মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-৪৬+৪৭

0
837

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪৬.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

লাস্যময়ী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটা, অশ্লীল ভাবে বাঁকা দাঁতটা দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে । তার ভাবভঙ্গি দেখে একটুও ঘাবড়ালো না মাহতিম, তার মস্তিষ্কের প্রতিটি নার্ভ খুব সচল, তার দৃষ্টিজোড়াও খুব কৌশলের সাথে মেয়েটার আচরণবিধি পরোখ করে যাচ্ছে। মেয়েটা অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা বের করার ধান্দায় ছিলো, লিফটটাও তখন থার্ড ফ্লোরে এসে পৌঁছলো। একপলক রেড সাইনের ‘ 3 ‘ লেখাটা দেখলো মাহতিম, এক মূহুর্ত দেরি না করে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো সে! এতোই দ্রুত ঘটলো যে মেয়েটা ভয়ে তটস্থ হয়ে লিফটের দেয়ালে দুম করে পিঠ ঠেকিয়ে চিৎকার দিলো, সামনের সুদর্শন চেহারার স্মার্ট ব্যক্তির দিকে ভীষণ ভয় নিয়ে তাকিয়ে আছে, অনবরত ঢোক গিলেই যাচ্ছে, চোখের কোটর ভয়ের চোটে বড়-বড়, নিশ্বাসের বেগে বুকটা উঠা-নামা করছে তার। লিফটটাও ‘ পজ ‘ হয়ে থমকে আছে, আর নিচে নামছেনা। কপালের ঠিক মাঝ বরাবর পিস্তল তাক করে ধরেছে মাহতিম, ট্রিগারের কাছে আঙ্গুল রাখা, যেকোনো মূহুর্ত্তেই মৃত্যুর কাছে ছিটকে পরতে বাধ্য মেয়েটা! মেয়েটা পিস্তলটার দিকে একপলক তাকিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,

– আ-আমাকে, আমাকে আপনি যেতে দিন। আমাকে মা-রবেন না মিস্টার। আমিতো কনড —

– ‘ চুপ ‘, খুবই ক্ষীণ কন্ঠে জোর দিয়ে বলে উঠলো মাহতিম। চোখটা সরু করে মেয়েটার ভয় জড়ানো চোখের দিকে সরাসরি তাকালো। মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে তাকাতেই ওই অনড় চোখের কাছে নত স্বীকার করলো। নিতান্তই দূরত্ব রেখে পিস্তল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু কড়া পারফিউমের সুঘ্রাণযুক্ত মোহটা কঠিনভাবে আসক্ত করে দিচ্ছে। এমন স্বচ্ছ পার্সোনালিটির পুরুষদের হাতে ভারী পিস্তলটা বড্ড বেমানান, তাদের হাতে দামী বিয়ারের বোতল থাকলে চমৎকার লাগতো। শান্ত অথচ সংযত ঠোঁটটায় একটা বেনসন চেপে রাখলে মন্দ হতো না। কালো গেন্ঞ্জিটার দিকে তাকালেই বুকটা কেমন কেঁপে উঠে! খাপে-খাপে ছয়টা ভাঁজের আদল স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, দুহাতে টিশার্টটা খুললেই ভয়ংকর কিছুর মুখোমুখি হবে নিশ্চিত! মাহতিমের ইচ্ছা করছে ঠাস করে মেয়েটার গালে চড় মারতে, পরিবার নিয়ে হোটেলে উঠেও এমন জঘন্য ঘটনার মুখোমুখি হবে সেটা চিন্তাও করতে পারেনি। এরা সংঘবদ্ধ দল হিসেবে বিভিন্ন হোটেলে-হোটেলে ঘুরে বেড়ায়, কোনো ধনী বা টাকা-পয়সাওয়ালা লোকদের কাছে স্বেচ্ছায় দেহ বিকিয়ে দেয়, রাত কাটিয়ে ওইসব লোকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে ভোরের মধ্যেই পগারপার। মাহতিম দাঁত কিড়মিড় করে রাগ দেখিয়ে বললো,

– ট্রিগারটা চাপলে কি হবে জানো? ডিরেক্ট মৃত্যু। ব্যাগ থেকে যেই প্যাকেট বের করতে চাচ্ছিলে সেটা এক্ষুনি বাইরে গিয়ে ফেলে দিবে। এ ব্যবসায় কেনো নেমেছো? লজ্জা করে না এসব করতে?

মেয়েটা হুমকি খেয়ে গড়গড় করে সব বলে দিলো। মেয়েটার নাম বন্যা, সে প্রায় তিন বছর যাবৎ এ লাইনে কাজ করছে, অনাথ, আত্নীয় বলতে কেউ নেই। দারিদ্র্যতার জন্যই এ পেশায় নিয়োজিত এবং সে মাহতিমকে এখানে আসার পর থেকেই ফলো করছিলো, কিন্তু মাহতিম যে সাধারণ ব্যক্তির মতো নয় এবং ওইসব নারীপিপাসু চেতনাও নেই সেটা বুঝতে পেরেছে বন্যা। চুপচাপ পিস্তল নামিয়ে সেটা কোমরে গুঁজলো মাহতিম, মেয়েটার হাতে কিছু টাকা এবং একটা কার্ড ধরিয়ে বললো,

– কার্ডে একটা নাম্বার আছে। ওটায় কল দিয়ে আনসারী নামটা বললেই এনাফ। স্যালারি কত লাগবে সেটা ঠিকঠাক মতো ফাইনাল করে দিবে। আর যদি কখনো এ লাইনে থাকতে দেখি, পরেরবার নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাবে না। চলে যাও।

মেয়েটা অপরাধী মুখে চোখ নামিয়ে রেখেছে, হাতে কার্ড ও টাকা পেয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর হালকা গলায় বললো,

– আপনি আমাকে সাহায্য করলেন কেনো? আমিতো আপনার ক্ষতিই করতে চেয়েছিলাম।

লিফটটা অন অপশনে চাপ দিতেই একপলক মেয়েটার দিকে তাকালো সে, শেষে চোখ ঘুরিয়ে স্বাভাবিক মেজাজে বললো,

– পাপমোচনের সুযোগ দিলাম। নিজেকে আর দূষিত না করে কলঙ্কের দাগ ঘুচাও। মেয়ে হিসেবে নিজের প্রেস্টিজ বিক্রি করে সংসার দেখবে এটা লজ্জার। কর্মে খাটো, শ্রম দাও, নিজ বুদ্ধিতে টাকা ইনকাম করো, এসব অনৈতিক পথে থাকার মানে হয় না। মরলেও তুমি শান্তি পাবে না বুঝেছো? চলে যাও।

মৃদ্যু আওয়াজে লিফটের দুই দ্বার খুলে যেতেই বন্যা মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলো। দু’পা এগুতেই হঠাৎ কিছু একটা মনে পরার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পরলো, মাহতিম সেদিকে কপাল কুঁচকে তাকাতেই বন্যা মাথাটা পিছু ঘুরিয়ে চোখে-চোখ রেখে অকপটে বললো,

– আপনার স্মার্টনেস মেয়েমানুষকে করুণভাবে ঘায়েল করার যোগ্যতা রাখে মিস্টার। পিস্তলের চাইতেও মারাত্মক!

কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না মাহতিম আনসারীর। সদাসর্বদার মতো গুমর মুখে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো, লিফটের বাটন অপশনে ক্লিক করে পকেটে হাত গুঁজতেই দুদিক থেকে দুটো সিলভার দরজা আসতে লাগলো। হঠাৎ এবং এক সেকেন্ডের জন্য ঠোঁটের ডানকোণে বাঁকা হাসি ফুটলো মাহতিমের, হাসিটুকু মিলিয়ে দিয়ে লেগে গেলো লিফটের দরজা। ছোট-ছোট পায়ে হোটেল এরিয়া ত্যাগ করে কখন যে অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে বালুকা স্থানে চলে এলো খেয়াল নেই বন্যার। হাতে এখনো সাদা কার্ড এবং কচকচে পাঁচটা এক হাজার টাকার নোট। চোখ তুলে সামনে তাকালো বন্যা। বালুময় জায়গাটা সন্ধ্যার মায়াতে নির্জন হয়ে উঠেছে, ডুবো-ডুবো কমলালেবুর গোল অরুণের চাকাটা সমুদ্রের নিচে যেনো তলিয়ে যাচ্ছে। আস্তে-আস্তে জলন্তপিন্ডটা তেজ হারিয়ে সমুদ্রের প্রশস্ত বুকে গা ভাসাতে প্রস্তুত। বন্যা দেখলো প্রকৃতি যেনো আগুনের পিন্ডটাকে সমুদ্রের জলধারা দিয়ে আগলে নিলো, সমস্তু দাপট শোষণ করে নির্বিকার বানিয়ে দিলো সূর্যটাকে। ‘ পাপমোচন ‘ শব্দটা যেমন ছোট্ট, তেমনি এর ভাবার্থ যেনো বিশাল কিছু। কিছু টাকা কি অভুক্তদের মাঝে বিলিয়ে দিবে? দিলে ভালো হয়। তার পেটেও তো সকাল থেকে কিছু পরেনি।
.

আকাশে কোনো তারা নেই, চাঁদের আলো নেই, সবকিছু কেমন নিস্তব্ধ। কুয়াশা যেনো প্রবলভাবে ঘণীভূত হচ্ছে, দূর-দূরান্তের দৃশ্যপট এখন ধোয়ার চাদরে ঢাকা। ঠান্ডায় পায়ের তলা যেনো গরম হওয়ার নাম নেই, তার উপর সকাল থেকে নষ্ট ফোনটা নিয়ে কল করে যাচ্ছে শানাজ। গ্রাম্যভিটায় একমাত্র আদরের টুকরোটা যেনো মেহনূরই ছিলো, নিজের সহোদর বোন সাবার থেকেও প্রিয়। আদরের টুকরোটা যখন স্বামীর হাত ধরে শহরের দিকে ছুটলো, সে আর পিছু ফিরে আসেনি। শেফালীর হাতে কড়ায়-দন্ডায় মার খেয়ে যখন সব বোনেরা খিঁচিয়ে থাকতো, তখন ছোট্ট মেহনূর ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না চোখে ‘ বুবু ‘ মানুষটাকে জাপটে ধরতো। মাঝে-মাঝে আকাশ ডেকে উঠলে দৌঁড়ে-পালিয়ে ছুটে আসতো শানাজের কাছে, দুহাতে শানাজকে জাপটে ধরে কতবার যে বাজের শব্দে চমকে উঠতো হিসাব নেই। কখনো মায়ের মতো, কখনো বোনের মতো মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো, আজ বুলিয়ে দেওয়ার মাথাটা কাছে নেই। মোটা লেপে গা ঢাকা দিয়ে শুয়ে আছে শানাজ, ঘড়িতে দশটা বাজলেও এখন গভীর নিশুতির মতো নিঃশব্দ হয়ে আছে। নষ্ট বাটন ফোনটা ছোটোখাটো ভাবে আছাড় দিতেই ফোনের স্ক্রিনটা জ্বলে উঠলো, সাথে-সাথে খুশি হয়ে গেলো শানাজ। তড়িঘড়ি করে মেহনূরের নাম্বারে কল দিলো, কিন্তু ফোনটা বন্ধ বললো। হতাশ শানাজ জানে তার নিজের ফোনটাও কিছুক্ষণের ভেতর বন্ধ হয়ে যাবে, যা করার চটজলদি করতে হবে। অনেক ভেবেচিন্তে শেষে মাহতিমের নাম্বারে ডায়াল করলো, আল্লাহ্-আল্লাহ্ জপতে-জপতে দুশ্চিন্তায় পরলো শানাজ। না-জানি মাহতিমের নাম্বারটাও বিজি দেখায়, এদিকে অভাবনীয় কায়দায় কলটা চট করে রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে গাঢ় গলায় বললো,

– আসসালামুয়ালাইকুম শ্যালিকা, কি খবর?

শানাজ প্রচণ্ড খুশিতে এক লাফ দিয়ে বসলো। লেপটা ফেলে জানালার কপাটটা খুলে খুশি হয়ে বললো,

– ওয়াআলাইকুমসসালাম ভাইয়া, আমার নাম্বার আপনি চিনেছেন? কি কপাল, কি কপাল! আমি ভালো আছি ভাইয়া। আপনার কি অবস্থা? আপনি তো আমাদের ভুলেই গেছেন, ভাইয়া মেহনূর কেমন আছে? ওকে একটু লাইনে দেওয়া যাবে? ওর তো ফোনটা বন্ধ, অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু পেলাম না।

চোখ বন্ধ করে জোরে নিশ্বাস ছাড়লো মাহতিম। কি উত্তর দিবে এখন? বলবে তোমার বোন জ্বরে কাতরাচ্ছে? আমার দোষেই এখন বাজেভাবে অসুস্থ? উত্তর না পেয়ে ওপাশ থেকে ‘ হ্যালো, হ্যালো ‘ করে উঠলো শানাজ। অস্থির কন্ঠের কাছে অধোমুখ করে মাহতিম সাড়া দিলো,

– মেহনূর ঘুমিয়ে পরেছে শানাজ। কাল সকালে যদি কথা বলিয়ে দেই সমস্যা হবে? আমি দুঃখিত, ওকে এখন জাগাতে পারছি না।

শানাজ দ্রুত মাহতিমকে আড়ষ্টতা থেকে রেহাই দিলো। স্বাভাবিক কন্ঠে হাসি দিয়ে বললো,
– না, ভাইয়া এভাবে বলতে হবে না। ও যেহেতু ঘুমাচ্ছে তাহলে ঘুমাক। আমার ফোনটা নষ্ট বলে এতোদিন ওকে কলটা দিতে পারিনি, ওকে আমার কথা বলে দিবেন।

নিজেকে চূড়ান্ত সীমায় স্বাভাবিক রেখে কথা সারলো মাহতিম, একটুও শানাজের মনে সঙ্কোচ বাড়তে দিলো না। বিশাল বড় জানালা দিয়ে বাইরের স্বল্প আলোটা রুমে ঢুকছে, রুমটা আজও লাইটহীন। সবাই যার-যার হোটেল রুমে ক্লান্তদেহে ঘুমাচ্ছে, অথচ তার চোখে ঘুম নামক কিছুই নেই। বিছানায় বসে ফ্লোরের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে আছে, চোখদুটো নিজের হাতের উপর স্থির। গাড়ির মধ্যে যখন মেহনূর বেহুঁশ হয়ে গেলো, সে চিৎকার করে ডাকার পরও উঠলো না, তখন মাহতিম বুঝতে পেরেছিলো ‘ ভয় ‘ কি জিনিস। ভয়ের ব্যাখ্যাটা হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছে, কঠিনভাবে পেয়েছে। পুরোটা রাস্তা কেমন পাগল-পাগল অবস্থায় ড্রাইভ করেছে, সেটা বোধহয় এই ড্রাইভিং জীবনে প্রথম। কান্নার চোখদুটো তো সেই কবেই শুকিয়ে গেছে, তবুও শুষ্ক চোখদুটোয় যেনো বর্ষা নামতে চেয়েছিলো। ‘ যদি কিছু হতো? ‘ – এই প্রশ্নের কাছে ভেঙ্গেচুড়ে যায় মাহতিম, চূর্ণবিচূর্ণ কাঁচের মতো ভেঙ্গে যায়।

ড্রিম লাইটের মৃদ্যু আলোয় নিজেকে আবিষ্কার করলো মেহনূর। দেহের অসহন তাপমাত্রায় মাথার তালুটা ঝিমঝিম করছে, চোখ খুলে আশেপাশে তাকিয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে রইলো। পরক্ষণে আস্তে-আস্তে বুঝতে পারলো সে এখন মারজার পাশে শুয়ে আছে। ঠিক ডানদিকটায় মারজা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে, মুখটা মেহনূরের দিকে ঘুরানো হলেও মুখ বাদে সমস্ত শরীর কম্বলে আবৃত। মেহনূর খুব কষ্টে দূর্বল হাতটা নিজের কপালে উঠালো, হাতের উলটোপিঠে কপাল ছুঁয়ে বুঝলো তার জ্বরটা এখনো কমেনি। পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার ভাবে বুঝতে একটু সময় লাগলো ওর, সেই গাড়ির ঘটনা থেকে একে-একে সবটুকু ঘটনা মনে করতেই হঠাৎ মাহতিমের জন্য চিন্তিত হয়ে উঠলো। মাহতিম কোথায়? তারা কি বাড়িতে ফিরেছে? কিন্তু বাড়িতে ফিরলেও এই রুমটা একদম অচেনা। কোথায় আছে এখন? এই রুমটা ভুলেও আনসারী নিবাসের রুম হবে না। মারজাকে ডাকতে গিয়েও বিবেকে বাধা খেলো মেহনূর, অসুস্থ মারজা এমনেই ঘুমাতে পারেন না, আজ একটু ঘুমাচ্ছে, ঘুমোক। দুহাতে ভর দিয়ে যেই বিছানা থেকে উঠতে যাবে ওমনেই ধপ করে বিছানায় পরে গেলো মেহনূর, জ্বরে শরীরের হাড়গুলো যেনো ভঙ্গুর হয়ে মটমট করে উঠলো। চোখ খিঁচুনি দিয়ে বিছানায় পরে রইলো, উঠার জন্য কয়েকবার জোর খাটালো কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ-বিফল। এই মূহুর্তে যদি মাহতিমকে না দেখে কিছুতেই শান্তি পাবে না, মাহতিমকে এখন চাই-ই চাই! অদ্ভুত জেদের বশে মেহনূর এবার উন্মাদের মতো উঠার চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু সফল হলো না। জ্বরের মধ্যে থাকতে একটুও সহ্য হচ্ছে না, উঠতে পারছেনা, বসতে পারছেনা, দাঁড়াতে পারছেনা। মেহনূর রাগে-ক্ষোভে-জেদে দুহাতের মুঠোয় চাদর খামচে ধরে, ঠোঁট শক্ত করে ফেলে, চোখ থেকে টলটল করে গরম পানি ছাপিয়ে পরছে, অসাড়তায় শরীর যেনো চূড়ান্তরূপে টলছে। অসহ্য, সব অসহ্য লাগছে!

এমনই সময় চাপা নিস্তব্ধতার ভেতর ক্ষীণ একটা শব্দ হলো, শব্দটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্ণপথে ঢুকতেই মেহনূর চোখ খুলে দরজার দিকে তাকালো, আবছা অন্ধকারে কোনো কিছু দেখতে না পেলেও তার উদ্দীপ্ত ইন্দ্রীয় নিশ্চিত এই মূহুর্তে মাহতিম এসেছে। জ্বরের ঘোরে সবকিছু বিষাদ লাগলেও পারফিউমের গন্ধটা চিনতে কখনো ভুল করবে না। গতরাত যেই উন্মুক্ত বুকটার ভেতর মুখ লুকিয়ে ঘুমিয়েছিলো, তার রেশ ভোলা অসম্ভব কিছু। মোটা-মোটা অশ্রুগুলো জ্বরের সাথে দাঙ্গা করে ঝরঝর করে ঝরছে, চোখদুটোও কেমন ফোলা এবং ব্যথা অনুভব হচ্ছে। মেহনূর হাতের মুঠো স্বাভাবিক করে দূর্বল স্বরে বললো,

– আমি জানি, আপনি এসেছেন। রুমের লাইটটা জ্বালান। আপনাকে একটুও দেখতে পারছি না।

বলার কয়েক মিনিট পেরিয়ে গেলেও রুমের লাইট জ্বলার নাম-গন্ধ নেই। জ্বরের মধ্যে কোনোভাবেই শক্তি কুড়াতে পারছেনা মেহনূর, গলা উঁচাতে গেলেও স্বর যেনো বেরুতে চায় না, গলাতেই দুমড়ে-মুচড়ে আঁটকে যায়। আস্তে-আস্তে পদধ্বনির আওয়াজটা ক্ষীণ থেকে প্রকট হলো, হ্যাঁ এগিয়ে আসছে, তার দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে নিরব পায়ে আসছে। দূর্বল হাতজোড়া থরথর করে কাঁপা অবস্থায় তার দিকে বাড়িয়ে দিলো মেহনূর, ব্যকুল আবেদনে মাহতিমকে জাপটে ধরার ইচ্ছায় রুক্ষ গলায় কাশতে-কাশতে বললো,

– এদিকে আসুন, আপনাকে একটু ধরতে চাই। কাছে আসুন।

নির্বিকার ভঙ্গিতে বিছানার কাছে আসলো মাহতিম, পলকহীন দৃষ্টিতে মেহনূরের বাড়িয়ে কাঁপা-কাঁপা হাতের দিকে তাকালো, চোখ সয়ে যাওয়া আলোয় মেহনূরের চিকচিক চোখদুটোর অবস্থা দেখে ধপ করে হাঁটু ভেঙ্গে বসলো মাহতিম। মেহনূরের হাতদুটো উপেক্ষা করে কাতর মুখটার কাছে এগিয়ে গেলো, বাঁহাতটা দিয়ে গরম গালটা পূর্ণ আবেশে ধরতেই ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেলো মাহতিম। চোখ বন্ধ করে মাহতিমের মাথায় কাঁপা হাতটা রাখলো মেহনূর, চুলের ভেতর নরম চামড়ায় উষ্ণ আঙ্গুলগুলো বুলিয়ে দিতেই মাহতিম চোখ খুলে তাকালো। দুজনের সরাসরি চোখাচোখি হতেই মেহনূরের দিকে ব্যথাতুর কন্ঠে বললো,

– গা পুড়ে যাচ্ছে মেহনূর। তুমি আমাকে কোন্ অপরাধের শাস্তি দিচ্ছো?

কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠলো মেহনূর, দু’ফোঁটা মোটা অশ্রু তখন দু’কোল বেয়ে গড়িয়ে পরলো। ক্লিষ্ট ডানহাতটা দিয়ে মাহতিমের মাথা ও বাঁহাতটা পিঠের উপর সমানতালে ছুঁয়ে দিতে লাগলো। বুক ঠেলে গরম নিশ্বাসটা সশব্দে ছেড়ে দিতেই বললো,

– নিউমোনিয়া হলে কি করতেন? তখন তো আমার অক্সিজেন নেওয়া লাগতো, সূঁই ঢুকিয়ে হাত ঝাঁঝরা করে দিতো। ডাক্তার এসে বলতো রোগীর অবস্থা খারাপ, খুব খারাপ। যেকোনো সময় দম বেরিয়ে মরতে পারে।

ভ্রুঁ কুঁচকে কপট রাগ দেখিয়ে মাহতিম বললো,
– তুমি কি আমার সাথে মষ্কারা করছো?

রাগের আভাস পেয়ে হাসতে-হাসতে বললো মেহনূর,
– না, সত্য কথা বললাম। হতেও তো পারতো। হয়নি তো। হলে কি ভালো হতো না? আমার মতো একটা তুচ্ছ জীব পৃথিবী থেকে বিদায় নিতো। অন্তত এই সুযোগে আপনাকে কঠিন শাস্তি দিতে পারতো, তাই না?

দুই মিনিট একদম নিরব হয়ে রইলো। মেহনূর তো ভয়েই তটস্থ, জ্বরের ঘোরে বুঝি আবোলতাবোল মার্কা কথা বলে ক্ষেপিয়ে দিলো। মাহতিম যে চুপটি মেরে আছে এখন কি তুলে আছাড় মারবে? মেহনূর তাড়াতাড়ি হন্য হয়ে যেই কিছু বলতে যাবে, ওমনেই দু’হাঁটুর নিচে এক হাত ও ঘাড়ে তলায় অন্য হাত ঢুকিয়ে কোলে তুলে ফেললো মাহতিম। বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই বন্ধ দরজার দিকে আগাতে-আগাতে বললো,

– থাপ্পড় মারলেও কথা বের হয় না, আর এখন জ্বরের মধ্যে কথার খই খুটাচ্ছো। বলি কি, শ্বাশুড়ি আম্মা কি তোমাকে পেটে নিয়ে মৌনব্রত করেছিলো?

কথাটা বলতেই দরজা খুলে বাইরে বেরুলো মাহতিম। খোলা দরজাটা চাপিয়ে দিতেই নিজের রুমের দিকে যেতে-যেতে ফের বলে উঠলো,

– তোমার জন্য মা আমাকে খুব গালাগালি করেছে মেহনূর। ভাবতেও অবাক লাগে, বাবা যাওয়ার পর থেকে মা ওরকম শাসন কোনোদিন করেনি। একদিকে খুশিও ছিলাম, আরেকদিকে দুঃখও লাগছিলো। মেহনূর তোমাকে যত্ন করতে কি কমতি রেখেছিলাম? কেনো ওভাবে সেন্সলেস হয়ে গেলে?

মেহনূর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো শুধু, কোনো কথা বলতে পারলো না। একে-একে সারিবদ্ধ রুমের দরজাগুলো পেরিয়ে যেতেই হঠাৎ মাঝের একটা দরজা যেনো ফাঁক দেখলো মাহতিম। সেই সরু ফাঁক দিয়ে কেউ যেনো তাদের দেখছে, মাহতিমের অবচেতন মন জানান দিলো মানুষটা কে হতে পারে, তবুও সেদিকে বিন্দুমাত্র ধ্যান না দিয়ে নিজের রুমে ঢুকলো সে। সরু ফাঁকটা এক লহমায় খুলে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো অনামিকা, সোনালী লাইটের আলোয় করিডোরে দাঁড়িয়ে সে মাহতিমের রুমটা দেখছে। রাগে দুহাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে নিজের রুমে ঢুকলো, ঠাস করে দরজাটা বন্ধ করতেই ফোন লাগালো। চোখ বন্ধ করে দেয়ালে দু’ঘাত ঘুষি মারতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হলো,

– হ্যালো, ঘুমাচ্ছি না? এমন অসময়ে কল দেওয়ার মানে কি? কি হয়েছে অনা?

দপদপ রাগে চোখ বন্ধ করে দাঁত কিড়মিড় করে বললো অনামিকা,
– আনসারী ওর কচি মালকে নিয়ে লুকিয়ে-লুকিয়ে রাত কাটাচ্ছে জানো? জানো না। তুমিতো মুখে চুইংগাম দিয়ে বসে আছো, আমি কিন্তু সহ্য করতে পারছি না ফুপি। আমি যেকোনো সময় বাবাকে কল দিয়ে অঘটন ঘটিয়ে দেবো।

রজনী চোখ কচলে কপাল কুঁচকে বললো,

– তোমার মাথায় কি বুদ্ধি নেই? সবসময় তাড়াহুড়ো কেনো লাগাও? মাহতিম যদি লটরপটর করেই থাকে তাতে তো তোমার সমস্যা হবার কথা না। ও চাইলে আরো দশটাকে সামলানোর ক্ষমতা রাখে, তুমি জাস্ট চুপ থাকো। আমাকে আমার মতো চলতে দাও অনা। প্লিজ!

ক্ষান্ত হলো না অনা, রাগটা প্রশমন না করে গজগজ করে বললো,
– আর কতো চুপ ফুপি? তুমি কি ইচ্ছে করে এই কাণ্ডটা করছো না? আমি কিন্তু এব্রড ফিরতে চাই, শুধু ওই গেঁয়োর বাচ্চাটাকে জঘন্য শিক্ষা দিয়ে ফিরতে চাই। এমন শিক্ষা দিতে চাই যেনো মাহতিম আনসারী ধুকে-ধুকে ক্ষমা চাক্!

ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ছাড়লো রজনী। পুরোনো অতীতটা আরেকটু চাপা দিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
– তুমি ঠান্ডা থাকো অনা। ভাইজানকে প্লিজ বিরক্ত করতে যাবে না। এমনেই ইলেকশানের জন্য প্রচুর ব্যস্ত হয়ে আছে। এবারের ভোটে যদি জিতে যায়, তাহলে মাহতিমকে নাকানি-চুবানি খাওয়াতে দেরি করবো না। আমি শুধু পাওয়ারটার জন্য অপেক্ষায় আছি, ওকে কোনোভাবেই প্রোফেশনালি হ্যান্ডেল করা যাবে না। তুমি এটা ভালো করেই জানো মাহতিম সবার আড়ালে খুবই ‘ ডেন্ঞ্জারাস পার্সন ‘ বলেই পরিচিত। ওকে টলানো কিন্তু ইজি না। একমাত্র পলিটিক্যাল পাওয়ারটাই ওর মতো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে টলাতে পারবে। আশা করছি তুমি আমার কথাটা বুঝেছো?

রজনীর যুক্তি শুনে শান্ত হলো অনা। সম্মতির সূচকে ফোনটা কেটে বিছানায় শুলো সে। টেবিল ল্যাম্পটা অফ করে চোখ বন্ধ করলো। ঘুমানো খুব প্রয়োজন, ঘুমটা না হলে শান্তি-স্বস্তি-স্বাভাবিক কোনোটাই হতে পারবে না।

.
গেমস খেলতে-খেলতে চোখ দিয়ে পানি পরছে মাহদির। ঘোলা চোখটা কচলাতে-কচলাতে বিছানা থেকে নামলো, ফোনটা ট্রাউজারের পকেটে ঢুকাতেই সোজা পা চালিয়ে মায়ের রুমের সামনে আসলো। দরজা খুলতেই হতভম্ব হয়ে বিরাট বড় হা করলো মাহদি, ঠাস করে হা করা মুখটা দুহাত ঢাকলো সে। ‘ ওমা, আমার বউ কোথায়? ‘ প্রশ্নটা মনে-মনে উচ্চারণ হতেই একদৌড়ে রুম থেকে বেরুলো মাহদি। হনহন করে দৌঁড়ে গিয়ে একদম কাট-কাট ভাবে মাহতিমের দরজায় থামলো, নাক দিয়ে ক্ষেপাটে ষাঁড়ের মতো নিশ্বাস ছাড়তেই দুহাতের থাবা উঁচিয়ে দরজায় বারি মারতে নিলো, দরজায় যেই ভয়ংকর আঘাতটা করবে ওমনেই পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে শূন্যে তুলে ফেললো কেউ। মাহদি তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে দেখলো মানুষটা তৌফ। তৌফ চোখ-মুখ কুঁচকে ভীষণ রাগ নিয়ে ফুসফুস করছে। চার্জারের জন্য সামিকের রুমে যাওয়ার জন্য কেবল দরজা খুলেছিলো তৌফ, চোখের সামনে ফুলস্পীডে মাহদিকে দৌড়ে যেতে দেখে সেও পিছু-পিছু গিয়ে হাজির। মনে-মনে যা ভেবেছিলো, তাই ফলতে দেখে এখন ইচ্ছে করছে ধানের বস্তার মতো ছুঁড়ে আছড়াতে। তৌফের মুখে তাচ্ছিল্যের জায়গায় রাগ দেখে আজ ঠেলেঠুলে হাসি দিলো মাহদি, হিহি করে হাসতেই তোতলা সুরে বললো,

– ব-ব-বউ খুঁজতে এসেছিলাম।

তৌফ চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

– ওটা তোর বউ? কষিয়ে লাগাবো।

তোতলাতে-তোতলাতে বললো মাহদি,
– ভাভাভা-ইয়ার মানে তো আমার। ভাইয়া বলেছিলো তার যা-যা কিছু আছে, তা-তা আমার।

তৌফ ক্রুদ্ধভাবে বললো,
– তোর বউগিরি কবে ছুটবে বলতো? অসহ্য লাগে না এসব বলতে?

মাহদি হো হো হাসি দিয়ে বললো,
– ম-রলে পরে যাবে তৌফ ভাই। আমি না ম-রা পযর্ন্ত ভাইয়ার কপালে আমার বউকে দেবো না। শী ইজ মাই ওয়াইফ।

হো-হো করে মুখে হাত চেপে হাসছিলো মাহদি। কথাটা শুনতেই কেনো যেনো তৌফের মনটা কামড়ে এলো, সে সমান তালে হাসতে পারলো না আজ।
সোল্লাস হাস্যে মাতোয়ারা মাহদির দিকে নির্লিপ্তে-নির্বিকারে শূন্য মুখে চেয়ে রইলো তৌফ। ধীরে-ধীরে হাত নিচু করে মাহদিকে নামিয়ে দিলো। বিকারহীন দৃষ্টিতে ভেতর থেকে বললো কেউ,

শেষ দেখাটা হলো যেনো,

ফিরবে না এই সময়।

হুট করে হারিয়ে যাবে,

দেখতে পাবো না তোমায়।

– চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪৭.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

ভোরের দিকে সমুদ্রের কাছে যেতে অদ্ভুত ভয় পেলো সবাই। কেউ-কেউ সূর্যাদয়ের দৃশ্য দেখতে গিয়ে কাছে যেতে পারলো না, কেমন গা ছমছম শিহরনে পিছিয়ে গেলো তারা। ভোর সকালে ঘুম থেকে উঠেই কনকনে ঠান্ডার ভেতর গোসল সেরে বেরিয়ে পরেছে মাহতিম, সাদা টিশার্টটা পরে ‘ নাইক ‘ ব্র‍্যান্ডের ট্রাউজার পরে সমুদ্রের বালুকারাশির উপর হাঁটতে থাকে। মন আজ অন্যমনষ্ক নয়, কিন্তু ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই কেমন যেনো আড়ষ্ট বোধ করছে। ‘ কিছু একটা হবে ‘ এমন একটা চিন্তা-মনোভাব-উৎকন্ঠা তার মনের ভেতর ছোটোখাটো টর্নেডোর মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। সাদা টিশার্টের উপর নেভি রঙের জ্যাকেট পরা, জ্যাকেটের বাঁদিকে ছোট-ছোট অক্ষরে ইংরেজি বর্ণমালায় সাদা রঙে লেখা ‘ N A V Y ‘. জ্যাকেটটা আজ পরার ইচ্ছা ছিলো না মোটেই, কিন্তু লাগেজ খুলে হাতের কাছে যেটা পেয়েছে সেটাই ছোবল মেরে গায়ে টেনে বেরিয়ে পরেছে। ঠান্ডা-শীতল-হিম বাতাসে তার জেলহীন চুলগুলো থেমে-থেমে উড়ছে, ডিউটিতে পুরোপুরিভাবে ঢুকে গেলে চুলগুলো ছেঁটে ছোট করে ফেলবে, অবশ্য এটাই নিয়ম। নিয়মটা একটু হেরফের হয়ে গেছে এবারের জন্য। হঠাৎ মনে পরলো সে আজ শেভ করতে গিয়েও চোয়ালের নিচটায় হালকা মতোন কেটে ফেলেছে, তবে সেই কাটাটা ছোট্ট ও চিকন ছিলো বলে রক্ত বেরুয়নি। এতটা ছটফট কেনো অনুভব করছে এই প্রশ্নের উত্তর কোনোভাবেই জানা নেই। শেভ করার দক্ষতাটা এতোই নিপুণ যে, দেদারসে বাঁহাত দিয়েও স্বল্প সময়ে ইলেকট্রিক রেজার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে টানতে পারে। দফায়-দফায় এতোগুলো ভুল যে কাকতলীয় ঠেকছেনা, অবচেতন মন যে কোনোকিছুর ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে, যেটা মূলত ধরতে পারছে মাহতিম। ছয়টা একচল্লিশ বেজে তেত্রিশ সেকেন্ড অতিক্রম করলো এখন। সারারাত ঘুম হয়নি, ক্লান্তির রেশটা এখনো তাকে কাবু করতে পারেনি। মেহনূরকে নিজের রুমে এনে সারাটা রাত ধরে জ্বর নামানোর শুশ্রূষায় লিপ্ত ছিলো, জ্বরের ঘোরে মেহনূরের আবোলতাবোল কথা শুনে কতবার যে দমফাটা হাসি আঁটকাতে হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সে জানে মেহনূর স্বাভাবিক ও সুস্থরূপে ফিরে এলে আর এভাবে কথা বলবে না, কিন্তু সে মন থেকে চায় মেহনূর নিজের শক্ত খোলসের জড়তাটা দয়াকরে ভেঙ্গে ফেলুক। ফোনটা নিয়ে কল করলো সে, ট্রাউজারের বাঁ পকেটে হাত গুঁজে সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি ফেলে তাকালো। কলের বিপরীতে থাকা ব্যস্ত ব্যক্তিটা টাচস্ক্রিনে ‘ M. A. B. ‘ লেখাটা ফুলফর্মে ট্রান্সফার করতেই ‘ Mahtim Ansari Boss ‘ বলে দ্রুত কলটা রিসিভ করলো। সাথে-সাথে কোনো দেরি না করে এম.এ.বি. মানুষটা গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

– আপডেট দিতে এতো দেরি লাগার কথা না নোমান। তুমি ভালো করেই জানো আমি দেরি জিনিসটা খুবই অপছন্দ করি। দেরিতে উঠেছো নিশ্চয়ই? ডেডবডি থেকে কি ইনফরমেশন পেলে জানাও।

কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই তার ডেষ্কের উপর ফটাফট রিপোর্টটা খুলে গড়গড় করে বলতে লাগলো নোমান। সবটুকু তথ্য শুনে মাহতিম যারপরনাই অবাক, তবুও অবাকের রেশটুকু ভেতরে চেপে নিজেকে স্বাভাবিক করে রাখলো। অজ্ঞাত সন্ত্রাসীর দলটা কোত্থেকে এসেছে এবং কোথা থেকে লিড পাচ্ছে সেসব তথ্য জানা জরুরী। এদের বিশাল নেটওয়ার্ক সম্পর্কে এখনো অনেক কিছু জানা যায়নি, পুরোপুরি একটা বিষয়ে না জানলে এদের সাথে ধাওয়া-পাল্টা খেলা সহজ হবেনা। নোমানের ভাষ্যমতে ট্রেক ডাউন করার পর কেউ একজন গাড়িগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়, সেই সাথে গুলিবিদ্ধ হওয়া মৃত সন্ত্রাসীদের সমস্ত আলামত সেখান থেকে সটকে দেয়। মাহতিমের স্পষ্ট মনে আছে সে কেবল চারটা গুলি ছুঁড়েছিলো, সেই চারটা গুলির টার্গেট ছিলো পেছন থেকে তিনটা গাড়ির গতিরোধ করা, অথচ আশ্চর্য্যের বিষয় হলো একটা গাড়ির বদলে তিনটা গাড়িই নাকি আগুনে ভষ্ম হয়েছে। তার মানে এটা পরিষ্কার যে, ওই যাত্রায় যারা বেঁচে গেছে, তারাই তাদের সঙ্গীদের আগুনে পুড়িয়ে নাম-নিশানা বিকৃত করে দিয়েছে। সমুদ্রের শো-শো হিমেল হাওয়ায় মাহতিমের চুলগুলো আবার কপাল ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দুলছে, তার চোয়াল জোড়া রাগে শক্ত! ভ্রুঁর কাছে নীল রগগুলো ফুলে উঠেছে, পকেটে থাকা হাতটা পাঁচ আঙ্গুলে মুষ্টিবদ্ধ। সামনের যাত্রাটা খুব ভয়াবহ হবে, নির্ঘাত প্রাণে মারাটাই তাদের টার্গেট! কখন-কোথায়-কবে হামলা হবে তার জন্য একচুল অনুমান করা যাচ্ছে না। বিশাল বড় ঝুঁকিতে ঝুলতে যাচ্ছে মাহতিম, তার আগামীর দিনগুলো যে বীভৎস হবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। নিজের উপর যা ইচ্ছা তা আসুক, তারা চাইলে জানে মে’রেই ফেলুক! কোনো ভয় নেই মাহতিমের, শুধু নিজের পরিবার যেনো সহি-সলামত থাকে। সমুদ্রের কাছ থেকে সরে এসে হোটেলের দিকে যেতে লাগলো, নোমানের উদ্দেশ্যে কাট-কাট গলায় বললো,

– আমার জন্য ফোর্স পাঠাতে হবে না। আমি সেফ আছি। আমার জন্য কিচ্ছু দরকার নেই। আমি চাই হোটেল এরিয়ার চারপাশে স্পেশাল ফোর্স পাঠানো হোক। তাদের সিভিল ড্রেসে আসতে বলো, আমি বিকেল পাঁচটার মধ্যে জয়েন করছি। আমার এদিকের কাজ শেষ। নিরাপত্তার ব্যাপারে একটুখানি গাফিলতি দেখলে আমি কাউকে ছাড় দেবো না সোজাসাপ্টা বলে দিলাম!

কল কাটার সঙ্গে-সঙ্গেই নোমান ব্যস্ত হয়ে উঠলো। বসের আদেশ মতো অনেকগুলো কল করে লোকেশন মতো সিভিল টিমকে রেডি হতে বললো। আজই মাহতিম স্বশরীরে ডিপার্টমেন্টে ফিরবে বলে ভোররাতেই লাগেজ গুছিয়ে রেখেছে। মেহনূরের জ্বরটা মাঝরাতেই ছেড়ে দিয়েছে, এবার সে ইচ্ছে করেই হাইডোজের ঔষুধ খাইয়েছে ওকে। হোটেলে ঢুকে রুমের দিকে যেতেই পেছন থেকে মেয়েলি কন্ঠে ‘ এক মিনিট মাহতিম ‘ বলে উঠল কেউ। চমকে উঠলো না মাহতিম। শুধু চলন্ত পাদুটো থামিয়ে দাঁড়ালো, মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো না সে। পেছনের আগন্তক মেয়েটা যে অনামিকা তাতে সন্দেহ জাগার প্রশ্ন উঠেনা। মুখোমুখি এসে হাজির হলো অনামিকা, একজোড়া দৃষ্টি সে মাহতিমের উপর ছুঁড়ে দিয়েছে। গায়ে ঢিলেঢালা অফ-হোয়াইট রঙের সিল্ক নাইটি, সেই নাইটির উপর কালো রঙের শাল জড়িয়ে নিয়েছে। গলাটা এতোই বড় যে, অশালীন কায়দায় বুকের ছোট্ট পোশাকটাও পরিদৃষ্ট। মাহতিম দৃষ্টি সংযত করে অন্যদিকে মুখ ঘুরালো, একচোট তুখোড় গালি ঢোকের সাথে গিলে হাতদুটো পকেটে গুঁজলো। অপ্রস্তুত ঢোক গিলাটা অন্যকিছু মনে করে মিটিমিটি হাসলো অনা, তার উদ্দেশ্যটা সফল হয়েছে ভেবে আস্তে করে মাহতিমের কাছে এসে দাঁড়ালো, আবেদনময়ীর মতো দৃষ্টি বিলিয়ে প্রসন্ন হাসিতে বললো,

– যদি তুমি চাও, দ্যান আই ক্যান এ্যাডোর ইউ মাহতিম।

ইঙ্গিতটা বুঝতেই রাগে চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। অনামিকা এতে আরো খুশী, মনে-মনে বিশ্বজয়ীর মতো আনন্দ হতেই গতরাতের ব্যাপার টেনে বললো,

– ছেলেদের কষ্টটা আমি বুঝি আনসারী। তোমাদের সহ্য আর ধৈর্য্য জিনিসটা একেবারেই কম। সুযোগ পেলে আদরের জায়গায় বাঁদর হতে এক সেকেন্ড দেরি করো না। জানিতো আদর খোঁজো। তা তোমার বউ কি তোমাকে হ্যান্ডেল করতে পেরেছে? মানে ওইযে বুঝোই তো, তবে ওর সেন্স কি আছে?

মুচকি করে হেসে দিতেই হঠাৎ পূর্ণচোখে তাকালো অনা। মাহতিমের গাঢ় লালচের ঠোঁটদুটোর দিকে দৃষ্টি যেয়ে ঠেকলো। অতীতের পুরোনো লোভটা কেমন চনমন করে উঠলো আজ, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের বেগটা যেনো ভারী হয়ে বুকটায় ধুকধুক করে ছুটছে। লালচে ঠোঁটদুটোকে নিজের অধরযুগলে পাওয়ার এক অদ্ভুত নেশা মনের ভেতর জেঁকে ধরেছে। লম্বা মানুষটার ঠোঁটদুটোর নাগাল পাওয়ার আশায় পা উঁচু করে বদ্ধচোখে এগুচ্ছিলো অনা, সুতীব্র আকাঙ্ক্ষায় মুখ বাড়িয়ে দিতেই সশব্দে ঠাস করে তাক লাগানো শব্দ হলো! বিদ্যুৎপৃষ্টের মতো মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো অনার, চোখে-মুখে সাথে-সাথে অন্ধকার দেখতে পেলো, ডান কান থেকে মৌমাছির মতো ভোঁ-ভোঁ-ভোঁ শব্দ শুনতেই কোথায় ছিটকে পরলো সেই হুঁশ নেই। চোখ ঝাপটাতে-ঝাপটাতে স্পষ্ট দেখার চেষ্টায় ছিলো অনা, কিছু বুঝে উঠার আগেই তার চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে এলো। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে ভরহীন অবস্থায় ঠান্ডা ফ্লোরে পরতেই আধো-আধো দৃষ্টিতে দেখতে পেলো একজোড়া পদধ্বনি দাপটের সাথে তার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, অনেক দূরে, এরপর সব অন্ধকার।

.

মেঘলা আকাশের বিষণ্ণতা কাটিয়ে পূর্ব দিকে সূর্য উঠলো। সূর্যের গোলাকার অগ্নি চাকাটা চারিদিকে আলো ছড়িয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিলো। সমুদ্রের বুকে নিজের জৌলুস ফেলে বেশ গরম করছিলো পরিবেশ। সমুদ্রতীরে ভিড় করেছে পর্যটকরা। কেউ পরিবারসহ এসেছে, কেউ এসেছে বন্ধুদল নিয়ে, আবার কিছু-কিছু এসেছে নব দম্পতির মতো হালাল ভ্রমনে। সকাল ন’টার দিকে ঘুমের তন্দ্রা কাটলো মেহনূরের, কঠিন জ্বরটা ছেড়ে গেলেও শরীর থেকে সব শক্তি যেনো টেনে নিয়েছে। ঘুম জড়ানো চোখদুটো আস্তে-আস্তে খুলতেই সোনালী আলোয় ঝলমল রুমটা দেখতে পেলো। ছোট্ট একটা হাই তুলে আশেপাশে কাউকে খুঁজতেই শোয়া থেকে উঠে বসলো। ডানদিকে জানালার উপস্থিতি দেখে দুহাতে পর্দা সরিয়ে দিলো, ওমনেই চোখ ধাঁধিয়ে সকালের সূর্যটা ছুঁয়ে দিলো ওকে। চোখ বন্ধ করে লম্বা নিশ্বাস নিয়ে নাক ও ঠোঁট দিয়ে শব্দ করে নিশ্বাসটা ছাড়লো। চোখ খুলতেই সুন্দর সকালকে মুচকি হাসি দিয়ে অভিবাদন জানাতেই বিছানা থেকে নামলো। সকাল-সকাল মাহতিমের দেখা না পেয়ে সুন্দর সকালটাও ফিকে লাগছে। জ্বরের জন্য ম্যাজম্যাজ ভাবটা কাটানোর জন্য গোসলের উদ্যোগ নিলো, কিন্তু পড়নের কাপড় যে মারজার রুমে সেটা সে জানে। সালোয়ার-কামিজে অভ্যস্থ নয়, খুব ছোট থেকেই মা-বড়মার নির্দেশে শাড়ি পরে বড় হয়েছে। এখন কামিজ পরেও কেমন যে খুঁতখুঁতে লাগছে, কতক্ষণে পালটাবে সেই চিন্তাই যেনো বড় কথা। ঘরের একদিকে বিশাল লম্বা বাদামী রঙের আলমারি দেখতে পেলো। সেখানে নিশ্চয়ই মাহতিমের পোশাক-আশাকের সাথে তোয়ালে রেখেছে! আপাতত ট্যাপের পানির নিচে মাথা ভেজাতে ইচ্ছে করছে ওর, সেই চিন্তাটা চেপে বসতেই আলামারি খুলে হাতের কাছে তোয়ালে পেয়ে গেলো। তোয়ালেটা দুহাতে নিয়ে নাকের কাছে আনতেই পরিচিত ঘ্রাণে ঠোঁটে হাসি ছলকে উঠলো। মাহতিমের ব্যক্তিগত জিনিসে হাত লাগালে অদ্ভুত শান্তি লাগে, মনটা আনন্দে নেচে উঠে! মনেহয় যেনো নিজের দেহের প্রতিটি ভাঁজে-ভাঁজে অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে। তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতেই হঠাৎ ক্লথ হ্যাঙ্কারে দৃষ্টি আঁটকে গেলো। একি! হ্যাঙ্কারে আগে থেকেই শাড়ি-ব্লাউজ-পেডিকোট ঝুলছে? আশ্চর্যে নাস্তানাবুদ হতেই ক্লথ হ্যাঙ্কারের শাড়িটা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো মেহনূর। মাহতিম আনসারীর দূর্ধর্ষ চিন্তা ও উপস্থিত বুদ্ধি দেখে একবুক ভালোবাসায় শিউরে উঠলো। হালকা বেগুনী রঙের সুতির শাড়ি, লাল টকটকে মোটা পাড়, শাড়ির পাশে মখমলের লাল ব্লাউজ দেখে মিচকি হাসিতে মাথাটা ডানে-বামে দুলালো মেহনূর। অসভ্য লোক তো দেখি সবই ব্যবস্থা করে গেছে।

.

নাস্তা খেতে বসে সবার মুখের অবস্থা করুণ। চিন্তায় কারোর গলা দিয়ে পানি পযর্ন্ত নামছেনা।কি হবে, না হবে সেটা নিয়ে চিন্তা করলেই মাথা কাজ করেনা। টান-টান উত্তেজনার ভেতর রুক্ষ মুখে বসে আছে সবাই, একটু আগে জানতে পরেছে অনাকে করিডোরের কাছ থেকে সেন্সলেস অবস্থায় পাওয়া গেছে। তার অবস্থা খুবই খারাপ, রীতিমতো হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গুরুতর দশা। কিভাবে ওই অবস্থা হয়েছে সেটা অবশ্য সৌভিকরা ছাড়া কেউ জানে না। হোটেলের দু’জন স্টাফ একই ফ্লোরের অন্য রুমে বেড-টি নেওয়ার সময় ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখে ফেলে, তাদের কাছ থেকে টোপ ফেলে জেনে এসেছে সিয়াম। আপাতত ওই স্টাফদের টাকার জোরে মুখ বন্ধ করে এসেছে, ভুলেও এ খবর যেনো অন্য কারো কানে না যায় সেটাও পরিষ্কার ভাবে বলা শেষ। ভয় শুধু একটাই, নিরব বাঘিনী যেনো এ বিষয়ে না জানে। কোকের বোতলে ছোট্ট চুমুক দিয়ে বিমর্ষ কন্ঠে বললো তৌফ,

– মাহতিম যাই করুক আমার আপত্তি নাই। কিন্তু অনার ম্যাটার আইলে রে ভাই আমি বহুত টেনশনে থাকি।

তৌফের কথায় যোগ করে শান্ত কন্ঠে বললো সৌভিক,

– শুধু তুই না, আমরা সবাই থাকি। তোর কি মনে হয় বলতো, রজনী যে চুপ মে’রে আছে এই মহিলা কি কিছু প্ল্যান করে এসেছে?

সৌভিকের কথাটা চট করে টেনে নিলো নীতি। নিশ্চিত গলায় বললো,

– প্ল্যান করেই এসেছে। নাহলে আমাদের সাথে শুধু-শুধু তো সী-বিচ দেখতে আসতো না।

নীতির কথার পর চুপ রইলো সবাই। সবার মন যেখানে একীভূত হয়ে চিন্তায় ডুবে আছে, তখনই গেমস খেলায় ব্যস্ত মাহদি দাম্ভিকতার সুরে বললো,

– মাহতিম ভাইয়ার শার্প মাইন্ডের কাছে এইসব ফাউল প্ল্যান টিকে না।

সবাই চকিত ভঙ্গিতে চমকে উঠতেই সাথে-সাথে মাহদির দিকে তাকালো। যেই আত্মবিশ্বাস, যেই দৃঢ়তা, যেই প্রবল চেতনার সাথে মাহদি কঠিন কথাটা সত্যটা বলে উঠলো তাতে সবাই বেশ অবাক! খাপে-খাপ মাহতিমের মতো মাহতিমের ভাবসাবে কথাটুকু বললো সে, বিষ্ময়ের ঘোরে সবাই এখন মাহদির দিকে তাকিতে আছে। আড়চোখে সবার দৃষ্টি লক্ষ্য করে লজ্জা পেলো মাহদি, গেমটা পজ্ করে দুই ভ্রুঁ কঠিন করে কুঁচকে বিব্রত গলায় বললো,

– আমি কি লজ্জা পাই না? আমার দিকে এভাবে তাকাও কেনো? আমিতো একটু-আধটু ভাইয়াকে দেখে শিখি। ভাইয়া বুড়া হলে আমার তো মেহনূরকে বিয়ে করা লাগবে। এজন্য, এখন থেকে ট্রেনিং নিচ্ছি। বুঝছো সবাই?

মাহদির উটকো কথা শুনে কয়েক মিনিট শক্ত মুখে নিরব রইলো সবাই। সবার গম্ভীর মুখের অবস্থা দেখে মাহদি ইতস্তত ভঙ্গিতে চোখ নামালো, এক মূহুর্ত যেনো সুনশান! এরপর হো-হো হাসির কলরব ফেটে পরলো রুমের ভেতর । হাসতে-হাসতে সবাই তখন একই সুরে বলে উঠলো,

– চুপ কর বা’টপার!

.

ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ালো মেহনূর, মাথা থেকে ভেজা তোয়ালেটা খুলে চুলগুলো ঝাড়া দিলো। টপটপ করে বৃষ্টিফোঁটার মতো বিন্দু কণা ফ্লোর জুড়ে পরলো। ওয়াশরুমে শাড়ি পরতে গেলে পানিতে শাড়িটা ভিজে যেতো, বাধ্য হয়ে শাড়ি হাতে রুমে আসতে হয়েছে। মাহতিম এখনো রুমে নেই, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আয়নার সামনে দাঁড়ালেও মনটা শান্তি পেলো না। কোথায় গেছে লোকটা? একবার কি বলে যাওয়া যেতো না? এখন যে একপলক দেখার জন্য অসহ্য রকম অস্থির লাগছে সেটা কি করে বোঝাবে? লাল পেডিকোটের ভাঁজে-ভাঁজে শাড়িটা গুঁজে নিতেই বুকের উপর আঁচলের কাপড়টা টেনে নিলো, মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে পেটের কাছে কুচির জন্য থামলো মেহনূর। দক্ষ হাতের আঙ্গুলে কুচির ভাঁজগুলো ঠিক করছিলো সে, একটা-দুটা-তিনটা করে ভাঁজযুক্ত কুচিগুলো ক্রমাগত আঙ্গুলে ধরছিলো, মাথা নত অবস্থায় ঠিক করা কুচিগুলো পেটের কাছে যেই গুঁজবে, ঠিক তখনই গা কাঁটা উঠলো ওর! পেছন থেকে একজোড়া হাত এসে চোখের পলকে পেটের উপর আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরলো। নিশ্বাস আঁটকে যেনো স্থির হয়ে আছে মেহনূর, হাত থেকে এক-এক করে সবগুলো কুচি ফস করে ফ্লোরে পরলো। পিঠের উপর সুঠাম বুকের সান্নিধ্য টের পেলো, কিছুক্ষণ পর অনুভব করলো পিঠের উপর চুলগুলো বামে সরে যাচ্ছে। নত দৃষ্টিটা চট করে বন্ধ করলো মেহনূর, নিশ্বাস আঁটকে রাখার কারণে প্রাণবায়ুটা বুকের ভেতর ফুরিয়ে আসছে। মেহনূরের নিশ্বাস না নেওয়ার পরিস্থিতিটা দেখে পেছনে থাকা মানুষটা মৃদ্যু শব্দে হাসলো। হাসি দিয়েই বললো,

– মুখটা তুলো মেহনূর। একটু তো লজ্জাখানা মুখটা দেখি।

মাহতিমের কথায় আরো কুঁকড়ে গিয়ে চোখ খিঁচে রইলো, ভুলেও মাথা তুললো না মেহনূর। লজ্জায়-কুণ্ঠায় মাথা নুইয়ে রাখলে ওর ডান কাধটায় থুতনি রাখলো মাহতিম। আদরে-আহ্লাদে চোখ বন্ধ করে মৃদ্যু স্বরে বললো,

– বিকেলে চলে যাচ্ছি। মন খারাপ কোরো না, পরেরবার অনেকদিনের জন্য আসবো।

চট করে চোখ খুললো মেহনূর, মাথাটা স্বাভাবিক ভাবে তুলতেই মুখটা ডান কাধের দিকে ফিরাতে নিলো, পারলো না। মাহতিমের গরম নিশ্বাসটা মেহনূরের গাল ছুঁয়ে থামিয়ে দিলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে মেহনূর এবার ঠিকই মুখ খুললো,

– চলে যাচ্ছেন মানে?

চোখ খুললো মাহতিম। আয়নায় এবার মেহনূরের পাশাপাশি সেও একদৃষ্টিতে তাকালো। পেটের উপর হাত বুলাতে-বুলাতে বললো,

– আমি থাকলে যে ‘ আব্বু-আম্মু ‘ ডাকার দলবল এসে পরবে।

এমন ভয়াবহ কথা শুনে কপট রাগ দেখাতে গিয়ে খিলখিল করে হেসে ফেললো মেহনূর। সেই হাসিতে কোনো জড়তা নেই, ভয় নেই, সঙ্কোচ নেই। হাসতে-হাসতে পেটের উপর মাহতিমের হাতের উপর নির্বিঘ্নে হাত রেখে দিলো মেহনূর, মুখটা ডানে ঘুরিয়ে মাহতিমের দিকে তীর্যক চাহনিতে বললো,

– আপনাকে আমি বাধা দেইনি। কালরাতেও মোক্ষম সুযোগ ছিলো। আপনিই সবসময়ের মতো দূরত্ব রেখে চলেছেন।

কথা শুনে কিছুক্ষণ নির্বাক রইলো মাহতিম। একদৃষ্টিতে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে থাকতেই বোঝার চেষ্টা করলো কোনো কল্পনা করছে কিনা। মেহনূর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পেটের উপর থেকে হাত সরিয়ে মাহতিমের দিকে ফিরলো। কালো শার্টের ফোল্ডেড স্লিভের হাতদুটো টেনে এনে কোমরের দুপাশে রেখে দিলো। বিমূঢ় মাহতিম অবাকের রেশ না কাটাতেই আলতো সুরে ধীরে-ধীরে বললো,

– তুমি কি কালরাতে হুঁশে ছিলে?

মেহনূর ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে চোখে-চোখে রেখে বললো,

– আপনি যে আমার ঠোঁটে চুমু খেয়ে লাভ ইউ বলেছেন ততক্ষণ পযর্ন্ত ছিলাম।

আরেক দফা আশ্চর্য হয়ে হাসি-হাসি চোখে তাকালো মাহতিম। দুহাতে মেহনূরের গালদুটো ধরে নিচু স্বরে বললো,

– তুমি কি তাহলে একটুও বেঁহুশ ছিলে না?

মেহনূর একটুক্ষণ চুপ থেকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো। মাহতিমের গভীর চাহনির অতল স্পর্শে নিজেকে সমর্পণ করে হালকা গলায় বললো,

– আপনার কোলে যখন মাথা রাখলাম, আপনিও চিৎকার করতে-করতে পানিপট্টি দিতে লাগলেন তখন আমার হুঁশ ছিলো না। অন্ধকার দেখছিলাম।

চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। বুকভর্তি নিশ্বাস ছেড়ে আবার চোখ বন্ধ অবস্থায় বললো,

– একটু ভয় পেয়েছিলাম।

ফিক করে হাসলো মেহনূর। সরল গলায় বললো,

– একটু ভয় পেলে বুঝি ওভাবে পাগলের মতো চিৎকার করে?

চোখ খুলে প্রসন্ন চাহনিতে হাসলো মাহতিম, শান্ত কন্ঠে বললো,

– তোমাকে কাছে যে পুরো আমিটাই তুলে দিয়েছি। তোমার কিছু হলে এই আমিটা টিকবে? ভণ্ডুল হয়ে যাবে না? আমার উপর কতকিছুর চাপ যায় জানো? একটা ভুল করলে দেশের মধ্যে ধ্বং’সাত্মক অবস্থা হবে। খুব ভয় পেয়েছিলাম মেহনূর। ভয়ের ব্যাখ্যা কোনোদিনই ঠিকঠাক মতো বলতে পারবো না।

গালের উপর থেকে আস্তে করে দুহাত সরালো মেহনূর। এহেন কান্ডে একটু চমকালো মাহতিম। পরক্ষণে দেখতে পেলো মেহনূর উলটো তার গালদুটোই আদুরে হাতে ধরলো। আবদার সূচকে বললো,

– মুখটা একটু নিচে নামাবেন?

শীতল চাহনিতে তাকিয়ে থাকতেই মাথা নেড়ে সায় দিলো মাহতিম। মেহনূরের নাগাল বরাবর মুখটা নিচু করতেই দেরি করলো না মেহনূর, চোখ বন্ধ করে লালচে অধরযুগল নিজের ঠোঁটের ভাঁজে মিলিয়ে নিলো। ক্লিন শেভের ডানগাল থেকে হাত সরিয়ে ছোট করে ছাঁটা চুলের উপর রাখলো। দূরে যাওয়ার বিষণ্ণ সুর যেনো কাঁদিয়ে দিচ্ছিলো মেহনূরকে, নিজের চোখদুটোকে সংযত করতে গিয়ে ভুলবশত দাঁত শক্ত করলো ও। কিন্ঞ্চিৎ ব্যথায় মাহতিমের বন্ধ চোখদুটো খিঁচুনি দিয়ে পুনরায় স্বাভাবিক হয়ে গেলো। মাহতিম আজ বারবার-হাজারবার-দফায়-দফায় অবাক হলেও দারুণ খুশীতে-আনন্দে-আবেগে মেহনূরকে বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলো। দুহাতের পাঁচটা আঙ্গুলে খামচে পিঠের মখমলের লাল ব্লাউজটা ধরলো। চোখ খুলে আজ দেখতে পেলো, কান্নায় লাল নাক ফুলে-ফুলে উঠছে, চোখের বড় বড় পাপড়ি চুয়ে পানি গড়িয়ে পরছে।

– চলমান .

#FABIYAH_MOMO