সর্বনাশিনী পর্ব-১৪

0
485

#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১৪।

দিলশাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো বিন্দুর অগোচরে।

” মা স্নেহা নেই।”

বিন্দু চোখে মুখে দুঃখজনক আর অনুশোচনার ভাব। চোখ টলমল করে বলল,

” কোথায়… কোথায় সে?”

দিলশাদ মায়ের পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালো। কয়েক কদম হেটে এলো খোলা জানালাটার পাশে। স্ব স্ব মিষ্টি বাতাস শরীরের লোমকূপে স্পর্শ করে হারিয়ে যাচ্ছে আবারো শূন্যে। বাহিরের টিমটিম লাল হলদে আভা জলছে। হসপিটালের সামনেই বড় মাঠ আর তার পাশেই দুটি কয়েক দাঁড়িয়ে থাকা বড গাছ উঁকি দিচ্ছে। বডগাছে ডাল পালার মাঝে বসে আছে জোড়ায় জোড়ায় কিছু সংখ্যাক পাখি। দিলশাদ মনযোগ সহকারে দু’টি পাখির দিকে তাকিয়ে রইলো। নিরবচ্ছিন্ন রাতের আঁধারে দুটি পাখির ভালোবাসার অন্তরঙ্গ কিছু মুহূর্ত বুক কাঁপিয়ে তুললো দিলশাদের। হঠাৎ অনুভব করলো চোখ দুটি তার জ্বলছে। দিলশাদ চোখ বুঝে ফেললো। ঝড়ো হাওয়ার মতো আরো একবার গায়ে আছড়ে পড়লো হিমশীতল বাতাস। ভেসে উঠলো চোখের পাতায় ছোট একটি বাচ্চা মেয়ের অসহায়ত্ব মুখ। যার বড় বড় দুটি চোখ দিয়ে দিলশাদকে দেখেছিলো প্রথম। আপেলের মতো দুটো লাল গালে হাত রেখে বিদায় জানিয়েছিলো যেদিনে। মাঝে মাঝে হুট করে বয়ে আনা কিছু খেলনা, খাবার, চিপস, চকলেট। সব কিছু মনে পড়লো দিলশাদের। স্নেহার ছোট পুতুলটি? তা তো….. এখনো পড়ে আছে দিলশাদের পুরোনো আলমিরাতে। দিলশাদ চোখ খুললো। ঠান্ডা কন্ঠ হলেও, কেমন যেন হেরে যাওয়া মানুষ বা তার সব নিঃস্ব। এমন ভাবে বলল,

” মা, এমনটা কেনো হয়? আমরা যাকে চাই তাকে কখনো পাই না, আর যাকে পাই তাকে মূল্য দিতে জানি না!”

বিন্দু হয়তো ছেলের কষ্টটা উপলব্ধি করতে পেরেছে,

” এইটাই নিয়ম বাবা। আমরা প্রতিটি মানুষ যদি, যা পেতাম তাতেই সন্তুষ্ট হতাম, তাহলে আর কোনো কিছুর চাহিদা আমাদের থাকতো না। ভেদাভেদ থাকতো না হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার থাকতো না। অনুসূচনা, অনুতাপ থাকতো না। ”

দিলশাদ এবার ঘুরে দাঁড়ালো বিন্দুর দিকে। চোখ দুটি অফুরন্ত লাল হয়ে গেছে, এই বুঝি টুপ করে রক্তের ফোঁটা ছলকে পড়বে। দিশাদের ফ্যাকাশে ঠান্ডা মুখ আর লাল চোখ দেখে বিন্দু ঘাবড়ে গেলো।আতঙ্কিত কন্ঠে বিচলিত হয়ে বলল,

” দিলশাদ কি হয়েছে? বাচ্চা! এদিকে আয়? দিলশাদ আমাকে খুলে বল সব, ভয় হচ্ছে খুব আমার!”

দিলশাদ কাছে গেলো না । নিস্প্রভ চাহনিতে চেয়ে রইলো মায়ের দিকে। বলল,

” মা, স্নেহা আমাদের থেকে অনেক দূরে চলে গেছে, অনেক দূরে। সে আর এই দুনিয়ার মানুষ নই না।”

বিন্দু পরক্ষণেই স্তব্ধ হয়ে গেলো। হয়তো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে খুব। ঠিক কিছুক্ষণ পর যখন ঠাহর হলো। বিন্দু মুখে হাত গুঁজে কাঁদতে লাগলো। দগ্ধ হতে লাগলো ভিতরে ভিতরে। অপরাধবোধ টুকু ভিতরে ভিতরে কুঁকড় খেতে লাগলো। বুকে চেপে ঘন ঘন শ্বাস, আর নাক টেনে বলতে লাগলো,

“, এ-কি হয়ে গেলো, আমার স্নেহা?”

দিলশাদ আবারো জানালার দিকে ঘুরে গেলো। হয়তো নিজের চোখের জল লুকাতে, নয়তো মনের কষ্ট।

——————-

” আকৃতা মা, তোমার পায়ে পড়ি, আমার মেয়ে কোথায় আছে বলে দাও!”

আকৃতা চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ ফুঁটে উঠলো। তালুকদার বংশের এই দুজনের নর-নারীর উপর। বলল,

” মিঃ এন্ড মিসেস তালুকদার, আমি কতবার বলবো? আপনার মেয়ের খবর আমি জানি না।”

সায়রা তালুকদার আচলে মুখ লুকালেন কাঁদতে কাঁদতে,

” আজ কতদিন দেখি না মেয়েটাকে কেমন আছে, কোথায় আছে, কি করছে!”

স্নেহার মনচাইলো জোড়ে জোড়ে হাসার জন্য। কিন্তু সামলে নিলো। বলল,

” শুনেছি, আপনার মেয়ে নাকি হুটহাট গায়েব হয়ে আবার ফিরে আসার রেকর্ড আছে? চিন্তা কেন করছেন? হয়তো নতুন কোনো বয়ফ্রেন্ডের সাথে সময় কাটাচ্ছে? ”

মাথা হেড করে ফেললো তারা। স্নেহা পথ কাঁটিয়ে চলে যেতে নিয়ে পিছনে ফিরে চাইলো। তার নতুন জম্মের পর তারুনের পরিবার অফুরন্ত ভালোবাসা তাকে দিয়েছে। অথচ পুরোনো জীবনে এই ব্যক্তি দুটো ব্যবহার করেছে স্নেহাকে। স্নেহা আবারো জগিং শুরু করলো। পিছনে ফেলে গেলো পুরোনো অতীত।

————-

দিনের মধ্যে ভাগ। দিলশাদের সামনে আবারো চেনা পরিচিত দুটি মুখ বসে আছেন। দিলশাদ তার ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে আরেক পলক সামনে তাকালো। বলল,

” আঙ্কেল আন্টি, আমি এবার শুধু এই জন্য সাহায্য করছি, কারণ আপনি স্নেহাকে লালন-পালন করেছেন তাই। তা না হলে, এই অফিসে ঢোকার মতো সাহস পেতেন না।”

সায়রা তালুকদার দিলশাদকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় হলো। দিলশাদ কাউকে কল করলো,

” তোমাকে কিছুদিন আগে কাউকে খোঁজার দায়িত্ব দিয়েছিলাম!”

অপাশ থেকে কথা আর শোনা গেলো না। দিলশাদ বলল,

” আমি কালকের খবরটা চাই!”

বলেই ফোন কেঁটে দিলো। এবং নিজের কাজে আবারো ব্যস্ত করে নিলো নিজেকে।

————–

স্নেহা আজ শপিং মলে এসে। ইচ্ছে করে নয়, অনেকটা জোড় করে মাহাদ তাকে নিয়ে এসেছে, একটা নামি দামি বড় একটি শপিংমলে। মাহাদ বলল,

” বিউটিফুল ট্রাই দিস!”

স্নেহা অবাক হয়ে তাকালো। পিঠ খোলো আর সাসনের সাইডে বড় গলা ইনফেক্ট যে কোনো মেয়ের বুকের খাঁজ এই ড্রেসে দৃশ্যমান হবে। স্নেহা নাক ছিটকে বললো,

” আমি এসব পড়বো না।”

মাহাদ চোখ রাঙ্গালো। স্নেহার কাঁধে শক্ত করে হাত রেখে বলল,

” বিউটিফুল, আমার না শোনা পছন্দ নয়। ভুলে যেও না তুমি আর আমি খুব শীঘ্রই একই বাঁধনে বাধতে যাচ্ছি। ”

স্নেহা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

” হবো, হইনি। এখনো অধিকারটা আপনাকে দি নি!”

স্নেহার কাঁধের উপর হাতটি মাহাদের শক্ত হলো,

” তুমি কি চাইছো, আন্টিকে আমি কল করি?”

রাঙ্গানিত কন্ঠে বললো মাহাদ। স্নেহা অসহায়ের মতো চাইলো। এই ছেলেটি তার জীবন হেল করে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে ছেড়ে দে ভাই কাইন্দা বাঁচি। এদিকে বিয়ে বিয়ে করে মাথা নষ্ট করে ফেলছে তারুনের মা।কি করবে এমন অবস্থা? কবে যে তারুন আসবে তারুন? স্নেহা সুপ্তপর্ণে শ্বাস লুকালো। হাতের ড্রেসটি টেনে নিয়ে চলে গেলো ট্রায়াল রুমে।মাহাদের দেয়া সাদা রঙের খুব সুন্দর একটি গ্রাউন পড়ে নিলো স্নেহা। আয়নায় নিজেকে দেখে কিছুটা থমকে গেলো। ওয়েস্টার্ন গাউনে অনেক সুন্দর লাগচ্ছে তাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে দরজা খুলে গেলো। এক ঝটকায় পিছনে ফিরতেই ভেসে উঠলো একটি মুখ। যার আগমনে লোকটির পিছনে সব আলো লুকিয়ে পড়লো। শুধু জ্বলজ্বল করতে লাগলো স্নেহার মুখমন্ডল । ধীরে পায়ে এগিয়ে এলো সে। খুব কাছে, খুব কাছে, এতটাই কাছে যেন স্নেহার দ্রুত গতিতে চলা হার্টবিট সাসনের লোকটি অনায়াসে শুন্তে পারছে। স্নেহা কাঁচের আয়নার সাথে লেগে গেছে। লোকটা তার এতো কাছে? স্নেহার হুট করেই সেদিনের রাতের কথা গুলো মনে পড়তে লাগলো এক এক করে। শরীরে তখন নতুন এক অদ্ভুত অনুভূতির দোল খেলা। স্নেহা ঘেমে, নেয়ে একাকার। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। লোকটি নিশ্বাস পড়ছে স্নেহার চোখে মুখে আর ঠোঁটে। স্নেহা বিড়বিড় করে বলল,

” দিল… দিলশাদ!”

চলবে,,