অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব-২৭+২৮

0
604

#অনুবদ্ধ আয়াস
#ইফা আমহৃদ
পর্ব:২৭+২৮

“আচ্ছা, এই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যা একটু রোমান্টিক হলে কোনো দোষ হবে জোনাকি? আজ বড্ড বেহায়া হতে ইচ্ছে করছে। কেন এমন হচ্ছে, একটু বলতে পারবে? আচ্ছা তোমার কী হচ্ছে না।”

বলেই মাথার উপর থেকে ছাতাটা সরিয়ে ফেললেন। লহমায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃষ্টি ধারা পতিত হলো মুখশ্রীর উপর। ঘনঘন পলক পড়ল চোখের। হিম ধারায় লোমকূপ দাঁড়িয়ে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। চটজলদি রৌধিকের ছাতা ধরা হাত স্পর্শ করলাম। অস্ফুট স্বরে বললাম,
“কী করছেন? ভিজে যাচ্ছি তো!”

“কী হয়েছে তাতে? একদিন একটু ভিজলে দোষের কী?”

“জামা কাপড়গুলো ভিজে যাচ্ছে যে, আন্টি রাগ করবে!”

পরক্ষণেই বলিষ্ঠ পুরুষালি হাতের সাহায্যে হাতে রক্ষিত জামা কাপড় গুলো কেড়ে নিলেন। অন্য হাতে মুঠোয় ছাতাটা গুঁজে দিলেন। অতঃপর জামা কাপড় নিয়ে ধাবিত হলেন। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। অপেক্ষায় মাশগুল।‌ পরক্ষণেই অন্তঃকরণে হানা দিল, তিনি নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। তখন তার সামনে হাঁটা সম্ভব হবে না। তাই ধীরে ধীরে হাঁটার প্রয়াস করলাম। তৎক্ষণাৎ রৌধিক জামা কাপড় রেখে উপস্থিত হলেন। হাত থেকে ছাতাটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন অদূরে। হাত ধরে ঘুড়াতে লাগলেন। দৃঢ়ভাবে মাটিতে বারবার পা করার নিমিত্তে ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠছি। তবুও হাসার চেষ্টা করছি। ধীরে ধীরে পায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই রক্ত দেখতে পেলাম। পানির সাথে বয়ে চলেছে। কী করা উচিত ভুলে গেলাম। যখন তখন রৌধিকের দৃষ্টি সেদিকটায় যেতে পারে। তখনই প্রশ্ন করবে। কী উত্তর দিবো আমি।

পড়নের ওড়নাটার সাহায্যে রৌধিকের মুখ ঢেকে দিলাম। পানি মুছতে মুছতে বললাম,

“চলুন না, অন্য একদিন ভিজব। শরীরটা ভালো লাগছে না।”

রৌধিক বিচলিত হলেন। ওড়নাটা সরিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ” কী হয়েছে জোনাকি? বলো আমাকে। প্লীজ বলো। শরীর খারাপ লাগছে।”

“চলুন না।”

“ঠিক আছে, চলো।”

আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। রৌধিক কিছুদূর গিয়ে ফিরে এলেন। ডানহাত ধরে কৌতূহলী স্বরে বললেন, “কী হয়েছে বলো তো। ভিজবে না বলছ, আবার যেতেও চাইছ না। ব্যাপার কী?”

“কোলে নিন না।” আদুরে আবদার।

ভ্রু কুঁচকালেন রৌধিক। রৌধিক তোয়াক্কা করলেন না। হাত ধরে টান দেওয়ার প্রয়াস করল। দু’পা ফেলতেই চোখ মুখ কুঁচকে গেল। সন্দিহান চোখে অবলোকন করলেন। হুট করেই নিচের দিকে চাইলেন তিনি। হাঁটু গেড়ে বসলেন। ডানপা হাঁটুর উপর তুলেন স্বযত্নে। স্পর্শ করলেন পায়ের পাতা। দাঁতে দাঁত চেপে ধরলাম। কেঁপে উঠলাম। কিয়ৎক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

“কী হয়েছে তোমার পায়ে? চুপ! মিথ্যা একদম বলবে না। বলতে ইচ্ছে করলে বলবে, নতুবা নয়।”

গম্ভীর কণ্ঠে শাসালেন। থমকে গেলাম আমি। তার কণ্ঠ অতিশয় সরল হলেও আমার সমীপে সরল লাগল না। মিনমিনে স্বরে বললাম,

“ও ওয়াশরুমে। ওয়াশরুমে পা স্লীপ করে পড়ে গেছিলাম। দেখতে পাই..

রৌধিকের শক্তপোক্ত হাতটা আমার গালে বিকট শব্দে বিচরণ করল। পুড়ে উঠল জায়গাটায়। তবে ব্যাথাটা তিক্ষ্ম হলো না। বৃষ্টির পানির নিমিত্তে শব্দ হলো একটু জোরে। থেমে গেল কথন। ঈষৎ ফাঁক হওয়া ওষ্ঠদ্বয় পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্নই রইল। সেকেন্ড খানেকের নিমিত্তে চোখের পলক থমকাল নিঃশ্বাস টানলাম। রৌধিক চোখ রাঙালেন। আমি মাথানত করলাম। বুকে হাত গুজলেন তিনি। ললাটে সরু ভাঁজ ফেলে ত্যাঘা গলায় বললেন,

“থামলে কেন? বলো। শুনি কত মিথ্যা বলতে পারো।
সাহস কী করে হয়, একবার বারণ করার সত্বেও মিথ্যা বলছ। এখন তোমার কাছ থেকে শিখতে হবে, ওয়াশরুমে পড়ে গেলে ব্যাথাটা কেমন হয়।”

পরবর্তীতে মিথ্যা বলার দুর্সাহস হলো না। ততক্ষণে বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছি উভয়েই। রৌধিক ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছু মুহূর্ত। অতঃপর কোলে তুলে নিলেন। একদম ড্রয়িং রুমে এসে থামলেন। মিতা আন্টি, মা আর ইয়ানাত উপস্থিত ছিল শুধু। আমাকে সোফায় বসিয়ে দিলেন। টি টেবিল টেনে পা রাখলেন উপরে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“তোমরা দেখে বলো তো, এটা কীভাবে হয়েছে? জোনাকি তো বলছে, ওয়াশরুমে পড়ে গিয়ে এমন হয়েছে। তোমাদেরও কী তাই মনে হচ্ছে?
স্লীপ করে পড়লে কালচে দাগ পড়বে, নতুবা ভেঙে যাবে। এমন খাদ খাদ কী হবে?”

রৌধিক নির্বিকার দৃষ্টিতে ইয়ানাতের দিকে চেয়ে বলেন। মিতা আন্টি বসলেন। পায়ের জখমে হাত বুলালেন। বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন। মুখ তুলে বললেন, “সূচালো কিছু ঢুকেছিল নিশ্চয়ই। লাইক সেফটিপিন, সূচ, আলপিন। তবে এত আঘাত কেন পাবে?
ইচ্ছে করে এমনটা কেউ করেছে।”

মিতা আন্টির বিচক্ষণতার দৃষ্টি আকর্ষণ করল ইয়ানাতের দিকে। আমাকে সহ্য করতে পারে না, এটা নতুন কিছু নয়। গম্ভীর গলায় বললেন,

“ইয়ানাত, এটা কী তুমি করেছ?”

“আমি কেন করব..

“স্টপ। হ্যাঁ অথবা না। আমি ঘুড়িয়ে পেঁচিয়ে কথা পছন্দ করি না।”

“সামান্য একটু ধাক্কার লাগার কারণে ইয়ানাতের ফোনটা মাটিতে পড়েছিল। স্ক্রিন একটু ভেঙেছিল। তাই বলে সেদিন কষে চড় বসিয়েছি জোনাকির গালে।” রৌধিক সোজাসাপ্টা বললেন।

ইয়ানাত নিশ্চুপ। তার দৃষ্টি বিরক্তকর। নাক ফুলিয়েছে। মুখশ্রীতে বিরাগী একটা ভাব। মিতা আন্টি পরপর দুই চড় দিলেন ইয়ানাতের গালে। আমি ধরতে গেলে বাঁধা দিলেন আন্টি। স্টার্ফদের নির্দেশ দিলেন মেডিসিন বক্স আনতে। অতঃপর আন্টি সোফায় বসলেন। ইয়ানাতকে কড়া আদেশ দিলেন আমার পা ব্যাণ্ডেজ করিয়ে দিতে। যেহুতু আঘাত তিনি করেছেন তাই তাকেই ব্যাণ্ডেজ করে দিতে হবে। তিনি আমার বড়, ব্যাণ্ডেজ করাতে হলে অবশ্যই পায়ে হাত দিতে হবে। আমি না করলাম। কিন্তু রৌধিক শুনলেন না। আমাকে ধমক দিয়ে বসিয়ে রাখলেন। তার কথা একটাই, আরেকবার কিছু বলেনি বলে এবার সুযোগ পেয়েছে। এবার শাস্তি দিলে এমন করবে না।
মিতা আন্টিও সায় দিলেন। ব্যাণ্ডেজ না করে দিলে ইমতিয়াজ আমহৃদের কাছে বিচার দিবেন। ইয়ানাত তার বাবা বলতে ভীতিগ্রস্ত। তাই ক্ষোভে ফুঁসতে থাকেন।
_________________
আমি পায়ের উপর পা তুলে তেঁতুলের দানা চিবুচ্ছি। দানা দুটো আমার ব্যাগে পেয়েছি। শুকিয়ে শুঁটকি হয়েছে। কবে রেখেছিলাম জানা নেই। রৌধিক শাওয়ার নিতে গেছে। আধঘণ্টা হয়ে গেছে, বের হওয়ার নামই নেই। অদ্ভুত মশাই। এতক্ষণ কী করে? একে সাবানের এড করতে দেওয়া উচিত। সাবানের ‘স’ ও থাকবে না।
আমার প্রগাঢ় মানসিক উদ্‌বেগের ছেদ ঘটল মৃদু শব্দে। মস্তক উঁচু করতেই রৌধিকের বলিষ্ঠ দেহ নজর কাটল। পুনরায় মাথানত করলাম। মশাইয়ের তবে শাওয়ার শেষ হয়েছে। স্বচ্ছ দর্পণের সম্মুখে দাঁড়িয়ে স্পষ্টবাদী কণ্ঠে বললেন, ” যাও, নিচে গিয়ে এক কাপ কফি নিয়ে এসো।”

আমি পায়ের দিকে আশাহত দৃষ্টিতে চাইলাম। ব্যথাহত পা বিধেয় তিনি আমাকে কোলে করে এনেছেন, এখন বলছে আমাকে গিয়ে কফি বানিয়ে আনতে। আমাকে নড়তে না দেখে পুনরাবৃত্তি করলেন, “যাবে?”

আমি পা নিয়ে নিচের দিকে ধাবিত হলাম। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই কফির কাপ ধরিয়ে দিলেন মিতা আন্টি। আমি কাপ নিয়ে উপরে উঠে এলাম। উনি কাপ নিলেন ঠিকই তবে কথনভঙ্গি দেখালেন না। আমি নামক একজন প্রাপ্তবয়স্ক তরুণী এখানে আছি, তাকে দেখে মনে হচ্ছে না। হুট করেই তিনি বললেন,

“এক পায়ে নাকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকো!”

“মানে!” হতবাক আমি।

“এটা তোমার শাস্তি। প্রথমত আমাকে কিছু জানাও নি। দ্বিতীয়ত মিথ্যা বলেছ!
যদি কানে না ধর। তাহলে তৃতীয় শান্তি হিসেবে, কাল তোমার বাড়িতে চলে যাবে।”

আমি মুখ ভার করে কান ধরতে গেলাম। তৎক্ষণাৎ ধমকে বললেন, তিনি নাক ধরতে বলেছেন। কানে নয়। এটা তার স্পেশাল শাস্তি।
ধরলাম কানে। বেশিক্ষণ বা’পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার জোর নেই। এই ছেলেটা অদ্ভুত ধরনের। একদম বিচ্ছু। এভাবেই কাটল মিনিট বিশেক। পা ভেঙে আসছে। উনি ধীরে ধীরে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে।

আমি আদুরে গলায় বলি, “এবারের মতো ছেড়ে দেওয়া যায় না।”

“যায়, তবে একটা শর্ত আছে!”

আমি ফট করে পা নাড়িয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। উনি আঙুল তুলে পা উঁচু করতে বললেন। পেঁচা মুখ করে দাঁড়ালাম। তিনি আয়েস করে বললেন,

“শর্ত হচ্ছে। এই যে, তুমি এখন প্রতিজ্ঞা করবে আর কখনো আমার থেকে কিছু লুকাবে না। যদি লুকিয়েছ, তাহলে তোমার তুলতুলে নরম নাকটা গুলে পড়ে যাবে। তখন সবাই তোমাকে নাক পড়া জোনাকি বলে ডাকবে।
রাজি থাকলে, হ্যাঁ বলো। তবেই এই শাস্তি থেকে মুক্তি।”

ঈষৎ ফাঁক হলো ওষ্ঠদ্বয় পরস্পরের থেকে। ঘনঘন পলক ফেললাম। হাত গিয়ে ঠেকল নাকের ডগায়। এটা কেমন প্রতিজ্ঞা?

“আমি জোনাকি। আমি যদি কখনো মিথ্যা বলি, তাহলে আমার নাম পড়ে যাবে। সবাই আমাকে নাক পড়া জোনাকি বলবে।

কাঁদো কাঁদো মুখ করে টেনে টেনে বললাম আমি। রৌধিক ভ্রু কুঁচকে হাসলেন অধর চেপে। কফির কাপটা মৃদু শব্দে সেন্টার টেবিলের উপর রাখেন। হাতটা বেডের উপর ইশারা করে বসতে বললেন। আমি বসলাম। বাহু টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন। থমথমে গলায় বলল,

“কেন বারণ করার সত্বেও এখানে এলে। এখন শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছ। বাড়ি চলে যাও।”

আমি মাথা তুললাম। চলে যাওয়ার হলে তার দেওয়া শর্ত কেন মানলাম। শর্ত সাপেক্ষ তিনি কিছুতেই এখন এই বাড়ি থেকে আমাকে বের করতে পারেন না। কিছুতেই না। আমি কথা ঘুরিয়ে অন্য প্রসঙ্গ টানলাম।

“কালকে আপনি কোন মেয়ের সাথে ছিলেন। আমাকে পাত্তাই দিলেন না। মেয়েটা কে?”

রৌধিক গভীর ভাবনায় লিপ্ত হলেন। ভাবনা আয়ত্তে করতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেন কোন মেয়ে।
” ভার্সিটির রাস্তায় যেই মেয়েটা ছিল।”

রৌধিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। আমার ক্ষোভ লহমায় অন্তরিক্ষ স্পর্শ করল। রুদ্ধ হলাম আমি। আমাকে এভাবে দেখে রৌধিক মজার ছলে বলে,

“ঐটা তো গার্লফ্রেন্ড। তবে বেশিদিন থাকবে না। ভাবছি আরেকটা বিয়ে করব। বর্তমান বউ-তো মনের দুঃখটাই বুঝে না!”

কথা যেন মোটেও অন্তঃকরণে ঠাঁই পেল না। কয়টা লাগে তার। ইয়ানাত আপুর ছোট বোন। তাকে না-কি ভালোবাসে। তাহলে শেফা কে? শেফা গেছে, এখন আমি আছি। আবার আরেকটা মেয়েকে খুঁজছে। আমাকে আরেকটু খ্যাপাতে গম্ভীর গলায় বলে,

“বেশি বউ সমান বেশি ভালোবাসা।”

আমি চোখ মুখ ছোট করে ফেললাম। অজান্তেই অশ্রু গড়াল চোখ বেয়ে। লোকটা এমন কেন? আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে তার উদ্ভর কথায়, তবুও কেন এরুপ কথা বলেন?
পরক্ষণেই হু হা করে হেসে ফেললেন। আমাকে রেখে উঠে দাঁড়ালেন। কাবার্ড থেকে স্বযত্নে একটা প্যাকেট বের করে হাতে দিলেন। আমি নিলাম না। একবার তাকালামও না। আমাকে রাগিয়ে এখন আদিক্ষ্যেতা দেখানো হচ্ছে। আমার ভাবাবেগ না পেয়ে তিনি নিজেই প্যাকেট খুলেন। একটা স্মার্টফোন ভেতরে। আমার ভাড় করে রাখা মুখের পরপর কয়েকটা ছবি ক্যামেরা বন্দি করলেন। ফোড়ন কেটে বললেন,

” নাউ পারফেক্ট। একাই আমার এবং তোমার ওয়াল পেপার থাকবে।
উনি উকিল। আমার মামলাটা দেখছেন। বাড়ির ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও কথা বলছি।”

আমার টানা টানা চোখ জোড়া ডাগর ডাগর চোখে রুপান্তরিত হলো। তিনি উকিলের সাথে ছিলেন আর আমি কি-না কি ভেবে বসে আছি। নিজের ভিত্তিহীন কাজে অন্তরে অন্তরে তীব্রতর হাসলাম। অতঃপর বললাম,

“বাড়ির ফিরে পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা হয়েছে?”

“আশা রাখছি, হয়ে যাবে। তবে কিছুটা সময় লাগবে। বিদেশি কোম্পানির যাবতীয় টাকার কিছু পরিমাণ দান করার হয় এবং কিছুটা ব্যাংকে জমা করা হয়। আমার কিংবা বাবার সাইন্স ছাড়া উত্তোলন করা সম্ভব নয়। তাই লন্ডনে যেতে হবে একবার। ভাবছি, বিদেশি কোম্পানিটা এখানে প্রতিষ্ঠা করব।”

“দরকার নেই। ওটা ওখানেই থাক না! আপনি বাড়িটা ফিরিয়ে আনার আর একটা চাকরির চেষ্টা করেন। যদি আরু আবার কোনো ক্ষতি করে ফেলে, আমি কক্ষনই নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। প্লীজ!”

রৌধিক ফুঁ দিয়ে উড়িয়েছি দিলেন তার অগোছালো এলোমেলো কেশগুচ্ছ। আমার কথা রাখার প্রয়াস করবেন তিনি। আমি এতেই অসন্তুষ্ট।
____________

পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে আয়।
ও সে চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
আয় আর একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।
মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলনায়–
বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়।
হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়–
আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়।

অন্তরিক্ষে কৃষ্ণ বর্ণ মেঘের ছড়াছড়ি। শৈত্য হাওয়া বইছে। আমি মাথায় চিরুনি চালাচ্ছি। আর মন খুলে গান গাইছি। গানটা ছোটবেলা থেকেই খুব পছন্দের আমার। হুট করেই মেঘলা আকাশের সাথে তাল মিলিয়ে সুর তুলছে ইচ্ছে হলো। মাথার দুই পাশে দুই বেণুনী করে ব্যালকেনি থেকে ঘরে এসে বসলাম। তৎক্ষণাৎ দেখা মেলল মিতা আন্টির। সে বেডের উপর বসে আছে। স্থির দৃষ্টি মাটির দিকে। আমি চিরুনিটা ব্রাশদানীর মাঝে রেখে হাঁসি হাঁসি মুখে বলি,

“আন্টি, তুমি এখানে বসে আছো? কখন এলে। আমাকে কেন ডাকলে না।”

ভাবনার ছেদ ঘটল তার। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“গানটা অনেক পছন্দের। শুধু আমার একার নয়, ওর বাবা, ইভু ইনায়াত আর ..
অনেক বছর পর গানটা‌ শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ছিল।”

“ওহ্!”

আন্টি একটা থ্রী পিছ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে পড়ে নিতে বললেন। কোথাও একটা ঘুরতে নিয়ে‌ যাবে। মুখের উপর না করতে পারলাম না, তাই পড়ে নিলাম। খুলতেই শুভ্র রঙটা নজরে এলো।
আমি চটজলদি পড়ে বেরিয়ে এলাম। চোখে কাজল আর গোলাপী রঙের লিপস্টিক দিলাম। অতঃপর আন্টির সাথে বেরিয়ে এলাম।

দোলনায় দুলছি। আমার থেকে কিছুটা দূরত্বে বসে আছেন মিতা আন্টি। তার স্থির দৃষ্টি আমার নিকট নিবদ্ধ। মিশুক স্বভাবের মানুষ তিনি। তার ন্যায় মানুষ পাওয়া যায় না। আজ মনটা ভালো নেই। বাড়িতে মা ছাড়া কেউ নেই। ইয়ানাত আপু একটা প্রাইভেট স্কুলের শিক্ষিকা। ইভু ভাইয়া হসপিটালে গেছেন। বাকিরা যে যার নিজ নিজ কাছে গেছেন। সেই সুবাধে বাড়ি ফাঁকা। আমহৃদ বাড়ির পাশেই ছোট একটা পার্ক। বাচ্চারা পার্কে খেলাধুলা করছে।
বাচ্চাদের সাথে থাকলে আমার মন ভালো হবে, এই আকাঙ্ক্ষায় মিতা আন্টি এখানে নিয়ে এসেছে। এসে থেকেই এভাবে বসে আছেন।

কিয়ৎক্ষণ পর তিনি এগিয়ে এলেন। আমার দোলনায় ধাক্কা দিতে চাইলেন। আমি সম্মতি দিলাম। তৎক্ষণাৎ একটা ছোট বাচ্চা ছুটে এলো। আন্টিকে জড়িয়ে ধরলেন। আধো আধো কণ্ঠে বলে,

“আমিও দোলনায় উঠব, নানিমা। তুমি আন্টিকে বলো, আমাকে একটু তুলতে। দেখো বাকি দোলনা‌গুলো ফাঁকা নেই।

বাচ্চার কথায় বাজ পড়ল মাথায়। আমার ন্যায় স্বল্পবয়সী তরুণীকে আন্টি ডাকছে। বাহ্।
কথা অনুসরণ করে পাশে ফিরতেই দেখলাম, দোলনাগুলো ফাঁকা নেই।‌ আমি ফট করে কোলে তুলে নিলাম। আন্টি পেছন থেকে ধাক্কা দিতে লাগলেন। মিনিট পাঁচেক পর মেয়েটি চ্যাঁচিয়ে বলল,

“থামো থামো। আমি যাবো!”

“কোথায় যাবে তুমি?”

“মা যাবো।”

দোলনা থামাতেই মেয়েটি যেমন ছুটে এসেছিল, তেমনি ছুটে গেল। আমিও নামলাম দোলনা থেকে। মেয়েটি তার মায়ের কাছে পৌঁছাতে পারল কি-না তাই পিছু নিলাম। কিছুদূর যেতেই দেখলাম, সে স্বল্পবয়সী একজন মহিলার কোলে। তাই আমরাও উল্টো পথ ধরলাম। গাছের নিচেই গিয়ে বসলাম। দুপুর হয়ে আসছে। উষ্ণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই বাড়ির দিকে হাঁটা দিবো।
অবিলম্বে এসে উপস্থিত হলো ইভু ভাইয়া ও রৌধিক।চোখ পরিষ্কার করে পুনরায় তাকালাম। দুহাতে হাওয়াই মিঠাই। আমার দিকে এগিয়ে দিলেন একটা। লহমায় খুলে খেতে শুরু করলাম। বরাবরই এই জিনিসটা পছন্দ আমার।‌
অতঃপর আন্টিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“মামুনি, জোনাকির সাথে আমার কিছু কথা আছে। নিয়ে যাবো?”

“যা!”

আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম। তা দেখে তিনি বললেন,
” চলেন দিপ্তিরানী।” একটু সামনে অগ্ৰসর হতেই রিক্সা পেলাম। হয়তো রৌধিকই ঠিক করে রেখেছিলেন।রিক্সায় উঠতেই ছেড়ে দিলেন। ছোট একটা ব্রীজের সামনে এনে দাঁড় করালেন। রৌধিক ভাড়া মিটিয়ে হাঁটতে লাগলেন। আমিও তার পিছুপিছু হাঁটছি। কম হাঁটছি তো খাচ্ছি বেশি। রৌধিক রেলিংয়ের উপর বসলেন। আমিও বসলাম। হাতের উপর হাত রাখলেন। আমি হাত ছাড়িয়ে একটু সরে বসলাম। শান্ত কণ্ঠে বললেন,

“জোনাকি, আমার পাশে বসতে ভালো লাগছে না বুঝি।”

বুঝতে পারলাম, তার অভিমানী কথার ধরন। বিনিময়ে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে কাঁধে মাথা রাখলাম। হাঁসিমাখা কণ্ঠে বললাম,

“শুধু আপনার পাশে না, আপনার কাঁধে মাথা রেখে সর্বক্ষণ থাকবে আমার অনেক ভালো লাগে।”

এবারে নিরবচ্ছিন্নতায় কেটে গেল প্রিয় মুহুর্তগুলো। উষ্ণ দুপুরেও বেশ তৃপ্তিদায়ক এই মুহুর্তটা। হুট করেই তিনি বলেন,
“জোনাকি, আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।‌”

“জি বলুন।”

“দিনকে দিন বয়স বাড়ছে আদ্রুর। আমাদের অসচ্ছলতা বাড়ছে। বাবা চাইছে আদ্রুর বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে। লন্ডনের কোম্পানিটার অবস্থা ভালো না। মাসখানেক সময় লাগবে সেদিকটা দেখতে। আমাকে যেতে..

রৌধিক থেমে গেলেন। বলতে চেয়েও বলতে পারলেন না। আমি পরবর্তী কথাটা শ্রবণ করার নিমিত্তে চেয়ে রইলাম চাতক পাখির ন্যায়। তার নীলাভ চোখজোড়া উদাসীন। অন্যরকম।

“থেমে গেলেন কেন বলুন?”

কিছু না, বাড়ি চলো। ভালো লাগছে না। মাথা ব্যথা করছে।

[চলবে.. ইনশাআল্লাহ]