#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৩২.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
মাহদির চালাকিটা ধরতে পারলো না মাহতিম। ছাদের দরজা দিয়ে ঢুকার পর পিছু ফিরেও দেখলো না। মাহদি যে ছাদের দরজা লাগিয়ে পেছন থেকে পালিয়ে গিয়েছে সেটাও বুঝলো না। মাহতিমের উত্থাল-পাত্থাল মন শুধু মেহনূরকে নিয়ে চিন্তিত ছিলো, আশেপাশের পরিস্থিতির উপর নজর ছিলো না তার। দু’কানে যখন শুনতে পেলো মেহনূর অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় কাঁদছে, তখন মন ও মস্তিষ্ক তীব্র উত্তেজনায় ফেটে পরলো। কি থেকে কি হলো সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবতে পারলো না মাহতিম। সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে ওভাবেই ফেলে দৌঁড় লাগালো ছাদের দিকে। সিড়ির প্রতিটি ধাপে হুলস্থুল ভঙ্গিতে পা ফেলে একদৌঁড়ে যখন মেহনূরের রুমে ঢুকলো, তখন নিশ্বাসের টানে হাঁপাতে থাকা মাহতিম দরজার প্রবেশদ্বারে থম মেরে দাঁড়িয়ে গেলো। ভেতরে ঢুকার জন্য বাড়িয়ে দেওয়া পা-টা আর যেনো এগুলো পারলো না, তৎক্ষণাৎ অচল হয়ে থেমে গেলো পা-টা। ঠোঁট খুলে অনবরত নিশ্বাস ছাড়ছিলো মাহতিম, কিন্তু চোখের সামনে যে দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলো তাতে ভেতরের অবস্থা কাহিল করে দিচ্ছিলো তখন। হাতদুটো মুঠোবন্দি করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের সীমায় আবদ্ধ রাখার প্রতিজ্ঞায় ছিলো। বুকের হৃদপিন্ডটা এতোক্ষন দৌড়ের জন্য ধড়াস-ধড়াস করছিলো, কিন্তু এখন যে অবস্থা হচ্ছে তাতে তাকিয়ে থাকার দিব্যি নেই। মাহতিম তৎক্ষণাৎ নিজের দৃষ্টিদুটো ফ্লোরে নামিয়ে ফেললো। বাইরে থেকে আসা আলোয় রুমটা তখন উজ্জ্বল ছিলো, জানালাগুলো খোলা থাকার জন্য শোঁ শোঁ করে বাতাস প্রবেশ করছে এখন। সিলিং ফ্যানটা মৃদ্যু রেগুলেটর পেয়ে বেশ অল্প গতিতে ঘুরছে, দমকা হাওয়ার জন্য রুমের পরিবেশটা বেশ ঠান্ডা হয়ে আছে। মাহতিম তখনো স্বাভাবিক হতে পারছিলো না, একটু আগে মাহদির কাছে যে ঘটনা শুনলো, তার সাথে এই দৃশ্য কোনোভাবেই খাপ খায় না। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মেহনূর, গায়ের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে গাঢ় বেগুনির শাড়ি। কনুই অবধি ঢেকে থাকা ব্লাউজটা আজ যেনো অপ্রস্তুত দেখা যাচ্ছে, অজান্তেই সেটা ফর্সা পিঠকে উন্মুক্ত করে মাহতিমের বুকে এফোড়-ওফোড় করে দিচ্ছে। পিঠের উপর থেকে লম্বা আচঁলটা সরে বিছানার ঢাল বেয়ে নিচে পরে আছে। দীর্ঘ কেশগুলো বেণীমুক্ত হয়ে এলোমেলো অবস্থায় আঁচলের সাথেই ফ্লোরে স্থান নিয়েছে। ঘুমন্ত মেহনূর উপন্যাসের পাতায় মশগুল ছিলো, সেই মশগুলের রেশ কখন যে দীর্ঘ হলো টের পায়নি। ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের ‘ শাপমোচন ‘ বইটা বেখেয়ালি ভঙ্গিতে খোলা পরে আছে। নিদ্রামগ্নে ডুবে আছে ছোট্ট দেহের মানুষটা। যার মুখটা বাইরের আলোয় নীলাভ হয়ে আছে এখন, ঠোঁটদুটোর লালচে রঙটা আশেপাশের মানুষকে কতোখানি নাজুক করে দিচ্ছে সে হিসেব অসংগত। মাহতিম কিছুক্ষণ স্থির রইলো ঠিকই, কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে সংযত করে জোরে দুটো নিঃশ্বাস ছাড়লো। চোখদুটো উপরে তুলতে-তুলতে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতদুটো স্বাভাবিক করতে থাকলো। মেহনূরের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে ধীরে-ধীরে ওর দিকে এগুতে লাগলো। বিছানার দিকে যতো নিকটগামী হচ্ছিলো, ততই বেসামাল হচ্ছিলো ওর দেহমন। মেহনূরের খুব কাছাকাছি যাওয়ার ইচ্ছাটা আজ দারুণভাবে ফলাতে পারতো মাহতিম, কিন্তু সে ইচ্ছা ধূলোয় উড়িয়ে মেহনূরের পাশে গিয়ে বসলো। ঘুমন্ত মুখটাকে একটুখানি ছুঁয়ে দেবার তেষ্টায় ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলো। সেই তেষ্টাকে সাঙ্গ করে মেহনূরের কোমল গালটা আঙ্গুলে-আঙ্গুলে ছুঁয়ে দিতে থাকলো মাহতিম। মলিন দৃষ্টিতে নিজের যন্ত্রনাগুলো ক্ষুদ্র করে গুটাতে থাকলো, মনের অদৃশ্য বাক্সে সকল আক্ষেপ জমা রেখে মেহনূরকে গাঢ়দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো। ঘুমের ঘোরে লালচে ঠোঁটদুটো কেঁপে-কেঁপে উঠছে মেহনূরের, চোখের পল্লবজোড়াও ফোপানোর ভঙ্গিতে নড়েচড় উঠছে। অধরযুগলের কাঁপুনি দেখে বুকের কোথাও চিড়চিড় করে বিঁধছে মাহতিমের। সেখান থেকে কোনোভাবেই দৃষ্টি সরানো যাচ্ছে না। চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করা ওষ্ঠদুটিকে ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য মন আকুলিবিকুল করছে, উৎকন্ঠায় ভুগছে, ছটফট করছে তীব্রভাবে। মাহতিম নিজের ব্যকুল ইচ্ছাটা দমিয়ে রেখে মেহনূরের গাল থেকে হাত সরাতে লাগলো, আঙ্গুলগুলো গাল ছুঁতে-ছুঁতে কম্পিত ওষ্ঠের উপর রাখলো। হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ওষ্ঠদুটি আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দিলো মাহতিম। বৃদ্ধাঙ্গুলটা নিরবে সরিয়ে নিতেই বাকি চারটে আঙ্গুল দিয়ে মেহনূরের অধরজোড়ায় আলতো চাপ দিলো। সেই চাপের স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ রাখলো না, কয়েক মূহুর্ত্তের ভেতর সরিয়ে নিলো। লালচে ঠোঁটের উষ্ণতাটুকু পেতে নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল ছোঁয়ালো মাহতিম। অজানা প্রাপ্তিতে, চাপা গ্লানিতে, অদ্ভুত শান্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। মেহনূরের সাথে কাটানো প্রতিটি মূহুর্তই চোখের পলকে স্মৃতিচারণ করে ফেললো। চোখ করা অবস্থায় মুচকি হাসিতে হেসে দিলো মাহতিম, ধীরে-ধীরে ঠোঁট থেকে হাত নামিয়ে নিলো। দমকা হাওয়ায় খসখস করে বইয়ের পৃষ্ঠা উড়ছে, বাতাসের তেজ বেড়ে যেতেই হুরহুর করে পৃষ্ঠা উলটে যাচ্ছে। মাহতিম বইটা নিঃশব্দে বন্ধ করে ফেললো, সেখান থেকে তুলে নিয়ে পাশের টেবিলে রেখে দিলো। রুমের কোণায় থাকা আলমারির দিকে নজর পরলো তার, চুপচাপ আলমারির কাছে গিয়ে দুই দ্বার খুললো। ঘ্যাচ করে শব্দ হতেই দ্বারদুটো খুলে গেলো, কিন্তু শব্দের সুক্ষ্ম আওয়াজে নড়েচড়ে উঠলো মেহনূর। ঘুমের মধ্যেই উপুড় অবস্থা থেকে বাঁ’কাত হয়ে শুলো। মাহতিম এক পলকের জন্য পিছু ফিরে মেহনূরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলো, মেহনূর জেগে গেলো কিনা সেটাই যেনো সজাগ দৃষ্টিতে দেখছে। না, মেহনূর উঠেনি, কিছু টেরও পায়নি। মাহতিম স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে কম্বল বের করলো, আলমারির দুই দ্বার আগের চেয়েও কম শব্দ করে বন্ধ করলো। মেহনূরকে কম্বলে ঢেকে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু নিচে যেতে পারলো না মাহতিম। ছাদের দরজা বাইরে থেকে আটকানো দেখে প্রচুর অবাক হলো। দরজায় কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে পুনরায় মেহনূরের রুমে ফিরলো। মেহনূরের বিছানায় যতটুকু জায়গা ছিলো তাতেই মাহতিম গুটিশুটি পাকিয়ে কম্বল টেনে শুয়ে পরলো। মাঝখানে দূরত্ব থাকলেও সেটা অবশ্য বিশাল দূরত্ব না। মেহনূর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ঘুমালেও মাহতিম ওর দিকেই মুখ করে ঘুমালো। মেহনূর তখনও ঘুমে বিভোর ছিলো।
.
মাহতিমের সাথে চালাকি করে নিজেকে সম্রাট-সম্রাট লাগছে মাহদির। বড় ভাইকে টেক্কা দেওয়াটা কোনো চাট্টিখানি কথা না। তার উপর ভাই যদি নিরাপত্তাকর্মীর সদস্য হয়, তাহলে তো হিংস্র বাঘের সাথে লড়াই বলা চলে। এসব নিয়ে ভাবতে-ভাবতে নিজের প্রতি গর্ব বোধ করছে মাহদি। এদিকে মাহদির রুমের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো সিয়াম। মাহদিকে ওমন বিজয়ী স্টাইলে হাসতে দেখে তৎক্ষণাৎ হাঁটা থামিয়ে ফেললো। তাড়াতাড়ি মাহদির কাছ থেকে আড়াল হওয়ার জন্য দরজার পাশ থেকে উঁকিঝুঁকি চালাতে থাকলো। মাহদি কেনো হিহি করে হাসছে সেটাই এখন বিষ্ময়ের ব্যাপার। ওর মতো ছোটকা পোলাপান না-জানি কি করে এসেছে কে জানে? সিয়াম সেটাই তখন ধরার জন্য চটজলদি রুমে ঢুকে গেলো। হাতদুটো বুকের কাছে ভাঁজ করে সরু দৃষ্টিতে বলতে লাগলো,
– নতুন করে কি করেছিস বলে ফ্যাল পাগলা। যদি এবার ধরা খাস! মাহতিম তোর পিঠের চামড়া তুলে শুটকি বানাবে।
সিয়ামের কথা শুনে মাহদি গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো। এতোক্ষণ যেই হাসিটা ঠোঁটে লেগে ছিলো সেটা গাম্ভীর্যের আড়ালে ঢেকে গেলো। সিয়ামের দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– আমি কি দোষ করেছি? তুমি না ঘুমিয়ে এখানে কি করছো?
মাহদির কথায় চোখদুটো আরো ছোট করলো সিয়াম। হাতদুটো স্বাভাবিক করে মাহদির দিকে এগিয়ে গেলো। মাহদি যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিলো, কিন্তু সিয়ামের জন্য সেটা সম্ভব হলো না। মাথায় সজোড়ে একখানা চাট্টি খেয়ে ওমনেই ধরাশায়ী হলো মাহদি। তখনই পেটের কথাগুলো সিয়ামের কাছে গড়গড় করে উগরে দিলো,
– সিয়াম ভাইয়া, তোমার মারগুলো খুব লাগে। দয়াকরে আর মেরো না। আমিতো কিছুই করিনি। কাল ভাইয়া চলে যাচ্ছে। এদিকে আমার বউ ভাইয়ার শোকে-শোকে সন্ধ্যার দিকে খুব কাঁদছিলো। এমনেই জানো, আমার এসব ভালো লাগে না। এজন্য ভাইয়াকে ছাদে আঁটকে দিয়েছি। চার রাউন্ড গেম খেলেই দরজা আবার খুলে দিয়ে আসবো।
সিয়াম কথাগুলো শোনার পর বিশাল বড় হা করে তাকালো, অক্ষিকোটরও বড়-বড় করলো। পিটপিট করে চোখের পাতা ঝাপটাতে লাগলো। আহাম্মকের মতো কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতেই বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
– তুই সত্যিই এই কাজ করেছিস?
মাহদি দ্রুত মাথাটা উপর-নিচ দোলাতে লাগলো। কথাটা হ্যাঁ সূচকে বোঝানোর পর সিয়ামের চোখে-মুখে এমনি অবস্থা দেখা গেলো, যেনো খুশীর ফোয়ারা উপচে-উপচে পরছে। সিয়াম চওড়া একটা হাসি মাহদির কাধটা গর্বিত সূচকে চাপড়ে বললো,
– ওয়েল ডান শয়তানের হাড্ডি! যা কাজ করেছিস না, আহা! তোকে তো চুমিয়ে চুমিয়ে লালপল্টু বানাতে মন চাচ্ছে। আয় বাবু আয়, তাড়াতাড়ি বুকে আয়। তোকে একটু আদর করি, আয়।
সিয়ামের অবস্থা দেখে ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেছে মাহদি। সিয়াম বারবার মাহদিকে কাছে টানাটানি করছে, ঠোঁটদুটো চুমু স্টাইলে উঁচিয়ে-উঁচিয়ে হাবিজাবি প্রলাপ বকছে। মাহদি চোখ-মুখ বিরক্তিতে ডুবিয়ে সিয়ামের দিকে এক ধাক্কা মারলো। আকস্মিক ধাক্কা খেয়ে সিয়াম একটু পিছিয়ে গেলে ওমনেই হুড়মুড় করে বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে দৌড় লাগালো মাহদি। দরজার বাইরে যেই পালাতে নেবে ওমনেই মাথা পিছু ঘুরিয়ে কাটকাট ভঙ্গিতে বললো,
– ভাইয়া যে ছাদে আছে, এ ব্যাপারে যেনো কেউ না জানে। মা যদি জানতে পারে, তাহলে কিন্তু সমস্যা হবে। নীতি আপুকে চাইলে বলতে পারো। কিন্তু ফারিনকে ভুলেও বলতে যাবে না।
কথাটুকু শেষ করেই ছুট লাগালো মাহদি। বিছানায় পরে থাকা সিয়াম মাহদির অবস্থা দেখে আনমনেই হাসতে লাগলো। হাসতে-হাসতে খোলা জানালার বাইরে তাকালো সিয়াম। রাতের আকাশটার দিকে দৃষ্টি যেতেই ঠোঁট থেকে হাসি সরে যেতে থাকলো। আগামীকাল থেকে দুটো বন্ধু একই যন্ত্রণা অনুভব করবে। একই ব্যথায় জর্জরিত হতে থাকবে দিনের-পর-দিন। প্রিয়তমাকে দূরে রাখার ব্যাথায় দগ্ধ হবে হৃদয়। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাবে মনের প্রতিটি স্তর। সৌভিক তো এতোদিন সহ্যসীমায় আঁটকে ছিলো, মাহতিম কি করবে সেটা তো আগেভাগে বলা যায়না। কখনোই না।
.
তিলতিল করে এগিয়ে যাচ্ছে সময়। গভীর হচ্ছে ততো রাতের প্রহর। দূর থেকে ভেসে আসছে শহুরে কুকুরের ডাক। মাঝে-মাঝে শোনা যাচ্ছে ট্রাকের শ্রুতিহীন হর্ণের আওয়াজ। মাথার উপর ঘূর্ণায়মান ফ্যানটা বেশ ভালোই বাতাস ছড়াচ্ছে। সেই বাতাসের জোরে হিম হয়েছে মেহনূরের দেহ। শীতের প্রভাবে কাটা দিয়ে উঠছে শরীরের পশমস্তর। মেহনূর হালকা মতোন জেগে উঠলে কম্বলটা থুতনি পযর্ন্ত টেনে নিলো। পাদুটো গুটিশুটি পাকিয়ে ঠিক করে শুতেই হঠাৎ সৎবিৎ ফিরে পাওয়ার মতো চমকে উঠলো মেহনূর! ওমনেই গায়ের কম্বলটা সরিয়ে শোয়া থেকে তড়িঘড়ি করে উঠতে নিলো, কিন্তু যেই মুখটা ডানে ফিরালো, ঠিক তখনই মেহনূরের উঠাটা থেমে গেলো সহসা। দুহাতের কনুইদুটোতে ভর রেখে আধশোয়া ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে মেহনূর। ডানপাশে যে ব্যক্তিটি শুয়ে আছে, তাকে দেখে গায়ের চামড়া এখন শীত ছাড়াই কাটা দিচ্ছে। মেহনূয প্রথমে চিন্তা করলো, হয়তো সে ভুলভাল দেখছে। কিন্তু যখনই মাহতিমের দিকে হাত বাড়িয়ে মোটা পেশির বাহুটা ছুঁলো, তখনই নিশ্চিত হলো এটা মাহতিমই। মেহনূর কিছুক্ষণ নির্বাক চাহনিতে তাকিয়ে থেকে পুনরায় বালিশে মাথা রেখে শুলো। মাহতিমের ঘুমন্ত মুখটার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো মেহনূর। গালটা হাতের তালুতে রেখে ঘুমিয়ে আছে মাহতিম, অন্যহাতটা বিছানার উপর রেখে দিয়েছে সে। মেহনূর ঘুমন্ত চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকলো ঠিকই, মাহতিমকে নিয়ে কোনো অভিব্যক্তি সে প্রকাশ করলো না। যেভাবে শুয়েছিলো, ঠিক সেভাবেই মাহতিমের দিকে পিঠ দিয়ে ঘুমালো মেহনূর। চোখদুটো বন্ধ করার অনেক চেষ্টা করলেও মাহতিমের উষ্ণতার জন্য বেচইন অনুভব করছিলো। ওই হাতটা যখন দেহের উপর থাকে, পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে, শক্তভাবে আগলে রাখে, পরম উষ্ণতায় খোলসের মতো আবদ্ধ করে দেয়, বুকের উষ্ণতা দিয়ে বুঝিয়ে দেয় ‘ আমি তোমার সাথেই আছি ‘, তখন মেহনূর নিজেকে কতটা নিরাপদ অনুভব করে সেই অনুভূতি ব্যক্ত করা অসম্ভব ব্যাপার। মাহতিম ঘুমের মধ্যে ঠিকই তলিয়ে ছিলো, টের পায়নি মেহনূর যে একটুখানি উষ্ণতার জন্য আবারও তার কাছে ঘেঁষছে। মেহনূর নিচের ঠোঁটটা দাঁতে চেপে একধাপ পেছনের দিকে পিছিয়ে গেলো, মাহতিমের হাতটা বিছানা থেকে উপরে তুলে ওর বুকটার সাথে সন্তপর্ণে পিঠ মিলিয়ে দিলো। শূণ্যে ধরে রাখা মাহতিমের হাতটা নিজের দেহের উপর নামাতে লাগলো মেহনূর। এবার হাতটার জায়গা পরিবর্তন করে পেটের উপর নামাতে থাকলো। ভারী হাতটার ওজন পেটের উপর ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। বড় একটা ঢোক গিলে মাহতিমের হাতটার উপর নিজের হাত রেখে দিলো মেহনূর। সে যে চলে যাচ্ছে, বহুদিনের জন্যই ছেড়ে যাচ্ছে। কবে আসবে, কখন ফিরবে, কিচ্ছু বলেনি মানুষটা। কিভাবে আত্মার সাথে জুড়ে গেলো সবকিছু, কিভাবে তার জন্য একটু-একটু করে কষ্ট অনুভব হচ্ছে, মেহনূর এতোসব প্রশ্নের উত্তর কিছুতেই জানে না।
.
নরম বিছানায় গোল হয়ে বসে আছে সবাই। রাত তখন তিনটা বিশ বাজে। নীতির মুখটা অমাবস্যা রাতের মতো কালো হয়ে আছে, বাকিদের অবস্থাও এক। মাহদি ঢুলতে-ঢুলতে নীতির কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে, অথচ বাকিদের চোখে ঘুম নেই। একটু আগে যে লোমহর্ষক খবরটা পেয়েছে তাতে হুঁশ-জ্ঞান বিগড়ে আছে সবার। আগামীকাল কেমন ঝড় আসতে চলেছে কেউ ধারণা করতে পারছে না। প্রীতি কোনোভাবেই স্থির হতে পারছে না। অস্থির ভঙ্গিতে বারবার হাতের তালু হাত ঘষছে। নীতির সামার ভেকেশান শেষ হয়েছে চারদিন আগেই, কিন্তু সেটা গোপন রেখেছিলো নীতি। আজই মেইলে খবর এসেছে দ্রুত কান্ট্রিতে ফিরে যাওয়ার জন্য। নীতি যে ক্যাম্পাসের আন্ডারে পড়াশোনা করছে, সেখানে হুট করেই প্রোগ্রাম দিয়ে ফেলেছে, যেই প্রোগ্রাম এ্যান্টেন্ট করা খুব জরুরী। নীতি না পারতে কাল দুপুরের দুটো টিকিট কেটে ফেলেছে, যেখানে একসঙ্গে দু’বোনই ফিরে যেতে বাধ্য। যদি কোনো কারণে ভিসা জটিলতায় পরতে হয়, তাহলে আর রক্ষে নেই। এদিকে মাহতিমের ফুপুও মেয়েদের ফেরা নিয়ে টেনশনে পরে গেছেন, প্রোগ্রাম এ্যান্টেন্ড করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা তিনিও জানেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বীভৎস যে খবরটা এসেছে, সেটার জন্যই মূলত ঘুম হারাম অবস্থা চলছে। সৌভিক অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর মুখ খুললো। নিজের ডার্ক সার্কেলের চোখদুটো এলার্জির জন্য কচলাতে-কচলাতে বললো,
– মাহতিমকে আগে ঠিকঠাক মতো বিদায় করা দরকার। মাহতিম আগে কাজে ফিরুক। আপাতত সবকিছু সিচুয়েশনের উপর ছেড়ে দে। তোরা বেশি ভাবিস না। ভাবীর দিকে খেয়াল রাখার জন্য কেউ-না-কেউ ঠিকই প্রেজেন্ট থাকবে, টেনশন নিস না।
সৌভিক শেষ করলেধ চোখদুটো তখনো কচলাচ্ছিলো। ওর অবস্থা দেখে পাশ থেকে ফারিন বলে উঠলো,
– চোখ কচলিয়েও না ভাইয়া। চোখ প্রচুর ব্যথা করবে। অলরেডি খুব লাল হয়ে গেছে। আর কচলিয়েও না।
সৌভিক কয়েক সেকেন্ডের জন্য ফারিনের দিকে তাকালো।ফারিন ‘ না ‘ সূচকে মাথা নাড়িয়ে বারণ করার ইশারা দিচ্ছিলো। এদিকে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়তে-ছাড়তে তৌফ বলে উঠলো,
– শালার একটা কাহিনী ফিনিশ মারলে আরেকটা কাহিনী টপকায়া পরে। তোরা আমারে বল, এই মূহুর্তে ওই বা’ন্দি ছেড়ির আহনের দরকার আছে? হুদাই তো মুখটা খারাপ হয় না। এইসব বা’লের উপ্রে ছা’লের কারবার দেখলে মুখটা আরো নষ্ট হয়। আমারে আর ভালো হইতে দিলো না।
তৌফের বিশ্রী ভাষা শুনে সবাই বিরক্তিতে তাকালো। কিন্তু মুখ ফুটে কিচ্ছু বলার অবস্থায় ছিলো না কেউ। মাহদি যদি জেগে থাকতো, তাহলে মিনি বাঘের মতো হামলে ধরতো ঠিকই। এটাকে মাহতিমের জুনিয়র কপি বলা চলে। ত্যাড়াত্যাড়া কথা বললে ডিরেক্ট এ্যাকশন! সামিক সবার নিরবতাকে চ্ছিন্ন করে বেখেয়ালী সুরে বলতে লাগলো,
– তৌফ ভাই, প্লিজ ব্রাদার, তুমি এখন মুখ খারাপ করো না। সবার মাথাই এলোমেলো হয়ে আছে। কি করলে সবকিছু ঠিক হবে কেউ জানি না। তুমি জাস্ট প্রে করো, ওই মামী যেনো ভাবীর জীবনে কিছু না করে। ভাবী যে হাজারটা উষ্টা খেলেও অভিযোগ করবেনা, এটার সুযোগই মামী লুফে-লুফে খাবে। মাহতিম ভাই না থাকলে কি অঘটন ঘটবে, তোমরা সবাই এ বিষয়ে কম-বেশি জানো। শেফালীর মতো ধুরন্ধর মহিলাকে ট্যাকেল দেওয়ার জন্য মাহতিম ভাই জোশ খেলা দেখিয়েছে। কিন্তু এখন পুরো ম্যাটারটাই আলাদা।
সামিকের কথায় সায় জানাতে গিয়ে আবার মুখ খারাপ করলো তৌফ। এবারের ভাষাটা নর্দমার মতো জঘন্য করে বিশ্রী ভঙ্গিতেই বললো,
– স্কুল কলেজের বাথরুম দেখছোস না? ওইসব বাথরুমে স্পেশাল কিছু কমোড থাকে জানোস তো? ওই বাথরুমের সুঘ্রাণ এতোই ভালো, পাবলিক দশ মাইল দূর থাকলেও নাক টিইপা হাঁটে। ওইসব বাথরুমে এইগুলারে ঢুকায়া টানা একমাস আঁটকায়া রাখতে মন চাইতাছে। বিশ্বাস কর, সবগুলায় জন্মের শিক্ষা পাইবো। যাগোর কারেন্ট বেশি, ওগোর কারেন্ট এমনেই ছুটানো দরকার।
তৌফের প্রতি বাজেভাবে ক্ষেপে গেলো প্রীতি। কিন্তু নীতির বাধা পেয়ে আর যেনো এগুলো না। সবাই একসঙ্গে সশব্দে নিঃশ্বাস ছাড়লে ভূতুড়ে পরিবেশের মতো অনুভূত হলো তখন। নিরবতা আঁকড়ে ধরলো কঠিনভাবে।
.
পূব আকাশে দেখা যাচ্ছে দগদগে অরুণ পিন্ড। কিচিরমিচির আওয়াজে মুখর পরিবেশ। ভোরের খোলস ছেড়ে অরুণ আলোয় পরিণত হয়েছে আকাশের রূপ। শহুরে কোলাহল কিছুটা হ্রাস পেলেও পাখির ডাকে-ডাকে মনোরম লাগছে এখন। মেহনূর আড়মোড়া ভেঙ্গে চোখের পল্লব খুলে তাকালো, গা থেকে কম্বল সরিয়ে হাত দুটো টানা দিয়ে নিলো। বড় একটা হাই ছাড়তে-ছাড়তে হঠাৎ চৈতন্য পাওয়ার জন্য হড়বড় করে উঠে বসলো সে। আশেপাশে, চতুর্দিকে মাহতিমকে খুঁজতে লাগলো, কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলো না তাকে। মেহনূর পাগলের মতো উন্মুখ হয়ে মাথায় খোপা পাকাতে থাকলো। শাড়িটা ঠিক করে মুখটা কোনোমতে ধুয়ে তাড়াতাড়ি নিচে নামতে লাগলো। সিড়ি দিয়ে নিচে নামলো ঠিকই, কিন্তু বাড়িতে কাউকে খুজেঁ পেলো না। এদিক-ওদিক সবদিকে তাকিয়ে দেখলো মেহনূর, কেউ আশেপাশে ছিলো না। মেহনূর উন্মাদের মতো এই রুম থেকে ওই রুমে দেখতে থাকলে হঠাৎ পেছন থেকে একটা চাকর কৌতুহলে থমকে দাঁড়ালো। মেহনূরকে দেখে বিষয়টা বুঝতে পেরে নিজ থেকেই বলে উঠলো,
– দিদিমনি, আপনি কি মাহতিম বাবাকে খুঁজছেন?
মেহনূর অনবরত হাঁপাতে-হাঁপাতে পিছু ফিরে তাকালো। ঠোঁট খুলে হাপানির মতো নিঃশ্বাস ছাড়তেই পাগলের মতো হ্যাঁ সূচকে মাথা ঝাঁকাতে থাকলো। বয়োবৃদ্ধ ষাটোর্ধ্ব চাকর সিরাজ মেহনূরের দিকে ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
– দিদিমনি, বাবা যে গাড়িতে চড়লো। গাড়ি ছেড়েছে কিনা —
বৃদ্ধ কথাটা শেষ করার সুযোগ পেলো না, মেহনূরের জোরালো পদক্ষেপের গতিতে সেখানেই হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। মেহনূর কখনো শাড়ি পড়া অবস্থায় দৌড়ায়নি, আজ যে দৌড়াতে গিয়ে কতটা কষ্ট হচ্ছে, মেহনূর তবুও প্রাণপণে দৌড় লাগিয়ে বিশাল ড্রয়িংরুমটা পার করার চিন্তায় ছিলো। কিন্তু তখনই সশব্দে বাইরের হাওয়াটা গরম হয়ে উঠলো, গাড়ির দরজাগুলো ঠাস-ঠাস করে আটকানোর আওয়াজ হচ্ছিলো, মূহুর্ত্তের ভেতর দুটো হর্ণ বাজতেই সবচেয়ে ভয়াবহ শব্দ হিসেবে আওয়াজ হলো, গাড়ি ছেড়ে যাওয়ার শব্দটা।
– চলবে
#FABIYAH_MOMO .
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৩৩.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
গাড়ি ছাড়ার শব্দ হতেই সদর দরজা ধরে দাঁড়িয়ে পরলো মেহনূর। চোখের সামনে যে দৃশ্যগুলো দেখতে পেলো তাতে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে ওর। দৌড়ের জন্য একটুও স্বাভাবিক হতে পারছে না সে, বুকের হৃদপিন্ড যেনো লাফ দিয়ে গলায় বসে গেছে। বারবার ঢোক গিলেও খসখসে গলাটা সিক্ত করতে পারছে না, নিশ্বাসের টানে বারবার বুক ফুলিয়ে হাঁপাচ্ছে। আরো জোর খাটিয়ে দৌড়ানো দরকার, মাহতিমকে আটকানোর জন্য শেষ শক্তিটুকু খরচ করতে কুণ্ঠিত নয় মেহনূর। কিন্তু এতখানি দৌড়ে এসে গলাটা নিশ্বাসের টানে ছিড়ে যাচ্ছে যেনো, ঢিপঢিপ করে কাঁপছে বুকটা, শরীরটা এমন হতবিহ্বল-শক্তিশূণ্য লাগছে তাতে মনেহচ্ছে জ্বর থেকে কেবল উঠেছে মেহনূর। কাঠের আভিজাত্য দরজায় হাত রেখে ফ্লোরের দিকে মাথা নুয়ালো মেহনূর, মুখ হা করে জোরে-জোরে শ্বাসকার্য চালাতেই শাড়ির কুচিগুলোর অবস্থা এলোমেলো দেখতে পেলো। পায়ের কাছে কুচিগুলো খানিকটা নিচে নেমে গেছে, একপা এগুতে গেলেই উষ্টা খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। মেহনূর জোরে-জোরে দম নিতেই দরজা থেকে হাতটা ধীরেসুস্থে নামিয়ে ফেললো, উষ্টার হাত থেকে বাচার জন্য কুচিগুলো উচুঁ করে ধরলো। বড় বড় দুটো গভীর নিশ্বাস নিতেই সামনের দিকে তাকালো মেহনূর। ওমনেই নিশ্বাসটা ছাড়ার সুযোগ হলো না, স্থিরদৃষ্টিতে থমকে গেলো মেহনূর। এতোক্ষন যেই ঝড়টা টের পায়নি, হঠাৎ সেটা এমনভাবে গ্রাস করলো তখন আর স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না মেহনূর। চোখদুটো টলমল করে উঠলো ওর, তীব্র জোয়ারের মতো উত্থাল-পাত্থাল হয়ে গাল জুড়ে অশ্রু গড়াতে লাগলো। হেড কোয়ার্টার থেকে আসা চকচক সাদা গাড়িটা চলে যাচ্ছে, বেগতিক স্পিডে এগিয়ে যাচ্ছে বাড়ির মেইন গেটের দিকে। তীব্র ক্ষোভে তাকিয়ে মেহনূর ছিলো, ভেবেছিলো একবিন্দু কাঁদবে না, নিজের মনকে বারবার বুঝ দিচ্ছিলো ওরকম নিষ্ঠুর ব্যক্তির জন্য কষ্ট পাওয়া যাবেনা। গাড়িটা যখন মেইন গেটের বাইরে চলে গেলো, যেতেই বায়ে বাক নিয়ে হারিয়ে গেলো, তখনই দু’পাটি দাঁত শক্ত করে ডুকরে কেদেঁ উঠলো মেহনূর। ফিসফিস আওয়াজে চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে ফেললো, সমস্ত শরীর কান্নার হিড়িকে কাঁপতে লাগলো ওর। ঘুমে ছিলো বলে এতো বড় শাস্তি দিলো? কে জানতো চোখের পাতায় ঘুমের যুদ্ধটা হানা দিবে? মেহনূর যদি জানতো মাহতিম ওকে না জানিয়ে চলে যাবে, তাহলে মেহনূর ঘুমাতোই না। সারারাত যেই মানুষটার হাত টেনে ঘুমালো, তার বিদায়কালে একটাবারও দেখা মিললো না, দেখা হলো না তার হাসিমাখা মুখটা। পেছন থেকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো বৃদ্ধ সিরাজ। তিনি মাহতিমকে বিদায় জানিয়ে মাত্র রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিলো, ওই মূহুর্তে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় মেহনূরকে দেখে কিছুটা অবাক হয় সে। পরক্ষণে যখন আসল ব্যাপারটা ধরতে পারে ততক্ষণে গাড়িটা ছেড়ে দিয়েছে। মেহনূরকে সদর দরজার সামনে ওভাবে ফুপিয়ে কাঁদতে দেখে প্রচণ্ড উদাস হয়ে গেছে সিরাজ, নিজের বয়সটা যদি আগের মতো ক্ষমতাবলে থাকতো তাহলে সাইকেলের প্যাডেল হাঁকিয়ে থামাতে যেতো গাড়িটা। খোলা দরজার বাইরে একপলকের জন্য দৃষ্টি দিলো সিরাজ, হেড কোয়ার্টার থেকে আসা বিশেষ গাড়িটা দৃষ্টিসীমার মধ্যে নেই। নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে গাড়িটা চলে গিয়েছে। একবুক হতাশা নিয়ে সশব্দে নিঃশ্বাস ছাড়লো বৃদ্ধ, মেহনূরকে অসহায়ভাবে কাঁদতে দেখে তার মনটা আরো গুমিয়ে যাচ্ছে। নিরুপায় সিরাজ মন শক্ত করে পুনরায় কাজের দিকে রওনা দেওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে যেতে নিলো, কিন্তু হুট করে কি যেনো ভেবে সদর দরজার বাইরে দৃষ্টি দিলো, ওমনেই বৃদ্ধ প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে স্বর গুলিয়ে ফেললো! থরথর করে কাঁপতে থাকা হাতটা মেহনূরকে ডাকার জন্য উঠালো কিন্তু বৃদ্ধ একটুও কথা বলতে পারলো না। বিষ্ময়ের ঘোরে মুখে হাত চাপা দিলো বৃদ্ধ! একবার কান্নারত মেহনূরের দিকে তাকালো, আরেকবার বাইরে তাকালো নির্বাক দৃষ্টি দিয়ে। বাড়ির বাইরে থাকা সৌভিক, মারজা, নীতি, প্রীতিরা চরম আশ্চর্য হয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে ফেলেছে! মারজা কৌতুহল দমাতে না পেরে সঙ্গে-সঙ্গে বলে উঠে,
– এ কি অবস্থা! গাড়ি যে ফিরে আসছে?
মারজার কথা শেষ না হতেই সাদা গাড়িটা ইউ-টার্ণ স্টাইলে ঘুরে এলো। নীতি-সহ সবার মনে কৌতুহল জাগিয়ে তুমুল স্পিডে ভেতরে ঢুকতে থাকলো গাড়িটা। সবার সামনে দিয়ে ধূলো উড়াতে-উড়াতে ড্রাইভারের বিশেষ দক্ষতায় গাড়িটা সদর দরজার কাছে গিয়ে একদম সিড়ি ঘেঁষে থামলো। কয়েক সেকেন্ডের ভেতর যে দাপুটে খেলা চললো, সেই খেলা দেখে বোকার মতো তাকিয়ে আছে সবাই। যেই মেহনূর ক্ষতবীক্ষত মন নিয়ে কাঁদছিলো, সে এখন সদ্য থামা গাড়িটার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাদা রঙের গাড়িটা নতুনের মতো চকচক করছে, চকচক করছে গাড়ির প্রতিটি কাঁচের জানালা। ভেতরে যে ব্যক্তিটি বসে আছে, তাকে বদ্ধ জানালার জন্য দেখা যাচ্ছে না। গাড়িটার দিকে অবাকের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সবাই, সবার মধ্যে আকাশসমেত কৌতুহল কাজ করছে। মাহদি বাদে সবাই তখন নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করছে। মারজা কপাল কুঁচকে সদ্য স্থির হওয়া গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলো, মারজাকে দেখতে পেয়ে জানালার কাঁচ একটু যেনো নামলো। কৌতুহলী মেহনূর দূর থেকে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। ফাঁক হওয়া জানালার মধ্য দিয়ে কি ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে কেউ জানে না। মিনিট দুয়েক কথা বলার পর মারজা যেনো স্বাভাবিক হলো, তাঁর কৌতুহলী মুখটা যেনো সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে শান্ত হয়ে গিয়েছে। মারজা কিছু খোলাখুলি না বলে সৌভিকদের ইশারা দিয়ে ভেতরে যেতে বললো, সৌভিকরা আরো আশ্চর্য হয়ে গেলো, কিন্তু মারজার অমান্য করলো না কেউই। বিষয়টা প্রথম-প্রথম কেউ বুঝতে পারেনি কেউ, কিন্তু নীতি যখন ছোট্ট একটা ইঙ্গিত বুঝালো, তখন সবার কাছে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। মেহনূরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সবাই যেনো মিচকি-মিচকি হাসছে, মেহনূর ওদের হাসির কারণটা তখনও ধরতে পারেনি। হতবাক মেহনূর অবুঝের মতো তাকিয়ে-তাকিয়ে সবার যাওয়া দেখছিলো, এরই মধ্যে ধরাস করে খুলে গেলো দরজা। অন্যমনষ্ক মেহনূর দরজা খুলার প্রবল আওয়াজে মৃদ্যুভঙ্গিতে শিউরে উঠলো, তৎক্ষণাৎ মাথা ঘুরিয়ে গাড়িটার দিকে দৃষ্টি দিলো। সঙ্গে-সঙ্গে দেখতে পেলো, গাড়ির সামনের সিট থেকে অদ্ভুত পোশাকের লোক বেরিয়েছে। লোকটাকে ড্রাইভার বলা বললেও তার পোশাক-আশাক মোটেও স্বাভাবিক ড্রাইভারের মতো না। মেহনূর বড় বড় চোখ তুলে ড্রাইভারকে দেখতে লাগলো তখন। মেহনূর মনে করতে লাগলো সেই ছোটবেলার স্মৃতিগুলো। গ্রামে একবার সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা সরকারি কাজে এসেছিলো, তাদের পড়নে ছিলো অদ্ভুত রঙের পোশাক। সেই পোশাকটা দেখার পর বাচ্চা মেহনূর দাদাভাইয়ের হাত ঝাঁকি দিয়ে প্রশ্ন করেছিলো, লোকগুলো কারা? প্রত্যুত্তরে হান্নান শেখ মুচকি হাসি দিয়েছিলেন, নাতনীর ছোট-ছোট আঙ্গুলগুলো আদরে আগলে ধরে বলেছিলেন, দাদুভাই ওরা সেনাবাহিনীর মানুষ। ওরা দেশের জন্য কাজ করে। দাদাভাইয়ের মুখ থেকে ওমন উত্তর শুনে অবুঝ মেহনূর আবার তাদের দিকে তাকায়। তাদের প্রত্যেকের কাছে থাকা বিশাল-বিশাল বন্দুকগুলো দেখতে পেয়ে ভীষণ ভয় পায়। সেই বন্দুক দিয়ে প্রচুর মানুষ মারা যায় এমন ঘটনা দাদার মুখ থেকে শুনেছিলো মেহনূর। সেই থেকেই তাদের দেখলে ভীরুতা কাজ করে ওর। মনেহয়, তাদের কাছে গেলেই বন্দুক ঠুকে মেরে ফেলবে। আজ একই পোশাকের মানুষ দেখে মেহনূরের পুরোনো ভয়টা মনের উঠোনে ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে। মাঝে-মাঝে ধাক্কা দিচ্ছে হাতুড়ির মতো ধুকধুকনিটা। মেহনূরকে কাঁচুমাচু করতে দেখে ড্রাইভার একটু অপ্রস্তুত হলো ঠিকই, কিন্তু অফিসারের বউকে সম্মান দেখানোর উদ্দেশ্যে মাথাটা নিচু করে সালাম ঠুকলো। ড্রাইভারকে ওরকম অবস্থায় দেখার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না মেহনূর, এদিকে যে কুচির অবস্থা নাজেহাল হয়ে গিয়েছে সেদিকেও যেনো বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই ওর। ড্রাইভার নিজের কাজ সমাপ্ত করে সোজা বাড়ির অন্যদিকটায় চলে যেতে লাগলো, এমনভঙ্গিতে যেতে লাগলো যেনো আগেই যথা-আজ্ঞা পেয়ে গেছে ড্রাইভার। পাখির কিচিরমিচির ডাক ছাড়া দ্বিতীয় কোনো শব্দ ছিলোনা তখন। পরিবেশটা সোনালী রোদের আলোয় ঝলমল করছিলো খুব, সোনালী আলোটা কাঁচের জানালায় তীর্যকভাবে পরতেই মেহনূরের চোখ ধাঁধিয়ে উঠলো। তৎক্ষণাৎ চোখদুটো ছোট-ছোট করে আধবোজা করে ফেললো মেহনূর, চট করে ডানহাতটা চোখের উপর রেখে তীর্যক আলোটা আড়াল করার চেষ্টা করলো। চোখের উপর ছায়া পেতেই চোখদুটো খুললো মেহনূর, আঙ্গুলের প্রতিটি ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি চলে গেলো গাড়ির চকচকে জানালায়। কাঁচটা ধীরগতিতে নিচে নামছে এখন, যতই নিচের দিকে নামছে ততই বেড়ে যাচ্ছে বুকের ধড়ফড়-ধড়ফড় অবস্থা। মেহনূর নিজের সবটুকু চাহনি দিয়ে জানালার ভেতর স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো, চোখের সামনে ওই মানুষটার মুখ যত পরিদৃষ্ট হচ্ছে ততই বাঁহাতের মুঠোয় ধরা কুচিগুলো ভয়ঙ্করভাবে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিষ্ময়ে বড় হচ্ছে চোখের চক্ষুতারা, নির্বাক হচ্ছে মুখের ভাবভঙ্গি। জেল দিয়ে সেট করা চুলগুলো আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় স্মার্টলি ব্রাশ করা, গালদুটোর অবস্থা ক্লিন-সেভ দেখা যাচ্ছে, চোখে ব্রাউন স্ট্যান্ডার্ডের সানগ্লাস লাগানো তার, মুখে কোনো হাসি নেই। সজাগ চাহনিটা আজ চশমার জন্য দেখা যাচ্ছে না, মুখটা কেমন শক্ত-কঠোর করে রেখেছে, দেহভঙ্গিতে প্রকাশ পাচ্ছে আলাদা গাম্ভীর্য মূর্তি, যা ছিলো না কোনোভাবে। ব্রাউন গ্লাসটার ভেতর দিয়ে তীক্ষ্মদৃষ্টিটা সোজা মেহনূরের দিকে পরলো এবার, মেহনূর সেকেন্ডের ভেতর থতমত খেয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। জোরে একটা ঢোক গিললো, লম্বা একটা নিশ্বাস নিলো, আবারও হতবিহ্বল চাহনি নিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো। মেহনূরের হাঁশফাশ অবস্থা দেখে গম্ভীর মুখে ধীরে-ধীরে কিরণফোঁটার মতো হাসি ছলকে উঠলো মাহতিমের। মুচকি হাসিতে হেসে দিলে মাথাটা ডানে-বামে হালকাভাবে নাড়াতে লাগলো সে। খট করে দরজাটা খুলে বাইরে পা রাখলো মাহতিম, সিট থেকে বাইরে বেরুতেই হা করে চোয়াল ঝুলালো মেহনূর। আশ্চর্য দৃষ্টিতে মাহতিমের দিকে চোখ বুলাতেই চশমার দুই ডাট ধরে সানগ্লাস খুললো মাহতিম। মেহনূরের দিকে এগিয়ে আসতেই হাতটা পেছনে ঘুরালো সে, সিটের দিকে হাতটা তাক করতেই চালান দিলো চশমাটা, ওমনেই চশমাটা গদিতে বারি খেয়ে একটু দূরে ছিটকে পরলো। মেহনূর ক্ষণকালের জন্য মাহতিমের পেছনে থাকা চশমাটার দিকে নজর দিয়ে তাকালো, এদিকে মাহতিমের তীক্ষ্মদৃষ্টি মেহনূরের উপর পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছে। বিদায় না দেওয়ার জন্য অবস্থা কেমন খারাপ হয়েছে সেটাই দেখতে পেয়ে বাঁকা হাসছে মাহতিম। নাকের মাথাটা রক্তিম দেখে ঠোঁটের হাসিটা বেড়ে গেছে ওর, চোখের অবস্থা কতটা নাজেহাল হয়েছে সেটা আর বলার প্রয়োজন রাখে না। মাহতিম ডানেবামে একবার চোখ ঘুরালো, আশেপাশে কোনো কাক-পক্ষিও নেই সেটার হিসেব বুঝে ভালোভাবে আশ্বস্ত হলো। মেহনূর উজবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মেহনূরের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো মাহতিম। চোখের পলকেই দুহাত এগিয়ে মেহনূরের খুলে আসা চুলগুলো খোপা পাকাতে থাকলো। কুচি ধরা হাতটা বৈদ্যূতিক শক খাওয়ার মতো ঝট করে ছেড়ে দিলো মেহনূর, কুচিগুলোও একের-পর-এক পরে গিয়ে পায়ের কাছে জড়ো হয়ে গেলো। খোপা পাকা থাকা মাহতিম খানিকটা আশ্চর্য হয়ে নিচের দিকে তাকালো। কুচিগুলো যে ওর জন্যই নষ্ট হয়ে গিয়েছে সেটা বুঝতে পেরে খিলখিল করে হেসে উঠলো মাহতিম। হাসিটুকু ঠোঁটে রেখে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বললো,
– তুমি কি চাচ্ছো কালরাতের মতো আবারও তোমাকে স্পর্শ করি?
মেহনূর উত্তর দিলো না কোনো। চোখের সামনে শুভ্র পোশাকের ব্যক্তি দেখে হৃদযন্ত্র বেকায়দায় ধকধক করছে ওর। গলা শুকিয়ে কাঠ ফাঁটা মাঠের মতো খাঁ খাঁ করছে যেনো। বুকটায় যেহারে ধকধক ছন্দের তাল উঠেছে, প্রচণ্ড উৎকন্ঠায় হাঁশফাশ করতে-করতে পিছিয়ে যাচ্ছে মেহনূর। কালরাতেও যে মানুষটা স্বাভাবিক ব্যক্তির মতো শুয়েছিলো, যার হাতটা টেনে নিজের অবুঝ মনকে শক্ত করেছিলো, আজ তাকে অন্য বেশে দেখে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে মেহনূর।বলিষ্ঠ দেহে আষ্টেপৃষ্টে ঢেকে আছে সাদা টানটান পোশাক, সাদা শার্টের নিচে ঢেকে আছে গতরাতের প্রশস্ত বুকের জায়গাটা, সাধারণ প্যান্টের বদলে আজ দেখা যাচ্ছে সাদা রঙের প্যান্ট। কোমরের বেল্টটাও যেনো অদ্ভুত রকমের আজ, ইন-করা শার্টটা সুকৌশলে বেল্ট দিয়ে আঁটকে রেখেছে মানুষটা। বুকের ডান-পকেটে লেগে আছে বিভিন্ন ধরনের ব্যাজ, সেই ব্যাজ যে একেকটা দূধর্ষ অর্জনের চিহ্ন সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিটি ব্যাজের দিকে একবার-একবার করে চোখ বুলালো মেহনূর, শরীরের রক্ত যেনো টগবগ করে ছুটে যাচ্ছে তার।
হৃদপিন্ডের দ্রুতক্রিয়ায় বিবশ লাগছে নিজেকে। মেহনূরকে অবসন্ন দেখে বিষয়টা ধরতে পারে মাহতিম। তৎক্ষণাৎ আর দেরি না করে হাতটা খাবলে ধরে ওর। যতোটা দূরে গিয়েছিলো মেহনূর, সেটা ধূলোর মতো ঘুচিয়ে দিয়ে কাছাকাছি আনলো তাকে। ফর্সা চিবুকটা ডানহাতে ছুঁয়ে মুখটা নিচে নামালো মাহতিম, ঠোঁটদুটো এগিয়ে মেহনূরের কপালে গাঢ় চুমু দিতে গিয়ে থেমে গেলো। মেহনূর তীব্র উৎকন্ঠায় ক্ষণিকের জন্য শ্বাস আটকে রেখেছিলো, সেই ক্ষণিকের মূহুর্ত যখন আর সম্পণ্ণ হলো না তখন বাধ্য হয়ে চোখ খুললো মেহনূর। সাথে-সাথে মাহতিমের মুখটার দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু কিছুই দেখা গেলো না। যতবার জোরে-জোরে দম নিচ্ছে ততই নাসাপথে সুগন্ধ পারফিউমের সুভাস প্রবেশ করছে। নিজেকে অন্যভুবনে আবিষ্কার করতেই হঠাৎ যেনো কানে শান্তসুরটা ভেসে এলো,
– তুমি কি একা থাকতে পারবে মেহনূর? রাতে যে আমি থাকবো না কিভাবে থাকবে? কালরাতে একটুও আশা করিনি, বিশ্বাস করো তোমার পেটে আমার হাত ছিলো, মানে তুমি আমার হাত টেনে ঘুমিয়েছো। তুমি আমাকে কতখানি বিশ্বাস করো এবার বুঝতে পেরেছো? তুমিতো নিরবেই তোমার সবটুকু বিশ্বাস আমায় দিয়ে দিয়েছো। এখন কি থাকতে পারবে?
কোনো উত্তর নেই মেহনূরের। বুক ফুলিয়ে জোরে দম নিতেই নিচের ঠোঁটটা উপরের ঠোঁট দিয়ে আবদ্ধ করলো সে। একবার মাহতিমের প্রশ্নসূচক দৃষ্টির দিকে তাকালো, এরপর দৃষ্টি ঘুরালো মাহতিমের বুকের বাঁপাশটার দিকে। সেখানে সূর্যের আলোতে চকচক করছে কালো-সোনালীর আয়তাকার নেমপ্লেটটা। নেমপ্লেটের প্রতিটি অক্ষর নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে পরতে লাগলো মেহনূর। M. ANSARI – ইংরেজি বর্ণমালায় লিখা চারকোণা নেমপ্লেটটার উপর থেকে দৃষ্টি সরালো মেহনূর। এদিকে মাহতিম নিরবে নিজের হাতদুটো নামিয়ে ফেললো। মেহনূর বাকহীন ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছিলো,মাহতিমের প্রতি বিন্দুমাত্র বিশেষ অভিব্যক্তি প্রকাশ না করে ঝাপসা চোখে তাকালো সে। রাগে-ক্ষোভে-অভিমানে তীব্র আক্ষেপে বলতে লাগলো,
– আপনার আসল পরিচয়টা আগে জানলে আমি হয়তো কোনোদিন আপনাকে চাইতাম না, চাইতাম না, কোনোদিন চাইতাম না। আপনি চলে যান। আপনি এখুনি চলে যান। আপনাকে চাই না। চলে যান।
অদ্ভুত ভঙ্গিতে কথাগুলো বলতেই হু হু করে কেদেঁ উঠলো মেহনূর। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে মাহতিম। বাক্য ফুরিয়ে শব্দ হারিয়ে মূঢ় হয়ে গেছে সে। হতবাক-নির্বাক অবস্থাটা না কাটাতেই বাঁহাতের কবজিটায় টিকটিক করা ঘড়ির দিকে সময় পরোখ করলো। এখনো হাতে যতটুকু সময় আছে, সেটা ওর জন্য যথেষ্ট সময় নয়, ফ্লাইট মিস হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তবুও হাতেনাতে রিস্কটা নিয়ে ধাম করে গাড়ির দরজাটা পা দিয়ে আঁটকালো মাহতিম। মাহতিমের পরিবর্তিত রূপ দেখে বিচলিত হলো মেহনূর, ভাববার সময় না পেতেই ডান কবজিটা চোখের পলকে মাহতিমের হাতের বলয়ে চলে গেলো। মাহতিম বেপরোয়াভাবে কোলে তুললো মেহনূরকে, আশেপাশে দৃষ্টি না দিয়ে গ্যারেজটার দিকে হনহন করে এগিয়ে গেলো। এদিকে দরজার পাশ থেকে উঁকিঝুঁকি চালাচ্ছে মাহতিমের ভাইবোন ও বন্ধুর দল। দুপাশের সদর দরজার চিপায় লুকিয়ে-লুকিয়ে দুজনের অবস্থা দেখছিলো ওরা, মিয়া-বিবি মিলে কি সিন-সিনারি দেখায় সেটার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলো। অথচ মাহতিমের ওমন যাওয়া দেখে সবক’টা হতাশ হলো। মাহতিম কি টের পেলো নাকি এখন সেটা নিয়েই চিন্তা হচ্ছে। যদি মাহতিম সত্যি-সত্যিই টের পেয়ে যায় তাহলে একটারও গায়ে চামড়া থাকবে না। ছাল তুলে খাল বানিয়ে সেখানে কুমির চাষ করবে মাহতিম। ভয়ে সবার বুকটা দুরুদুরু করছে। নীতি ওদের সঙ্গ দেওয়ার জন্য এখন নিজের নির্বুদ্ধিতার উপর লজ্জাবোধ করছে। যদি মাহতিম নীতিকে ধরে ফেলে তাহলে কানটা ছিড়ে কোথায় ভাসিয়ে দিবে কে জানে। দরজার দু’দ্বারের চিপা থেকে সবগুলো বেরুল তখন, সবার মুখের উপর ভয়ের ছায়া নেমে এসেছে। মুখগুলো কালো হয়ে ভয়ের আশঙ্কায় উশখুশ করছে। সিয়াম ছিঃ ছিঃ ভঙ্গিতে মাথায় হাত দিয়ে বললো,
– তোরা কি নাস্তার সময় আমার পানিতে কিছু মিশাইছিলি? আমি কি নেশা করছি? লা হাওলা — এইটা কি করলাম? এখন যদি মাহতিম ধইরা ফেলে আমার মান-ইজ্জত কই থাকবো? কি মুখ নিয়া ওর সামনে বন্ধু পরিচয় দিমু? শা’লা’রপুতে তো আমারে লাইত্থায়া শেষ করবো।
সিয়ামের কথা শেষ না হতেই রাগী সুরে সৌভিক বললো,
– আমি বারবার তোদের না করছিলাম, বারবার বলছিলাম এমন শয়তানি করিস না। ওরা জামাই-বউ, ওদের প্রাইভেসিটা এ্যাটলিস্ট ছেড়ে দে। তোরা কি ভুলেও আমার কথা শুনছিলি? এখন ভয় পাস কিসের জন্যে?
সৌভিকের কথায় চটে উঠলো তৌফ। সাথে-সাথে সৌভিকের পিঠে দুম করে এক ঘা বসিয়ে ছাড়লো। সৌভিক চোখ রাঙানি দিয়ে তাকালে টগবগে রাগটা আরো দুদফা দেখালো তৌফ, তখনই তৌফের কাজে বাধা দিয়ে হায়হায় কন্ঠে বললো সিয়াম,
– আরে ভাই থাম তোরা। প্লিজ এমন করিস না। আপাতত থাম, আগে দেখ মাহতিম গ্যারেজে ঢুকছে নাকি। ওর ভাবসাবে তো মনে হইলো ভাবীরে গলা টিপা ধরবো।
সিয়ামের কথাটা শেষ করতে দেরি, ওমনেই পেছন থেকে শান্ত-শক্ত কন্ঠ ভেসে এলো। সবাই একযোগে সেদিকে তাকালে তখনই মাহদিকে দেখতে পেলো । মাহদির হাতে মারজার এন্ড্রয়েড ফোনটা দেখে সবাই সরু দৃষ্টিতে তাকালো। মাহদি চুপচাপ হেঁটে আসতে-আসতেই ফোনটা থ্রি-কোয়াটার প্যান্টের ডান পকেটে পুরলো। সিয়ামের ভীত মুখটার দিকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে বলতে লাগলো,
– তোমরা যে একেকটা বোকা এটা নিয়ে সন্দেহ নেই। দরজাটার চিপায় না লুকিয়ে জানালার পাশেই লুকাতে পারতে। ভাইয়া তোমাদের দেখেনি বুঝছো? ভাইয়ার এ্যাটেনশন এখন আমার বউয়ের দিকে। আমার বউ যে বিদায় না দিতে পেরে কেদেঁছিলো, সেটার জন্য ভাইয়া এসেছে। এখন হাট-পাট গুটিয়ে নিজেদের রুমে যাও। তাদের বিরক্ত করো না।
মুরুব্বির মতো বয়ান দিয়ে আবার ফোনটা বের করলো। পাবজির গেমটা বের করে সেটা স্টার্ট করতে-করতে রুমে চলে গেলো মাহদি। নিজেদের বোকামির ধরণটা সামান্য একটা পুচকে ছেলে ধরিয়ে দিচ্ছে এর চেয়ে লজ্জার ব্যাপার হয়? সবাই নিজেদের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করলো, নিজেদের গাধামির অবস্থা দেখে তখন সবাই একসাথে নিশ্বাস ছাড়লো। মাহতিমের রাগ দেখে সবাই মনে-মনে চিন্তায় ভুবে আছে। নীতি অসহায় দৃষ্টিতে মুখ তুলে সবার দিকে চোখ বুলাতে-বুলাতে বললো,
– কি বি’পদ হলো এটা? কেনো হলো? ভাইয়ার এই মূহুর্তে রেগে যাওয়াটা শুভ লক্ষণ নয়। আমরা যেটা নিয়ে ভয় পেয়েছিলাম সেটাই কেনো হলো? যদি মেহনূর রজনী মামীর ভাগ্নীর ব্যাপারে জেনে যায় তখন কি হবে? আর কতো ঝামেলা হবে রে ভাই? কেউ কি এ ব্যাপারে ভেবেছো? আমরাও তো থাকছিনা, তোমরাও চলে যাচ্ছো। মেহনূর তো একটুও শান্তি পাবেনা সৌভিক ভাই। আমি আর ভাবতে পারছি না। সামনে কি হবে কেউ তো বলো? টেনশনে আর থাকা যাচ্ছে না।
– চলবে
#FABIYAH_MOMO