তবুও_তুমি ১৩ তম পর্ব

0
1824

তবুও_তুমি
১৩ তম পর্ব
.
বের হয়ে দেখি রাসেল ভাই নীল একটা পাঞ্জাবী পরে দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা এই লোকের ব্যাগে কি মিনি আলমারি নিয়ে ঘোরে নাকি। আজব কাহিনী তো এই পাঞ্জাবী পেল কই? সামনে এসে দাঁড়াতেই যেন সেই আগের মাতাল করা ঘ্রানের মাঝে হারিয়ে গেলাম। আমি সামনে এসে দাঁড়াতেই যেন ঘোর ভাঙ্গা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল ” আচ্ছা নিপা বল তো আমি কি স্বামী হিসেবে খুব খারাপ হবো?”। রাসেল ভাইয়ের মুখে এই প্রশ্ন শুনে আমি খুবই চমকে গেলাম। চোখের দিকে তাকিয়ে যেন অন্য এক মানুষকে দেখতে পেলাম। হাত দিয়ে আমার শাড়ির আঁচলটা ঘুরিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে আমার দিকে চুপ করে চেয়ে থাকলেন। ” বাহ আমার বউটাকে তো খুব সুন্দর লাগছে ” হঠাৎই বলে উঠলেন রাসেল ভাই। এক নিমেষেই মনে হল যেন পৃথিবী যেন ভোঁ চক্কর মারছে। তাহলে এই হল কাহিনী এই লোকই আমাকে বিয়ে করেছে। হায় কপাল আর আমি কি কি না ভেবে গিয়েছে। আমার ডান হাতটা বুকের বাঁ পাশে ধরে বললেন ” এই শরীরটা আজ পূর্ণ হল তোকে পেয়ে। তুই কি জানিস আমার বুকের হাড় দিয়ে আল্লাহ তোকে বানিয়েছে “। লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিলাম কেন জানি না। ” সে দিন বলেছিলি না যে পারলে তোকে নিজের করে নিতে। আমি কিন্তু তোর চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট করেছিলাম। এক সপ্তাহের ভিতরে সত্যিই তোকে নিজের করে নিয়েছি” এই বলেই মুচকি হাসি দিল সে। বৃষ্টিরাও যেন আজ আমার লজ্জার সাথে পাল্লা দিচ্ছে বেড়েই চলেছে। ” এখন তো তুই শুধুই আমার এবার তো অন্তত আর ঝাড়ি দিবি না তাই না?” সে প্রশ্ন করল আমাকে। ” এজন্যই তো বলি দিব্বি এত নির্ভয়ে আমার ঘরে আনোগোনার কারন এখন বুঝলাম ” মিনমিনিয়ে বললাম আমি। ” তুই এত বোকা কেন নিপা আর আমাকে এত ভয়ই বা পাস কেন ” হাত দিয়ে মুখ উঁচু করে বলল রাসেল ভাই। কিছু না বলে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইলাম চুপ করে। ” আমি পাঞ্জাবি পরলে তুই যে হা করে দেখতি সেটা যে আমি কত ইনজয় করতাম সেটা কি তুই জানিস? তুই চোরের মত চুরি করে আমাকে দেখে নিশ্বাস ফেলতি আর আমি দূর থেকে তোকে দেখে হাসতাম আর ভাবতাম ভালবাসে না ভয়ের চোখে আমাকে দেখে ” শান্ত শিষ্ট মানুষটাকে যেন আজ কথার নেশায় পেয়েছে। ” কালকে অনেক চেষ্টা করেছি তোকে বলতে যে আমিই তোর। কিন্তু ওই যে কথায় আছে কুকুরের লেজ সোজা হয় না কখনও তাই হয়ত পেঁচাইছিলাম”। তখন যে কি হল আমার আমি নিজেও জানি না দু হাত দিয়ে তার পাঞ্জাবির গলা টেনে ধরলাম হ্যাঁচকা টানে বকের মত গলা আমার মুখের সামনে নিয়ে আসলাম। ” আমাকে কষ্ট দিতে খুব মজা লাগে তাই না” একরাশ অভিমান নিয়ে বললাম তাকে। ” কথা দে কখনও আমাকে ছেড়ে যাবি না ” রাসেল ভাই আমার হাতটা ধরে বলল। ” উনার হাতটা জড়িয়ে বললাম ” কখনও যাব না আপনাকে ছেড়ে “। কতরাত পর্যন্ত যে হাতে হাত দিয়ে কাঁধে মাথা দিয়ে রেখেছিলাম জানি না। সকালে উঠে দেখি আমি বিছানায় এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছি আমার পাশে সেও ঘুম। কতক্ষন পরে মনে পড়ল যে আমি মনে হয় বারান্দায় বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমাকে এনে। নিজের অবস্থা দেখে লজ্জায় মরে যচ্ছিলাম। শাড়ি কই আর আমি কই উফফ কি একটা অবস্থা। পাশে ফিরে দেখলাম মানুষটা বেঘোরে ঘুম। আস্তে করে পাশে থেকে যখন উঠলাম আলগোছে উনাকে ওভারটেক করে নিচে নেমে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হতেই দেখি মিলি জিমি সামনে হাজির। দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে হাসছে। কালকে ওদের দেখে রাগ হচ্ছিল আজ আজকে পাচ্ছি লজ্জা। একি মানা যায়। ” কি রে নতুন বউ কেমন আছো ” দুলতে দুলতে প্রশ্ন করল মিলি। কোন রকমে পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম। খালার সামনে যেয়ে যেন লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম। নাস্তার টেবিলে মাথা নিচু করে পাউরুটি চাবাচ্ছি আর ভাবতেছি সবাই মনে হয়বামার দিকেই তাকিয়ে আছে। ভাবি উঠে এসেছে নাস্তা করছে ভাইয়া এখানও ঘুমে মনে হয়। নাস্তা খাওয়ার পরে ওই দুইটা গেল স্কুলে। খালা খালুকে নিয়ে বের হলেন বাজারের জন্য। ভাবি চেষ্টায় লাগল ভাইয়াকে উঠানোর কাজে। আমি রুমে এসে দেখি এক ফালি রোদ এসে পড়েছে মানুষটার পেটের উপরে। ফর্সা লোমশ পেটটা এত কিউট লাগছে যা বলার মত না। পর্দা গুলো ভাল করে টেনে রুমটা আরেকটু অন্ধকার করে দিলাম ভাবলাম ঘুমাচ্ছে ঘুমাক না আরেকটুকু।

কখন যে উনার পাশে শুয়ে আমিও আবার ঘুমিয়ে পড়েছি। চোখ মেলে দেখি আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
___ কি ব্যাপার কি দেখেন অমন করে?
___ ঘুমালে তোকে কত্ত কিউট দেখায় সেটা কি তুই জানিস? আচ্ছা তোর নাভি ছাড়াও আর একটা জায়গায় তিল আছে সেটা কি তুই জানিস।
বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বললাম, ” মানে কি আপনি করেছেন কি? “। সোজা হয়ে শুয়ে বলল ” আমার বউ আমি যা খুশি করতে পারি। তাতে তোর কি শুনি? ” এই নাছোড়বান্দার সাথে সারাজীবন কাটাতে হবে যে কিনা তার বউ ঘুমালে তিল খুঁজে বেড়ায়। আল্লাহ গো কি যে কপালে আছে আমার কে জানে।” যান ফ্রেশ হয়ে নেন আমি নাস্তা দিচ্ছি ” একথা বলে যেই আমি উঠতে যাব আমাকে চেপে ধরে শুইয়ে দিয়ে বলল ” তুই আমার সামনে শুয়ে থাক। তোকে দেখেই পেট ভরে যাবে নাস্তা লাগবে না “। কোন রকমে মোচড়ামুচড়ি করে বললাম ” আজকে আপনাদের বাসা থেকে যে মেহমান আসবে খেয়াল আছে তা? খালা মনে হয় বাজার নিয়ে এসেছে সব মিলতাল করা লাগবে “। তাকে নাস্তা দিয়ে আমিও যেয়ে কাজে বসলাম। রান্না বাড়া করতে করতে প্রায় একটা বেজে গেল। এতক্ষনে একবারো মানুষটার খোঁজ নিতে পারি নি। তাড়াতাড়ি করে রুমে ঢুকে দেখলাম আমার টেবিলে রাখা সমরেশ মজুমদারের ” গর্ভধারিণী” বইটা পড়ছে আর পাশে শুয়ে ভাইয়া ফোনে কি যেন করতেছে। ভাবি এসে ভাইয়াকে বলতে গেলে এক প্রক্স্র ধরে বেঁধেই নিয়ে গেল গোসলের জন্য। আমি কাপড় হাতে নিয়ে গোসল ঢুকবো এমন সময় পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আমাকে বলল ” জানো মেয়েদের কাজ করে আসলে কত্ত সুন্দর লাগে ঘামে ভেজা শরীর দেখলে নিজেকে সামলে রাখা দায় হয়ে যায় “। ” খালা লাঠি নিয়ে আসতেছে অর্ডার দিছে আপনাকে আর ভাইয়াকে রেডি হয়ে দশমিনিটের মধ্যে ড্রয়িংরুমে হাজির হতে”এই বলেই ঘুরে দাঁড়ালাম। ওমা আমাকে ঠেলা দিয়ে আমার হাতের টাওয়াল নিয়ে নিজেই ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতেছি কান্ডটা করতেছেটা কি। একটু পরে আবার দরজা ফাঁক হয়ে গেল হ্যাঁচকা টানে আমাকে ভিতরে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। গোসল করে যখন বের হলাম আধা ঘন্টা পার মেজাজটা এত্ত গরম হচ্ছিল যা বলার মত না। কেন যে এমন করে খালার হাতে বকা তো মাষ্ট দেখা গেল মাইর দিয়ে বসলেও অবাক হবার কিছুই নাই। উনাদের বাসা থেকে সবাই এসে খুব খুশি। আগে থেকেই চিনতো ঘরের বউ হওয়াতে যেন আর তাদের খুশিই ধরে না। শাশুড়ী মা দোয়া করে দিলেন আল্লাহ যেন তাদের ছেলেকে সহ্য করার ধৈর্য আমাকে দেয়। মনে মনে আমিও আমিন বলে নিলাম। এই দোয়াটা যে বড়ই প্রয়োজন আমার। ঠিক দুই দিন পরে এসে হাজির হুড়ুম করে ” ব্যাগ সব প্যাক কর আমাদের বাসায় যেয়ে থাকবি ” একথা বলেই সব নিজেই গুছানো শুরু করল। খালা বোঝালো খালু বোঝালো কারো কথায় কানে তুলল না। এক ভাইয়া খালি হামি দিতে দিতে বলল ” ওর বউ ও নিয়ে যাচ্ছে যাক না। তোমরা এমন করতেছ ক্যান? “। থ্রিপিস পরে রাত দশটায় এসে হাজির হলাম আমার নিজের বাড়ি। খুশিও লাগছিল হাসিও আসছিল ভয়ও পাচ্ছিলাম সে এক মিশ্র অনুভূতি। এসব অনুভূতি ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করলে যেমন লাগে ঠিক তেমন অনুভূতি। শাশুড়ী মা আমাকে দেখে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ঘরে তুলে নিলেন যেন আমি তার মেয়ে। ” রাসেল যে এই দুই দিন তোমারে ওই বাসায় রাখছে সেটাই তো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না ” হাসতে হাসতে বলল উনার মা। দিন গুলো যে কিভাবে চলে যায় তা হয়ত কেউ জানে না। আর সুখের দিন গুলো তো আরো তাড়াতাড়ি চলে যায়। বিয়ের দুই বছর পরে টের পেলাম আমার ভিতরে আরেকটা ছোট্ট আমির অস্তিত্ব খুশিতে নেচে উঠলো মন। উনাকে বলাতে উনি তো খুশিতে পাগল প্রায়। বড় আপুকে ফোন দিয়ে জানালাম বড় আপু ততদিনে সাদ ভাইয়ার সাথে ইতালি প্রবাসী। মানহা আপুকেও জার্মানি নিয়ে চলে গেছে। মিলি স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেছে সুইডেনে। জিমিটারও বিয়ে হয়ে গেছে সেও বাগেরহাটে থাকে।সময়ের সাথে সাথে কত চেঞ্জ হয়ে গেছে মানুষ।

” জানো আম্মু তোমার আর বাবাই এর প্রেম কাহিনী পড়ে আমি হাসতে হাসতে শেষ ” মিহানার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছি আমি। ” বাবাই তো প্রায়ই বলে তুমি নাকি বুদ্ধু। কিন্তু তুমি তো আমার সুপার মম। জানো আম্মু বাবাই এখনও তোমার সাথে যেমন জেদ করত আমার সাথেও করে” মুখ ফুলিয়ে বলল মেয়েটা। মুখ ফুলালে কেমন জানি মিহানাকে ঠিক আমার মত লাগে। মেয়েটা এত সুন্দর করে কি করে যে কথা বলে। ” মিহানা অনেক হয়েছে আম্মুর সাথে কথা এখন আর না। অন্য আরেকদিন আসবো এখন চল মা ” রাসেল ভাই আমার মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল। ” আচ্ছা বাবাই সবার আম্মু সবার কাছে থাকে আমার আম্মু কেন এখানে থাকে ” মিহানার প্রশ্নে যেন রাসেল ভাই চুপ হয়ে গেল। আমি জানি এখন উনার চোখ থেকে পানি আসি আসি করছে। মনে চাচ্ছিল চিৎকার করে বলি ” মা রে তোর বাবাই কে আর কিছু জিজ্ঞেস করিস না কারন উনি বারবার বলেছিল তুমি আগে বাচ্চা না।তাও শুধু মা ডাক শোনার জন্য সবার বিরুদ্ধে যেয়ে এই ছোট্ট প্রাণটাকে দশ মাস দশদিন নিজের মধ্যে আগলিয়ে রেখেছিলাম “। মেয়েটা যে আজ দশে পা দিয়েছে শাশুড়ী মায়ের কাছে একটা চিঠি রেখে এসেছিলাম মিহানার দশ বছর হলে যেন ওর হাতে এটা দেয়। ঠিকই পেয়েছে চিঠিটা। মেয়েটা বাবাইয়ের হাত ধরে সত্যিই চলে যাচ্ছে কিন্তু আমি যে দেখতে পাচ্ছি না। কারণ কবরের গহীন অন্ধকার থেকে শুধু শোনা যায় অনুভব করা যায় কিন্তু দেখা যায় না। বড্ড ইচ্ছা করছিল মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরি। বিধাতা বুঝি সব সুখ সবার কপালে দেয় না।

সমাপ্ত