#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
#পর্ব-২১
তীক্ষ্ণ মাথার ব্যথায় কুকিয়ে উঠলো স্নেহা..! হাতের বাঁধন শক্ত করে বাঁধা। দুই ঠোঁটের মাঝ খানেও কাপড় দিয়ে আঁটানো। স্নেহা অন্ধকার ভয়ে কুঁকড়ে উঠছে। কথা বলার হাজার চেষ্টা করেও গোঙ্গানির মতো শব্দ হচ্ছে। স্নেহা ফুপিয়ে উঠলো। আজ তিন দিন যাবত পড়ে আছে অন্ধকার ঘরটিতে। এখন পর্যন্ত কেউই আসেনি এই ঘরটিতে । ক্ষুদায় তৃষ্ণায় স্নেহা আধমরা হয়ে যাচ্ছে । মনে করতে চাইলো কিছু দিন আগের কথা গুলো।
স্নেহা নিজের ছেলে-মেয়েদের কস্টাডি নিয়ার জন্য আজ কোর্টে ফাইল করতে যাবে। তা জানতে পেরে দিলশাদের মাথা আশি মন চালের বস্তা পড়লো যেন। তবুও সে তো কম যায় না? নিজের ছেলে-মেয়েদেরতো সে নিজেও চায়.. সাথে চায় তার বউকেও। দিলশাদ বাঁকা হাসলো। টাইম এসে গেছে দিলশাদের জলবা দেখাবার। তার পাওয়ার দেখাবার। দিলশাদ স্নেহাকে ফোন করলো,
” আর ইউ শিউর তুমি কেস ফাইল করছো!”
স্নেহা কনফিডেন্সের সাথে বলল,
” ইয়ে এন্ড ইউ নো হোয়াট? বাচ্চাদের আমি আমার কাছেই এনে রাখবো।”
দিলশাদ ফোনের অপর প্রান্ত হাসলো। এই জংলী বিল্লিটাকে এবার আর কোনো মতে হারাতে দিবে না। সে বলল,
” স্নেহা মন দিয়ে কেসে ফাইট করো। শুভ কামনা তোমার জন্য… বাট…! বাট তুমি হেরে গেলে তো ফেঁসে গেলে। কারণ আমি শুধু বাচ্চাদের নয়… বাচ্চার মাকেও চাই!”
ফোন কেঁটে দিলো দিলশাদ। ফোনের ওপাশে স্নেহা হতবুদ্ধি হয়ে রইলো। কি করতে চাইছে এই দিলশাদ? জিলাপির প্যাচ যত এই লোকটা ভিতরো। না জানি কোন গুঁজামিল মারে? তাহলে তো স্নেহাকে হারতে হবে? তা কখনো সম্ভব না.. একদম না। স্নেহা ঠিক করে ফেলেছে, যে কোনো মূল্যে সে জিতবেই। শুধু বাচ্চাদের নয়.. বিয়ে নামক জঞ্জাল থেকেও মুক্তি নিবে দিলশাদকে ডিভোর্স করে…দরকার পড়লে আবারো সর্বনাশিনীর রূপ ধারণ করবে স্নেহা..কেঁটে কুঁচি কুঁচি করে ফেলবে দিলশাদকে….তারপর.. তারপর.. গুম করে দিবে স্নেহা। স্নেহা শয়তানী হাসি দিলো.. হো হো হো…
“দেখার পালা এবার কে জিতে আর কে হারে..”
স্নেহা হাতের ছুঁড়ি দিয়ে জোড়ে আঘাত করলো একটি তরমুজের উপর…।
স্নেহা রাগে গজগজ করতে করতে রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়লো আদালতের জন্য সাথে ছিলো লিলিয়ান আর লুবনা। লিলিয়ানের বড্ড মন খারাপ। সে মাকে পেয়ে যতটা না খুশি হয়েছিলো? তার থেকে দুঃখ পাচ্ছে তার পাপা আর মমি আবারো আলাদা হয়ে যাবে বলে। সে তো দু’জন কেই চায়। তাই সে লুবানকে বলল,
” ভাইয়া? মমি কি সত্যি পাপার সাথে থাকবে না?”
লুবান বাবার মতোই গম্ভীর। কুচকুচে গভীর চোখ জোড়া নিয়ে দেখলো তার বোনটিকে। বোনটি ঠোঁট ফুলিয়েছে। যে কোনো মুহুর্তে কেঁদে ভাসাবে। লুবান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তার যে কষ্ট হচ্ছে না তা মোটেও না। তবে…! লুবান বলল,
” মমি যা ডিসিশান নিবে তা আমি সম্মান করবো। তার সাথেও থাকবো। যাতে মমি খুশি সেটাই সে করুক তাই চাই!”
লিলিয়ানের চোখ জোড়া মুহুর্তেই লাল হয়ে গেলো। যে কোনো মুহুর্তেই বুঝি কেঁদে গাঙ্গ ভাসাবে? লিলি তার ছোট পুতুলটিতে শক্ত করে ধরে মুখ লুকালো। লুবান বাহিরে তাকিয়ে রইলো। তার বুকের ভিতর-ও চলছে তোলপাড়। তবে সে কখনো তার মাকে জোর করবেনা। লুবান জানে যখন তারা বিদেশে থাকতো তখন স্কুলের ছেলে-মেয়েরা তার বাবা নেই বলে ক্ষেপাতে। যার জন্য লুবান তাদের ধরে কেলাতো।তখন খুব কষ্ট হলেও স্নেহা কিচ্ছু বলতো না। সে চাইতো না.. স্নেহা এসব শুনে কষ্ট পাক। লুবানের ছোখ জোড়াও এবার জ্বালা করতে লাগলো। আর যাই হোক সে-ও তো বাচ্চাই! বাবা-মার আদরের লোভ কে না চায়?
ঘন্টা খানেকের মাঝেই কোর্টের সামনে এসে থামলো স্নেহাদের গাড়িটি। স্নেহার বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করছে। একবার বলছে স্নেহা ভুল করছিস। আরেকবার বলছে স্নেহা একদম ঠিক করছিস স্নেহা দোনোমোনো নিয়ে পা বাড়ালো। ঠিক তখনি একজন উঁকিল এসে দাঁড়ালো। উনার নাম সিফাত। উনি বলল,
” জজ মেডাম ভিতরেই আছেন আসুন আমার সাথে।”
স্নেহা মাথা নাড়ালো। যাওয়ার আগে তার বাচ্চাদের একটি বেঞ্চে বসিয়ে রেখে গেলো। যাওয়ার সময় লিলিয়ান তার মায়ের জামার অংশ শক্ত করে চেপে ধরলো। স্নেহা হাঁটু গেড়ে মেয়ের সামনে বসে লিলিয়ানের চুলে হাত বুলালো। বলল,
” মমি এখুনি চলে আসবে বাচ্চা। লুবান বোনকে দেখে, আমি আসছি। ”
লুবান মাথা হ্যা বোধক নাড়লো। স্নেহা আবার যেতে নিতেই লিলি তার ধরে আঁটকে নিলো। কান্না মাখা মায়বী লাল চোখে কাতর কন্ঠে বললো,
” মমি! পাপা কি সত্যি আর থাকবে না আমাদের সাথে? আমি পাপাকে ছাড়া ঘুমাতে পারি না! আমি তোমার মতো পাপাকেও অনেক ভালোবাসি!”
স্নেহার বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। ছোট বাচ্চা মেয়েটির মন কি সত্যি ভেঙে দিবে স্নেহা? সে আবার লিলির সামনে বসলো। লিলির চোখ জোড়া মুছে দিয়ে বলল,
” নাহ্ লিলি! পাপা যখন চাইবে তার বাচ্চাদের সাথে দেখা করতে পারবে!”
লিলি আর কিছু বললো না বড় বড় চোখে জলের ফোয়ারা নিয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু। স্নেহা আরো কিছু বলতে চাইছিলো ঠিক সে সময় তার পিছন থেকে ডাক দিলো সিফাত,
” মেম চলুন দেড়ি হচ্ছে।”
স্নেহা আর সময় নষ্ট করলো না। ভিতরে চলে গেলো। এদিকে লিলিয়ান ফোপাঁতে লাগলো। লুবান লিলিকে থামাবার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। মেয়েটি থামছেই না। তাই লুবান বলল,
” লিলি আইসক্রিম খাবে?তুমি বসো আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি। ”
লিলিয়ান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। কাঁদতে লাগলো শুধু। লুবান আর সময় নষ্ট না করে বোনের কান্না থামাতে। লুবান যেতেই লিলিয়ানের কাছে হঠাৎ একটি খেলনার প্লেন উড়ে এসে স্নেহার পায়ের কাছে পড়লো। তারপর পরেই। একটি ১১/১২ বছরের ছেলে দৌঁড়ে এসে থামলো লিলির সামনে। প্লেনটি তুলে দাঁড়ালো ছেলেটি। ঠিক সামনেই পুতুলের মতো একটি মেয়েকে কাঁদতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। রূঢ় কন্ঠে বলল,
” এি মেয়ে কাঁদছো কেন?”
লিলিয়ান ছেলেটির দিকে চাইলো। তারপর আবার মাথা নত করে ফেললো। ছেলেটি হয়তো বুঝতে পেরেছে মেয়েটির মন হয়তো অনেক খারাপ। সে পাশে বসলো মেয়েটির। এবার কন্ঠ নরম করে বলল,
” জানো সুন্দর মেয়েদের কাঁদতে নেই। তোমাাে দেখতে একদম পঁচা লাগচ্ছে।”
লিলিয়ান কান্না বন্ধ করে দিলো। সে কখনোই চায় না তাকে দেখতে পঁচা লাগুক। তবে কান্নার দমক রয়েই গেছে তার। লিলিয়ান মিনমিন করে বলল,
” আমি মোটেও পঁচা দেখতে নই।”
ছেলেটি ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। বলল,
” তাহলে আর কেঁদো না। আর তুমি কাঁদছো কেন?”
লিলিয়ান আবারো ঠোঁট ভাঙ্গলো। বলল,
” আমার পাপা আর মমি আমাদের নিয়ে লড়ছে। আমি তো দু’জনকেই চাই। তারা আমাকে বুঝতেছেই না।”
ছেলেটি খুব মনোযোগ সহকারে শুনলো কথাটি। বলল,
” ঠিক আছে তোমার আব্বু আম্মু তোমার কাছেই থাকবে। তবে একটা শর্ত আছে!”
লিলিয়ান মাথা তুলে তাকালো। বলল,
” আমি আমার মমি-পাপার জন্য সব করতে চাই!”
ছেলেটি কুটিল হাসলো। লিলিয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” তুমি এখানেই বসো আমি আসচ্ছি।”
বলেই ছেলেটি আদালতের ভিতরে চলে গেলো। এদিকে… স্নেহা জজ্ মেডামের রুমে ঢুকতেই দিলশাদকে দেখে হতাশার শ্বাস ছাড়লো,
” আপনি এখানেও চলে এসেছেন?”
দিলশাদ ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
” বাচ্চা আর বউকে তো আমারো চাই?”
স্নেহা রাগে গজগজ করতে করতে দিলশাদের পাশেই বসে পড়লো। জজ মেডাম এখনো আসেনি। দিলশাদ তার ফোনে ব্যস্ত স্নেহা তার মনের চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত। এদের দুজনকে দেখে মনেই হচ্ছে না এরা একে অপরকে চিনে। বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা জজ মেডাম এদের কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলো। তার মনে হলো এদের দুজনের আলাদা হয়ে যাওয়াই উচিত। অথবা ছেলে-মেয়েদের মাই সামলাবে ভালো। মার কাছেই দিয়া উচিত। যা ভাবা তাই কাজ। জজ মেডাম দরজা ঠেলে ভিতরে জেতে নিলো। তখনি একটি পরিচিত কন্ঠ এসে বাড়ি খেলো তার কানে,,
” আমি আপনার কাছে কখনো কিছু চাই নি। আজ একটি জিনিস চাইতে এসেছি!”
জজ মেডাম থমকে গেলেন। বাচ্চা ছেলেটি আজ তার সাথে কথা বলছে? তা নিজ থেকে কিছু চাইছে সে আবার দিবে না?
ধীরে পায়ে এগিয়ে এসে হাটু মুড়ে জিজ্ঞেস করলো জজ মেডাম,
” বল কি চাই বাবা, তোর সব ইচ্ছে আমি পুরন করবো। ”
বাচ্চা ছেলেটি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। তা দেখে জজ মেডামের মনটা আহত হলো। তবুও চেয়ে রইলো ছেলের দিকে উত্তরের আসায়।
” ভিতরে যে আঙ্কেল আন্টি আছে, তাঁরা আমার বন্ধুর মা-বাবা। আমার বন্ধু কান্না করছে।আপনার কাছে আমার একটি চাওয়া তাদের এক করে দিন!”
জজ মেডাম হ্যা বোধক মাথা নাড়লো। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে নিবে তার আগেই ছেলেটি চলো গেলো। এক রাশ দুঃখ কষ্ট এসে জমা হলো জজ মেডামের মনে। কবে.. কবে যে সব ভুলে তার ছেলে তাকে মেনে নিবে! বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো সে। তারপর ভিতরে এসে দিলশাদ আর স্নেহাকে বলল,
” আমি আপনাদের দুজনের ফাইল স্টাডি করেছি। এবং আমার মনে হচ্ছে আপনাদের এক সাথে থাকা উচিত ছ’মাস।অতন্ত্য বাচ্চাদের কথা ভেবে এই ডিসিশনটা চিন্তা করে দেখেন। আদলত কিন্তু তাই চায়।”
দিলশাদ এমন কথা শুনে মনের কোনে ইচ্ছেরা জায়গা পেলো। ওদিকে স্নেহার মাথায় চিন্তার ভাজ। না চাইতেও তারা এই ডিসিশন মেনে বেড়িয়ে এলো।তখন দিলশাদ হেসে বলল,
” তো.. চলুন মেম নিজের বাড়ি?”
স্নেহা রাগে কিড়মিড় করে চাইলো। এদিকে লিলিয়ানের ঠোঁটের কোনে হাসি। ছেলেটি তখন বলল,
” মনে রেখো.. লিলি। তুমি আমার কাছে ঋণি। ”
বলেই ছেলেটি দৌড়ে চলে গেলো। লুবান ততক্ষণে বোনের জন্য আইসক্রিম নিয়ে ছুটে এলো। বোনের মুখে হাসি দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। বোনকে আইসক্রিম দিয়ে বলল,
” এটা তোমার জন্য লিলি!”
লিলি ঠোঁট বের করে হাসলো। দিলশাদ হেঁটে তাদের কাছে এসে বলল,
” আমার বাচ্চারা? চলো পাপার বাসায়?”
লুবান গম্ভীর মুখে বলল,
” মমিকে ছাড়া যাবো না!”
দিলশাদ লুবানের চুল গুছিয়ে দিয়ে বলল,
” মমিও যাচ্ছে আমাদের সাথে। আজ থেকে আমরা এক পরিবার।”
দূর থেকে স্নেহা তার বাচ্চা আর তাদের বাপকে দেখে ভাবলো। একটা সুযোগ তাদের সম্পর্ককে দেয়া উচিত। স্নেহা কাছে এসে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” তোমরা যাও, আমি পড়ে আসচ্ছি!”
দিলশাদ বলল,
” স্নেহা পড়ে কেনো, চলো এক সাথে যাই!”
স্নেহা বলল,
” আমার কিছু কাজ বাকি। আমি আসছি কিছুক্ষণ পর তোমরা যাও!”
দিলশাদ আর স্নেহা সাথে বেশি একটা পিড়াপিড়ি করলো না। যাচ্ছে তো তার বাড়িই নাকি? তখন দেখা যাবে কিভাবে তার কথা না শোনে। দিলশাদ মনে মনে ডেভেল মার্কা হাসি দিলো। তারা চলে যেতেই স্নেহা গাড়ির কাছে যেতেই হুট করে কেউ এসে তার মাথা পিছনে আঘাত করলো। স্নেহা নিস্তেজ হয়ে পড়লো । যখন চোখ খুললো, নিজেকে এক অপরিচিত জায়গায় আবিষ্কার করলো হাত পা বাঁধা অবস্থায়। স্নেহা কাতরাতে লাগলো। কিন্তু নিজেকে ছাড়াতে পাড়লো না। এভাবে তিনটে দিন কেঁটে গেলো। ঠিক চার দিন পর কেউ দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। আলো আঁধারের খেলার মাঝে চোখ ধাঁধিয়ে উঠলো স্নেহার। এতদিন পড়ে চোখেুখে আলো পড়তেই কেমন জানি লাগতে লাগলো স্নেহা। যখন চোখ দুটি আলো সয়ে যায়।তখন চোখ কচলাতে কচলাতে স্নেহা সামনের মানুণটির দিকে তাকালো। আলো ব্লক করে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে স্নেহা বাকরূদ্ধ হয়ে গেলো। ক্ষুদায়, তৃষ্ণা নিষ্প্রাণ কন্ঠে খুব কষ্টে বলল,
” আপনি! তার মানে এত দিন যা হয়েছে তার পিছনে শুধু আপনার হাত ছিলো?”
চলবে,