হৃদয়েশ্বরী পর্ব-২৩+২৪

0
1059

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা- সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব-২৩
_____________

সায়াহ্ন হতেই অম্বর ঘোলাটে, মেঘবর্ণ। পূর্ণিমাতিথি হলেও দেখা নেই চাঁদের। মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ। থেমে থেমে প্রকৃতিতে বইছে ঝড়ো হাওয়া। বৃষ্টি আসবে বলছে মেদিনী। মিনিট খানেক পর পর বজ্রপাত আছড়ে পড়ছে পৃথিবী পৃষ্ঠে। বজ্রপাতের সেই কড়া শব্দে উশানের হুঁশ ফিরে। জানালার উন্মুক্ত কপাট ব্যাস্ত হাতে বন্ধ করে দিয়ে ফিরে আসে নিজের চকিতে। উশান ঘাড় দুই দিকে কাত করে। পুরো শরীরে যেনো মূর্হতেই বিষ যন্ত্রণা এসে ভর করেছে। নিজের রোমশ এক হাত নেত্র সম্মুখে তুলে আনে উশান৷ হাতের এক কোণে কামড় দেয়ার ছাপ। লাল হয়ে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। উশান বিড়বিড়িয়ে শুধালো,

-‘ বড্ড ফাজিল হয়ে গেছো তুমি মীরা। বড্ড বেশি! ‘

উশান স্থির দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো মীরার প্রতি। মীরা তখন নিঃশব্দে বসে। দাঁত দিয়ে নখ কাটছে আর বিড়বিড় করছে৷ ভ্রু’কুটি এক করে উশান৷ এই মেয়েটা যে তার ওপর কিয়ৎক্ষণ পূর্বে যেই নির্যাতন চালিয়েছে তা কি মীরা স্বীকার করবে কখনো?আদও সকালে উঠে মনে থাকবে এসব কথা?

কিয়ংদশ পূর্বে! মীরা কে অচেতন অবস্থায় কক্ষে টেনে হিঁচড়ে আনতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে উশান এর। পথিমধ্যে মীরা তাকে কাঁদায় ফেলে দিয়ে নাকানি-চুবানি খাইয়েছে। উশান কোনোমতে কাঁদা থেকে উঠে মীরাকে ধরে কক্ষে প্রবেশ করতে নিলে মীরা তার চুল টানতে টানতে ভিতরে প্রবেশ করেছে। চুল টানার পর উশানের মাথার একাংশ যন্ত্রণায় কাতর। এতটুকুতেই থামেনি মীরা।
কক্ষে প্রবেশ করার পর মীরা তাকে ধমকে ধমকে কিল – ঘুষি দিয়েছে যে কতগুলো তা বেহিসেব!হাত ধরে কামড় দিয়েছে চার – পাঁচটা। কামড় দেয়ার পূর্বে মীরার কবিতার মতো করে বলেছিলো,

-” উশান তুই পাগল ছাগল।
তোকে দিবো আমি সজোরে কামড়!”

মীরা হুঁশে নেই! অচেতন সে। দিন- দুনিয়ার কোনো ধারণা আপাতত তার মাঝে নেই।এসব ভেবে নিয়ে নিজেকে সর্বোচ্চ শান্ত রাখার চেষ্টা করেছে উশান। তবুও ভুলবশত একবার রাগের বশে হাত উঁচু করে নিয়েছিলো সে মীরাকে থাপ্পড় দেয়ার ছলে। তবে সেটাই তার কাল হয়ে দাঁড়ালো। মীরা ক্ষেপে যায় আরো! রুষ্ট কন্ঠে বলে,

-‘ তুই আমাকে থাপ্পড় দিতে চাস? বে’য়া’দ’ব ছেলে! তোকে তো আজ আমি মে’রে’ই ফেলবো। ফাজিল! কত বড় সাহস তোর। ‘

মীরা কথা শেষে উশানের গালে টপাটপ চার পাঁচটা থাপ্পড় মে’রে বসে। হতভম্ব উশান! তবুও সে শীতল, শান্ত, মৌন! পরিশেষে মীরা তাকে চিমটি দেয়া শুরু করে। যেই সে ঘুমে ঢুলে পড়ে ঠিক তখনই মীরা তার চুল টান দিয়ে বাহুতে চিমটি দেয়। রাগ দমন করতে উশান জানালার কাছে চলে আসে। মীরা পরবর্তীতে উঠে আর আসেনি বলে স্বস্তি পায় সে। ভাগ্যিস মীরা আর আসেনি। নয়তো এবার ধৈর্যের বাধঁ ভেঙে সে চড় দিয়ে বসতো মেয়েটাকে৷

বর্তমানে! উশান এসে চকিতে বসতেই মীরা এসে ঘেঁষে বসে তার সন্নিকটে। তপ্তশ্বাস ছাড়ে উশান। বিরক্তি নিয়ে বলে,

-‘ আরো কতো জ্বালাবে আমাকে? একটু ঘুমাও না। তোমার অত্যাচারে আমার মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে।’

মীরা আঙুল নাড়িয়ে বাচ্চাদের মতো করে জবাব দিলো,

-‘ ডিফেন্স অফিসার আমার মতো পুচকির হাতে মার খেয়েছে। তারপর আবার তার মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে। ছিহঃ! কাপুরষ! এই তোকে ডিফেন্সে এলাউ করলো কে? বল তো! তাকে গিয়ে আমি গু’লি মেরে আসবো। উল্টোপাল্টা লোককে দেশ রক্ষার দায়িত্ব দেয়। হুহ্! ‘

উশান মীরাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মীরার চকিতে চলে যায়। সেখানে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে কঠিন গলায় বলল,

-‘ ঘুমাও মীরা। আর একটা কথা তোমার মুখ দিয়ে বের হলে আমি আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবো না। আই উইল বিট ইউ! ‘

উশান পাশ ফিরে ঘুমোনোর চেষ্টা করে। মীরার মুখে তুই-তুকারি শুনতে ভালো লাগছে না তার। ‘ তুমি ‘ বললেও হতো কিন্তু তুই? ছিঃ! শব্দটা এতো উদ্ভট লাগছে কেনো তার নিকট? আশ্চর্য! ভাবনার ঝালে আঁটকে পড়ার সময় উশান উপলব্ধি করে মীরা চকি থেকে উঠে আসছে তার নিকট। নেত্র যুগল খিঁচে বন্ধ করলো সে। নাহ! আর পারবেনা সে এই মেয়ের অত্যাচার সহ্য করতো। এবার জ্বালাতে আসলে ঠাস করে থাপ্পড় মে’রে বসবে।

মীরা বিড়াল পায়ে এগোল। উশানের পাশে বসে আঙুল দিয়ে উশানের পিঠে খোঁচা দিতে থাকলো। আহ্লাদী স্বরে বলল,

-‘ এই, এই ওঠ! আমাকে না ঘুম পাড়িয়ে তুই আগে ঘুমোচ্ছিস কেনো? আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দে।’

উঠে বসলো উশান। তার নেত্রযুগলে আশার আলো। ক্লান্তিমাখা কন্ঠে বলল,

-‘ ঘুম পাড়িয়ে দিলে ঘুমিয়ে পড়বে তো? ‘

-‘ হু। ‘

-‘ আচ্ছা চলো। তুমি ঐ চকিতে ঘুমাও। আমি ঘুম পাড়িয়ে দিবো। ‘

-‘ ও..কে! ‘ একটু টেনে বলল কথাটা মীরা।

উশান বুঝলো! ঘুম এসেছে মীরার। স্বস্তির শ্বাস ফেলে সে মীরার পিছু পিছু চললো। মীরা চকিতে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ে। ইশারায় নির্দেশ দেয় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। উশান তাই করলো। ক্ষণ বাদে ফিসফিস করে আনমনে বলল,

-‘ আমি তোমার সব কথা এমন অক্ষরে অক্ষরে কেনো পালন করছি মীরা? আমি তো কারো কথা শুনি না। কারো কথা পালন করি না। আমি চলি নিজ মর্জি মতো। কিন্তু আজ? আজ তুমি আমার এতো বছরের অভ্যাস কে কিভাবে এক মূর্হতেই চেইঞ্জ করে দিলে? তোমার ওপর রাগতে পারছি না কেনো আমি? হোয়াই? ‘

মীরা ঘুমিয়ে পড়তেই উশান মীরার চোখের চশমাটা খুলে পাশে রেখে দিয়ে নিজের স্থানে ফিরে আসে। কিছুক্ষণ গভীর ভাবে চিন্তা করার পর সঠিক উত্তর না পেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো সে।

এতক্ষণ ঘুমের নাটক করা মীরা নেত্রযুগল উন্মুক্ত করলো। আলত হেঁসে আঁধারের মাঝে উশানকে পরখ করার চেষ্টা করে। সে হুঁশে ছিলো এতক্ষণ যাবৎ। যা করেছে হুঁশে থেকেই। পানি খাওয়ার জন্য কলস থেকে তরল জাতীয় দ্রব্য গ্লাসে ঢালার পরই সে বেশ বুঝতে পেরেছিলো এটা পানি নয় ‘ ভাং ‘! চট্রগ্রামে না থাকুক কিন্তু কিছু জিনিস সম্পর্কে তার জ্ঞান আছে ভালোই। ভাং গ্লাস থেকে ফেলে দেয়ার লহমায় সে খেয়াল করে উশান আসছে। বুদ্ধি চাপে মস্তিষ্কে। অন্ধকারে গোপনে গ্লাস থেকে ভাং ফেলে দিয়ে তারপর খালি গ্লাসে চুমুক দেয়ার ভঙ্গি করে। উশান আঁধারে হতে সম্মুখে এসে বুঝতে পারে এমন ভাবক যেনো মীরা ভাং খেয়ে ফেলেছে ভুলবশত।

ঘটনাটা ইচ্ছাকৃত ভাবেই করা মীরার। উশানের বিকেলে বলা কথাটা তার মস্তিষ্কে গেঁথে ছিলো নিপুণ ভাবে। লোকটাকে শাস্তি না দিলে চলেই না! একদম অতিরিক্ত শুধু করেছে। মীরাকে কষ্ট দেয়?বেয়াদব লোক! নাকমুখ কুঁচকে মীরা বলল,

-‘ আমাকে এতোদিন যা কষ্ট দিয়েছেন আপনি তা কাঁটায় কাঁটায় আপনাকে আমি ফিরিয়ে দিবো উশান। বিশাল যন্ত্রণা দিবো। দূরে চলে যাবো। আমার গুরুত্বটা আপনাকে বুঝতে হবে। আমি এতো সস্তা নাকি? আমার অনুভূতির কোনো মূল্য নেই?’

হাতের দিকে গহীনে চোখে তাকায় মীরা। আচানক কষ্ট হচ্ছে। নিদারুণ কষ্ট! কামড়, খামচি, চিমটি, কিল – ঘুষি দিয়েও এতোটা কষ্ট হয়নি যতোটা কষ্ট এই মাত্র প্রায় পাচটা থাপ্পড় দিয়ে হয়েছে। থাপ্পড়টা না দিলে হতো না?স্বগোতক্তি করে নিজেকেই ধমক দেয় মীরা। লোকটার প্রাপ্য ছিলো এটাই। এভাবে এখন অনুশোচনা করার মানেই হয়না। পাশ ফিরে মীরা। মেঘের আড়াল হতে বেড়িয়ে এসেছে চাঁদ। চাঁদের স্বচ্ছ আলোয় উশানের মুখোশ্রী অতীব পবিত্র এবং শুদ্ধ লাগছে। ম্লান হাসে মীরা। নিম্ন সুরে বলে,

-‘ আপনাকে আমি যতো আঘাত, অবহেলা, বিরক্ত করিনা কেনো উশান! আপনি আজীবন আমার প্রেমিক থাকবেন। আমার না হওয়া প্রেমিক। আপনাকে হয়তো কখনোই ঘৃণা করতে পারবোনা আমি। আমার প্রণয় নগরের শেহজাদা আপনি! শুদ্ধতম পুরুষ আপনিই থাকবেন আমৃত্যু পর্যন্ত। ‘

চলবে…

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকাঃসাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব-২৪
____________

ভোরবেলা সর্বপ্রথম ঘুম ভাঙে মীরার। ঘুম থেকে উঠেই হুড়মুড়িয়ে সে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে।মূলত উশানের সামনে যাতে তার না পরতে হয় তারই কারণ বশত এমনটা করা। মীরা কুঁড়ে ঘরের সামনে থাকা খড়ি দিয়ে তৈরি রান্নাঘরের দিকে যায়। সেখানে হাশেম মিয়ার স্ত্রী রোজি এবং পাখি রান্না করছিলো তখন। মীরা তাদের সামনে গিয়ে মিষ্টি কন্ঠে বলে,

-‘ আসসালামু আলাইকুম আন্টি। ‘

‘ সুপ্রভাত ‘ শব্দটা কন্ঠনালি দ্বারা উচ্চারণ করতে গিয়েও থেমে যায় মীরা। সালাম করা উচিত এখন, অন্তঃকরণ হতে বার্তা এলো। রোজি সালামের উত্তর নেয়। ম্লান হেঁসে বলল,

-‘ রাতে তোমাগো ঘুমাইতে অসুবিধা হইছে? ‘

-‘ না আন্টি। আপনাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ রাতের বেলা আমাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য। ‘

-‘ হইছে থামো! তা তোমার ভাই কুণে? তারে দেহিনা যে? ‘

মীরা ইতস্তত বোধ করে জবাব দিলো, ‘ ও ঘুমাচ্ছে! ঘুম থেকে উঠতে দেরী লাগে তার। ‘

-‘ ওহ! যাও তুমি কলপাড় তে মুখ ধুইয়া আহো।খুদা লাগছে না? খাইতে দেই। ‘

মীরা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে কলপাড়ে আসে। মুখ ধুয়ে আসার পথে তার দৃশ্যমান হয় উশান কে। ঘুমু ঘুমু চোখে হাশেম মিয়ার সাথে হেঁসে কথা বলায় ব্যাস্ত সে। মীরা একটু অবাক হলো। এইতো সে আসার পথে দেখলো লোকটা গভীর ঘুমে মগ্ন! আর এখনি উঠে গেলো? এতো জলদি? অদ্ভুত! উশান মুখ ধুয়ে আসার পর দু’জনকে সকালের নাস্তা দেয়া হয়। নাস্তা শেষ করে হাশেম মিয়া এবং রোজির থেকে বিদায় নিয়ে উশান মীরাকে নিয়ে রওনা হয়। আসার পথে উশান বেশ কিছু টাকা দিয়ে আসে হাশেম কে। নিতে চাচ্ছিলেন না যদিও হাশেম মিয়া তবে পাখির পড়াশোনায় কাজে লাগবে বলে টাকা গুলো তার হাতে গুঁজে দিয়ে কৃতজ্ঞতা পেশ করে চলে এসেছে পাহাড় ছেড়ে জঙ্গলে। মীরা, উশান ২ জনই নিশ্চুপ, নির্লিপ্ত! মীরা চোখ মেলাতে পারছে না উশানের সাথে। কেনো?কে জানে!

-‘ মাথা ব্যাথা করছেনা? ‘

উশানের থমথমে কন্ঠস্বর। মীরা তটস্থ হলো। আমতা আমতা করে বলল,

-‘ কি আশ্চর্য! আমার মাথা ব্যাথা করতে যাবে কেনো?’

-‘ কাল রাতে ভাং খেয়ে মাতলামি করলে আর এখন বলছো মাথা ব্যাথা করবে কেনো? ‘

মীরা হকচকিয়ে উঠলো। ইশ! সে তো ভুল করে ফেললো একটা। কাল রাতে কৃত্রিম মাতালের মতো ব্যাবহার করার পর সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে সব ভুলে বসেছে। আলগোছে, উশানের দৃষ্টি অগোচরে কপাল চাপড়ালো মীরা। শান্ত হয়ে স্বভাবগত কন্ঠে বলল,

-‘ মাথা ব্যাথা করছেনা। একটু ভার হয়ে আছে শুধু।’

উশানের পাল্টা প্রশ্ন, ‘ কাল রাতের কথা কিছু মনে আছে? ‘

-‘উহ্.. না! মনে থাকার কথা নাকি? ‘

উশান সম্মুখে দৃষ্টিপাত ফেললো৷ অধর কোণে ফুটে উঠলো তেরছা হাসি। আলত স্বরে, বিড়বিড়িয়ে শুধালো,

-‘ ডাফার গার্ল! ‘

______

লোকালয়ে ফিরতে উশান, মীরার সময় লাগলো ১ ঘন্টার মতো। আরো আগে ফিরতে পারো তবে মীরা অত্যান্ত ধীর পায়ে হেঁটেছে। কালকের পায়ের আঘাতের নিদারুণ যন্ত্রণা এখনো আছে। তাই চাইলেও সে দ্রুত হাঁটতে পারেনি। নিজেদের ফ্লাটে এসে পৌঁছাতেই মাহদি দৌড়ে আসলেন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে উত্তেজিত হয়ে বললেন,

-‘ ঠিক আছো আম্মু? ‘

নম্র কন্ঠে মীরা প্রতিত্তুর করলো, ‘ জি বাবা। আমি ঠিক আছি। শান্ত হও! মায়ান কোথায়? ‘

-‘ মায়ান তো স্কুলে। আসো ভিতরে। উশান? তুমিও আসো। ‘

উশান বিরোধিতা পেশ করে বলল, ‘ না আঙ্কেল! অন্য কোনো সময় আসবো। আমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে আঙ্কেল! তাই একটু তাড়া আছে। পরে আসবোনে। ‘

-‘ আচ্ছা। এসো কিন্তু! ‘

উশান দ্রুত পদে বেড়িয়ে যায়। মীরা বাবার সাথে কথা বলতে জানতে পারে আহনাফ বিয়ে ভেঙে দিয়েছে যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে মীরা। যাক! একদিক তো ঠিক হলো। মাহদির সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে মীরা হাস ফাঁস করে বলল,

-‘ বাবা আমি ফ্রেশ হবো। জামাকাপড়ে ধুলোবালি লেগে আছে। ভালো লাগছেনা আমার। গা গুলিয়ে আসছে। পরে কথা বলবো তোমার সাথে। ‘

মীরা তড়িৎ বেগে প্রস্থান করলো কক্ষ হতে। মাহদি হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো। মেয়েটার খুঁতখুঁতে স্বভাবের পরিবর্তন তাহলে হলোই না।

_______

-‘ আর কতোবার গোসল করবি মীরা? ‘

রুহি হাই তুলে প্রশ্ন ছুড়লো। মীরা তখন নিজেকে আরশিতে দেখতে ব্যাস্ত। তোয়ালে দিয়ে ব্যাস্ত হাতে চুল মুছছে৷ দুই ঘন্টায় প্রায় সাত থেকে আটবার তার গোসল করা শেষ। তবুও বারংবার মনে হচ্ছে, ধুলোবালি, নোংরা যেনো তার সাথে এখনো মিশে রয়েছে। রুহির কন্ঠে মীরা পিছন তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে বলল,

-‘ বাহির থেকে এসে পা না ধুয়ে আমার বিছানায় বসতে তোকে মানা করেছিনা রুহি?নাম জলদি! ‘

রুহি বিরক্ত হয়। ভীষণ বিরক্ত! মেয়েটা একটু অতিরিক্ত করছেনা? বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে মীরার সন্নিকটে এগোল রুহি। ফ্লোরে বসে পড়ে বলল,

-‘ হইছে শান্তি এবার? মাটিতে বসছি। ‘

আঁড়চোখে রুহিকে দেখে নিজের কাজে তুমুল ব্যাস্ত হয় মীরা। রুহি দাঁত দিয়ে নখ কাটতে শুরু করলো। কিয়ৎক্ষণ বাদে হৃষ্টচিত্তে বলল,

-‘ তো সোনা! কাল রাত উশান ভাইয়ের সাথে কি কি করলা? ঝগড়া করছিস দু’জন? উশান ভাই আবার তোকে কিছু করছে? বকা দিছে?আঘাত করছে কোনো?’

-‘ আঘাত সে আমাকে করেনি। বরং আমি তাকে করেছি। ‘

রুহি চমকিত হয় বেশ। ওষ্ঠাধর গোল গোল করে জিজ্ঞেস করলো,

-‘ হোয়াট? ‘

কাল রাতের সম্পূর্ণ ঘটনা মীরা একে একে খুলে বলল। রুহি সবটা শুনে হাসতে গিয়েও থেমে গেলো। তার খটকা লাগছে বড্ড! সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠলো,

-‘ ওয়েট! ওয়েট! আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না তুই মিথ্যা মাতলামোর নাটক করে ভাইয়াকে এতো কষ্ট দিছিস আর ভাইয়া কিছুই বুঝেনাই৷ আমার সন্দেহ হচ্ছে জান! আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে উশান ভাই সব জানতো। জানতো তুই এক্টিং করছিস। দেখ এটা কিন্তু তেমন কোনো বড় ব্যাপার না। তাছাড়া ভাইয়া ডিফেন্স অফিসার!সে বেশ চতুর। তার সাথে এমন নাটক করলি তুই আর সে বুঝলো না? হোয়াট এ জোক্স!’

মীরা ভাবনায় পড়লো। একটু গভীর মনোযোগ সহকারে চিন্তা করার পর সে নিজেও বেড়াজালে ফেঁসে গেলো। আসলেই তো! রুহির কথাটা তো এতোটা হাল্কা ভাবে নেওয়া যাচ্ছেনা। কিন্তুসন্দেহ এবং প্রশ্ন এক জায়গাতেই। উশান যদি সব জেনে যায় ও তবে সে চুপ কেনো ছিলো?

_____

তীব্র শব্দ যোগে হাসছে। হাসতে হাসতে গাল ব্যাথা হওয়ার উপক্রম তবুও হাসি, অতীব চেষ্টা করেও থামানো যাচ্ছে না। দিগন্ত অতী কষ্টে নিজের হাসি চেপে রেখেছে। এখন হাসলেই বিপদ। মহা বিপদ! উশান স্যার দেখা যাবে হু হা করে হেঁসে দিলে তার চাকরি ধরে টান দিতে পারে। হাসি চেপে রাখা ভীষণ কষ্টসাধ্যকর কাজ দিগন্ত আজ তা হারে হারে টের পেলো। কোনোমতে সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

-‘ স্যার? একটু বাহির যাই? ঐ মানে.. প্রকৃতির ডাক এসেছে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাই স্যার?’

উশান জলদগম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘ যাও! ‘

দিগন্ত দৌড়ে রুম থেকে বের হয়। এখন সে মন – প্রাণ খুলে কতক্ষণ হাসবে অতঃপর রুমে প্রবেশ করবে।

তীব্র, দিগন্তের হাসির কারণ মূলত উশান। কাল রাতে মীরা তার সাথে যা যা করেছে তা সে সংক্ষিপ্ত করে তীব্রকে বলেছে। তেমনি দিগন্ত রুমে কাজে মহা ব্যাস্ত থাকার পরও উশানের সকল কথা মনোযোগ সহকারে কাজ ফেলে শ্রবণ করেছে। উশানের কথা শেষেই তীব্রের এই হাসি। উশান কড়া দৃষ্টিতে তাকালো। নিজেকে সামলায় তীব্র। লম্বা শ্বাস টেনে বলে উঠলো,

-‘ সিরিয়াসলি দোস্ত? তোর এতো ধৈর্য কোথা থেকে আসলো? এতো মার খাওয়ার রেকর্ড গড়লি তাও সেই মার খেয়েছিস ইচ্ছে করেই? ‘

-‘ ইচ্ছে করেই সহ্য করেছি। আর মীরা মাতাল ছিলো না। ভাং খায়নি ও। ইচ্ছে করে এমন ব্যাবহার করেছে আমার সাথে। গ্লাসে ভাং ঢেলে ও ফেলে দিয়েছিলো। অন্ধকারে অতোটা স্পষ্টত না দেখতে পেলেও কিছুটা দেখেছি। প্রথমে পাত্তা দেয়নি। দ্যান ও যখন মাতালের ব্যাবহার এবং কথা বলতে শুরু করলো তখন প্রথমেই বুঝে গিয়েছিলাম ও একদম ঠিক আছেনা। অন্ধকারে যা দেখেছিলাম ঐ দৃশ্যটুকু ছিলো ও যখন গ্লাস থেকে ভাং ফেলে দিচ্ছিলো। মীরা এমনটা করেছে মেইবি সেদিন সকালের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ‘

তীব্র চমকালো! রুমে মাত্র প্রবেশ করা দিগন্তও অবাক উশানের কথায়। তীব্র জিজ্ঞেস করলো,

-‘ সহ্য করলি? ‘

-‘ ইচ্ছাবশত! ‘

-‘ কেনো?’ তীব্রের বিস্মিত কন্ঠ!

-‘ কারণ এটার প্রাপ্য আমি। মীরার সাথে যা করেছি, যেই অপমান! তার বদলে ও আমাকে কমই আঘাত দিয়েছে। ‘

হাস্য-রসক পরিবেশ লহমায় গম্ভীরতায় পরিণত হলো। তীব্র তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করে আছে উশানের মুখোশ্রীতে। বোঝার চেষ্টা করছে উশানের অন্তঃকরণ। আসলে উশান চাইছেটা কি?
দিগন্ত হটাৎ বলে উঠলো,

-‘ স্যার! তূর্শী বাংলাদেশ আসছে। ও বাংলাদেশে আসলে আমরা ওকে কিডন্যাপ করি? তাহলেই তো যা জানার জানতে পারবো। কেনো আপনাকে জেলে পাঠালো অযথা! ‘

উশান মৌনতা বজায় রাখলো কিয়ৎক্ষণ। শেষে ফিচেল কন্ঠে বলল,

-‘ তার দরকার পড়বে না। আমার যা জানার ছিলো জেনে গিয়েছি। তূর্শী ইচ্ছে করে আমায় জেলে পাঠায়নি। ওকে ব্লাকমেইল করছিলো কেও। তূর্শীর আম্মুকে কিডন্যাপ করে আঁটকে রেখে বলা হয়েছিলো যাতে আমাকে মিথ্যা অভিযোগে জেলে পাঠিয়ে আমার জীবন থেকে দূরে চলে যায়। নয়তো ওর আম্মুকে মে’রে ফেলা হবে। তূর্শীর তখন বয়স কম ছিলো, বুদ্ধি কম ছিলো, আবেগী ছিলো। ভয় পেয়ে ওদের কথা মেনে নিয়েছিলো। কিন্তু ও যখন আমায় জেলে পাঠায় তখন কায়দা করে ও ট্রাই করেছিলো আমাকে জেল থেকে বের করার কিন্তু তখনই যারা ওকে ব্লাকমেইল করছিলো তারা তূর্শীর আম্মুকে মেরে ফেলে। তূর্শী ভেঙে পড়ে যখন মানষিক ভাবে তখন ওর কাজিন ওকে ক্যালিফোর্নিয়া নিয়ে যায়। ‘

তীব্র অবাক কন্ঠে বলল,

-‘ এতকিছু জানলি কি করে? আর মীরাকে দূরে রাখার কারণন তাহলে এটাই? ‘

-‘ হ্যা! আমার ক্ষতি চাচ্ছে কেও। মে’রে ফেলার চেষ্টায় ব্যার্থ হয়ে এখন আমার উইক পয়েন্টে আঘাত করছে।এই কারণেই মীরা কে শত অপমান করে নিজের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করি। এসব কে করছে? তা না জানা পর্যন্ত আই কান্ট হ্যান্ডেল মীরা! ‘

দিগন্ত কথার মাঝে ফোড়ন কেটে বলল,

-‘ এখানে মীরা ম্যামকে আগলে নেয়ার কথা বলছেন কেনো স্যার? ‘

তীব্র ম্লান হেঁসে উত্তর দেয়, ‘ হি লাভ’স মীরা! এতদিন ঢং করছে অযথা। ‘

চলবে…
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা.