#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১৭।
” লুবান? তুমি কি সত্যি মেরেছো এলেক্সকে?”
লুবান ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। ছোট বাচ্চাটি ঠিক যেন দিলশাদের মতো হয়েছে। খাঁড়া নাক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, চুল, গায়ের রং এমন কি চোখ জোড়াও। একদম গম্ভীর আর ঠান্ডা স্বভাবের। ওর বয়সের বাচ্চারা যেখানে ছুটোছুটি, হৈ-হুল্লোর করে? সেখানে লুবানের চারিদিক যেন একদম স্তব্ধ। ছেলেটি নিজের মাঝেই ঢুবে থাকে। সারা দিন বই আর নানান রকম ডিভাইস নিয়েই তার দিন পার হয় । এই নিয়ে তেরোবার কমপ্লিন এসেছে লুবানের নামে। কিন্তু বরাবরের মতোই স্নেহা হতাশার শ্বাস ছাড়লো। বিড়বিড় করে বলল,
” ছেলেটি আমার, তার বাপকেও ছাড়িয়ে গেছে।”
স্নেহা নিজের সাথে কথা বলতে বলতেই লুবানের প্রিন্সিপাল স্যারের রুম নক করলো,
” মে আয় কামিং?”
প্রিন্সিপাল স্যার আধ বয়সি। স্নেহাকে দেখে খুশিতে গদগদ হলেন ।এই লাল টুকটুকে দেশি মেমকে উনি খুবই পছন্দ করেন। বললেন,
” আরে আসুন আসুন!”
স্নেহাকে এভাবে আপ্যায়নে ব্যস্ত দেখে, পাশেই দাঁড়ানো এলেক্সের মমি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন,
” মিঃ স্মীথ। আপনি আজ এর একটা বিহিত করবেনি!”
স্মীথ গলা ঝাড়লেন। স্নেহার পাশেই নির্ভয়ে লুবানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি নিজেই বিষম খেলেন। এতটুকু বাচ্চা , অথচ ওর সিনিয়াররা পর্যন্ত বাচ্চাটিকে ভয় পায়। অথচ এই পাঁচ বছরের বাচ্চাটি সব সময় থাকে গম্ভীর। আর এদিকে মার খেয়ে এলেক্স মায়ের পিছনে লুকিয়ে আছে। যেন কিছু চুরি করেছে। স্নেহা হাসার চেস্টা করে বলল,
” এলেক্স! সান? লুবান হিটস ইউ?”
এলেক্সের মাথা ফেটে গেছে, বেন্ডেজ করা। বোঝাই যাচ্ছে চোট ভালোই পেয়েছে। এলেক্স মাথা ‘হ্যাঁ ‘ বোধক নাড়লো। তারপর আবার লুবানের দিক তাকিয়ে ‘না’ বোধক মাথা নাড়লো। এলেক্সের কান্ডে উপস্থিত সবাই দ্বিধায় পড়ে গেলো। বরাবরই এমন হয়, কোনো বাচ্চাই লুবানের নামে বিচার দিতে সাহস করে না। কিন্তু কেন? তা কেউ বুঝতে পারেনা। স্নেহা নির্ভয় দিলো। আবারো এলেক্সকে জিগ্যেস করতেই, একই উত্তর পেয়ে সকলেই হতাশা হলো। বিরক্ত হলো লুবান নিজেই। এলেক্সের সামনে এসে দাঁড়িয়ে কাটখোট্টা ভাবে বলল,
” এলেক্স? স্যারকে সত্যি কথা বল, আমি কি তোকে মেরেছি?”
লুবানের কথা বাকি সবার কাছে নরমাল শোনালেও, এলেক্স যেন বুঝে গেছে, এরপর কঁপালে শনি আছে। সঙ্গে সঙ্গে মাথা দুলিয়ে বলল,
” সরি স্যার, এলেক্স আমায় মারেনি। আমি মিথ্যে বলেছি।”
এবার চমকানোর পালা যেন মি. স্মীথের। প্রিন্সিপাল স্যারের রুম থেকে বেড়িয়ে তারা সোজা গাড়িতে উঠে। স্নেহা গাড়ি চালাতে চালাতে প্রশ্ন করে লুবানকে,
” লুবান? স্পীক দ্যা ট্রুথ! ”
মায়ের থমথমে মুখের কন্ঠে শুনেও লুবান মুখ খুললো না। স্নেহা এবার রেগে গিয়েই বলল,
” লুবান? আমি কিন্তু খুব ডিসা পয়েন্টেড। তুমি দেখছো এলেক্সের হালটি? মাথা ফেটে গেছে, যদি কিছু হতো তখন?”
লুবান এবার মুখ খুললো,
” বেশ করেছি মেরেছি!”
“লুবান?”
স্নেহা থমকে গেলো যেন। সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কসলো। লুবানের দিকে তাকাতেই, দেখতে পেলো, বাচ্চাটি কাঁদছে। স্নেহা মাথা হাত বুলিয়ে দিতেই লুবান মিনমিন করে বলল,
” যারা আমাকে বলবে, আমি পাপা ছাড়া সন্তান, আমার পাপা নেই, আমার পাপা আমাকে ভালোবাসে না, তাদের সবাইকে মারবো আমি।”
স্নেহার বুকে মোচড় দিয়ে উঠে। ছেলেটি ঠোঁট ভেঙ্গে কাঁদছে। স্নেহা বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। জানতো ভবিষ্যতে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন সে হবে। কিন্তু এত জলদি? তা ভাবা ছিলো না। স্নেহা লুবানকে আদুরে কন্ঠে বলল,
“, লুবান, ডোন্ট ক্রাই। তোমার পাপা তোমাকে অনেক ভালোবাসে, অনেক!
লুবান আকুতি ভরা দৃষ্টিতে তাকায় বলে,
” কবে আসবে মমি?”
স্নেহা এর উত্তর দিতেনপারে না। বুকের ভিতর শুধু শক্ত করে ছেলেকে জড়িয়ে রাখে। ভেবে পায় না স্নেহা, কখনো সত্যি দিলশাদ যদি বুঝতে পারে তার একটি সন্তান আছে? তাহলে? তাহলে কি হবে? কেড়ে নিবে নাতো, লুবানকে? নাহ্। স্নেহা লুবানকে এভাবেই বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখবে। স্নেহার জীবনের এক মাত্র বাঁচার পন্থা এই ছেলেটিই তো!
—————
বাংলাদেশ সময়ে ঘড়ির কাঁটা ১২ টা ছুঁই ছুঁই। একটি ছোট পুতুল যেন আরেকটি পুতুল নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বসে আছে ডিভানে। বড় বড় চুলে তার পোনিটেল করা। গায়ের রঙের সাথে গোলাপি জামাটা অদ্ভুত ভাবে মানিয়ে গেছে। বড় বড় চোখ দিয়ে বার বার ঘড়ি আর দরজায় নজর দিচ্ছে। তার পাশেই বসা বেবি সিটার হাই তুলছে এই মুহুর্তে তিনবার। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটি তার পাপাকে না দেখে নাকি কিছুতেই ঘুমাবে না।
” লিলিয়ান কাম বেবি?”
দিলশাদ তার পাঁচ বছরের ছোট মেয়েটিকে কাছে ডাকলো। এতক্ষণে বাবাকে পেয়ে বাচ্চা মেয়েটি লাফিয়ে উঠে কাছে চলে গেলো। আবারো মুখ গুমরো করে নিলো। বলল,
” পাপা আই মিস ইউ!”
দিলশাদ হাসলো। বলল,
” এই সেন্টেন্সটি কে শিখালো?”
লিলিয়ান গর্বের সাথে নিজের ছোট ছোট হাত গুলো বাবার গালে স্পর্শে করে বলল,
” আমি, আমিতো টিভিতে দেখেছি। সেখানে একটি বাচ্চা ছেলে তার পাপা আর মমিকে বলছে এইটা!”
পরক্ষণেই আবার মন খারাপ করে মিনমিন করে বলল,,
” আমার তো মমি নেই, তাই শুধু পাপাকে বলেছি!”
দিলশাদের হাসি মুখে, মেদুর ছায়া। বাচ্চা মেয়েটির বড্ড মায়ের অভাব তা বুঝতে পেরেও কিছু করার নেই দিলশাদের। যাকে তাকে তো আর তার মা বানিয়েনদিতে পারে না? দিলশাদ লিলিয়ানের গালে চুমু এঁকে দিলো। ঠোঁটের কোনে হাসি আবারো জোর পূর্বক টেনে বলল,
” পাপা অলওয়েজ মিস ইউ লিলি।”
লিলিয়ান এবার বাবার দিকে তাকালো । বারবি ডলের মতো চোখ জোড়া লাল হয়ে গেছে মেয়েটির। ঠোঁট ভেঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
” পাপা, মমি আমাকে মিস করে না, তাই না? তাই তো সে আসে না সবার মমির মতো!”
দিলশাদ এর উত্তর কি দিবে ভেবে পেলো না। মেয়ের কান্না থামাবার জন্য চেষ্টা করতে লাগলো শুধু। জানালার বাহিরের চোখ মেলে রাতের আকাশের দিকে। তারপর? বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো দিলশাদের……।
———–
সময় পরিবর্তন হতে থাকলো দুটি মানুষের দিলশাদ তার লিলিয়ান আর স্নেহা তার লুবানকে নিয়ে সুখে দিন কাঁটালেও, এদের জীবন গুলো আজো অসম্পূর্ণ রয়েই গেছে। এদের কি আবার ভাগ্য একসাথে করবে? এটাই যে দেখার পালা এবার। স্নেহা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। লুবান ঘুমিয়ে। ঘুমের মাঝে তার পাপা চাই। স্নেহার এই পাঁচটি বছর কিভাবে পাড় করেছে স্নেহা নিজেই জানে। ওর পাশে যদি শেখ পরিবার না থাকতো? এই সিচুয়েশনে ভেঙে পড়তো স্নেহা। অন্য দিকে দিলশাদ-ও ধোঁয়া উঠা কফি নিয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের মাঝে আজ চাঁদ নেই। আঁধার। টিমটিম করা তারার আলো-ও দূর করতে পারছেনা যেন এই আঁধার। ঠিক যেন দিলশাদের বুকের ভিতরটার মতো। হয়তো এই আঁধারেই সে হারিয়ে যেত। যদি তার কাছে লিলিয়ান না থাকতো। হ্যাঁ লিলিয়ান, স্নেহার অংশ। বাচ্চা মেয়েটি একেবারে তার মায়ের মতো হয়েছে। স্নেহার মতো। ছোট বেলায় স্নেহা দেখতে ঠিক যেন এমনি ছিলো। দিলশাদ পিছনে ফিরে নিজের মেয়েকে একবার দেখে নিলো। মেয়েটির তার মমি চায়, কিন্তু দিলাদ তা কিভাবে দিবে? সে নিজেও তো চায় স্নেহাকে, আবার আসুক তার জীবন, যে ভুল গুলো করেছিলো? সব দূর করে নতুন করে বাঁচতে চায় দিলশাদ। দিলশাদ খোলা আকাশের দিকে তাকালো। বলল,
” স্নেহা প্লিজ কাম ব্যাক! প্লিজ?”
দিলশাদের কন্ঠ ধরে এলো যেন। এদিকে মাঝ রাতেই স্নেহার ফোনে ফোন এলো। ফোন তুলতেই তারুনের কন্ঠ ভেসে এলো,
” ভাই?”
তারুন বলল,
” স্নেহা? মা হঠাৎ করেই অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হাসপাতালে আছে। আর তার দ্বিতীয় মেয়েকে দেখতে চায়ছে।”
স্নেহা বিচলিত হয়ে উঠলো,
” ভাই, কিভাবে কি হলো? এখন কেমন আছে?”
ওপাশ থেকে শুধু একটি বাক্য ভেসে আসলো,
” ভালো নেই, আই টিকেট কেটে দিয়েছি, জলদি এসো!”
ফোন কেঁটে গেলো। যেই মানুষ গুলোকে ছেড়ে চলে এসেছে, তাদের সাথে আবারো দেখা হবে। আচ্ছা দিলশাদ কেমন আছে? সে কি ভুলে গেছে তাকে? খবরে দেখেছিলো তার নাকি একটি বাচ্চা আছে। তাহলে হয়তো সে বিয়েও করেছে। স্নেহাকে কি তাহলে দিলশাদ সত্যি ভুলে গেছে!!!
চলবে,