#কন্ট্রাক্ট_অফ_ম্যারেজ
Sadia afrin nishi
— পর্বঃ২৯
___________________
পর পর কয়েকটি থাপ্পড়ের শব্দে কেঁপে উঠল পুরো ড্রইং রুম। সবার সামনেই মৃধা মুগ্ধকে গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে টেনে টেনে চড় মা’র’ল। উপস্থিত সবাই হতবাক। কার কী বলা উচিত কেউই কিছু বুঝতে পারছে না। সবাই নিশ্চুপ। অবশেষে আদ্র এসে মৃধাকে থামাল। এতকিছুর পরেও মুগ্ধের কোনো হেলদোল নেই। সে অট্টহাসি হাসতে হাসতে ফের কান্নায় ভেঙে পড়ছে বারংবার। অতঃপর কান্নারত অবস্থায় মৃধার উদ্দেশ্যে বলল,
“আরো মা’রো আপুনি। আমাকে আরও মা’রো। তবুও ওকে আমার কাছে এনে দাও। ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না। কী দরকার ছিল আমাদের এতো বিলাসবহুল জীবনের? খুব তো সুখে ছিলাম আমরা ওই ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে। তবে কেন এলে এই অট্টালিকায়? কেন?কেন?কেন?”
সবাই পুরোপুরি না বুঝলেও কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে মুগ্ধর কথা। তবুও সবাই নিশ্চুপ। এভাবেই মুগ্ধ আরও কিছুক্ষণ আবোলতাবোল বকতে বকতে ধীরে ধীরে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে ঢলে পড়ে। উপস্থিত সবাই ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। ততক্ষণাৎ তাকে ঘরে নিয়ে ডক্টরকে খবর দেওয়া হয়। ডক্টরের চিকিৎসায় মুগ্ধ কিছুটা সুস্থ হয় কিন্তু পুরোপুরি নয়। সে রাতে তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় ডক্টর। ঘুমালে হয়তো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে সেই আশায়।
___
দিনকে দিন মুগ্ধের অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে। মৃধা অনেক কষ্টে তাকে চেপে ধরে তার থেকে কথা বের করে নিয়েছে। মুগ্ধ এসব বলতে একেবারেই ইচ্ছুক ছিল না। কিন্তু মৃধার জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। অগত্যা সব ঘটনা খুলে বলে। মৃধা সবকিছু শুনে মুগ্ধর থেকে ঠিকানা নিয়ে মৌ-দের বাড়িতে চলে যায় মৌ এর সঙ্গে কথা বলতে। মৌ মৃধার সঙ্গে খারাপ বিহেভ করে নি কিন্তু তার প্রস্তাবে রাজিও হয়নি। মৌ এর একটাই কথা সে তার বোনের মতো ভুল কিছুতেই করবে না। তার বোনের বিষয়ে জানতে চাইলে মৌ বলে, তার বোনকেও এক বড় লোকের ছেলে ভালবাসার অভিনয় করে বিয়ে করে। পরে চাহিদা পূরণ হয়ে গেলে তার বোনের ওপর চালায় নির্মম অত্যাচার। এক সময় তার বোন দুঃখ, কষ্টে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তাদের টাকা পয়সা না থাকায় কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে নি ওই শয়তান দের বিরুদ্ধে। এজন্য সে চায় না কোনো বড়লোক ঘরের ছেলেকে বিয়ে করতে। মৃধার সবটা শুনে ভীষণ কষ্ট লেগেছে। তারও তো একসময় দারিদ্র্যতায় ভুগেছে। মৌ যদি সেসব দিনের কথা জানত তাহলে হয়তো বুঝত সব বড়লোক সমান হয় না। আরও কিছু কথা হলো তাদের মধ্যে । অতঃপর মৃধা চলে গেল। মৌ এর হাতে দিয়ে গেল ভাববার জন্য সময়।
___
“আচ্ছা আপনি কী বলতে চাইছেন টা কী বলুন তো? সেই কখন থেকে দাড় করিয়ে রেখেছেন। ওদিকে যে মুগ্ধর পাত্রী দেখতে যাওয়ার জন্য সবাই তৈরি হয়ে গেছে।”
খুব অস্থির হয়ে কথাটি বলল আহিবা। সেই কখন থেকে আদ্র তাকে কিছু একটা বলবে বলবে করে বলছেই না। আহিবার এমন অস্থিরতা দেখে আদ্র বলল,
“আরে মুগ্ধর জন্য তো সবাই আছে কিন্তু আমার জন্য তো তুমি ছাড়া কেউ নেই। একটু বোঝার চেষ্টা করো।”
আহিবা চোখ জোড়া বড় বড় করে আদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনার মাথা ঠিক আছে তো? দেখি দেখি কাছে আসুন তো দেখি জ্বর টর এলো নাতো আবার?”
এই বলে আহিবা আদ্রের কপালে হাত রাখতে গেল। কিন্তু আদ্র তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আরে আমি একদম ঠিক আছি। তুমি আগে চুপ চাপ দাড়াও। আমার কথা মন দিয়ে শোনো।”
“আরে আমি তো সেই কখন থেকেই দাঁড়িয়ে আছি। আপনার কিছু বলার থাকলে জলদি বলুন।”
“ইয়ে মানে ইয়ে আসলে…. হয়েছে কী… আমি..”
আর কিছু বলার আগেই নিচ থেকে সবাই আহিবাকে ডাকতে লাগল। আহিবা আদ্রকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“থাক আপনাকে আর কিচ্ছু বলতে হবে না। আমি এখন আসছি৷ ”
অগত্যা আদ্রকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আহিবা দ্রুত চলে গেল। আদ্র একটা দীর্ঘ শ্বাস টেনে মনে মনে ভাবল, “সে আসলেই একটা অপদার্থ।”
___
“মাশাল্লাহ মেয়ে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে । একেবারে চাঁদের টুকরো। আমার ঘর আলো করে থাকবে। আপনি কী বলেন বাবা।”
আয়েশা চৌধুরীর প্রশ্নে আফরোজ চৌধুরীর প্রতিত্তোর,
“হ্যাঁ অবশ্যই। ঠিকই বলেছিস তুই মা। আমাদের মুগ্ধর জন্য এর থেকে ভালো পাত্রী আর হতেই পারে না। আমরা সবাই রাজি। কী বলো তোমরা?”
সবাই একত্রে বলল,হ্যাঁ আমরা সবাই রাজি।
“তাহলে আগামী মাসের প্রথম জুম্মায় বিয়ের দিন ঠিক করা হোক। সকলের কী মত? বেয়াইন সাহেবা আপনার কী মত?”
পাত্রীর মা বলল,
“আমাদের তরফ থেকে কোনো অসুবিধা নেই। আপনারা যেটা ঠিক করবেন সেটাই হবে।”
তাহলে সকলে বলো, আলহামদুলিল্লাহ।
আলহামদুলিল্লাহ।
___
“সারাক্ষণ শুধু পালাই পালাই করো। সমস্যা টা কী তোমার? সবার দিকে নজর আছে বাট নিজের বর-কেই করো অবহেলা।”
ভ্রু কুঁচকে বলল আয়ান। আয়ানের এরূপ বাক্যে মৃধা বলল,
“লাইক সিরিয়াসলি,আমি আপনাকে অবহেলা করি?”
আয়ান গাল ফুলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, করোই তো। আমাকে একটুও কেয়ার করো না, আমার কোনো খোঁজ খবর নাও না,একটুও ভালবাসো না, একটুও আদর……।”
আয়ানকে আর কিছু বলতে না দিয়ে মৃধা তার মুখ চেপে ধরে বলল,
“ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর বলতে হবে না। একেবারে লাগামহীন কথা বার্তা। শুনলেও কান ঝনঝন করে ওঠে।”
“ও মা তাই বুঝি। তোমার কান ঝনঝন করে। তারমানে তোমার কানে নিশ্চয়ই ঝুনঝুনি ফিট করা আছে। কই আমাকেও দেখাও।”
“অসভ্য লোক একটা। দাড়ান দেখাচ্ছি আপনাকে…”
শুরু হয়ে গেল দুজনের ছোটাছুটি। সারাঘরে মৃধা আয়ানকে ধাওয়া করছে। একসময় টাল সামলাতে না পেরে দুজনেই হুড়মুড়িয়ে গিয়ে খাটের ওপর পড়ল। আয়ান নিচে আর মৃধা আয়ানের বক্ষের উপরিস্থলে। আচমকা এমন ঘটনায় দুজনেই হতভম্ব।সেই সঙ্গে ভীষণ লজ্জিত হলো। মৃধা ততক্ষণাৎ উঠে চলে যেতে চাইল কিন্তু বাঁধ সাধল আয়ান। সে মৃধার আঙুলের ভাঁজে লুকালো নিজের আঙুল। দুরত্ব ঘোচালো আরও খানিকটা। অতঃপর পরম তৃপ্তিতে বক্ষপিঞ্জরে আবদ্ধ করে নিল মৃধাকে। আবেশে আঁখি জোড়া বন্ধ হয়ে এলো দুজনের।
রিনরিনে গলায় শোনা গেল আয়ানের মধুর উক্তি, “ভালবাসি প্রেয়সী”। লজ্জাবতী লতার মতো মিয়িয়ে গেল মৃধা। প্রতিত্তোরে শুধু ছোট্ট করে বলল, ” আমিও, ভীষণ রকম।” আলাদা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল দুজনের কোমল হৃদয়। এ যেন এক অবিচ্ছেদ্য ভালবাসার গল্প।
__
দেখতে দেখতে তারিখ এগিয়ে চলে এলো প্রায় মুগ্ধর বিয়ের দিনের কাছাকাছি। সবাই খুব খুশি। তবুও একটা চিন্তা রয়েই গেছে। সেটা হলো মুগ্ধ। মুগ্ধ এখনো জানেই না তার বিয়ে দুদিন বাদেই। সবাই আশঙ্কায় আছে এই নিয়ে, ‘মুগ্ধ কী এই বিয়েটা করতে রাজি হবে?’ রাজি না হলে জোর করতে হবে। নয়তো এভাবে আর কত দিন। সবার জোরাজুরিতে মুগ্ধকে রাজি করানোর দায়িত্ব গিয়ে বর্তাল মৃধার ওপর। সেই দায়িত্ব কার্য্যকর করতে মৃধা হাজির মুগ্ধর ঘরে…….
“আমাদের সবার কথা ভেবে তোকে এই বিয়ে টা করতেই হবে ভাই।”
“প্লিজ আপুনি তুমি তো জানোই আমার সবকিছু। মৌ কে ভোলা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।”
“ওই এক মেয়ের জন্য তোর জীবন টা এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে সেটা আমরা কিছুতেই দেখতে পারব না। আমি তো চেষ্টা করেছিলাম তাই না কিন্তু সে তো রাজি হয়নি। বরং আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন তুইও বল আমাদের কী করণীয়?”
“আমি কিছু জানি না আপুনি। শুধু জানি আমার ওকেই চাই ব্যস। আর আমি অন্য কাউকে কিছুতেই বিয়ে করতে পারব না।”
“এমন হলে তাহলে তুইও শুনে রাখ তুই যদি এই বিয়ে না করিস তবে আমার আর মায়ের ম’রা’মু’খ দেখতে প্রস্তুত হয়ে নে। আমরা বেঁচে থাকতে তোর এই হাল কিছুতেই সহ্য করতে পারব না।”
মুগ্ধ কিছু বলতে যাবে তার আগেই মৃধা কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে গেল। মুগ্ধ ধপ করে মেঝেতে বসে পরল।দু-হাতে আঁকড়ে ধরল নিজের চুলের মুঠি।
চলবে,