#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা- সাদিয়া মেহরুজ দোলা
| পর্ব-৩১|
তখন সকাল নয়টা ছুঁই ছুঁই! মীরার বাসার নিচে উশান ব্যাস্ত পায়ে পায়চারি করছে৷ তার আপাতত চাওয়া মীরাকে শেষবারের মতো দেখা। আজ তাকে ক্যালিফোর্নিয়া যেতে হবে। বিকেল পাঁচটায় ফ্লাইট। এখান থেকে ক্যাম্পে গিয়ে ক্যাপ্টেনের সাথে সাক্ষাৎ করে বিকেলে নিজের টিমের সাথে রওনা দিবে সে। অস্থির নেত্র বারবার ঘড়িতে সময় দেখছে সে।মীরা আজ এখনো বারান্দায় আসছে না কেনো?মেয়েটা তো ভোর বেলাতেই ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় আসে ফুল গাছে পানি দিতে। কিন্তু আজ?উশান প্রায় তিন ঘন্টা যাবৎ দাঁড়িয়ে মীরার বাসার নিচে। কিন্তু সকাল থেকে মেয়েটার দর্শন পেলো না বিন্দুমাত্র!
পকেট থেকে ফোন বের করে রুহির নাম্বারে কল দেয় উশান। ক্ষীণ বাদে রুহি ফোন রিসিভ করতেই উশান প্রশ্ন ছুড়লো,
-‘ তুমি কি বাসায় রুহি? ‘
অপাশ হতে জবাব আসে ভেঙে ভেঙে,
-‘ না ভাইয়া৷ আমি মায়ানকে নিয়ে বাহিরে এসেছি। আমার খালামনির বাসায়। কেনো? ‘
-‘ মীরাও কি তোমাদের সাথে? ‘
-‘ নাহ। ও তো বাসায়। ঘুমোচ্ছে! সকালবেলা আঙ্কেল ডাকলো কতক্ষণ, আমি আসার সময় ডেকে এলাম। উঠলো না! মীরা বাসায় একা।আঙ্কেল ঢাকা গিয়েছে। ‘
-‘ ওহ্! আমার মীরার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিলো তাই তোমাকে ফোন দিয়েছি। ‘
-‘ আপনি বাসায় যান ভাইয়া। বাসায় বুয়া আছে। আর মীরাও এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠে গেছে হয়তো।’
উশান ফোন কাটার পূর্ব মূর্হতে ছোট্ট করে জবাব দিলো,
-‘ আচ্ছা দেখছি! ‘
উশান দ্রুত পায়ে ওপরে উঠে এলো। তার হটাৎ করেই ভীষণ অস্থির, অস্থির লাগছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ললাটে নোনা ঘামের উৎপত্তি ঘটেছে বিন্দু বিন্দু পরিমাণে। দ্রুত পদে দশ তলায় উঠে এসে কলিং বেলে চাপ দিলো কয়েকবার করে।কিয়ংদশ বাদে দরজা খুললো অল্পবয়সী এক নারী।উশান চেনে তাকে। মীরাদের বাসায় কাজ করে তিনি।নাম রুবা! উশানকে দেখে সে স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
-‘ ভাইজান আপনি আইছেন? আল্লাহ রহম করছে! মীরা আফায় তো দরজাই খুলতেছে না রুমের।আমি এই ঘর খোলা রাইখা অন্য জায়গায় কামেও যাইতে পারতেছি না। আপনি একটু বহেন ঘরে আইয়া ভাই, আমি কামে যামু! ‘
উশান চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-‘ মীরা এখনো রুমের দরজা খোলেনি? ‘
-‘ না ভাইজান। আপায় মনেহয় ঘুমায়। ‘
রুবা চলে যায়। উশান ফ্লাটে প্রবেশ করে তড়িঘড়ি করে দরজা আঁটকে ছুটলো মীরার রুমের দিকটায়। দরজায় কড়াঘাত করে মীরার নাম ধরে ডাকলো সে কয়েকবার। অপাশ হতে সাড়া এলো না। অস্থিরতা ক্রমাগত বেড়েই চললো তার। সিদ্ধান্ত নিলো দরজা কোনো ভাবে খুলতে হবেই! খুঁজে খুঁজে ফাইলের উপরিভাগ ছোট্ট টুকরো করে আনলো উশান।নবের ভিতর প্রবেশ করিয়ে মোচড় দিতেই লক খুলে গেলো দরজার। ত্রস্ত পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে আশেপাশে দেখলো। শেষে নজরে এলো বাথরুমে খোলা দরজা, সম্পূর্ণ খোলা নয়। শুধুমাত্র কিঞ্চিৎ ফাঁক! উশান সেদিকে এগোল। হন্তদন্ত হয়ে বলল,
-‘ মীরা? মীরা তুমি কি ভেতরে? ‘
প্রতিত্তুর আসলো না। ছটফট করলো উশান।কিছু তো একটা হয়েছে নিশ্চিত। কিন্তু এভাবে বাথরুমে প্রবেশ করবে? মেয়েটা কি অবস্থায় আছে কে জানে! বিছানার ওপর থেকে চাদর টেনে সহসা ভিতরে প্রবেশ করলো উশান। অনুমান স্বরূপ হেঁটে মীরাকে চাদর দ্বারা আবৃত করে চোখ খুললো। তৎক্ষনাৎ তার চক্ষু জোড়া স্তব্ধ! মীরার ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখোশ্রী সাদা হয়ে আসছে। নীলচে ঠোঁট।পোশাক সিক্ত হয়ে চুপসে! সিক্ত দেহ তার মাত্রাতিরিক্ত শীতল। উশানের শ্বাস রুখে আসলো। স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় মীরার দেহ একটু বেশিই ঠান্ডা হয়ে রয়েছে। মেয়েটা আছে তো বেঁচে? মীরার পালস পরীক্ষা করে উশান। নিম্ন কন্ঠে শুধালো,
-‘ এমনটা কেনো হলো মীরা? ‘
__
-‘ উজান রেজওয়ান! রাইট? ‘
রিনরিনে মিষ্টি একটা কন্ঠ! উজানের ধ্যান কাড়লো কঠোর ভাবে। গুরুত্বপূর্ণ আলাপ ফেলে সে দৃষ্টিপাত ফেললো সম্মুখে। বয়স ১৮ কি ১৯ হবে। অতিরিক্ত পরিমাণে ফর্সা, ভীষণ সুন্দর দেখতে এক মানবী তার সামনে দাঁড়িয়ে৷ উজান এগোতে নিলেই সে চটপট পায়ে এগিয়ে আসলো। মৃদু কন্ঠে বলল,
-‘ আমি সিয়া! আমাকে মীরা আপু পাঠিয়েছিলো। ‘
উজান ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকালো। অন্তঃকরণে ভাবলো কিছু।অতঃপর কাঙ্ক্ষিত বার্তা সৃতির পর্দায় আসার পর সে ম্লান হেঁসে বলল,
-‘ অহ হ্যা। বসুন প্লিজ! মীরা আমাকে বলেছিলো আপনার কথা পরশুদিন ফোন করে। তো, বলুন আপনার কি হেল্প করতে পারি? ‘
সিয়া উজানের পাশে বসলো। উজান তার হাতের ইশারায় উপস্থিত দু’জন পুলিশ অফিসারকে চলে যেতে আদেশ দিতেই তারা বিদায় জানিয়ে প্রস্থান করে সেখান হতে৷ কাঁধে বহমান ব্যাগটা কোলে নিয়ে সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজ বের করলো সে। পরিশেষে উজানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘ আমার ইউনিভার্সিটির থেকে কিছু দূরে একটা কলেজ আছে। গার্লস কলেজ! ওখানকার পরিবেশ টা অতোটা উন্নত না বলতে পারেন। সেখানে প্রায় কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে কলেজের মেয়েদের উত্যক্ত করে। দেখা যায় মাঝেমধ্যে খারাপ ভাবে স্পর্শও করে ফেলে। ছেলেগুলোর দাপট আছে সেখানকার এলাকায়। বলতে গেলে ওরা কুখ্যাত সন্ত্রাসী দলের অন্তর্ভুক্ত। যার কারণে ভয়ে কেও ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগও করতে পারেনা। আমি ঐ কলেজের একটা মেয়েকে পড়াই। ও আমাকে আজ বলল! এলাকাটা নিম্নতর তাই কেও সাহস পাচ্ছে না তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলার। তাই আমিই চাচ্ছি ওদের বিরুদ্ধে স্টেপ নিতে। যথেষ্ট প্রমাণ আছে। এইযে! কাগজগুলো দেখুন। ‘
উজান হাত বাড়িয়ে কাগজ গুলো হাতে নিলো।তার দৃষ্টিপাত এখন সম্পূর্ণ কাগজ গুচ্ছের মাঝে৷ প্রতি পাল্টা উল্টে উল্টে দেখা শেষে সে মাথা তুলে মিষ্টি হেঁসে বলল,
-‘ আপনার কাজ বেশ প্রশংসনীয় মিস.সিয়া৷ এই ইনফরমেশন টুকু প্রদান করার জন্য থ্যাংক্স! ‘
-‘ ধন্যবাদ দিবেন না স্যার। এটা আমার দায়িত্ব ছিলো। কোনো হেল্প লাগলে বলবেন।’
ইশারায় সায় জানিয়ে উজান আরেকবার পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে কাগজের প্রতি। সিয়া তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করলো সম্মুখে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে উজানের মুখোশ্রীতে কিছু খোঁজার প্রয়াস চালালো। শেষে কৌতূহলী কন্ঠে বলল,
-‘ আপনার গায়ের রঙটা কিন্তু খুব সুন্দর।’
উজান অপ্রতিভ দৃষ্টিতে তাকালো। হটাৎ নিজের সম্পর্কে এমন মন্তব্য পেয়ে একটু ভড়কে গিয়েছে। সিয়া নিজেও একটু লজ্জা পেলো। হুট করে এমন মতবাদ পেশ করার মানে আছে? সে কি করলো এটা!
-‘ উপহাস করছেন মিস? আমার গায়ের রঙটা কিন্তু সকলের অপছন্দের তালিকায়। ‘
সিয়া নড়েচড়ে বসলো উজানের প্রতিত্তুর শ্রবণ করার পর। চটপট কন্ঠে বলল,
-‘ অবশ্যই না। কালো একটা সুন্দর রঙ। আমার পছন্দের খুব। আর আমার কাছে মনে হয়কালো ব্যাক্তিরা পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরতম ব্যাক্তি কারণ তাদের চেহারার আল্লাহ তায়ালা বিশেষ মায়ার প্রলেপ দিয়ে তৈরি করেছে। ‘
উজান আর কোনো কথা বলল না। সিয়াও নিশ্চুপ। সিয়ার উত্তরে মুগ্ধ হলেও কিছু বলার মতো পেলো না বলে উজান মৌন রইল। এদিকে সিয়ার অবস্থা বেহাল! সে ধরেই নিলো লোকটা হয়তো তার কথায় কষ্ট পেয়েছে তাই আর কথা বলছে না। ফুপিয়ে উঠে চুপ করে রইল সে। উজানের খারাপ লেগেছে! এই ব্যাপারটা তাকে এতো কষ্ট দিচ্ছে কেনো?
____
-‘ ইজ শি অলরাইট ডক্টর? ‘
বিচলিত শোনালো মানবের কন্ঠস্বর। রাহি মীরাকে চেকআপ করা রেখে নত দৃষ্টি ওপরে তুলে জবাব দিলো,
-‘ উম..হু! বলা যায়। কিন্তু আগামী কয়েকদিন ওনাকে বেড রেষ্টে থাকতে হবে স্যার। একেই তো কয়েকদিন আগে এতো বড় ধকল পার করলো তার ওপর এখন এই অবস্থা। রেষ্ট করলেই ঠিক হয়ে যাবে। শরীরের তাপমাত্রা কমে গিয়েছিলো অনেক তাই সেন্সলেস ছিলো। রাতে জ্বর আসতে পারে। ঔষধ লিখে দিচ্ছি ওগুলো খাইয়ে দিবেন তাহলে জ্বর আসার সম্ভাবনা থাকবে না। ‘
স্বস্তির তপ্তশ্বাস ছাড়লো উশান। বুকের ওপর থেকে বিশাল এক পাথর নেমে গিয়েছে। শান্তি লাগছে একটু একটু। রাহি ঔষধ লিখে দিয়ে উশানকে কিছু নির্দেশনা সম্পর্কে ধারণা এবং যথার্থ ব্যাখা দিয়ে চলে যায়। হাতের প্রেসক্রিপশন সাময়িক সময়ের জন্য পাশে ফেলে উশান এগোয় মীরার নিকটবর্তী। রুহিকে ফোন দিয়েছে সে। রুহি আসলেই ঔষধ আনতে যাবে।
মীরার বিছানার পাশে লাগোয়া সোফা। উশান সোফায় গিয়ে বসলো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে মীরার মুখে পড়ে থাকা চুলগুলো নরম হাতে কানের পিঠে গুঁজে দিলো। মীরা তখন কাঁপছে। ভয়ংকর কাঁপুনি দিচ্ছে তার সর্বাঙ্গ। দুইটা ব্লাঙ্কেট দিয়েও কাঁপুনি থামানো যায়নি তার। রাহি বলেছে, এটা স্বাভাবিক! আপাতত এই কাঁপুনি মানব দেহের উষ্ণতার মাধ্যমে থামানো প্রয়োজন ছিলো কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মীরা অবিবাহিত। তাই এই উপায় আপাতত বিফলে গেছে! মীরা কাঁপা অবস্থায় কিছু বিড়বিড় করে বলছিলো। কৌতূহল বশত উশান কান পাতে শ্রবণ করার স্বার্থে মেয়েটা কি বলছে!
মীরার ওষ্ঠাধর নিকট মুখ এগোতেই মীরা পাশ ফিরে সজোরে এক থাপ্পড় মারলো। বিকট এক শব্দ হয়ে আবারও নীরবতা কক্ষের মাঝে। উশান তখন স্তব্ধ! মীরা ঘুমে বিভোর। উশানের বুঝতে বেগ পেতে হয়নি মীরা মাত্র করা কর্মটি তন্দ্রাঘোরে করেছে। মেয়েটা ঘুমোলে দিন – দুনিয়ার প্রতি খেয়াল থাকে না৷ উশান বিড়বিড়িয়ে বলল,
-‘ কি ডেঞ্জারাস মেয়ে, মাই গড! ঘুমের ঘোরে খু’ন করলেও তো মনেহয় ঘুম ভাঙবে না। ‘
উশান উঠে যেতে নিলে মীরা তার বাহু আঁকড়ে ধরে।বাহুতে নিজের মুখ ঘষে আবারও গভীর ঘুমে মগ্ন হয়। হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে নিতেও থেমে যায় সে। সন্তপর্ণে, নিঃশব্দে বিছানায় বসে। গভীর দৃষ্টিপাতে মীরাকে পর্যবেক্ষণ করার একসময় হুট করে মোহে থাকাকালীন আলত করে নিজের ওষ্ঠাধরের স্পর্শ আঁকে মীরার ললাটে। অতঃপর হাত ছাড়িয়ে লম্বা পা ফেলে প্রস্থান করে কক্ষ হতে। এখানে থাকলে নিশ্চিত কোনো অনর্থ ঘটে যাবে তার আশঙ্কায়।
চলবে…
#হৃদয়েশ্বরী
#লেখিকা-সাদিয়া মেহরুজ দোলা
#পর্ব-৩২
_________
মানুষের জীবন অতি ক্ষুদ্র পরিসরের। এই ক্ষুদ্র জীবনে বেশ কিছু মানুষ আছে যাদের আমরা নিজ অন্তঃকরণে একদম পাকাপোক্ত ভাবে বসিয়ে ফেলি যাদের পরবর্তীতে অন্তঃকরণ থেকে মুছে ফেলতে ভীষণ কষ্ট বহন করতে হয়।সেই মানুষ গুলোকে অন্তঃস্থল হতে সরিয়ে ফেলার সময় যেই নিদারুণ যন্ত্রণাটা হয়! সেই যন্ত্রণা অত্যান্ত পীড়াদায়ক।এইযে মীরার ব্যাপারটা! দীর্ঘ এক মাস চোখের পলকে কাঁটার পরও সে উশানকে ভুলতে গিয়ে যে দারুণ যন্ত্রণা উপভোগ করছে। তার আপাতত মনে হচ্ছে, এ যন্ত্রণা হতে মৃত্যু শ্রেয়, পরম শান্তির!
কেটেছে দীর্ঘ এক মাস। চলেছে অভিমানের পালা। উশান ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার পর মীরা আর তার সহিত কোনোরূপ যোগাযোগ করেনি, যোগাযোগ রাখেনি। একদম ‘ ইগনোর লিষ্ট ‘ এ ফেলে রেখেছে সে এই পাথর মানবকে। ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার পর উশান যে কত শত বার মীরাকে ফোন দিয়েছে, ম্যাসেজ করে বার্তা পাঠিয়েছে হিসেব নেই তার।কিন্তু মীরা ছিলো নিজ সিদ্ধান্তে অটল! সে উশানকে কষ্ট দিবে মানে তো দিবেই। আপনজন আমাদের অবহেলা করলে কেমন লাগে?এটা উশানের অনুভব করা উচিত। তারপর আসে মীরার ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার সময়কাল। সকল প্রস্তুতি শেষে মীরা ক্যালিফোর্নিয়া এসেছে আজ এক সপ্তাহ হবে।তবে অদ্ভুতুরে ব্যাপার হচ্ছে, এখানে আসার দুই দিন পর্যন্ত উশান কল দিয়ে আর কোনো প্রকার কল বা ম্যাসেজ দেয়নি৷ যোগাযোগ বন্ধ! মীরা আহত হয় প্রচন্ড! লোকটা এতো তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দিলো?মীরা যে তার বেলায় এতদিন ঘুরলো। কই! সে তো এতো জলদি হাল ছাড়েনি৷ তারমানে কি উশান তাকে পছন্দই করেনা? দয়া প্রদর্শন করছে?
-‘ আমারে সামনে রেখে তুমি কার কথা ভাবতেছো জান? ‘
রুহির চঞ্চল কন্ঠ! মীরা হুঁশে ফিরে। হাতের স্ট্র টা ফেলে দৃষ্টি দেয় রুহির প্রতি৷ রুহির নেত্রে প্রকাশ পাচ্ছে চরম কৌতূহল। মীরা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। বলল,
-‘ তোর হ্যাজবেন্ডের কথা ভাবছিলাম। বেচারা কত আনলাকি সেটা ভেবে দুঃখ প্রকাশ করছিলাম। তুই যেই বান্দর। তোকে সামলাতে গিয়ে বেচারা হার্ট অ্যাটাক না করে বসে। ‘
রুহি বিদ্রুপ হেঁসে বলল, ‘ বিয়া করলে তো! ফিলিং স্যাড ফর মাই উডবি ফিউচার জামাই বেইব!আমার মতো এতো কিউট একটা মেয়েকে হাতছাড়া করলো সে। আহারে..! আর ঐ! আমার বান্ধবী হয়ে তুই কিসব উল্টোপাল্টা বলস? বান্দর আমি মানলাম তাই বলে এই না যে জামাইরে জ্বালামু। ‘
মীরা নিরুত্তর! পাগলের সাথে কথা বলে লাভ আছে কোনো?নেই! আপাত লহমায় মৌন থাকাই শ্রেয়। রুহি, মীরা চটজলদি কফি শেষ করলো। মন খারাপের পায়রা গুলোকে উড়িয়ে দিলো মীরা। ব্যাস্ত হলো আপন কাজে। কফির বিল পরিশোধ করে ব্যাস্ত পায়ে বেড়িয়ে আসলো।
ক্যালিফোর্নিয়ার আবহাওয়া এখন উষ্ণ। তপ্ততা বিরাজমান। কাঠফাটা রোদে গলা শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে। হলদেটে অম্বরে শুভ্র মেঘের আনাগোনা আংশিক! কড়া রৌদ্দুর দর্শন করা মাত্র রুহি ছটফট করে বলল,
-‘ দোস্ত চল ক্যাব বুক করি। এই রোদে হেঁটে যাওয়া সম্ভব না। ‘
মীরা ভাবলো কিছুক্ষণ। অতঃপর অনিচ্ছা সত্বেও সায় জানালো। ক্যাব আসার পর তারা দু’জন নিজেদের ফ্লাটে ফিরে আসে। এখানে আসার পর হোষ্টেলে না উঠে ফ্লাট ভাড়া করেছে তারা। মাহদির আদেশ! হোষ্টেলে ওঠা যাবেনা। মীরা – রুহি বিশেষ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি মাহদির সিদ্ধান্তে। তবে অন্তঃস্থলে দু’জনই অসন্তুষ্ট। এখানকার বাসা ভাড়া বেশ চওড়া। মাত্রাতিরিক্ত টাকা নষ্ট হয়!রুহি বাসায় ফিরে হাত – পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ে। কারণ আপাতত তাকে মীরা বিছানায় যেতে দিবেনা যতক্ষণ না সে ফ্রেশ হচ্ছে। রুহির আপাত অবস্থা দর্শন করে মীরা বিরক্তিতে ভ্রু’কুটি কুঁচকালো!বলল,
-‘ ফ্রেশ হতে যা রুহি। তোর ড্রেসে ধুলোবালি লেগে আছে। ‘
-‘ যাইতেছি বইন। মাফ কর একটু! রেস্ট করে নেই।’
মীরা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। মেয়েটা এখন আর তার কথা শুনবে না, মানবে না! তোয়ালে হাতে শ্রান্ত পায়ে সে ঢুকলো ওয়াশরুমে।
___
বাসায় যাওয়ার পথে মাঝ রাস্তায় আসতেই হটাৎ সিয়ার স্কুটি নষ্ট হয়ে যায়। আকাশ’সম বিরক্তি নিয়ে স্কুটি থেকে নেমে দুই চারটা লাথি মারলো তাতে। রাস্তাটা নির্জন, জনমানবহীন! শর্টকাটে জলদি বাসায় পৌঁছাতে এই রাস্তা ধরে সিয়া সবসময় যাতায়াত করে। কখনো কোনো বিপদে না পড়লেও আজ বোধহয় মহা বিপদে ফেঁসে গেলো সে৷ ভূমিতে এলোমেলো রূপে পড়ে থাকা স্কুটিটাকে টেনে দাঁড় করায় সে৷ সেলফোন বের করে কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করে কাকে ফোন দেয়া যায়? কে তাকে এ সময় সাহায্য করতে পারে। অতঃপর মিনিট খানেক ভাবার পর ফলাফল আসে শূন্য! বইয়ে যাওয়া সমীরে মিলিয়ে গেলো তার যন্ত্রণাদায়ক দীর্ঘশ্বাস।
নিস্তব্ধ সড়কে হটাৎ শব্দের উৎপত্তি। চমকে পিছন তাকায় সিয়া। দর্শন মিলে উজানের। জিপ ড্রাইভ করে এদিকেই আসছে। চঞ্চল পায়ে সে দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো রাস্তার মাঝখানে। হাত নাড়িয়ে থামাতে বলল। উজান জিপ থামায়। বিষ্মিত নয়নে বেড়িয়ে আসে। সিয়ার নিকট এগিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-‘ আপনি এভাবে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে ব্যাঙের মতো লাফালাফি করছেন কেনো মিস? এনিথিং রং?’
নিজেকে ‘ ব্যাঙের ‘ সাথে তুলনা করায় সিয়া বোধহয় একটু অসন্তুষ্ট হলো। অপ্রতিভ কন্ঠে বলল,
-‘ আসলে.., আমার স্কুটিটা নষ্ট হয়ে গেছে। একটু হেল্প করবেন প্লিজ? আমায় একটু বাসায় পৌঁছে দিবেন? ‘
-‘ সেটা নাহয় দিলাম। কিন্তু আপনার স্কুটি?
সিয়া স্কুটির দিকে তাকিয়ে রুষ্ট কন্ঠে বলল,
-‘ এটা এখানেই মরুক। মাঝপথে নষ্ট হলো কেনো?বেয়াদব! ওর শাস্তি পাওয়া উচিত। চলুন আমরা চলে যাই। ‘
উজান একটুখানি ভড়কালো। সিয়ার উদ্ভট কথা শুনে মনে মনে হাসলো কতক্ষণ। শেষে তারা রওনা দেয় নিজস্ব গন্তব্যে। নিজের বাসায় আসার পর নেমে যায় সিয়া। উজানকে ছোট্ট করে ধন্যবাদ দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। বাসার ভিতর ঢুকতে ঢুকতে তার ফোনে কল আসলো। কল দেয়া ব্যাক্তির নাম দেখে সে বুঝি আরো একবার অপ্রতিভ হলো। রিসিভ করলো সেকেন্ড দুয়েক পর। জিজ্ঞেস করলো,
-‘ গুড মর্নিং স্যার। ‘
অপাশ হতে জবাব এলো ভারী, কর্কশ কন্ঠে,
-‘ পিরীতের আলাপ ছাড়ো সিয়া! যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শোনো।’
-‘ সরি স্যার!বলুন স্যার। ‘
-‘ সব ইনফরমেশন কালেক্ট করার পর উজানকে তুমি মে’রে ফেলবে। এটা তোমার আপাতত টাস্ক। ফারদিনকে কিছু করার দরকার নেই। উশানের প্লান সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবে উজানের ক্লোজ হয়ে বুঝতে পেরেছো? সবকিছু জানার পর সুযোগ বুঝে ওকে মেরে ফেলবে। ‘
সিয়া চরম আশ্চর্য! হতবিহ্বল হয়ে বলল,
-‘ বাট স্যার। আমার তো কাওকে মে’রে ফেলার কথা ছিলোনা৷ ডিল সাইন করার সময় আমি কাওকে মে’রে ফেলবো! এমন কোনো লাইন পাইনি৷ এখন হটাৎ করে কেনো স্যার? ‘
-‘ ছিলোনা! এখন বলছি। এরজন্য তুমি এক্সট্রা টাকা পাবে। বুঝেছো? আপাতত কাজে মনোযোগী হও। ‘
সেলফোন কান থেকে সরিয়ে নিলো সিয়া। হাত তার কাঁপছে। কেনো?অদ্ভুত তো! তার এই ১৯ বছরের জীবনে তো কম খু’ন করেনি। আজ যখন আরেক ব্যাক্তিকে খু’ন করার আদেশ আসলো তাহলে এখন হৃদঃস্থলের এমন নড়বড়ে অবস্থা কেনো?
______
তখন গোধূলি লগ্ন। মীরা বারান্দার ডিভানে শুয়ে বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে দেখছিলো। কাল থেকে তার ক্লাস শুরু। মাস্টার্স শেষ করবে মীরা এখানে। তারপর বাংলাদেশে চলে যাবে নয়তো মাহদি আর মায়ানকে এখানে নিয়ে আসবে। আপাতত এসবই তার মস্তিষ্কের নিউরনে গেঁথে ছিলো। মগ্ন ছিলো ভাবনায়! হটাৎ তীব্র হর্ণের শব্দে তার ধ্যান ফিরলো। হকচকিয়ে উঠে বসে বহির্ভাগে দৃষ্টি ফেলতেই তার নেত্রযুগল বড়সড় হয়ে এলো। ওষ্ঠাধর প্রসারিত হয়ে অস্ফুটস্বরে বেড়িয়ে এলো একটা শব্দ,
-‘ উশান! ‘
হুড়মুড়িয়ে রেলিঙ ধরে ঝুঁকলো মীরা। উশানের রুষ্ঠ চাহনি তার অন্তঃস্থল কাঁপিয়ে তুলছে ক্ষনে ক্ষনে। কি আশ্চর্য!লোকটা এতে রেগে আছে কেনো?আর উশানই বা এখানে কিভাবে হলো? তার তো ট্রেনিং ক্যাম্পে থাকার কথা। মীরা মুখ ফুটে কিছু বলবে তার পূর্বেই উশান ইশারায় মীরাকে নিচে আসতে আদেশ দেয়। মীরা ভাবলো একবার, যাবেনা সে! শেষে অন্তঃকরণের আগ্রাসী অনুভূতির নিকট পরাজিত হয় চললো দ্রুত পদে নিচে।
.
উশানের সামনে দাঁড়িয়ে মীরা। লোকটার রুষ্ট চাহনি! ক্রোধে ভরা নেত্রযুগল তাকে প্রথম বারের মতো ভয় পাওয়াতে বাধ্য করলো। অন্তঃস্থলে নিজেকে ধাতস্থ করে মীরা। শ্লেষের গলায় বলে,
-‘ কি হয়েছে? আপনার এখানে কি চাই? ‘
-‘ বাইকে ওঠ! ‘ রাগান্বিত কন্ঠস্বর।
মীরা ভীতি ফেলে প্রশ্ন করলো,
-‘ কেনো? কিসের জন্য? আমি আপনার সাথে কোথায় যাবোনা। ‘
উশান প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ধমকে বলে উঠলো,
-‘ বেশি কথা বলবি তো এই পাবলিক প্লেসে আমি তোকে তিন – চারটা থাপ্পড় মেরে বসবো মীরা। ‘
মীরা আর বাঁধ সাধলো না। নম্র পায়ে এগিয়ে উঠে বসলো। উশান দ্রুত পদে এসে বাইকে বসে দ্বিগুণ গতিতে বাইক চালানো শুরু করে। মীরা ভাবলো একবার, তাকে বলবে গতি কমাতে! কিন্তু তা আর বলা হলো না। জেদি লোকটা যে তারই মতো।শুনবে না কথা নিশ্চিত। গাড়ি নির্জন, নিস্তব্ধ, মানবহীন স্থানে থামলো। স্থানটা সম্পর্কে মীরার জ্ঞান নেই। কোথায় এটা সে জানেনা! তবে এই জায়গাটা তার বাসা হতে অনেক, অনেক দূরে তা নিশ্চিত সে।
মীরা নামলো। আশপাশটা তীর্যক চাহনিতে পর্যবেক্ষণ করে উশানকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুড়লো,
-‘ এখানে কেনো এনেছেন? ‘
জবাবহীন পাথর মানবটা! হেলমেট খুলে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে সামনে এগোল। সামনে যাওয়ার পথে মীরার হাত টেনে ধরলো। অতঃপর তাকে এক প্রকার টানতে টানতে নিজের সঙ্গে নিয়ে চললো।মাঝে মীরা তার হাতে খামচি দিয়েছে, থাপ্পড় দিয়েছে, কিল- ঘুষি দিয়েছে! লোকটা তবুও তার হাত ছাড়েনি। শেষে কাঙ্ক্ষিত স্থানে নিয়ে গিয়ে মীরার কো’মড় চেপে মীরাকে ব্রিজের রেলিঙের ওপর বসিয়ে দিলো। মীরা আঁতকে উঠে বলল,
-‘ কি করছেন? আল্লাহ! পড়ে যাবো তো। ‘
উশান মীরার কো’মড় পিছন দুই হাত আড়াআড়ি ভাবে আবদ্ধ করে নিয়ে মীরার কোলে মাথা রাখলো। অতঃপর অতি নম্র কন্ঠে শুধালো,
-‘ পড়বেনা। আমি আছিনা। ‘
শীতল এক অনুভূতি মীরাকে স্পর্শ করলো তুলতুল করে। উশানকে এখন অনেকটা নম্র, শান্ত দেখাচ্ছে যেমনটা তাকে সবসময় দেখায়৷ শান্তশিষ্ট লোকটার হটাৎ রেগে যাওয়াতে মীরা ভীষণ ভড়কে গিয়েছিল অনেকটা। কিয়ৎক্ষণ নীরবতা পালন! চারপাশে মিষ্টি সমীরের সাইঁ সাইঁ করে চলাচল। গোধূলির রাঙা আলো সামনের স্বচ্ছ নীল পানিতে আছড়ে পড়ে নিদারুন সৌন্দর্যের প্রলেপ একেছে। ঘোরতর মৌনতা ভেঙে উশান বলে উঠলো,
-‘ এতদিন তোরে ফোন দিচ্ছি আমি! ফোন কেনো রিসিভ করোনি তুমি? ইগনোর কেনো করছো?তুমি কি আমাকে মেনে নিতে পারছো না? তাহলে বলো! আমি তোমাকে জোর করে নিজের কাছে রাখবো না। এক- একটা মানুষের স্বাধীনতা আছে নিজের মতো করে চলার। অনেক কষ্ট ক্যাম্প থেকে সময় নিয়ে বাহিরে এসেছি মীরা। জলদি উত্তর দাও! তুমি কি আমাকে এক্সেপ্ট করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছো? তুমি যা সিদ্ধান্ত নিবে আমি তাতে সায় জানাবো। ‘
উশানের কন্ঠে ধরে এলো। শব্দ গুলো বিষাক্ত বেশ!নয়তো কন্ঠনালী দ্বারা উচ্চারণ করতে তার এতো কষ্ট হলো কেনো?
মীরা নিশ্চুপ। উশান মাথা তুলে। ফিচেল হেঁসে বলে,
-‘ মৌনতা সম্মতির লক্ষন! চলে যাচ্ছি তাহলে।’
নিস্তব্ধ, শব্দহীন স্থানটায় ছোট খাটো বিস্ফোরণ ঘটলো। মীরা হটাৎ রেলিঙ হতে ঝাপ দিয়ে উশানের বুকে মাথা দিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠলো। নিজেকে আর তার পক্ষে সামলানো সম্ভব হয়নি। ক্রন্দনরত কন্ঠে বলল,
-‘ আপনাকে ইগনোর করে বুঝি আমি শান্তিতে ছিলাম? কতটা কষ্টে ছিলাম আমি জানেন? আমি আপনাকে ইগনোর করতাম যাতে আমার অতীতে কতোটা কষ্ট হয়েছে তা আপনি বুঝতে পারেন তার জন্য। সেদিন তো বড় বড় ভাষন দিচ্ছিলেন আমি না মানলে কিডন্যাপ করে তুলে নিয়ে যাবেন আর আজ এতটুকুতেই হাল ছেড়ে দিচ্ছেন। আপনি নিষ্ঠুর, জঘন্যতম একটা ব্যাক্তি উশান! ‘
দু’হাতে উষ্ণ আলিঙ্গনে মীরাকে আবদ্ধ করলো উশান। তার অধর কোণে হাসি। ম্লান হাসি! আসক্তি মাখা কন্ঠে আচানক বলে উঠলো,
-‘ আমি নিষ্ঠুর।আমি জঘন্য।
তুমি মায়াবিনী, প্রাণদায়িনী!
আমি আঁধারের কলুষিত অন্ধকার,
তুমি স্বচ্ছ, পবিত্র রশ্মি!
আমি চাঁদের বুকের কলঙ্ক,
তুমি চাঁদের সৌন্দর্যের প্রতিমা।
তুমি বিশুদ্ধ প্রণয়ের প্রিয়তম হৃদয়েশ্বরী। ‘
চলবে…
[ রি-চেইক করা হয়নি। ]