#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৪৯
#Lutful_Mehijabin ( লেখা)
[কপি করা নিষেধ]
সমুদ্রকে একপ্রকার উপেক্ষা করে ভিতরে প্রবেশ করলেন শোয়াইব খান। তার চোখে মুখে হাসির চিটে ফোঁটাও নেই। সমুদ্র ডোর লক করে শোয়াইব খানের পিছু পিছু ধাবিত হলো। সে আজ বেশ আনন্দিত। শোয়াইব খানের আগমন তার নিকট সৌভাগ্যময় । বিশেষ করে সমুদ্র খানিক চিন্তিত ছিলো কারণ সেদিন ঘটনার পর শোয়াইব খান একবারের জন্যও সমুদ্রের খোঁজ খবর নেন নি। সমুদ্র তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছে কয়েক বার।
চেয়ারে বসে সমুদ্রের প্লেটের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছিলো মেহের। হঠাৎ শোয়াইব খানকে দৃশ্যমান হতেই জড়তা সহিত দাঁড়িয়ে পড়লো সে। প্রথমত নিত্যদিনের ন্যায় মাথায় ঘোমটা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো মেহের। অবশেষে শোয়াইব খানকে সালম দিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল।
মেহেরকে দৃশ্যমান হতেই শোয়াইব খানের হৃদয় গহীনে প্রশান্তির প্রাদুর্ভাব ঘটছে। ইতিমধ্যে তার চোখ জোড়া স্বল্প সজল হয়ে এসেছে। নিজেকে ঠিক রাখতে বার কয়েক দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। মেয়েটাকে নয়ন জুড়ে প্রাণ ভরে দেখতে লাগলেন। আহ, একেই বুঝি প্রথম শান্তি বলে! মেহের তার মেয়ে, মেহের তার একমাত্র অস্তিত্ব, তার নিজের অংশ ভাবতেই শোয়াইব খান নিজের প্রতি গর্বে বুকটা ফুলে উঠছে। মেয়েটা সম্পূর্ণ তার প্রতিচ্ছবি। মায়ের সঙ্গে আংশিক সাদৃশ্য রয়েছে মেয়েটার। ওই যে চোখ জোড়া যেন তার স্ত্রী কল্পনার ন্যায় মায়াবী! শুধু মাত্র চোখ দুটো প্রমাণ করেছে মেয়েটা মায়ের মতো বড্ড অবুঝ। একদমই মায়ের মতো শান্ত, কোমল হৃদয়ের অধিকারী।
প্রায় সেকেন্ড ষাট এক অতিক্রম হয়েছে কিন্তু কার মুখে কোন কথা নেই। সমুদ্র শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। মেহেরের চোখ যুগলের সংকোচ পূর্ণ দৃষ্টি পূর্বের ন্যায় ফ্লোরে আবদ্ধ। মুহুর্তেই শোয়াইব খান মেহেরের নিকটবর্তী এসে দাঁড়ালেন। অতঃপর ঠোঁট যুগল জিহ্বা দ্বারা ভিজিয়ে পরিবেশের নিরবতার ইতি ঘটালেন শোয়াইব খান। মেহেরের মুখশ্রীতে অসহায় দৃষ্টি আকর্ষন করে বলে উঠলেন,
— কেমন আছো মামুনি?
শোয়াইব খানের কথা শুনে সমুদ্রের দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো মেহের। সেকেন্ড পাঁচেকের মধ্যেই দৃষ্টি সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো সে। ইশ, কি সাংঘাতিক চাহনি! তৎক্ষণাৎ ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা টেনে মেহের বলে উঠলো,
— জী স্যার, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
মেয়ের মুখে থেকে স্যার শব্দটা শুনতেই শোয়াইব খানের বুকের মাঝে ধ্বক করে উঠলো। তার মেয়েটা কতোটা নিম্ন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত তা ঠিকই আন্দাজ করতে পারছেন। আজ পরিবেশ পরিস্থিতি মেহেরকে স্যার বলতে শিখিয়েছে। ওর জায়গায় অন্য কোন বিলাসবহুল ঘরের মেয়ে হলে অবশ্যই তাকে আঙ্কেল বলে সম্বোধন করতো তা নিশ্চিত। বিষয়টা মস্তিষ্ক থেকে খানিকের জন্য মুছে, শোয়াইব খান মেহেরকে বলেন,
— মামুনি, তোমাকে এতো অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে কেন?
আচমকা শোয়াইব খানের মুখশ্রী হতে নির্গত এমন অদ্ভুত বাক্য শুনে মেহেরের চোখ যুগল ছলছল করে উঠলো। সে বাকরুদ্ধ! কথা বলার ভাষা হারিয়েছে। কি বলবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না।
শোয়াইব খান মেহেরের জবাব না পেয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। মেহেরের একদমই নিকটবর্তী চলেন এলেন তিনি। অতঃপর একটা শুকনো ঢোক চেপে বলে উঠলেন,
— মামুনি আমাকে নিজের বাবা মনে করে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিবে, প্লিজ?
শোয়াইব খানের প্রত্যুত্তরে মাথাটা ডান দিকে খানিকটা কাত করলো মেহের।
আকস্মিক শোয়াইব খানের ব্যবহার বেশ সন্দেহ জনক লাগছে সমুদ্রের নিকট। কিন্তু যাইহোক এতে তার কোন সমস্যা নেই। তার মস্তিষ্ক বলে উঠছে, হয়তো মেহেরকে দেখে পছন্দ হয়েছে শোয়াইব খানের তাই তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। সমুদ্র দু হাত পকেটে গুঁজে ভাব বিলাসিহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
লহমায় শোয়াইব খান শীতল কন্ঠে মেহেরকে উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
— তুমি কি এই বিয়েতে রাজি ছিলে?
কথাটা কর্ণপাত হতেই চমকে উঠলো মেহের। এই প্রশ্নের জবাব যেন তার নিকট অনুপস্থিত।
শোয়াইব খান ফির বলে উঠলেন,
— আমি জানি নিরবতা সম্মতির লক্ষণ। এখন বলো তো মামুনি তুমি কি পড়ালেখা করতে ইচ্ছুক? ভবিষ্যতে বড়ো কোন পদে চাকরি করতে চাও কি? সংসার বাদ দিয়ে মুক্তি হয়ে পাখির ন্যায় ডানা মেলা উড়তে চাও কি?
শোয়াইব খানের কথা শুনে দিশেহারা হয়ে পড়লো মেহের। এমন অদ্ভুত প্রশ্নে সে অনুভূতিহীন নির্বাক! বার দুয়েক দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো মেহের। অবশেষে দৃষ্টি ফেলল সমুদ্রের অচঞ্চল নয়ন যুগলে। ইশ, পূর্বের চেয়ে দ্বিগুণ সাংঘাতিক দৃষ্টি! সমুদ্র গম্ভীর মুখশ্রীতে কোথাও যেন অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। ওই চোখ দুটো যেন মেহেরের অদ্ভুত অনুভূতির শিহরণে জড়িয়ে নিচ্ছে। ভীষণ অদ্ভুত অনুভূতি! যার নাম এখন অবধি মেহেরের অজানা। দু হাত মুঠো বন্ধি করে নিজের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করার প্রয়াস করলো মেহের।
মেহেরের উত্তর না পেয়ে শোয়াইব খান পুনরায় আকুতি মিনতির সহিত বলে উঠলো,
— বলো না মামুনি? তুমি কি পড়ালেখা করতে চাও? চাও কী এই সমুদ্রের সারা জীবনের জন্য মুক্তি দিতে?
শেষোক্ত কথাটা শুনেই চিন চিন ব্যথা অনুভব হলো মেহেরের বক্ষ পিন্জরে। একরাশ সাহস জুটিয়ে বলে উঠলো,
— হ্যাঁ আমি চাই পড়ালেখা করতে। কিন্তু,,
মেহেরের বলা বাক্যগুলোর সমাপ্তি ঘটাতে দিলেন না শোয়াইব খান। আচমকা তিনি নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলেন মেহেরকে। মেহেরের মাথাটা আলতো করে বুকের সঙ্গে চেপে বলে উঠলেন,
— আর কিছু বলতে হবেনা মামুনি। যা বুঝার তা আমি বুঝেছি।
শোয়াইব খানের বুকে মাথা গুঁজতেই মেহেরের চোখ যুগল আপনা আপনি বন্ধ হয়ে এলো। খুবই শান্তি পাচ্ছে মেহের। তার অনুভব হচ্ছে এই যেন এক শাস্তির নিবাস। বর্তমানে মেহের নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ প্রাণী বলে মনে করছে। অদ্ভুত আনন্দ মেহেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরছে। এতো ভালোবাসা কেউ মেহের কে দেখাইনি। বাবা নামক শান্তি বুঝি একেই বলে। বাবাকে ঘিরেই যেন সকল প্রশান্তি যা পৃথিবীতে শুধু মাত্র বাবা নামক প্রাণী হতে নির্গত হয়।
সমুদ্র ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে শোয়াইব খানের কার্যক্রম লক্ষ্য করছে। তার বুকের ভেতর অদ্ভুত অস্থিরতার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। শোয়াইব খানের এমন উদ্ভট আচরণ সমুদ্রকে বড্ড আঘাত করছে। কি করতে চাইছেন শোয়াইব খান তা বোধগম্য করতে পারছে না সমুদ্র!
প্রায় মিনিট পাঁচেক নিরবে বাবার বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে রইলো মেহের। অতঃপর শোয়াইব খান মেহেরের কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে নিজের মুখশ্রীর সামনে দাঁড় করালেন। মেহের গাল জোড়া দু হাতের মধ্যে আবদ্ধ করে বললেন,
— যাও মা ঘুমাও। আমি কালকে আবার আসবো তোমার জন্য সারপ্রাইজ নিয়ে।
শোয়াইব খানের কথার প্রেক্ষিতে মেহের সমুদ্রের দিকে আড় চোখে তাকালো। মেহেরের হৃদয় যেন শান্তিতে ভরে উঠছে। মেহেরের অনুভব হচ্ছে, আজ চারপাশে অক্সিজেন যেন পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মেহেরের শ্বাস প্রশ্বাসে প্রশান্তির চাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। মেহের বুঝতে পারলো না কেন অচেনা অজানা একজন লোকটা তার এতোটা আপন মনে হলো? কেন লোকটার বুকে নিজেকে অত্যাধিক নিরাপদ মনে হলো? কেন এখন লোকটার কথা মতো তার প্রস্হান করতে মন চাইছে না। ইচ্ছে হচ্ছে আরো খানিকটা সময় লোকটার সঙ্গে অবিবাহিত করতে। নানান চিন্তার আবির্ভাব ঘটেছে মেহেরের অন্তরালে।
মেহেরকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শোয়াইব খান পুনরায় মেয়েটার কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে শান্ত স্বরে বলে উঠলো,
— যাও মা। ঘুমিয়ে পড়। কি হাল করেছো নিজের শরীরের! এভাবে চললে তো তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে। সো এখন দ্রুত গিয়ে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়।
তৎক্ষণাৎ ফির মেহের সমুদ্রের দিকে দৃষ্টিপাত ফেলল। সমুদ্র এখন অব্দি পূর্বের ন্যায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোকটা চোখ জোড়া মেহেরকে ইশারায় কিছু বলতে চাইছে। মেহের আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। দ্রুত শোয়াইব খানকে বিদায় জানিয়ে পা যুগল ধাবিত করলো নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
________
সোফার উপর আয়েশ ভঙ্গিতে বসে রয়েছে শোয়াইব খান। ড্রইং রুম হতে সমুদ্র রুমে প্রস্হান করেছেন তারা। শোয়াইব খানের বিপরীতমুখী হয়ে বসে রয়েছে সমুদ্র। নিত্যদিনের ন্যায় স্তব্ধতা পালন করতে ব্যস্ত সমুদ্র। নিরবতা ভেঙে হঠাৎ শোয়াইব খান বলে উঠলেন,
— সমুদ্র,,
শোয়াইব খানের কথার উত্তরে সমুদ্র বলে উঠলো,
— ইয়েস স্যার। হাও ক্যান আই হেল্প ইউ?
সমুদ্রের শক্ত কন্ঠের প্রেক্ষিতে শোয়াইব খান বললেন,
— তুমি তো জানো সমুদ্র, হেঁয়ালি আমার একদমই পছন্দ নয়। আমি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এক কথা বলতে পারি না। যাইহোক , মনে আছি কি তোমার কয়েক দিন আগে আমি কি বলেছিলাম। বলেছি যে আমার একটা ভয়ঙ্কর পুরোনো অতীত রয়েছে তা তোমাকে বলতে চাই।
সমুদ্র নিশ্চুপ ভঙ্গিতে শোয়াইব খানের মুখ পানে তাকিয়ে রইলো। লহমায় তিনি বলেন উঠলেন,
— তুমি হয়তো জানো না আমার একটা পরিবার ছিলো। এমনকি আমার একজন ওয়াইফ ছিলো। বছর ষোলো পূর্বের কথা। হঠাৎ আমার মাথায় ভুত চেপে ধরে। আমি নিজের ক্যারিয়ার গড়ার লক্ষ্যে পরিবার ত্যাগ করে অচেনা রাজ্যে পাড়ি দেই।
বলেই দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন শোয়াইব খান। সেকেন্ড পাঁচেক বিরতি নিয়ে ফির বলে উঠলেন,
— বিশ্বাস করো সমুদ্র, আমি জানতাম না আমার দ্বারা কতো বড় অন্যায় হয়েছে। সেদিন আমার নিকট অজানা ছিলো পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখ যে আমি ইচ্ছে করে ফেলে দিয়ে এসেছি! আমি জানতাম না আমার চলে যাবার পর আমার ওয়াইফের কোল জুড়ে সন্তান জন্ম নেয়। খবরটা আমি পাই নি। যদি জানতাম আমি বাবা হয়েছি তাহলে কসম আমি ফিরে আসতাম। আগলে রাখতাম আমার আদরের কন্যাকে। একটুও দুঃখের আঁচ আসতে দিতাম না। কিন্তু আমি এতোটা অভাগী যে আজ ষোলো বছর পর জানতে পেরেছি আমার পরিটার কথা।
শোয়াইব খানের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে উঠলো সমুদ্র। শোয়াইব খান ক্রমশ সমুদ্রের হৃদয় বিচ্ছিন্ন কারি বাকের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। লহমায় তিনি বলে উঠলেন,
— তুমি জানতে চাইলে না আমার পরিটা কে? সে কোথায়?
সমুদ্র তৎক্ষণাৎ অস্থিরতার কাঁপা গলায় সহিত বলে উঠলো,
— কে?
সমুদ্রের কথার উত্তরে শোয়াইব খান দ্রুত গতিতে বলে উঠলেন,
— সে আর কেউ নয় মেহের। আমার মেহের। আমার একমাত্র মেয়ে।
বাক্যগুলো সমুদ্রের কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই স্বল্প কেঁপে উঠলো সমুদ্র। চোখ যুগল বড় বড় করে বলল,
— হুয়াট!
শোয়াইব খান সমুদ্রকে উপেক্ষা করে বলে উঠলেন,
— আসল কথাই আসা যাক সমুদ্র। আমি চাইছি আমার মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে রাখবো। তুমি ইচ্ছুক না থাকলে ও দিতে বাধ্য। কারন একটু আগেই তুমি শুনেছ আমার মেয়ে কি চাই! সে বলছে তোমার সঙ্গে থাকবে না। সে পড়ালেখা করতে চাই। সে মুক্তি পেতে চাই তোমার সংসার থেকে।
শোয়াইব খানের কথা শুনে বুকের মধ্যে হাত চেপে ধরলো সমুদ্র। তার বুকটা যে ব্যাথায় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতোক্ষণে অদৃশ্য রক্তক্ষরণে ভরে উঠছে তার অন্তর! ঠোঁট যুগল প্রসারিত করতে শক্তি পাচ্ছে না সমুদ্র। অবশেষে বহুত কষ্টে বলে উঠলো,
–না,,
সমুদ্রের কথার ভিত্তিতে শোয়াইব খান হুংকারের সহিত বলতে লাগলেন,
— লজ্জা লাগে না তোমার? নিজের হাঁটু বয়সী মেয়েকে স্ত্রী বানিয়ে রাখতে চাইছো! আমার মেয়ে তো বললো ও পড়ালেখা করতে চাই। দেখো সমুদ্র আমার মেয়ে আর তোমার কাছে বন্দী থাকবে না। আর হ্যাঁ আমি কালকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেবো। এতে তোমার মত থাক বা না থাক। আমি কালকে আবার ও আসবো।
আরো কতো গুলো কথা শুনিয়ে আজকের মতো বিদায় নিলেন শোয়াইব খান।
_____
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে আকাশ পানে তাকিয়ে রয়েছে সমুদ্র। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে সে। তার বুকের মাঝে বড্ড কষ্ট। প্রিয় মানুষটাকে হারানোর ভয়ে সংঙ্কিত হয়ে উঠেছে তার অন্তরাল। তার চেয়ে দ্বিগুণ কষ্ট তার পুচকি কেন তাকে বুঝে উঠতে পারে না? কেন উপন্যাসের পাতার মতো তার মন পড়তে পারে না? মেয়েটা কেন তাকে অনুভব করতে পারে না?
মেহেরের কথা ভাবতে মত্ত হয়ে উঠেছে সমুদ্র। মেহেরের উপর তার ভীষণ অভিমান হচ্ছে। মেয়েটা একবারও খোঁজ নিলো সে খেয়েছি কিনা? ইতিমধ্যে সমুদ্রের চোখ জোড়া জলে ছলছল করে উঠেছে। অতিরিক্ত কষ্ট হচ্ছে তার। এক যেন এক পাহাড় সমান কষ্ট। তাকে বলে সীমাহীন দুঃখ! সমুদ্রের বুকটা যে মেহের নামক অনুভূতির দহনে পুড়ে ছারখার হয়ে উঠছে। ক্রমশ তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
___
অন্যদিকে হঠাৎ মেহেরের মনে পড়ছে সমুদ্র রাতের খাবার খাই নি। সঙ্গে সঙ্গে এক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করে নি মেহের। নিজেকে একগাদা ধিক্কার জানিয়ে ড্রইং রুমে হাজির হয়েছে সে। ড্রইং রুমে এসে তার লক্ষ হয়েছে সমুদ্রের ঘরের বাতি জানালো। শোয়াইব খানের ব্যাবহার বেশ সন্দেহ জনক লেগেছে। অদ্ভুত হলেও মেহের আন্দাজ করতে পেরেছে কোন এক ভয়াঙ্কর ঝড় বইছে সমুদ্রের উপর। তাই এক একরাশ ভয় নিয়ে সমুদ্রের বেলকনির দিকে ধাবিত হলো মেহের।
প্রায় মিনিট পাঁচেক বেলকনিতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে মেহের। সমুদ্রকে ডাক দেওয়ার সাহস হচ্ছে না মেহেরের। সমুদ্রের এমন অবস্থার দেখে তার অন্তরাল ফেটে যাচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। লোকটার নিঃশ্বাস আওয়াজ বলে দিচ্ছে সে কতোটা যন্তণা হচ্ছে!
মেহেরের উপস্থিত আন্দাজ করতে পারলো সমুদ্র। প্রথমত তার স্বপ্নের পুচকি ভেবে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো সে। কেন আসবে তার পুচকি তার খোঁজ নিতে? সে তো এখন ঘুমে বিভোর। পুচকিটা তাকে কোনদিনই বুঝবে না।
লহমায় সমুদ্র জিহ্বা দ্বারা নিজের ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিলো। এক হাত পকেট রেখে অন্য হাতটা ঠিক বুকের মাঝখানে রাখলো। অতঃপর অভিমান স্বরে আকাশ পানে চেয়ে সমুদ্র বলতে লাগলো,
— জানো পুচকি, আমি কতোটা কষ্টে আছি? তুমি তো দিনের বেলা একটি বারের জন্যও কেন আমার কাছে আসো না? রাত হলেই বুঝি আমার কথা মনে পড়ে! তুমি কি জানো তুমি কতোটা নিষ্ঠুর? আচ্ছা পুচকি আমাকে দেখতে একটুও সুন্দর না? আমাকে দেখলে কি তোমার মনে ‘তুমি নামক অনুভূতির’ সৃষ্টি হয় না! কেন হয় না পুচকি? আমি কি খুব খারাপ? আমাকে কী একটুও ভালোবাসা যাই না। আমি কী তোমার থেকে অনেক বড়ো! তোমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না? আচ্ছা পুচকি, আমার বয়স কী কমানো যাবে না?
(চলবে)
#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৫০
#Lutful_Mehijabin ( লেখা)
[কপি করা নিষেধ]
— জানো পুচকি, আমি কতোটা কষ্টে আছি? তুমি তো দিনের বেলা একটি বার কেন আমার কাছে আসো না? রাত হলেই বুঝি আমার কথা মনে পড়ে! তুমি কি জানো তুমি কতোটা নিষ্ঠুর? আচ্ছা পুচকি আমি কী দেখতে একটুও সুন্দর না? আমাকে দেখলে কি তোমার মনে ‘তুমি নামক অনুভূতির’ সৃষ্টি হয় না! কেন হয় না পুচকি? আমি কি খুব খারাপ? আমাকে কী একটুও ভালোবাসা যাই না। আমি কী তোমার থেকে অনেক বড়ো! তোমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না? আচ্ছা পুচকি, আমার বয়স কী কমানো যাবে না?
সমুদ্রের বলা বাক্যগুলো মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই তার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। ইতিমধ্যে তার বক্ষ পিঞ্জরের হৃদয় স্পন্দন বৃদ্ধি পেয়েছে তড়িৎ বেগে! অস্থিরতার যেন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরেছে। সবচেয়ে বড় কথা সমুদ্র অদ্ভুত প্রকৃতির কথাগুলো হজম করতে সক্ষম হচ্ছে না সে। ভীষণ তোলপাড় আরম্ভ করেছে মেয়েটার ছোট মস্তিষ্কে! বাকরুদ্ধ হয়ে অতিরিক্ত হারে কাঁপছে মেহের। অতঃপর নিজের বেলেন্স নিয়ন্ত্রণ করতে দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে দিলো ব্যার্ধ্য হলো সে। চোখ জোড়া বন্ধ করে নিজেকে স্বভাবিক রাখার প্রয়াস চালালো ক্রমাগত। এক মিনিটে হওয়ার পূর্বে ফির মেহেরের কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনি তুললো সমুদ্রের অনুভূতি সম্পূর্ণ বাক্য।
সমুদ্র চোখ করে অতি শীতল কন্ঠে বলে,
— পুচকি, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, অন্যের নিদ্রা কেড়ে নিয়ে তুমি কীভাবে প্রতিটা দিন শান্তির নিদ্রায় মগ্ন থাকো! তোমার মনে কি একটি বারের জন্যও আমার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে না? তুমি কেন বুঝো না , প্রতিরাত ধরনীর ওই বিশাল আকাশকে সাক্ষী রেখে এক ব্যক্তি সারারাত জাগ্রত থেকে তোমাতে মত্ত থাকে! তার চোখ যুগলের নিদ্রা ছিনিয়ে নিয়ে ও কি তোমার মাঝে অপরাধ বোধ জাগ্রত হয় না? কেউ যে তোমার দহনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত তা কি তুমি সত্যিই বুঝো না? তোমার পুরো ফ্রেমের বৃত্তকার চশমার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ওই শান্ত নয়ন জোড়ার একরাশ ভীতি দৃষ্টি কাউকে যে ক্রমশ উন্মাদ পাগলে তৈরি করতে উঠে পড়ে লেগেছে তা কি তুমি বুঝেও বুঝো না! কেন বুঝো না তোমার নির্ঝর হাসির কলকল ধ্বনি নিমিষেই কোন এক পুরুষের হৃদয় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে তুলে? তুমি নামক অনুভূতি কাউকে ক্রমশ মৃত্যুর পথে ঠেলে দিচ্ছে তাও কি আন্দাজ করতে পারো না। তুমি হীনা বাঁচার কথা ভাবতে গিয়ে কেউ একজন নিঃশ্বাস আটকে ছটফট করে মারা যাবার পথে ধাবিত হওয়ার উপক্রম, তা একটি বার কেন অনুভব করো না!
কথাগুলো বলেই সমুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেহেরের মুখমুখি দাঁড়ালো। জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মেহেরের মুখশ্রীতে। বেলকনির আবছা আলো হওয়ার সুবাদে সমুদ্র ভেবে বসলো, আজ কি এমন হলোএখনো কেন বেলকনি ত্যাগ করলো না তার দিবা স্বপ্নের পুচকি। নিত্যদিন রাত্রি বেলা সমুদ্রের নিকটবর্তী হাজির হয় এই ছলনাময়ী পুচকি! কিন্তু বেশিক্ষণ উপস্থিত থাকতে বোধহয় লজ্জা লাগে তার! সমুদ্রের দিবা স্বপ্নে এসেই এই ছোট্ট নারী তাকে দগ্ধ করে তবেই বিদায় নেয়। বিষয়টা পরিলক্ষিত হতেই একরাশ অভিমান যেন চেপে বসেছে সমুদ্রের হৃদয় গহীনে। লহমায় বুকের বাঁ পাশে ডান হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো সমুদ্র। বা হাত দ্বারা চুলগুলো টেনে ধরলো সে। অতঃপর সেকেন্ড পাঁচেক নিজ অধর দাঁত দ্বারা কামড়ে ধরলো। চোখ যুগল খানিক বন্ধু করে কঠোর কন্ঠস্বরে বলতে লাগলো,
— তুমি কি সত্যিই আমাকে বুঝবে না পুচকি? তুমি কি চাইছো আমাকে আঘাত করে তিলে তিলে শেষ করতে? কেন আমি কী খুব বড়ো অন্যায় করে ফেলেছি? সেদিন কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত আমি। মনে তোমার সেদিন আমার মতো একজন পাথরের বুকে থেকেও রক্ত ধরেছিল। তুমি লক্ষ করো নি আমার অদৃশ্য রক্ত। কিন্তু তাই বলে আমার এই অবাধ্য চোখ জোড়া থেকেই আষাঢ়ের অবিরাম ঢল নেমেছিল তা নিশ্চয়ই তোমার দৃশ্যমান হয়েছিল। মানলাম সেদিন ভীষণ বড়ো অপরাধ করে বসেছিলাম আমি। আমার বাজে হাতের আঘাতে তোমার ওই শুভ্র স্বচ্ছ গাল রক্ত জবাতে রুপান্তরিত করেছিলাম। জানি এই হাতটা তোমার ক্ষমা পাবার যোগ্য নয়। তাই তো যখনি অপরাধ বোধ আমার মাথায় হানা দেয় ঠিক তখনই আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করে তুলে? তোমার মস্তিষ্কতে কি একবারও বলে উঠে না আমি হাত দিয়ে খাচ্ছি না কেন!
কথাগুলো মেহেরের কর্ণপাত হতেই আতকে উঠলো সে। সমুদ্রের এমন রুপ দেখে তার মস্তিষ্কের কার্যকর ক্ষমতা লোপ পেয়ে বসেছে। লোকটা বুকে এতোটা কষ্ট! ইতিপূর্বে সমুদ্রের অনুভূতি সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল মেহের। কিন্তু লোকটা তো কখনোই তাকে আন্দাজ করতে দেয় নি! সে যদিও ছলে কৌশলে সমুদ্রে সঙ্গে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলেও, সমুদ্র তাকে উপেক্ষা করে চলে। তাহলে আজ কী এমন হলো সম্পর্কের রশ্মি টেনে ধরলো সমুদ্র। আজ মেহের অচঞ্চল আঁখিতে সমুদ্রের মুখ পানে তাকিয়ে রয়েছে। লোকটা জলে টলমল করা নয়ন দুটো তার ভয় কেড়ে নিয়েছে। তার চোখ জোড়াতে ফুটে উঠেছে অসহায়ত্ব। সমুদ্রের সাংঘাতিক দৃষ্টি ক্ষত বিক্ষত করে তুলেছে তাকে ক্রমাগত! নিত্যদিনের ন্যায় লোকটির মুখশ্রীতে গম্ভীর্য থাকলেও চোখ জোড়াকে নমনীয়তার শেষ নেই। শুধু তাই নয় সমুদ্রের এমন রুপ মেহেরের হৃদয় ঝড় রাত্রির উত্তাল উদ্যম সমুদ্রের ন্যায় তোলপাড় আরম্ভ করাতে সক্ষম হয়েছে। মেহেরের চোখ যুগল জলে ভরে উঠছে। খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।
সমুদ্রের প্রায় মিনিট পাঁচেক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেহেরের মুখ পানে। এখনো তার বা হাতটা বুকে সীমাবদ্ধ। সমুদ্রের নিঃশ্বাস নিতে খানিক কষ্ট হচ্ছে। তাই হয়তো তার ঠোঁট যুগল কিঞ্চিৎ ফাঁকা হয়ে রয়েছে। তার নিঃশ্বাস গ্রহণে গতি বলে দিচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আসছে। তৎক্ষণাৎ সমুদ্র মেহেরের নিকটবর্তী হাজির হলো। মেহেরের সন্নিকটে অবস্থিত করে ফির জোরে জোরে অক্সিজেন গ্রহণ করলো। আকস্মিক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়ে বসলো সমুদ্র। হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মেহেরের পায়ের কাছে। অতঃপর মাথা উঁচু করে মেহেরের মুখশ্রীতে স্থির দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে বলে উঠলো,
— আচ্ছা পুচকি, লোকে বলে কৈশোর কালে মেয়েরা আবেগ প্রবণ থাকে। তারা নাকি এই বয়সে রঙিন চশমার আড়ালে নিত্যনতুন প্রেমে পড়ে। আবেগ প্রবণ হয়ে না বুঝেই প্রেমের সুগন্ধি নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু এখন আমার মনে হয় লোকে মিথ্যা বলে। কেন জান এমন মনে হয়? কারন আমার পুচকি ওরফে আমার স্ত্রী একজন কিশোরী হয়েও আমার মুখ পানে একটি বারের জন্যেও তাকানোর প্রয়োজন বোধ করে না। একজন কিশোরী হয়েও তার মনে নিজ স্বামীর জন্য কোন অনুভূতি জাগ্রত হয় না। সে সর্বদা আমাকে উপেক্ষা করে চলে। ভয় পাই আমাকে দেখে! তার দৃষ্টিতে সবসময়ই ভয় বিদ্যমান থাকবেই। সে কি আন্দাজ করতে পারে না তার স্বামী তার এই আচরনের ফলে দিনে কমপক্ষে শত বার আয়নাতে ভেসে উঠা প্রতিচ্ছবি পর্যবেক্ষণ করে।
বাক্যগুলো মেহেরের কর্ণপাত হতেই বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে সে। সমুদ্রের ভেতর কঠোরতা প্রলেপ আজ কোথাও যেন উধাও হয়ে গিয়েছে। লোকটা একদমই বিপরীত রুপ ফুটে উঠেছে মেহেরের সামনে। যা মেহেরের ধারনার বাইরে ছিলো। ইতিমধ্যে মেহের থরথর করে কাঁপছে! সমুদ্রের বেদনা সইতে পারছে না সে। কিন্তু হঠাৎ সমুদ্রের এমন প্রত্যাশা মেহেরের হতভম্ব করে তুলেছে। আচমকা লোকটা কী এমন হলো? সমুদ্র তো সবসময়ই বলে, পুচকি পুচকির মতো থাকবে’। মেহের এই কথার ভিত্তিতে সবসময়ই নিজের অনুভূতি দমিয়ে রাখতো। হ্যাঁ মেহেরের মনে সমুদ্রকে নিয়ে অনুভূতির দানা বাঁধে। সংসার নামক জীবনে প্রবেশ করে সে নিজেও সমুদ্র নামক অনুভূতিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু নিজেকে সংযত রাখতে রাখতে শুরু করে মাত্র সমুদ্র জন্য। এমনকি সমুদ্র জানলে হয়তো বিশ্বাস করতে পারবে না যে তার পূর্বে পুচকির হৃদয়ে তুমি নামক অনুভূতি জাগ্রত হয়েছে। যার প্রমাণ স্বরুপ বর্তমানে সমুদ্রের ত্যাগকৃত কষ্ট মাখা নিঃশ্বাস তাকে বড্ড যন্ত্রনা দিচ্ছে। তাছাড়া ইতিপূর্বে যেদিন রাত্রি বেলা সমুদ্র তার নিকট অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ক্ষমা চেয়েছিল ঠিক সেদিন মধ্যে রাতে সমুদ্রে আড়ালে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল মেহের! লোকটার কষ্ট যে সে নিজেও সহ্য করতে পারে না। সমুদ্রের ছলছল নয়ন তাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে তুলে। নিমিষেই তার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে উঠে। বর্তমানে মেহের আর সহ্য করতে পারছে না। তার চোখ জোড়া বেয়ে দুর্বোধ্য রহস্য টপটপ করে বিসর্জন ধরনীর বুকে। মুহুর্তেই মেহের দ্বিগুণ আঘাত প্রাপ্ত করতে সমুদ্র আলোতে করে মেহেরের দু পা তার দু হাত দ্বারা স্পষ্ট করো। আকস্মিক এহেন কান্ডে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেললো মেহের। তৎক্ষণাৎ সমুদ্র পুনরায় বলে উঠলো,
— তুমি কেন বুঝো না পুচকি, তোমার বড়ো হবার অপেক্ষায় কেউ যে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। মানুষকে ছারখার করে পুড়িয়ে মারতে তোমার বুঝি আনন্দ হয়? আচ্ছা পুচকি সমাজ কি আমাদের বিয়ের সম্পর্ক কেউ মেনে নেবে না! সমাজ কি আমার মুখের উপর থু থু দেবে? বলো না!
কথাগুলো বলেই চোখ যুগল খিঁচে বন্ধ করে নিলো। অতঃপর শুকনো ঢোক চেপে শক্ত করে মেহেরের পা জোড়া স্পর্শ করলো। ঠোঁট যুগল প্রসারিত করে মিনমিন করে বলে উঠলো,
— আমার বয়স কী কমানো যাবে না,পুচকি?
এবার সমুদ্রের কথার মাঝে আনমনে মেহের কাঁপা কাঁপা বলে উঠলো,
— আপনার বয়স কমাতে কে বলেছে! আপনি যেমন ঠিক তেমনটাই থাকুন।
মেহেরের প্রত্যত্তুরে সমুদ্র লহমায় চিৎকার করে বলে উঠলো,
— বাহ্, পুচকি তুমি তো ছলনময়ীতে পরিনত হচ্ছো! তুমিই তো তখন এসিপির কথায় সম্মতি জানালে। মেহের আমি কি এতোটাই খারাপ! কেন? বলো না! তুমি সত্যিই কী মুক্তি পেতে চাও আমার হাত থেকে? আনসার মি পুচকি!!
সমুদ্রের কর্কশ ধ্বনিতে ডুকরে কেঁদে উঠলো মেহের। সমুদ্র তাকে এমন কথা কীভাবে বলতে পারলো! সে পড়ালেখা করতে চাই ঠিকই তবে সমুদ্রের নিকটবর্তী থেকে। প্রসঙ্গ পাল্টাতে মেহের কান্না রত কন্ঠে বলে ,
— আপনি তো কিছু খান নি। প্লিজ খেতে চলুন।
খাবারের কথা শুনে দ্বিগুণ রাগে ফেটে পড়লো সমুদ্র। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে সমুদ্র মাথা চেপে ধরে বলে উঠলো,
— এই নিশিরাতে আমার হৃদয় প্রেমের সম্মোহন ঘটানোর কোন অধিকার নেই তোমার। তুমি কল্পনাতে শ্রেয়! আমাকে তুমি নামক অনুভূতিতে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করছো তাতেও তোমার প্রশান্তি মিলছে না। তাই তো এখন আমাকে দ্বিগুণ কষ্ট দিতে এসেছো। এখন তুমি যেতে পারো। আমি জানি তুমি আমার পুচকি নও শুধু মাত্র তার অবয়ব। গো,,
বলেই সমুদ্র মাথা চেপে মা জোড়া বাঁড়াল। তৎক্ষণাৎ ঘটে বসলো এক অনাকাঙ্খিত ঘটনা!
_________________
ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছুঁই বারো। পারভেজের সন্নিকটে গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে বসে রয়েছে ইয়াদ। আজ ইয়াদের মুখশ্রীতে নেই কোন কঠোরতা। পারভেজের ঠোঁটের কোণে লেগে রয়েছে এক তুচ্ছতাচ্ছিল্য পূর্ণ হাসির রেখে। প্রায় মিনিট দশেক অতিবাহিত হয়েছে কারো মুখে কোন কথা নেই। ইয়াদ মোবাইল ফোনে কিছু একটা করছে। কিছুক্ষণ বাদে হঠাৎ নিরবতা ভেঙে বললো ইয়াদ। কন্ঠে শীতলতা বজায় রেখে বলে উঠলো,
— মিস্টার পারভেজ, আপনি সত্যিই স্বীকার করুন। আপনি শুধু বলুন কাজগুলো আপনাকে কে করতে বলেছে?
ইয়াদের কথার উত্তর পারভেজ মুচকি হেসে ঠোঁট জমাট বাঁধা ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে বললো,
— কেউ বলে নি। জারা আমার পুরাতন প্রেমিকা। আপনার উপর আক্রমণের পিছনে ওর হাত ও রয়েছে। ও প্রতিশোধ নিতে চাই।
পারভেজের কথার উত্তরে সমুদ্র ঠান্ডা গলায় বললো,
— চিন্তা করবেন না আপনি। আপনার মা এবং বোন আমাদের কাছে। হো আপনি সত্যিটা বলুন।
(চলবে)