অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব-২৯+৩০

0
608

#অনুবদ্ধ আয়াস
#ইফা আমহৃদ
পর্ব:২৯+৩০

সন্ধ্যার অন্তরিক্ষ আজ অধিক আঁধারে আবৃত। সচরাচর অপেক্ষায় বড্ড পৃথক। অনুপস্থিত পূর্ণিমার থালার ন্যায় মস্ত চাঁদ। অনুপস্থিত মিটিমিটি তারকা। উপস্থিত আকাশে ভাসমান পুঞ্জীভূত জলীয় বাষ্প। যা মেঘ নামেই পরিচিত। যখন তখন পতিত হতে পারে পৃথিবীর বক্ষে। আমি কফি বানাচ্ছি মনের সুখে। রৌধিক প্রত্যাহিক দিনের ন্যায় শাওয়ার নিচ্ছে। আজ নিজ থেকে কফি চায়নি। আমারই বানাতে ইচ্ছে করল। হুট করে বাড়িতে উপস্থিত বাকিদের কথা মস্তিষ্কে হানা দিল। তাই আরেকটা পাতিলে পানি দিলাম। চা বানিয়ে ট্রে সমেত ছুটলাম চা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এঁকে এঁকে সবার ঘরে দিয়ে যখনই বাবা-মায়ের ঘরে দিতে যাবো তখনই শ্রবণ হলো অপ্রত্যাশিত কিছু কথন। থেমে গেল চরণ। আদ্রিক আহম্মেদ মৌমিতাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন,

“রৌধিক কালকে বিকেলের ফ্রাইটে চলে যাবে। ওর প্রিয় খাবারগুলো রান্না করো। আসতে আসতে মাস ফুড়িয়ে যাবে। সেখানে গেলে খেতে পারবে কি-না।”

“হ্যাঁ। সবে বিয়ে হয়েছে মাস পেরুতে পারল না। জোনাকি কিভাবে নিবে ব্যাপারটা।
জোনাকিকে রৌধিক বলেছে তো?”

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অবলোকন করল মৌমিতা। আদ্রিক আহম্মেদ জবাব দিতে ব্যর্থ। এই প্রশ্নের প্রত্যুত্তর নেই। আমি নিঃপলক, স্থির, উদাসীন। রৌধিক লন্ডনে চলে যাচ্ছে আর আমি কিছু জানি না। এতোটা তুচ্ছতাচ্ছিল্যর কি আদৌও প্রাপ্য আমি। হাত ফসকে গেল। ট্রেটা ব্যালেন্স করতে সক্ষম হলাম। কাপে কাপে মৃদু ঘর্ষণের সৃষ্টির ফলে তারা অবলোকন করল। আমি ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করলাম। কাঁপা কাঁপা হাত দ্বারা দু’কাপ চা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে শব্দহীন পায়ে বেরিয়ে এলাম। শরীরটা অবস হয়ে আসছে। দীর্ঘ অবকাশ প্রয়োজন। ভাবতে ভাবতে নিজের ঘরে চলে এলাম। কফির কাপটা কিঞ্চিৎ শব্দে টেবিলের উপর রাখি, যাতে রৌধিক বুঝতে পারেন আমার অবস্থান।
“বাহ্। বউ বউ লাগছে আজ।”
প্রত্যুক্তি নেই হৃদমাঝারে। তিনি কফির কাপ নিয়ে চুমুক দিলেন। মুখ কুচকালেন। আজ কফিতে চিনি দিয়েছি, হয়তো তাই। আমি শক্তপোক্ত কণ্ঠে বললাম,

“আপনি কাল কোথাও যাচ্ছেন?”

বিষম খেলেন। কাশতে কাশতে কিছু বলার প্রয়াস করতেই পুনরায় বলি, “হ্যাঁ অথবা না। সোজাসাপ্টা বললেন।”

“হ্যাঁ। আসলে তোমাকে বলতে..

“থাক। বলার দরকার নেই। আপনি ঘুমান। আমি আপনার লাকেজ গুছিয়ে দিচ্ছি।”

রৌধিক আশাহত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। পাত্তা দিলাম না। কাবার্ডের উপর থেকে লাকেজ নামিয়ে চেইন খুলে রাখলাম। অতঃপর জামা কাপড় বের করে ভাঁজে ভাঁজে রাখলাম। খুঁটি নাটি সব কিছু গুছিয়ে দিলাম। পুরোটা সময় রৌধিক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলেন। আমি কম্পিলিট করে সোফায় বসলাম। রৌধিক উঠে এলে। পাশে বসে সরল ভাষায় বলে,

“কী হয়েছে, এমন গোমরামুখ করে বসে আছো কেন?”

“কিছু হয়নি। আমি বলেছি, কিছু হয়েছে? যান সরেন এখান থেকে।”

“ধ্যাত। না বললে না।”

আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় ফুটতে লাগলাম আমি। কলার টেনে ধরলাম। রক্তচক্ষু করে চেয়ে রইলাম। চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম,
“ধ্যাত। না বললে না। মানে কী হ্যাঁ? তুই যে লন্ডনে যাবি। আমাকে বলেছিলিস? আমি বাবার মুখে শুনছি! তাও আবার প্রায় একমাস।”

বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। রৌধিক হাত ছাড়ালেন কলার থেকে। গহীন নয়নে চেয়ে রইলেন। পানি ঢেলে এগিয়ে দিলেন। মুখ ভার করে রাখলাম। পানি খাবো না মানে খাবো না। কিছুতেই না। রৌধিক আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা মানলেন না। গাল চেপে দুই অধরের মাঝে কিঞ্চিৎ ব্যবধান করে পানির গ্লাস এলিয়ে দিলেন। আমি ঢোক গেলার জন্য কিয়ৎক্ষণ থামলাম। পুনরায় কান্নার সূচনা করার পূর্বেই রৌধিক বলতে শুরু করলেন,

” আগে আমার কথা শেষ হবে, পরে তুমি কথা বলবে।আজকে তোমাকে আমি ব্রীজে নিয়ে গেছিলাম। গেছিলাম তো?”

কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলি, “হম!”

“কিছু বলতে চেয়েছিলাম?”

“হম।”

“বিদেশে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলেছিলাম তো?”

“হ্যাঁ। কিন্তু মাঝপথে আপনি থেমে গেছিলেন। বলেছিলেন, আমাকে যেতে। তারপরে আর কিছু বলেন নি।”

“তাহলে? আমি তোমাকে সবটা বলতে চেয়েছিলাম। তখন তুমি বাচ্চা বাচ্চা মুডে ছিলে। আমি সত্যিটা বললে, তুমি কষ্ট পেতে। আমি চাইনি তোমার খুশিটা নষ্ট করতে। তাই বলেনি। বুঝেছ?”

আমার নাক টেনে শব্দের সমাপ্তি ঘটালেন রৌধিক। আমাকে তিনি এই কথাটা বলতেই সেখানে নিয়ে গেছিলেন। আর আমি তাকে ভুল বুঝলাম। আচ্ছা তিনি চলে গেলে, আমি একা কীভাবে থাকব? কথাটি ভাবতেই হৃদস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিকের তুলনায় ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগল। অজান্তেই নেত্রযুগল পূর্ণ হল অশ্রুধারায়। ঝাঁপসা হল দৃষ্টি। নেত্রযুগলের পলক ফেলতেই গাল গড়িয়ে পড়ল। হুট করেই অজান্তা আয়াসে বক্ষটা ছ্যাত করে উঠল। রৌধিকের বেষ্টিত করে নিলাম নিজের পৃথক বাহুবন্ধনে। অস্ফুট স্বরে শুধালাম,

“আপনি সত্যিই চলে যাবেন রৌধিক। আমি কীভাবে থাকব আপনাকে ছাড়া।”

“আমি তো চলে যাচ্ছি না। ফিরে আসছি।”

বলেই পরপর কয়েকবার নিজের অধর জোড়া ছুঁয়ে দিলের আমার পৃথক অধরে। তীক্ষ্ণ আঘাতপ্রাপ্ত হলো আমার তুলতুলে গাল। আহ্ করে উঠলাম। কিছু বলার প্রয়াস করার পূর্বেই রৌধিক বেপরোয়া কাজ করে বসলেন। আমার ভাঁজ বিশিষ্ট ললাটে তার ভাঁজ বিহীন ললাটে রেখে নেশাক্ত কণ্ঠে বললেন,
“আই নিউ ইউ জোনাকি। ডিপলী নিড। এই রাতের মাধুর্যের বিনিময়ে আগামী এক মাস প্রাণভরে বাঁচতে চাই। এক মুহুর্তের জন্যও যাতে মনে না-হয় তুমি আমার পাশে নেই।”

আমি মাথা তুলে অবলোকন করার প্রয়াস করলাম। বরাবরের ন্যায় এবারেও ব্যর্থ। তার বলিষ্ঠ পুরুষালি হাতের দ্বারা আমি বাঁধা। সম্পূর্ণ নিঃশব্দ। আমি চাই, যাতে আগামী একমাস তিনিহীনা কাটাতে পারি। মাথা নতজানু। তার জামাবিহীন উদাম দেহ নজর কাটল আমার। শীতলতা কয়েকশ’গুন বাড়িয়ে দিল। তিনি কতক্ষণ ধরে এমন অবস্থার আছেন। অথচ আমার অভিমানী নজর একবারও তার দিকে পড়ল না। হাত জোড়া চেপে ধরলেন। আমি মিনমিনে গলায় বলি,

“আপনার শার্ট কোথায়?”

রৌধিক মাথা সরালেন না। পূর্বের ন্যায় রেখেই জড়ানো গলায় বলেন, “আমি তো শার্ট পড়ি নি। তাহলে আবার কোথায় যাবে? টাওয়ার কাঁধে পেঁচানো ছিল। তোমার অভিমান ভাঙাতে গিয়ে খসে পড়েছে।
এখন কি আফসোস হচ্ছে, দেখতে পারো নি বলে?”

“আপনি তো পুরোটাই আমার। আমি দেখতেই পারি! আপনি আমার ঠোঁটে চুমু খেয়েছেন। এবার আমিও চুমু খাবো। তো শোধবোধ।”

“কিন্তু আমি এখন আর দেখতে দিবো না, না চুমু খেতে দিবো।”

“এই তো..

নেত্রযুগল বড়ো বড়ো করে পরপর কয়েকবার রৌধিকের উন্মুক্ত বুকে অধর ছুঁয়েছিলাম। পরক্ষণেই ওষ্ঠদ্বয় শীতল স্পর্শে ভরে উঠল। নেত্রযুগল ছোট হলো না। নিভে গেল আলো। অতিবাহিত হতে লাগল প্রহর।

_____________
ভোরের মিষ্টি সোনালি আভা গাছগাছালি ভেদ করে উঁকি দিয়ে পূর্ব আকাশে। নিভু নিভু আলো পেরিয়ে প্রজ্বলিত হয়েছে পৃথিবীর এক প্রান্ত। আমি গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছি রৌধিকের বাহুডোরে। ঘড়ির কাঁটা নয়টা পেরিয়েছে। ঘুম ভেঙ্গেছে বহু সময় পূর্বে। উঠার স্পৃহা নেই। এই মুহূর্তটা উপভোগ করছি। উঠলেই মনে হবে, আবার কবে এই বুকে মাথা রাখব। কিছু ঘণ্টা পরই হয়তো রৌধিককে চোখের দেখাও দেখতে পাবো না। হাত দিয়ে স্পর্শ করতে পারব না। ভাবলেই চোখের পাতা ঝাঁপসা হয়ে আসে। এইসব ভাবতে ভাবতেই চোখের ভরে এলো। গড়িয়ে পড়ল রৌধিকের উন্মুক্ত বুকের উপর। রৌধিক নড়েচড়ে উঠল। চোখ মেলতেই চোখাচোখি হলো দুজনার। আমি দৃষ্টি সরালাম। রৌধিক কিছু বললেন না। হয়তো অনুভব করতে পারলেন আমার অবস্থাটা। এভাবে পেরিয়ে গেল কিছু মহেন্দ্রক্ষণ। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলে,

“উঠবে না। না-কি আমার মতো সুদর্শন সুপুরুষের প্রেমে ভাসছ?”

“একটু ভাসতে ইচ্ছে করছে। আবার কবে ভাসতে পারব?
হয়তো কাজের মাঝে সারাদিনে একবারও আপনার কণ্ঠ শুনতে পেলাম না।”

“বাহ্, বাহ্। কালরাতে তুইও বলেছিলে আমাকে আর আজ আবার আপনি?”

“স্যরি!” [সৌজন্য মূলক হাসি দিয়ে]

“ঠিক আছে, এবার উঠ। সবাই কী ভাববে।”

আমি বসলাম। কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া অগোছালো চুলগুলো হাতখোপা করতে করতে বলি, “ব্রেকফাস্ট সেরে এসে কিন্তু আবার এভাবে শুয়ে থাকব।”
রৌধিক হাসলেন। বাঁকা হাঁসি তার ওষ্ঠদ্বয়ে। বোধগম্য হলো তার হাসির মানে। কী ভাবতে কী ভেবে ফেলেছে? ছিঃ! ছিঃ! কী লজ্জা। লজ্জানত হলাম আমি। চটজলদি উঠে জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। পেছনে না ফিরে বুঝতে পারছি, তিনি এখন হাসছে। পরক্ষণেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। আমি হাসতে গিয়েও হাসলাম না। হয়তো কখনও এই হাসিটাকে বড্ড বেশি মিস্ করব, মানুষটাকে মিস্ করব কিংবা এই লজ্জাদায়ক মুহুর্তটাকে মিস্ করব।

বালিশে মুখ গুঁজে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছি আমি। রৌধিককে কোথাও দেখতে পারছি না। তার পছন্দসই আজ স্পেশাল খাবার রান্না করেছি। সেই ফাঁকে তিনি আমাকে না জানিয়ে চলে গেলেন? হৃদয়টা কেঁপে উঠল। আমাকে বলে গেলে, কী হতো? আমি বুঝি তাকে যেতে দিলাম না। আমার ভাবনার মাঝপথেই দ্বার খোলার মৃদু শব্দ কর্ণপথে আঘাত হানল। টনক নড়ল আমার। বিন্দু পরিমাণ স্থান অপসারণ করলাম না। নিম্নস্বরবিশিষ্ট কণ্ঠে বললেন,

“জোনাকি, কী হয়েছে তোমার? লজ্জাবতী লতার মতো এত লজ্জা কেন পাচ্ছ?”

কান্নার গতি হ্রাস পেল। আমি দ্রুত চোখ মুছে পশ্চাৎ ফিরলাম। রৌধিকের পড়নে ছাই রাঙা ট্রাউজার। টাওয়াল দ্বারা আর্দ্র কেশসমূহ মুছতে ব্যস্ত। তবে বর্তমানে তার আর্দ্র হাত স্থির। অনিমেষ দৃষ্টি আমার নিকট। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। আমাকে অচঞ্চল দেখে পুনরায় বলেন,

“ওয়াট হ্যাপেণ্ড জোনাকি? তুমি..

কথন ‌অবসান করার পূর্বেই তাকে জাপ্টে ধরলাম। আকস্মিক ঘটা পরিস্থিতিতে রৌধিক ভরকে গেল। ভারসাম্যহীন হয়ে পিছিয়ে গেল। সর্বাপরি দেয়ালের সহিত গিয়ে ঠেকেছে। অবিচল আস্থাসহিত বলে,

“জোনাকি কুলডাইন। কী হয়েছে, বলো আমাকে।”

“কোথায় ছিলেন আপনি? কত খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি।”

রৌধিকের আর্দ্রহাতের সাহায্যে পেঁচিয়ে নিয়ে বলে, “আমি ওয়াশরুমে ছিলাম। গাঁ ছিপছিপে লাগছিল। ফ্রাইটে তো শাওয়ার নিতে পারব না। তাই।”

“কিন্তু আমি যে দেখতে পেলাম না।”

“তখন মেভি মায়ের কাছে ছিলাম। এবার ওঠ।”

আমি নিভু নিভু চোখে অবলোকন করলাম। তিনি পূর্বেই আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন বিধায় চোখাচোখি হল দু’জনার। আমি সরে আসার প্রয়াস করলাম। রৌধিক ছাড়লেন না। তার বলিষ্ঠ হাতে সাহায্যে আমাকে মিলিয়ে নিলেন। অকপটে কণ্ঠে বলেন,
“শাড়ি পড়তে যা যা লাগে পড়ে এসো। শাড়ি পড়বে না। আমি পড়িয়ে দিবো। নাও গো..

“মানে..

“কিছু না। জামা খুলো আমিই পড়িয়ে দিচ্ছি।”

আমি এক লাফে রৌধিকের থেকে পিছিয়ে এলাম। রৌধিক কাবার্ড হাতরে একটা কালচে প্যাকেট দিয়ে পড়তে বললেন। আমি মাথা নিচু করে প্যাকেট নিয়ে দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে অগ্ৰসর হলাম। দ্বার গ্ৰথণ করে প্যাকেট খুলতেই নজর কাটল পেটিকোট আর ব্লাউজ। আমি পড়ে উপর থেকে ওড়না জড়িয়ে বেরিয়ে এলাম।
রৌধিকের ঘোরলাগা নেত্রযুগল। পা টেনে টেনে এগিয়ে এলেন। কোমর টেনে ড্রেসিং টেবিলের উপরে বসালেন। অতঃপর শাড়ি বের করে সামনে রাখলেন। নাক ছিঁচকালাম আমি। বৈশাখী শাড়ি। হাড়ি পাতিলের ছবি। আমি নাক ফুলিয়ে বলি,

“এই হাড়ি পাতিল কে পড়বে?”

“হাড়ি পাতিল কোথায়?”

“এটা হাড়ি পাতিল না তো কী? একটা কাজ করি আমি ব্লাউজ আর পেটিকোট খুলে আপনাকে দেই। আপনি পড়ে আসুন আপনাকে এই হাড়ি পাতিল পড়িয়ে দেই। এই ধরনের শাড়িমার বি’শ্রী লাগে।”

রৌধিক একগাল হাসলেন বিনিময়ে। কাবার্ড থেকে আরও একটা শাড়ি বের করলেন। শুভ্র রঙের ভেতরে লাল রঙের মোটা পাড়। এক দেখাতেই নিমিষেই মন কাড়ল। আমি দ্রুত শাড়িটা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। অপূর্ব সুন্দর।

আমার থেকে শাড়িটা না নিয়েই নিজের কাজে মনোনিবেশ করলেন। কাজল দ্বারা টানা টানা করে পড়ালেন। লিপস্টিক লাগালেন। অতঃপর গাঁ থেকে ওড়না সরিয়ে ফেললেন। খিঁচে নেত্রযুগল গ্ৰথণ করে নিলাম। হাত দ্বারা আঁকড়ে ধরলাম ড্রেসিং টেবিলের কাঁচ। চোখ মেলার প্রয়াস করলাম। কিন্তু পরক্ষণেই ওড়নার শক্তপোক্ত কাপড় দিয়ে চোখজোড়া বেঁধে দিলেন। আর দেখা হলো না তাকে। রৌধিক নিজের অন্তঃকরণের ন্যায় শাড়ি পড়িয়ে দিতে লাগলেন। তার দুষ্টু মিষ্টি স্পর্শের সাথে শাড়ি পড়ান শেষ করলেন। চোখের বাঁধন খুলে দাঁড় করালেন। হাঁটু মুড়ে পায়ের কাছে বসলেন। স্বযত্নে শাড়ির কুচি ঠিক করলেন। স্বচ্ছ দর্পণের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে গহীন নেত্রে দেখলেন সবকিছু। টেনে টেনে বললেন,

“বাহ্। অসাধারণ লাগছে তোমায়? তোমার ভালো লাগছে কী?”
আমার ধ্যানের ছেদ ঘটল। চটজলদি তাকাতেই মায়ায় হারালাম। শাড়িতে আমাকে ভালো লাগছে কি-না জানা নেই, তবে রৌধিকের পাশে দাঁড়ানোর ফলে আমাকে হাজার গুণ সুন্দর লাগছে। মেইড ফর ইচ আদার। লজ্জানত হলাম। রৌধিক চিবুক উঁচু করলেন। নেশাল মানুষের ন্যায় বললেন,

“কাল রাতের পরেও এত লজ্জা। আচ্ছা মেয়েদের এত লজ্জা আসে কোথা থেকে? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, বাসর ঘরে বসে আছ। আশ্চর্যজনক ভাবে সেদিন তুমি এত লজ্জা পাও নি।”

বা’হাতটা রৌধিকের অধরের উপর রেখে থামিয়ে দিলাম তাকে। তার বলা প্রতিটা কথা কাঁধে স্পর্শ করছে। বিধায় সর্বাঙ্গ কেঁপে কেঁপে উঠছে। খাবারের নিমিত্তে ডাক পড়ল। তাই নিচে নামলাম।

________________
“রৌধিক, শেষবারের মত একটু জড়িয়ে ধরবেন আমায়। প্লীজ।
এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? দেরি হচ্ছে যাচ্ছে তো। সবাই নিচে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”

রৌধিকের ভাবাবেগ নেই। সে স্থির। বাধ্যহয়ে আমিই তার গলা জড়িয়ে ধরলাম। দৃঢ় করে কিয়ৎক্ষণ নেত্রযুগল গ্ৰথণ করে রইলাম। অতিবাহিত হলো কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর আমি ছেড়ে দাঁড়ালাম। হাতের সাহায্যে রৌধিকের মাথাটা এনে অধর ছুয়ে দিলাম। হাসির আধো আধো স্বর টেনে বললাম,

“নিজের যত্ন নিবেন। আমার সাথে কথা বলতে ভুলবেন না। তাড়াতাড়ি চলে আসবেন।”

বিনিময়ে তিনিও তার অধর জোড়া ললাটে ছুঁয়ে দিলেন। বাঁধ ভাঙাল আমার। নিভৃতে লুকিয়ে রাখা অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ল নিচে। রৌধিকের বুকে মাথা রেখে ঢুকরে কেঁদে উঠলাম। রৌধিক নিশ্চুপ। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

“কেঁদো না, আমি যাবো না।”

“যাবেন না, মানে কী?”

“যাবো না মানে তোমাকে ছেড়ে আপাতত কোথাও যাচ্ছি না। ফ্রাইট ক্যান্সেল।”

আমি চটজলদি নেত্রযুগল মুছে নিয়ে অকপটে কণ্ঠে বলি, “শুনেন। একদম না। দেখুন আমি কাঁদছি না। আমি কেন কাঁদব? আমি তো এখন হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমাব।”

বলেই মুখ ভেংচি কাটলাম। রৌধিক ভ্রু কুঁচকালেন। অধর কামড়ালাম আমি। একটু বেশিই বলে ফেলেছি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলে, “এবার একটু বেশিই হয়ে গেল না?”

খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম। রৌধিক গতিহীন পা দুটো গতিশীল করে সামনের দিকে অগ্ৰসর হলেন। লহমায় অদৃশ্য হল আমার মুখের প্রাণবন্ত হাসিটা। আমি ব্যালকেনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। রৌধিক পেছনে না চেয়েই গাড়িতে উঠে বসলেন। নিচে নামলাম না। সকলে এগিয়ে দিতে বিমানবন্দর অবধি যাবে। কেন তাকালেন না? আমি শেষবারের নিমিত্তে তার ন্যায় সুদর্শন সুপুরুষের প্রেমে তীব্রতর ভাসতে স্পৃহা প্রকাশ করলাম।‌ কিন্তু ব্যর্থ হলাম। তার উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় ঠেকিয়ে দেওয়া জায়গাটায় ডানহাত স্পর্শ করলাম। গলা ধরে আসছে। ধরে ধরে ঘর অবধি গেলাম। বেডের উপর বসতেই নিজেকে সংযত করতে ব্যর্থ হলাম। বালিশে মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। রৌধিক নেই। আমার অগোচরে বিরাজমান।

ভাবী ডাকে হুস ফিরে আমার।‌ দ্রুত নেত্র মুছে উঠে বসলাম। মাত্রারিক্ত কান্নার ফলে এখনও ক্রমাগত হেঁচকি তুলছি। আদ্রিতা আপু এসে বসলেন। আমার নাজেহাল অবস্থা দেখে একগ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন। আমি পানি পান‌ করলাম। তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

” যখন এতো ভালোবাসিস, তাহলে ভাইয়ের সাথে লন্ডনে গেলেই পারতি। শুধু শুধু কেঁদে চোখ মুখের এত খারাপ হয়েছে।”

আমি নতজানু হয়ে বসলাম। আদ্রিতা আপু আমাকে তার সাথে নিয়ে যেতে এসেছেন।‌ আজ পহেলা বৈশাখ। বাঙালি নববর্ষের প্রথম দিন। ইয়ানাত আপু যেই স্কুলে পড়ান সেখানে ছোট করে উৎসব অনুষ্ঠিত করা হয়েছে। রৌধিক যাওয়ার পূর্বে কড়া গলায় তাকে শাসিয়ে গেছেন, তিনি যাওয়ার পর যাতে আমাকে নিয়ে বৈশাখী অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। আমি অসম্মত। অথচ আদ্রিতা আপু কিছুতেই আমাকে রেখে যাবেন না। রৌধিক জানতে পারলে তার অবশ্যই শোচনীয় করবেন।
মুখে পানির ছিটা দিতে ওয়াশরুমের দিকে অগ্ৰসর হলাম।

.

আদ্রিতা আপুর সাথে যাওয়া হল না। ভার্সিটিতে গেলাম। অহি ফোন করে আসতে বলেছে। বড় করে আয়োজন করা হয়েছে। আদ্রিতা আপুকে বলতেই তিনি সম্মতি দিলেন। যেহুতু ফ্রেন্ডদের সাথে থাকব সেহুতু মন খারাপ হওয়ার কোনো উপায় নেই। আমি বেরিয়ে এলাম ভার্সিটির অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে।

“এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।”

গান বাজছে। এখনও অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। ভার্সিটিতে উপস্থিত হয়নি প্রধান অতিথি। তাই মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। আমি ভিড় ঠেলে সামনের দিকে অগ্রসর হতেই অহি হাত টেনে এক পাশে নিয়ে এলো। সেখানে সিনিয়ররাও ছিলাম। আমাকে দেখে বেজায় খুশি হয়েছেন, বুঝতে পারলাম। জড়িয়ে ধরে বলেন, কেমন আছি, এতদিন কেন আসিনি। আজ আমাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে।

[চলবে.. ইনশাআল্লাহ]