#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪৮.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
মনের ভেতর কু ডেকে উঠছে। আজ এমন কিছু হবে যেটা ঝড়ের মতো লন্ডভন্ড করে দিবে। তছনছ হয়ে সবকিছু গুড়িয়ে যাবে। মারজা ভয়ে কাতর, সকাল থেকে মুখে কিচ্ছু রোচেনি। মেহনূরকে পাশে না পেয়ে প্রথম-প্রথম ভয় পেলেও আস্তে-আস্তে বুঝতে পারেন ছেলে সম্ভবত সঙ্গে নিয়ে গেছে। গতকাল রাগের মাথায় খুবই জঘন্য গালাগাল করেছেন তিনি, মায়ের ঝাঁঝ মাখা বকুনি খেয়েও মাহতিম টু শব্দটি পযর্ন্ত করেনি, চুপচাপ অপরাধীর মতো পরাজয় স্বীকার করে মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেছিলো। আজ মনেহচ্ছে বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন, মেহনূরকে মেয়ের মতো আদর সোহাগ করতে গিয়ে একটু বেশিই উচাটন হয়ে গেছেন। মাহতিম বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে চলে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি রেডি। তার গোছানো লাগেজটা মেহনূর আরো একটু গুছিয়ে দিলো। মনটা ভারী উদাস, ডুকরে বারবার কেঁদে উঠলেও ঠোঁট কামড়ে শক্ত হচ্ছে। সমুদ্রের কাছাকাছি আসাটা জীবনের সবচেয়ে বড় স্বার্থকতা, অথচ যে মানুষটা এখানে নিয়ে আসলো সেকিনা বিকেলের দিকেই চলে যাচ্ছে। যাচ্ছে-তো-যাচ্ছে তাও আবার মাস খানেকের জন্য। কবে ফিরবে এ ব্যাপারে কিচ্ছু বলতে পারেনা। আহ্লাদ করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে, কোলে মাথা টেনে ঘুম পাড়াবে, দুগাল ভরে-ভরে আদর করবে সেই সুযোগটুকুও কপালে জুটেনি। এখন তো ইচ্ছে করছে হাউমাউ করে কেঁদে তার যাওয়া আঁটকাতে, মাহতিমের উপর যে গাঢ় মায়া পরে গেছে। এই মায়ার ছাপ কি তাকে শান্তি দিবে? মুখ ফুটে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, একটু থাকুন, আপনাকে একটু আমার করে নেই। সময় তো চলে যাচ্ছে না, আমার যে অপেক্ষা ভালো লাগে না। আর কতো অপেক্ষা? কেনো অপেক্ষার মতো যন্ত্রণা সহ্য করবো বলুন? এই যন্ত্রনা যে প্রতিটা সেকেন্ডে-সেকেন্ডে বি’ষযুক্ত সূঁইয়ের মতো বিঁধবে!
মাহতিম মন ভার করে থাকলেও নিজেকে একটু প্রাণবন্ত রাখার মিথ্যে অভিনয় করছে। অভিনয়টা না করলে সৌভিক, সিয়াম, তৌফ এই তিনটা নেং’টাকালের বন্ধু সত্যি-সত্যিই বিষাদের মুখে বিদায় দিবে। নীতি-প্রীতি-ফারিন নামক তিনটা বোনকে আপনের চেয়েও আপন ভাবে, তাদের ভালোবাসার মমার্থটা দেখলে মাহতিম নিজেকেই ক্ষুদ্র কীটের মতো অযোগ্য মনে করে। কোলে-পিঠে এই তিনটা বোনকে কোনোদিন চাচাতো-ফুপাতো বোনের মতো লাগেনি, যেনো মায়ের পেটের সহোদর বোন ছিলো। মাহদির প্রতি সবচেয়ে বড় আক্ষেপটা কাজ করে, ছোট থাকতে একবার পা ভাঙ্গার জন্য একটুও ছুটি পায়নি। তখন সবে কর্মজীবনে নিজেকে গড়ার জন্য, প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করছিলো সে, ওইসময় একমাত্র ছোট ভাইটার জন্য ডিপার্টমেন্টে কয়েক দফা এ্যাপ্লিকেশন করেও ছুটি মন্ঞ্জুর পায়নি। ঈর্ষান্বিত কিছু অফিসার তার পেছনে আদাজল খেয়ে লেগেছিলো, তাদের কূটনৈতিক চালাকির জন্য মাহদিকে একবারের জন্যও দেখে আসতে পারেনি। জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বোধহয় সেদিনই বুঝতে পেরেছিলো, তখন থেকেই ভেতরের ক্রোধটা তাকে জেদে পরিণত করে দেয়। সেই ডিপার্টমেন্ট এখন তাকে নমঃ নমঃ ভক্তির মতো সম্মান করে, তার কোনো ছুটিই তারা সাথে-সাথে খারিজ করার সাহস দেখাতে পারে না। কিন্তু জীবনের ওই ব্যর্থতার ব্যথা আজও মাহতিমের মস্তিষ্কে রিনরিন করে বাজে, চোখ বন্ধ করলে হতাশার নিশ্বাস বেরিয়ে আসে। আজ সে সফল। সফল বলেই চারিদিকে এতো কদর। সৌভিকের রুম থেকে চুল ছেঁটে আসার সময় হঠাৎ অজানা কারণে পাদুটো থেমে যায়, তার উর্বরমস্তিষ্কটা ধরতে পারে বিপদের ব্যাপারটা ধীরগতিতে আগাচ্ছে। দরজার সরু ফাঁকটা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, অনামিকা এখনো ইনজেকশনের কড়া ডোজে ঘুমাচ্ছে। তার মাথার কাছেই শিউরের দিকটায় বসে আছে রজনী। নিঃসন্তান রজনী নিজের ভাতিজিকে কলিজার খনিই ভাবে। যদি অনামিকার মুখ থেকে চড়ের কথাটা শুনে ফেলে, তাহলে রাগে হয়তো অকল্পনীয় কিছু করে ফেলবে। হামলা যেনো কোনোভাবেই মেহনূরের উপর না আসুক, সেজন্য নিজেই রজনীর কাছে ধরা দিলো মাহতিম। আধ ভেজানো দরজায় ঠকঠক করে নক করতেই ভেতর থেকে রজনীর অনুমতি পেয়ে যায়, দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে-ঢুকতেই গুছানো কথাগুলো ঠোঁটের আগায় সাজিয়ে নেয়। রজনী দরজার দিকে মাহতিমের অবয়ব দেখে চমকে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে জিজ্ঞেস করে,
– কি ভেবে এই রুমে এলে? কোনো দরকার ছিলো? শুনলাম, তুমি নাকি বিকেলেই ফিরে যাচ্ছো?
মাহতিম একগাদা প্রশ্ন শুনে একটু হাসলো। বিছানার কাছে চেয়ার টেনে বসতেই সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো,
– কিছু প্রয়োজন ছিলো বলেই এই রুমের রাস্তা ধরেছি। নাহলে আপনি ভালো করেই জানেন, এই রুমের রাস্তাটা আমার জন্য বিষাক্ত কিছু।
শেষ বাক্যটা বলার সময় চোখ শক্ত করে দাঁত চিবিয়ে বললো মাহতিম। সেকেন্ডের ভেতর হাসি-হাসি মুখটা কিভাবে পালটে গেলো তা দেখে আরেকবার আশ্চর্য হলো রজনী। সেও একইভঙ্গিতে সৌজন্য হাসি ছুঁড়তে-ছুঁড়তে শেষে চাপা ক্ষোভের সাথে বলে বসলো,
– তোমাকে নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। কিন্তু মাঝে-মাঝে বিশেষ ভাবে শিক্ষা দিতে ইচ্ছে করে। দিই না।
রহস্যভাবে হেসে ফেললো মাহতিম, দৃঢ়চিত্তে অটল থেকে শান্ত কন্ঠে বললো,
– শিক্ষাটা আমাকেই দিবেন, এটার জন্য অন্য কাউকে দাবার গুটি বানাতে যাবেন না।
চাপা আক্রোশে তির্যকদৃষ্টিতে বললো রজনী,
– মানুষ দরকার পরলে নিজের বাপকেও শূলে চড়াতে ভুলে না। সেখানে তুমিতো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকো। তোমাকে ধরাশায়ী করতে হলে তো গুটি লাগবেই।
কথার মা’রপ্যাঁচ আর বাড়তে না দিয়ে মোদ্দাকথায় ফিরলো মাহতিম,
– আমি নিজে ধরা না দিলে আপনি কখনো আমাকে কবজা করতে পারবেন না মামী। এই কথা আরো একবার আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম। আপনার সাথে দুটো জরুরী কথা বলার জন্যেই এসেছি। আপনার ভাতিজির সার্ডেন অসুস্থতার জন্য আমি দায়ী। কিন্তু আমাকে ক্ষেপানোর জন্য ও নিজেও যথাযথ দোষী ছিলো। আপনি এটা ঠিকই জানেন, আমি শুধু-শুধু আমার শ্রম ও সময় ওর মতো ফা’লতুর জন্য নষ্ট করবো না। একজন বিবাহিত পুরুষকে কিসের জন্য এ্যাপ্রোচ করাটা সত্যিই ধি’ক্কারজনক।
রজনীর স্থির মুখটা কয়েক মিনিট স্থির থেকে ভারী গলায় বললো,
– আমার ভাতিজির প্রতিশোধটা যেনো মেহনূরের উপর না নেই, সেজন্যই তুমি এখানে ধরা দিতে এসেছো। কথা কি ঠিক বললাম মাহতিম?
কথাটা হ্যাঁ সূচকে সায় জানিয়ে বলতে লাগলো মাহতিম,
– জ্বী। আপনি আমার উপর যা ইচ্ছা তা করুন, আমি কিচ্ছু বলবো না, কোনোপ্রকার এ্যাকশনও নিবো না। আমি ডাইরেক্ট আপনার কাছে সারেন্ডার করলাম। কিন্তু খবরদার! প্রতিশোধের জ্বালাটা যেনো আমার মেহনূরের উপর না আসে। আমার মাথা নষ্ট হলে কিন্তু খুবই খারাপ হবে মামী। ওকে ছেড়ে কথা বলবেন।
একটু থেমে ফের বললো রজনী,
– তুমি কাকে শাষাচ্ছো ভেবে দেখেছো? আমি কিন্তু ডরাই না।
নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে হাসলো মাহতিম। পরক্ষণে হাসিটা সাইডে ফেলে কঠোর চাহনিতে জোরালো কন্ঠে বললো,
– জানি দেখেই শাষিয়ে যাচ্ছি। অন্য কেউ হলে শাষানোর সময়টুকুও নষ্ট করতাম না। বিকেলে ফিরতে হচ্ছে বলে ধরা দিলাম, আশাকরি আমার অনুপস্থিতিতে ঘোঁট পাকানোর চেষ্টা করবেন না। আমার বউ এসব বিষয়ে যথেষ্ট সরল, ওকে নিজের থাবায় আনতে গিয়ে নিজের দূর্গতি ডাকবেন না মামী।
রজনীকে পাত্তা না দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে পরলো মাহতিম। রাগে গজগজ করা রজনী তুমুল আক্রোশে গর্জে উঠবে, ঠিক তখনই দরজার কাছ থেকে মাথা ঘুরিয়ে বললো মাহতিম,
– আরো একটা কথা, আমার উপর কোনো ধরনের পলিটিক্যাল পাওয়ার খাটানোর চেষ্টা করবেন না। ওইসব নোংরা পলিটিক্সের ভয় দেখানোর ধান্দা আপনার ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর রাখবেন। বি অন দি সেফ সাইড রজনী ইবনাত মামী।
চোখ খুললো মাহতিম। একটু আগের ঘটনাটা স্মরণ করতে-করতে কখন রুমের সামনে এসে পরেছে বুঝতে পারেনি। লান্ঞ্চটা একসাথে করবে বলে সবাইকে একত্র করতে রুম থেকে বেরিয়েছিলো, তখনই আসার পথে অনামিকার রুমে কথাগুলো উগলে দিয়ে আসে। সিলভার নবটায় হাত দিয়ে রজনীর কথা ঝেড়ে ফেলে দরজা খুলে ঢুকলো, ঢুকেই প্রথম কদমটা ফেলতে গিয়ে বিছানার দিকে চোখ স্থির করে দাঁড়িয়ে পরলো। দরজার দিকে পিঠ দিয়ে চুপচাপ বসে আছে মেহনূর, বিছানায় বসে ফ্লোরে পা রেখে সামনের বিশাল জানালার দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয়ই চোখমুখের অবস্থা বারোটা থেকে তেরোটা বাজিয়ে শেষ! জোরে নিশ্বাস ফেলে দরজাটা বিনা শব্দে ভেজিয়ে নিঃশব্দ পায়ে মেহনূরের সামনে এসে দাঁড়ালো। মায়াবী চোখদুটো বন্ধ হয়ে আছে, চোখের দু’কোনা ভেজা-ভেজা। লম্বা-দীঘল চুলগুলো বাঁদিকে বেণী করে রেখেছে, কান্না শেষে মুখের উপর লালচে আভা পরেছে। ছোট্ট কোলটার দিকে দৃষ্টি দিতেই মনটা লোভীর মতো কাঙাল হয়ে উঠলো, ওই কোলের উপর মাথা রেখে দুটো মিনিট চোখ বুজে থাকতে চায়। মেহনূরের হাতের ছোঁয়ায়, গায়ের গন্ধ পাবার একটু আকাঙ্ক্ষা কাজ করছে। ফ্লোরে হাঁটুগেড়ে চোখদুটো বন্ধ করে ধীরে-ধীরে ছোট্ট নীড়ের কোলে মাথা গুঁজে দিলো, মনের উপর সমস্ত চাপ যেনো হালকা হতে লাগলো। দুহাতে কোমর বেষ্টন করে নিজেকে সপে দিতেই হালকা গলায় বললো,
– নিচে চলো মেহনূর, সবাই লান্ঞ্চটা একসাথে করতে চাই।
নিশ্বাস নিতেই ফোঁপানির হিড়িকে কেঁপে উঠলো মেহনূর। নাক টেনে ঢোক গিলে চোখ খুলে তাকালো, দৃষ্টি নিচু করে কোলের মাথাটা আঙ্গুলে-আঙ্গুলে ছুঁয়ে দিতে লাগলো। ট্রিম-কাটের চুলগুলো ঘন্টাখানেকের ভেতর উধাও, আঙ্গুলের ডগায় এখন ছোট করে ছাঁটা চুলের খোঁচা লাগছে। বুক ফুলিয়ে ভারী নিশ্বাস ছেড়ে কোমল কন্ঠে বললো মেহনূর,
– একটু সমুদ্র দেখিয়ে আনবেন?
আবেশে-আরামে চোখ বন্ধ করে আছে মাহতিম। এই অদ্ভুত শান্তিটা শরীরের নেগেটিভ ভাইবটা যেনো শুষে নিচ্ছে। একটু নড়েচড়ে উঠতেই আরামসিক্ত কন্ঠে বললো,
– আগে খাবে, তারপর।
মলিন মুখে একটুখানি হাসলো মেহনূর।
মুখ নিচু করতেই চোখ বন্ধ করে মাহতিমের খোঁচা-খোঁচা চুলে ঠোঁটের গাঢ় চাপে চুমু খেলো। স্থির রইলো কিছুক্ষণ, নিশ্বাসের টানটাও স্থির করে রাখলো, যেনো অনাবিল সুখটুকু রন্ধ্রে-রন্ধ্রে টের পাচ্ছে মেহনূর। এরপর ছেড়ে দিলো আঁটকানো নিশ্বাস ও মাহতিমের ডোর বন্ধনটা। দুজনের মধ্যবর্তী নিরবতা কাটিয়ে দুপুরের খাবারের জন্য নিচে রওনা দিলো তারা, পথিমধ্যে কানটা কঠিন মোচড় মেরে গেমাসক্ত মাহদিকে ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত করলো মাহতিম। ব্যথার চোটে চোখ কুঁচকে ‘ ও ভাইয়া, কান ছিঁড়ে যাচ্ছে, ছেড়ে দাও ‘ বলতে-বলতে কাতরালো মাহদি, বেচারা মাহদি দানবের হাতে ভয়ংকর কানমলা খেয়ে কেঁদে দিবে-দিবে অবস্থা। শেষে অনামিকা বাদে বিশাল গোল টেবিলে আসন নিলো সবাই, কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, রজনী বারবার কাকে যেনো কল দিয়ে যাচ্ছে। তার আচরণটা সন্দেহজনক ঠেকলেও মাহতিম সেদিকে তোয়াক্কা করার প্রয়োজন মনে করলো না। মাহদি চোখ লাল করে ইতিমধ্যে বারবার চোখ মুছছে। মায়ের কাছে বিচার দিয়েও লাভ হয়নি, মা ভাইয়াকে একটুও বকে না, শুধু আদর করে খালি। সবাই খাওয়া শুরু করলেও ঘাপটি ধরলো মাহদি, খাবারের প্লেটটা না ছুঁয়ে মুখ নিচু করে আছে। ডানে বড় ভাই, বামে মা বসেছে। ভাইয়া ইচ্ছে করে মেহনূরকে তার সঙ্গে বসতে দেয়নি। ভাইয়া তাকে একটুও ভালোবাসে না, সবসময় খালি বকাবকি করে। কেউ তার দিকে খেয়াল করে না, উলটো নিজেদের কথায় মজে থাকে। সবাই যখন খাওয়ার জন্য ব্যস্ত, তখনই মাহদির দিকে মেহনূরের চোখ পরলো। একপলক সেদিকে তাকিয়ে মাহতিমের উরুতে হাত রাখলো মেহনূর, উরুতে স্পর্শ পেয়ে ডানে চোখ ঘুরাতেই মেহনূরের দিকে ‘ কি হয়েছে ‘ টাইপ ইশারা করলো মাহতিম। মেহনূর চোখ বড় করে মাহদির দিকে তাকাতে বললো, মেহনূরের ইঙ্গিতে এবার বায়ে তাকাতেই মুখে চিবানো খাবারটা গিলে ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,
– খাস না কেনো? কি সমস্যা? প্লেটের খাবার ওভাবে পরে আছে কি জন্যে? সারাদিন ফোন গুতাগুতি করতেই মজা লাগে, না?
মাহতিমের ঝাঁঝালো কন্ঠে শিউরে উঠলো মাহদি। এবার ঠোঁট উলটে মাথা নুয়ে কেঁদেই দিলো। দ্রুত মেহনূর চেয়ার ছেড়ে উঠে মাহদির কাছে ছুটে গেলো, মাহতিমের পাশাপাশি সবার অবস্থাই কৌতুহলে চূর্ণ। চোখ মুছাতে-মুছাতে মাহদিকে নিজের সিটে আনলো মেহনূর, দূর্বল-জীর্ণ শরীরেই নিজের কোলে বসিয়ে আঁচলে চোখ মুছিয়ে বললো,
– তুমি না অনেক বড় হয়ে গেছো? বড় ছেলেরা কি সবার সামনে কাঁদে? তোমার ভাইয়াকে কখনো কাঁদতে দেখেছো? সৌভিক ভাইয়া, সামিক ভাইয়া তারা কি বকা খেলে কাঁদে? আমার দিকে তাকাও, মাহদি তাকাতে বলেছি না?
মাহদি ঠোঁট কুঁচকে মেহনূরের দিকে তাকালো। মেহনূর গালদুটো ধরে চোখের নিচের পানিটুকু বৃদ্ধাঙ্গুলে মুছিয়ে বললো,
– সারাদিন গেমস খেলা কি ভালো? খাওয়ার সময় যদি না খাও, তখন যদি গেমস খেলো তাহলে এই শরীর কি তোমার ভাইয়ার মতো শক্তপোক্ত হবে? শরীরে মাংস লাগবে না? আমি খাইয়ে দিচ্ছি, একটুও এঁটো করবে না। এঁটো করলে রাগ করবো, আর কোনোদিন আদর করবো না।
মেহনূরের প্ররোচনায় কান্না একটু থামলো মাহদির। কিন্তু রাগ কমলো না তার। বড় ভাইয়ের প্রতি তীব্র ক্ষোভ জাহির করতে গিয়ে টপটপ অশ্রু ফেলতে-ফেলতে বললো,
– আমাকে কেউ মূল্য করে? কেউ করে না! আমি যেদিন ম’রে যাবো, সবাইকে ছেড়ে যাবো, সেদিন দেখিও মেহনূর ওরা কিভাবে কাঁদে। আমাকে কেউ ভালোবাসে না, ভাইয়া আমার উপর ইচ্ছামতো চিল্লাচিল্লি করে শান্তি পায়, কেউ আমাকে ভালোবাসে না, কেউ না! আমার স্কুল সেরেমনিতে আজ পযর্ন্ত ভাইয়া আসেনি। আমি যেদিন রেকর্ড ব্রেক করে লং জাম্প খেলায় পুরষ্কার নিতে গেলাম, ওইদিনও ভাইয়া ধমকানি দিয়ে বলেছে সে আসবেনা! আমি ফ্রেকচার পা নিয়ে ছয় মাস বিছানায় ছিলাম, ডাক্তার কতগুলো ইনজেকশন দিয়েছিলো তাও ভাইয়া আমাকে দেখতে আসেনি। ফোন করে বলেছে আসবেনা! ভাইয়া আমাকে খালি বকেই, সে আমার কোনো ইচ্ছাই পূরণ করেনি। আমি সব ছেড়েছুড়ে চলে যাবো। দেখিও চলে যাবো।
হু হু করে কেঁদে উঠলো মাহদি। হিচকির সুরে কাঁদতে-কাঁদতে বললো,
– আমি বাবাকে দেখিনি। ভাইয়া বাবার আদরও পেয়েছে, মার আদরও পেয়েছে। অথচ আমি কারোরটাই পাইনি। কেউ আমার কথা রাখে না। আমি গতকাল পানিতে নামতে চেয়েছিলাম, ভাইয়া চড় মেরে আমাকে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমাকে কেনো মা’রলো? আমি কি —
কন্ঠ রোধ হয়ে থেমে যায় মাহদি। কান্নায় চোখ খিঁচুনি দিয়ে ফোঁপাতে থাকে। মাহদির কান্নায় মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো মেহনূর। বিমূঢ় সবাই কিছুক্ষণের জন্য বাক্যশূন্য হয়ে আছে, শুধু অনামিকার চতুর মস্তিষ্ক অন্য কিছুর রটনায় ব্যস্ত! তার ঠোঁটে জয়ীর মতো হাসি, এই বুঝি ফাঁদে ফেলার মহড়া পেয়ে গেছে। এবার এমনভাবেই চালটা চেলে দিবে যাতে, অ’ সাপও না ম’রে, লাঠিও না ভাঙ্গে ‘ অনেকটা এই প্রবাদের মতো। মাহতিম ভ্রুঁ কুঁচকে শক্ত মুখে কিছু বলবে এই প্রথম মেহনূর চোখ গরম করে তাকালো। রাগটা পুরোপুরি প্রকাশ না করলেও স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
– খেয়ে নিন। নাহলে আপনার মতো ব্যস্ত মানুষ খাবার এঁটো করলে সেটা লজ্জার হবে।
দারুণ আশ্চর্যের সাথে দমে যায় মাহতিম। তার কান গরম লাগছে, মুখে খাবার দেওয়ার ইচ্ছাও ম’রে গেছে। দূর থেকে মেহনূরের রূপ চেপে খামচে হাসছে তৌফরা। তৌফ মুখে খাবার চিবাতে-চিবাতে ডানে থাকা ফারিনের কানের গোড়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
– ওই ফারিন, ফারিন রে, পোল্ট্রি মুরগী দেখি বাঘে’র সামনে ছোঁক ছোঁক করতাছে।
কানের কাছে সুড়সুড়ি খেয়ে চমকে উঠলো ফারিন। সিনারি দেখতে ব্যাঘাত পাওয়ায় তৌফের দিকে বিরক্ত ভরে বললো,
– তোমার এই গাঁ’জাখুরি স্বভাব আর গেলো না তৌফ ভাই! অসহ্য লাগে কিন্তু! এগুলা কি —
তৌফ সেই কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে আবার বলে উঠলো,
– ফারিন, ফারিন রে, হাতে একটা চিমটি কা’ট তো। দেখি ঘটনাটা স্বপ্ন না বাস্তব।
ফারিন বেজায় ক্ষেপে গিয়ে স্বর নামিয়ে বললো,
– তোমাকে আমার কি করতে মন চায় জানো? যখন এই ফিসফাস আচরণটা করো, মনে চায় তোমার ওই কানটা আমি কাম’ড়ে ছিঁ’ড়ে ফেলি!
এবার যেনো টনক নড়লো তৌফের। ফারিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
– তুই তো দেখি ভালোই দু’ষ্টু হইছোস। আমার কান কাম’ড়াতে চাস কেন?
ফারিন আহাম্মকের মতো হতভম্ব হয়ে বললো,
– হোয়াট দ্যা…, ছিঃ ছিঃ তৌফ ভাই, আমি তোমাকে একটুও পছন্দ করি না। ছিঃ ছিঃ!
সন্দেহপ্রবণ চাহনিতে চোখ ছোট করলো তৌফ। ফারিনের দিকে মুখ এগুতেই ফারিন বিব্রত হয়ে মাথা পিছিয়ে ফেললো, তোতলাতে-তোতলাতে বললো,
– তুতুতুতু, তুতুতু মি —
তোতলাতে লাগলো ফারিন। তৌফ কপালে ভাঁজ ফেলে সরু চোখে বললো,
– তুতু করতেছিস কেন? আমি কুত্তা না, আমি মানুষ। পছন্দ করলে সোজাসুজিই বলবি, আমি মাইন্ড খাই না।
এ কেমন জ্বালারে ভাই! এর চেয়ে খাবার টেবিলে না বসাই ভালো ছিলো। একদিকে ভাইয়া-ভাবী নিরব দাঙ্গা করলো, অন্যদিকে এই তৌফ ঘাড় ম’টকে বসেছে। সবার দৃষ্টি যখন মাহদিকে শান্ত করায় উঠে-পরে লাগলো, তখনই রজনী চোখের আড়াল হয়ে একটু দূরে কলে গেলো। হোটেলটার এন্ট্রেস পথের কাছে এসে আশেপাশে তাকাতে-তাকাতে ফোন নিয়ে চটপট কাউকে কল করলো, কলটা রিসিভ করতেই সেখানকার এক আভিজাত্য পিলারের পেছনে লুকিয়ে পরলো। কন্ঠ যতটা সংযত করা যায়, ততটাই নিচে নামিয়ে বললো,
– হ্যালো, হ্যাঁ। সব রেডি তো? শোনো, প্ল্যান পরিবর্তন করো। হ্যাঁ এক্ষুনি করো! ওকে মা’রার দরকার নেই। কোনো সাফাই চাই না। এখন ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় নেই। অনা ওর রুমে আছে, হ্যাঁ ঘুমাচ্ছে। না, মাহতিমের গাড়ি আসতে এখনো দেরি। ওর সিভিল টিম আশেপাশেই আছে। না, আমি কাউকে চিনি না। শুনেছি, সিভিল ড্রেসে হোটেলের বাইরে গার্ড দিবে। হ্যাঁ, খাওয়া শেষ হতে বেশি দেরি নেই। প্ল্যান ঘুরাও। ‘ ইত্তেফাক ‘ নিউজপেপারে এডভান্স এক লাখ সবুজ রঙের বিনে ফেলেছি, কাজ হলে আরো দেবো। শুরু কাজটা হওয়া চাই। মাহতিম যাওয়ার আগেই যেনো ধাক্কাটা খেয়ে বিদায়। আমি ওর চোখে পানি দেখতে চাই! কাউন্ট-ডাউন শুরু।
– চলমান .
#FABIYAH_MOMO .
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪৯.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
অংশ ০১.
সমুদ্রের জলরাশির কাছে ভিড় করলো সবাই। সময়টা ঘড়ির কাটায়-কাটায় তিনটা বাজে। পর্যটকের টালমাটাল ভিড়টা এসময় একদম কম। জায়গাটা ফাঁকা-ফাঁকাই। মাহতিম তার পরিবার নিয়ে ঠিক জায়গাটা খুঁজে নিলো। সবাই খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু রেস্ট নিয়ে পানিতে নামার প্রস্তুতি নিয়েছে, সবার গায়েই হালকা মতোন পোশাক। ছেলেদের গায়ে শার্ট-গেন্ঞ্জি, মেয়েদের পড়নে জিন্স-কূর্তি। মেহনূর, মারজা, রজনী তিনজন কেবল নিজেদের বেশভূষা ছাড়েনি। মাহতিম একটু দূরে গিয়ে কাদের সাথে যেনো কথা বলছে, ঘাড় ঘুরিয়ে মেহনূর সেটা দূর থেকে দেখছে, মেহনূরের ডানহাত ধরে নীলাভ পানির দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহদি। কান্না থেমে গেলেও ফোঁপানির হিড়িকে একটু পরপর গা কেঁপে উঠছে। মাথায় ওড়না টেনে চুপচাপ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মারজা, গায়ের দামী শালটা আরেকটু টেনে শীতের হাওয়াটা আঁটকে নিচ্ছেন। চোখ থেকে কালো সানগ্লাসটা খুলে মাথায় রাখলো রজনী, আশেপাশে চোরাদৃষ্টিতে কাউকে খুঁজে যাচ্ছে, ফোনের ডিটেলস মতে তার এখানেই থাকার কথা। বাকিরা হাঁটু পযর্ন্ত পানিতে নেমে হৈ-হুল্লোড় করছে, একে-অন্যকে পানি ছোড়াছুড়ি খেলায় ঠিক শৈশবের মতো ফূর্তি করতে মত্ত। ডানহাতটায় মৃদ্যু ঝাঁকুনি খেতেই চমকে উঠলো মেহনূর, মাহতিমের দিক থেকে চোখ সরিয়ে মাহদির দিকে তাকালো সৈ, একজোড়া অশ্রুমোচন চোখে মেহনূরের তাকিয়ে আছে মাহদি। ওই চোখ দিয়েই বলে যাচ্ছে আমি একটু সমুদ্রে নামতে চাই।হাত ছেড়ে দিয়ে ঝলমলে চুলে হাত রাখলো মেহনূর, পাতলা-কালো-ঝলমলে চুলটা যেনো মাহতিমের মতোই। কপাল থেকে সারি-সারি চুলগুলো ডানহাতে পেছনে ঠেলে দিলো, ছোট্ট নিষ্পাপ মুখটা ধরে গালে-কপালে-চক্ষুপাতায় চুমু খেলো মেহনূর। মাহদির চোখের দিকে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় বললো,
– আমি তোমার ভাইয়াকে রাজি করাবো, কোনো চিন্তা নেই। উনি রাজি না হলে আমিই তোমাকে নিয়ে ঘুরিয়ে আনবো, ঠিক আছে?
মলিন ঠোঁটে হাসি ফুটলো মাহদির। খুশীতে আমোদে গদগদ হয়ে বললো,
– সত্যি? তুমি সাঁতার পারো?
মেহনূর হাসি দিয়ে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়ালো। তা দেখে খুশীতে লাফিয়ে উঠলো মাহদি, উল্লাসে দুহাত বাড়িয়ে মেহনূরকে জাপটে ধরলো সে। হঠাৎ কথা বলার সময় কিছু একটা দেখতেই চোখ আঁটকে গেলো মাহতিমের, দূর থেকে মাহদি-মেহনূরের সুন্দর মূহুর্ত দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো। ভারী আশ্চর্য হয়ে দেখতে-দেখতে হেসে উঠলো মাহতিম। বুক থেকে বিষাদের ভারী নিশ্বাসটা বেরিয়ে পরলো। যাক কেউ-না-কেউ আছে, সে না থাকলেও পিঠ-পেছনে কেউ তো মাহদির খেয়াল রাখবে। মারজাকে নিয়ে আর টেনশন নেই, সবটুকু টেনশন আড়ালে-আবডালে মেহনূর গুড়িয়ে দিয়েছে। আজ যখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ গরম করে তাকালো, তখনই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। যেই সরল-সহজ মেহনূরকে সে বিয়ে পরিয়ে সঙ্গে এনেছিলো, সে একটু-একটু করে বুঝতে শিখেছে, পরিস্থিতির ভেতর জড়িয়ে নিচ্ছে, অন্যায়ের প্রতিও রুখতে শিখছে এখন। প্রীতি চুপিচুপি করে নীতির কাছে এসে ছোট্ট প্রশ্নটা করলো,
– আপু, ভাইয়া কি রেগে আছে নাকি?
নীতি উল্লাস থেকে মুখ ঘুরিয়ে প্রীতির দিকে তাকালো। এরপর চোখ সরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকাতেই নিরুত্তেজ ভঙ্গিতে বললো,
– না, রাগেনি। রাগলে তো হল্লা করে ফেলতো। চোখ-কান লাল হয়ে ডেন্ঞ্জারাস অবস্থা। উলটো মনেহচ্ছে যে, ভাবীর আচরণে খুশী হয়েছে।
প্রীতি প্রশ্নসূচকে বললো,
– খুশী? তুমি পাগল? ভাবীর রাগ দেখে ভাইয়া খুশী হবে?
ছোটবোনের নির্বুদ্ধিতা দেখে মাথায় একটা চাপড় মারলো প্রীতি। বিরক্তির সুরে বললো,
– খুশী হবে নাতো কি হবে? কোনো ডিফেন্সের বউ যদি গাধা হয় সেটা কি ঠিক? ভাবী এখন চালাক হচ্ছে এটা দেখেই ভাইয়া খুশী। ওসব তুই বুঝবি না। চুপ থাক।
মাথায় হাত বুলাতে-বুলাতে চুপ মেরে যায় প্রীতি। বোনের কথায় একটু রাগ হলেও সেটা অদৃশ্যের মতো উবে যায়। সামিকের ক্যামেরায় ফটো বন্দি করার জন্য চটপট দুবোন সেদিকে দৌঁড়ে ছুটলো। সবাই দফায়-দফায় অনেক ছবি তোলার পর সবাইকে নিয়ে গ্রুপ ফটো তোলার জন্য হট্টগোল উঠলো। মাহতিমকে নেওয়ার জন্য ভেজা গায়ে পানি থেকে উঠলো সৌভিক, বন্ধুর কাধ জড়িয়ে অনুনয় করতে-করতে সবার সাথে একত্র করলো সে। মাহতিম হার মেনে চুপ হয়ে গেলে ফারিন তাকে মেহনূরের পাশে দাঁড় করিয়ে দিলো। একদল দাঁড়িয়ে রইলো, একদল হাঁটু মুড়ে বসলো।পেছনে নীল সমুদ্রকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে এক পর্যটকের হাতে ক্যামেরা তুলে দিলো সামিক, ওমনেই হুড়মুড় করে নিজেও ফারিন-নীতি-প্রীতির পাশে হাঁটুগেড়ে বসলো। পর্যটকটা ক্যামেরার লেন্স আরেকটু পরিষ্কার করতে নিলে এইফাঁকে বাঁহাতটা বাঁদিকে বাড়িয়ে দিলো মাহতিম, চুপিসারে বাঁদিকে এগুতে-এগুতে হাতটা খপ করে কোমর জড়িয়ে ধরলো। সাথে-সাথে ডানদিকে চোখ ফিরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো মেহনূর। মাহতিম এমন ভান ধরে দাঁড়িয়ে আছে যেনো সে কিছুই করেনি। একবার ভাবলো ঝটকা মেরে হাতটা সরিয়ে দিবে, পরক্ষণে হাতের উপর হাত রাখলো মেহনূর। হাতটা সরালো না। লেন্স পরিষ্কার হলো, ক্যামেরাটা তাদের দিকে তাক করে ধরলো, ওমনেই হাঁটুগেড়ে বসা নীতিরা দুহাতে ‘ ভি ‘ পোজ দিতেই একটানা ছবি উঠলো। আনন্দ-কল্লোলে মেতে উঠলো সবাই। বাতাসে যেনো আনন্দের গন্ধ, হৈচৈ উল্লাসের সুভাস, প্রাণচাঞ্চল্যে মেতে উঠা প্রফুল্ল মনের গান, সবমিলিয়ে সুখের ঠিকানাটা ফুটে উঠলো ছবিতে। সমুদ্রে একটুখানি ঘুরানোর জন্য ছোটোখাটো রাইডের ব্যবস্থা করলো মাহতিম, ওয়াটার বাইক রেডি করে সবাইকে এক চক্কর ঘুরানোর বুদ্ধি আঁটলো। এই উছিলায় মাহদিকে পানির উপর ঘুরিয়ে আনলে বদমাশটার মন গলে যাবে। বাতাসের জন্য আকাশী রঙের শার্টটা গায়ের সাথে আষ্টেপৃষ্টে সেঁটে আছে, কালো প্যান্টের সাথে বেল্ট পরলেও আজ শার্টটা ইন করা নেই। হাতের কালো ঘড়িটা খুলে মেহনূরের দিকে এগিয়ে গেলো মাহতিম, মেহনূরের মুখোমুখি হয়ে ওর দিকে ঘড়িটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– এটা রাখো।
ঘড়িটা একপ্রকার মেহনূরের হাতে গুঁজে দিলো সে। চটপট শার্টের স্লিভদুটো গুঁটিয়ে নিতেই মেহনূরের উদ্দেশ্যে বললো,
– মাহদি সাঁতার জানে না। এটা যদি গ্রামের নদী হতো আমি ‘ না ‘ করতাম না। কিন্তু এটা সমুদ্র, এখানে একটু-আধটু এদিক হলেই শেষ। তুমিযে ওর কথায় নেচে বেড়াচ্ছো এটা ঠিক না মেহনূর। খাবার টেবিলে কিছু বলিনি, এর মানে এটা না তোমার কথায় দমে গেছি। ওর প্রতি খেয়াল রাখছো বলে আমি খুশী, কিন্তু আসকারাটা কমিয়ে করো।
মাহতিমের কথায় মাথা নিচু করলো মেহনূর। আসলেই ঠান্ডা মাথায় ভাবলে দোষটা মাহতিমের না। মানুষটা তো নিজের দিকেই খেয়াল রাখে না। এবার যখন ফিল্ড থেকে ফিরলো, তার চোখদুটোয় ক্লান্তি জড়ানো ছিলো, যেনো কত রাত ঘুমোয়নি। মুখটাও ছিলো রুক্ষ-রুক্ষ। সেখানে থাকলে যে একরাশ ব্যস্ততার ভেতর জড়িয়ে যায়, নানা কাজের জটিলতায় আঁটকে পরে এটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছে মেহনূর। সমুদ্রের রোমান্ঞ্চকর অনুভূতির জন্য ওয়াটার বাইকে চড়েছে। প্রথমটায় সৌভিকের পিছনে সাবির, দ্বিতীয়টায় সিয়ামের পেছনে নীতি, তৃতীয়টায় তৌফের পেছনে সামিক উঠলো। এদিকে তৌফ হাজার তোষামোদ করেও ফারিনকে নিজের পেছনে উঠাতে পারলো না। ফারিন পাগলাটে ভঙ্গিতে ‘ না, না ‘ করেই যাচ্ছে, শেষমেশ স্পষ্ট করে বলে দিলো মাহতিমের রাইডেই উঠবে। তৌফের ওইসব ফটকা টাইপের হিরোগিরি দেখার ইচ্ছে তার নেই। সবার কীর্তিকলাপ দেখে হাসতে-হাসতে ফারিনকে লাইফ জ্যাকেট পরতে বললো মাহতিম, নিজে প্রস্তুত হয়ে ওয়াটার বাইকে চড়তে-চড়তে বললো,
– আমি কিন্তু স্পিডে চালাতে পারিনা। স্পিড বাড়াবাড়ির জন্য হাউকাউ করলে লাভ নেই।
ফারিন দাম্ভিকতার সাথে মুখ ভেঙিয়ে বললো,
– হু, আমিতো গা’ধা না? তুমি বললেই আমি হ্যাচোঁড়-প্যাঁচোড় করে বিশ্বাস করবো? এর আগেরবার যেই স্পিডে চালিয়েছো, তৌফ ভাই লুঙ্গি পরলে সেটা ভয়ের চোটে খুলেই যেতো।
ফারিনের গলা শুনে বাঁজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠলো তৌফ। বাকিদের অবস্থা হাসতে-হাসতে কাত। ফারিনের লাইফ জ্যাকেটটা পরা হলেই এক ছুট দিয়ে মাহতিমের কাধ ধরে বাইকে উঠলো। বড় ভাইয়ের গলাটা পিছন থেকে ঠিকঠাক মতো ধরতেই উত্তেজিত গলায় বললো,
– ভাইয়া, তুমি কিন্তু আজকেও স্পিড দিয়ে চালাবা। সৌভিক আর তৌফ ভাইয়াদের একদম পিছু ছাড়িয়ে দিবা ঠিক আছে?
হ্যান্ডেল দুটো গ্রিপ করে মৃদ্যু হাসলো মাহতিম। মুখটা ডানকাধের কাছে এনে প্রসন্ন হাসিতে বললো,
– রেডি তুই?
চটপট উত্তর দিলো ফারিন,
– ইয়েস ভাই, ফুলপ্রুফ রেডি।
মুখটা সামনে ঘুরিয়ে ওয়াটার বাইক স্টার্ট দিলো মাহতিম। ওমনেই পানির উপর দারুণ স্পিডে জলতরঙ্গ উঠে বাইক ছুটালো সে, সামনেই সৌভিক ও তৌফদের বাইকে টক্কর চলছে। ফারিন এক্সাইটমেন্টে চিৎকার করে ‘ সাব্বাশ ভাই, ইয়াহু ‘ বলে-বলে পাগল। ভুম-ভুম শব্দে তুমুল গতিতে ওয়াটার বাইকটা ছুটছে, ওয়াটার বাইকের দুধারে পানি ভেঙ্গে পায়ে লাগছে, বাইকটা কখনো ডানে কাত হয়ে যাচ্ছে, কখনো বাঁদিকে। দূর থেকে তিন বাইকের অবস্থা দেখে মাহদিও আমোদে চেঁচিয়ে উঠে, সে জানে ভাইয়া একটা-একটা করে দুটো বাইকই পিছু হটিয়ে দিবে। হলোও তাই। মিনিটের ভেতর দুটো বাইককে পিছু করে গোল-গোল রাউন্ডে বাইক ঘুরালো মাহতিম, এরপরই তীড়ের কাছে এনে ফারিনকে নামিয়ে নিলো। মেহনূরকে রেখেই এক দৌড়ে মাহতিমের কাছে গেলো মাহদি, আবারও লজ্জা-শরম সব ভুলে আকুতি গলায় বললো,
– ভাইয়া উঠবো।
মাত্র গা থেকে লাইফ জ্যাকেট খুলতে নিচ্ছিলো মাহতিম, মাহদির আগমন ও চোখের করুণ দেখে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
– উঠ।
সায় পেতেই তাড়াহুড়ো করে ফারিনের জ্যাকেটটা নিলো মাহদি। মাহতিমের জ্যাকেট পরা ততক্ষণে শেষ, মাহদির হাত থেকে জ্যাকেটটা নিয়ে ঠিকঠাক মতো নিজেই তাকে পরাতে লাগলো। মাহদি জুলজুল চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতেই স্মিত স্বরে বললো,
– সরি ভাইয়া।
হাঁটু গেড়ে জ্যাকেট পরাতেই দৃষ্টি তুললো মাহতিম। কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে থেকে অম্লানবদনে হেসে বললো,
– সরি বলিস না।
আবার জ্যাকেটের দিকে মনোযোগ দিলো মাহতিম। জ্যাকেটের সবকিছু ঠিকঠাক কিনা দেখতেই ঝট করে জাপটে ধরলো মাহদি। গলাটা দুহাতে জড়িয়ে মাহতিমের কাধে মুখ গুঁজে বললো,
– তুমি আমার উপর রাগ কোরো না ভাইয়া। আই মিস ইউ।
চোখ বন্ধ করে ফেললো মাহতিম। গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে সেটা ছাড়তে-ছাড়তে তাকালো। মাহদির পিঠে হাত বুলাতেই দেখলো সামিকের ক্যামেরাটা ‘ খট ‘ করে শব্দ করলো। মাহতিম হালকা একটু ভ্রুঁ কুচকাতেই ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে হাসি দিলো সামিক,
– জাস্ট দুটো তুলেছি।
ভ্রুঁ সমান করে হেসে ফেললো মাহতিম। মাহদিকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়ে দিলো, প্রায় পনের যাবৎ তাকে নিয়ে মনের ইচ্ছায় সমুদ্র ভ্রমণ করাতে ব্যস্ত হলো। মারজার ঔষুধ নিতে প্রীতির সাথে একটু হোটেলমুখো হয়েছিলো মেহনূর, এসেই দু’ভাইয়ের এ্যাডভেন্ঞ্চার দেখে আনন্দে আটখানা হলো সে দুহাত বুকের কাছে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে রজনী, তার চোখে এখন সানগ্লাস আঁটা। সানগ্লাসের নিচে থাকা চোখদুটো অদ্ভুত রহস্যে হাসছে। চোখটা একটু নিচু করে হাতের হাতঘড়িটা পরোখ করে হাসলো, আর বেশি সময় নেই। বামে তাকিয়ে মেহনূরের হাসিমাখা মুখটা দেখলো, এবার চোখের হাসিটা ঠোঁটে ছলকে উঠতেই দারুণ উত্তেজনায় সামনের দিকে তাকালো। হাতের মুঠোয় থাকা স্মার্টফোনটা ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে দক্ষতার সাথে চটপট টাইপ করলো, অনেকটা ইংরেজি শব্দে বাংলায় লিখলো,
– Ready how. Shomoy 10 min.
বেঁধে দেওয়া সময় দশ মিনিট। মাহতিম শেষ রাউন্ডটা কমপ্লিট করে বাইক ঘুরিয়ে ফিরছে। রজনীর হাসিটা পাতলা থেকে আরো গাঢ় হচ্ছে। গুনগুন করে সুর ধরেছে পুরোনো দিনের গান, গানটা সম্ভবত এমন। ‘ আমার ভেতর বাহিরে অন্তরে-অন্তরে, আছো তুমি হৃদয় জুড়ে… ‘। তীড়ে ভিড়লো বাইকটা, এবার মাহদি আস্তে করে নেমে পরলো। ছুটে গেলো মায়ের কাছে, কি কি থ্রিল পেয়েছে সেটা ছোট-ছোট শব্দ জুড়ে মা’কে বলতে লাগলো। নীতিরা ভেজা গায়ে একটু দূরে থাকা ঝালমুড়ির পসরা দেখে সেখানে ছুটে গিয়েছে, গা থেকে জ্যাকেট খুলে লোকের কাছে সপে দিতেই মেহনূরের কাছে গিয়ে হাজির। কোনোদিকে পরোয়া না করে মেহনূরের আঁচল টেনে মাথা মুছতে লাগলো। লজ্জায় আশেপাশে তাকাতে পারলো না মেহনূর। সবাই কি ভাববে বাবা! মা-ও তো অদূরে বসে আছে। তাঁর সামনেও কি নূন্যতম লজ্জাবোধ নেই? এই লোক কি ট্রেনিংয়ের নামে সবটুকু লজ্জা গিলে এসেছে? মেহনূর নতমুখে মিনমিন করে বললো,
– আপনি আঁচলটা ছাড়ুন। এখানে সবাই আমাদের দিকে তাকাবে।
মাহতিম বেপরোয়া কন্ঠে বললো,
– তাকালে তাকাক। আজ তো চলেই যাচ্ছি।
মেহনূর দিশাহীন ভঙ্গিতে কাঁচুমাচু করছে। শেষে সহ্য করতে না পেরে মুখ ফসকে বললো ,
– আপনার কি একটুও শরম নেই?
মাহতিম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থমকে গেলো। চরম আশ্চর্য হয়ে বললো,
– আজব, আমি কি তোমার ঠোঁট কাম’ড়ে চুমু খাচ্ছি?
লজ্জায়-কাতরে চোখ খিঁচুনি দিয়ে গুটিয়ে গেলো মেহনূর। আর পারা যায়না! এই লোক এতো ঠোঁটকাটা কেন? মুখের উপর কিভাবে ঠাস-ঠাস করে এসব বলে ফেলে? ছিঃ ছিঃ অবস্থা। মেহনূরের জড়সড় অবস্থা দেখে নিজেই আঁচল ছেড়ে দিলো মাহতিম। মাথাটা ডানে-বামে নাড়াতে-নাড়াতে বললো,
– তোমাকে যে কি করতে ইচ্ছে করছে, তোমাকে নিয়ে কোথাও শান্তি —
আর কোনো শব্দ নেই। এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড টানা অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। তাও, আওয়াজ নেই। মেহনূর খিঁচুনি দেওয়া চোখ খুলে তাকাতেই এক চিৎকার দিলো কেউ! চিৎকারের সাথে-সাথে আরো আট-দশটা গলা হাহাকার করে উঠলো! শোরগোল বাড়ছে-বাড়ছে, আরো চড়াও করে বাড়তেই মেহনূর লক্ষ্য করলো নীতি হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছে। মাহতিম সামনে নেই! ফারিন ‘ ইয়া আল্লাহ্ ‘ বলে এক চিৎকার দিয়েই ধপ করে বালুতে বসে পরলো। সৌভিক-তৌফ-সিয়াম সবকিছু ফেলে সমুদ্রের দিকে দৌঁড় লাগিয়েছে, নীতি বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উলটে কেঁদে দিয়েছে, বারবার সমুদ্রের দিকে ছুট লাগাতে চাইছে, পারছেনা। পেছন থেকে সামিক চেঁচামেচি করে নীতিকে আঁটকে দিয়েছে, সেও রীতিমতো উদভ্রান্তের মতো চিৎকার করে যাচ্ছে। পুরো কাহিনী বুঝতে সময় লাগলো মেহনূরের, বড় করে ঢোক গিলতেই একবুক ভয় নিয়ে সমুদ্রের দিকে এবার ভাল করে তাকালো। তৎক্ষণাৎ বুকের মধ্যে কামড়ে এলো ওর, নিশ্বাসটা গলার কাছে আঁটকে যেতেই হাঁপানির মতো ঠোঁট খুলে ফেললো। নিশ্বাস নিতে পারছেনা মেহনূর, কেউ গলার কাছটায় যেনো দানবীয় হাতে টিপে ধরেছে, চোখ ফেটে পানি বেরুচ্ছে, চিৎকার করতে মন চাইছে! কানে এবার মারজার গগনবিদারী চিৎকার শুনতে পেলো, বুকটা যেনো গুলির আঘাতের মতো ঝাঁঝরা হয়ে খেলো। কপাল ঘেমে উঠছে, হাত-পা ভয়ংকর ভাবে কাঁপছে, গলায় নিশ্বাস জমে ঠোঁট দিয়ে ফোসফোস করে বেরুচ্ছে। নীতি পাগলের মতো কেঁদে যাচ্ছে, তার চিৎকারের করুণ সুর ভয়াবহ। বারবার আর্জি জানাচ্ছে, ‘ আল্লাহ্ মাফ করো, আল্লাহ্ মাফ করো। ওকে ফিরিয়ে দাও। ‘
হা করে জোরে-জোরে নিশ্বাস নিতেই টলমল চোখে আবার সামনে তাকালো মেহনূর। সমুদ্রে একটুখানি বাঁচার তাগিদে হাবুডুবু খাচ্ছে মাহদি, বারবার দুই হাত উঁচিয়ে সাহায্যের জন্য ডাকছে। স্রোতের জোয়ারে বহু দূরে চলে গেছে মাহদি, নাগালহীন হাতদুটো বারবার ডেকে যাচ্ছে। তাকে নাগালে পাওয়ার জন্য প্রাণপণে ছুটেছে চারজন, সমুদ্রের দূরত্ব যেনো কয়েকশো মাইলের মতো ঠেকছে। আজ মাহতিমের স্থিরজ্ঞান নেই, পুরো দুনিয়াটা অন্ধকার লাগছে। সমুদ্রের নোনাপানির সাথে তার চোখদুটো মিলে গেছে। এই সমুদ্রেই যাত্রা তার শুরু, সমুদ্রের জন্যই সে দূরে থাকে, আজ কি এই সমুদ্র সবটুকু মায়া গিলে নিবে? হঠাৎ বাতাসের সাথে করুণ সুর শুনে থমকে গেলো মাহতিম, পেছন থেকে নীতির কন্ঠে ‘ মেহনূর ভাবী ‘ ডাকটা শুনে সাঁতার থেমে গেলো তার। মুখটা পিছু ঘুরাতেই বুকের ভেতরটায় সজোড়ে একঘা চাবুক লাগলো! সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করে বাজতেই স্থির হয়ে গেলো সে, কানে-কানে চিরপরিচিত স্লোগানের সুরটা শুনতে পেলো,
– শান্তিতে সং’গ্রামে সমুদ্রে দূর্জয়, শান্তিতে সং’গ্রামে সমুদ্র দূর্জয়।
– চলমান .
#FABIYAH_MOMO .
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪৯.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
অংশ সংখ্যা – শেষ .
মাহতিম ওই মূহুর্তে কিচ্ছু চিন্তা করতে পারছিলো না! মাথাটা একদমই কাজ করছেনা! মেহনূর উন্মাদের মতো সমুদ্রের দিকে ঝাঁপ দিতে আসছে! অপরদিকে স্রোতের তুমুল উত্থালে দূরে চলে যাচ্ছে মাহদি। দুদিক থেকে বিরাট সমস্যার মোকাবিলা আগেও করেছে মাহতিম, কিন্তু এবারেরটা পুরোই ভিন্ন। আবেগের ঘনঘটা তাকে গোগ্রাসে গিলে ধরেছে, মেহনূর যতোই সাঁতারে পটু হোক, সমুদ্রের কাছে সে পারবে না। সৌভিকরা মাহদির জন্য ঝাঁপিয়ে পরলেও সাঁতরে বেশিদূর যেতে পারেনি, তারা পিছিয়ে যাচ্ছে স্রোতের ধাক্কা খেয়ে। মাহতিম লম্বা-লম্বা নিশ্বাস ছাড়তেই চোখ বন্ধ করলো, তার মাথাটা ঠিকভাবে কাজ করা প্রয়োজন। তার সচল মস্তিষ্কটা বারবার নেতিয়ে পরছে, ঠোঁট কাঁপছে প্রচুর, কেনো এমন হচ্ছে? হওয়ার কারণটা কি? আগে তো এমন অবস্থা হয়নি? শত্রুর হাতে ধরা খেয়েও মৃত্যুর ভয়ে বুক কাঁপেনি, আজ কেনো ভেতরটা ভেঙেচুড়ে শেষ হয়ে আসছে? তার ক্যালকুলেশন মতে কেউ কি শেষ হতে যাচ্ছে? মেহনূর কি সমুদ্রের পানিতে ঝাঁপ দিয়ে দম হারাবে নাকি, মাহদি … ক্যালকুলেশন বারবার গুলিয়ে যাচ্ছে, সূত্র বসাতে ভুল করছে, কেনো এমন হচ্ছে? তার ট্রেনিংয়ের সিক্যুয়েন্সগুলো এভাবে বেখাপ্পা হয়ে যাচ্ছে? কোনো কঠিন সত্যের জন্যই কি ভেতরটা ধসে-ধসে ভাঙছে? মাথা কাজ করছেনা, সমুদ্রের অতল গহ্বরের কাছে মস্তিষ্কের গভীরতা কাজ করছেনা।
নাক দিয়ে, মুখ দিয়ে নোনাপানি ঢুকছে। অবাধে ছোট্ট দেহটার ফুসফুস থলির ভেতর অক্সিজেন শূন্য হচ্ছে। মস্তিষ্কের ক্রিয়া আস্তে-আস্তে সুইচ টেপা বাতির মতো নিভে আসছে। মনে হচ্ছে, কেউ যেনো মাথার ভেতর ঢুকে সব বাতিগুলো টপটপ বন্ধ করে দিচ্ছে, বন্ধ করতেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে মাথার যন্ত্রটা নিস্তেজ হয়ে আসছে। শরীরের উপর কয়েক শো টনের ভার অনুভূত হচ্ছে, নিশ্বাস ফুরিয়ে শূন্য স্কেলের দাগে পৌঁছেছে। জীবনের মায়াটা হাতছানি দিয়ে তাকে বিদায় জানাচ্ছে, যেনো বলছে ওপারে ভালো থেকো মাহদি। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা, কোনোকিছু স্বচ্ছ না। পানির তলে বহুক্ষণ যাবৎ যুদ্ধ করেও কারোর নাগাল ছুঁতে পারেনি। কান্নার অশ্রুগুলো সমুদ্রের নোনাপানিতে মিশে গেছে, আলাদা করে যাবে না তার অশ্রুগুলো। উঁচিয়ে রাখা হাতদুটো আস্তে-আস্তে পানির উপর ধপাস-ধপাস করে পরলো, হাতে আর শক্তি নেই, শক্তি শেষ। পানির নিচে পাদুটো পাগলের মতো দানাদাপি করে মুখটা শেষবারের মতো উপরে তুলতে পারলো, গলা অবধি শরীরটা পানির নিচে কাতরাচ্ছে। মুখ হা করে শেষ নিশ্বাসগুলো টানার সময় স্তব্ধ কানে ‘ ভো ভো ‘ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কেউ ‘ মাহদি, মাহদি ‘ বলে জান-প্রাণ দিয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। সুরসুর করে আরো একদফা পানি নাক দিয়ে ঢুকলো মাহদির, সোজা মাথার ভেতর ছ্যাৎ করে আঘাত হানতেই নিশ্বাসে দারুণভাবে টান খেলো। যন্ত্রনায় কাতরাতে গিয়ে দুই হাত সমানতালে ঝাপটাতে লাগলো, পানির উপর ঝপাস-ঝপাস আওয়াজ হলো আবার। গলাকাটা মুরগির মতো কিছুক্ষণ দাপাতে লাগলো, এরপরই নিস্তেজ মুরগির মতো শান্ত হয়ে গেলো মাহদি। দুচোখের পাতা এক হয়ে রঙিন দুনিয়াটা ঢেকে গেলো, শরীর হালকা হতে-হতে পানির তলে নেমে গেলো। আরো তলে, আরো গভীরে, আরো অতলস্পর্শী জায়গার ভেতর যেতে-যেতে দিনের আলোটা ফিকে হয়ে আসতে লাগলো। জীবনের শেষ সন্ধিটুকুতে ফ্যাকাশে ঠোঁটে ক্ষীণভাবে হাসলো মাহদি, মানসপটে শৈশবের সেই দৃশ্য থেকে জীবনের সমস্ত মধুর দৃশ্যগুলো স্মৃতির দেয়ালে চলে আসলো। মনে পরলো, অবুঝ বয়সে তার ভাই কত রাত ঘুমায়নি। অসুস্থ হলে বুকে টেনে ঘুম পাড়িয়ে দিতো, কখনো-কখনো মায়ের পরিবর্তে সে-ই গোসল করিয়ে দিতো। বাবাহীন জীবনে সকল বায়নাক্কা তার ভাই-ই পূরণ করেছে। জন্মদিনে ভাইয়ের কাছে কম্পিউটারের বায়না করেছিলো, দামটাও ছিলো ঢের। তাও নিজের বেতন দিয়ে সেই শখ পূরণ করেছিলো মাহতিম, সাইকেলটাও এনেছিলো বিদেশী ব্র্যান্ডের। তার ভাই তো তাকে ভালোবাসেই, কে বলেছে আদর করেনা? যদি আদর না করতো তাহলে কি সমুদ্রের মধ্যে বাঁচাতে আসতো? কই, সৌভিক ভাইয়ারা দেখি পিছিয়ে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। কিন্তু ভাইয়া তো ভাইয়াই, সে যে এখনো বাঁচাতে ছুটে আসছে। বাবার আদর, মায়ের আদর, স্বজনের আদর সবার আদর ভাইয়া একাই দিয়েছে। কখনো বাবার মতো ছায়া হয়ে থাকতো, কখনো ভাইয়ের মতো ঢাল হয়ে দাঁড়াতো। জীবনে এইটুকু বয়সে কখনো একা-একা লাগেনি, তার ভাইয়া ছুটি থেকে ফিরলে তাকে একা রেখে কোথাও ঘুরেনি। পকেটের ফোনটাও তো ভাইয়ার দেওয়া, তাহলে সে কেনো ভাইয়াকে আজ কষ্ট দিলো? খাবার টেবিলে ওসব কথা বলে কষ্ট দেওয়া হলো না? কেনো বললো ওসব? মেহনূরকে আর বিয়ে করা হলো না, ভাইয়া বুড়ো হয়ে গেলে মেহনূর একা থেকে যাবে। তার তো কেউ নেই। ভাইয়া কি মেহনূরকে দেখে রাখবে? মেহনূর সবার চেয়ে আলাদা, কেউ ওর মতো নয়। সবাই স্বার্থপর, সবাই খারাপ, শুধু মেহনূর তাকে খুব চোখে-চোখে রাখতো। রজনী মামী কি মেহনূরকে খুব মা’রবে? হঠাৎ নিশ্বাসের শেষ টান খেয়ে কাশতে লাগলো মাহদি, তার শরীরটা শেষের দিকে এসে পরেছে। মুখের ভেতর সমুদ্রের নোনাযুক্ত বিদঘুটে স্বাদ, পেটটাও এমন ভরে গেছে যেকোনো সময় বোমার মতো ফেটে যাবে। শরীরটা ছেড়ে দিয়েছে সে, ভরহীন শরীরটা তলিয়ে যাচ্ছে, নিচ থেকে কেউ যেনো সাদরে টেনে নিচ্ছে তাকে। সমুদ্রের অতল অন্ধকারে চেতনার শেষ সময়টুকু চলছে, চোখের সামনে সব শূন্য হতে শুরু করেছে। দেহ-মন-মস্তিষ্ক সবকিছু কোথাও মিলিয়ে যেতেই চূড়ান্ত নিশ্বাস ছেড়ে দিলো, অন্ধকূপের দৃষ্টিতে ছেপে উঠলো একটি মুখ, একটি হাসি-হাসি চেহারা, একটি সুদর্শন আদলের যুবক। তার দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসি দিয়ে কপালে গাঢ় চুমু খেলো। যুবকের চোখদুটোয় কি আনন্দ, আনন্দে চোখের ভেতর পানি চিকচিক করছিলো। সদ্য নবজাতকের ফুটফুটে দুটো গালে চুমু খেয়ে আদরে-স্নেহে গালে-গাল জড়িয়ে রাখলো। ফিসফিস করে নবজাতকের কানে বললো, ‘ তোর নাম দিলাম মাহদি। আমার মাহদি আনসারী। আমার কলিজার ভাই প্লিজ দ্রুত বড় হ।’
.
বাংলাদেশের স্বনামধন্য কক্সবাজার সমুদ্র-সৈকতটা এখন রেড এলার্টে সিল করা হয়েছে। দলে-দলে সমুদ্রের উপর ডুবুরিদের হামলা হচ্ছে, দূর থেকে উৎসুক পর্যটকদের ভীড় বড় হচ্ছে। বালুর উপর অনেকগুলো মানুষ এসেছে, কারো-কারো পড়নে আর্মিদের মতো পোশাক, কারো পড়নে সাদা রঙের অদ্ভুত ইউনিফর্ম। ট্যূরিস্ট পুলিশ, স্থানীয় পুলিশ, টহল দল, ডুবুরিদের বিশাল ফোর্স, জেলা প্রশাসন থেকে কিছু গুণী ব্যক্তিবর্গদের গাড়ি যেনো হৈচৈ অবস্থা করে ফেলেছে। কৌতুহল পর্যটকরা এতোক্ষণে বুঝে ফেলেছে, এখানে কোনো বিশেষ ব্যক্তি তার পরিবার নিয়ে এসেছে। সবার সাথেই সাধারণ মানুষদের মতো চলাফেরা করেছে তারা। যার দরুন তারা কেউই বুঝতে পারেনি সেই বিশেষ ব্যক্তিটা এতো ক্ষমতাসীন ছিলো। একটু আগে আবাসিক হোটেলের সামনে সাইরেন বাজাতে-বাজাতে দুটো এ্যাম্বুলেন্স এসে থেমেছে, এটা তাদের কাছে বেশ বিরল চিত্রের মতোই লাগছে। কখন-কিভাবে-কি হলো তারা নিজেরাও বুঝতে পারছেনা। একটা এ্যাম্বুলেন্স হোটেলের দোরগোড়ায় থামলো, হুড়মুড় করে হোটেলের ভেতরে ডাক্তারদের একটা টিম ঢুকে গেলো। একটু আগে সবাই দেখেছে শাড়ি পড়ুয়া একটা মেয়েকে অচেতন অবস্থায় হোটেলের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে একদল শিক্ষার্থী কক্সবাজার ট্যূরের জন্য এসেছে, তাদের পুরো দলটাই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সমুদ্র-তীরের দৃশ্য দেখে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও স্মার্ট মেয়েটা ন্যাকান্যাকা সুরে বললো,
– আমার কিন্তু অসহ্য লাগছে। প্লিজ এখান থেকে চলতো। অন্যের ম্যালোড্রামা দেখার টাইম আছে? আমরা সেফে আছি, সেটা নিয়ে চিল করা উচিত না?
মেয়েটার দিকে পুরো ছেলেদলটা গরম চোখে তাকালো। তাদের ভেতর থেকে চশমা পরা বিজ্ঞ-বিজ্ঞ চেহারার তূর্য বললো,
– তোর কাছে মানুষের মৃ’ত্যুটা ড্রামা লাগে? চোখের সামনে নিজেই তো দেখলি ছোট্ট একটা ছেলে পানিতে ডুবে নিখোঁজ হলো। এখনো ছেলেটার লাশ পাওয়া যাচ্ছে না। যেই অফিসারের রিলেটিভ ম’রেছে উলটো তার দিকেই তুই ত্যাড়া চোখে তাকাচ্ছিস। তোর মতলব কি বুঝিনি ভেবেছিস? আমরা কি এতোই মূর্খ?
ছেলেটার কাটকাট কথা শুনে মেয়েটাও চড়া গলায় বললো,
– তোর যদি এতোই মায়া লাগে তাহলে নিজেই লা’শ খোঁজ না! এখানে এসে লেকচার কেনো দিচ্ছিস? এতোই যখন আমার মতলব বুঝেছিস তাহলে যেয়ে লেগে পর। তোর মতো জনদরদী হওয়ার ইচ্ছে তো আমার নেই।
তূর্য দৃষ্টিচ্যূত হলো। ফোর্সের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সোজাসুজি ইতির পানে তাকালো। ইতির মেয়ে সঙ্গীরা বুঝে গেছে এখন দুজনের তুমুল তর্কযুদ্ধ বাঁধবে। তাড়াতাড়ি মধ্যকার যুদ্ধটা স্থগিত করার উদ্দিশ্যে ইতিকে টানতে-টানতে অন্যদিকে নিয়ে গেলো তারা। পরাস্ত ইতি চোখ পাঁকিয়ে রাগে গজগজ করে বললো,
– তোরা আমাকে আনলি কেন? দিতাম দুটো গালি শুনিয়ে। ফাজিল কোথাকারটা যখন-তখন আমার উপর তেড়ে আসে। অসহ্য কাজকর্ম! আমি থাকবো না এদিকে, বাসায় চলে যাব।
ইতিকে ঠান্ডা করার জন্য মিলি নামের মেয়েটা নিজের কোকের বোতল ধরিয়ে দিলো, খাওয়ার জন্য ইশারা করতেই শান্ত কন্ঠে বললো,
– চেতিস না। তূর্যকে শুধুশুধু আমরা গ’বেট বলি? ও তো আস্তো একটা গ’বেট! আচ্ছা সারাক্ষণ বইয়ে মুখ গুঁজে থাকলেই কেউ নিউটন হয়? উহু, ভেতরে চিয়ার্স ভাইবটা থাকা লাগে।
মিলির ভুল বক্তব্য শুনে ভ্রুঁ কুঁচকালো আফরা। পড়াশোনায় ভুল তথ্য শুনলে তার মাথায় ঢিংঢিং ঘন্টা বাজতে থাকে, এখনও তাই হচ্ছে। মিলিকে খপ করে নিজের যুক্তির ভেতর ধরলো সে,
– তুই নিজে গ’বেট হয়ে তূর্যকে গ’বেট বলিস? নিউটন কবে চিয়ার্স ভাইব রেখেছে রে ছা’গল? আইজ্যাক নিউটন যদি একটু হলেও চিয়ার্স ভাইব রাখতো, তাহলে আজ তার কপালে বিয়ের তকমা থাকতো বুঝলি? ওই ব্যাটার একটা গার্লফ্রেন্ডও ছিলো। বাট, আফসোস ব্যাটার অন্যমনা স্বভাবের জন্য গার্লফ্রেন্ড তাকে ছেড়ে যায়।
মিলি, ইতিসহ সব মেয়েরা মুখরোচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আইজ্যাক নিউটনের ঘটনা শুনতে গিয়ে হঠাৎ ইতি অন্যমনষ্ক গলায় মিহি করে বললো,
– ওই লোকটা খুব মারাত্মক দোস্ত। সে জাস্ট একবার দিকে তাকিয়েছিলো। মুখটা ক্লিন, নো দাড়ি। একদম আর্মি-আর্মি কাটের মতো চুল। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা কি জানিস? পানিতে ভিজে লোকটার মাশল-ফাশল বডিটা দেখার মতো। হি হ্যাজ এ্যা এ্যাক্ট্রেক্টিভ লুক, ফিগার এ্যান্ড ড্যাশিং পার্সোনালিটি।
.
সামুদ্রিক অভিযান এখনো চলছে। লাপাত্তা মাহদিকে খোঁজার জন্য পুরো ফোর্স ডেকে ফেলেছে। মাহতিমের খিটখিটে মেজাজ দেখে তার জুনিয়রদের অবস্থা শোচনীয়। বিশেষ করে, নোমান ইকবাল ঢোক গিলে একটু পরপর ভয় কাটিয়ে চলছে। মাহদির কিছু হলে মাহতিম তাদের একটাকেও ছাড়বে না, সবগুলোকে ইচ্ছে মতো ঝাড়বে। তার চেয়েওবড় কথা, মাহতিমের রাগের চেয়ে তার নিরবতাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। পুরো ডিপার্টমেন্ট জানে মাহতিমের নিরবতা কতটা ভয়াবহ। মাহতিম এখন সেই রূপেই নিরব বনে আছে। মুখে নূন্যতম শব্দ নেই। গায়ের শার্টটা ভেজা, প্যান্ট ভেজা, পুরো শরীরটাই ভিজে শেষ। বুকের কাছে দুহাত ভাঁজ করা। মুখে তালা এঁটে স্ট্যাট-কাট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার ডানে-বামে দুজন সিনিয়র পুলিশ ওয়াকি-টকিতে কথা বলে যাচ্ছে। আশেপাশের কিছু পর্যটক অবাক চোখে দেখে যাচ্ছে, কারো-কারো দৃষ্টিতে মাহতিম আঁটকে গেছে। আপাদমস্তক তার দিকে চোখ বুলিয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছে কেউ। হঠাৎ নোমানের লেফট পকেট থেকে ফোন বিপ করলো, পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোন বের করলো নোমান। কলটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে নিউজ শুনে বিষ্ময়ে চেয়ে রইলো। কলটা কেটে দিয়ে নিশ্বাস ছাড়লো নোমান, নিচের ঠোঁটে জিহবা বুলিয়ে সামনে তাকালো। কয়েক কদম সামনে থাকা মাহতিমের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সে, বাঁদিকের পুলিশটাকে ক্রস করে মাহতিমের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভুড়ি পেটওয়ালা পুলিশটা নোমানকে দেখে কিছু একটা বুঝে দূরে সরে গেলো। একই ভঙ্গিতে মাহতিমের ডানদিকের পুলিশটা দূরে সরলে সন্নিকটে এলো নোমান, স্বর নামিয়ে একটু আগের নিউজটা বসের উদ্দেশ্যে বললো,
– স্যার, আপনাকে হোটেলে যেতে বলেছে। ম্যামের অবস্থা একটু খারাপ।
বিশেষ প্রতিক্রিয়া নেই। যেমন ছিলো, তেমনই আছে মাহতিম। দৃষ্টি অটল, ভাব অটুট, দেহভঙ্গি শক্ত। নোমান আবার সঙ্কোচের সাথে বাকি কথাটা পাড়লো,
– ম্যামের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে স্যার। আপনার ছোট বোন ফারিন আপনাকে যেতে বলছে।
কথাটার বলার প্রায় মিনিট খানেক পেরিয়ে গেলো, মাহতিম একটুও ভ্রুক্ষেপ দেখায়নি। সে স্থির দৃষ্টিতে সমুদ্রের ফেনিল রাশিতে তাকিয়ে আছে। আশাহত নোমান যেই চলে যেতে নিবে, ওই সময় তেজালো গলায় ছোট্ট জবাব চলে এলো,
– ডাক্তারকে হ্যান্ডেল করতে বলো।
নোমান বেকুবের মতো অস্ফুট সুরে বলে উঠলো,
– জ্বী.. মানে তারা —
কথা শেষ করার আগেই দাঁত চিবিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো মাহতিম,
– ডাক্তারকে হ্যান্ডেল করতে বলেছি নোমান! গেট লস্ট!
ঝাঁজালো কন্ঠের গলা শুনে একমূহুর্তের জন্য সব চুপ! সবার দৃষ্টি কেবল মাহতিমের দিকে। ওয়াকিটকিতে কথা বলা পুলিশও কথা থামিয়ে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে আছে। নোমান আড়চোখে বিব্রতকর অবস্থা দেখে ছোট্ট করে বললো,
– সরি স্যার।
ওপাশ নির্যুত্তর। মুখ তুলে স্যারের শক্ত মুখের দিকে তাকালো নোমান। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হতাশার সাথে নিশ্বাস ছেড়ে চলে গেলো। সময়ের পালা এখন চারটায় এসে ঠেকেছে। মাথার উপর সাক্ষী থাকা সূর্যটা এখন পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটু আগে হেড অফিস থেকে কল এসেছিলো, মাহতিম সেই কলে রিসপন্স করতে পারেনি। মাহতিম জানে, তারা আজকের ভেতর ফিল্ডে ফেরার জন্য তাগাদা দিবে। একমাত্র এটার জন্যই এইমূহুর্তে কল এসেছে, নাহলে আসতো না। নিজেকে একটু স্থির করে হেড অফিসের জন্য কল করলো মাহতিম, কয়েক টোন বাজতেই রিসিভ হলো কলটা,
– হ্যালো,
হেড অফিসের বিশেষ ব্যক্তির উত্তরে মাহতিম বললো,
– আনসারী বলছি।
মাহতিমের কন্ঠ পেয়ে ধাতস্থ হলো বিশেষ ব্যক্তি। সমবেদনার মতো বিমর্ষ সুরে বললো,
– তোমাকে আজই ফিরতে হবে মাহতিম। আই এ্যাম সো সরি। তুমি তো রুলস রেগুলেশান জানোই। আমি এর চেয়ে বেশি কিছুই করতে পারবোনা, আমি রুলস মানতে বাধ্য।
আক্ষেপে চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। কানে ফোন ধরা অবস্থায় জোরে নিশ্বাস ছাড়লো সে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চোখ খুলে হালকা কেশে বললো,
– সমস্যা নেই। আমি নিজেও ডিপার্টমেন্টকে এক্সকিউজ দিতাম না। কিন্তু, স্যার, যদি ডিউরেশনটা একটু বাড়ানো যেতো…
মাহতিমের অসম্পূর্ণ কথাটা ওপাশের ব্যক্তি চট করে বুঝলো,
– আজ মানে আজই মাহতিম। আমি এ বিষয়ে কিছুই করতে পারবো না। তোমাকে আজই ফিরতে হবে, আমি রুলসের এ্যাগেনেস্ট যেতে পারবো না। প্লিজ ট্রায় টু আন্ডারস্টেন্ড ম্যান।
কথা বাড়ালো না মাহতিম। তাদের বলে অবশ্য লাভ নেই। একরোখা কর্মজীবনে সবকিছুই একমুখী হয়ে গেছে। ‘ ইমোশন ‘ শব্দটাই বড্ড ভেজাল শব্দ, ভেজালের জন্যই বোধহয় পাষাণ হবার জঘন্য ট্রেনিং দেওয়া হয়। আজ থেকে নাহয় আসল রূপটাই দেখানো যাক। অদ্ভুত ক্ষোভের সাথে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো মাহতিম, খুবই অদ্ভুত।
বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ ডুবুরির তৎপরতায় অভিযান সমাপ্ত হলো। যেই কাঙ্ক্ষিত মূহুর্তের জন্য দিনকাল স্থির করে পুরোটা দুপুর, পুরোটা বিকেল অপেক্ষা করছিলো সেটা উদ্ধার করতে পেরেছে। জালের ভেতর আঁটকা পরেছে নিথর একটি দেহ, দেহে কোনো প্রাণ নেই। পুরো শরীর বরফের মতো জমে গেছে, মুখটা পাণ্ডুর। ডুবুরির দলটা জলযানে করে তীরের দিকে ফিরলো, ছোট্ট দেহটা পাজকোলে করে মাহতিমের সামনে আনলো তারা। বালির উপর রাখা প্লাস্টিকের শীটের উপর আস্তে করে ডেডবডিটা নামিয়ে দিলো। মাহতিম চোখ কুঁচকে আছে, তার হাতের মুঠোদুটো মুষ্টিবদ্ধ। ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে আছে, এখুনি চোখ খুললে ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে আসবে। বাঁকাধে হাতের স্পর্শ পেয়ে মাথা তুললো মাহতিম, একটু ভরসার মতো সুরাহা পেয়ে সেদিকে চোখ খুলে তাকালো। নোমানের চোখ দিয়ে দরদর করে পানি নামছে, ছেলেটা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। লাশকে ঘিরে গোল হয়ে আছে সবাই, অন-ডিউটিতে থাকা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরা মাথার টুপি নামিয়ে মাথানত করে আছে। মাহতিম একপলক সবার দিকে চেয়ে থেকে শেষমেশ নিচের দিকে তাকালো, শূন্যদৃষ্টির মতো নিষ্পলক হয়ে গেলো সে। ধপ থেকে হাঁটু গেড়ে বালিতে বসে পরলো, একদৃষ্টিতে সামনে থাকা নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখে কোনো অশ্রু নেই মাহতিমের, ভেতরের কোনো উত্তাপও বাইরে প্রকাশ পেলো না। নিরব চাহনিতে বহু সময় ধরে তাকিয়ে রইলো। গায়ে লেমন টিশার্ট, গতবছর ঈদে কেনা দেওয়া কালো ট্রাউজার পরনে। পেটটা অনেক ফুলে উঠেছে, এখুনি দুহাতে চাপ দিলে গড়গড় করে পানি বেরিয়ে আসবে। মুখে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, নেই কোনো দুঃখের ছাপ। যেনো গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে নিষ্পাপ মাহদি, দুনিয়াবি সকল কারসাজি থেকে বিদায় নিয়ে ঘুম দিয়ে ফেলেছে। এই নিদ্রা, এই তন্দ্রা আর কোনোদিন ভাঙবে না। এই নিদ্রামগ্ন মুখটা আগেও দেখেছে মাহতিম, কিন্তু তখন ইচ্ছে করেই জাগাতো না। ভাবতো, ঘুমাচ্ছে যেহেতু, একটু নাহয় ঘুমোক। অথচ, কঠিনভাবে ইচ্ছে করছে দুহাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে-ঝাঁকিয়ে উঠাতে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ঘুমাস নারে ভাই, এবার উঠ্। আর ঘুমিয়ে থাকিস না। আর ঘুমিয়ে থাকিস না ভাই। আর ঘুমিয়ে থাকিস না।
ডাক্তারের পুরো টিম এখনো রোগীর দিকে ঝুঁকে পরেছে। একটু পরপর পালস রেট দেখছে, অক্সিজেন লেভেল নিরীক্ষা করছে, শরীরের অবস্থা কোন পর্যায়ে খারাপ বা ভালো, সেটা নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে। রুমে স্বজনদের মধ্যে কেবল দুজনকে এলাউ করেছে, তাও সেই দুজন কোনো প্রকার আওয়াজ করতে পারবে না। মেহনূরের অবস্থা ভালো না। পানিতে দীর্ঘক্ষণ থাকার কারণে রক্তে অক্সিজেন কমে গেছে, ঠান্ডায় অবস্থা আরো জঘন্য। সদ্য জ্বর থেকে উঠার জন্য বডিতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো লক্ষণ দেখাচ্ছে না। ঘড়িতে এখন ছয়টা চল্লিশ বাজছে, ঘন্টা খানেক আগে দাফনের জন্য চলে গেছে সবাই। ছেলেরা কেউ হোটেলে নেই, মারজা থেমে-থেমে হাউমাউ করে কাঁদছেন। রজনী পাশে নেই, অনামিকার অজুহাত দেখিয়ে অনামিকার রুমে দরজা বন্ধ করে উইষ্কির ফূর্তি করছে। নীতি ও ফারিন ফোলা-ফোলা চোখ নিয়ে মেহনূরের রুমে বসে আছে। চোখ ভিজে-ভিজে আসছে দুজনের, তবুও নিজেদের শক্ত করে নিরবে চোখ মুছে যাচ্ছে তারা। ডাক্তাররাও ব্যথিত, এরকম একটি শোকের ভেতর আরেকটি শোক যেনো ভর না করুক নিজেরাই মন থেকে প্রার্থনা করে যাচ্ছে। নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই এখন পেশেন্টের দিকে। দরজার নব মোচড়ানোর আওয়াজ হতেই নীতি ও ফারিন চোখ মুছে তাকালো, কেউ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দুজন দাঁড়িয়ে পরলো। মাহতিম এসেছে। মাহতিমের চোখ-মুখের অবস্থা একদম স্বাভাবিক, কান্নার সামান্য চিহ্নটুকুও নেই। গায়ের পোশাকটা পালটে ফেলেছে, এখন গায়ে ফর্মাল ক্যাটাগরির ড্রেসআপ। নীতি পুরোপুরো বুঝে ফেলেছে মাহতিম বিদায় নিতে এসেছে, তাই বিদায়ের সময়টুকুতে নিজেরাই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মাহতিম নিশব্দে হেঁটে আসতে-আসতে ডাক্তারের দিকে নিম্ন স্বরে বললো,
– কিছুক্ষণের জন্য কি কথা বলতে পারি? আসলে আমি চলে যাচ্ছি তো, এজন্য ওয়াইফের সাথে একটু প্রাইভেট-টক সারতে চাই।
থুতনীতে মাষ্ক নামানো ডাক্তার মেহনূরের দিকে তাকালেন, এরপর দৃষ্টি তুলে মাহতিমের দিকে বললেন,
– জ্বী স্যার, পারবেন। কিন্তু, ম্যাম এখনো খুব উইক। একটু খেয়াল রাখবেন, কথায় যেনো প্রেশারাইজ না থাকে।
মাহতিম স্বাভাবিক গলায় বললো,
– জ্বী, শিওর।
রুম থেকে একে-একে সবাই বেরিয়ে গেলো। শেষ নার্সটা চলে যেতেই দরজা থেকে চোখ সরালো, সামনে তাকিয়ে বিছানার দিকে দৃষ্টি রাখলো মাহতিম। গায়ের শাড়িটা খুলে ফেলা হয়েছে, তার পরিবর্তে আগের মতোই ঢিলেঢালা সাদা কামিজ দেখা যাচ্ছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো, চোখদুটো এখনো বন্ধ। সম্ভবত নিম্ন স্বরে কথা বলার জন্য মেহনূর এখনো টের পায়নি। বিছানার ঠিক ডানদিকটায় টুল টেনে বসলো মাহতিম। স্যালাইন লাগানো হাতটা ছুঁতে গিয়েও ধরলো না। একটু এগিয়ে এসে মেহনূরের কপালে হাত রাখলো। সুপরিচিত স্পর্শ পেয়ে চোখ খুললো মেহনূর, মাষ্কের আড়ালে থাকা ঠোঁটদুটো একটুখানি ফাঁক করলো। প্রথম-প্রথম অস্বচ্ছ দেখতে পেলেলেও আস্তে-আস্তে পরিষ্কার দেখতে পেলো। মাহতিম কাছে এসে বসে আছে, একটা হাত কপালে রেখে চুপ করে তাকিয়ে আছে। গায়ে এখন সাদা শার্ট, কালো প্যান্টের সাথে ইন করে শার্ট পরেছে। পুরো বেশভূষা ঠিকমতো আঁচ করতেই মেহনূর বুঝে যায় মাহতিম চলে যাবে। মেহনূরের দিকে অপলক চাহনিতে তাকিয়ে থাকতেই ঠান্ডা সুরে বললো মাহতিম,
– ঠিক আছো?
মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো মেহনূর। মোটা অশ্রুটা চোখ গড়িয়ে টপ করে পরলো। ঠোঁট নাড়িয়ে ফিসফিস করে বললো,
– ঠিক আছি।
অসুস্থ মুখটার কাছে গেলো মাহতিম, একহাতে গাল ধরে কপালে গভীর চুমু খেলো। নিভু-নিভু চোখদুটোর দিকে আবারও চুপ করে তাকিয়ে রইলো। নির্বাক মাহতিমের দৃষ্টিজোড়ায় দৃষ্টি মিলিয়ে তাকালো মেহনূর। মুখের অক্সিজেন মাস্কটা টেনে সরাতে ইচ্ছে করছে। যদি মাষ্কটা মুখে না থাকতো, তাহলে মাহতিম কি চুমু খেতো না? মাহতিম নড়েচড়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো, মুখের উপর থেকে মুখ সরিয়ে দূর্বল মেহনূরের কন্ঠায় ছোট্ট চুমু খেলো। চোখ বন্ধ করে মেহনূরের থুতনির নিচে মুখ গুঁজে দিলো মাহতিম, মেহনূরের দেহের উপর নিজের অস্তিত্বকে ছেড়ে দিলো সে। স্যালাইনের নল ঢুকানো হাতটা ধীরগতিতে উপরে তুললো মেহনূর, মাহতিমের শক্ত শরীরটায় হাত উঠিয়ে দূর্বল ভাবে বুলিয়ে দিতে লাগলো। অন্যহাতটা নাড়াতে পারছেনা মেহনূর, ওই হাতটা অবশ হয়ে পরে আছে। অসহ্যকর মাষ্কটার জন্য একটুও আদর করতে পারছেনা। হঠাৎ মাহতিম আস্তে-আস্তে বলে ফেললো,
– সব চলে গেলো, আর কেউ নেই।
ভেতরটা যন্ত্রনায় গুমরে উঠলো, চোখ বন্ধ করে ফেললো মেহনূর। নিজের বুকটার ভেতর মাহতিমকে লুকিয়ে রেখে চিৎকার করে বলতে মন চাচ্ছে তার, খুব মন চাচ্ছে বলতে,
‘ আমি আছি, আমি কক্ষনো আপনাকে ছেড়ে যাবো না। ‘ মেহনূর দূর্বলতার কাছে হার মেনে কিছুই বলতে পারলো না , শুধু স্পর্শ হিসেবে মাহতিমকে নিজের সাথে জোর খাটিয়ে জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকতেই স্বাভাবিক কন্ঠে বললো মাহতিম,
– তুমি তোমার বাড়ি ফিরে যাও মেহনূর।
কথাটায় সম্বিত ফিরে পেয়ে চোখ খুললো মেহনূর, পিঠের উপর হাত সরাতেই মাহতিম মুখ তুলে তাকালো। মেহনূরকে ছেড়ে দিয়ে চোখে-চোখ রেখে তাকাতেই মেহনূর আশ্চর্য হয়ে তাকালো। মিনিটের ভেতর কি হয়ে গেলো? ফিসফিসিয়ে কোনোরকমে বললো,
– কেনো যাবো?
মেহনূরের দিক থেকে চোখ সরালো মাহতিম। মেহনূরের স্যালাইন লাগানো হাতটা নিজের গা থেকে দূরে সরিয়ে দিলো। পুনরায় মেহনূরের দিকে দৃষ্টি ফেলে কাঠিন্য স্বরে বললো,
– কারণ, এখানে কারো দরকার নেই। তুমি তোমার গ্রামে ফিরে যাও। আমি সৌভিককে বলে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমি যাওয়ার পরপরই নিজ দায়িত্বে গ্রামে ফিরে যাবে।
একটা পাষাণের মতো লাগলো মাহতিমকে, একটা আস্তো পাষাণতুল্য মানুষ! হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকতে-থাকতে স্থির হয়ে গেলো মেহনূর। ‘ কারো দরকার নেই মানে কি? ‘
চলমান .
#FABIYAH_MOMO .