হৃদয়েশ্বরী পর্ব-২৭+২৮

0
1095

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকাঃ সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব-২৭.
____________________

রজনীর কালচে অন্তরীক্ষ বর্তমানে মেঘাবৃত। মেঘ বলছে বৃষ্টি নামবে। কিয়ৎক্ষণ পর হলোও তাই। অম্বর হতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি আছড়ে পড়লো পৃথিবী পৃষ্ঠে। বৃষ্টির মিষ্টি সুর চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ঈষৎ বাদে নিষ্ঠুর, জোরালো আর্তনাদে ফেটে পড়ছে অম্বর। ঝিলিক দিচ্ছে বারংবার। ক্ষীণ বাদে বৃষ্টির তেজ বাড়লো। উশান সিক্ত হয়ে টইটুম্বুর।খানিকটা এগোতেই নেটওয়ার্ক কানেকশন ডিসকানেকটেড হয়ে যায় ব্লুটুথ থেকে। জোড়াল শ্বাস ফেলে বাইক থামায় উশান। চার – পাঁচটা হাচি দেয় পরাপর।সে জানতো নেটওয়ার্ক কানেকশন ডিসকানেকটেড হয়ে যাবে। তাই আগে থেকেই পূর্ণ ব্যাবস্থা গ্রহণ করে এসেছে। তবে তার কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য তেজস্বী বর্ষণের থামার দরকার। কিন্তু বর্ষণ যে থামার নামই নিচ্ছে না। এদিকে হাতে সময়ও খুব সীমিত।

পনেরো মিনিট পর বৃষ্টি থামলো পুরোপুরি। তবে অম্বর হতে আসা গর্জন জানান দিয়ে রাখছে বর্ষণ আসবে আবারও। উশানের পরনের শার্টটা খুলে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে। তার গায়ে এখনো এঁটে সেঁটে রয়েছে পাতলা কালো রঙের টিশার্ট। উশান নিজের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট ব্যাগ করলো। অতঃপর ওষ্ঠাধর দু’টো গোল করে শিষ বাজালো। একবার, দুইবার, তিনবার..! সিক্ত মাটিতে পড়ে থাকা শুষ্ক ঝড়ে পড়া পাতায় মচমচ শব্দ প্রতিফলিত হয় উশানের কর্ণকুহরে। মৃদু হাসে উশান। আসছে তাহলে! ঈষৎ বাদে জঙ্গলের বাম দিক হতে লেজ নাড়াতে নাড়াতে বেড়িয়ে আসে এক নেড়ি কুকুর। উশান হাঁটুগেড়ে বসে ইশারায় কুকুরটাকে ডাকলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

-‘ মিস মি লিও? ‘

চেঁচিয়ে উঠলো লিও। উশান তার হাতে থাকা মাংসের প্যাকেট লিওর সামনে দেয়। তৃপ্তি সহকারে খাওয়া শুরু করলো লিও।
লিও উশানের এককালীন পোষা কুকুর। ফারদিনের বাসায় থাকার সময় উশান লিওকে পুষতো। তবে ঢাকায় চলে যাওয়ার পর আর লিও’র সাথে তার যোগাযোগ ছিলোনা। উশান চলে যাওয়ার পরপর লিও জঙ্গলের ঠিক এই জায়গাতেই বসবাস করে। উশান জানতো তা! ঠিক এই জায়গায় এসে উশান চির-পরিচিত শিষ বাজালে লিও ছুটে আসতো তার প্রিয় মনুষ্য ব্যাক্তির নিকট।

লিও’র খাওয়া শেষ। উশান ব্যাগ থেকে পলিথিনে মোড়ানো প্যাকেট’টা আনলো। লিও এগিয়ে আসে ছুটে। উশান কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে বলল,

-‘ উঁহু! এটা তোর খাবার না। পিছে সর!

লিও বুঝলো হয়তো উশানের কথা। সে পিছু হটলো।পলিথিন থেকে মীরার পোশাক বের করে উশান। আসার পথে রুহির থেকে নিয়ে এসেছিলো সে।লিওর নাকের কাছে মীরার পোশাক ধরলো উশান। গন্ধ শুঁকে লিও। তারই মধ্যে লিও’র গলায় উশান একটা লোহার চেইন লাগিয়ে পিঠে নিজের ব্যাগ ঝুলিয়ে নেয়। লিও’কে বলে,

-‘ চল লিও! ওকে আমাদের খুঁজতে হবে। ‘

লিও ছোটা শুরু করলো। লোহার চেইনটা শক্ত করে ধরে উশানও ছুটছে লিওর পিছন। জঙ্গলের মাঝে যাচ্ছে তারা। লিওর ছুটে চলার গতী বাড়ছে ক্ষণে ক্ষণে। উশান এতোটা ছুটে ক্লান্ত হলোনা। অভ্যাস আছে তার। তাছাড়া, মাদকতা যখন অন্যত্রে পড়ে, তখন ক্লান্তিরা আর কিভাবে ভর করে দেহে?

লিও গন্ধ শুঁকে শুঁকে থামলো পরিত্যাক্ত তেলের গোডাউনের সামনে। উশানের ধারণা ছিলো মীরাকে এখানেই নিয়ে আসা হয়েছে। লিও গেলো সিক্ত এক বস্তার নিকট। সেখানে দাঁড়িয়ে সে জিহ্বা বের করে শ্বাস টানছে। উশান এগোল। তার বোধগম্য হলো মীরাকে এই বস্তায় করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।তবে একটা বিষয়ে খটকা লাগে উশানের। বাহিরে কোনো পাহারাদার নেই কেনো?অদূরে কাওকে দৃশ্যমান হচ্ছে না। তাহলে কি শুভ্র মীরাকে অন্যত্রে সরিয়ে ফেলেছে?

লিওর গলা থেকে লোহার শিকলটা খুলে ফেললো উশান। লিওকে মুক্ত করে কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

-‘ ফিরে যা লিও। এবার ঢাকা যাওয়ার পথে তোকে নিয়ে যাবো সাথে। এটা তোর আমায় হেল্প করার গিফ্ট! ‘

লিও লেজ নেরে অসম্মতি জানালো। উশান দম ফেলে৷ আদেশের সুরে বলে,

-‘ যেতে বলেছিনা আমি তোকে? ‘

ক্ষেপাটে উশানকে এই পশুটাও বোধহয় ভয় পায়। সে উশানের হাতে গাল ঘষে জঙ্গলের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেলো। জোড়াল শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো সে।অন্তঃকরণ হুহু করছে! মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ তখন ছটফটে। সামনে এগোল উশান। আস্তে করে সদর দরজা খোলার পর দর্শন হয় তার চক্ষু সম্মুখে ২ জন ব্যাক্তিকে। তারা দু’জন আপনমনে খেজুরে আলাপে তুমুল ব্যাস্ত। সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলটা হাতে নিলো উশান৷ দ্বিতীয় হাতে তার ধারালো ছু’রি। সর্বপ্রথম গুলি ছুড়লো সে এক লোকের মাথায় এবং দ্বিতীয়বার সেকেন্ডের মাঝেই অপর লোকটিকে চেঁচানোর সুযোগ না দিয়ে তার হৃদপিণ্ড বরাবর ছু’রি ছুঁড়ে মারলো। দু’জন একসাথে পড়ে গেলো ভূমিতে। প্রাণহীন দেহ! উশান দু’জনের হাত ধরে সদর দরজার বাহিরে ফেলে রেখে ভিতরে প্রবেশ করে।

আশপাশে বড়সড় তেলের ড্রাম। এসব ছাড়া বাদ বাকি অন্য কিছু দর্শন হচ্ছেনা উশানের। উশান নিম্ন সুরে আনমনে বলল,

-‘ হোয়ার আর ইউ মীরা? হোয়ার আর ইউ?’

উশান আরো অন্তরালে প্রবেশ করে। হাতে তার র’ক্ত মাখো মাখো ছু’রি আর পিস্তল। ক্ষীণ বাদে ফের দৃশ্যমান হয় চারজনকে মেশিনগান হাতে নিয়ে পাহারা দিতে। উশান আড়ালে দাঁড়িয়ে ছক কষে কিভাবে এদের সামলাবে। পরিশেষে সে উপস্থিত লোক ৪ জনের চক্ষু আড়ালে এক তেলের ড্রামের পাশে গিয়ে দাড়ালো। লোক ৪জন হাঁটছে। দুইজন উশানের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে নিলেই উশান ২ হাতে দু’জনের মুখ চেপে আড়ালে এনে নিঃশব্দে ঘাড় বাঁকিয়ে মেরে ফেলে দু’টোকে। বাকি দুজনকে পিস্তল দিয়ে গু’লি করেই মা’র’লো। অতঃপর সেই কাঙ্খিত স্থান! শুভ্র বসে মাথার চুল মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে। তার পাশে দাঁড়িয়ে জবুথবু অবস্থায় তিনজন। উশান পাশে চেপে দাঁড়ায়। শ্রবণ করার প্রয়াস চালায় তারা কি কথা বলছে৷ নীরবতা ধ্বংস করে শুভ্র প্রলয়কারী হুংকার দিয়ে বলল,

-‘ তোরা এতো জন এখানে থাকা অবস্থায় ঐ মীরা কেমনে গায়েভ হইলো?কি করতাছিলি তোরা? অপদার্থের দল! মীরা’রে যেখান থ্যাকা পারোস খুঁজে আন যা।’

চিন্তাগ্রস্ত হয় উশানের অন্তরাল। মীরা নেই? তবে কি পালিয়েছে? পালাতেই পারে। মেয়েটার সাহস আছে অনেক। বুদ্ধিমতীও৷ কিন্তু সে এখন কি করবে?আগে মীরাকে খুঁজবে নাকি শুভ্রের দলবল কে ধরবে? তার অফিসিয়াল কার্যক্রম হিসেবে তাকে এখন শুভ্রদেরই ধরা উচিত। এদিকে দায়িত্বে হেলাফেলা করা তার কষ্নিকালেরও পছন্দ না।সে কাজ প্রেমী মানুষ। দোটানায় থাকাকালীন প্রকৃতিই বলে দিলো তার কি করা উচিত! শুভ্রকে দেখে ফেলেছে উশানকে। তাকে দেখে হাসতে হাসতে করতালি দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। শুভ্র কুটিল হেঁসে জিজ্ঞেস করলো,

-‘ এসে পড়লেন? এতো জলদি! বাহ! প্রেমিকার প্রতি এতো ভালোবাসা? ‘

উশান পিস্তল সন্তপর্ণে পিঠের পিছে গুঁজে পকেটে হাত দিয়ে হেলতে- দুলতে সামনে আসে। শুভ্র হতে তার দুরত্ব চার ফিট দূরে দাঁড়ায়৷ তাচ্ছিল্যের কন্ঠে শুধালো,

-‘ কি কিডন্যাপ করিস যে একটা মেয়ে তোদের এতো গুলো লোকের চোখের ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেলো? লজ্জা লাগেনা? ‘

-‘ মেয়েটার ওপর ইন্টারেস্ট থাকলে তো আমি তারে আঁটকায় রাখতাম কড়া সিকিউরিটি দিয়ে অফিসার। আমার তো তাকে না তোকে চাই!তোমারে মেরে তারপর নিজে মরবো। ‘

ফিচেল হাসলো উশান৷ একহাত পিছে নিয়ে গুঁজে রাখা পিস্তল বের করে ক্ষনিকের মধ্যে তিনটে ছেলের চক্ষু আড়ালে তাদের হৃদপিণ্ড বরাবর গুলি করে৷ নিষ্প্রাণ দেহ তৎক্ষনাৎ প্রাণহীন রূপে ভূমিতে আছড়ে পড়ে। শুভ্র বিচলিত হয় কিঞ্চিৎ। পরবর্তীতে নিজেকে সামলে নিয়ে হালকা হেঁসে বলল,

-‘ জিনিয়াস হাহ্! ‘

-‘ তোর মতো বেকুব নাকি সবাই? তোর বাবা কতো শতো পাপ কাজ করেছে। এমনকি তোর মাকে অব্দি নিজের চামচাদের দিয়ে ধ’র্ষ’ণ করিয়ে তারপর মে’রে’ছে। তুই কিনা সেরকম এক ব্যাক্তির মৃত্যু প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছিস!ষ্টুপিড! ‘

শুভ্রকে দারুণ আশ্চর্য দেখালো। চঞ্চল নেত্রযুগল প্রশ্ন ভরা। বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-‘ মা..মানে? কিসব বলছেন? ‘

পকেট থেকে নিজের ফোন বের করে কাঙ্খিত কিছু বের করে সে শুভ্রের পানে ছুঁড়ে দিলো। ফোন ক্যাচ ধরে শুভ্র। উশান ইশারায় বলল, ফোন দেখতে। শুভ্র মনোযোগী হয় সেদিকে। ঘাড় কাত করে বাম দিকে তাকাতে নিবে তৎক্ষনাৎ তড়িৎ বেগে মীরা কোথা হতে যেনো ছুটে আসলো। এসেই ঝাপটে ধরলো উশানকে। ভীষণ শক্ত করে উশানকে আঁকড়ে ধরে মুখ লুকালো উশানের বক্ষঃস্থলে। উশান হতবিহ্বল! আস্তেধীরে সেকেন্ড খানেকের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে মীরাকে আগলে নিলো তার উষ্ণ আলিঙ্গনে। বলল,

-‘ মীরা? ঠিক আছো? কোথায় লুকিয়ে ছিলে? ‘

মীরা ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। দাঁত দিয়ে ওষ্ঠ চেপে ধরে কোনোমতে বলল, ‘ আপনি সত্যিই এসেছেন নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি? ‘

উশান মৃদু হাসলো। শেষে নিচু হয়ে মীরার কানের পিঠে হিসহিসিয়ে বলল,

-‘ আ’ম হেয়ার! আই উইল অলওয়েজ বি হেয়ার। ফিল ইট গার্ল! ‘

মীরা ফুপাতে ফুপাতে আলিঙ্গন নিবিড়, শক্ত, দৃঢ় করলো আরেকটু। উশানের উষ্ণ বক্ষ পিঞ্জরে নাক ঘসলো। ইশ! মেয়েটা যদি হুঁশে থাকতো। তাহলে লজ্জায় মারা যেতো নিশ্চিত। উশানের ব্যাস্ত নেত্র যুগল তখন পরখ করছে মীরাকে। শুভ্রের প্রতি তার খেয়াল নেই। মীরা’র উপরিভাগে আঘাত লেগেছে কিনা কোনো তা দেখতে ব্যাস্ত তার নেত্র জোড়া। সঙ্কোচ পায়ে ঠেলে মীরার ঘাড়ের কাছের ওড়নাটা সরায় উশান। সেখানে বেশ কয়েকটা ফুটো। যেমনটা ইনজেকশন পুশ করলে হয়ে থাকে। মস্তিষ্কের শান্ত স্নায়ু দপ করে অস্থিতিশীল হলো তার। শুভ্রের প্রতি দৃষ্টি ফেলে গর্জে উঠে জিজ্ঞেস করলো,

-‘ ওকে কিসের ইনজেকশন দিয়েছিস? ‘

শব্দহীন ক্রন্দনে ব্যাস্ত ছিলো শুভ্র। উশানের হটাৎ গর্জনে কেঁপে উঠে ফোন থেকে দৃষ্টি সরালো। হাতের ফোন ফেলে দিলো পাশে। অতঃপর নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলল,

-‘ প’য়ে’জন! টেক টু হার হসপিটাল আর্লি। ‘

অনুভূতিশূন্য মস্তিষ্ক। নিষ্প্রভ নেত্রে মীরার প্রতি দৃষ্টি ফেলার পর খেয়াল করলো মীরা তখন অচেতন। পিছনের পোশাক রক্তে মাখামাখি। মেয়েটাকে কি তবে সে হারাতে চললো? ‘

চলবে…

[ রি-চেইক করা হয়নি। ]

#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকাঃ সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব-২৮.
___________________

-‘ মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী মিস. মীরা কখনো মা হতে পারবেনা স্যার। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম প’য়ে’জ’ন যাতে গুরুতর ক্ষতি না করে কিন্তু আপনি একটু বেশিই লেট করে ফেলেছেন পেশেন্টকে হসপিটালে আনতে।এন্ড দিস টাইম! উই হ্যাভ নাথিং ইলস্ টু ডু স্যার! ‘

উশান কিংকর্তব্যবিমূঢ়!নিষ্প্রাণ, অনুভূতিশূন্য নেত্রে চাইলো সম্মুখে। কাঁচের দেয়ালের ওপারে মীরা। মাহদির কোলে মাথা রেখে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।আচ্ছা মেয়েটা যদি জানতো সে আর কখনোই মা হতে পারবেনা তখনো কি এমনই ভাবে শান্তিতে ঘুমোত? নিজেকে বোকার মতো একটা প্রশ্ন করে বসলো উশান। তার অন্তঃকরণের দশা বেহাল প্রায়। মীরার এ অবস্থার জন্য অবশ্যই সে দায়ী। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলো উশান নিজের থেকে মীরাকে দূরে দূরে রাখার। কতো অপমান, অবহেলা করেছে মেয়েটাকে সে, একমাত্র মীরার সুরক্ষার কথা চিন্তা করে। কিন্তু সেই তো মেয়েটাকে ঠেলে দিলো সে বিপদ সম্মুখে।

ডা.রাহি গভীর দৃষ্টিতে দেখছিলেন উশানকে।তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক সময়কার পাথর মনের অধিকারী মানুষটার পরিবর্তন স্ব-চোখে বিষ্ময় নিয়ে দর্শন করছেন। তীব্রের থেকে শুনেছিলো সে যদিও। তবুও বিশ্বাস করেননি। এবার স্পষ্টত নিজ নেত্র দ্বারা দর্শন করে তার হতভম্ব হওয়ার উপক্রম।রাহি ধাতস্থ করে নিজেকে। গলা ঝেড়ে ফের বলে,

-‘ স্যার! উনাকে প’য়ে’জ’ন দেয়াই হয়েছিলো যেনো সে আর কখনো মা না হতে পারে তারজন্য। যার কারণে পেশেন্ট মারা যায়নি। জীবিত এবং সুস্থ আছে। জাস্ট রক্তক্ষরণ হয়েছে একটু। এতটুকুই! ‘

-‘ আপনি যান। ‘ রাশভারী কন্ঠের জবাব।

রাহি দ্রুত সেখান হতে প্রস্থান করলো। উশান কাঁচের দরজা ঠেলে কেবিনে প্রবেশ করে। মাহদি উশানকে দেখে নড়েচড়ে বসলো। জিজ্ঞেস করলো,

-‘ বাবা? ডাক্তারের সাথে কথা বলছিলে দেখলাম। কি বলল সে? মীরা সুস্থ আছে না? গুরুতর কিছু? ‘

তন্দ্রাচ্ছন্ন মীরার প্রতি নরম চোখে তাকালো উশান। কন্ঠের খাদ নামিয়ে জবাব দিলো,

-‘ মীরা সুস্থ আছে আঙ্কেল। কিন্তু.., প’য়ে’জ’ন এর ব্যাড এফেক্টের কারণে ও কখনো মা হতে পারবে না। এমনিতে ও এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ‘

মাহদি মৌন! লোকটার অন্তঃকরণের ভাষা পড়তে পারলো না উশান। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মাহদি এখন কিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে? তা সম্পর্কে তার ধারণা নেই। তবে সে চাইছে, বাবা হিসেবে মাহদি শক্ত থাকুক। মীরাকে সামলাতে হবে তো! মিনিট খানেক পর মাহদি বলল,

-‘ মেয়েটা আমার বেচে আছে এটাই আমার কাছে যথেষ্ট উশান। ও মা হতে পারবে না! এটা নিয়ে আমার আপাতত কোনো দুঃখ, কষ্ট নেই। মেয়েটা আমার এই কঠিন সত্যটা সহ্য করতে পারলেই হলো। ‘

নিভৃতে ভীষণ স্বস্তি পেলো উশান। মাহদির থেকে এমন ব্যাবহার, এমন বক্তব্যই আশা করছিলো সে। ঈষৎ বাদে সে বলল,

-‘ আই থিঙ্ক! মীরাকে এখন এই ব্যাপারটা না জানানোই ব্যাটার হবে আঙ্কেল। এমনিতেই ও এখন মেন্টালি ডিপ্রেসড! এই কথাটা শুনলে আরো অবস্থা খারাপ হতে পারে। ‘

-‘ হুম। ‘

উশানের ফোন বেজে উঠলো। পকেট হাতড়ে ফোন বের করে কর্ণারে যায় উশান। পুলিশ অফিসার ফোন দিয়েছে। রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে অপাশ হতে ব্যাস্ত কন্ঠে বলা হলো,

-‘ স্যার আপনি শুভ্রকে এতোটা বাজে ভাবে মেরে ফেলেছেন।এখন হেড ডিপার্টমেন্টে আমরা কি জবাব দিবো স্যার? ‘

উশান রাশভারী কন্ঠে প্রতিত্তুর করলো,

-‘ হেড ডিপার্টমেন্টকে আমি দেখবো অফিসার। আপনি লাশ নিয়ে থানায় ফিরুন। ‘

-‘ ও.কে স্যার! বাট আপনাকে এখনই থানায় আসতে হবে। এসিপি স্যার, আপনাদের গ্রুপ ক্যাপ্টেন এসেছেন সেখানে। এখনই কথা বলে নিলে ভালো হতো। ‘

-‘ আসছি আমি। ‘

ফোন কেটে পকেটে ঢোকায় উশান। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোলো সামনে। মাহদির নিকট এগিয়ে এসে বলল,

-‘ আঙ্কেল! আমাকে যেতে হবে একটু। আসি? আমি রাতে আসবো৷ থানায় যেতে হবে এখন। মীরাকে যে কিডন্যাপ করেছে, কেনো করেছে তা সম্পর্কে! ‘

-‘ আচ্ছা বাবা। তোমার আছে আমি কৃতজ্ঞ। তুমি আছো তাই হয়তো আমার মেয়েটা এখনো বেঁচে আছে। পুলিশের কাছে বললে হয়তো তাদের খুঁজতে খুঁজতে আমার মেয়েটাই মারা যেতো। ‘

উশান বিড়বিড়িয়ে নিম্ন কন্ঠে শুধালো, ‘ আমার জন্যই আজ আপনার মেয়ের এ অবস্থা আঙ্কেল। শুধুমাত্র আমার জন্য। ‘

তীব্রকে সঙ্গে করে উশান চলে যায়। মাহদি মীরার মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে দিয়ে মেয়ের গায়ে কাঁথা টেনে উঠে দাঁড়ায়। তার নেত্র কার্নিশে অশ্রুকণা। সে কাঁদছে? আজকের এই পরিস্থিতিতে মাহদি একবার ভেবেই নিয়েছিলো মেয়ে হয়তো তার আর সুস্থ রূপে ফিরে আসবে না৷ এশারের নামাজ শেষে আল্লাহ তায়ালার নিকট মাহদি দু’হাত তুলে দোয়া করলো, শুকরিয়া আদায় করলো আল্লাহর নিকট। ছেলেরা কাদেনা সহজে। কিন্তু বাবার সন্তানের কষ্টে অল্পতেই কেঁদে ফেলে! মাহদি কাঁদলো কিয়ৎক্ষণ। নিরবে, নিভৃতে, আপনমনে!

________

তখন সাঝবেলা! ঘুমের ঔষধের প্রকোপ কেটে গিয়ে মীরার তন্দ্রা কেটেছে ক্ষীণ সময় পূর্বে। রুহি তাকে স্যুপ খাওয়াচ্ছে। মায়ান মীরার কোলে মাথা রেখে বোনের সাথে নানান কথা বলছে, মাহদি নেই কেবিনে! বাহিরে গিয়েছে জরুরি কিছু ঔষধ আনতে৷ সবাই ব্যাস্ত। জাগতিক ভুবন হতে বিছিন্ন কেবল মীরা। সে ভাবছে কিছু। মনোযোগ সহিত।তার বারংবার মনে হচ্ছে জ্ঞান হারানোর পূর্বে সে এক বলিষ্ঠ দেহী পুরুষকে জরিয়ে ধরেছিলো৷নিবিড় বন্ধনে আবেষ্টিত ছিলো। কিন্তু কে ছিলো সেই পুরুষ? তা মস্তিষ্কের ওপর তুমুল জোর দিয়েও মীরা মনে করতে পারছেনা। অচেতন হওয়ার পূর্বকার কোনো ঘটনাই তার মনে নেই। মনে করতে পারছে না।দেখা যায়, মনে করতে গেলেই মাথায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়। মীরা এদিক সেদিক তাকালো।কাওকে খোঁজার চেষ্টা করলো। মন পিপাসু যাকে চাচ্ছে, স্নায়ুকোষ বলছে সে নেই! নেই এখানে, তার আশেপাশে। এতকিছুর পরও বেহায়া মন সেই সুদর্শন মুখোশ্রী দর্শণ করার লালসায় ছটফট করে ভীষণ। ভীষণ করে! খাওয়ার মাঝে নাক সিটকেঁ নিলো মীরা। বলল,

-‘ কি ছাইপাঁশ খাওয়াচ্ছিস? আমি খাবোনা আর। ‘

রুহি আরেক চামচ মীরার ওষ্ঠাধর সম্মুখে তুলে ধরে বলল,

-‘ ছাইপাঁশ না জান৷ ইট’স পুষ্টি! হা করো। ‘

কড়া দৃষ্টিতে তাকালো মীরা। রুহি হাসঁফাসঁ করলো।উদ্বেগ নিয়ে বলল,

-‘ এভাবে তাকাবি না কতদিন বলছি? আমার রুহ্ বের হয়ে আসতে চায়। এই অসময় মরে গিয়ে নিজের জামাইটাকে আমি বিপত্নীক করতে চাই না?’

মীরা বিরক্তিমাখা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-‘ জামাই? নতুন বয়ফ্রেন্ড পেয়ে গিয়েছিস?’

-‘ আরে না! ভবিষ্যতের কথা বলতেছি।নে খা! হা কর জলদি। উফ্! আমার মনে হচ্ছে আমি আমার বাচ্চারে খাওয়াচ্ছি। অথচ বিয়েই করলাম না এখনো।ইট’স পেইন ড্যাম!হা করো বাবু হা..।’

রুহির উদ্ভট কথা শ্রবণ করে মীরা খাওয়া শেষ করলো। হাতে স্যালাইন চলছে তার। স্যালাইন শেষ হলেই রিলিজ দেয়া হবে। মাহদি আসলো ঈষৎ বাদে। সবকিছু ভুলে বাবার সাথে আদুরে আলাপে ব্যাস্ত হলো মীরা। বাবা পাশে থাকলে তার পুরো পৃথিবীটা তখন ফিকে হয়ে পড়ে।

_____

সময় প্রবাহিত হওয়ার সাথে সাথে মীরার পুরোনো ঘটনা সব মনে পড়ছে। মনে পড়ছে শুভ্রের দলের সেই লোকদের বাজে স্পর্শ করার মূর্হত। মনে পড়ছে শুভ্রের সেই বাজে কুরুচিপূর্ণ দৃষ্টি! তিক্ততার মাঝে আবার এক মুঠো প্রশান্তির প্রয়াসে মনে পড়েছে উশানকে জরিয়ে ধরার মূর্হত। নির্মেদ গাল দু’টোর অবস্থা রক্তিমতায় ছেয়ে বেহাল তখন। সে এতোটা নির্লজ্জ কি করে হলো? হোক না উশান প্রেমিক পুরুষ তার। লোকটা তো পর-পুরুষ’ই তাই না? সে কিভাবে জরিয়ে ধরলো লোকটাকে এভাবে?

ডিভানে বসেছিলো মীরা। মাহদি দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো রুমে। হাতে তার পানি ভর্তি গ্লাস আর ঔষধ।মীরা এগোল সম্মুখে। প্রশ্ন করলো,

-‘ ঘুমাওনি বাবা? ‘

-‘ এখনি ঘুমাবো। তোমার ঔষধটা দিতে আসলাম।’

-‘ আমিই খেয়ে নিতে পারতাম তো বাবা। যাইহোক, নিজের ঔষধ খেয়েছো? ‘

মীরা ঔষধ মুখ নিয়ে গ্লাসে ওষ্ঠাধর স্পর্শ করতে করতে জিজ্ঞেস করল। মাহদি হেঁসে সায় জানায়। মীরা ফের জিজ্ঞেস করে,

-‘ রুহি, মায়ান! ওরা দু’জন কই বাবা? ‘

-‘ ডাইনিং রুমে। খাচ্ছে! রুহি তো কাল সন্ধ্যা থেকে তোমার চিন্তায় খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে বসে আছে। মায়ানও একই! জোর করে রাতে একটু খাইয়েছিল রুহি। ‘

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবাকে ঘুমোতে বলে মীরা এগোল ডাইনিং রুমে। পথিমধ্যে যাওয়ার সময় কলিংবেল এর শব্দে ভ্রু’কুটি কুঁচকে নেয় সে। রুহি ডাইনিং রুম থেকে মীরাকে দেখে চেঁচিয়ে বলল,

-‘ তুই ঘুম বাদে এখানে কি করিস? রেস্ট করতে বলল না ডক্টর?’

দরজা খুলতে উঠে আসছিলো রুহি। মাঝে প্রশ্ন করলো। মীরা রুহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

-‘ খা তুই! আমি দেখি কে আসলো। ‘

সদর দরজা খোলার পর সম্মুখে দৃশ্যমান হয় তার উশানকে। পরনের সাদা টিশার্ট সিক্ত। সিক্ত কেশ হতে বিন্দু বিন্দু পানি গড়িয়ে পড়ছে কাঁধে। এতো রাতে উশানকে দেখে চমকালো মীরা।চমকিত স্বরে বলল,

-‘ আপনি এতো রাতে? ‘

উশান মোলায়েম কন্ঠে বলল, ‘ কথা ছিলো। তুমি কি ঘুমোচ্ছিলে? ‘

-‘ নাহ আসুন। ‘

ড্রইং রুমের সোফায় উশানকে নিয়ে আসে মীরা। সিঙ্গেল সোফায় বসে কৌতূহলী দৃষ্টিপাত ফেললো উশানের প্রতি। উশান বসেনি। তার পোশাক সিক্ত। বৃষ্টিতে ভিজে এসেছে। তোয়ালে এগিয়ে দিয়ে মীরা জিজ্ঞেস করল,

-‘ বৃষ্টির মাঝে ভিজে এলেন কেনো?ছাতা কোথায়?’

-‘ পুলিশ স্টেশন থেকে এসেছি।সেখানে যাওয়ার সময় সঙ্গে ছাতা নেইনি। ‘

সিক্ত কেশ গুচ্ছো মুছার পরও উশান বসলো না। মীরা ‘ বসুন ‘ বলতে গিয়েও থেমে যায়। ক্ষীণ দূরে রুহি আঁড়চোখে একবার দু’জনকে পরখ করে মায়ানকে খাওয়াতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।উশান থেমে থেমে বলল,

-‘ শুভ্র তোমাকে কিডন্যাপ কেনো করেছে জানো?’

-‘ হু জানি। ও মনে করেছিলো আমি আপনার প্রেমিকা। তাই আমাকে কিডন্যাপ করে আপনাকে ব্লাকমেইল করে সেখানে নিতে চাচ্ছিলো যাতে শুভ্র সহজে আপনাকে হাতের কাছে পায় আর হ’ত্যা করতে পারে। ‘

মীরার সোজাসাপ্টা উত্তর। উশান বোধহয় একটু চমকালো। জিজ্ঞেস করল,

-‘ জানলে কি করে? ‘

-‘ ওদের কথোপকথনে বুঝেছি। ‘

-‘ তো! এবার বুঝতে পেরেছো আমায় তোমাকে দূরে রাখার কারণ? অযথা, অহেতুক কারণে তোমায় অপমান করার কারণ? ‘

মীরা বেশ দেরী করে উত্তর দিলো। বলল, ‘ না।’

-‘ তোমার সেফটির জন্য মীরা। যদিও লাভ হলোনা কিছুই। তোমাকে শেষ পর্যন্ত সেইফটি দিতে পারলাম কোথায়? আমার লাইফটা অতো সহজ না মীরা যতোটা তুমি বা তোমরা মনে করো। ‘

মীরা মৌনতা পালন করলো। অতঃপর কৌতূহলী কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,

-‘ আপনার লাইফটা সহজ হলে বুঝি আমায় মেনে নিতেন? ‘

প্রতিত্তুর পাওয়া গেলো না। হাল ছেড়ে দিলো মীরা। নিজ থেকে এরূপ প্রশ্ন করাটা ভুল হয়েছে বৈকি।সে নির্লজ্জ! চরম মাপের নির্লজ্জ! হাতের কালো রঙের ঘড়িতে সময় দেখে উশান বেড়িয়ে যেতে যেতে বলল,

-‘ কিছু প্রশ্ন, প্রশ্ন আকারেই থাকা ভালো মীরা। এরূপ প্রশ্নের উত্তর না জানাই শ্রেয়।ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করো। সেখানে হয়তো হবে নতুন কিছু। নতুন যাত্রার সূচনা। এন্ড নাউ! ইউ শুড টেক রেস্ট। ‘

‘ নতুন যাত্রার সূচনা। ‘ তিনটে শব্দ বহুবার মস্তিষ্কে আওড়ালো মীরা। কিন্তু বুঝতে পারলো না কিছুই।কি আশ্চর্য! উশানের এরূপ কথা বলার মানে কি?কিসের ইঙ্গিত দিয়ে গেলো সে?

চলবে…
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা