ভালোবাসি তাই পর্ব-৩০+৩১+৩২

0
521

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-৩০

“তোমায় জরিয়ে ধরলে খুব ভালো লাগবে কিউটি.. আমার বুকে তোমার মাথা আর কান ঠেকবে, শুনতে পাবে আমার হৃদস্পন্দন। অনুভব করতে পারবে, আমার হৃদয়ে তোমার নামে কম্পিত হওয়া সেই শব্দ যোগ… যা তোমার টানে আমাকে নিয়ে এসেছে সূদুর দূর দেশ থেকে এখানে।
খাটো মেয়েরা বুঝি এদিক দিয়ে খুব ভাগ্যবতী হয়…
তারা ভালোবাসার মানুষের হৃদস্পন্দন খুব সহজেই শুনতে পারে। এমনকি কতবার হৃদস্পন্দন হয় সেটা গুণতেও পারে।

আশা আবেশে তাকায় সাদের দিকে। সাদ পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে আশার দিকে। এক সময় সাদ বলে
“কিছু বলো কিউটি!
আশা কিছুটা সময় জড়তার মধ্যে থাকে। কি বলবে সে ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলো না। এক সময় জড়তা কাটিয়ে বলে উঠে
“আবার কবে চলে যাবেন?
আশার প্রশ্নে সাদ অদ্ভুতভাবে হাসে। এরপর দুষ্টুমি করে বলে
“আর কোনো প্রশ্ন পেলে না খুঁজে। আমি চলে গেলে তুমি খুশি?
আশা সামান্য বিরক্ত হয়ে বললো
“আমি কি বলেছি আমি খুশি? জিজ্ঞেস করেছি মাত্র, ইচ্ছে হলে বলবেন, না হলে নাই।
সাদ আবারও হাসে। এক হাতে নিজের দিকে টেনে নেয় আশাকে। কোমল গলায় বলে
“আমি একেবারে চলে এসেছি কিউটি.. আর ফিরে যাবো না সেখানে।
আশা অবাক হয়। বিস্ময়ে প্রশ্ন করে
“কেন? কেন যাবেন না আপনি আর?
সাদ আশার চোখের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ এভাবেই তাকিয়ে থাকে। এরপর আবেশে উত্তর দেয়…
“ভালোবাসি তাই।

আশা সম্মোহিত দৃষ্টিতে তাকায় সাদের দিকে। সাদের গভীর চাহনি আশাকে ক্রমশই দুর্বল করে দিচ্ছে। সাদের ঠোঁটগুলি কাঁপছে, চোখজোড়া যেনো কথা বলছে। সে কথা সবাই বুঝবে না। এটা ভালোবাসার কথা, প্রেমের কথা… এ কথা বুঝার সাধ্যি সবার নেই। সাদ আশাকে নিজের দিকে আরেকটু টেনে নিয়ে ক্ষীণ গলায় বলে
“আমায় বিয়ে করবে তো কিউটি?
আশা অবাক হয়ে তাকায় সাদের দিকে। সাদ আবারও বলে উঠে
“এবার কিন্তু কোনো নিষেধ মানবো না। তোমার কারণে আমি সব ছেড়ে এখানে ছুটে এসেছি.. তোমায় ভালোবেসে নিজের অস্তিত্বে খুব যত্নকরে তোমায় মিশিয়েছি। এবার আর কোনো কথা নয়, সোজা কবুল..
রাজি থাকলে ভালো, না হলে ওই রানার মতো গুন্ডামি করবো। জোর করে আদায় করবো নিজের ভালোবাসা।

আশার এবার হাসি পেলো খুব, এ ছেলের নির্ঘাত মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
সে সাদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দুপা পেছনে গেলো। ভ্রু বাকিয়ে বললো
“গুন্ডামি করবেন?
সাদ জোর গলায় বললো
“হু করবোই। আশা এবার আর হাসি আটকে রাখতে পারলো না। শব্দ করে হেসে উঠলো সে, সাদের এইরুপ কথা আশার কানে বাচ্চামোর ন্যায় ঠেকছে৷
আশাকে হাসতে দেখে সাদও হাসলো। সে আবারও বললো
“হাসলে কিন্তু তোমায় আরো বেশি কিউট লাগে কিউটি৷ ইচ্ছে করে খেয়ে ফেলি।
আশা চোখ বড় করে তাকায় সাদের দিকে। এ ছেলে এইসব কি বলে!! মুখে কিছুই আটকায় না।
আশা এইবার বলে উঠে..
“এখানেই থাকবেন নাকি বাড়ি যাবেন?
“ওখানে অনেক মানুষ, এখানেই নাহয় থাকি কিছুটা সময়।
আশা কোনো কথা বলেনা এইবার।

সাদ পুকুরের সিড়ির উপর গিয়ে বসে। আশাকেও ইশারায় বসতে বলে। কিন্তু আশা বসে না। এদিকটায় যদি কেউ এসে দেখে ফেলে দুজন পাশাপাশি বসে আছে তাহলে ব্যাপারটা খুব খারাপ দেখাবে। যদিও এদিকে মানুষের আনাগোনা খুবই কম, তারউপর ওদের বাড়িটায় অন্য কোনো ফ্যামিলি নেই, আলাদা বাড়ি তাদের। আশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাদ আবারও বলে
“আসছো না কেন কিউটি?
“আপনি বসুন, আমি এখানেই আছি।
“আমার পাশে বসলে খুব অসুবিধে হবে?
“কেউ এসে দেখলে খুব বাজে হবে।
সাদ হেসে বলে
“তাতে আমার জন্য সুবিধা হবে।
আশা বিস্ময় নিয়ে বলে
“কেমন সুবিধা?
“এই ধরো, অপরিচিত কেউ এসে আমাদের দুজনকে পাশাপাশি দেখবে..। গ্রামের মানুষ, তাই ব্যাপারটাকে বেশ নেগেটিভভাবে নিবে.. তোমার নামে বদনাম রটিয়ে দেবে। সেই সুযোগে আমি সবাইকে বলে দিবো, বদনাম যেহেতু আমার জন্য হয়েছে তাই এটার সমাধানও আমিই করবো। আমি কিউটিকে বিয়ে করবো। গ্রামের মেয়েকে বদনামের হাত থেকে বাচাঁনোর জন্য সবাই এক কথায় এ বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে। ব্যাপারটা সিনেমাটিক হবে তাইনা…

আশা সামান্য মেজাজ দেখিয়ে বললো
“যত বাজে চিন্তা আপনার মাথায়। আপনি থাকেন এখানে, আমার এত ক্যাচালের মধ্যে যাবার শখ নেই।
আশা চলে গেলো সেখান থেকে, সাদ এখনো আশার যাবার পথের দিকে তাকিয়ে হেসেই চলেছে। এ মেয়েটার সাথে এইসব মজা করলে ভালোই লাগে.. রাগলে একদম রসগোল্লা রসগোল্লা মনে হয়। সাদ আপনমনে হাসে আবারও।

আশাদের উঠোনে একটা জটলা মত বেধেছে। সেখানে স্বপ্না, ওর হাজবেন্ড, রানা, মৃদুলা, আদিব আর দিলারা বসে থেকে কথা কাটাকাটি করছেন। আশা কিছুটা দূরে বারান্দায় হেলান দিয়ে ওদের কথোপকথন শুনছে। কথা হচ্ছে ওর আর রানার বিয়ে নিয়ে। রানার বাড়ির লোকেরা বেশ ঝামেলা করছে।।
এ নিয়ে আদিবও বেশ রেগে যাচ্ছে। রানার বড় ভাই মানে স্বপ্নার হাজবেন্ড দিলারার দিকে তাকালেন। অভিযোগের সাথে বললেন
“এটা কোনো কথা বলেন খালাম্মা! আমরা সবকিছু পাকাপোক্ত করে বিয়ের দিন ঠিক করার জন্য আসলাম, আর এখন আপনারা বলেন বিয়ে দিবেন না। এটাতো আমাদের জন্য অপমান তাইনা? আমার ভাইটা, যে কিনা জীবনেও কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখে না, সে আশাকে একটা ছবিতে দেখেই পছন্দ করে ফেলেছে, যে সে পছন্দ না.. একদম বিয়ে করতে চায় সে। আপনারা এটা করতে পারেন না। আমার ভাইয়ের কি দোষ বলেন..? বেচারা মনে কতটা কষ্ট পচ্ছে আপনাদের এইসব ব্যবহারে।

দিলারা কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে সব শুনলেন। এরপর ভারীমুখে বলে উঠলেন
“তুমি কি মনে করো তোমার ভাই আমার মেয়ের যোগ্য?
রানার বড় ভাই অহংকারের সাথে বলে উঠলেন
“এইটা কি বলেন খালাম্মা, রানা আশার যোগ্য হতে যাবে কেন, বরং বলেন আশা রানার যোগ্য কিনা। আমার ভাইকে আমরা কোনো কোটিপতির মেয়ের সাথে বিয়ে করাতে পারতাম। প্রচুর বিয়ের প্রস্তাবও আসে, কিন্তু ও আশার মত একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে বিধায় আমরা এখানে আসছি।
“তাহলে বলতে চাইছো আশা রানার যোগ্য না। তাও তোমরা তোমার ভাইয়ের সুখের জন্য এই বিয়েটা করাতে চাইছো?
রানার বড় ভাই ভদ্রভাবে হেসে বললো
“জ্বি খালাম্মা।
দিলারা এবার গম্ভীরমুখে বললেন
“তোমরা চলে যাও এবার, আমার মেয়ের বিয়ে আমি তোমার ভাইয়ের সাথে দিবোনা। যে ছেলে মনে করবে আমার মেয়ে তার যোগ্য, আমি তার সাথেই আমার মেয়েই বিয়ে দিবো।।

মৃদুলা এতক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেও এবার বলে উঠলো
“সমস্যা কি আম্মা? রানা ছেলে ভালো, দেখতে শুনতেও ভালো। অনেক পয়সাওয়ালা, ভালো চাকরিও করে, তাহলে বিয়ে দিতে সমস্যা কোথায়? বরং ওখানে আমার বোন আছে, আশা সুখেই থাকবে।
“তোমারে তো কালই বলে দিছিলাম বউমা, তোমার কোনো বোন থাকলে তার বিয়ে দিয়ে দাও।
মৃদুলার মুখ চুপসে গেলো।
এমন সময় সাদও এগিয়ে এলো এদিকটায়। এরকম একটা জটলা দেখে কিছুটা অবাক হলো সে। সে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। রানার নজরে এলো সাদ। রানা হুংকার করে বলে উঠল
“যত দোষ এই সাদের। আজ সকাল পর্যন্তও সব ঠিক ছিলো, ও আসার পর থেকে সব পালটি খাইছে। রানা এবার আদিবের দিকে তাকালো। শক্ত গলায় বললো
“কত টাকা ঘোষ দিছে ও আপনাদের? আপনারা চাইলে আমি এই চেয়ে অনেক বেশি দিবো.। তাও আশাকে আমার চাইই চাই। ওর বিয়ে শুধু আমার সাথেই হবে।

সাদ অবাক হয়ে তাকালো আশার দিকে। মেয়েটা চুপটি মেরে বারান্দায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এইসব শোনার পর হয়তো সে মানসিকভাবেও ভেঙ্গে পরেছে।
আদিব এবার মুখ খুললো..
“আচ্ছা রানা, তোমার ভাই তো দাবী করছে তুমি খুব ভদ্রসভ্য ছেলে তাইনা? ভালো একটা চাকরিও নাকি করো।
রানা কিছু বলার আগে ওর ভাই বলে উঠলো
“অবশ্যই ।
আদিব হেসে বললো
“আপনার ভাই কিসে চাকরি করে শুনি?
এবার উনি কিছুটা দমে গেলেন। কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। আদিব বললেন
“আমি বলি আপনার ভাই কি করে?

রানার ভাই আর স্বপ্না অবাক হয়ে তাকালো আদিবের দিকে। মৃদুলাও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো। আদিব বললো
“আপনার ভাই না কোনো ভদ্র ছেলে, আর না কোনো চাকরিজীবী। সে একালার গুন্ডা, বদমায়েশ। যাদের কাজ রাস্তাঘাটে মেয়েদের উত্যক্ত করা, থ্রেট দেওয়া.. সবসময় জ্বালাতন করা। কি রানা, আমি ঠিক বলছি তো?
রানা অবাক হলো, আশা তাহলে সব বলে দিয়েছে ওর ভাইকে? আদিব আবারও বললো
“আপনারা ভাবলেন কি করে, একজন বখাটের কাছে আমার বোনকে বিয়ে দেবো?
রানার ভাই গম্ভীরমুখে বললো
“এইসব যে বলছেন, তার কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে?
আদিব হাসলো। এরপর সে আশাকে ডাকলো নিজের কাছে৷ আশা একবার সাদের দিকে তাকালো। ওর অসহায়ভাবে তাকানো দেখে সাদের বুকে মোচড় দিলো। ইচ্ছে করলো, দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরুক ওকে, বুকের সাথে মিশিয়ে বলুক, “ভয় পেওনা কিউটি, আমি আছি তো।”

আশার কাছ থেকে ওর ফোনটা নিয়ে রানার সমস্ত কীর্তিকলাপ সবার সামনে তুলে ধরলো আদিব। এক এক করে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা বললো সবার সামনে।। এমনকি রানার নাম্বারে কল দিয়ে এর সত্যতাও প্রমাণ করে দিলো। রানার ভাই এবার মাথা নিচু করলো। তার ভাই বখাটে সেটা জানে, কিন্তু আশার সাথে এতো কীর্তি করেছে এটা তাদের জানা ছিলো না। আদিব এবার সাদের দিকে তাকালো। মুচকি হেসে ওকে ডাকলো। সাদ এগিয়ে গেলে রানার ভাইকে বললো
“এই যে দেখছেন ছেলেটাকে, ওর সাথে আপনার ভাইয়ের ভালোই পরিচিতি আছে। জিজ্ঞেস করুন আপনার ভাইকে ওকে চিনে কিনা..

রানার ভাই রানার দিকে তাকায়। রানা রেগে চোখ সরিয়ে নেয়। সাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে
“এ তখনও আমার আর আশার মাঝে বাধা হয়েছিলো, আর এখনো। একে তো আমি ছাড়বো না।
আদিব ভারী গলায় বলে
“তুমি কি ভুলে গেছো, এই মুহূর্তে তুমি কোথায় আছো?
” ভুলি নাই। এইখানে আমি কিছুই করবো না, আমার হাতের নাগালে পাই.. কোনো না কোনো দিন তো আমার এলাকায় যাইতেই হইবো, সেদিন বুঝাবো আমি কি জিনিস।
আদিব মুচকি হেসে বললো
“নিজের এলাকায় তো কুকুরও নিজেকে রাজা মনে করে।
আদিবের কথায় রানা রেগেমেগে তাকায় ওর দিকে। আদিব আবারও ঠান্ডা মাথায় বলে
“আমার বোনের সাথে তুমি যা যা করেছো চাইলে আমি সুদে আসলে তা ফেরত দিতে পারতাম। কিন্তু আমি তা করবো না। আমিও যদি এইসব করি তাতে তোমার আর আমার মাঝে কোনো তফাৎই থাকবে না।

আদিব এবার মৃদুলার দিকে তাকায়। ওকে প্রশ্ন করে
“রানার সাথে আশার বিয়ে দেওয়ার খুব শখ জেগেছিলো তোমার মনে। এখনো কি সেই শখটা আছে?
মৃদুলা মাথা নিচু করে বললো
“এতকিছু তো আমি জানতাম না।
“এবার জেনেছো তো?
মৃদুলা অসহায়ভাবে আদিবের দিকে তাকায়। আদিব মৃদুলাকে বলে
“এই যে আমার মা, আর আমার বোন… এরা শুধু আমার মা বোন নয়, এরা আমার কলিজা।। আমার বোনটাকে খুব কষ্টে বড় করেছি জানো তো। আর আমার মা, আমাদের দুই ভাইবোনকে ছায়ার মতো আগলে রেখেছে। বাবা মারা গেছে সেই ছোটবেলায়। আজ তোমার স্বামী হতে পেরেছি এই বৃদ্ধ মহিলাটির কারণেই, যিনি আমার মা, আমার জান্নাত।

আমি প্রায়শই দেখি তুমি বিনা কারণে ওদের সাথে খারাপ আচরণ করো, আমি কিছু বলিনা তোমায়, ভাবি, হয়তো ঠিক হয়ে যাবে তুমি। কিন্তু তোমার ঠিক হবার কোনো নামই নেই। আমার সামনে তুমি ঠিকই ভালো, আর আড়ালে… সেটা নাহয় নাইবা বললাম। এবার কান খুলে শোনে রাখো.. ভবিষ্যতে আর কোনো দিন যদি আমার মা বোনকে কটু কথা বল, আমি তোমাকে ছেড়ে দিতে দুইবার ভাববো না।
মৃদুলা আঁতকে উঠলো আদিবের কথার। চোখদুটো ভিজে গেলো তার। দিলারা রেগে চিৎকার করে বলে উঠলেন
“এইসব কি কথা আদিব?
আদিব ভারী গলায় বললো
“আমি ঠিকই বলছি মা। বউ হচ্ছে একজন পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী। আর সেই অর্ধাঙ্গিনী যদি তার স্বামীর সন্তুষ্টি না বুঝে, স্বামীর মা বোনের দিকে বিনা কারণে আঙ্গুল উঠায়, তাহলে সেটা আমি মোটেও সহ্য করবোনা। এতদিন সুযোগ দিয়েছি, এবার আর সুযোগ নয়।
মৃদুলা হঠাৎ কান্নাজড়িত গলায় বলে উঠলো
“আমায় মাফ করে দাও, আমি আর কোনো দিন এমন করবো না। আর রানার ব্যাপারটা সত্যিই আমি জানতাম না।
আদিব কোনো কথা বললো না।

মৃদুলা এবার স্বপ্নার দিকে তাকালো। রাগী গলায় বললো
“তোমাকে তো আমি বোনই ভাবতাম, আর সেই তুমি আমার কাছে সত্যটা গোপন করে মিথ্যা বলে এতকিছু করলে?
স্বপ্না মাথা নিচু করলো। মৃদুলা আর কোনো কথা না বলে দৌড়ে চলে গেলো ঘরের মধ্যে।

আদিব এবার স্বাভাবিক গলায় রানার পরিবারের দিকে তাকিয়ে বললো
“আমার বোনের বিয়ে খুব শীঘ্রই হবে। আপনাদের ইনভাইট করবো, আশা করছি নিমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন।
রানা রাগী গলায় বললো
“কার সাথে বিয়ে দিবেন আশার?
“সেটা অবশ্যই তোমার সাথে নয়।
গম্ভীরমুখে বললো আদিব।

চলবে……

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-৩১

রানা রাগী গলায় বললো
“কার সাথে বিয়ে দিবেন আশার?
“সেটা অবশ্যই তোমার সাথে নয়।
গম্ভীরমুখে বললো আদিব।
রানা ক্ষেপে গিয়ে বললো
“আমার সাথে বিয়ে দিতে সমস্যাটা কোথায়?
“এতক্ষণ কি বললাম? ভারী গলায় বললো আদিব।
রানার সারা শরীর রাগে কাপতে লাগলো। সে হঠাৎ আশার দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড চিৎকারে বলে উঠলো
“আমারে ছাড়া অন্য কাউরে বিয়া কইরা দেখ খালি, তোর হাত, পা ভাইঙ্গা যদি তোর বিয়ার সাধ না মিটাইছি তয় আমি রানা না।

আদিব প্রচন্ডভাবে রেগে গেলো এবার। সে রানাকে কিছু না বলে ওর বড় ভাইয়ের দিকে তাকালো। চাপা রাগে প্রশ্ন করলো
“এর পরেও আপনাদের কিছু বলার আছে?
রানার ভাই রানাকে ধমকে বলল
“রানা, এবার কিন্তু বারাবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তোমার কারণে আমরা ছোট হচ্ছি।।
রানা একবার বড় ভাইয়ের দিকে তাকালো, চোখমুখ দিয়ে রাগ ঝরছে তার।
আদিব আবারও বললো
“ভাইকে বড়ই করেছেন, কিন্তু মানুষ করতে পারেন নি।
উনারা লজ্জায় মাথা নত করলো। আদিব এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে উঠলো
“আমার বউ আপনাদের জন্য দুপুরের রান্না করেছে, আশা করছি খেয়ে যাবেন।
এরপর আর কোনো কথা না বলেই উঠে গেলো সে। দিলারাও চলে গেলো নিজের রুমে। রানা সাদের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো একবার। এরপর হনহন করে চলে গেলো সেখান থেকে। সবাই যে যার মতো নিজ যায়গায় চলে গেলেও আশা আপন যায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। এতসব ঝামেলা, এতসব তর্কবিতর্ক… সব তাকে ঘিরেই হচ্ছে। ব্যাপারটা বেশ কষ্ট দিচ্ছে তাকে।

সাদ ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো আশার দিকে। আশা নড়লো না, আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইলো। সাদ আলতোহাতে ওর মাথায় হাত রাখলো, মৃদু কেঁপে উঠলো আশা। অবাক চাহনিতে তাকালো সাদের দিকে। সাদ ক্ষীণ গলায় বললো
“কিউটি, মন খারাপ করে আছো কেন?
আশা হতাশায় বললো
“ভালো লাগছেনা।
সাদ মুচকি হাসলো। এরপর ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো
“এভাবে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছো দেখলে রানা তোমায় দুর্বল ভাববে, মনে মনে আরো শয়তানি বুদ্ধি আটঁবে। নিজেকে শক্ত করো, ওকে বুঝিয়ে দাও তুমি ভালো আছো।

আশা সাদের দিকে তাকালো। মুচকি হেসে বললো
“আপনি সত্যিই অনেক ভালো।
“তোমার মত অতটাও নয়।
দুপুরের খাবার খেয়ে যাবার কথা থাকলেও এর আগেই রেডি হয়ে গেলো রানার পরিবার। ভেবেছিলো আজকের দিনটা থেকে সবকিছু ঠিকঠাক করে আগামীকাল রওনা করবে। কিন্তু যা হলো, এরপর আর কোন মুখে এরা এখানে থাকবে।
রানার ভাই ব্যাগপত্র গুছিয়ে স্বপ্নার দিকে তাকালো। রাগী গলায় বললো
“রানা কোথায়?
“জানিনা।
“এটা জানবে কি করে, ও কোথায় কোন মেয়েলি কারবারে জরিয়েছে সেটা জানাই তো তোমার কাজ।
স্বপ্না রেগে গিয়ে বললো
“এই শুনো, একদম আমার সাথে ঝাঁঝ দেখাবেনা৷। তোমার ভাইকে বড় করতে গিয়ে আমার বাপের বাড়ির লোক আর তার শশুরবাড়ির লোকের কাছে আমার মাথা কাটা গেছে।
“কে বলেছিলো তোমায় আমার ভাইকে এতো বড় বানাতে যেতে? যত্তসব।

বাড়ির সামনে একটা মাটির সরু রাস্তা বয়ে গেছে অনেকদূর। রাস্তার দুধারে অনেক বড় বড় গাছ। প্রচন্ড রোদের মাঝেও এই বড় গাছগুলো পুরো রাস্তাটাকে ছায়া দিয়ে আচ্ছাদন করে রেখেছে, অসম্ভব ভালো লাগার একটি মুহূর্ত এটি। সাদ একলা এই রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছে। একে তো মাটির রাস্তা, তারউপর শহরের রাস্তার মতো নেই কোনো যানজট, নেই কোনো কোলাহল। দুষিত বাতাস নয়, সম্পুর্ন ফ্রেশ বাতাস যা শরীর আর মন জুরিয়ে দিচ্ছে। ভালোই লাগছে হাঁটতে। এই মুহূর্তে কিউটি পাশে থাকলে আরো বেশি ভালো লাগতো। আশার কথা মাথায় আসতেই মুখে মৃদু হাসির আভা ফুটে উঠলো।

কয়েক পা সামনে গিয়েই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরলো সাদ। ভ্রু বাকিয়ে তাকালো সামনের দিকে। রানা তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে, চোখমুখ কুচকে আছে সে। বুঝাই যাচ্ছে রাগে ফেটে পরছে। সাদ খানিক শক্ত গলায় বললো
“এভাবে রাস্তা আগলে দাঁড়ানোর মানেটা কি?
“সবেতো রাস্তা আগলেছি, আর কি কি যে আমি আগলে দাঁড়াতে পারি সেটা তোর ধারণারও বাইরে।
সাদ মুচকি হাসলো, ক্ষীন গলায় বললো
“তোর মাথায় সমস্যা হয়েছে, বাড়ি চলে যা। বাবা মাকে গিয়ে বল তোকে যত দ্রুত সম্ভব পাবনা পাঠাতে।
রানা রেগে গিয়ে বললো
“তোকে তো আমি…
সে খপ করে সাদের কলার চেপে ধরলো। শক্ত গলায় বললো
“চলে তো গিয়েই ছিলি, তাহলে কেন ফিরে এলি আবার?
“ফিরে আসায় তোর কোনো প্রব্লেম হয়েছে?
রানা দাঁতে দাঁত চেপে বললো
“জানিস না তুই আমার কি হইছে?
সাদ মুচকি হাসলো। এরপর রানার হাতটা নিজের কলার থেকে ছাড়িয়ে ঝেরে ফেলে দিয়ে বললো….
“কিউটিকে বড্ড বেশি ভালোবাসি, তাই ফিরে এসেছি।
“বাংলাদেশে কি মেয়ের অভাব পরছে? ওকেই কেন ভালোবাসা লাগবে তোর?
“সেটা কি তোর কাছে জবাবদিহি করবো? রাস্তা ছাড়, বড্ড কানে জ্বালা করছে। এই কন্ঠস্বর আমি নিতে পারছিনা আর। রানাকে পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো সাদ।
এমন সময় রানা তেজ দেখিয়ে বললো
“আশা তো তোকে ভালোবাসে না। তাও কেন এত লাফাচ্ছিস তুই?

রানার এই কথায় থমকে দাঁড়ালো সাদ। ভ্রু বাকিয়ে পেছন ফিরে তাকালো সে। সন্দিহান গলায় বললো
“তোকে কে বলেছে কিউটি আমায় ভালোবাসে না? কয়েক সেকেন্ড রানার দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে সাদ৷ এরপর আবারও বলে উঠে
“ও আমাকে আমার চেয়েও বেশি ভালো বাসে। সাদের ঠোঁটের কোনে হাসি। সে হাসি দেখে জ্বলে ছারখার হয়ে যাচ্ছে রানা। সে ক্ষীপ্ত কন্ঠে বললো
“আশা কি তোকে এ কথা বলেছে কখনো?
“মুখের ভাষা নয়, ওর চোখের ভাষাই আমার জন্য যথেষ্ট।

একলা ঘরে উপুর হয়ে শুয়ে ফুপিয়ে কাঁছে মৃদুলা। বেশ কষ্ট হচ্ছে আজ তার, যে মানুষটাকে সে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলেছে, এতটা ভালোবেসে ফেলেছে, সে মানুষটা তাকে অপরাধের শাস্তি হিসেবে ছেড়ে দেবার কথা বলেছে, এরচেয়ে দু ঘাঁ যদি পিঠে বসিয়ে দিতো তাও এতটা কষ্ট হতনা। তখন থেকে কেঁদে চলেছে বেচারি। এই পর্যন্ত একবারের জন্যও আদিব আসেনি রুমে, হয়তো বেশ রেগে আছে তার উপর।
আদিব যখন রুমে এলো তখনও কেঁদে চলেছে মৃদুলা। আদিব উত্তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বিছানার এক প্রান্তে বসে। মৃদুলা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকায় আদিবের দিকে। কোনো কথা বলে না সে। বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। আদিব কয়েক সেকেন্ড পর দৃষ্টি অন্যদিকে রেখে বলতে শুরু বলে
“যখন ছোট ছিলাম, তখন আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলো তিনজন। আমার মা, আমার বাবা আর আমার একমাত্র আদরের ছোট বোন আশামনি। আশামনি তখন বেশ ছোট ছিলো, একটা পুতুলের সমান। সারাক্ষণ কোলে করে রাখতাম, বাবা আমাদের দুজনইকেই অনেক আদর করতো।

দুধের ফিডার আশামনির মুখে চেপে আমি ওকে খাইয়ে দিতাম, আর আমার মা ঠিক সেই সময়টায় আমার মুখে ভাত তুলে খাওয়াতো। যখন বাবা বাজারে যেত, প্রতিবার তিনি আমাকে উনার ঘাড়ে বসিয়ে সাথে করে নিয়ে যেতেন। বাড়ি ফেরার সময়ও তাই করতেন। বাবার ঘাড়ে থাকতাম আমি, আর হাতে থাকতো বিশাল ওজনের বাজারের ব্যাগটা। তবুও বাবা কখনো বলেনি, তার কষ্ট হচ্ছে। সবসময় হাসিমুখেই থাকতে দেখেছি বাবাকে। মাঝে মাঝে বাবাকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করতাম, কেন সমসময় বাবা এত হাসে? বাবা তখনও হাসিমুখে উত্তরে বলতো, “হাসি থাকাটা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক, কারণ এটা হচ্ছে একজন মানুষের ভালো থাকার ঔষধ।
হঠাৎ করেই বাবা মারা যায়, তখন সবেমাত্র আমি হাই স্কুলে উঠেছি। আশামনি তখন ক্লাস ওয়ান কি টু এ পড়ে। বাবা চলে যাবার পর আমি বুঝেছি জীবন কি! প্রথম প্রথম মা অনেক কষ্টে সংসার চালাতো, সারাদিন রাত খাটতো। মাকে দেখতাম অন্যের বাড়ির রান্নাবান্না করে দিতো, কাপড় চোপড় ধুয়ে দিত। আমি মাকে প্রশ্ন করতাম সে কেন অন্যের কাজ করে৷ মা আমায় হাসিমুখে উত্তর দিতো, ” বেচারির অনেক কষ্ট হয় একা একা কাজ করতে, তাই আমি সাহায্য করছি।

মায়ের কথার মানেটা তখনও ভালো করে বোধগম্য হতোনা। ধীরে ধীরে আরেকটু বড় হলাম, বুঝলাম অন্যের বাড়িতে মায়ের কাজ করার কারণ টা কি। সেদিন এতটা কষ্ট লেগেছিলো, যে কষ্ট আমি এইটুকু বড় হওয়া পর্যন্ত আর দ্বিতীয়বার পায়নি। আমার স্কুলে আমার সাথে পড়ুয়া এক বন্ধু ছিলো, তার বাবার কাপড়ের দোকান ছিলো একটা ছোটখাটো। একদিন জানতে পারি উনি দোকানটাকে বড় করবেন, আর সেইজন্য তার একজন ছেলের দরকার। সে তাকে আগেপাছে সাহায্য করবে।
জানো তো, তখন থেকেই আমার স্ট্রাগল শুরু। অনেক কষ্ট করেছি, মায়ের অন্যের বাড়িতে কাজ করানো বন্ধ করেছি, এত কষ্টের মাঝেও বোনটাকে মাথায় করে রেখেছি। এতকিছুর পরেও লেখপড়াটা কিন্তু ছাড়ি নি। ধরেই রেখেছি।

সময় পাল্টেছে, আমাদের জীবন ধারা পাল্টেছে। যখন কলেজে উঠেছি, তখন সল্প পুঁজি নিয়ে ব্যাবসা দিয়েছি। ব্যবসার টাকা কোথা থেকে এসেছিলো জানো মৃদু?
মৃদুলা অবাক হয়ে তাকায় আদিবের দিকে। আদিব একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। এরপর আবারও বলতে শুরু করে
“আমার বোনটা যখন খুব ছোট, তখন আমার বাবার অবস্থা অনেক ভালো ছিলো, আমার বাবা আমার বোনকে তার এক জন্মদিনে এক স্বর্ণের চেইন উপহার দিয়েছিলো, খুব ভারী ছিল চেইনটা। আমার মায়েরও খুব সুন্দর একজোড়া কানের দুল ছিলো।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি আমার মা আর বোন আমাকে না জানিয়েই সেগুলো বিক্রি করে। অনেকগুলো টাকা এসেছিলো সেগুলো বিক্রি করে। একদিন আমার মা এই টাকাগুলো আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে
“আর পরের গোলামি নয়, এবার নিজে কিছু কর।
আমি অবাক হয়ে মাকে প্রশ্ন করেছিলাম টাকা কোথা থেকে পেলো। মা হাসিমুখে সেদিন উত্তর দিয়েছিলো,
“তোর জন্য এগুলো তোর বাবাই রেখে গেছিলো। আমার বোনটাকেও দেখেছিলাম সেদিন হাসিমুখে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে। নিজের শখের একটা দামী জিনিস হারিয়েও তার মধ্যে বিন্দুমাত্র দুঃখ ছিলোনা।

যদিও পরবর্তীতে আমি সেগুলো ফিরিয়ে এনেছি, আমার বাবার স্মৃতিটুকু আমি কি করে মুছে ফেলতে পারি বলো।
মৃদুলা নির্বাক। সে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে আদিবের দিকে। হঠাৎ আদিবের চোখে পানি চলে আসলো। মৃদুলা ভাঙ্গা গলায় বললো
“কাঁদছো কেন?
আদিব মৃদুলার দিকে তাকালো। নরম কন্ঠে বললো
“সেদিন আমি কতটা কষ্ট পেয়েছিলাম তোমার ধারণারও বাইরে মৃদু।
মৃদুলা অবাক হয়ে বললো
“কোনদিন?
“যেদিন আমার বোনের খাওয়া পড়া নিয়ে তুমি খুটা দিয়েছিলে। যাদের টাকায় আমি আজ ব্যবসা করে এতদূর এসেছি, তাদেরই তুমি তাচ্ছিল্য করেছিলে। মৃদুলা মাথা নিচু করলো এবার। ওর চোখের কোনেও বিন্দু বিন্দু পানি। আদিব বললো
“যে মা নিজে না খাইয়ে আমাকে খাইয়েছে, আমার সে মায়ের সাথেও কটু কথা বললে।

আমার বোনটাকে যেদিন তুমি ভুলভাল খবর দিয়ে বিব্রত করেছিলে সেদিন আমি তোমাকে সামান্যই শাসন করেছিলাম, ভেবেছিলাম এটা তোমার ছেলেমানুষী।

আদিব নিশ্চুপ। মৃদুলা মাথা নিচু করে বসে আছে ওর সামনে। আদিব আবারও উত্তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলে
” আমি ভাবতাম, আমার জীবনে তুমি আসার পর বাকি তিনজনের সাথে সাথে তুমিও একজন গুরুত্বপূর্ণ কেউ হয়ে উঠেছো। আজ আমার সন্দেহ হচ্ছে, আদৌ তোমাকে আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সাথে ঠাঁই দিয়ে আমি ঠিক করেছি তো?

চলবে…..

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-৩২

আদিব নিশ্চুপ। মৃদুলা মাথা নিচু করে বসে আছে ওর সামনে। আদিব আবারও উত্তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলে
” আমি ভাবতাম, আমার জীবনে তুমি আসার পর বাকি তিনজনের সাথে সাথে তুমিও একজন গুরুত্বপূর্ণ কেউ হয়ে উঠেছো। আজ আমার সন্দেহ হচ্ছে, আদৌ তোমাকে আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সাথে ঠাঁই দিয়ে আমি ঠিক করেছি তো?

এতক্ষন নিশ্বব্দে কাঁদলেও এবার শব্দ করে কেঁদে উঠে মৃদুলা। আদিব বিমর্ষ চোখে তাকায় মৃদুলার দিকে। কিন্তু কেন যানি আজ বলতে ইচ্ছে করছেনা “কেঁদোনা মৃদু, সব ঠিক হয়ে যাবে।
মৃদুলা দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরে। আদিব অন্যদিকে চোখ ফেরায়। ওর চোখের কোনেও পানি, তবে চোখের পানি ছেড়ে শব্দ করে কাঁদা বোধহয় পুরুষদের ধাতে লিখা নেই। মৃদুলা হঠাৎ বিছানা ছেড়ে নেমে আদিবের পা দুটো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কান্নাজড়িত গলায় অনুনয়ের স্বরে বলো
“আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে, আমি বুঝতে পারিনি ব্যপারটা তোমায় এতোটা বেশি কষ্ট দিবে। আমায় মাফ করো প্লিজ প্লিজ।
আদিব নিজের পা থেকে মৃদুলার হাত দুটো ছাড়িয়ে নেয়। এরপর মৃদুলার থেকে এক হাত দূরে সরে গিয়ে বসে। ইচ্ছে করছে জোরে জোরে কান্না করতে, কিন্তু পারছেনা সে। মৃদুলা কয়েক সেকেন্ড থ মেরে বসে রইলো। বুক ফাটা আর্তনাদে বললো
“আমি তোমায় সত্যিই অনেক ভালো বাসি, এমন করে সরে যেও না আমার থেকে।
আদিব এবারেও নিশ্চুপ।
মৃদুলা এবার উঠে গিয়ে আদিবের পায়ের কাছে বসে। এরপর শক্ত করে জরিয়ে ধরে আদিবকে।

এবার নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা আদিব। সেও জরিয়ে ধরে মৃদুলাকে৷ ভেজা গলায় বলে উঠে
“আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি মৃদুলা, দয়া করে ভালোবাসার যায়গাটা নষ্ট করেও দিও না।

দুপুরের আগে আশাকে খুজে বের করতে দিলারার রুমের সামনে যায় সাদ। আশা তখন মায়ের ঘরে বসে হাতের কিছু কাজ করছিলো। সাদ আসার পর থেকে ওর রুমটা আবারও সাদের দখলে গিয়েছে। তাই ইচ্ছে থাকলেও নিজের রুমে যেতে পারছেনা সে। দিলারা সাদকে দেখতে পেয়ে হাসিমুখে প্রশ্ন করে
“কিছু বলবে বাবা?
সাদ ভদ্রতার সাথে উত্তর দিলো
“আন্টি, গোসল করা লাগবে আমার।
দিলারা বলে উঠে
“এই দেখো বাবা, ভুলেই গেছিলাম এই কথাটা। দিলারা তৎক্ষনাৎ আশাকে ডেকে বলেন
“এই আশা..
“কি?
“নতুন গামছাটা আর সাবান বের করে গোসল খানায় রেখে আয় তো। সাদ গোসল করবে।

আশা তখন বলে উঠে….
“সাবান তো গোসল খানায় আছে।
“গামছা তো নেই, ওটা দিয়ে আয়।
“উনি বোধহয় উনার গামছায় সাথে করে নিয়ে এসেছেন। আমাদের গামছা দিয়ে কি করবে উনি?
সাদ দাঁতে দাঁত চেপে বলে
“আমি কোনো গামছা টামছা আনি নি।
দিলারা আবারও আশাকে ডেকে বলেন
“ও গামছা আনেনি সাথে করে। বের করে দিয়ে আয় মা।
আশা এবার সামান্য বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। চোখ মুখ কুচকে মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বলে
“উফ, একটা কাজও শান্তিতে করতে পারি না। এই আমলে কেউ গামছা ছাড়া কি করে বাড়ি থেকে বের হয় আমার বুঝে আসে না। গামছা হচ্ছে এমন একটা জিনিস, যেটাকে কোথায় যাওয়ার সময় নিজের থেকেও বেশি গুরুত্ব দিয়ে গুছাতে হয়।

দিলারা সামান্য রেগে গিয়ে বললেন
“এতো কথা কেন বলছিস, যেটা করতে বলেছি সেটা কর।
এরপর উনি সাদের দিকে তাকিয়ে বললেন
“এর কথায় কিছু মনে করো না বাবা, এর মাথায় সমস্যা আছে। এমনিতে তো ভালোই থাকে, মাঝে মাঝে মাথায় কি উঠে কে যানে।।
সাদ হেসে বললেন
“আমি কিছু মনে করিনি আন্টি, আসলে পাগলীদের আমার ভালোই লাগে।
আশা রাগী চোখে তাকালো সাদের দিকে।। চাপা আক্রোশ নিয়ে বললো
“আসুন আমার সাথে। আপনাকে গামছা দিয়ে আমি ধন্য হই।

আশা দ্রুতপায়ে নিজের ঘরের কাছে গেলো। সাদ পেছন পেছন আসছে। আশাকে রুমে ঢুকতে দেখে সাদ বললো
“আমার রুমে কেন ঢুকছো কিউটি?
“ওটা আমার ঘর। দাঁতে দাঁত চেপে বললো আশা।
সাদ হেসে বললো
“অতীতে তোমার ছিলো, কিন্তু বর্তমানে তো আমার।
” ভবিষ্যতে আবারও আমারই হবে।
“সে দেখা যাবে ক্ষন। এবার আমায় গামছা দাও।
“আপনি গামছা আনেন নি কেন?
“তোমার গামছা ব্যবহার করবো তাই।
“আমার বয়েই গেছে আমার গামছা আপনাকে দেওয়ার জন্য।

আশা ওয়ারড্রবের ড্রয়ার খুলে সেখান থেকে একটা নতুন তোয়ালে বের করে সাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো
“নিন, আমায় উদ্ধার করুন।
সাদ তোয়ালেটা হাতে নিয়ে বললো
“এটা তে হবে না।
“কেন?
“এতে তোমার গায়ের ঘ্রাণ লেগে নেই। তোমার ব্যবহার করা গামছাটা দাও।
আশা এবার সামান্য লজ্জা পেলো। এই মুহূর্তে মনে হলো দৌড়ে পালিয়ে যাক এখান থেকে। পরক্ষণেই নিজেকে স্বাভাবিক করলো সে। বুঝতে দেওয়া যাবে না সে লজ্জা পাচ্ছে, তাতে আরও বেশি পেয়ে বসবে দুষ্টুটা।।
সে সামান্য রাগ দেখানোর ভঙ্গি করে বললো
“আমি কোনো গামছা ব্যবহার করি না।
“তুমি কি আমার উপর রেগে আছো কিউটি? এভাবে কেন কথা বলছো?
আশার হাসি পেলো এবার। সে সত্যিই সামান্য রেগে রেগে কথা বলছে, কিন্তু মন থেকে সে রেগে নেই। শুধুমাত্র রাগ দেখানোর অভিনয় করছে যাতে সাদ উল্টোপাল্টা কিছু না বলে। সামনে আসলেই এমন এমন কথা বলা শুরু করে দেয় লোকটা যে নিজেকে সামলানো দায় হয়ে পরে।

আশা হাসিটাকে রাগের আড়ালে লুকিয়ে বললো
“রেগে যাওয়াটা আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি, তাই রেগে যেতেই পারি।
“রাগ তোমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হলে তুমিও আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি, তাই আমার সাথে রাগ দেখানো চলবেনা। এবার গামছা বের করো তোমার।
আশা বড় বড় চোখ করে বললো
“আমি আপনার ব্যক্তিগত সম্পত্তি?
“অবশ্যই?
“কবে থেকে?
“যবে থেকে আমি তোমায় ভালোবাসি।
“আমিতো বাসিনা।
“সেটা আমি পরে বুঝবো, এবার গামছাটা দাও না ভাই… গোসল করবো তো।
আশা একমত বাধ্য হয়ে নিজের ব্যবহার করা গামছাটা সাদের হাতে তুলে দিলো। সাদ মুচকি হেসে ওটা হাতে নিয়ে বললো
“এবার ঠিক আছে, চলো।
আশা বিস্ময় নিয়ে বললো
“চলো মানে, কোথায় যাবো?
“গোসল করবো, এসো আমার সাথে।
আশা বিস্ময়ের উপর বিস্ময় হতে থাকলো। এ ছেলে কি পাগল হয়ে গেছে? কি বলে যাচ্ছে এইসব?
আশা আবারও বললো
“আপনি কি পাগল হইছেন?
“এমন কেন বলছো কিউটি?
“আপনি গোসল করবেন, আমি এসে কি করবো?
“তুমি বসে থাকবে কিউটি, আমার ভালো লাগবে। একা একা যেতে ভালো লাগছেনা।
“আমি আপনার সাথে গোসলখানার ভিতরে ঢুকবো? আতংকিত গলায় বললো আশা।

সাদ এবার হু হু করে হাসতে লাগলো। আশা অবাক হয়ে বললো
“আবার হাসছেন কেন?
“তোমার কি সেন্স কিউটি, সেটা ভেবেই আমি হাসছি।
“আমি আবার কি করলাম? ঠোঁট জোড়া বাকিয়ে বললো আশা।
“তোমার কি মনে হয়, আমি বলবো তুমি আমার সাথে বাথরুমে আসো?
“বললেনই তো। নিচু গলায় বললো আশা।
সাদ আবারও হেসে বললো
“আমি পুকুরে গোসল করবো কিউটি।
আশা অবাক হয়ে বললো
“কিহ!
“এতো অবাক কেন হচ্ছো?
আশা এবার জোর গলায় বললো
“জীবনে কোনো দিন পুকুরে নেমে দেখছেন?
“নামিনি বলেই তো নামবো।
“সাঁতার জানেন?
“শেখা হয়নি।
“তাহলে পুকুরে গোসলের কথা ভুলে যান। আমাদের এ পুকুরের গভীরতা অনেক।
সাদ হেসে বললো
“তুমি তো সাঁতার জানো, আমার কিছু হলে নাহয় তুমিই আমায় বাঁচিয়ো।
“এত আহ্লাদীপনার কোনো দরকার নেই। বাথরুমে গিয়ে গোসল করেন।।

সাদ এবার হেসে বললো
“আমি পুকুরে নামিনি ঠিকই, তবে রেগুলার সুইমিংপুলে নামা হয়, তাই সাঁতারটা ঠিকই জানি। তাই আমাকে নিয়ে এত ভয় পাওয়ার কোনো দরকার নেই কিউটি। তুমি শুধু এসে পাড়ে বসে থাকো, আমার তাতেই চলবে।
“একা একা ভয় পান? চোখমুখ বাকিয়ে বললো আশা। সাদ আশার চোখ বরাবর ঝুকে বললো
“প্রচুর ভয় পাই।
“তাহলে আমি ভাইয়াকে পাঠাচ্ছি। কথাটা বলেই আশা উল্টোদিকে হাঁটা দেয়। ঠিক সেই মুহূর্তে আশার হাত খপ করে ধরে নিজের দিকে টান দেয় সাদ। টাল সামলাতে না পেরে আশা হুমরি খেয়ে পরে সাদের বুকে।

শ্বাস প্রশ্বাস প্রচুর উঠানামা করছে, চোখমুখ খিচে এক হয়ে গেছে। নিজ যায়গায় জমে আছে আশা। এ মুহূর্তে ঠিক কি হচ্ছে সবটা তার ধারণারও বাইরে। সাদ মুক্তোঝরানো দাঁতে বুকে আগুন ধরানো হাসি হেসে বললো
“কিউটি?
আশা এখনো সাদের বুকে।। সেখানে থেকেই আশা বললো
“হু?
“ভালো লাগছে?
আশার হুশ এলো। সে তৎক্ষনাৎ এক লাফে সাদের কাছ থেকে দূরে সরে গেলো। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে তার। এটা কি হয়ে গেলো? সাদ আবারও হেসে বললো
“এতেই এতো লজ্জা?
আশা সামান্য রেগে গিয়ে বললো
“অসভ্য একটা। আপনি থাকুন এখানে, ইচ্ছে হলে গোসল করুন, না হলে নাই।
আশা হনহন করে চলে গেলো সেখান থেকে। সাদের মুখের হাসি যেনো থামছেই না। নিশ্বব্দে কিছুক্ষণ হেসে একটা সময় সে থামে। ততক্ষণে আশা চোখের আড়ালে চলে গেছে। সাদ ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার সামনে দাঁড়ালো। এক পলক নিজের বুকের দিকে তাকালো সে। এটা সেই যায়গা যেখানে কিছুক্ষণ আগে তার ভালোবাসাটা ছিলো। সাদ তার হাত দিয়ে মৃদুভাবে স্পর্শ করলো, একটা অদ্ভুত অনুভূতি সে অনুভব করলো।

দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে সামান্য রেস্ট নিয়ে দোকানে যাবার জন্য তৈরি হলো আদিব। আজ সারাদিনে একবারও দোকানে যাওয়া হয়নি। এবার একটু যাওয়া দরকার। আদিব তখন বের হচ্ছিলো তখন সাদ বাইরের একটা চেয়ারে বসা ছিলো। আদিবকে বেরোতে দেখে সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে প্রশ্ন করলো
“কোথায় যাচ্ছেন ভাইয়া?
আদিব হাসিমুখে বললো
“একটু দোকান থেকে ঘুরে আসি। যাবে আমার সাথে?
সাদ হাসিমুখে বললো
“কেনো নয়?
একটা অটোতে করে দুজন গিয়ে পৌঁছে আদিবের দোকান বরাবর। ভাড়া মিটিয়ে দোকানের সামনে গিয়ে শাটারটা তুলে নেয় সে। এরপর সাদকে একটা টুল দিয়ে সেটাতে বসতে বলে দোকানটা ঝাড় দেওয়ায় লেগে পরে আদিব।।
সাদ হেসে বলে
“এই প্রথম দোকান খোলার মুহূর্তটা আমি নিজ চোখে দেখছি। অনুভূতি টা দারুণ। এখানে না এলে এত ভালো অনুভূতি কখনোই অনুভব করতে পারলাম না।

আদিব হাসলো, বললো
“সত্যিই তাই। এটা আমার জীবনের সাথে মিশে গেছে। এখানে না এলে ভালই লাগে না।
আদিব সবকিছু গোছগাছ করে একটা টুল নিয়ে সাদের মুখোমুখি বসলো। মুচকি হেসে বললো
“কোক খাবে? কোক আনি?
সাদ হাসিমুখে বললো
“এখন না, বাড়ি ফিরে যাবার সময় খেতে খেতে যাবো।
আদিব হাসলো। কয়েক সেকেন্ড পর সে বললো
“হঠাৎ করেই চলে এলে এখানে? কানাডা থেকে কবে ফিরলে? আর আমার নাম্বারটাই বা জানলে কি করে? এত ব্যস্ততার মাঝে ছিলাম, তাই জিজ্ঞাসা করা হয় নি। কিন্তু আমার বিষয়গুলো জানতে বেশ ইচ্ছে করছে।। প্রশ্নগুলো বার বার মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে।

সাদ হাসলো। বললো
“ইচ্ছেগুলো অপূর্ণ রাখতে নেই। আমি নিশ্চয়ই বলবো আপনার প্রশ্নের উত্তর গুলো।

চলবে…..