অরুণরাঙা প্রেম পর্ব-১১

0
911

#অরুণরাঙা_প্রেম
#পর্বঃ১১
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

আরো কিছুক্ষণ কার্বাড নাড়াচড়া করেও আরোশী কোন কিছু পেলোনা।হতাশ হয়ে যখনই সে কার্বাডের দরজাটা বন্ধ করতে যাবে তখনই তার চোখ যায় একটা ফাইলের মধ্যে।আরোশী তাড়াতাড়ি ফাইলটা বের করলো এই আশায় যদি কিছু পেয়ে যায়।ফাইল খুলে সে অবাক হলো সাথে হতাশ।কারণ ফাইলগুলোর মধ্যে আহিরের সম্পর্কে কিছু নেই বরং এটাতে অনেকগুলো ড্রেসের ডিজাইন এর স্কেচ আছে।আরোশী দেখেই বুঝতে পেরে যায় এগুলো আকাশ তৈরি করে।আরোশী অবাক এবং মুগ্ধ হয়ে প্রত্যেকটা ডিজাইন দেখতে লাগলো।সবগুলো ডিজাইনই একটা থেকে একটা সুন্দর।

” স্কেচগুলোতে ডিজাইন এতো সুন্দর হলে ড্রেসগুলো তাহলে কত সুন্দর হবে!আসলেই স্যার এর অনেক ট্যালেন্ট আছে,আঁকার হাতও ভালো।ওনার এই গুনটাই আহির পেয়েছে।বাবা যেমন ছেলেও ঠিক তেমন গুণবান।”

দেখা শেষ হলে আরোশী ফাইলটা আবারো আগের জায়গায় রেখে দিলো।রুমের এককোণায় একটা মাঝারি সাইজের টেবিল দেখতে পেলো আরোশী।টেবিলে থাকা জিনিসগুলো নাড়াচাড়া করে আরোশী আরো কয়েকটা ডিজাইন পেলো।সেগুলোও মুগ্ধ হয়ে দেখছে সে।ডিজাইন দেখতে দেখতে আরোশী ভুলে গেলো সে আসলে কেন এই ঘরে এসেছিলো।

এখন প্রায় রাত নয়টা।বিছানার মাঝখানে বসে আছে আহির আর আরোশী।আহিরের সামনে খাতা আর রঙ বক্স।খুব মনোযোগ সহকারে ছবি আঁকছে সে।সামনেই নাকি তাদের স্কুলে বার্ষিক ক্রিয়া প্রতিযোগিতা,তার জন্য আহির এই ড্রইংটা তৈরি করছে।খুব সুন্দর করে আহির একটা দৃশ্য অংকন করলো।যার একপাশে গ্রামীণ চিত্র এবং অন্য পাশে শহরের চিত্র ফুটে উঠেছে।আহিরের এভাবে আঁকা আইডিয়াটা আরোশীই দিয়েছে।

” ফেরি আন্টি এটা কেমন হয়েছে?”

” খুব সুন্দর হয়েছে আহির।”

” কিন্তু আমার সুন্দর লাগছেনা।” ছবির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টো বললো আহির।

” কে বলেছে সুন্দর হয়নি?খুব সুন্দর হয়েছে।তোমার এমনিতেই মনে হচ্ছেম।তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করোনা?”

” না না ফেরি আন্টি,তুমি যখন বলছো তার মানে সুন্দর হয়েছে।তুমি মন খারাপ করোনা।”

আরোশী কিছু বলবে তার আগেই শিলা তাড়াহুড়ো করে রুমে ঢুকে এলো।

” আরোশী স্যার এসেছেন।”

” তা তো আমি জানি শিলা আপু,বেল বাজানোর শব্দ শুনতে পেয়েছি আমি।”

” তোমাকে আর আহিরকে নিচে যেতে বলেছেন।না জানি ওনার মাথায় কি চলছে।আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।”

” কি হয়েছে আপু?কোন সমস্যা?আর উনি আামাদের নিচে যেতে বলছেন কেন?অন্যদিন তো উনি উপরে চলে আসেন।আজ হঠাৎ নিচে কেন যেতে বলছেন?”

” তুমি নিজেই দেখে যাও।”

শিলার কথা শুনে আরোশী কোন ঝামেলার গন্ধ পাচ্ছে।তাই সে তাড়াতাড়ি আহিরকে নিয়ে নিচে চলে এলো।কিন্তু নিচে এসে তো সে অবাক।ড্রইং রুমে থাকা টেবিলটাতে মাঝারি সাইজের দুটো পিজ্জার বক্স,সাথে বার্গার আর বিরিয়ানির প্যাকেটও দেখতে পেলো আরোশী।হঠাৎ এতো খাবার দেখে অবাক হলো আরোশী।আরোশীর জামা ধরে তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আহির।সে শান্তদৃষ্টিতে আকাশকে দেখছে।এই সময় অন্যকোন বাচ্চা হলে হয়তো খুশিতে লাফিয়ে উঠতো কিন্তু আহির চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।অন্যসময় হলে আরোশী অবাক হতো কিন্তু এখন মোটেও অবাক হলোনা কারণ সে কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে আহির কেমন।

” আরে তোমরা চলে এসেছো।এসো এসো তাড়াতাড়ি এসে।”

” এগুলো কি স্যার?হঠাৎ এতো গুলো খাবার?”

” আরে এতো কথা বললে হয় নাকি?আজ আমার বাইরের কিছু হেভি খাবার খেতে ইচ্ছে করছিলো তাই ভাবলাম একেবারে বাসায় নিয়ে যায়,সবাই মিলে একসাথে খাবো।শিলা যাও সবার জন্য প্লেট নিয়ে এসো,আর হ্যাঁ তোমার জন্য কিন্তু আনতে ভুলো না।”

শিলা প্লেট আর চামচ নিয়ে এলে আকাশ তাকে ইনস্ট্রাকশন দিলো কিভাবে ভাগ করবে।তারপর উপরে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।শিলা সব খাবার আকাশের কথা অনুযায়ী ভাগ করছে।আহির চুপচাপ সোফায় বসে শিলার কাজ দেখছে।

” আপু হঠাৎ ওনার কি হলো বলো তো?হুট করে আজ এতো খাবার নিয়ে এলো?”

” আমি জানিনা আরোশী।জানলে কি আর অবাক হতাম।মানুষের মনে কখন কি চলে তা বোঝা বড় দায়।”

” আরে তোমরা এখনো না খেয়ে বসে আছো কেন?খাবারগুলো তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।সবাই তাড়াতাড়ি খাওয়া শুরু করো।”

আরোশী আহিরকে এক স্লাইস পিজ্জা দিয়ে নিজেও একটা নিলো।আকাশ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রায় রাতের খাবার সময় হয়ে গিয়েছে তাই একেবারে তারা রাতের খাবারও সেরে ফেললো।আহির শুধু এক স্লাইস পিজ্জা আর কয়েক চামচ বিরিয়ানি খেয়েছে।আরোশীও আর জোর করেনি কারণ জোর করে খাওয়ালে যেমন মনের ক্ষতি হয় তেমনি শরীরের।যেহেতু খাবারটা সে খাচ্ছে তাই অন্যদের থেকে সে ভালো জানে যে আসলেই সে আর খেতে পারবে কিনা।তাই জোর করে খাওয়ানো কখনো উচিত বলে আরোশী মনে করেনা।

খাওয়া শেষ হলে আরোশী শিলার সাথে গিয়ে প্লেটগুলো পরিষ্কার করে আবারো ড্রইংরুমে ফিরে এলো।

” আরোশী।”

” জ্বি স্যার?”

” এই নাও।” বলে আকাশ মোটামুটি মাঝারি সাইজের চকলেট আরোশীর দিকে বাড়িয়ে দিলো।আরোশী এটা দেখে ভ্রু-কুচকে জিজ্ঞেস করলো,

” এটা আমাকে কেন দিচ্ছেন স্যার?এটা কি আহিরের জন্য?তাহলে ওকেই দিন।”

” আরে নাও তো আগে এটা।” কৌতুহল নিয়ে আরোশী চকলেটটা আকাশ থেকে নিলো।আকাশ এরপর আরো একটা চকলেট ব্যাগ থেকে বের করে আহিরাে দিলো এবং শিলার দিকে তাকিয়ে বললো,

” তুমি তো চকলেট খাও না তাই তোমার জন্য আইসক্রিম এসেছি।ফ্রিজ আছে,এখন কেউ না ঠান্ডা লেগে যাবে।কাল সকালে খেও।”

আকাশের কথা শুনে শিলা মাথা নাড়িয়ে হেসে চলে গেলো।আরোশীও চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবো তখনই আকাশ তাকে থামিয়ে দিলো,

” আরোশী আপনি কি এখনো রেগে আছেন?”

আকাশের কথা শুনে আরোশী কয়েক মূহুর্তের জন্য কনফিউজড হয়ে যায় এটা ভেবে যে আকাশ কিসের কথা বলছে।কিন্তু কয়েক মিনিট পর সে বুঝতে পারলো আসলে আকাশ কোন বিষয়ে কথা বলছে।

” তারমানে এতো সব আপনি করেছেন এটা ভেবে যে আমি রেগে আছি।”

” মিথ্যা বলবো না তুমি ঠিকই ধরেছো।মনে আছে আমি প্রথমদিন তোমাকে বলেছিলাম তোমাকে আমি ১ মাস দেখবো কিন্তু ১ মাস হওয়ার আগেই আমি তোমাকে আমার বাড়িতে থাকার অফার দিয়।আহিরকে দেখাশোনা করার জন্য তোমার আগেও ৩/৪ জন ছিলো কিন্তু তারা কেউ তোমার মতো আহিরের যত্ন করেনি।তোমার আহিরের প্রতি এতো কেয়ার,এতো দায়িত্ববোধ আর আহিরও তোমার সাথে খুব ফ্রী,এতোটা কথা সে আমার সাথেও বলেনা আর বলবে কেমন করে আমি তো তাকে সময়ই দিতে পারিনা,সেখানে তুমি তো তাকে সারাটাদিন সময় দাও।আহিরের ফেরি আন্টি যে তুমি,আর আমার বাচ্চার ফেরি আন্টি রেগে থাকবে এটা কি করে হয়।আমি তো জানিনা তুমি কি পছন্দ করো,তাই ভাবলাম খাবারই নিয়ে যায়,সবাই নাহয় আজ একটা ছোট পার্টি করবো।”

আকাশের কথা শুনে আরোশী হালকা হেসে উওর দিলো,

” আপনি আমার কথা চিন্তা করেছেন এতে অনেক ধন্যবাদ।আমি রেগে নেই,আমি ঠিক আছি।আর রেগে থাকলেও কখনো এটা মনে করবেন না আমি আহিরের অবহেলা করবো।বাবা,মা ছাড়া থাকা যে কতটা কষ্টের সেটা আমি জানি স্যার,আমি তো পারবোনা আহিরের বাবা,মায়ের জায়গাটা নিতে কিন্তু ওকে সঙ্গ তো দিতে পারবো।তাই আমি যতোদিন এই বাড়িতে আছি আপনি চিন্তা করবেন না,আহিরের আমি কোন অবহেলা হতে দেবোনা।আহির চলো ঘুমাতে হবো তো।”

আরোশী আহিরকে নিয়ে চলে গেলো।আকাশ সোফায় বসে আরোশীর কথা চিন্তা করছে।

” আসলেই আমি মানুষ চিনতে ভুল করেনি।আরোশী আসলেই ভালো আর উদার মনের মানুষ।মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই কষ্ট করে আসছে।বাবা-মা না থাকার কষ্টটা হয়তো তাকে খুব তাড়া করে বেড়ায়।কারো দায়িত্বে না থাকলে মানুষটা বিপথে চলে যেতে সময় লাগেনা কিন্তু আরোশী একা একা বড় হয়েও কত উদার মনের মানুষ।আহির তার কেউ নয় তাও সে নিজের ভয়ানক অভিজ্ঞতা যেন আহিরেরও না হয় তার জন্য কত চেষ্টা।”

চলবে…..