#প্রিয়কাহন❤️
#লেখিকা ‘কায়ানাত আফরিন’
#পর্ব |১৫|
‘ তুমি অভীর খালামনিকে বিয়ে করেছো পুলক চাচ্চু?’
প্রিয়তার নিজের কাছেই নিজের কন্ঠস্বরটা অচেনা মনে হলো। ঢোক গিললো ক্রমাগত। মনে মনে বলে চললো, বিধাতা যেন আর অবমাননা না করে তার ওপর। ‘দোহাই করো বিধাতা, দোহাই করো।’ কথাটা প্রিয়তা নিজেই মনে মনে আওড়ালো। কিন্তু হাজারো অনুনয় অনুরোধ সবকিছুকে উড়োবেগে উড়িয়ে পুলক চাচ্চু মাথা চুলকিয়ে বললো,
‘ আরে হ্যাঁ রে! পরিচয়টা তো সেভাবেই হয়েছিলো যখন জানলাম তিথী নুরুল স্যারের শালী। সেম ডিপার্টমেন্টের ছিলাম তখন আমরা, দেখতে সুন্দরী, হলো বন্ধুত্ব-বন্ধুত্ব থেকে প্রেম, আর প্রেম থেকে বিয়ে।’
মনে মনে বিভৎসভাবে চাচ্চুকে উপহাস করতে ইচ্ছে হলো প্রিয়তার। দুনিয়াতে কত মেয়ে, হাজারো – লক্ষ কোটি মেয়ে। প্রেম আর বিয়ে করার জন্য কি তাকেই পেয়েছিলো? অভীর সাথে এখন প্রিয়তার বিয়ে হোক বা না হোক- আজীবন তার সামনে ঘুরঘুর করতে হবে। আর সেটা যে কতটা অস্বস্তির – প্রিয়তা তা ভাবতেই মুখ বিবর্ণ হয়ে গেলো।
অভী এতক্ষণ ভূমিকা পালন করছিলো নীরব দর্শকের মতো। যেন গল্পের এই দৃশ্যপটে তার কোনো ভূমিকা দেওয়া হয়নি। তবে এখন মুখ খুললো সে। হাত ভাঁজ করে সংকীর্ণ কন্ঠে বললো,
‘ মা যদি জানে খালামণি যে তুমি না বলে কয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছো ভাবতে পারছো কি হবে?’
তিথী তাকালো ভাগ্নের দিকে। কথা বলার ধরন, চোখের দৃষ্টি অবিকল তার মায়ের মতো। বাবা তাহলে ঠিকই বলতো অভীর কথা। তিথী নিঃশ্বাস ফেললো। কথা পাল্টিয়ে বললো,
‘ সে নাহয় পরে দেখি। এখন এখান থেকে বের হই কেমন! তালপাকা গরমের মৌসুম না ; কিন্তু যেই গরম পড়েছে আমি নিজেই পেকে যাবো!’
তারপর হড়বড় করে নামলো সবাই। প্রিয়তা অদ্রি এখনও বিস্ময়ে, তবে সেই বিস্ময়ভাবের সীমারেখা রুদ্রর মধ্যে নেই। ছেলে হিসেবে সে খুব দ্রুতই এসব কাটাতে পারে। ওদের দাঁড় করিয়ে বেবিট্যাক্সি আনতে গেলো রুদ্র। পুলক তিথী ওদের সাথেই দাঁড়িয়ে আছে। তখনই মোবাইল নিয়ে ওদের পাশে দাঁড়ালো অভী। দৃষ্টি বিন্যস্ত মোবাইল স্ক্রিনে। পুলক এবার বললো,
‘ কিরে বুড়ী তোর নাকি নুরুল স্যারের ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হলো? এটা সেই অভী না রে!’
হঠাৎ সবার সামনে ‘বুড়ী’ বলাতে ভীমড়ি খেলো প্রিয়তা। লজ্জায় কোনঠাসা হয়ে গেলো ওর মন। চাচ্চু এমন কেন? নতুন বউ, অভীর সামনে এভাবে এত বড় ধেড়ি মেয়েকে বুড়ী বললে তার বুঝি লজ্জা লাগে না? প্রিয়তা মিহি কন্ঠে প্রতিউত্তর দিলো,
‘ হুম।’
চোখে কৌতুহল জেগে উঠলো পুলকের। চকমক করছে অদ্ভুতভাবে। পকেট থেকে লাইটার বের করে একটা সিগারেট ধরালো সে। তিথী আগুন ধরিয়ে দিতে সাহায্য করলো। এজন্যই তিথীকে ভালোলাগে পুলকের। অন্য চার পাঁচটা মেয়ের মতো বিয়ের পর অধিকার দেখাতে আসে না। বললো,
‘ আগেই বুঝেছিলাম, ছোট ভাবি আই মিন তোর মা অভীর যেভাবে পাই টু পাই বর্ণণা দিয়েছিলো, ছেলেটা খাপে খাপ মিলে গেছে। তার ওপর আমার প্রাক্তন শিক্ষক নুরুল স্যারের ছেলে, চেনা জানা তো একটু হবেই।’
কথাটা মন্দ বলেনি পুলক। নুরুল স্যার আজ প্রায় ২০ বছর ধরে কলেজে পড়াচ্ছেন, পুলক আর প্রিয়তা অদ্রির মতো অজস্র স্টুডেন্ট সে পড়িয়েছে এই চট্টগ্রামে। বাবার জন্য অভীর আরও একবার গর্বে বুক ফুলে গেলো৷ তবে তাজ্জব হলেও এই যে অভী হয়েছে অবিকল তার মায়ের মতো। অল্পভাষী, চোখে প্রগাঢ়তা সবমিলিয়ে সবাই বলবে, ‘এ সেলিনার ছেলে!’
অভী দাঁড়ালো প্রিয়তার পাশে। বুক দ্রিমদ্রিম করে উঠলে মেয়েটার। অভীর কাছাকাছি থাকলেই এমন হয়, সবসময়ই হয় যখন সে কাছাকাছি থাকে। তবে শক্ত হলো প্রিয়তার চোখমুখ। তাকে দেখলেই অপমানগুলোর কথা মনে পড়ে বারবার। তিথী তা দেখে বললো,
‘ বাহ! অভী দেখি এখনই কেয়ার করা শিখে গিয়েছে। বলতে হবে প্রিয়তার সাথে দারুন মানাবে।।তাই না পুলক?’
অভী খেয়াল করলো প্রিয়তার মুখ। বিবর্ণ হয়ে আছে। তিথীর কথায় টু প্রতিশব্দ করলো না। অন্যসময় হলে প্রতিক্রিয়া দেখাতো। আরও একবার স্পষ্ট প্রতীয়মান হলো ঠিক কতটা হেয়ালি করার চেষ্টা করছে সে অভীকে। অদ্রি দেখলো অভীর কার্যকলাপ। কনুই দিয়ে তাকে গুঁতা মেরে বললো,
‘ শুনুন অভী ভাইয়া, আমার বোনকে এখন টু পরিমাণ জ্বালাবেন না। সেদিন ওর সাথে কি করেছিলেন ভুলিনি কিন্ত। ডিসিশন ফাইনাল, আপনি আমার কোনো দুলাভই টুলাভাই হবেন না। যত ভয়াবহ ধরনের ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানিরা পূর্ববঙ্গ হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছিলো তার থেকেও ভয়াবহ ষড়যন্ত্র করে প্রিয়তার সাথে আপনার বিয়ের ভাঙানী দিবো। ফেইস টু ফেইস থ্রেড। বুঝলেন?’
অভীর হঠাৎ হাসি এসে পড়লো অদ্রির গম্ভীর ধরনের কথায়। বোনের সাথে শালীসাহেবাও পাল্টি খেয়েছে। হাসিটা আড়ালে রেখে অদ্রির দিকে তাকালো অভী। তবে সমানতালে সংকীর্ণ কন্ঠে বললো,
‘ দেখা যাবে!’
রুদ্র এসে পড়লো বেবিট্যাক্সি নিয়ে। তিথীকে নিয়ে পুলক প্রথম যাবে সাখাওয়াত ভিলাতে। নিজের পরিবারকে মানাতে খুব বেশি কষ্ট হবে না পুলকের। মা হারা ছেলে, খালামণির কাছেই পেয়েছে মায়ের আদর, খালাতো ভাইগুলোও তাকে নিজের ভাই মনে করতো৷ প্রিয়তাদেরও তাই সে কম স্নেহ করেনি। আজও বেকার পুলক- সংসার চলবে তিথী ঢাকায় যে চাকরি করছে সেই বেতনে, তবুও পুলক জানে ওর হাত খরচ দিতে কেউ বিপত্তি করবে না। সর্বোচ্চ শাসিয়ে কথা শুনাবে সাখাওয়াত ভিলার যমদূত রুদ্র অদ্রির বাবা ওরফে শাহেদ সাখাওয়াত। এই লোকের ভয়াবহভাবে চটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বেকার ছেলের এভাবে বিয়ে করে বউয়ের টাকায় খাওয়াটা শুনে পুলককে সর্বোচ্চ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেও পুলক আজ পরোয়া করবে না৷ খালা আছে, সে ঠিকই সামলে নেবে তার শর্ট টেম্পার্ড বুড়ো ছেলেকে।
অভী বললো,
‘ তাহলে বাসায় গিয়ে কি বলবো আমি?’
‘ কিছু বলতে হবে না। আপাকে ফোন করে বল ট্রেন আসতে দেরি হবে। ততক্ষণে বাসায় যাবি না। সন্ধ্যার আগেই তোর খালুকে নিয়ে চলে যাবো!’..
বেবিট্যাক্সিতে বসে পড়লো সবাই। প্রিয়তাও অভীকে এড়িয়ে গেলো নীরবে। আর সেই এড়ানোটা পুলকের চোখ ঢাকা দিলো না। ভাইয়ের এই মেয়েটাকে ভালোভাবেই চেনে সে। হয়তে এখনও সহজ হতে পারেনি। আর অভীকেও দেখলে বোঝা না এ এক্সট্রোভার্ট না, মনের অনুভূতি মনেই চেপে রাখবে সে। পুলক বুঝলো এই দুজনের রসায়ন করতে হলে যা করার তাকেই করতে হবে। এজন্যই প্রিয়তার মা ডেকে পাঠিয়েছে তাকে।
বেবিট্যাক্সিতে ওঠার সময় খেয়াল হলো আর সিট নেই। রুদ্র সামনে, অদ্রি, পুলক আর তিথী পেছনে। প্রিয়তার বসা একেবারেই অসম্ভব। এটা হওয়ারই ছিলো। ওদের ধারনা ছিলো চাচ্চু যেহেতু একা আসবে অনায়াসেই চারজন হয়ে যাবে। তাই স্টেশনে আসার সময় কোনো গাড়ি ভাড়া করেনি৷
তিথী বললো,
‘ এমা! প্রিয়তা কোথায় বসবে তাইলে? আরেকটা ট্যাক্সি ভাড়া নিতে হবে তো!’
চিন্তার ভাঁজ পড়লো সবার কপালে। আর সে দুশ্চিন্তা উড়িয়ে পুলক বললো,
‘ আরে কোনো ব্যাপার না গিন্নিসাহেবা! ব্যাবস্থা হয়ে গেছে। এই অভী? এদিকে আসো তো!’
চলে যাচ্ছিলো অভী। এমন গলা হাকানোতে পেছনে ফিরলো। দেখলো পুলক ডাকছে। অভী এগোলো তাদের দিকে। জিজ্ঞেস করলো,
‘ ডেকেছিলেন?’
‘ হ্যাঁ, তুমি কিভাবে যাবে এখন?’
‘ বাইক এনেছি।’
‘ তাহলে তো ভালোই। প্রিয়তাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও তো! জায়গা হবে না এখানে!’
অভী কিঞ্চিত অবাক হলো। আশা করতে পারেনি কাঙ্খিত সেই সুযোগটা অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়ে যাবে। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে দেখলো ভড়কে গেছে মেয়েটা। চট করে বললো,
‘ প্রয়োজন নেই চাচ্চু। আমি রিক্সা দিয়ে যাবো!’
‘ প্রয়োজন না হলে প্রয়োজন বানিয়ে নে। অভীর সাথেই যাচ্ছিস তুই। কোনো কথা শুনবো না। নাইলে তোরে বুড়ি ছাড়া আর যেই কয়টা বিশ্রি নামে ডাকতাম সবগুলা এখানে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে ডাকবো!’
বাধ্য হলো প্রিয়তা। নতজানু হলো মন। কৌশলে এড়িয়ে যাওয়াটা ব্যার্থ হয়ে দাঁড়ালো। চরমভাবে ব্যার্থ। চোখের সামনেই তাকে ভর্ৎসনা করে সা সা করে ছুটে গেলো গাড়ি। স্টেশনের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে রইলো দুজনে। অভী হাসলো। হাসলো জয়ের হাসি। এত এড়িয়ে যাওয়ার পরও শেষমেশ তার কাছে ধরা দিতে হলো ভেবে তা যেন গা চাড়া দিয়ে উঠলো। রাগে ব্রহ্মতালু ফেটে পড়লো প্রিয়তার। তবে কিছুই করার নেই। অভী বাইক নিয়ে এলো। রোদের প্রকটতা এড়াতে চোখে পড়লো কালো চশমা। নির্বিকারে বললো,
‘ বাইকে উঠো প্রিয়তা!’
.
.
.
.
.
#চলবে ইনশাআল্লাহ