হৃদয় নিবাসে তুই পর্ব-২২

0
542

#হৃদয়_নিবাসে_তুই
#পর্ব_২২
লেখনীতেঃ ভূমি

বিছানার উপর প্র্যাগনেন্সি রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা পজেটিভ।অদ্রিজা বার কয়েক শ্বাস ফেলল সেই রিপোর্টটার দিকে তাকিয়েই।নিজের ভেতর কেমন অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে তার।অনুভূতিটা সুখের কি দুঃখের জানা নেই তার।তবে হাত পা কাঁপছে সেও মা হবে কথাটা ভেবেই।হাত পা ঘেমে উঠেছে ইতোমধ্যেই। হৃদয়ের স্পন্দটা দ্রুত বাড়ছে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে। অদ্রিজা জোরে জোরে শ্বাস ফেলে রিপোর্টটা হাতে নিল ।ডান হাতটা মুহুর্তেই গিয়ে নিজের পেটের উপর স্থির হলো।বিশ্বাসই হলো না তার ভেতরে একটা প্রাণ আছে।যে ক্রমশ বেড়ে উঠছে তার ভেতরে।অদ্রিজা হাসল।অবিশ্বাস্য চাহনিতে অত্রিয়ার দিকে তাকাল।খুশিতে চকচক করা চোখ মুখ নিয়েই সন্দেহী কন্ঠে বলল,

‘ এই রিপোর্টটা সত্যিই অত্রি?আমিও মা হবো?আমি কনসিভ করেছি সত্যি?সত্যি অত্রি?’

অত্রিয়া টলমলে চোখে তাকিয়ে রইল বোনের দিকে।সেদিনের পর দেড় মাস হলো সে তার বোনকে এটুকুও হাসতে দেখেনি।সারাক্ষন একটা রুমে নিজেকে বন্দি করে রেখেছিল।খাওয়া দাওয়া হতে নিজের জীবনের সবকিছুই অগোছাল করে তুলেছিল।বেশ কয়েকদিন যাবৎ অদ্রিজার শরীররটা খারাপ যাচ্ছিল।প্রথমে মানসিক অবস্থার জন্য হচ্ছে ভাবলেও খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম রোজ চলতে লাগল।খাওয়া খেয়ে বমি করা যেন তার রোজ অভ্যেস হয়ে দাঁড়াল।চোখজোড়ার নিচে কালো কালি জমেছে বেশ করে।মোমের মতো ফর্সা ধবধবে তুলতুলে মুখটা কেমন শুকিয়ে গিয়েছে।চোখেমুখে কেমন শুকনো, অসহায় ভাব।আগের মতো আর গোছাল থাকে না অদ্রিজা।অগোছাল জীবনযাপন নিয়েই পড়ে থাকে রুমের ভেতর।রুমের দরজা খুলে বাইরে আসতেও তার শত সংকোচ।আর মায়ের সাথে তো সব সম্পর্ক বোধ হয় সেদিনই শেষ হয়ে গিয়েছিল তার।আজও মনে পড়ে গালে মায়ের সেই চড়ের কথা।আয়নায় দাঁড়িয়ে মুখ দেখতে গেলেই চোখের উপর যেন এখনও ভেসে উঠে সে আঙ্গুলের লালচে দাগগুলো।অদ্রিজা মৃদু শ্বাস ফেলে হাসল।অত্রিয়ার দিকে তাকিয়েই আবারও প্রশ্ন ছুড়ল সে,

‘ বল না, সত্যিই আমি মা হচ্ছি অত্রি?রিপোর্টটা ঠিক তো?’

অত্রিয়া এবার কেঁদেই দিল বোনের পাগলামো মাখা প্রশ্ন শুনে।দু পা এগিয়েই দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল অদ্রিজাকে। পরক্ষনে গালে হাত রেখেই বলে উঠল,

‘ হ্যাঁ আপু।রিপোর্টটা একদমই ঠিক।তুই মা হচ্ছিস। আমি মামনি হচ্ছি আপু।’

অদ্রিজা চাপা হাসল।নিচের পেটের উপর দুই হাত রাখতেই প্রশান্তিতে ছেঁয়ে গেল নিজের ভেতরটা।নিজের ভেতরের ছোট্ট প্রাণটাকে অনুভব করেই যেন শিহরন বইল নিজের ভেতরে।সঙ্গে সঙ্গে মন ও মস্তিষ্কে ভেসে উঠল সেই মানুষটারই প্রতিচ্ছবি যে মানুষটা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।যে মানুষটা বড্ড্ নিকৃষ্টভাবে তার অনুভূতির এটুকুও মূল্য দেয় নি।অদ্রিজা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।চোখজোড়া বন্ধ করেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটাল।রক্তিম তো বলেছিল সেই রাতটাকে ভুলে যেতে।সত্যিই কি এত সহজ সেই রাতটাকে ভুলে যাওয়া?এত সহজ?সেই রাতের ফলস্বরূপই তো তার ভেতর আজ রক্তিমের অংশ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। অদ্রিজা মুখ চেপে হাসল।যে মানুষটা এত অহংকার, এত দাম্ভিকতা নিয়ে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল সে মানুষটার সব থেকে দুর্বল কিছু আজ তার মাঝে উপস্থিত।কিন্তু না!সে বলবে না।সেও আজ নিষ্ঠুর হবে।সেই নিষ্ঠুর মানুষটার মতোই নিষ্ঠুর হয়ে লুকিয়ে যাবে খবরটা। কোনদিনও জানতে দেবে না সে বাবা হতে চলেছে।ছোট্ট তুলতুলে শরীরের কেউ তাকে মা হিসেবে চিনলেও কোনদিন রক্তিমকে বাবা হিসেবে চিনবে না।চিনবে না!কথাগুলো ভেবেই অত্রিয়ার দিকে তাকাল অদ্রিজা।মৃদু হেসেই বলল,

‘ আমি মা হতে চলেছি এটা সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছে না অত্রি।আমার কেমন একটা ফিল হচ্ছে।আনন্দ নাকি ভয় কিছুই বুঝতে পারছি না।আমার হাত পা হালকা কাঁপছে, নিঃশ্বাস ঘন হচ্ছে।কেমন এক দমবন্ধকর ফিল হচ্ছে।সে আমায় আধো গলায় মা বলে ডাকবে ভাবতেই আনন্দে হাত পা কাঁপছে।আবার ভয় হচ্ছে এই ভেবে তার ছোট্টো বাচ্চা কন্ঠ যখন বলবে তার বাবার নাম কি?তখন?আমি রক্তিমের পরিচয়টা দিতে পারব তো!’

অত্রিয়া ঠোঁট টেনে হাসল।মনে পড়ল রায়মানের কথা।রায়মান নামক জঘন্য লোকটার প্রতি প্রথমে যেমন মিষ্টি অনভূতি জম্মেছিল, এক অন্যরকম ভালোলাগা তৈরি হয়েছিল এখন ঠিক ততোটাই তেঁতো বিদ্ঘুটে অনুভূতি আর তীব্র ঘৃণা কাজ করে।রায়মান নামক জঘন্য মানুষটাকে এখন আর সহ্য হয় না তার। সেই লোকটার জন্যই আজ দেড়মাস তার বোন হাসতে ভুলে গেছে, তার জন্যই তো রক্তিমের সাথে অদ্রিজার সম্পর্কটা ভেঙ্গে গেল।এইযে অদ্রিজার প্র্যাগনেন্সিতে এই মুহুর্তে অদ্রিজা শঙ্কিত, এর জন্যও রায়মান দায়ী।বড্ড নিষ্ঠুর মানুষ রায়মান।একটা সময় সেই মানুষটিকেই ভালো লাগত কথাটা ভেবে তাচ্ছিল্যমাখা হাসল অত্রিয়া।খাটের এক কোণে অদ্রিজার পাশে বসেই হাত বুলিয়ে দিল অদ্রিজার অগোছাল চুলে।পাশ থেকে চিরুনিটা নিয়ে অদ্রিজার অগোছাল চুলগুলো আঁচড়িয়ে দিতে দিতেই মিষ্টি হেসে বলল,

‘ তুই শুধু শুধু এসব নিয়ে ভাববি না তো আপু।এখন থেকে তুই কেবল হাসবি। যতোটা সম্ভব খুশি থাকবি তুই।হাসবি, খেলবি, লাফাবি যা ইচ্ছে তাই করবি।আমি তোকে খুশি দেখতে চাই আপু।তোর মন খারাপ হলে তোর ভেতরের ছোট্ট প্রাণটারও যে মন খারাপ থাকবে সেই খেয়াল কি আছে তোর?একদমই মন খারাপ করবি না।একটা রুমে নিজেকে আটকে রাখবি না।বুঝলি?তোর ভেতরের প্রাণটাকে সবটা উপলব্ধি করতে দে।প্রকৃতি, বাইরের পরিবেশ সবটা।তাকে এভাবে একঘরে আটকে রাখার অধিকার তোর নেই আপু।’

অদ্রিজা হালকা হাসল।চোখজোড়া সরু করে দরজার আড়ালে তার মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই দৃষ্টি সুচালো হলো।কঠিন কন্ঠে বলে উঠল সঙ্গে সঙ্গে,

‘ অত্রি?উনাকে সরে যেতে বল ওখান থেকে।প্লিজ!’

.

অফিস থেকে অগোছাল রক্তিম বাসায় ফিরেই ব্লেইজারটা ছুড়ে রাখল সোফার এক কোণে।ট্রাই টা ঢিলে করে কপালে ঝুকে পড়া অগোছাল চুল গুলো এক হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে দিল সে।চোখজোড়া প্রচন্ডরকম লাল। সেই লাল টকটকে চোখজোড়া দিয়েই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুইটহার্টকে একবার দেখে নিল সে।মুচকি হেসেই দুই হাত দিয়ে সুইটহার্টকে জড়িয়েই তপ্তশ্বাস ফেলল সে।ফিসফিসিয়ে গাঢ় গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ সুইটহার্ট, আমরা কালকের ফ্লাইটে দেশের বাইরে শিফট হচ্ছি।তুমি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত তো?ছেলেমেয়ে সবাইকে রেখে যেতে মন চাইছে তো তোমার?যদি না চাও তবে তুমি থাকতে পারো সুইটহার্ট।আমি একাই যাব না হয়।’

সুইটহার্ট শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।দুই হাত দিয়ে সেও আগলে ধরল রক্তিমকে।মৃদু হেসেই বলল,

‘ ধুরর!তোমায় ছাড়া আমি কি করে থাকব জান।জানকে ছাড়া কি বাঁচা যায় দাদুভাই?তুমি তো আমার কলিজা।তোমায় ছাড়া কি করে থাকব আমি?’

রক্তিম হালকা হাসল।সুইটহার্টকে ছেড়ে দিয়ে পাশ ফিরে তাকাল।দুইহাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরেই চোখ বন্ধ করল সে।বার কয়েক শ্বাস ফেলেই ব্যাথিত নয়নে তাকাল সুইটহার্টের দিকে।বলল,

‘ সৃষ্টিকর্তা আমার ভাগ্যের সবটুকু ভালোবাসা এভাবে কেড়ে নিয়ে মোটেই ভালো করেনি সুইটহার্ট।আমার ভাগ্যে কি এটুকু ভালোবাসা ও লেখা যেত না সুইটহার্ট?সেই ছোটবেলা থেকেই সৃষ্টিকর্তা আমার প্রতি অন্যায় করে এসেছেন। না আমি বাবার ভালোবাসা পেয়েছি, আর নাহ তো মায়ের।আর এখন যখন নিজের প্রিয় কাউকে ভালোবাসলাম,খুব করে চাইলাম?তখনও সৃষ্টিকর্তা আমার ভাগ্যে তাকে রাখেননি।কেন বলোতো?’

সুইটহার্ট গভীর ভাবে তাকাল রক্তিমের দিকে। ছোট ছোট চোখজোড়া সঙ্গে সঙ্গেই যেন টলমলে হয়ে উঠল।রক্তিমের মাথার চুলে হাত বুলিয়েই বলল সে,

‘ জান মন খারাপ করে না।তুমি তো স্ট্রং তাই না?আমি জানি আমার স্ট্রং ম্যান অলটাইম হাসে। তাই না জান?একদম মন খারাপ করবে না।সৃষ্টিকর্তার প্রতি কেবল তোমার নয়, আমার ও দাবি থাকবে দাদুভাই।কেন তিনি এমনটা করলেন?কেন?আমার সুস্থতার বিনিময়ে হলেও তো উনি তোমায় সুস্থ সবল রাখতে পারতেন।কেন এমনটা করল?’

রক্তিমের কঠিন, ঘন পাঁপড়িতে ঢাকা চোখজোড়া আরো কিছুটা লাল হলো।মুখের চাহনিও আরো অনেকটা সংকুচিত হলো।হাত জোড়া দিয়ে শক্তভাবে নিজের মাথার চুলগুলো চেপে ধরেই তীব্র যন্ত্রনা নিয়ে মৃদু গলায় বলে উঠল রক্তিম,

‘ আমি বোধ হয় আর বেশিদিন থাকব না অদ্রি। খুব বেশিদিন আর তোমায় দেখা হবে না অদ্রি।আমায় ক্ষমা করে দিও অদ্রি।তোমার জীবনটা আমি নষ্ট করে দিয়েছি।আমি ক্ষমাপ্রার্থী অদ্রি।আদৌ কি ক্ষমা আমার যোগ্য?তোমার ভালোবাসাকে এভাবে তীব্র আঘাত দিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে ও ক্ষমাটা আমার প্রাপ্য নয় অদ্রি।তবুও চাইছি।আমি যে অসহায় অদ্রি।আমার অনিশ্চিত জীবনে তোমায় জড়াতে যে পারব না আমি। পারব না!’

সুইটহার্টের চোখজোড়া বেয়ে এবার গড়িয়ে পড়ল পানি।রক্তিমের দিকে সে অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন তিনি।আর রক্তিম যন্ত্রনায় চুলগুলো আরো শক্তভাবে টেনে ধরল।জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলেই তীব্র বেদনায় মুখচোখ লাল হয়ে উঠল।চোয়াল হয়ে উঠল শক্ত।নিজের ওপর চরমভাবে রাগ হচ্ছে তার।চরমভাবে!

#চলবে….