#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৩৭
#Lutful_Mehijabin( লেখা)
[কপি করা নিষেধ]
–আমার বিশ্বাস হচ্ছে না সমুদ্র! আপনি মজা করছেন? প্লিজ একবার বলুন আপনি মিথ্যা বলছেন। আমি জানি আপনি আমাকে ইচ্ছে করে বিভ্রান্তে ফেলছেন। এই পিচ্চি মেয়েটা কী করে আপনার ওয়াইফ হতে পারে! মেয়েটা তো আপনার হাঁটু বয়সের। আপনার মতো একজন স্টং,গম্ভীর, কিউট অফিসার কখনোই এতটুকু পিচ্চি মেয়েকে বিয়ে করতে পারে না। মেয়েটার বয়স তো এখনো আঠারো হয় নি।
কথাগুলো বলে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল সাকিলা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে শোয়াইব খান সাকিলা এবং সমুদ্রের নিকটবর্তী চলো এলেন। অহনার এহেন কাণ্ডে, সে কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। কী বলে অহনাকে শান্তনা দেবে তাও ভেবে পাচ্ছেন না।সে নিজেই সমুদ্রের বিয়ের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে! তার ভাবতেই অবাক লাগছে সমুদ্র বিয়ের বিষয়টা তাকে জানায়নি!
পরিস্থিতি নিমিষেই বিগড়ে যাচ্ছে। সাকিলা অতিরিক্ত রেগে গিয়ে সমুদ্রের শার্টের কলার এখনো অবধি চেপে ধরে রয়েছে। সমুদ্র সকিলার অবস্থা দেখে থতমত খেয়ে গিয়েছে। বিরক্তিতে তার মুখশ্রীতে লালাভ বর্ণ ধারণ করে উঠেছে। শুধু বিরক্তি বললে ভুল হবে, তার চোখ মুখে রাগের ভাবটা স্পষ্ট! সকলের সামনে সাকিলার এমন অদ্ভুত আচরণ মোটেও প্রত্যাশা করেনি সে। সাকিলার চোখের জল দেখে উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছে। অবাকের চরমে পৌঁছে গিয়েছে সবাই। ফলে তাদের মুখ দিয়ে টু শব্দও নির্গত হচ্ছে না। তিতাস অবাকের সহিত মেহেরের মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত আবদ্ধ করে রয়েছে। শুধু অবাক নয় বিষয়টা ব্যাথিত করে তুলেছে তার হৃদয় গহীন। যাকে বোন ভেবে ভালোবাসে এসেছে।সে বোনটা তাকে এতবড় চিরন্তন সত্যের ব্যাপারে একবারও জানাইনি! বেশ অভিমান হচ্ছে বোনটার উপর।আজ তার কাছে মেহের এবং সমুদ্রকে নিয়ে সকল রহস্যের সমাধান মিলেছে।
সমুদ্র আচমকা অহনার হাত যুগল শার্ট থেকে ছাড়িয়ে স্বল্প জোড় গলায় বলে উঠলো,
–শাট আপ! অন্যের হাজবেন্ড এর গায়ে হাত দিতে আপনার লজ্জা করে না।
সমুদ্রের কথা শুনে সাকিলা তার মাথার চুলগুলো মুঠো বন্ধি করে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে কাঁদতে লাগলো। সমুদ্রের কথাটা শোয়াইব খানের কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই রাগে দু হাতের মুঠো করে ফেললেন তিনি। সমুদ্র এমন বিহেভ তার কাছে অভদ্রতা ছাড়া অন্য কিছু মন হচ্ছে না। একপর্যায়ে ক্রোধের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলেন শোয়াইব খান। মুহূর্তেই তিনি ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,
–আই কান্ট বিলিভ সমুদ্র! তুমি আমার অবাধ্য হলে? এমনটা তোমাকে দিয়ে আশা করে নি আমি। তুমি আমাকে অপমান করলে। আমার তো এখন তোমাকে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছে। আজ যদি এখানে কেউ না থাকতো তাহলে তোমাকে আমি কি করতাম, আমি নিজেও জানি না। তুমি নিজেই তোমার রিপুটেশন নষ্ট করতে চাইছে।
সাকিলা শোয়াইব খানের কথার মাঝে বলতে লাগলো,
— আংকেল, তুমি কেন আমাকে এই লোকটাকে নিয়ে স্বপ্ন বাঁধতে শিখালে? আমি তো ভালোই ছিলাম এই লোকটাকে নিয়ে না ভেবে। বিগত ছয় মাস যাবত আমি সমুদ্রের কথা চিন্তা করে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি নি। যেদিন প্রথম তার ছবি দেখেছিলাম সেদিন থেকেই ওনার প্রেমের গভীর সমুদ্রে ডুবে গিয়েছি আমি। জানো আংকেল আমি লাইফে কখনো যায়গা মতো শুট করতে ব্যর্থ হয়নি। কিন্তু যখনি সমুদ্রের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঠিক তখনি আমার পৃথিবী ওলোটপালোট হয়ে যায়। তুমি আমাকে ঠকিয়েছে আংকেল। আই হেইট ইউ। এর পরিনতি একদমই ভালো হবেনা কিন্তু।
সাকিলার কথাগুলো প্রত্ত্যুরে শোয়াইব খান বললেন,
–কান্না করে না, মামুনি! আই আম সরি। দেখো এখানে সবাই তোমার জুনিয়র। এদের সামনে কান্নাকাটি করলে তোমার সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে। সো শান্ত হও। আমার মামুনিটাকে কাঁদতে দেখতে একদমই ভালো লাগে না।
সকলের কথা মনোযোগ সহকারে কর্ণপাত করছে মেহের। অদ্ভুত ভাবে তার বড্ড কষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে সাকিলার বলা কথাগুলো তার হৃদয় ক্ষত বিক্ষত করে তুলেছে। সে উপলব্ধি করতে পাচ্ছে, তার ব্যথিত হৃদয় থেকে টপটপ করে অদৃশ্য রক্ত ঝরে পড়েছে! ইতিমধ্যে সবাই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সাকিলার মুখশ্রীতে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আকাশ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক হতে চাইছে না। সমুদ্র মেহেরের থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তপ্ত শ্বাস ত্যাগ করেছে সমুদ্র। শোয়াইব খান তৎক্ষণাৎ এগিয়ে গেলেন মেহেরের নিকটবর্তী। জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন মেহেরের মুখশ্রীতে। মেহের মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি ফ্লোরে আবদ্ধ। শোয়াইব খান গভীর মনোযোগ সহকারে মেহেরকে দেখতে লাগলো। মেয়েটা কাঁপছে। কোলাহল পূর্ণ পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে না পেরে কাঁপছে সে! তার মুখশ্রীতে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। শোয়াইব খান মেহেরের মুখ দেখে শান্ত। কি আছে মেয়েটার মুখশ্রীতে? মেহেরের প্রতি অদ্ভুত টান অনুভব করছে সে। মেয়েটাকে দেখতেই তার অশান্ত হৃদয়ে এক অজানা শান্তির উৎপত্তি ঘটেছে! মূহুর্তে তার অন্তরালে বলে উঠেছে, মেয়েটা কে? অতীত যেন ভেসে উঠছে তার মস্তিষ্কে। কিন্তু সে তো অতীত হীনা দিব্বি বেঁচে আছে। শোয়াইব খান দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন। অতঃপর সমুদ্রের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
–তুমি কতো বড় অপরাধ করেছ তা কি তুমি জানো? বাল্যবিবাহ করেছো তুমি। একজন সিআইডি অফিসর হয়ে তুমি বাচ্চা একটা মেয়েকে বিয়ে করেছ! তোমার চাকরী থাকবে তো? তুমি কী একবারও ভেবেছো, যখন তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে তখন এই মেয়েটার জন্ম হয়েছে কী সন্দেহ! আর তুমি নিজের থেকে এত্ত ছোট কোন সেন্স এ বিয়ে করলে? ছিঃ
শোয়াইব খানের বলা বাক্য গুলো শুনেই মাথা নিচু করে ফেলল সমুদ্র। উত্তরে অনুতপ্ত স্বরে বলল,
–আম আই সরি স্যার। আমি সত্যিই দুঃখিত।
আমি পরিস্থিতির স্বীকার ছিলাম। প্লিজ ফরগিভ মি।
শোয়াইব খান একজন বুদ্ধিমান এবং সচেতন মানুষ। তাই তিনি সমুদ্রকে আর কিছু বললেন না। বিষয়টা এখানে স্থগিত করলেন। অতঃপর সাকিলাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,
–চলো সাকিলা এখানে থেকে যাই। আকাশ তোমার উপর সব দায়িত্ব দিয়ে গেলাম।
বলেই সাকিলার বাহু ধরে পা জোড়া সংকুচিত করলেন। যাওয়ার পূর্বে শোয়াইব খান সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তিক্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,
— বিষয়টা তুমি আমাকে জানাতে পারতে। তোমাকে দিয়ে আমি এমনটা আশা করিনি। তুমি আমাকে আগেই বলতে পারবে। কেউ করুক না করুক আমি তো তোমাকে খারাপ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতাম। যাইহোক তোমার সঙ্গে আমার বোঝাপড়া বাকি রইলো।
কথাগুলো মুখ হতে নির্গত করে , সাকিলাকে নিয়ে ড্রইং রুম প্রস্থান করলেন তারা। সমুদ্র আর এক মুহূর্তও দেরি করলো না। মেহেরকে রেখেই সেখান থেকে চলে গেলো সে। মেহের এখনও ঠাই দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবার দৃষ্টি মেহেরের উপর। তৎক্ষণাৎ রিয়া এগিয়ে এলো মেহের কাছে। মনোযোগ সহকারে মেহেরকে দেখতে লাগলো। সে যতই মেহেরকে দেখছে ঠিক ততোই অবাক হচ্ছে। হঠাৎ রিয়া অবাকের সহিত বলল,
–জানো পিচ্চি সরি ভাবি, তখন তো আমি তোমাকে দেখে স্যারের ছোট বোন ভেবেছিলাম। বাট বিশ্বাস করো আমার একফোঁটাও বিশ্বাস হচ্ছে না তুমি স্যারের ওয়াইফ! আই কান্ট বিলিভ।
রিয়ার কথার প্রেক্ষিতে একজন সিআইডি জুনিয়র অফিসার সাইফুল বিষ্মত কন্ঠে বলল,
–আমার ও বিশ্বাস হচ্ছে না। সমুদ্র স্যার এমনটা কীভাবে করলো?
আমি তো ভাবতাম স্যার কোনদিনও বিয়ে করবেন না। তা যাইহোক আজ স্যারের জন্য নিজের মেয়ের সঙ্গে পড়ুয়া মেয়েকে ভাবি বলে সম্বোধন করতে হবে! মানলাম স্যার আমার চেয়ে বয়সে ছোট কিন্তু তারপরেও ইগোতে বাঁধছে।
_________
সোফার উপর নতজানু হয়ে বসে রয়েছে মেহের। এ যেন মেয়েটার ব্যক্তিগত অভ্যস। নতজানু না হয়ে সে বসতেই পারে না। তার মনটা আজ ভীষণ বিষাদময়। তখনকার ঘটনার স্বীকার হয়ে বেশ ব্যাথিত সে। তার উপর সমুদ্র তাকে না বলেই চলে গিয়েছে। কোথায় গিয়েছে তা তার অজনা। লোকটা আকস্মিক সারপ্রাইজ তার হৃদয় পুলকিত করে তুলেছে। তার মন নব্য সূচনার উদ্ভাবন ঘটেছে। সমুদ্রকে নিয়ে তার ধারণা পাল্টে গিয়েছে। লোকটা গম্ভীর, রাগী টাইপের হলেও খারাপ নয়। রাগটা একটু কমলে ভালো হতো। একটু ভয় ও পেত না সে। এতোদিনের জমানো যতসব কথা রয়েছে সব তাকে মন খুলে বলতো।
তার সামনে অহনা ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে রয়েছে। সারাদিন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে অহনা। মেহেরের সঙ্গে নানান কথাবার্তায় ব্যস্ত সে। খানিক পূর্বে অহনার কাছে থেকে সে জানতে পেরেছে , সমুদ্র আজকে সারাদিনে কিছু খাই নি। খাবেই বা কী তার হাত তো বেন্ডেজ দিয়ে বাঁধা! ভেবেই বড্ড অভিমান হচ্ছে তার। নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে। সে এতোটা বেখেয়ালি! সমান্য খাবারের খোঁজটাও নেই নি।
(চলবে)
#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৩৮
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষেধ]
বারংবার জারার ফোনে একের পর এক মেসেজ আসছে। নোটিফিকেশন শব্দ তাকে জানান দিচ্ছে কেউ তার কথা স্মরণ করে বার্তা পাঠাচ্ছে! যতো বার শব্দ বেজে উঠছে ঠিক ততবারই ধ্বক করে উঠছে। ফোন স্কিনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করার সাহস পাচ্ছে না সে। পাবেই বা কি করে, সে তো জানে কে তাকে মেসেজ দিচ্ছে। তার বর্ষণ বললে ভুল হবে, এখন হয়তো অন্য কারো। ছেলেটা সত্যি বড় নাছোড়বান্দা! এ পর্যন্ত দশের অধিক ভিন্ন ভিন্ন নম্বর দিয়ে মেসেজ দিয়েছে তাকে। সবগুলো নম্বর ব্লক লিস্টে ফেলে দিয়েছে সে। কিন্তু এখন তার একদমই সাহস হচ্ছে না। মনটা যে একটুও ভালো নেই। রাফুর কথাগুলো বারবার তার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনি তুলছে! হিংসে তৈরি হয়েছে তার অন্তরে। পুনরায় জারার ফোনটা ছোট করে আওয়াজ তুললো। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে ফোনটা হাতে নিলো সে। আজ সে শর্ত ভেঙে ফেলবে। এতো দিন পরিষ্কার করে লিখে দিয়েছে, সে আর বর্ষণকে ভালোবাসে না। কিন্তু আজ সরাসরি বলবে। জারা কটকট দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, বর্ষণের নম্বরে কল করল। কয়েক বার ফোন রিনিং হলো কিন্তু কেউ ফোন করল না। কিন্তু মিনিট পাঁচেক পর কল ভেসে উঠলো জারার ফোনে। তৎক্ষণাৎ শুকানো ঢোক গিলল সে। তার বক্ষ পিঞ্জরের হৃদয় স্পন্দন দ্বিগুণ হয়ে। অজানা আশঙ্কায় ভরে উঠেছে তার অন্তর! একরাশ সাহস জুটিয়ে ফোনটা রিসিভ করল সে। অতঃপর এক বাক্যে বলে উঠলো,
–কতোবার বললো , আমি আপনাকে ভুলে গেছি।আমাকে দয়াকরে আর ফোন দিবেন না।আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।
বলেই ফোনটা কেটে দিলো সে। অতঃপর ফ্লোরে হাঁটু ভাঁজ করে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
————–
মিনিট দশেক পূর্বে সকিনা বেগমের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে সে। বিশ্রী নোংরা গলি মধ্যে একটা ক্ষুদ্র দোতলা বাড়িতে থাকেন সাকিনা বেগম এবং তার সতেরো বছর বয়সী একটা মেয়ে। তার মেয়ে এবার এস এস সি পরীক্ষার্থী। কিছুদিন পূর্বে সকিনা বেগমের স্বামীর অপ্র্যাশিত মৃত্যুতে পুরো পরিবারের উপর বড়ো আঘাত হানে। মেয়েটার পড়ালেখা একদম নষ্ট হয়ে যায়। তার উপর ঢাকা ছেড়ে হঠাৎ রংপুরে চলে আসাতে দু বেলা খাবার জুটেছে না তাদের। পেটের টানে সমুদ্রের খোঁজ নিতে বাধ্য হয়েছেন সকিনা বেগম। বর্তমানে একটা ভাঙা ক্ষয় চেয়ারে বসে রয়েছে সমুদ্র। তার মুখের সামনে ভীতি গ্রস্ত মুখশ্রী নিয়ে টুলে বসে আছেন সকিনা বেগম। তার চোখে মুখে আতংক ফুটে উঠেছে। ভীষণ তটস্থ ও শঙ্কিত তিনি। সমুদ্রের মুখ দেখে তার চোখ জোড়া ছলছল করছে! সমুদ্র রাগে থরথর করে কাঁপছে। রাগ যেন তার শিরাই শিরাই! যে সামান্য বিষয়ে রেগে যায়, সে এতো বড় সত্যি কথা জেনেও নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে। শক্ত চাহনিতে সকিনা বেগমের মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত আবদ্ধ করে রয়েছে সে। হঠাৎ সকিনা বেগম সমুদ্রের হা জোড়া শক্ত করে ধরলো। লহমায় কেঁদে উঠলেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে সমুদ্রকে বলছেন,
–আব্বা, আমাক মাফ কইরা দেও। মুই তোমাক কে দুক্ক দিবার চাই নাই।
সমুদ্রের সকিনা বেগমের বলা কথাগুলো শুনে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। বরাবরই সাকিনা বেগমের ভাষা তার নিকট লম্বা মনে হয়। চেষ্টা করেও সকিনা বেগমকে বইয়ের ভাষা অর্থাৎ শুদ্ধ ভাষা শেখাতে পারেনি। সর্বদা গ্রামের ভাষায় কথা বলেন। শত চেষ্টা করেও আঞ্চলিক ভাষা ত্যাগ করতে পারেন নি। শুদ্ধ ভাষায় সঙ্গে গ্রামের ভাষা মিশিয়ে কথা বলেন। সকিনা বেগম ফির দ্রুত গিয়ে সমুদ্রের হাত জোড়া ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
–সুরি আব্বা, হামি(আমি) তোমার কথা শুনমু, শুদ্ধ কইরা কথা কমু। জানো, ওই চ্যাংড়া(ছেলে) ব্যাটাছাওয়া(পুরুষ) গুলি এটিকনে(এখানে) চলি আইছে। ওরা আমার বেটির(মেয়ের) পিছন পিছন থাকে। আজ তো আমার মেয়েকে ওরা ডাংগাইছে(মেরেছে) আমাক তুমি ঢাকায় নিয়ে যাও।
সমুদ্র সকিনা বেগমের প্রত্ত্যুরে শক্ত গলায় বলল,
–তুমি আমাকে না বলে কেন এসেছো? তোমার তো উচিত ছিল আমাকে তোমার সব সমস্যা খুলে বলা। একে তো না বলে এসেছ তার উপর আমার পেইনড্রাইভ নিয়ে এসেছো তুমি। তুমি কী জান ওটা আমার জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ওই ছেলেগুলো তোমাকে বলল আর তুমি চুড়ি করলে!
সাকিনা বেগম একটা শুকনো ঢোক গিললেন অতঃপর বললেন,
–মুই ভাবছি ওই কালা কলারের চাবির মতো দেখতে ওইটা তোমাক বিপদের কারণ। তাই নিয়ে আইছি। ভাবছি ওইডা না থাকলে তোমাক কোনো ক্ষতি হইব না। আর চলে আইছি কারন ওরা আমাকে ভয় দেখাইছিল। আমাক বাঁচাও তুমি আব্বা।
সকিনা বেগমের বলা বাক্য গুলো শুনে তপ্ত শ্বাস ত্যাগ করলেন সমুদ্র। গৃহকর্মী সকিনা বেগমের সাথে যে তার গভীর সম্পর্ক। একজন গৃহকর্মীকে মায়ের মতো ভালোবাসে সমুদ্র। সাকিনা বেগম নিজেও সমুদ্রকে অনেক ভালোবাসে। তাই সে বাধ্য হয়ে তিনি গ্রামে চলে এসেছেন। কিন্তু এসেইও কোন লাভ হয়নি। সমুদ্রকে সব খবরাখবর নেওয়ার জন্য কেউ তাকে কিনতে চাইছে। আজ সকিনা বেগমের বোকামোর জন্য তার মেয়েটা আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে। লোকগুলো মেয়েটার মাথায় পাথরের আঘাত করেছে। ভাগ্যকমে রক্তাক্ত দেহ নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে এসেছে। সমুদ্র তৎক্ষণাৎ বলল,
–তাড়াতাড়ি রেডি হও। এখানে তোমাদের থাকাটা একদমই ঠিক হবে না। আমি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে এসেছি। অনেক কিছু জানার আছে তোমার থেকে। প্রস্তুত হয়ে থেকো। আর হ্যাঁ আংকেল ব্যবহৃত এখানে যা কিছু আছে সব প্যাকিং করো। আমাকে আজ রাতেই ফিরতে হবে। সো কুইক।
সমুদ্রের বলা বাক্য গুলো শুনেই এক চিলতে হাসি রেখা ফুটে উঠলো সকিনা বেগমের ঠোঁটের কোণে। খুশিতে আক্রান্ত হয়ে তার চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা আনন্দের রহস্য টপটপ করে মাটিতে পড়ল। মনে মনে সমুদ্রের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করলেন তিনি।
______
ঘড়ির কাঁটাতে ছুঁই ছুঁই দুটো। ডাগর ডাগর চোখ মেলে তাকিয়ে রয়েছে মেহের। নিদ্রা যেন ধরা দিতে চাইছে না তার চোখে। এতো রাত হয়ে গেলো তাও মেহের ঘুমাতে পারি নি। আজ তার বড্ড শাশুড়ি মা অর্থাৎ জারাদের কথা মনে পড়ছে। তার জীবনের এতো বড়ো স্মরণীয় ঘটনা ঘটে গেলো অথচ শাশুড়ি আম্মুকে বলল না! তার অন্তরাল অস্থির হয়ে উঠেছে। বারংবার তার চোখের পাতায় ভেসে সমুদ্রের গম্ভীর মুখশ্রী। তখনই সে চোখ বন্ধ করে ফেলছে। কিন্তু তাও শান্তি পাচ্ছে না সে। খুব ভয় হয় লোকটাকে দেখে। সমুদ্রকে কখনোই সে হাসতে দেখে নি। ইদানিং লোকটা তার সঙ্গে অদ্ভুত ব্যবহার করছে। সমুদ্রের বকুনির মাঝে ভিন্ন এক সেন্হ উপলব্ধি করতে পারছে সে। আগের মতো নেই সমুদ্র কিন্তু তারপরেও রাগ যেন লোকটার নাকের ডগায় থাকে!
সমুদ্র তার সঙ্গে দেখা করে যাইনি বলে বেশ অভিমান হচ্ছে তার। একে তো দেখা করে নি তার উপর সারাদিন কিছু খাইনি! এখান কোথায় গিয়েছে কে জানে? মেহের ভাবছে সমুদ্র বোধহয় আজ রাতে আর আসবে না। কালকে তো শুধু মাত্র সরি বলতে এসেছিল। কিন্তু রাতে কি খেয়েছে তা জানতে বড্ড ইচ্ছে করছে মেহেরের। সে অত্যাধিক রেগে গিয়েছে নিজের উপর। নিজের বিবেককে সে শত গালি দিচ্ছে। ইশ! সকাল বেলা লোকটা তার হাতে খেতে চেয়েছিল। কিন্তু সে কি করলো? কে জানতো সমুদ্র খাইনি। মেহেরের ভয় হয় সমুদ্রকে দেখে। তাছাড়া এতো বড়ো একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে সংকোচ বোধ হয়। ভাবলেই যেন তার শরীর শিউরে উঠে। বর্তমানে সমুদ্র ব্যবহার তাকে মানসিক ভাবে চিন্তিত করে তুলেছে। সমুদ্রের কথা চিন্তা করছে সে। ঠিক তৎক্ষণাৎ তার কর্ণপাত হলো দরজার চাপানোর মৃদু আওয়াজ। মুহূর্তেই উঠে বসলো সে। বেড সুইচ অন করে থতমত মুখ করে বসে পড়লো। হা করে তাকিয়ে রইলো সমুদ্রের মুখশ্রীতে।
–বেলকনির দরজা খুলে রেখেছো কেন?
বলেই সমুদ্র দরজা বন্ধ করে দিলো। অতঃপর ক্লান্তিমাখা শরীর নিয়ে এগিয়ে এলো মেহেরের নিকটবর্তী। সারাদিন না খেয়ে দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সমুদ্র। তার সুন্দর পরিপাটি সাজানো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের সীমান্তে এসে ঠাই নিয়েছে। এতে করে বোঝা যাচ্ছে লোকটা বেশ ক্লান্ত! মেহের আজ প্রথম সমুদ্রের মুখশ্রীতে দৃঢ় দৃষ্টিপাত ফেললো। তৎক্ষণাৎ তার মনে পড়ে গেলো, লোকটা তো সারাদিনে কিছু খাইনি। অতঃপর মেহের বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। ঠিক তখনই সমুদ্র গম্ভীর কন্ঠে রাগের সহিত বলে উঠলো,
–তোমাকে না কালকে বলেছি, বেলকনির দরজা বন্ধ করছ ঘুমোতে। আর তুমি বন্ধ করোনি ! পুচকি হয়েও তোমার বিন্দু পরিমাণে ভয় নেই, তাই তো?
সমুদ্রের বলা বাক্যের প্রেক্ষিতে মেহের বোকার মতো কম্পনিত কন্ঠে বলে উঠলো,
–আপনি তো বোধহয় রাতে কিছু খাননি!
মেহেরের কথার জবাবে সমুদ্র গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–আমাকে কেউ খাইয়ে দেইনি। তাহলে খাবো কি করে!
(চলবে)