ভালোবাসার ফোড়ন ২ পর্ব-২২+২৩

0
947

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২২

“এই অলক্ষুনে মেয়ে কে তোমরা ঘরে কেন তুলেছো মা!

ভাইয়ের এমন কথায় আমি পেছন থেকে বলি,
“তোমার ঘরে কি তুলেছে ভাইয়া, আমি যদি অলক্ষুনে হয়ে থাকি তাহলে তোমরা কি! আদৌ কি মানুষ তোমরা, যদি তা হতে তাহলে নিজের অসুস্থ বাপ আর মা কে অবশ্যই বাড়ি থেকে বের করে দিতে না!

আমার কথায় ভাইয়া অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এই প্রথম বার তার মুখে মুখে কথা বলছি বলে হয়তো সে অবাক। ভাইয়া একাই এসেছে বলে মনে হচ্ছে। মা আর বাবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা শুনছে। মা কাঁদছে বোধহয়! বারবার শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছছে। ভাইয়া কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

“মুখে মুখে তর্ক করছিস!

“যা সত্যি তাই বলছি।

“কি জানিস তুই, কি সত্যি বলছিস। তোর জন্য পুরো গ্রামে আমাদের মান সম্মান ডুবে গেছে। কোথায় মুখ দেখাতে পারছি না। আর তুই কি না এই মুখ নিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছিস।

“কোথায় মুখ দেখাতে পারছো না নাকি তোমার শশুড় বাড়ি মুখ দেখাতে পারছো না কোনটা বলো তো।

“নিহা!

“চেঁচিয়ে লাভ নেই। আর বললে গ্রামে কেন ফিরে এসেছি,‌ গ্রামে এসেছি নিজের মা বাবা কে দেখতে তবে চিন্তা করো না থাকতে আসি নি। আবার চলে যাবো

“তা এখনই চলে যা না। তোর জন্য আমরা কেন কথা শুনবো।

“কথা তুমি কেন শুনবে, আমি কি তোমার কাছে থাকি নাকি। আমি থাকি আমার মা বাবার কাছে। চাচার কাছে। যদি তাদের কোন সমস্যা না হয় তাহলে তোমার কি? তুমি এতো কথা বলছো কোন কারনে।

ভাইয়া এখন আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে মা’র দিকে তাকিয়ে বলে,
“এই শিখিয়েছো মেয়েকে। শহরে গিয়ে কি করে তোমার মেয়ে। ভালো কাজ করে বলে তো মনে হচ্ছে না।

আমি চুপ করে রইলাম কিছু বললাম না। ভাইয়া আবারো বলে উঠে,

“কিছু বলছো না। নাকি কোন অকাজ কুকাজ করে আবার এখানে এসেছে।

আমি এবার মুখ তুলে বলে উঠি,
“যাই করি না কেন তোমাকে বলতে বাধ্য নই।

“বড্ড মুখে মুখে কথা বলছিস। কে শিখিয়েছে তোকে এভাবে কথা বলতে

“সত্যি কথা বলতে তোমাদের থেকেই এসব শিখেছি। তোমরাই শিখিয়েছো

“কি বললি।

“যা বলেছি ঠিক বলেছি। ছেলে হয়ে যদি মা’র সাথে এভাবে কথা বলো তাহলে আমি দোষ করলাম কোথায়?

ভাইয়া রেগে মা কে বলল,
“তুমি কি এখনো কিছু বলবে না মা। দেখছো কিভাবে কথা বলছে ও

“মা কে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। কিছু বলবে না সে।

“কি বলছিস তুই।

“বুঝতে কষ্ট হবে এমন কথা বলিনি। সদর দরজা খোলাই আছে।

ভাইয়া রাগে ফুসফুস করতে বলল,
“এই অপমান কখনো ভুলবো না আমি।

“অপমান ভুলে যাবার জন্য করা হয় না ভাইয়া।

ভাইয়া হন হন করে রেগে চলে গেলেন। বাবা শান্ত ভাবে ঘরে চলে গেল। মা শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগলো। আমি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলি,

“ক্ষিধে লেগেছে খেতে দাও!
.
বিকালে কিছু নাড়ু আর মোয়া ডিব্বায় ভরে নিয়ে গেলাম আহিয়ান’র জন্য! আমার মনে হলো তার কাছে এগুলো খুব ভালো লেগেছে। তবে আজ তাদের বাড়ি যাবার সময় মুখ ঢাকি নি। ঢেকে কি লাভ তারা তো আমায় দেখেই নিয়েছে। যাদের থেকে লুকোতে চাই তারাই আমার সামনে এসে ঘুর ঘুর করে আর কি। রাস্তায় হাটার সময় কিছু লোক আমাকে এমন ভাবে দেখছিল যেন জীবনে কোন মানুষ কে দেখে নি তারা। আর রইল তাদের ফিচুর ফাচুর। কানাকানি শুরু হয়ে গেল। ফুলি এসব দেখে মুখ ফুলিয়ে আমাকে বলল,

“লোক গুলোর সমস্যা কি কও তো আপু। এভাবে তোমারে দেহে কেন।

নদী বলে উঠে,
“মনে হইতাছে নতুন বউ যাইতাছে। কেমন উইঠা পইড়া লাগছে দেখ।

“তোরা বাদ দে এসব। দেখ আমরা চলে এসেই উনাদের বাড়িতে।

রুবি বলে উঠে,
“ইয়া আল্লাহ এতো বড় বাড়ি। কিন্তু তারা তো মানুষ হুদা ৪ জন।

মিলি রুবি কে খোঁচা মেরে বলে উঠে,
“আরে গাধা কত্তো বড়লোক দেখছোস তুই। কাজের লোকগুলা আছে না। ওরা কি থাকবো না নাকি। তবে আফা যাই কও আমার অনেক শখ ছিল এখানে আসার। আজ আইলাম কিন্তু আমাদের ভিতরে ঢুকতে দিবো তো।

“কেন দিবো না!

বলতে বলতেই দারোয়ান চাচা সদর দরজা খুলে দিল। আমরা সবাই ভিতরে ঢুকলাম। চাচা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে স্বাগত জানালো আমাদের। বাড়ি ঢুকতেই ফুলের মিষ্টি গন্ধ নাকে এলো। মালিরা সেখানে পানি দিচ্ছে। চারদিক বিভিন্ন রঙে ফুলে ভরপুর। ব্যাপাটা দেখতে অনেক চমৎকার!

ফুলি ওরা সবাই দল বেধে দৌড়ে গেলো বাগানের ভিতর। আমি মানা করতেই কেউ বলে উঠলো,

“ভূতনি মানা করো না।‌

উপরে তাকিয়ে দেখি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন আহিয়ান।‌ তার সাথে আকাশ ভাইয়া উনারা সবাই। আমি আর তাদের না ডেকে হাটা ধরলাম বাড়ির ভিতর!

“তুমি এখানে!

“হুম আসতে মন চাইলো তাই, এই নিন!

“কি এগুলো?

“নাড়ু আর মোয়া!

উনি কিছু না বলেই আমার হাত থেকে ডিব্বা গুলো নিলেন। এর মাঝেই আকাশ ভাইয়া তার থেকে একটা ডিব্বা নিতে গেলে তিনি একটু দূরে সরে বলেন,
“মোয়ার ডিব্বা টা চাইলে নিতে পারিস তবে নাড়ু’র টা না।

ওদের এমন কান্ড দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কখনো ভাবিনি উনি এতোটা খুশি হবেন এগুলো আনায়। আকাশ ভাইয়া মুখ ভেংচি কেটে বলে,

“আচ্ছা এটাই দে!

অতঃপর আহিয়ান খুব সতর্ক ভাবে মোয়া ডিব্বা টা দিয়ে দিলো। আর নাড়ুর ডিব্বা টা নিজে নিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ তার থেকে সেটা ছিনিয়ে নিবে।

আকাশ ভাইয়া একটা মোয়া নেবার পর নাহান ভাইয়া আর আনাফ ভাইয়া দুজনেই মোয়া নিয়ে কামড় বসিয়ে দিল। আহিয়ান তার কোলের মাঝে নাড়ুর ডিব্বা টা নিয়ে
একটা মুখে দিল। সবার এমন কান্ড দেখে বেশ হাসি পাচ্ছিল আমার। আকাশ ভাইয়া বলেন,

“বলতে হবে নিহা তোমার মায়ের হাতে বানানোর মোয়া খেতে দারুন।

“আমি জানি। তা আপনাদের মিলাদ হবে কবে?

“কয়েকদিন পর হবে।

“ওহ আচ্ছা!

“হুম। তা নিহা তোমাদের গ্রাম টা সেভাবে ঘুরা হলো না আমাদের।

“কেন চাচা কে বললেই তো তিনি ঘুরিয়ে দিতেন।

নাহান ভাইয়া বলেন,
“তা তো জানি কিন্তু এতিম খানায় মিলাদ হবে সেই নিয়েই তিনি খাটছেন।

“আচ্ছা চলুন তাহলে আপনাদের ঘুড়িয়ে নিয়ে আসি আমি।

“কোথায় যাবে।

“এখানেই একটা নদী আছে। নৌকায় চড়বেন!

আনাফ ভাইয়া বলেন,
“আইডিয়া টা মন্দ না যাওয়া যায়। এমনে তেও এখন তেমন কোন কাজ নেই। কি বলিস আহিয়ান।

আহিয়ান আবারো একটা নাড়ু মুখে দিয়ে বলে,
“তৈরি হয়ে আসছি আমি!

বলেই সে চলে গেল। অতঃপর তারা সবাই একে একে চলে গেলো তৈরি হবার জন্য। ছেলেরা তৈরি হতে এতো সময় লাগে আহিয়ান না থাকলে হয়তো আমি জানতাম না। আকাশ ভাইয়া তারা সবাই এসে হাজির কিন্তু উনি এখনো আসে নি। আকাশ ভাইয়া একবার গিয়ে ডেকেও এসেছে বলেছে আসছে ৫ মিনিট পর।‌ হায়রে কি কান্ড! কি এতো সাজগোজ করছে তিনি।

ফুলি আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
“কি গো আপু! এতো সময় লাগে নাকি ওই মালিকের তৈরি হইতে।

“কি করে বলবো আপু।

নদী বলে উঠে,
“ছেলে মানুষের এতো কিসের সাজ!

আকাশ ভাইয়া হেসে বলেন,
“বুঝলে তো আপু মনি এটা আহিয়ান চৌধুরী! তাই আজ এই অবস্থা!

“কি অবস্থা!
আওয়াজ টা আসলো ওপাশ থেকে। আমরা সবাই ওদিক তাকালাম। দেখি উনি শার্টের হাতা ফোল্ট করতে করতে আসছে। মিলি তাকে দেখে চট করে বলে দেয়,

“আপনে আইছেন তাহলে! আমরা তো ভাবছি আর আইবেন না আপনে!

“কেন?

“এতোক্ষণ যে দাড়া করাইয়া রাখলেন কি আর কমু

“চেয়ার তো এখানেই ছিল। ভূতনির মতো সেখানেই বসে থাকতে।

আমি রেগে বলে উঠি,
“আপনাদের বক বক শেষ হলে চলুন তো। এভাবেই অনেক দেরি হয়ে গেছে! যেতে কতোক্ষণ লাগবে যানেন।

“গাড়ি দিয়ে যাবো!

“গাড়ি দিয়ে?

“কেন যাওয়া যাবে না।

“হ্যাঁ যাবে তবে পুরো পথ না।

“ঠিক আছে যতটুকু যাওয়া যায়। চলো এবার!

অতঃপর আমরা সবাই বের হলাম। গাড়ি তে উঠার আগেই চাচা এলেনা। চাচা অবশ্য আমাদের সাথে গেলেন না। কিছু কথা বলল শুধু আহিয়ানের সাথে। অতঃপর আবারো চলে গেলো।

আমরা সবাই গাড়িতে উঠলাম। ফুলি ওরা সবাই গাড়িতে উঠে বেশ হইচই শুরু করে দিল। তাদের হইচই আরো বাড়িয়ে দিল আহিয়ান। কি সব গান ছাড়লো আর তার সাথে ওরাও শুরু হয়ে গেল।

অতঃপর গাড়ি থামলে আমরা সবাই গাড়ি থেকে নামলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর নদীর কাছে চলে এলাম। আহিয়ান একটা বড় নৌকা ভাড়া করলেন, তাতেই আমরা সবাই চড়লাম। সূর্য অস্ত যাওয়া অবদি আমরা সবাই নৌকাতে ছিলাম। অতঃপর সন্ধ্যা নামার পর পর’ই সবাই নৌকা থেকে নামলাম।

নৌকা থেকে নামার পর আকাশ ভাইয়া সবাই কে আইসক্রিম কিনে দিল। আমার পিচ্চি বাহিনী আইসক্রিম পেয়ে লাফাতে লাগলো। আহিয়ান তারা সবাই ওদের কান্ড দেখে হাসতে লাগলো।‌‌ নাহান আর আনাফ ভাইয়া তাদের কিছু চকলেট ও কিনে দিলেন।

গাড়ি কাছে আসতেই থমকে গেলাম সবাই। কিছুলোক গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। এসব দেখেই আহিয়ান ওরা বেশ বিরক্ত। আমি একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখি এগুলো এই গ্রামের’ই লোক। আহিয়ান আগাতে গেলে আকাশ ভাইয়া তাকে থামিয়ে দেয়। অতঃপর তিনি আর নাহান ভাইয়া যায় কথা বলতে। তারা কিছুক্ষণ কথা বলার পর’ই তারা সরে যায়। অতঃপর আমরা যাই গাড়িতে উঠতে। আহিয়ান গাড়ির দরজা খুলে আমাকে বলে ভিতরে ঢুকতে। আশেপাশের ছেলে গুলো খুব বাজে বাজে কথা বলছিলো তখন। আমি ফুলি ওদের সবাইকে গাড়িতে উঠিয়ে নিজে উঠতে নিলাম তখন ওই ছেলেগুলোর মধ্যে একজন বলে উঠল,

“আরে এই তো দেখছি নিহা!

অপরজন বলে,

“কোন নিহা!

“আরে ওই যে খালেদের সাথে বিয়ে হবার কথা ছিল সে।

“আরে ওই যে বিয়ে ছেড়ে পালিয়ে গেছিল সে।

“হ্যাঁ , সে তো দেখছিস কাকে ধরেছে।

“মনে হচ্ছে এই জন্য’ই খালেদ কে ছেড়ে দিয়েছে।

“আরে নিজের ভালো পাগল ও বুঝেছিস। মালটা তো আর খারাপ না ভালাই তো দেখছি। বেশ মালদার পার্টি।

“নাহিয়ান চৌধুরী’র নাতি! বুঝলি তো!

“হুমম তাইলে অনেক আগে থেকেই সবকিছু ফিটফাট ছিল মনে হচ্ছে!

“হ্যাঁ সেদিন যে নিহা পালালো সেদিন তো এরাও চলে গেছিল জানিস!

“হ্যাঁ হ্যাঁ এখন সব সহজ পুরোই পানির মতো।

বলেই সবাই হাসতে লাগলো। আমার বেশ রাগ হচ্ছিল। আহিয়ান’র ও যে রাগ লাগছিল তা না। তবুও আমরা কিছু না বলে চুপচাপ গাড়ি নিয়ে এসে পড়লাম। আমি মন ঠিক করার জন্য বাইরে তাকালাম। সারাদিক শুধুই অন্ধকার,ঝিঁঝিঁ পোকাদের ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই আমি যেন খালেদ কে দেখলাম বলে মনে হলো। আমার পুরো শরীর জমে গেল। ভয় পেতে লাগালাম আবারো!

#চলবে….

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৩

বাড়িতে আজ ভাইয়া আর ভাবী দুজনেই এসেছে। কি মতলব নিয়ে এসেছে বুঝতে পারছি না। আসার পর’ই অনেক খাতির করছে। এই কাঁদছে এই ক্ষমা চাইছে। তবে কারনটা কি এটাই বুঝতে পারছি না। সে কি সত্যি’ই বদলে গেলো নাকি। তবে তার এই পরিবর্তন আর যাই হোক আমার হজম হচ্ছে না। ভাইয়া ও একসময় এসে আমার কাছে ক্ষমা চাইলো। এটাতে আমি হতবাক এর মতো তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।

কোন মা – বাবা পারে না তার সন্তানের প্রতি রাগ করে থাকতে। এখানেও তার ব্যতীক্রম হলো না। মা আর বাবা সহজেই ভাইয়া আর ভাবী কে ক্ষমা করে দিলো। এই নিয়ে আমার কিছু বলার ছিল না। ভাবী এসে আমাকে বলল,

“নিহা বইন ক্ষমা কইরা দে আমাদের।

আমি হাসি মুখে বলি,
“যেখানে মা আর বাবা ক্ষমা করে দিয়েছে সেখানে আমি আর কি করতে পারি বলো।

“এভাবে কইস না মন। আমরা আমার ভুল গুলা বুঝতে পারছি। এখন কি তুই আমাগোরে ক্ষমা করবি না। দেখ তোর ভাইয়া আইয়া তোর কাছে ক্ষমা চাইতাছে।

“এটাই তো আমার কাছে অন্যরকম লাগছে ভাবী। নাহলে দুদিন আগেও এসে সে আমাকে কথা শুনিয়ে গেছে

“দেখ ভুল তো মানুষ’ই করে। তোর বড় ভাই ভুল বুঝতে পারছে। তোর কাছে আইয়া ক্ষমাও চাইছে। মাফ করবি না তুই।

আমি মাথা নিচু করে রইলাম।‌ কি যে বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না। এই সময়’ই চাচা এলেন। তিনি মোটেও ভাইয়া আর ভাবী কে দেখে খুশি না, এটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এদিকে ভাইয়া আর ভাবী তার সাথেও কুশল বিনিময় করছে। ভাইয়া চাচা কে জিজ্ঞেস করছে,

“ভালো আছেন তো চাচা, আপনার শরীর টা কেমন এখন।

চাচা শুকনো মুখে বলেন,
“ভালো। ( অতঃপর আমার দিকে তাকিয়ে ) চারটে ভাত দে তো মা!

“দিচ্ছি চাচা তুমি হাত মুখ ধুয়ে আসো।

অতঃপর চাচা চলে গেল হাত মুখ ধুতে। আমি ঘরে এসে ভাত বাড়ছি। বাইরে উঠোনে বসে ভাইয়া, ভাবী মা আর বাবা কে গল্প করছে। চাচা এসে সামনে বসলে আমি ভাতের থালা টা এগিয়ে দেই। চাচা আমার হাত থেকে ভাতের থালা টা নিয়ে বলে,

“ওরা এখানে ক্যান আইছে!

“জানি না চাচা।

“ওগো মতলব ভালো লাগতাছে না আমার কাছে। ওগোরে যাইতে গা ক!

“কিভাবে বলমু চাচা! দেখতাছো না মা আর বাবা কিভাবে কথা বলছে। কতো খুশি তারা।

“শোন ওরা এমনে এমনে আহে নাই। কিছু না করবো দেখেই আইছে। তুই ওগো কথা একদম শুনবি না বুঝলি।

“আচ্ছা চাচা। তোমাকে একটু ডাল দেই।

“দে! হুন কালকে ওগো মিলাদ, অনেক কাজ

“তুমি কি সারাদিন সেখানে থাকবে।

“হ! সব দেখাশোনা আমারেই করতে হইবো।

“আমিও কি যাবো তোমার সাথে।

“যাবি! আইচ্ছা যাইস।

“হুম।

“তোরে আমি আবারো কইতাছি ওগো কথা কিন্তু হুনবি না। ওরা কিছু করবো দেইখা আইছে

এর মাঝেই ভাবী’র আওয়াজ পেলাম। তাকিয়ে দেখি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবী বলেন,

“কে কিছু করবো চাচা।

চাচা খাবার মুখে দিয়ে বলে,
“তোরা ছাড়া আর কারা। তগো মতলব কি আমি বুঝি না ভাবছোস

“ছিঃ চাচা এসব বইলেন না।

“ক্যান কমু না। দেখ আমার ভাইয়া ভাবী তগো মা বাপ দেইখা তারা সব ভুইলা গেছে। কিন্তু আমি কিছু ভুলি নাই। সব মনে আছে আমার। তোরা কি কি করছোস সব মনে রাখছি আমি।

“চাচা এই জন্যই তো ক্ষমা চাইতে আইছি।

“আইছোস ভালো কথা,রাতে এই খানে খাইয়া দাইয়া যাইস। কোন মতলব কইরা আইলে কিন্তু কোন লাভ হইবো না।

“চাচা গো এই বারের মতো মাফ কইরা দেন। আমরা বুঝতে পারেই আমরা কি ভুল করছি।‌ মা বাপ যে আল্লাহর রহমত আমরা এখন এটা বুঝতে পারছি চাচা।

বলতে বলতে আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন ভাবী। কিন্তু এতে আমার এতো টুকু মায়াও লাগলো না। কেন লাগলো না জানি না। তাদের প্রতি মায়া জিনিসটা আমার আসে না। এর কারন কি হতে পারে? তাদের সেই অমানবিক আচরণ হ্যাঁ এটাই তার একমাত্র কারন।
.
রাতে ভাইয়া আর ভাবী খেলো না। তার আগেই সন্ধ্যার সময় তারা চলে গেলো। তবে যাবার আগে মা আর বাবা কে নিয়ে গেছে। নিজের সাথেই রাখতে চেয়েছিল কিন্তু চাচা তাদের কাছে থাকতে দেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। তাই বলেছে কয়েকদিন বেড়িয়ে আসুক। আমাকেও নিতে চেয়েছিল কিন্তু চাচা আমাকে কোনমতে যেতে দেন নি। তার সাথেই রেখে দিয়েছে।

রাতে আমি খাবার গরম করে বসে আছি। চাচা একটু আগেই বাইরে গেছে। পুরো বাড়িতে আমি একা। দুটো গরু ছাড়া আর কেউ নেই সাথে। চাচা যাবার আগে বাইরে থেকে দরজা তালা মেরে গেছেন। একা আমাকে রেখে যেতে বেশ ভয় পাচ্ছেন তিনি। এর মাঝেই দরজায় ঠুক ঠুক শব্দ এলো। আমি উঠোনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বলি,

“কে কে?

কোন শব্দ এলো না। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার! ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঝোপঝাড় থেকেও আওয়াজ আসছে। আমি হাতে একটা হারিকেন নিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু এখন আর কোন শব্দ হলো না। তাহলে কি আমি ভুল শোনলাম।

হারিকেন নিয়ে আবারো ঘরে যেতেই কেউ আবারো কড়া নাড়লো দরজায়। হ্যাঁ সত্যি কেউ কড়া নেড়েছে।‌ আমি স্পষ্ট শুনেছি। আমি আবারো জিজ্ঞেস করি,

“কে, কে এসেছে? দরজায় কড়া কে নাড়ছে। কে এসেছে?

ওপাশ থেকে এবারো আওয়াজ আসলো না। সবকিছু নিশ্চুপ। আমি এবার হাঁটতে হাঁটতে দরজার কাছে গেলাম।‌ গোয়াল ঘর থেকে গরু গুলো ডাকছে। তাদের খাবার দিয়ে দিয়েছি অনেক আগে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করছি আসলেই কি বাইরে কেউ আছে কি না। ভূত প্রেতে আমার কোন বিশ্বাস নেই। হয়তো কোন বাচ্চা এমনটা করছে নাহলে বাতাসের কারনে এমন শব্দ হচ্ছে। আবারো শব্দ এলো। আমি এবার দরজার কাছেই দাঁড়ানো ছিলাম। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম,

“কে?

ওপাশ থেকে কেউ ধীরে বলল,
“আমি!

গলার স্বর পাওয়া মাত্র আবার দু পা পিছিয়ে গেলাম। এটা তো খালেদের গলার স্বর। তাহলে কি ও জেনে গেছে আমি এখানে একা। এজন্য এসেছে আমার কাছে! আমার পুরো শরীর কাঁপছে। গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরুচ্ছে না। ভয় পাচ্ছি আমি, খুব ভয়।
কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়া দৌড়ে ঘরে চলে গেলাম আমি। দরজা শক্ত করে বন্ধ করে বসে রইলাম চুপটি করে। ঘরের সব জানালা বন্ধ! ঘরে একমাত্র আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আর বাড়িতে আসার একমাত্র রাস্তা শুধু সদর দরজা। এছাড়াও কোন বিকল্প নেই। আর দরজা যখন বন্ধ তাহলে কেউই আসতে পারবে না। তবুও কেন জানি আমার মনে হচ্ছে সে এসে পড়বে। এক্ষুনি এসে পড়বে। এসেই আমার সাথে..

আর ভাবতে পারছি না আমি। ভয় বাড়ছে আমার। দরজা তালা বন্ধ তো কি? যদি সে তালা ভেঙে চলে আসে তখন! আমি ঘরের দরজা ভালো মতো বন্ধ করে নিলাম। এর মাঝেই জানালার দিক থেকে আওয়াজ আসছে। কে জানি জানালা টোকা দিচ্ছে। আমি হাত পা গুটিয়ে বসে রইলাম। এরপর ঢিল ছোড়া শুরু হলো। ঘরের চালে ঢিল মারছে কেউ। আমি কানে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম।

হঠাৎ যেন মনে হলো সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল। সব কিছু নিস্তব্ধ! এখন আর কোন শব্দ নেই। আমি কান থেকে হাত সরিয়ে নিলাম। ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগলাম। হঠাৎ করেই আবারো শব্দ হলো। এবার খুব জোরে শব্দ হলো। কেউ সদর দরজা খুলছে। তাহলে কি সে দরজার তালা ভেঙে দিল। আমি লাফিয়ে উঠলাম। কেউ জোরে জোরে ডাকছে,

“নিহা মা! নিহা মা!

এটা চাচা’র আওয়াজ, তবুও সাহস হচ্ছে না আমার। আমি এখনো ভয়ে চুপচাপ বসে আছি। হঠাৎ আরেকটা আওয়াজ এলো আমার কানে। এটা ছিল ফুলির গলায় স্বর। সে জোরে জোরে আপু বলে ডাকছে।‌ এবার আমি নিশ্চিত হলাম চাচা’ই এসেছে। আমি আর না দাঁড়িয়ে দ্রুত দরজা খুললাম! তাকিয়ে দেখি আসলেই চাচা এসেছে। তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে ফুলি। আমাকে দেখেই সে দৌড়ে ছুটে এলো। বলল,

“আপু আইজ আমি তোমার লগে ঘুমামো। চাচা তাই আমারে নিয়া আইছে।

আমি কিছু না বলে ওর মাথায় হাত রাখলাম। চাচা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

“কিরে মা কি হইছে তোর?

“কিছু না চাচা।

“দেইখা মন হইতাছে ভয় পাইছোস?

কাঁপা কাঁপা গলায় বলি,
“দরজা কেউ বার বার ধাক্কা দিচ্ছিল তাই।

“ওহ ওইটা! ওইটা একটা কুত্তা আছিলো। আমি দেখছি দরজার সামনে ঘুরতাছিল। আমি তাড়াইয়া দিছি। তুই আর ভয় পাইস না।

“আচ্ছা চাচা! তুমি হাত মুখ ধুয়ে আসো আমি খাবার বাড়ি।

“হ বাড় অনেক ক্ষুধা লাগছে। আয়রে মা ফুলি তুই ও হাত মুখ ধুইয়া ল।

“আইচ্ছা!

বলেই ফুলি দৌড়ে চলে গেল। আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কেন জানি মনে হচ্ছে এসব মোটেও আমার কল্পনা না। আমি যা শুনেছি একদম ঠিক শুনেছি। সে এসেছিল।‌ খালেদ সত্যি এখানে এসেছিল। হয়ত চাচা কে দেখে চলে গেছে। আর তখন কুকুর টা এসেছে। এটাই হবে। কিন্তু কেন এসেছিল সে। কেন এভাবে ভয় দেখাচ্ছে বার বার আমাকে!

চাচা আর ফুলি কে ভাত বেড়ে দিয়ে ভাতের থালা নিয়ে বসে আছি।‌ কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। গলা দিয়ে খাবার নামছে না। চাচা আমাকে এইভাবে দেখে বলে,

“কি রে মা খাবার খাচ্ছিস না কেন?

“খেতে ইচ্ছে করছে না চাচা।

“এটা কোন কথা, কি হইছে। দেখি জ্বর টর আবার আইলো নাকি।

“না চাচা তেমন কিছু না।

“তাইলে খাইয়া ল মা। খাইয়া তাড়াতাড়ি ঘুমাইয়া পড়িস। কাল অনেক সক্কাল সক্কাল উঠতে হইবো। অনেক কাজ। আর এতিমখানা তো আর এখানে না যাইতেও অনেক সময় লাগবো।

ফুলি খেতে খেতে বলে উঠে,
“চাচা আমিও যামু!

“আইচ্ছা যাইস। এখন তাইলে খাইয়া তাড়াতাড়ি ঘুমাইয়া পড়!

অতঃপর ইচ্ছে না করলেই অল্প করে খেয়ে নিলাম আমি।‌ চাচা’র বিছানা ঠিক করে দিয়ে মশারি টাঙিয়ে দিলাম। তিনি নাক টেনে ঘুমাচ্ছে। অন্য ঘরে আমি আর ফুলি। ফুলি শুয়ে শুয়ে আমার সাথে কথা বলছে। সে বলছে,

“আচ্ছা আপু কদিন আগে কি একটা হলো না।

“কি আবার হলো!

“ওই যে কি ইয়ার টিয়ার নাকি

“তুই কি হ্যাপি নিউ ইয়ারের কথা বলছিস!

“হ্যাঁ এটাই ইংরেজি নতুন বছর তো শুরু হয়ে গেছে নাহ।

“হুম।

“তুমি তো তাহলে চলে যাবে

“হ্যাঁ যেতে তো হবে, আমার ক্লাস শুরু হয়ে গেছে, তারপর টিউশনি

“দেখবা একদিন আমিও তোমার মতো শহরে গিইয়া পড়ালেখা করমু।

“হ্যাঁ করবি তো কিন্তু তার আগে যে এখানে ভালোমতো পড়তে হবে। এখানে ভালো মতো না পড়লে যে শহরে গিয়ে পড়তে পারবি না।

“হ্যাঁ আমি পড়তাছি তো। আচ্ছা ওই ইয়ারের দিন শহরে নাকি অনেক অনুষ্ঠান হয়।

“হ্যাঁ অনেকে করে।

“আমিও করমু একদিন

“আচ্ছা করিস এখন ঘুমা নাহলে সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে পারবি না।

“আইচ্ছা!

বলেই ফুলি কাঁথা মুড়ো দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু আমার কোন ঘুম আসলো না। আমি সারারাত বসে বসে কাটিয়ে দিলাম। দু চোখের পাতা আর এক হলো না আমার। ভাবছি আর কয়েকদিন থেকেই ফিরে যাবো গ্রামে। নতুন বছর ও শুরু হয়ে গেছে। এখন না গেলে টিউশনি চলে যাবে হাত থেকে।

#চলবে….