মনের কোণে পর্ব-৩৬+৩৭

0
312

#মনের_কোণে🥀
#আফনান_লারা
#পর্ব_৩৬
.
ছোটখাটো সভার আয়োজন হয়েছে বাগানে।এক পক্ষ হলেন রুহুল আমিন আর অন্য পক্ষ অনাবিলদের।
অনাবিল কি আর নিজের মত প্রকাশ করবেন,তিনি বসে বসে পান চিবোচ্ছেন।সামিয়া হাজার চেষ্টা করেও তার পান চিবানো থামাতে পারেনি।সকাল থেকে পাঁচটা পানের খিলি তার খাওয়া হয়ে গেছে অলরেডি। রুহুল আমিন খুশি হলেন এটা দেখে,তিনি ভেবেছিলেন হয়ত তার পান খাওয়া বেয়াইয়ের পছন্দ হবেনা।এখন তো তার সব উল্টা হচ্ছে।বেয়াই দেখি একসের মনের মতন।

‘আসলে আজকালকার ছেলেমেয়েরা কি আর বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করে?তারা তো কেবল নিজেদের পছন্দটাই বোঝে।’

‘ঠিক বলেছেন অনাবিল সাহেব।লিখির জন্য যে ছেলে আমি পছন্দ করেছিলাম তাকে ওর পছব্দ হয়নি,আমি জোর করায় সে দুইটা বছর বাড়ি থেকে কত দূরে গিয়ে ছিল এবার ভাবেন কেমন তেজ’

‘আর আমার ছেলেকে ভাল একটা পজিশনে নেওয়ার জন্য আমি বিদেশে পাঠাতে চেয়েছিলাম।অথচ সে কি করলো!সে বাসা থেকে পালিয়ে গেলো।আমার সামনে ধরাই দেয়নি মাসা-মাসি।’

‘কিন্তু নিয়তি তাদের দুজনকে এক করে বিয়ের বন্ধনে আটকে দিলো।এটাই তাদের জন্য উচিত হয়েছে বলে আমি মনে করি ‘

‘আমার কাছেও উচিত মনে হলো।যা হয়েছে একেবারে ঠিক হয়েছে’

‘আমি তো মেনে নিয়েছি সেদিনই।আপনি কি মানলেন?’

‘আমার শুধু দেখার ইচ্ছা ছিল আপনাদের পরিবার কেমন সেটা।দেখা হয়ে ভালোই লাগলো।আমার আর কোনো আপত্তি নেই কোনোকিছুতে’

‘আলহামদুলিল্লাহ ‘
——–
মা নিজের হাতে বিরিয়ানি রান্না করছেন সবার জন্য।লিখি পাশেই তাকে বসে চিপস খাচ্ছিল।নাবিল নাহিদকে নিয়ে ঘুরতে গেছে এগারোটার দিকে,আর মিসেস সামিয়া নিচে বাগানে অনাবিলের কাছে।
লিখির কাছে এই সময়টা এত বোরিং লাগছিল।নাবিল কাছাকাছি না থাকলে তখন ওর কাছে সময়টা বড্ড বোরিং লাগে।একেবারে বিরক্ত।এর আগে তার এমন লাগত না,যখন সে নাবিলকে চিনতোনা তখন কি করে যে সময় কেটে যেতো।
পা দোলাতে দোলাতে চিপসের প্যাকেটে হাত ভরে সে মায়ের রান্না করা দেখছিল।কি সুন্দর রান্না করে মা।আর সে কেবল একটু একটু পারে,পুরোটা পারেনা।হঠাৎ তখন সামিয়ার আওয়াজ পেয়ে লিখি পা দোলানো বন্ধ করে তাক থেকে নিচে নেমে গেলো।উনি লিখির হাত ধরে ওখান থেকে নিয়ে আসলেন।ওকে নিয়ে তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা রুমে নিয়ে এসেছেন সোজা।লিখি ভয়ে শেষ।সকালের সেই কান্ড নিয়ে না জানি বকাবকি করে ফেলে আবার।সেজন্যই বুঝি এতদূর নিয়ে আসা।
কিন্তু নাহ।উনি ট্রলি ব্যাগের চেইন খুলে কিছু গয়না আর একটা লাল টুকটুকে শাড়ী বের করে ওর সামনে ধরলেন।লিখি তার হাত থেকে যথারীতি নিলো সেগুলো।এবার তিনি বললেন,’এগুলো এনেছি তোমাকে বউয়ের বেশে বরণ করে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাব বলে, এভাবে তো নতুন বউকে নিয়ে যাওয়া যায়না।আর তুমি কোনোদিন আমাদের বাড়িতে যাও ও নি।
তাি সাজিয়ে নেবো ভেবে আমি আসার সময় এগুলো গুছিয়ে এনেছিলাম,ধরো এখন।আজ রাতে আমরা ঢাকায় ফিরে যাবো।তুমি তখন সেজে নিও’

লিখি মাথা নাড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তখনই মা পেছন থেকে এসে ঠাস করে ওর মাথায় একটা বাড়ি দিয়ে বললেন,’সালাম কর! ‘

লিখি জিভে কামড় দিয়ে সালাম করলো তারপর ওগুলো নিয়ে তার রুমে চলে গেছে।লিখির মা এবার মিসেস সামিয়ার পাশে বসে গেছেন গল্প করতে।
——
লাল শাড়ীটাকে গায়ে জড়িয়ে লিখি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিল, তাকে কেমন লাগে দেখতে।
এর আগে লাল শাড়ী তার পরা হয়নি।আসলেই লাল শাড়ীতে একটা গুণ আছে।এটা সৌন্দর্য অধিক বাড়িয়ে দেয় এবং নতুন বউকে নতুনের মতন করে রাখে।লিখির আর তর সইছেনা শাড়ীটা পরার।কি সুন্দর কিণারায় পুতির কাজ করা।মন চাইছে এখনই পরে ফেলতে।কিন্তু সে তো শাড়ী পরতে জানেনা।উল্টে নিজে পরতে গেলে শাড়ীটার ভাঁজই নষ্ট হয়ে যাবে।
নাবিল আসলে ওর হেল্পে পরে নিবে।আর দেরি করা তার পক্ষে অসম্ভব।
ফোন নিয়ে তাই নাবিলকে একটা কল করলো সে।নাবিল ততক্ষণে বাসায় এসে গেছিলো।
লিখি ভাবলো নাবিল ইচ্ছা করে ওর কল ধরেনি তাই রাগ করে ফোন রেখে শাড়ীটা নিজে নিজেই পরা শুরু করেছে।সে ভেবেছে নাবিল আসেনি এখনও।নাবিল ফোন দেখতে দেখতে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দুজন দুজনকে দেখে অন্যদিকে ফিরে গেলো।
নাবিল দূরের ফ্লাওয়ার ভাসের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,’চেঞ্জ করার আগে দরজা লক করতে হয়’

‘আমার রুমে কেউ আসেনা।আর আমি কি জানতাম নাকি যে আপনি হুট করে এসে পড়বেন?’

‘আমি এই জন্য কল কেটেছিলাম’

‘আচ্ছা এসেছেন যখন, আমাকে শাড়ীটা পরতে হেল্প করুন’

নাবিল হাত ভাঁজ করে বললো,’ঠিক ঠাক হয়ে দাঁড়াও তারপর।’

লিখি আঁচল ঠিক করে গায়ে দিয়ে বললো,’এবার ফিরেন’

নাবিল এবার রুমে এসে দরজা লাগিয়ে চুপচাপ কুচি করতে মন দিয়েছে।লিখি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললো,’আপনি শাড়ী পরাতে জানেন কি করে?’

‘নাহিদকে ২০০বারের মতন বউ সাজিয়েছিলাম।আমার একটা ছোট বোনের অনেক শখ ছিল।কিন্তু সেই শখ পূরন হয়নি বলে নাহিদকে দিয়ে মেটাতাম।ওকে বউ সাজাতাম ইচ্ছে হলেই।তো আম্মু আমাকে শাড়ী পরানো শিখিয়েছিল একদিন এরপর থেকে আমি নিজেই শাড়ী পরাতে জানি নাহিদকে।’

‘ওহ এই ব্যাপার’

‘তো তুমি কি ভাবলে?’

‘ভাবলাম প্রাক্তনকেও শাড়ী পরিয়েছেন’

‘ওর সাথে আমার যে সম্পর্ক ছিল ওটা ছিল ধরা ছোঁয়ার বাহিরে’

‘হইছে আর সাফাই গাইতে হবেনা।’
——-
লিখিকে শাড়ীটা খুব সুন্দর করে পরাতে পারলো নাবিল।লিখি আয়নার সামনে গিয়ে অবাক চোখে নিজেকে দেখছে।নাবিল শাড়ীটা চিনতে পেরে বললো,’এটা মা দিয়েছে তাই না?আমি অনেকবার দেখেছি এটা।আমাকে দেখিয়ে মা বলতো এটা আমার বউয়ের’

‘সুন্দর অনেক’

লিখি মাথার ক্লিপটা খুলে চুলগুলো ছেড়ে মাথা নাড়াচাড়া করছে এখন।ওর চুল তেমন লম্বা না হলেও অনেক ঘন।খোলা চুলে খুব সুন্দর লাগছিল ওকে।
নাবিল গয়না গুলো সরিয়ে রাখার সময় একবার সেদিকে তাকিয়েছিল।এই সুন্দর দৃশ্য দেখলে যেকোনো স্বামী এসেই জড়িয়ে ধরতো।নাবিলের ও ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু ভয়ে আর লজ্জায় চেয়েও পারেনি,যেটা পারার সেটা হলো শুধু চেয়ে থাকা।
লিখি কোমড়ে হাত রেখে ঘুরতে ঘুরতে বললো,’কি স্বামী মশাই?মাথায় কি ঘুরছে?কি করতে মন চাইছে আপনার?’

নাবিল এগিয়ে এসে কাছে দাঁড়ালো,ওর খুব কাছে।লিখি তো শীতল হয়ে গেছে।নাবিল তখন ফিসফিস করে বললো,’আমার কি ইচ্ছে করছে জানো?’

‘কি?’

‘আমার ইচ্ছে করছে….. ‘

কথাটা বলতে বলতে নাবিল ওর চুলে মুখ ডুবালো।লিখি চোখ বন্ধ করে থরথর করে কাঁপছে।নাবিল আবারও বললো,’আমার ইচ্ছে করছে চুল গুলো জোরে টেনে দিতে।ভূতের মতন দেখায় তো তাই’

লিখি চোখ মেলে নাবিলের দিকে ফিরে বললো,’সবসময় ভাল মুডটা নষ্ট করতে আপনার ভাল লাগে তাইনা?কি সুন্দর রোমান্টিক ছিলাম আমি,দিলেন তো সব খারাপ করে!’

‘যাক বাবা!!যেটা সত্যি সেটাই তো বলবো, মিছে মিছি কেন বলবো?’

‘মিছে মিছি?বউকে মনকাড়া কথা বলতে মন চায়না আপনার?আমি তো আপনারই বউ।আরেকজনোর তো না।আমাকে বলবেন না তো কাকে বলবেন?’

‘কিছু বলতে ভয় করে,আবার বলে না বসো যে এটা বলা মানে ভালোবাসা’
——-
লিখির পুরো পরিবার চাইলো ওনাদের আরও কটাদিন রেখে দিতে কিন্তু জনাব অনাবিলের অফিসের অনেক কাজ বলে তিনি আজ রাতেই চলে যেতে চাইলেন।কারণ ঢাকা যেতে যেতে গোটা রাত লেগে যাবে।পরেরদিন সকালে রওনা হলে ঐদিনটা নষ্ট হবে।
তাই আর কেউ বাধা দেয়নি।সবার কাছে বিদায় নিয়ে তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে।
নাবিলদের কারে জায়গা হচ্ছিলোনা।লিখির এক কাজিন সহ যাবে ওর সাথে।তাই রুহুল আমিন তার একটা গাড়ী নিয়ে যেতে বললেন ড্রাইভার সহ।
সেটাতে নাবিল,লিখি আর ওর কাজিন উঠেছে।তার নাম রিনতি।
রিনতি ক্লাস ফাইভে পড়ে।নিয়ম বলে তাকে লিখির সাথে পাঠিয়েছে লিখির আম্মু।
পথে সে সবার আগে ঘুমিয়ে পড়েছে, এদিকে লিখি বারবার গলা, হাত চুলকাচ্ছে।তার অস্বস্তি হচ্ছে শাড়ী পরে থাকতে।খুলে ফেললে বিশাল শান্তি লাগতো।
নাবিল ওকে নড়চড় করতে দেখে বললো,’কি বিচুটি পাতা লাগলো নাকি গায়ে?’

‘সেটার চেয়েও অসহ্য।’

‘কি হয়েছে?’

‘শাড়ীতে সমস্যা হয়।কেন যে পরতে গেলাম’

‘খুলে ফেলো’

কথাটা শুনে ড্রাইভার কারের ফ্রন্ট মিররে চোখ রাখলো।নাবিল মাথা ঘুরিয়ে বললো,’পরেছো যখন এভাবেই থাকতে হবে।কিছু তো করার নাই,এভাবে তো চেঞ্জ করতে পারবানা

লিখি হাত চুলকাতে চুলকাতে হেলান দিয়ে বসলো।নতুন শাড়ী বলে তার সমস্যা হচ্ছে এত।
নাবিল কারের ভেতরের আলো নিভাতে বললো ড্রাইভারকে তারপর গাড়ী থামিয়ে একটা দোকানে চা খেতে নামলো তারা।নাবিল দরজা খুলে বের হবার সময় নিজের গায়ের শার্টটা খুলে লিখির দিকে ধরে বললো,’শাড়ীটাকে স্কার্টের মতন পরো আর আমার শার্টটা পরে নাও ওপরে।আমি ড্রাইভারকে নিয়ে ঘুরে আসছি’

লিখি মুখে হাসি ফুটিয়ে ওর থেকে শা্র্টটা নিলো।
শার্টটা পরে ওর এত শান্তি লাগলো যে নাবিল আসার আগেই সে গাড়ীতে ঘুমিয়ে গেছে।নাবিল চায়ের কাপ নিয়ে এসে দেখলো তার বউ পা তুলে বসে জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমায় তাই ওর জন্য আনা চা’ টা ও খেয়ে উঠে বসলো গাড়ীতে।এরপর লিখির আঁচল টেনে ওর গায়ে জড়িয়ে দিলো।খুব শীত বেড়ে গেছে এই জায়গায়।নাবিলের গায়ে কেবল টিশার্ট একটা,তাও পাতলা।সে হাত ঘঁষতে ঘঁষতে ফোন টিপছে।
রিনতির তো খবরই নেই,সে আরও আরামে ঘুমায়।মাঝ দিয়ে নাবিলের ঘুম নেই।
লিখির জামাকাপড়ের ব্যাগটা বাবাদের কারে রয়ে গেছে।
—–
ভোর রাতের দিকে এসে ওর চোখ লেগে গেলো।লিখির কাঁধে মাথা রেখে সে ঘুমিয়েও গেছে।
অনেকক্ষণ পর একটা বড় ধাক্কায় লিখি জেগে গেছিলো।মাথা ফেরাতেই নাবিলের মুখের সাথে তার মুখ লেগে যাওয়ায় সে আশ্চর্য হয়ে দু মিনিট তাকিয়েই ছিল।

নাবিল ওর এত কাছে এই মূহুর্তে!! এতটা কাছে আজ পর্যন্ত তারা আসেনি।

চলবে♥

#মনের_কোণে🥀
#আফনান_লারা
#পর্ব_৩৭
.
ফুল দিয়ে বাসর সাজানো হয়নি।কেমন নিরামিষ টাইপের হয়ে আছে নাবিলের রুমটা।এলোমেলো রুমটাতে প্রবেশ করে লিখি মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে ছিল কিছু সময় ধরে।এলোমেলো বিছানা,এলোমেলো খোলা আলমারি,এলোমেলো আয়নার সামনের টেবিলখানা।রুমটা দেখার সব ইন্টারেস্টই নষ্ট করে দিয়েছে।
নাবিল লজ্জা পেয়ে সব ঠিক করতে করতে বললো,’আসলে আমি চলে যাবার পর বাবা রাগ করে আমার রুমে তালা লাগিয়েছিল।এরপর ঐদিন এসে আমি আমার কাজ সেরে আবার বরিশাল চলে গেছিলাম তারপর আজ এলাম।সবাই টায়ার্ড বলে গোছাতে পারেনি,রুমটাকে সাজাতেও পারেনি,তুমি এক মিনিট অপেক্ষা করো।আমি রুমটা ঠিক করছি।’

লিখি এগিয়ে এসে বিছানার চাদর টেনে ঠিক করে সেখানে বসলো।সকাল সাতটা বাজে এখন।সবে তারা বাসায় ফিরেছে।চোখে ঘুম তার খেলা করছে।বাকিরাও ঘুমিয়ে পড়েছে,এদিকে লিখির ও জমপেশ ঘুম আসছে।নাবিলের কাজ দেখতে দেখতেই সে ঘুমিয়ে গেলো।
নাবিল জামাকাপড় সব গুছিয়ে পেছনে ফিরে দেখলো লিখি ঘুমায়।
সে গিয়ে জানালার সামনের পর্দা সবগুলো টেনে দিলো।অনেক আলো আসছিল ঐদিকটা থেকে।
লিখির গায়ে এখনও নাবিলের শার্টটা।ভাগ্যিস বাবা -মা কেউ দেখেনি।
নাবিল ব্যাগ থেকে লিখির সেলোয়ার সুট একটা বের করে ওর পাশে রেখে নিজে গোসল করতে চলে গেছে।
গোসলটা করে বেরিয়ে মাথা মুছতে মুছতে নাবিল নিজের রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল,পাক্কা এক মাসের বেশি সময় ধরে রুম ছেড়ে বাহিরে ছিল সে।তার রুমটা তার ভীষণ প্রিয়।নিজের রুম ছেড়ে কোথাও যেতো না সে।
আজ আবার রুমে ফিরে এসে তার কি যে শান্তি লাগছে।
————
লিখি আটটার দিকে চোখ মেলে তাকালো।আশেপাশে কোথাও নাবিল নেই।পাশে হাত রাখতেই নিজর জামা দেখে হুশ ফিরলো তার।লাফ দিয়ে উঠে বসে নিজের গায়ের দিকে একবার তাকিয়ে দম ফেললো।নাবিলকে চোখের সামনে না দেখে প্রথমে চিন্তা হয়েছিল।
বিছানা ছেড়ে নেমে এসে জানালা থেকে পর্দা সরাতেই বাগানে নাবিলকে দেখে তার চিন্তা দূর হলো।
মুখে হাসি ফুটিয়ে এক দৃষ্টিতে ওকে দেখছিল সে।নাবিল বাগানে বসে নিউজপেপার পড়ছে।সামনে দাঁড়িয়ে কেউ তাকে দেখলে সে বুঝতে পারে,এখনও বুঝতে পারছিল বলে পেপার সরিয়ে মুখ তুলতেই লিখিকে দেখতে পেলো ওখানে দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হেসে যাচ্ছিল।
নাবিল ইশারা করে ওকে চেঞ্জ করতে বলায় লিখি আর দেরি না করে পর্দা টান দিয়ে জানালার কাছ থেকে সরে গেছে।
মিসেস সামিয়া আর জনাব অনাবিল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।নাহিদ তার রুমে গিয়ে সেও ঘুমাচ্ছে।আর রিনতি সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে।গাড়ীতে কেউই ভাল ভাবে ঘুমাতে পারেনি।তাই এখন সবাই ঘুমাচ্ছে।
—-
ফ্রেশ হয়ে এসে লিখি রুম থেকে বেরুলো।বিশাল একটা বাড়ি নাবিলদের।ঠিক লিখিদের মতন।
তবে বুয়া নেই।দুজন শেফের সুট পরা লোক রান্নাঘরে রান্না করছিল।লিখি তাদের রান্না করা দেখছিল দাঁড়িয়ে থেকে।
রুটি বানাচ্ছে একজন আর আরেকজন ভাজি বানাচ্ছে।অন্য একটা লোক হেঁটে হেঁটে আসবাবপত্র মুছতেছে খালি।সবাইকে দেখে নিয়ে লিখি বাগানের দিকে চলে গেলো।নাবিল পেপার রেখে রঙ চা খাচ্ছিল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বাগানের ফুলগুলোর গোড়া দেখছে আর বলছে পানি দেয়া হয়নি।
লিখি কাছে এসে বললো,’আমায় চা দেবেন না?’

‘রঙ চা এই এক কাপই বানিয়েছিল’

কথাটা বলে নাবিল চায়ের বাকি অর্ধেক লিখির দিকে ধরে খেতে বললো।সে ভেবেছিল লিখি হয়ত ওর মুখের চা খাবেনা।কিন্তু লিখি তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে চায়ের কাপটা নাবিলের হাত থেকে নিয়ে ওর সাথে হাঁটা ধরেছে।
কিছু সময় পর নাবিল লিখির দিকে ফিরে বললো ‘আচ্ছা তুমি চুরি কেন করতে?’

কথাটা যেন লিখির হজম হলোনা।রোবটের মতন দাঁড়িয়ে পড়লো হঠাৎ।নাবিল ওর এমন হাবভাব দেখে জানতে চাইলো কি হয়েছে।

‘আসলে আমি তখন সবে অনার্সে ভর্তি হয়েছিলাম। চাকরি পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছিল।এরপর একদিন আমার দেখা হলো খালার সাথে।উনি বললেন কিছু টেকনিক ইউজ করে আমি টাইমলি চুরি করতে পারি যাতে কেউ সন্দেহ ও করবেনা।খালাকে পেতে অনেক চড়াই উতড়াই যেতে হয়েছিল আমার।তারপর খালাকে পেয়ে কাজটা প্র‍থমে না না করেছিলাম বটে কিন্তু সয়ে গিয়েছিল।এরপর থেকে আমি এক্সপার্ট চোর।’

‘দারুণ।চুরি না করলে এতদিন তোমার সাথে আমার দেখা হতোনা, বিয়ে হতোনা।কিছুই হতোনা’

‘কার নিয়তি কোথায় লেখা আছে, কে জানে!!”

সেসময়ে মিসেস সামিয়ার ডাকে দুজনে পেছনে তাকালো।তিনি ওদের খাওয়ার জন্য ডাকছেন।নাবিল বললো পরে খাবে।কিন্তু লিখি বললো সে এখন খাবে তার খিধে পেয়েছে অনেক।তাই বাধ্য হয়ে নাবিল ও ওর সাথে চললো।
সামিয়া খাবারের টেবিলে বললেন,’আমি চাচ্ছি তোমাদের রিসিপশানটা হোক।তারপর বাসর ঘর ও সাজানো হলোনা তাড়াহুড়োতে।এক দিক দিয়ে তোমাদের পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ হয়ে যাবে আরও একবার,আত্নীয় স্বজনদের ও জানানো যাবে সব।কি বলো লিখি?’

‘আপনারা যেমন ভাল বুঝেন’

নাবিলও সাঁই দিলো।
খাবার শেষ করে নাবিল উঠে বললো সে আজ কিছু ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা করতে যাবে।ফিরতে রাত হবে, কথাটা বলেই ফোন পকেটে ঢুকিয়ে সে চলে গেলো,লিখির সাথে কোনো কথা বললোনা।লিখি মন খারাপ করে শুধু ওর চলে যাওয়া দেখেছে। সামিয়া বুঝতে পারলেন লিখির মন খারাপ, তাই ওকে ব্যস্ত রাখতে তিনি বললেন,’শোনো লিখি চলো শপিং করতে যাই।কাল রিসিপশানে কি পরবে সেটা আজ কিনবো, যাবে?’

লিখি খুশিতে গদগদ হয়ে বললো যাবে। তেমনটাই হলো।সকালের
নাস্তাটা সেরে তারা দুজন মিলে মার্কেট করতে বের হলো।
মার্কেটে তেমন একটা সময় কাটেনি।
গেলো আর শাড়ী পছন্দ করে কিনে তারা আবার চলেও আসলো।এগারোটার বেশি আর বাজলোনা।
লিখি নাবিলের রুমে এসে রিনতির বকবকুনি শুনছে অনেকক্ষণ।রিনতি বসে বসে নাহিদকে নিয়ে গল্প করছে।নাহিদ নাকি ওর দিকে ঢিল ছুড়েছিল এটা নিয়ে কত নালিশ তার।
শেষে রেগে গিয়ে লিখি বললো রুম থেকে বের হতে।এত বকবক ভাল লাগেনা তাও অসংগত কারণের।
নাবিল ফোন ধরছেনা,লিখির বিরক্তির সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
আর সহ্য হয়না এসব কিছু।
নাবিল আজ ইচ্ছা করেই চলে গিয়েছিল,সে লিখির মুখ থেকে ভালবাসার কথাটা বের করাতে চায়।লিখি আজ সারাদিনে একা থেকে বুঝে যাবে কত ধানে কত চাল হয়।
লিখি এখন গাল ফুলিয়ে টিভি দেখেছে,নতুন আনা শাড়ীটা উল্টো পাল্টে দেখেছে, নাবিলকে আরও কয়েকবার কল করেছে,,, রিনতির আজাইরা আলাপ শুনেছে।সময় আর কাটেনা।দুপুরবেলা সবার সাথে খাবার খেয়ে হালকা সময় কাটলো এরপর বিকাল থেকে আবারও সে একলা।
মিসেস সামিয়া রিসিপশানের কাজ নিয়ে ব্যস্ত।সোফায় বসে বসে দু ঘন্টা ধরে কেবল আত্নীয়দের কল করে যাচ্ছেন তিনি।
রিনতি নাহিদের সাথে খেলছে।অনাবিল অফিসে।
লিখি রুমে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়লো।
রাত অনেক হবার পর নাবিলের আগমন ঘটেছে বাসায়।সে ভাবলো লিখি হয়ত ঘুমে।কিন্তু না!সে এসে দেখলো লিখি খাটের এক কোণায় বসে নিরবে কাঁদছে আর চোখ মুছছে।
চোখ মুছার গতি অনেক বেশি তারমানে বেশি করে কাঁদছে।
নাবিল বুঝলো সে আজ লিখিকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।মাফ চাইতে হাঁটু গেড়ে নিচে বসে ওর হাত ধরতে যেতেই সে হাত সরিয়ে বিছানায় পা উঠিয়ে অন্যদিকে ঘুরে গেলো।

‘আই এম সরি লিখি,আসলে অনেকদিন পর বন্ধুদের দেখা পেলাম তো তাই তারা সারাদিন আসতে দেয়নি’

লিখি কিছু বলছেনা,শুদু কাঁদছে।নাবিল বিছানায় উঠে ওর সামনে এসে বসলো।
সে রাগ রে আবারও ঘুরতে যেতেই নাবিল দুহাত আটকে থামালো ওকে।ঠোঁট এগিয়ে ওর কপালে চুমু দিয়ে বললো,’প্লিজ মাফ করে দাও।আমি ইচ্ছে করেই কল কাটছিলাম।এটার জন্য সরি’

লিখি চুপ করে আছে।নাবিল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আবারও সরি বলতে গেলো কিন্তু তার আগেই লিখি বিছানা থেকে নেমে চলে গেছে।সোজা রিনতিকে যে রুম দেওয়া হয়েছে সে রুমে গিয়ে ওর সাথে শুয়ে পড়লো।নাবিল ওর পিছু পিছু এসে দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে বললো,’কানে ধরবো?’

লিখি কথা বলছেনা।নাবিল ওর পাশে বসে হাত ধরতে যেতেই সে উঠে বসে বললো,’আপনি রুম থেকে যাবেন?’

‘সরি একসেপ্ট কেন করছোনা?’

‘সেটার যোগ্য না আপনি।যান এখন’

নাবিল গেলোনা বরং ওকে ঠেলে ওর পাশেই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে।এদিকে রিনতি সবেমাত্র ঘুমিয়েছিল।ওকে জাগানোটা মোটেও ঠিক হবেনা।নাবিল ও নাছোড়বান্দা।রিনতির যাতে ডিস্টার্ব না হয় তাই লিখি উঠতে বাধ্য হলো।
চলে গেলো বাহিরে।নাবিল মুচকি হেসে সেও বের হলো।কিন্তু নাহ!লিখি রাগ কমানোর মানুষ না।সে সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে এবার।
নাবিল টেবিল থেকে পানি খেয়ে এসে লিখির সামনে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো।লিখি কুশন দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে আছে।

‘দেখো লিখি, যদি আমার সাথে রুমে না আসো তবে খুব খারাপ হয়ে যাবে’

লিখির কোনো সাড়া নেয়।নাবিল শার্টের হাতা উপরে তুলে নিচু হয়ে লিখিকে কোলেই তুলে নিলো এবার।লিখি আচমকা নিজেকে শূন্যো পেয়ে মুখ থেকে কুশন সরিয়ে দেখলো নাবিল ওকে রুমের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

‘এটা আপনি চিটিং করছেন!!আমার রাগ এভাবে ভাঙ্গানোর অধিকার আপনার নেই’

‘আমি স্বামী।আমার সব অধিকার আছে।ফলাতে পারি’

‘ছাড়ুন,নাহলে চেঁচাবো’

নাবিল লিখিকে বিছানায় এনে হাত ছেড়ে দিতেই লিখি ঠাস করে পড়লো নিচে।কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’আপনাকে ছেড়ে দিতে বলছি বলে এমন করে ছাড়বেন?আপনি খুব খারাপ একটা লোক।সারাদিন আমাকে কম কষ্ট দেন নাই। এখনও কষ্ট দিয়ে যাচ্ছেন।এটা ঠিক করছেননা!!’
চলবে♥