়ে কেমনে করবেন?হাত কাটা না?জামাইরে দেখাইছেন?’
কুসুম জবাব দিলোনা।বাটি নিয়ে চলে আসলো।রান্নাঘরে এসে ভেসিনের কাছে দাঁড়িয়ে বাম হাত দিয়ে আর ডান হাতের হালকা সাহায্যে যতটুকু পারলো চায়ের পাতিলটা মেজে নিলো।ভাল করে পরিষ্কার করে চায়ের পানি বসিয়ে দিয়ে আঁচল দিয়ে আস্তে আস্তে কাটা আঙ্গুলটা মুছে ছুটে গেলো অর্ণবের কাছে।সে তখন কুসুমের বইগুলো উল্টে পাল্টে দেখছিল ভেতরের রুমে। আগের মতন দরজার কিণারা জড়িয়ে ধরে কুসুম দাঁড়িয়ে থেকে এক দৃষ্টিতে অর্ণবকে দেখছিল।অর্ণব খেয়াল করেনি।এক এক করে বইয়ে আঁকা আম,জাম,কাঁঠাল, কলা এসব দেখছে মনযোগ দিয়ে।
-‘বলছি,দুধ চায়ে কি রঙ চায়ের মতন মশলা দিতে হয়?’
অর্ণব বই থেকে চোখ হটিয়ে কুসুমের দিকে তাকিয়ে বললো,’পাতিল মাজা ছাড়া কিসের চা?’
-“মেজেছি’
-“কি করে?’
-“যেমন করে, করে।তেমন করে।’
অর্ণব চট করে বিছানা থেকে নেমে রান্নাঘরে এসে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললো,’ওহ।বুঝলাম।মশলা দিতে হবেনা।পানি গরম হলে চা পাতা দিবে।যত কাপ চা তত কাপ চাপাতা’
কুসুম মাথা নাড়ালো।অর্ণব একটা বাটি নিয়ে বললো,’এটাও মেজে নাও।কাপ কিনতে ভুলে গেছি।বাটিতে চা খাব।আর কত কি যে দেখতে হবে আমায়’
কুসুম বাটিটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।অর্ণব চা পাতার প্যাকেট খুলে ঘ্রাণ নিচ্ছিল।সে না সরলে বাম হাতে মাজবে কি করে?নড়ছেই না।অর্ণব প্যাকেট থেকে নাক উঠিয়ে বললো,’কি হলো?থাক,দাও আমি মাজবো।না জানি আজ তোমার কি হয়েছে।সন্ধ্যায় ছাদে গিয়েছিলে?মাথা পাগল পাগল করে?ঘুরতে ইচ্ছে করে চরকার মতন?লাফাতে ইচ্ছে হয়?’
কুুসুম মাথা নাড়িয়ে না জানালো।অর্ণব ওর থেকে বাটিটা কেড়ে নিয়ে বললো,’ভূতে তো ধরেনি।তাহলে কথা শুনছোনা কেন?এমন ব্যবহারের কারণ কি?’
কুসুম তাও কিছু বললোনা।অর্ণব বাটিটা মাজতে মাজতে বললো,’ভাগ্যিস চামচ কিনেছি।নাহলে আঙ্গুল দিয়ে নাড়তে হতো।
চা বানাতে এত হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।ভাত তরকারি রাঁধতে গিয়ে কি হবে খোদা জানে’
অনেক যুদ্ধ করে চা বানিয়ে বাটি হাতে সেই নিচে বিছানো বিছানায় বসে পড়েছে সে।কুসুম ওর থেকে একটু দূরে বসে দেখছিল ওকে।অর্ণব কপালের ঘাম মুছে চায়ে চুমুক দিয়ে চোখ বুজে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,’রেস্টুরেন্টের চায়ের স্বাদকেও হার মানিয়ে দেবে আমার হাতের এই চা।জাস্ট ওসাম হয়েছে।’
কুসুম মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে।অর্ণব বাটিটা রেখে বললো,’তোমার জন্য দিলে না কেন?’
-“ইচ্ছে নেই।আপনি খান’
অর্ণব আরও দুবার চুমুক দিয়ে বাটিটা ওর দিকে এগিয়ে ধরে বললো,’আমি জানি তুমি এই চা খেতে দ্বিধান্বিত হবেনা কারণ সেদিন ঢাকায় ফিরে আসার আগে আমি পেছনে তাকিয়ে তোমায়, আমার মুখের চা খেতে দেখেছি।
কুসুম লজ্জাবতী পাতার মতন লজ্জা পেয়ে মুখ লুকাতে অন্য দিকে ফিরে বসেছে।অর্ণব বাটিটা নিচে রেখে উঠে চলে গেলো।ও যাবার পরপরই কুুসম ব্যস্ত হয়ে চায়ের বাটিটা হাতে নিলো যেন সে এটারই অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ।
হাসিমুখে চায়ে চুমুক ও দিলো সে।অর্ণব দূর থেকে এই দৃশ্য দেখেছে।
—
বাটিটা আর পাতিল ভেসিনের কাছে এনে রেখে কুসুম শাড়ীর আঁচল কোমড়ে গুজছিল এগুলো ধুবে বলে। সেসময়ে অর্ণবের ডাক শুনতে পেয়ে ওসব রেখে ছুটে গেলো ওখানে।
-‘আমার সামনে এসে বোসো’
-‘কেন?পড়াবেন এখন?তার আগে আমি বাটি আর পাতিলটা ধুয়ে আসি?’
-“নাহ।বসতে বলেছি তোমায়।ত্যাড়ামো করো কেন?’
কুসুম এগিয়ে এসে বিছানায় বসলো।অর্ণব ওর দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে ছিল।ও বসার পর খপ করে ডান হাতটা টেনে ধরলো ওর।কুসুম ভয় পেয়ে বাম হাতে মুখ ধরেছে।
-‘তোমার আঙ্গুলে এমন হলো কি করে?আমাকে বললে কি তোমায় চিবিয়ে খেয়ে নিতাম?’
-“নাহ।ও কিছুনা’
-“এটা কিছুনা?বারবার শাড়ীর যে অংশে আঙ্গুল ঢাকছিলে সে অংশে রক্তের লাল রঙ দেখেছি আমি।হলুদ শাড়ী পরেছো কিনা!!”
কথাটা বলেই অর্ণব চলে গেলো।কুসুম শাড়ীর আঁচল টেনে দেখে নিজের কপালে নিজে চড় মারলো।অর্ণব বাসার পাশের একটা দোকান থেকে মলম কিনে এনেছে।কুসুম ভাবছিল হঠাৎ কই গেছে সে।মলম নিয়ে এসে ওর হাতে সুন্দরমতন লাগিয়ে দিতে দিতে অর্ণব বললো,’আমি আরও ভাবলাম ভূতে বুঝি মুখের বুলি কেড়ে নিলো তোমার।এখন দেখি কাহিনী অন্য।আর কখনও এমন করবেনা।ব্যাথা পেলে জানাবে,আমি ঠিক করে দেবো।তুমি জানো এটাতে মলম না দিলে পঁচে ইনফেকশান হয়ে যেতো?’
-‘আচ্ছা,একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
-‘না’
-“করি না!’
-“হুম শুনছি।বলো’
-‘আপনি আমাকে তালাক দিবেন কখনও?’
অর্ণব চোখ বড় করে তাকালো কুসুমের দিকে তারপর মলমের সাথে আনা সাদা কাপড় দিয়ে আঙ্গুল বাঁধতে বাঁধতে বললো,’তালাক শব্দটা কে ঢুকিয়েছে তোমার মাথায়?’
-“এটা তো দূর্বল সম্পর্কের পরিবারে চিরাচরিত ‘
-‘নাহ।এটা চিরাচরিত নয়।আমি যতদূর জানি তোমার মাথায় যে শব্দ নাই সে শব্দের ব্যাপারে তুমি জানো না,বুঝোনা।তাহলে তালাকের ব্যাপারে কে বলেছে তোমায়?’
-“কেউনা।উত্তর তো দিবেন’
-“তালাক দেওয়ার মতন কাজ করলে নিশ্চয় দেবো’
কুসুম উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে।ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,’আমি তো নিজ থেকে পড়তে পারবোনা।তাহলে? ‘
-“পড়ার সঙ্গে তালাকের কি সম্পর্ক?এই তোমাকে সত্যি ভূতে ধরেছে?নাকি হাতের ব্যাথায় মরিয়া হয়ে উঠতেছো?কোনটা?’
-‘আপনি তো বললেন তালাক দেওয়ার মতন কাজ করলে তালাক দিবেন’
-“তুমি আারেক ছেলের সাথে ভেগে যাবে?’
কুসুম জিভে কামড় দিয়ে বললো,’না! তা কেন করবো?’
-“তাহলে আর কিছু বলবেনা এটা নিয়ে।চুপচাপ বসে থাকো।বই এনেছি বই দেখো।বই না পড়ে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেও জ্ঞান বাড়ে’
-‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
-“যেগুলো ধুতে এত কান্ড।সেগুলো ধুবো।তোমাকে কি বললাম?’
কুসুম দ্রুত গতিতে বিছানায় বসে বই দেখা শুরু করে দিলো।অর্ণব রান্নাঘরের দিকে গেছে।নতুন বাতির আলোয় বইগুলো কি সুন্দর দেখায়।প্রতিটা পাতায় হাত বুলিয়ে দেখে কুসুম।
সেগুলোর ঘ্রাণ প্রাণভরে নিলো।অক্ষরগুলোতেও হাত বুলালো।এক দারুণ ভাল লাগা কাজ করছে।
-‘আমিও পড়তে জানবো।লিখতে পারবো।উনিও আমাকে পছন্দ করবেন।আচ্ছা তখন কেন বললেন আমি আরেক জনের সাথে ভেগে যাব?তিনি কি জানেননা আমি তার জন্য কত পাগল?এটা আবার প্রমাণ করতে হবে নাকি।এটা তো তার জানার কথা।শুধু শুধু কথাটা বলে কষ্ট দিলেন।
কিন্তু একটু ভাল লাগলো যে উনি অন্তত আমার লেখাপড়া নিয়ে অসন্তুষ্ট নন।আমার জীবন সুরমা আপুর মতন হবেনা।
ভিন্নতর হবে।’
হঠাৎ বেজে উঠলো কুসুমের ফোন।এত কিছুর মাঝে ফোনের কথা ভুলেই গিয়েছিল সে।বালিশের তলা থেকে বের করে কানে ধরলো।অর্ণবের মা ফোন করেছেন। সালাম দিয়ে কুসুম জিজ্ঞেস করলো তিনি কেমন আছেন।
তিনি সালাম নিয়ে অর্ণবের কথা জিজ্ঞেস করে শেষে বললেন,”তোমাকে আদর যত্ন করে?’
কুসুম আঙ্গুল উল্টে পাল্টে বললো,’হুম।উনি অনেক ভাল মানুষ।’
-“নিজের খেয়াল রেখো।অর্ণবের খেয়াল সে নিজেই রাখতে জানে।তোমার জন্য চিন্তা হয়।বাচ্চা মেয়ে একা একা সংসারে নেমেছো।রান্না তো ঠিকমত পারবেনা।না পারলে বলিও।অর্ণব দেখিয়ে দেবে।নিজে পাকামো করিওনা।
পাকামোর জিনিস মন্দ হয়।বুঝলে?’
কুসুম আচ্ছা বলে ফোন রাখলো। অর্ণব হাত ঝাড়তে ঝাড়তে আসছিল এদিকে।সে ছুটে গিয়ে গামছাটা খুঁজে এনে ওর সামনে এগিয়ে ধরেছে।
চলবে♥
#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৫০
আফনান লারা
.
গামছাটা নিয়ে অর্ণব বিছানায় উঠে বসেছে।কুসুম আগের জায়গায় চুপ করে ওকে মুখ মুছতে দেখছিল।
অর্ণব সেটা বুঝতে পেরে বইগুলোর দিকে একবার চেয়ে নিলো।সব এলোমেলো করে রাখা।তার মানে খুলে দেখেছে।
বাংলা বইটা খুঁজে একটা পৃষ্ঠা বের করে সে বললো,’কাল ভোরে তোমায় এই পৃষ্ঠার অক্ষরগুলো শেখাবো।তোমার এই মূহুর্তের কাজ হলো অক্ষরগুলো বড় বড় চোখ দিয়ে দেখে নেওয়া।যেন আমি তোমায় লিখে দেখালে তুমি চট করে লিখতে পারো না দেখেই।বুঝেছো?’
কুসুম মাথা নাড়িয়ে বইটা নিলো।অর্ণব বইটা আবারও কেড়ে নিয়ে বললো,”ডান হাতের আঙ্গুল তো কেটে বসে আছো।লিখবে কি করে?আশ্চর্য! আচ্ছা কাল পড়া শেখাবো।পরে লেখা।তাও দেখো অক্ষর।ধরো’
অর্ণব বইটা ওকে দিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে।কুসুম বই নিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে নিচে বসে মনযোগ সহকারে অক্ষরগুলো রপ্ত করা শুরু করলো।অর্ণব ফোন বের করে ফেসবুকে ঢুকে সব পোস্ট দেখছিল তখন।
—
আকাশে সরু চাঁদ।খোলা বারান্দার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকা জবা গাছটার ঢাল নড়ছিল মৃদু বাতাসে।পাতার নড়চড়ে চাঁদের ঝলক কেটে কেটে আসছিল চোখের সামনে।বই থেকে চোখ উঠিয়ে কুসুম তাই সেদিকেই তাকালো।খুব ইচ্ছে হলো ছাদে গিয়ে চাঁদ দেখার।সে জন্য বই রেখে ছুটে অর্ণবের কাছে এসে বললো,’ছাদে যাবেন?’
‘কেন?’কি কারণ?’
‘চিকন চাঁদ দেখবো।খুব ইচ্ছে হয়।আগে নদীর পাড়ে গিয়ে দেখতাম।এখন ছাদে গেলে হয়ত সেরকম দেখা যাবে।একা যেতে ভয় লাগে।আপনি যাবেন আমার সঙ্গে?’
অর্ণব উঠে বসলো।হাঁটুর উপর হাত রেখে তাতে থুঁতনি ভর দিয়ে বললো,’জানো আমি পথ দিয়ে আসার আগে মেসতাক গাছ দেখেছিলাম।ওগুলোর ডাঁটা দিয়ে পিটালে খুব ব্যাথা পাওয়া যায়।
বই আজ আনলাম আর আজকেই তুমি অমনযোগী হয়ে যাচ্ছো।ঐ বেত দিয়ে মেরে মেরে দুদিনে তোমাকে আমি আমার লেভেলের শিক্ষিত বানিয়ে নিতে পারবো।আমাকে চেনা আছে তোমার?’
কুসুম ভয় পেয়ে দরজার ফটক ছেড়ে ছুটে চলে গেলো বইয়ের কাছে।
অর্ণব ওর রিপোর্টটা বের করে হাসপাতালের নাম্বারে কল করেছে।সেখানের নার্স নাম আর ফোন নাম্বার মিলিয়ে জানালো, যে রিপোর্টের রেসাল্ট দেওয়া হয়নি সেটা আসলে ঢাকা পাঠানো হয়েছিল পরীক্ষা করাতে।পেশেন্ট যদি এখন ঢাকা থেকে থাকে তবে তার প্রেজেন্ট এড্রেস দিলে শেষ রিপোর্টটার ফাইল এখন তার কাছে যাবে।অর্ণব এই বাসার এড্রেসটা দিয়ে দিলো।’যাক এবার একটু শান্তি লাগে।’
কুসুম বই রেখে বারান্দাতে এসে উঁকিবুকি দিচ্ছিলো।চাঁদটা দেখার অনেক অনেক শখ জেগেছে।বাড়িতে থাকতে একা একাই নদীর ধারে ছুটে চলে যেতো সে শুধুমাত্র চাঁদ দেখতে।অর্ণব তো সব কিছুতেই মানা করে।
‘তাই বলে কি স্বাদ মেটাবোনা?নাহয় তাকে না জানিয়ে স্বাদ মেটাবো।।’
যেমন ভাবা তেমন কাজ।পা টিপে টিপে দরজাটা আস্তে করে খুলে কুসুম এক দৌড়ে ছাদে এসে হাজির।অর্ণব তার ব্যাগ থেকে চাকরির প্রস্তুতিমূলক তিনটে বই বের করে তার মধ্য থেকে একটা নিয়ে পড়ছিল।ফেসবুকে এখন আর ভাল লাগেনা।কেমন যেন পানসে পানসে।বইতেই ভাল লাগে।
ছাদের সিঁড়ি যেই জায়গায় সেই জায়গা থেকে কুসুমের বিশাল আওয়াজে চিৎকার ভেসে আসলে অর্ণবের কানে।চট করে শোয়া থেকে উঠে বসে বই রেখে নেমে দিলো এক দৌড়।ড্রয়িং রুমে এসে ওকে না দেখে দরজার দিকে চেয়ে দেখলো দরজা আগে থেকে খোলা।এবার দরজা খুলে সে ছাদের দিকে গেলো।নিচ তলা থেকে সুলতান শাহ আর মিজুয়ানা বেগম ছুটে আসছেন চিৎকার শুনে।সবাই অর্ধেক সিঁড়ি পর্যন্ত এসে থেমে গেলো।কারণ অর্ণব নিজেও থেমে গেছে।কুসুম সিঁড়িতে পা ধরে বসে ছিল।চোখে অজস্র পানি।অর্ণব কোমড়ে হাত রেখে বললো,’কি হলো তোমার?আমার কথার অবাধ্য হওয়াই কি তোমার স্বভাব?কয়বার মানা করেছি?কোন সাহসে বের হলে?এখন আবার চেঁচালে কেন?পায়ে কি হয়েছে তোমার?’
মিজুয়ানা বেগম আর জাহান এগিয়ে এসে দাঁড়ালো ওর কাছে।মিজুয়ানা বেগম বললেন,’আহা বকছো কেন!মেয়েটা দেখোই না ভয় পেয়েছে কত!তার উপর হয়ত ব্যাথাও পেয়েছে।মা তুমি ঠিক আছো?’
কুসুম হাত দিয়ে মুখ মুছতেছে আর বারবার পিছনে ফিরে চিলেকোঠার দিকে তাকাচ্ছে।অর্ণব আরেক ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো কি সমস্যা।
‘শশশশশিয়াল’
‘শিয়াল?মানে?’
সুলতান শাহ কেশে গলাটাকে হালকা করে নিলেন সেসময়ে।তারপর হাতের লাঠিটাকে ফ্লোরে শক্তপোক্ত করে ধরে বললেন,’চলো সবাই।রাত করে বাহিরে থাকতে নেই এতো’
অর্ণবের মনে সন্দেহ হলো তাই সে কুুসুমের পাশ কাটিয়ে ছাদে গিয়ে যে দৃশ্য দেখলো তা দেখে মাথাটাই হ্যাং হয়ে গেছে।দুটো বড় সাইজের শেয়াল বাঁধা রডের সাথে।দুটো শেয়ালই দাঁত বের করে তাকিয়ে আছে।অর্ণব চোখ কপালে তুলে পিছিয়ে গেলো।কুসুমের কাছে এসে থামলো সে।সুলতান শাহ মাথার টুপিটা হাতে নিয়ে বললেন,’আসলে শেয়ালের মাংস খেলে বাত ব্যাথা সেরে যায়।এটা আমি বলিনা।সবাই বলে।শেয়ালের মাংস পাওয়া তো অনেক কঠিন সেটা অবশ্য তুমি জানো।
আমার আবার জাতের বাতব্যাথা।
সারার নামই নেয়না।যার কারণে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শেয়াল পালবো।তারপর এদের নাদুসনুদুস বানিয়ে একদিন রোস্ট বানিয়ে খাবো।ঘন করে।মোগলীয় ভাব আসবে বুঝলে?’
অর্ণব কপালের ঘাম মুছে বললো,’এরা কি সারাদিন এমনই থাকে?’
-“আরেহ না।দিন হলে ছেড়ে দিই।বনবাদাড়ে ঘুড়ে ফিরে আনন্দ করে।এরপর রাতে আবার ভাল ছেলের মতন ফিরে আসে।আমার শিকারি শেয়াল গুলা।আমাকে চেনে ভালমতন।দেখবে?’
সুলতান শাহ এগিয়ে এসে হাত নাড়িয়ে কি সব দেখালো।শেয়ালগুলো একসাথে চেঁচিয়ে উঠেছে তার অঙ্গভঙ্গিমা দেখে।অর্ণব দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।ঢোক গিলে বললো,’কর্পোরেশনের লোকেরা দেখলে তো নিয়ে যাবে’
-“দেখাবে কে?কার এত বড় সাহস?’
সুলতান শাহের অগ্নি রুপ দেখে অর্ণব কুসুমের হাত টেনে ধরে বললো চলো যাই।
কুসুম পায়ে হাত দিয়ে বললো,’আপনি যান।আমি ধীরে সুস্থে আসছি’
‘কেন?আমার সাথে চলো।এখানে এক মূহুর্তও থাকা ঠিক হবেনা।কোথায় এসে পড়লাম।এর কারণে বুঝি মৃদুল বলছিল আর কদিন থাকবো আমি।শয়তানটা সব জেনেও আমায় জানায়নি।একটুর জন্য সিবারেল হার্ট এ্যাটাক হয়ে বসতো।’
সুলতান শাহ তার স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেছেন।যাবার সময় ছাদের দরজায় তালা মেরে গেছেন।অর্ণব কুুসমকে উঠতে বললো কিন্তু সে পায়ে মচ খেয়ে বসে আছে।উঠতেও পারছিলনা।
এদিকে অর্ণবের কেমন অস্বস্তি লাগছিল।সে বুঝতে পারছিলানা এমন সিচুয়েশন থেকে রেহায় কি করে পাবে।
কুসুম ওর হাত ধরে অনেক চেষ্টারর ফলে উঠতে পারলেও হাঁটার দম আর পেলোনা।অর্ণবের পাঞ্জাবির বোতাম সমেত খাঁমছে ধরে রাখলো শক্ত করে।হাঁটতেই পারছেনা।চাইলে পারবে কিন্তু তার মাঝে সাহস আসছেনা।কদম রাখলেই কেমন ঝি ঝি করে আসে। যেন পায়ে কোনো বল নেই।পা একটি আলাদা অংশ হয়ে গেছে শরীর থেকে।হয়তবা মচ সত্যিই লেগেছে।তবে এই মচ যাবেই বা কি করে?
নিজের পাঞ্জাবিতে টান খাবার পর হুশ ফিরে আসলো অর্ণবের।সে কুসুমের দিকে চেয়ে বললো,’তোমার পায়ে কি হয়েছে আবার?’
‘ঐ আসলে শিয়াল দেখে ভয়ে ছুটতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম তার পর থেকে হাঁটার জো পাচ্ছিনা’
‘কোলে ওঠার বাহানা নয়তো?যদি তাই হয় তবে শূন্যে ছেড়ে দেবো’
কুসুম অর্ণবের পাঞ্জাবি ছেড়ে দিয়ে বললো,’আপনি যান।আমি ধীরে ধীরে চলে আসবো ‘
অর্ণব নিচু হয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়েছে।সামনের দিকে তাকিয়ে চলেছে এবার।কুসুম হাতদুটোকে একসাথ করে রেখে অবাক চোখে দেখছে ওকে।
এ কেমন অনুভূতি বলে বোঝাতে পারছেনা সে নিজের কাছেই।এ প্রথম অর্ণবের এমন আচরণে অবাক হবার সীমানা ছেদ করে গেলো মনের ভেতর।অর্ণব যেতে যেতে বললো,’দেখলে?আমার কথা না শুনলে কত কি বিপদ হয় তোমার?তার পরেও তো আমার কথা অমান্য করো।আমি ভাবতাম আমি তোমায় পছন্দ করিনা।এখন দেখছি তুমিও আমায় পছন্দ করোনা।আমার কথা মাথায় আনো না’
‘সেটা না।আমি তো এমনেই একটু দেখতে গিয়েছিলাম।সব ছাদ তো এমন দূর্ঘটনাপ্রবণ হয়না।যেমন আপনাদের ছাদ কত মনোমুগ্ধকর ছিল।গেলেই মন ভাল হয়ে যেতো।কিন্তু এই ছাদ যে এমন দুঃস্বপ্নের মতন হবে তা কি আমি জানতাম?’
‘জানলে মানুষ কোনো ভুলই করতোনা জীবনে।যাই হোক, আর কখনও যেন আমি তোমায় আমার কথার অবাধ্য হতে না দেখি।’
কথাটা বলে অর্ণব ধপ করে ফেলে দিলো ওকে বিছানায়। তারপর হাতের কব্জি কচলাতে কচলাতে বললো,’দেখে মনে হয় ত্রিশ কেজিও হবেনা।সব দেখি হাড্ডির ওজন।হাত ব্যাথা হয়ে গেলো আমার।ইচ্ছে করছে এক চড় মেরে দেই। কিন্তু তোমায় মারলে দশ পাড়ায় আগুন লেগে যাবে।আমার বাপে কুমিল্লা থেকে এসে আমাকে একটার বদলে একশোটা চড় মেরে দেবে।উনাদের কলিজার টুকরা তো তুমি’
কুসুম গালে হাত দিয়ে বললো,’আমি কাউকে বলবোনা সত্যি’
অর্ণব মাথা এগিয়ে এনে কুসুমের গাল টিপে ধরে বললো,’যে স্বাদের গাল আপনার।টিপে ধরলে একদিন লাল থাকবে আর চড় মারলে এক বছর লাল থাকবে।এখন মারলে কাল সকালে দেখবো বাবা মা এসে হাজির বেড়াতে।বাহানা হলো তাদের ছেলে তাদের বাবু পুত্রবধূর যত্ন নেয়না ঠিকমত।কি গো সত্যি বলছিনা??’
কুসুম চুপ করে চেয়ে ছিল।অর্ণব ওর গাল ছেড়ে দিয়ে ওর পাশে বসে কপাল আবারও মুছলো তারপর বললো,’আমায় খুব জলদি মেসের আশেপাশে বাসা খুঁজতে হবে। এদের সাথে একি ছাদের নিচে থাকা অসম্ভব। শেষে কিনা শেয়ালের সাথে!এই জন্যই কি আগের ভাঁড়াটিয়ারা পালাতো?এ্যাই তুমি ভুলেও ছাদে যাবেনা।জামাকাপড় সব বারান্দায় শুকাবে।শিয়ালের কামড় জঘন্য।’
কুসুম ফিসফিস করে বললো,’আপনি জানলেন কি করে?’
‘গোটা মুরগী গিলে খাওয়া কি খরগশের কাজ??ওটা শিয়ালের কাজ।তার মানে সে হিংস্র।প্রয়োজনে মানুষের ক্ষতি ও করতে পারে।আমি আরও একবার করে মানা করছি তোমায়,কখনও ছাদে যাবেনা।মনে থাকবে?’
চলবে♥
#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৫১
আফনান লারা
.
কুসুম আগের মতন মাথা নাড়িয়েছিল।দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ শুনতে পেয়ে অর্ণব গিয়ে দরজা খুলেছে।জাহান হাতে করে রাতের খাবার নিয়ে এসেছে।কুসুম যেতে পারবে নাকি পারবেনা তাই ভেবে খাবার তারা উপরে পাঠিয়ে দিলো।অর্ণব ট্রেটা নিয়ে টেবিলে এনে রাখলো।কুসুম বিছানায় বসে দেখছিল সব।অর্ণব সেখানে থেকে জিজ্ঞেস করলো এখন খাবে কিনা।কুসুম খেতে মানা করে দিয়েছে।
অর্ণব তাই খাবারগুলো ঢেকে রেখে নিচে বসে ভাবতে লাগলো এখন টিভি হলে মন্দ হতোনা।সময় কাটানো যেতো।টাকা জমাতে হবে টিভির জন্য।কুসুম মাথা বাঁকিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল ও কি করছে ওখানে।কিন্তু দেখছেনা কিছুই।
হাতে হিসাব নিকাশ করে অর্ণব আবার ফেরত চলে আসলো।কুসুমের পায়ের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বললো,’তোমার পায়ে মনে হয় মচ লেগেছে।’
এটা বলেই পা মুঠো করে ধরলো সে।কুসুম চিৎকার করে সরে গেলো।অর্ণব ওর পা আরও শক্ত করে ধরে আটকে বললো,’এ্যাই নড়বেনা।আমি শুধু পায়ের মচ সরিয়ে ফেলবো।তুমি কি চাওনা ঠিক হতে?তোমাকে কি কোলে করে নিয়ে ওয়াশরুমে যাব আমি?তুমি চাও সেটা?’
কুসুম মাথা নাড়িয়ে না জানালো।কথার ছলে অর্ণব কুুসুমের পা ধরে উল্টো দিকে মোচরাতেই কুসুম এক চিৎকার দিয়ে আবার চুপ হয়ে গেছে।সাথে গেছে তার পায়ের ব্যাথাটাও।
পা ধরে হেসে দিলো সে।অর্ণব ভেংচি কেটে চলে গেছে আবার।
কুসুম নিচে নেমে অর্ণবের পিছু পিছু যাওয়া ধরতেই মনে হলো বমি আসছে।ওদিকে না গিয়ে ওয়াশরুমেই চলে গেছে সে।
ইদানিং শরীর বেশ দূর্বল লাগে।অর্ণবকে বলা দরকার বলে মনে হয়।পরে মনে হয় কম খাওয়া দাওয়ার কারণে দূর্বলতা ঝেপে বসেছে।
ওয়াশরুম থেকে বের হবার পরেই কুসুম দেখলো অর্ণব আগে থেকে কোমড়ে হাত রেখে ওর অপেক্ষা করছিল।ও বের হবার পর বললো,’রেডি হয়ে নাও।আমরা হসপিটাল যাচ্ছি।কুমিল্লার ডাক্তারের স্লো মোশন রেসাল্ট আমার চাইনা।
আজ এখানকার ডাক্তার দেখাবো।কাল রিপোর্টে দেখবো কি আসে।চলো আমার সাথে’
‘নাহ।আমি ঠিক আছি।কম খাই বলে হয়ত এমন দূর্বল হয়ে পড়েছি।
বেশি খেলে ঠিক হয়ে যাব’
‘বেশি খেতে পারছো কই?খাওয়ার আগেই তো বমি করে ফেলতেছো।আমি আর অপেক্ষা করতে পারবোনা।অসুখ ঘরে পালার জিনিস না। এটা তোমার রোগ।ঔষুধ খেলে সেরে যাবে।রেডি হতে বলেছি,রেডি হবা।এত কথা বলার কোনো মানে আছে?’
‘অনেক রাত হয়ে গেছে।আচ্ছা কাল সকালে যাব আমরা’
‘কাল আমার রেসাল্ট দিবে।আমাকে সারাদিন ভার্সিটিতে থাকতে হবে।তাই বলছি এখন চলো।রিপোর্ট দরকার হলে আমি আসার আগে নিয়ে আসবো কাল।ডাক্তার কেও দেখিয়ে নেবো।’
কুসুম মাথা নাড়লো।এক কাপড়েই অর্ণবের সঙ্গে নামলো রাস্তায়।অর্ণব একটা পানির বোতল কিনে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে।বাসায় পানির গ্লাস নেই।যাবার পথে গ্লাস ও কিনতে হবে।
কুসুম বোতলের অর্ধেক পানি খেয়ে নিয়েছে এই টুকু সময়েই।একটা সিএনজি নেওয়ার পর অর্ণব কুসুমের থেকে পানির বোতল নিয়ে নিজেও পানি খেলো।
অনেকটা সময় লেগে যাচ্ছে হসপিটাল অবধি আসতে আসতে।কুসুমের সেসময়টুকুতেই ঘুম এসে গেছে।অর্ণবের ঘাড়ে মাথা রেখে ঘুমায় সে।
অর্ণব ভাবছিল অন্য কিছু।এমন রোগের কথা এর আগে সে শোনেনি।খেতে গেলে বমি পায়,অতিরিক্ত বমি ভাব,সারাক্ষণ মাথা ধরা।এসব কিসের লক্ষণ?
হসপিটাল আসতে আসতে রাত এগারোটা বেজে গেছে।অর্ণব কুসুমকে জাগিয়ে তুলে নামতে বললো।ভাঁড়া দিয়ে ওর হাত ধরে হসপিটালের ভেতরের দিকে গেলো সে।একজন নামকরা ডাক্তারের সিরিয়াল নিয়েছে।অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করতে হবে।রুগীর লম্বা লাইন।
কুসুম বসে বসে হাই তুলছে।অর্ণবের মনে হলো হয়ত ওর খিধে লেগেছে।ক্যানটিন থেকে একটা স্যান্ডুইচ কিনে এনে ওর হাতে ধরিয়ে দিলো আর অন্য হাতে সুপারির টুকরো তিনটে।বললো বমি আসলে সুপারি মুখে পুরে নিতে।
‘আপনি খাবেননা?’
‘খিধে নেই।’
অর্ণব এবার হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে গেলো।ঠাণ্ডায় গা কাঁপছে কুসুমের।হাসপাতালে সব খানে এসি অন করা।আঁচল টেনে কাঁধ ঢেকে নিলো সে।আশেপাশে সব রোগী আর তাদের পরিবারের মানুষজন।সবাই অপেক্ষা করছে ডাক্তারের।
রাত বারোটা দুই মিনিটে এসে কুসুমের সিরিয়াল ডাকা হলো।৭৬।
অর্ণব কুুসুমকে নিয়ে ঢুকেছে রুমে।ডাক্তারকে সালাম দিয়ে দুজনে বসলো।ডাক্তার কুসুমের থেকে জানতে চাইলেন ওর কি সমস্যা। সে পুরোটাই বললো।খাওয়ায় অরুচি,সকাল থেকে রাত অবধি মাথা ধরা,অতিরিক্ত বমি আসা। বমির কারণে খেতে না পারা,চুলে হাত দিলেই অনেকগুলো চুল উঠে আসা।
ডাক্তার সব শুনে বেশ কয়েকটা টেস্ট দিলেন।এরপর অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বললেন,’লক্ষণ ভাল দেখছিনা।যত্ন নিবেন উনার।রিপোর্ট আসা পর্যন্ত কিছু বলতেও পারছিনা।মেন্টালি স্ট্রং থাকবেন আশা করি’
ডাক্তার উঠে তার প্রাইভেট রুমে চলে গেছেন।অর্ণব প্রেসক্রিপশন নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বের হতে হতে ভাবলো এসব বলার কারণ কি হতে পারে।
গলা শুকিয়ে গেছে তার।কুসুমকে বললো পানি দিতে।সে খালি বোতল দেখিয়েছে।প্রেসক্রিপশনটাকে রিসিপশানে দিয়ে অর্ণব কুসুমকে বললো নার্সের সাথে যেতে।ও পানি খেয়ে ফিরবে।কুসুম তাই নার্সের সাথে চলে গেলো।
টেস্ট করাতে করাতে বেজে গেলো রাত ১টা।অর্ণব আর কুসুম এবার গাড়ী খুঁজতে খালি পথে হেঁটে চলেছে।কুসুম মাথার চুলগুলো বারবার করে কানের পেছনে গুজতে গুজতে বললো,’আমার কি হয়েছে বুঝলাম না।ডাক্তার এত ভয় দেখালো কেন?’
‘কিছু হয়নি।ডাক্তাররা ওমন বলে।’
‘তাহলে আপনার মন খারাপ কেন ওতো?’
‘কই মন খারাপ?সিএনজি পাচ্ছিনা তাই মুড অফ’
‘সেটা মানে কি?’
‘মন খারাপ’
‘আমার বলা মন খারাপ আর আপনার বলা মন খারাপ আলাদা জিনিস?মানে মুড অফের অর্থ যে মন খারাপ সেই মন খারাপ আর আমার বলা মন খারাপ আলাদা?’
‘তোমার বমি পাচ্ছেনা এখন?মাথায় যন্ত্রনা করছেনা?’
‘আমি অসুখের কথা মনে করলে কিংবা অসুখের বাস্তব কোনো রুপ দেখলে তারপর বুঝি আমার অসুখ।তার আগে বুঝিনা।এখনও তাই’
অর্ণব হাত বাড়িয়ে সিএনজি একটা থামালো।তিনশ টাকার ভাড়া পাঁচশ চাইতেছে।পাঁচশ ছাড়া যাবেইনা।অর্ণব বাদ দিয়ে আবার হাঁটা ধরলো।আকাশে চাঁদ নেই।চিকন চাঁদ এত জলদি গায়েব হয়ে যায়।কতবার করে কুসুম আকাশের দিকে তাকিয়েছিল।এত সুন্দর একটা সময়ে চাঁদ থাকলে সোনায় সোহাগা হয়ে যেতো।
‘আফসোস, আমার বেলায় একটার কমতি থাকবেই থাকবে।”
অর্ণব হঠাৎ ফুটপাতের কিণারায় বসে গেলো।কুসুম ওর দেখাদেখি নিজেও বসেছে।
গায়ে ফু দিয়ে চুলগুলোকে টেনে ধরে অর্ণব বললো,’হাঁপিয়ে গেলাম।আজ অনেক পরিশ্রম হয়েছে’
‘আমারও মুড অফ’
অর্ণব কুসুমের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।কুসুম হেসে বললো,’কেন মুড অফ শুধু আপনার হয়?’
‘রোগীর কত পাগলামি!’
কুসুম আর কিছু বললোনা।নতুন কেনা পানির বোতলটা নিয়ে ঘুরাতে লাগলো।সামনে দিয়ে রিকশা চলছে।অনেক সময় পর যাচ্ছে প্রাইভেট কার ও। কিন্তু সিএনজির দেখা মিলছেনা।কুসুমের শীত করছে আরও বেশি করে।বারবার অর্ণবের গা ঘেঁষে বসছিল সে।অর্ণব শেষে ঠিক করলো পাঁচশ হলেও সেটাতেই রাজি হবে।বেশি রাত বাহিরে থাকা ঠিক হবেনা।উঠে দাঁড়িয়ে পুনরায় হাঁটা ধরেছে সে।কুসুম ও ওর সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটা চালু রেখেছে।অনেক সময় হাঁটার পর একটা সিএনজি পেলো তারা।কিন্তু আশ্চর্য হলো ঐ সিনএজি ছয়শ ছাড়া যাবেনা।এ দেখি আগুন দাম।অর্ণব মনে মনে নিজেই নিজেকে বকছে।কেন তখন ঐ সিএনজিটাকে যেতে দিল তাই ভেবে।বাধ্য হয়ে ছয়শতেই রাজি হলো।কুসুমকে নিয়ে উঠে পড়লো তাতে।গাড়ীতে উঠে ফোনে একটা গেমস খেলছিল সে সময় কাটাতে।কুসুম সেসময়টায় ওর বাম হাতের আঙ্গুল ধরে ধরে দেখছিল।বিষয়টা সে খেয়াল করেনি।
কুসুম যখন বুঝতে পারলো অর্ণব খেয়াল করছেনা তখন সে হাতটাকে নিয়ে নিজের মাথায় রাখলো।অর্ণব সঙ্গে সঙ্গে টের পেয়ে ওর দিকে চেয়ে বললো,’ওমন করছো কেন?’
‘মাথায় হাত বুলিয়ে দেবেন একটু?’
ওর এমন অদ্ভুত আবদার শুনে অর্ণব চুপচাপ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবারও গেমসে নজর রেখেছে।কুসুম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।অনেক কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলোনা।কিসের যেন বাধা এসে থামে সামনে।বলতে চেয়েও হয়ে ওঠেনা।
কুসুম অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়েই ছিল।পলক ফেলছিলনা।
গাড়ীর ধাক্কায় হুশ ফেরার পর সিটে পিঠ ঠেকাতে গিয়ে খেয়াল করলো অর্ণবের হাত গিয়ে গ্রিল ধরেছে সিএনজির।সে অবাক চোখে ওর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে অর্ণব বললো,’পেছনে কিসের যেন বাক্স।তুমি হয়ত পিঠে ব্যাথা পাবে তাই হাত দিয়েছি।ওমন ভূত দেখার মতন চেয়ে থাকতে হবেনা’
—-
জুথি বারান্দায় একটায় বিনব্যাগে বসে চোখ বন্ধ করে স্যাড সং শুনছিল।রুম অন্ধকার,বারান্দা অন্ধকার।আলো বলতে দূরের ল্যাম্পপোস্টের।হঠাৎ কিসের যেন আওয়াজ লাগলো কানে।চোখ মেলে উঠে দাঁড়ালো সে।রেলিংয়ে হাত রেখে নিচে তাকিয়ে ভালো করে দেখলো।কিন্তু কোনো কিছুর দেখা মিললোনা।তাই কানে আবারও ইয়ারফোন গুজে যেইনা সে পেছনে ফিরতে গেলো সামনে গোটা দেহের একজন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক চিৎকার করা ধরলো সে।ঠিক তখনই পাশের মানুষটা ওর মুখ চেপে ধরে ফিসফিস করে বললো,’আমি মৃদুল’
জুথি হাত দিয়ে মৃদুলের বুকে কয়েকটা কিল ঘুষি মেরে দিয়েছে।মৃদুল হেসে ওর মুখ থেকে হাত সরালো।
জুথি ইয়ারফোন খুলে বললো,’আপনি এখানে কেন?তাও এ সময়ে?দূরে থাকতে বলেছিলাম।এত কাছে আসতে বলিনি’
‘কি করবো,তোমার ব্লক খেয়ে ঘুম আসছিলনা।বেশি থাকবোনা।জাস্ট এক ঘন্টা’
‘এক ঘন্টা!এতকাল কি করবেন আপনি?’
‘তুমিও ছ্যাঁকা খেয়েছো।আমিও খেয়েছি।সুতরাং রাত কত সময় জেগে থাকা হলো তা আমাদের দুজনের মাঝে একজনেরও ভাবার কথা না।
আর কি করবো জানতে চাইতেছো?তো শোনো,প্রথমে তোমার বাবার রুম টপকে রান্নাঘরে গিয়ে নুডুলস বানাবো।তারপর কফি।তারপর গান শুনাবো তোমায়।কয়েক মিনিট অসহ্যকর জ্বালাতন করবো তোমায়।তারপর একটা সুন্দর অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে মৃদুল, মৃদুল হাওয়ায় বিলীন হয়ে যাবে।তখন তুমি চাইবে আর একটিবার সেই অনুভূতির সাথে মিশে যেতে।কিন্তু মৃদুল আসবেনা।’
জুথি ব্রু কুঁচকে বললো,’কেন আসবে না?’
‘কারণ তুমি আমায় দূরে থাকতে বলেছো তাই’
চলবে♥