সায়েবা আসক্তি পর্ব-২৪+২৫

0
913

#সায়েবা_আসক্তি
#লেখিকা_সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_২৪

নিকষ কালো অন্ধকারে ঘিরে ধরেছে চারিপাশ। ঠান্ডা বাতাসের সাথে বসন্তের নতুন পাতার গন্ধ।আশেপাশের কোন এক আম গাছ থেকে ভেসে আসছে ঝিঝি পোকার ডাক।
ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াচ্ছে আদিব।বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে তাকিয়ে আছে অন্ধকারে ঘেরা আকাশের পানে।

— তুই আবারো সিগারেট খাচ্ছিস?

ফারহানের কথায় মলিন হাসলো আদিব। ঠোঁটের কোনে ম্লান হাসি ধরে রেখেই বলে,

— নিজের ভিতরে দগ্ধ হওয়া আগুনের ধোঁয়া তো আর বের করতে পারছি না। তাই নিকোটিনের ধোয়াই না হয় উরালাম।

ফারহান গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদিবের দিকে। প্রিয় বন্ধুটির জন্য তারও কষ্ট হচ্ছে।

— নিজেকে কেন কষ্ট দিচ্ছিস?এতো ভেঙ্গে পরলে চলে?আমরা আছি তো তোর সাথে। টেনশন নিস না ইয়ার।

ফারহানের কথা শুনে বাকা হাসলো আদিব। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে পা দিয়ে পিসে ফেললো। নিজের কার্জ শেষ করে হালকা করে ঘাড় কাত তাকালো ফারহানের দিকে। ফিচলে হেসো অবাক হওয়ার ভান করে বললো,

— নিজেকে কেন শেষ করবো!শেষ করার জন্য তোর বোন আছে না?টেনশন নিস না, আমার ভিতরে জ্বলা আগুনে তোর বোনকেও খুব তারাতাড়ি পোড়ানোর ব্যবস্থা করছি।ডাক্তার বিয়ে করার সখ সারা জীবনের মতো ঘুচিয়ে দিবো।

ফারহান মনে মনে হাসিতে ফেটে পরলেও চেহারায় রাগী ভাব এনে বললো,

— আমার বোন কে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বললেও এখান থেকে ধ’ক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিবো বেয়াদব।

— দুলাভাই ডাক শালা।এখন থেকে দিনে দুই বার করে দুলাভাই ডাকা প্র‍্যাক্টিস করবি।আর দুলাভাই প্রজাতি একটু বেয়াদপ টাইপের ই হয়।না হলে দুলাভাই দুলাভাই ভাব আসে না। বুঝেছিস?

আদিবের কথা শেষ হতেই দুজনেই একসাথে হেসে দিলো।

— ডাক্তারের বিষয় কোন ইনফরমেশন পেয়েছিস?

— তার জন্য চট্টগ্রাম যেতে হবে। দেড় বছর আগে তারা ওখানেই ছিলো। এখনের সবাই তাদের সম্পর্কে ভালো কথাই বললো। তবে ডাক্তারের মায়ের ব্যবহার কিছুটা সন্দেহজনক।

— হুম।বিয়ের জন্য খুব তাড়া দিচ্ছে। এতো তারাহুরোর কি আছে বুঝতে পারছি না। সব কিছু ঘরোয়া ভাবে করতে চাইছে।আজকে এ কথা বলতেই এসেছিলো।

— এই ডাক্তার আমার হাতে কঠিন মার খাবে ভাই।আমার বউয়ের সাথে ঘোরাঘুরির সখ সারা জীবনের মতো ঘুচিয়ে দিবো। (রেগে)

— আগে ডাক্তারের একটা ব্যবস্থা করি।তারপর তোদের ব্যবস্থা ও হয়ে যাবে। তবে একটা কথা আমি স্পষ্ট ভাবে বলে দিচ্ছি আদিব,আমার আপু যদি রাজি না থাকে তাহলে আমি কিছুই করতে পারবো না। তোকে আগে আপুকে রাজি করতে হবে। আপুর অমতে গিয়ে আমি বা আমারা কিছুই করবো না।

— শালা বেইমান।নিজে তো ঠিকই সায়েবার কে জোর করে বিয়ে করে নিয়েছিস।আমার বেলায় আলাদা নিয়ম কেন?

— কারন সায়েবা আমাকে ভালোবাসে। তাই আমি তার উপর জোর খাটাতে পারি।

— তোর বোন ও আমাকে ভালোবাসে। শুধু বয়সের তারতম্যের জন্য মুখ ফুটে বলতে পারে না।

— ঠিক আছে। তাহলে তো হয়েই গেলো। আপু রাজি থাকলে আমাদের পক্ষ থেকে কোন সমস্যা নেই।

— হুম।

— আমি নিচে যাচ্ছি। বউ অঅপেক্ষা করছে।তোর তো আবার বউ নাই।তুই বুঝবি না।(শয়তানি হেসে)

আদিব ফারহানের কথায় মন খারাপের ভান করে বললো,

— আজ তোর বোন অবহেলা করে বলে।নাহলে আমি ও দুই বাচ্চার বাপ হয়ে দেখিয়ে দিতাম।

ফারহান আদিবের পিঠে ধুম করে কিল বসিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলো।

🌸

আয়নার সামনে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে ব্যস্ত সায়েবা। আজ অনেকদিন পরে সে সেজেছে।তাও নিজের প্রান পুরুষের জন্য। সোনালী পাড়ের টকটকে লাল শাড়ীতে তার রুপ ঠিকরে পড়ছে। কোমড় পর্যন্ত কোকড়ানো খোলা চুলে বেলি ফুলের গাজরা টা আরেকটু ভালো করে লিগিয়ে আলতা পড়ায় মন দিলো সায়েবা।আলতা লাগানো শেষ করে মোটা নুপুর গুলো পড়তেই ধবধবে পায়ের সৌন্দর্য আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেলো। হাত ভর্তি লাল চুরির রিমঝিম শব্দে চারিপাশ মুখরিত হয়ে আছে।চিকন চেইনের কোমড় বন্ধনিটা পড়তেই এক রাশ লজ্জা এসে ভর করলো সায়েবার মুখে।লাল টকটকে লিপিস্টিক আর গাঢ় কাজলে অপরুপ সুন্দর লাগছে সায়েবা কে।নাকের নোলক আর হাতের চুরি গুলো ছাড়া আর গয়না পরতে ইচ্ছে হলো না। তাই সীতাহার টা আবার রেখে দিয়ে নিজেকে আরেকবার দেখে নিলো।ঘড়িতে এখন বারোটা তেইশ।ফারহান হয়তো এখুনি চলে আসবে।ফারহানের উপস্থিতি চিন্তা করতেই লজ্জায় নুইয়ে গেলো সে।ঘরের লাইট অফ করে মৃদু আলোর ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে জানালার দিকে এগিয়ে গেলো সে।জানালান কাচ খুলে দিতেই বাতাসের ঝাপটা এসে শীতল করে দিয়ে গেলো অঙ্গ। ঠিক সেই মুহুর্তে আগমন হলো ফারহানের।দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই পা জোড়া থেমে গেলো তার। কয়েকটি হৃদস্পন্দন মিস হতেই বুকের বা পাশে হাত রাখলো সে।হৃদপিণ্ড অস্বাভাবিক ভাবে লাফাচ্ছে। শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো ফারহান। এই মেয়ে কি তাকে মা’রার প্ল্যান করেছে নাকি!সে আজ খু’ন হয়ে যাবে এই রুপে।

ফারহানের আসার শব্দ পেয়েছে সায়েবা।কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও ফারহানের উপস্থিতি টের না পেয়ে কপাল কুচকে গেলো তার।চিন্তিত হয়ে পিছনে ঘুরতেই ফারহানের স্তব্ধ দৃষ্টি দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। প্রেয়সীকে এই রুপে দেখে ফারহানের বুকে চিন চিন ব্যথা হতে লাগলো। এক অজানা শক্তি টেনে নিয়ে গেলো সায়েবার পানে।ফারহানের গরম নিশ্বাস আচড়ে পরতেই চোখ তুলে তাকালো সায়েবা।সায়েবার শরীরের কম্পন স্পষ্ট বুঝতে পারছে ফারহান।আস্তে করে চিবুক ধরে মুখ উচু করতেই চোখ বন্ধ করে নিলো সায়েবা। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুকাল। কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে নেশালো গলায় বললো,

— আমাকে খু’ন করতে চাও?শ্বাস বন্ধ করে মারতে চাও? এই দেখো আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না। বুক ধুকপুক করছে। শব্দ শুনতে পাচ্ছো?

লজ্জাবতী গাছের মতো নেতিয়ে গেলো সায়েবা।সায়েবা কে ঘুরিয়ে ঘারে মুখ গুজলো ফারহান। আবেদনময়ী গলায় প্রশ্ন করলো,

— দেনমোহর বুঝে পেয়েছো বউ?

ফারহানের বেসামাল স্পর্শে ততক্ষণে নেতিয়ে সায়েবা।মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। কোন রকম মাথা নারিয়ে বোঝালো পেয়েছে।
সাথে সাথে সায়েবাকে কোলে তুলে নিলো ফারহান। ফিসফিস করে বললো,

— আমার তো আরো দুই রাকাত শুকরিয়া নামাজ পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে আমার হুরদের সর্দারনী।

সায়েবা তখন চোখ বন্ধ করে ফারহানের বুকে মুখ লুকাতে ব্যস্ত।

সায়েবাকে শুয়িয়ে দিয়ে তার হাতে চুমু খেলো ফারহান।ভারি নিশ্বাস ছেড়ে বললো,

— আমার তোমাকে চাই বউ।আমার অস্তিত্বের ভিতর তোমার অস্তিত্ব চাই।

সায়েবা ফারহানের আকুতি ভরা কন্ঠ শুনে তাকে হাত উচু করে জরিয়ে ধরলো। ফারহান হাসলো।যাকে বলে বিশ্ব জয় করা হাসি।প্রিয়তমার কপালে চুমু খেয়ে তার গলায় মুখ ডুবিয়ে আদরের ঝড় তুলে দিলো।সেই ঝড়ের তান্ডব চললো সারা রাত।এতদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটলো দুজনের।

ফজরের আজান হতেই মুয়াজ্জিনের সাথে আজানের জবাব দিলো ফারহান। তার বুকের মাঝেই গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে সায়েবা।চেহারার মলিন হয়ে আছে।সায়েবা কে দেখে একটু কষ্ট হলো তার।মলিন মুখে পরপর কয়েকটা চুমু খেয়ে বুকের সাথে নিবিড় ভাবে চেপে ধরলো। নিজেকে কয়েকদফা গালি দিলো নিজের বারাবাড়ির জন্য।মেয়েটার অনেক কষ্ট হয়েছে মনে হয়!আদুরে স্বরে কয়েক বার ডাকার পরে পিটপিট করে চোখ খুললো সায়েবা।একটু নড়াচড়া করে আবার চোখ বন্ধ করে নিলো।

— আজান হয়ে গেছে বউ।নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ো।

ফারহানের আদুরে ডাকে উঠে বসলো সায়েবা। শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই। ফারহান বুঝতে পেরে কোলে করে নিয়ে গেলো ওয়াশরুমে।কিছুক্ষণ সাহায্য করে বেরিয়ে এলো সে।সায়েবার গোসল শেষ হতেই চটপট নিজে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।

নামাজ শেষ করে সায়েবা কে বেডে শুইয়ে দিয়ে নিচে চলে গেলো ফারহান। হালকা কিছু খাবার খাইয়ে সায়েবা কে পেইন কিলার দিতে হবে। গায়ে জ্বর জ্বর ভাব চলে এসেছে।একদিনের ভালোবাসায় এই হাল!বউ তো নয়,যেন ননির পুতুল। মুচকি হাসলো ফারহান।

চলবে,,,

#সায়েবা_আসক্তি
#লেখিকা_সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_২৫

এক সপ্তাহ যাবত চট্টগ্রামের নাসিরাবাদের অলিগলি চষে বেড়িয়েছে আদিব।আশানুরূপ কোন ফল না পেয়ে হতাশার নিশ্বাস নিচ্ছে প্রতি মুহুর্ত। এভাবে চলতে থাকলে ফায়জা কে হারাবে নিশ্চিত। বিয়ের আর মাত্র তিন দিন বাকি!কালকে গায়ে হলুদ ফায়জার।যা করার আজকের মধ্যেই করতে হবে। আর যদি কিছু করতে না পারে তাহলে সব কিছু লন্ডভন্ড করে দিবে।ওই ডাক্তার ভালো না খারাপ তাতে কিছু যায় আসে না। যে কোন পরিস্থিতিতে ফায়জা শুধু তার। বিয়ে তো ফায়জার তাকেই করতে হবে। রাস্তার পাশের একটা বেঞ্চে বসে পরলো আদিব।পকেটে থেকে টিস্যু বের করে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিলো।বেলা দুটো বাজতে চললো। মাথার উপরের সুর্য টা তার সমস্ত তেজ ঢেলে দিচ্ছে ধরনীর বুকে।আদিব আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করলো, রোদের তেজে তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না। চোখ নামিয়ে মনে মনে বিরবির করলো,

— এক নিষ্ঠুর নারী হৃদয় পোড়াচ্ছে। তুই ই বা বাদ যাবি কেন? তুই না হয় শরীর পোড়া।

ফোনের রিংটোনে বিরক্তিতে মুখ কুচকালো আদিব।একটু বসে যে নিজের বিক্ষিপ্ত মন কে শান্ত করতে তার জো নেই।বেয়াদব ফোন টা সেই কখন থেকে বেজেই চলেছে। ফোনেত স্ক্রিনে ফারহানের নাম দেখেও পাত্তা দিলো না সে।দুই হাতে ভর দিয়ে পিছনের দিকে হেলে বসলো। মাথার উপর কারেন্টের তারের উপর একটা কাক থেমে থেমে ডেকে যাচ্ছে। বিরক্তি তে ভ্রুদ্বয় আরো বেশি কুচকে গেলো আদিবের।বেঞ্চ থেকে উঠে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। এখানে বসে থেকে কাজ নেই।এর চেয়ে বাসায় গিয়ে কিভাবে বউকে শিহরণ বইয়ে দেয়ার মতো বাসর উপহার দেয়া যায় তা নিয়ে একটা জম্পেশ প্ল্যানিং করতে হবে।

🌸

রাত দশটার দিকে উত্তরার বিলাশ বহুল বাড়িতে প্রবেশ করলো আদিব।গাড়ি থেকে নামতেই প্রচন্ড আঘাতে দুই পা পিছিয়ে গেলো সে। হঠাৎ আক্রমনে হচকচিয়ে সামনে তাকালো আদিব।ফারহান রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঠোঁটের কিনারায় স্রোতের আভাস পেতেই বুঝতে পারলো বন্ধু তার ঠোঁট ফাটিয়ে দিয়েছে।ফারহানের দিকে তাকিয়ে আহত কন্ঠে বললো,

— হবু দুলাভাইয়ের ঠোঁট ফাটিয়ে দিতে লজ্জা করলো না তোর?এই ঠোট দিয়ে তো বউ কে চুমু ও খেতে পারবো না! এখন বউয়ের রাগ ভাঙাবো কেমনে শালা?

— ফোন রিসিভ করছিলি না কেন?এতোবার কল দিচ্ছি তাহলে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।

ফারহানের চিৎকার শুনে ভরকে গেলো আদিব।চিন্তিত গলায় বললো,

— কি হয়েছে দোস্ত?সব ঠিক আছে তো?
একটু থেকে শঙ্কিত গলায় বললো, ফায়জা ঠিক আছে তো? চুপ করে আছিস কেন? আমার ভয় হচ্ছে ফারহান!

আদিব কে দেখে কষ্ট হচ্ছে ফারহানের।এখন যা বলবে তা শুনে ছেলেটা হয়তো খুব ভেঙে পরবে।
আদিবের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো ফারহান।নিজেকে শক্ত করে গমগমে গলায় বললো,

— আপু তোকে বিয়ে করতে চায় না আদিব।আজ সে সরাসরি বলেছে, তোর প্রতি তার কোন অনুভূতি নেই।তোকে বিয়ে করার কথা বললে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।আমি অনেক বোঝাতে চেয়েছি ভাই।কিন্তু আপু আমার কোন কথাই শুনলো না।আজকের মধ্যে ই বিয়ে সেরে ফেলতে চাইছিলো।আমি খুব কষ্টে ম্যানেজ করেছি।আমাকে মাফ করে দে ভাই।আপুর মতের বিরুদ্ধে যেতে পারবো না। আমি আগেই বলেছিলাম, আপু যা চায় তাই হবে। এখানে আমার কিছু করার নেই।

আদিব অনুভূতিহীন নির্জীব চোখে তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। বুকের ভেতর কিছু একটার ভাঙন চলছে। ভাঙ্গনের তীব্র শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। ফারহান কি শুনলতে পাচ্ছে সেই শব্দ?কি জানি!শুনতে পাচ্ছে না হয়তো। এই ভাঙ্গনের শব্দ শুধু ক্ষতবিক্ষত হওয়া প্রেমিক পুরুষই শুনতে পায়।সফল প্রেমিক পুরুষের কি এই ভাঙ্গনের শব্দ শুনার ক্ষমতা আছে!

ফারহানের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো আদিব।কান্না গুলো গিলে ফেলে কয়েকবার চোখের পাতা পিটপিট করে ফারহান কে বললো,

— বাসায় যা ফারহান। তোর বোনের বিয়ে।অনেক দায়িত্ব তোর।এখানে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করিস না দোস্ত।কল রিসিভ না করার জন্য সরি।অযথাই তোর সময় নষ্ট হলো এখানে এসে। অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছি।একটু রেস্ট নিতে হবে। আমি রুমে গেলাম।সাবধানে যাস।

ফারহান কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই টলমলে পায়ে এগিয়ে গেলো আদিব।ফারহানের কষ্ট হচ্ছে। বন্ধুর মতো ভাইয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পারছে সে। আদিব ফায়জা কে কতটা ভালোবাসে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।হৃদয়ের শেষ বিন্দু ভালোবাসা টুকুও ফায়জার পায়ের কাছে সপে দিয়েছে সে।তবুও কেন এই প্রত্যাখ্যান!নিজেকে পাগল পাগল লাগছে ফারহানের।শুধু আদিবের বয়সের জন্যই কি এই অবহেলা! আদিবের মতো করে কি জাবের ফায়জা কে ভালবাসবে?নাহ,এভাবে শেষ হতে দেয়া যায় না সবকিছু। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাবে ফারহান।দেখা যাক আল্লাহ কি চান।

🌸

বদ্ধ্য রুমে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে ফায়জা। চোখ দুটি কদমের ন্যায় ফুলে আছে।চোখের পানি এখন অশ্রু হয়ে ঝরতে ঝরতে ক্লান্ত। তবে ফায়জার ক্লান্তি নেই।

আজ সকালে আদিবের বাবা মা এসেছিলো। ফায়জার মামি কিছুটা অহংকারী। কথার ধাচে বুঝিয়ে দেয় সবার অবস্থান। মামা খুব নিরীহ মানুষ। তবে বউ কে খুব ভয় পান।আদিবের মা এসে কথার ছলে ফায়জা কে অনেক কথা শুনিয়ে গেছেন।তার সোনার টুকরো ছেলের জন্য মেয়ের বাবা রা লাইন দিয়ে থাকে।কিন্তু তাতে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই। সে তার বোনের মেয়েকেই আনবে একমাত্র ছেলের বউ করে।ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে ফায়জার অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে।বাবার টাকার জোর না থাকলে তো বিয়েই হতো না। তাও ভালো একটা ডাক্তার ছেলে জুটেছে। না হলে তো আইবুড়ো হয়ে ঘরেই বসে থাকতে হতো। যতই ডাক্তার হও না কেন, বিয়ে ছাড়া মেয়ে মানুষের কোন মুল্য নেই।

ফায়জা চুপ করে শুধু শুনে গেছে।তার পরিবারের কেউ শুনলে এই মহিলা কে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে।বড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজন। ফায়জা একবার জবাব দিলে চরম অপমান হয়ে যেতে হবে তাকে।আদিবের মা কে সে এতটা অপমানিত কিভাবে হতে দিবে!মামী বলে পরোয়া করে না সে।কিন্তু আদিবের মা বলেই বেচে গেলো আজ।তবে সব কিছু শুনেছে সায়েবা।বারান্দায় দাঁড়িয়ে কফি খেতে খেতে বাড়ির সাজ দেখছিলো সে।আদিবের মা জানতো না এখানে সায়েবা ও আছে।রাগে গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে ওর।এই মহিলা কে একটা কঠিন শিক্ষা দিতে হবে। নিজেকে কি রানী এলিজাবেথ মনে করে নাকি। আসার পর থেকে সবাই কে অতিষ্ট করে তুলেছে।সায়েবা একবার ভাবলো ফারহান কে বলবে সব কিছু। পরক্ষণেই এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো। ফারহান কে বললে ফারহান এক্ষুনি বাড়ি মাথায় তুলবে।একটা বিশ্রী পরিস্থিতিতে পরতে হবে সবাইকে।মামা কে সবার সামনে ছোট হতে হবে। ফায়জা ফোনের রেকর্ডার টা অফ করে আবার কফি খাওয়ায় মন দিলো।এখন কিছু সময় এখানেই কাটাবে।

🌸

নিস্তব্ধ রাতে অনেকটা ক্লান্ত হয়েই ঘুমের দেশে পারি জমিয়েছে ফায়জা।সারাদিন কান্নাকাটি করার ফলে সন্ধ্যার পর থেকেই ভয়ংকর মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে। অতিরিক্ত কান্নাকাটি করলে মাথা ব্যাথা জেকে ধরে তাকে।তাই নয় টার দিকেই রুম অন্ধকার করে শুয়ে পরেছে সে। আপাতত এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চাই তার।সামনে আরো কঠিন সময়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে।

ফায়জার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদিব।কি নিস্পাপ মুখ।এই মুখের দিকে তাকিয়ে অনন্তকাল পারি দেয়া যায়। কে বলবে,এই নিস্পাপ চেহারার মেয়েটা এতটা নিষ্ঠুর!এই মেয়েটাই তার কলিজা থেকে ভয়াবহ রক্তক্ষরণ করাচ্ছে!

ফায়জার মুখের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো আদিব,

— আমি তোমার জীবনে বসন্ত হতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু তুমি আমার জীবন চৈত্রের খড়া নিয়ে এলে!
ক্ষমা করবো না তোমায়।আমার ভালোবাসা এতটা ঠুনকো নয় সোনা।কিন্তু তুমি আমার ধৈর্যের দেয়ালে বারবার আঘাত করছো।তোমার প্রতিটি আঘাতে আমি ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি।তোমার অবহেলায় আমি নিশ্বেস হচ্ছি বারংবার। এই অবহেলার দহনে তোমাকেও পুড়তে হবে।

চলবে,,,,