মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব-৫৮+৫৯

0
833

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৫৮.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

হারিকেনের আলোয় অন্ধকার কেটে গেছে। দেয়ালে-দেয়ালে হলুদ বর্ণের আলো। মাহতিম পিঠের ব্যথাটা ভুলে গিয়ে মেহনূরকে বাহুডোরে জড়িয়ে ধরলো। ঠিক সামনের দেয়ালে দুটো মানবমূর্তির ছায়া পরলো, দুটো দেহের সাথে দুটো স্বচ্ছ হৃদয়ের আলিঙ্গন কালো ছায়ায় ভেসে উঠেছে। দৃশ্যটা হারিকেনের আলোয় আরো সুন্দর, আরো মোহময় দেখা যাচ্ছে। বুকের ভেতর ছোট্ট মুখটা জাপটে ধরে চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। আশ্লেষে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিচু গলায় বললো,

– কাঁদার কিছু নেই, চুপ করো।

মাহতিমের পিঠটা খামচাতে গিয়ে হঠাৎ থামলো মেহনূর। ব্যান্ডেজটার কথা মনে পরতেই পিঠের বাঁদিকটা আলতো হাতে ছুঁয়ে দিলো। নির‍্যুত্তর মেহনূরের ভাবভঙ্গি দেখে তাকে ছেড়ে দিলো মাহতিম, বুকের কাছ থেকে মুখটা তুলে উন্মত্তের মতো ভেজা চোখদুটোয় চুমু খেলো। ঠোঁটের চাপ পেয়ে বন্ধ চোখের পাপড়ি চুয়ে গাল বেয়ে অশ্রু পরলো মেহনূরের। অতিশয় উষ্ণ অনুভূতিতে গভীর শ্বাস নিলো সে। ঈষৎ লজ্জায় আঁখিজোড়া খুলার শক্ত সাহস দেখালো না। মাহতিম চোখদুটো ছেড়ে দিয়ে সরাসরি মুখের দিকে তাকালো, থুতনির নিচে ডানহাতের তর্জনী রেখে মুখ উঁচু করলো। হারিকেনের হলুদাভ আলোয় পুরো মুখটা নরম চোখে দেখতেই নিঃশব্দে হাসলো মাহতিম। ফর্সা গালের উপর লজ্জার আবরণটা গাঢ় করে লেগেছে, চোখাচোখি হবার ভয়ে চোখদুটো এখন বন্ধ। পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাতেই চট করে গলার কাছে চোখ পরলো। গলার ছোট্ট তিলতুল্য কালো বিন্দুটা সোনালী আলোয় চমৎকার লাগছে। চুম্বকের মতোই মৃদ্যু-মৃদ্যু টানছে। বুকের ভেতর আদুরে অনুভূতিটা প্রবল হলো তার, নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ডেরায় রাখাটা মুশকিল হয়ে দাঁড়ালো। ভেবেছিলো সকালের মনোরম মূহুর্তের মতো এবারও মেহনূর তাকে কাছে টেনে নিবে, কিন্তু সময়ের পরিধি তাকে অধৈর্য করে ছাড়লো। তখনই হাতটা নির্বিকারে মেহনূরের থুতনি ছেড়ে পিঠের মখমল ব্লাউজটায় হাত রাখলো। নিজের সমস্ত সীমাবদ্ধতা ভেঙ্গেচুড়ে মেহনূরের গলার কাছটায় ডুবলো মাহতিম। ক্ষুদ্র লোলিত তিলতুল্য কালো বিন্দুটায় ওষ্ঠদ্বয়ের ভার ঠেকিয়ে গাঢ় চাপ বসিয়ে দিলো। স্পর্শকারীর মোহমন্ত্রে সাথে-সাথে শিউরে উঠলো মেহনূর, মানুষটার নেভি ব্লু শার্টটা আঙুলের ফাঁকে-ফাঁকে চেপে ধরলো সে। সৌম্য পুরুষের বলশালী হাতদুটো তাকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। বিমুগ্ধ স্পর্শ, কাঁপা-কাঁপা অনুভূতি, মনের ভেতর উত্থাল ঢেউয়ের ধুকপুকনি সবটাই মেহনূরকে নিস্তেজ করে ফেললো। মূহুর্ত্তের ভেতর অনুভব করলো সে নিজের অস্তিত্বে নেই, মাহতিমের অশান্ত-অস্থির-অবাধ ছোঁয়ায় বিহ্বল হয়ে শেষ। বিভোর-মোহাচ্ছন্ন মেহনূর হঠাৎ গলায় কাছে ছোট্ট ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো, ভুলবশত মাহতিমের পিঠটা পাঁচ আঙ্গুলে চেপে ধরলো সে। সাথে-সাথে পালটা ব্যথায় চোখ কুঁচকে খুবই আস্তে ‘ আহ্ ‘ করলো মাহতিম। আর্তনাদের ছোট্ট শব্দটা মেহনূরের কান এড়িয়ে গেলো না। দ্রুত শার্টটা ছেড়ে দিয়ে মাহতিমের দিকে দৃষ্টি রাখলো মেহনূর। ততক্ষণে মাহতিম নিজের ব্যথাহত চেহারা পালটে নিয়েছে, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আচরণ দেখিয়ে শান্ত গলায় বলল,

– ভয় পেয়েছো? কিছু হয়নি। আমি ফিট আছি। টেনশন কোরো না।

অপলক চাহনিতে তাকিয়ে রইলো মেহনূর। তাকে অবুঝ অপরাধীর মতো দেখাচ্ছিলো। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেই নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো,

– আপনি চমৎকার মিথ্যা বলতে পারেন। এই গুণ কি ট্রেনিংয়ে শেখানো হয়েছিলো?

মৃদ্যু করে হাসতে গিয়ে রুমের অন্যপাশটায় চলে গেলো মাহতিম। মেহনূরের কথাটা এমন ভাবে অগ্রাহ্য করলো যেনো এসব প্রশ্ন শুনে সে অভ্যস্ত।দরজার বাইরে উঁকি দিয়ে মানুষের উপস্থিতি আছে কিনা একবার দেখে নিলো মাহতিম, কেউ নেই দেখে দ্বারের পাল্লাদুটো বন্ধ করতে নিলো। বন্ধ করার ঠিক আগ মূহুর্তে একবার মুখ ঘুরিয়ে পিছু তাকালো সে, দরজার ছিটকিনিটা তুলতে-তুলতে মেহনূরের দিকে ফের আপাদমস্তক চোখ বুলালো। ঠোঁটে রহস্যজনক হাসি রেখে হারিকেনের পলতেটা নিভু-নিভু করে ফেললো। রুমটা অন্ধকারে ঢেকে গেলেও চারপাশে ভূতুড়ে অবস্থা ধারণ করলো। বাইরে থাকা নানা ধরনের ডাক ভেসে আসছিলো, কয়েকটা কুকুরের হলেও কয়েকটা অজ্ঞাতধারী ডাক ছিলো। সময় বাড়ার সাথে-সাথে বাতাসটাও ঠান্ডা হচ্ছে, বৃষ্টি শেষে ব্যাঙের ডাকটা একাধারে শোনা যাচ্ছে। মাহতিমের চালচলন বোঝা আবারও দূর্বোধ্য ঠেকছে, কি করতে চাইছে ধরতে পারেনি মেহনূর। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলে ছিমছাম রুমটায় গুমর কন্ঠ ভেসে উঠলো,

– যদি বলি আমি তোমাকে ইউজ করতে বিয়ে করেছি, তোমার প্রতি কোনো ফিলিংসই আমার নেই, তখন তোমার রিয়েকশন কেমন হবে?

প্রশ্নটা করেই মেহনূরের পাশ ঘেঁষে বিছানায় আসলো মাহতিম। পায়ের উপর পা তুলে বেশ গম্ভীর কায়দায় বসলো। পুরো ব্যক্তিত্বের উপর আবেগান্বিত ব্যাপারটা গুড়িয়ে নিয়েছে সে, মেহনূর ভেবেই পাচ্ছেনা কিভাবে সেকেন্ডের ভেতর রূপ পালটে ফেলেছে! হাত উঠিয়ে গলার টনটন জায়গাটা স্পর্শ করলো মেহনূর, মেজাজটা প্রচণ্ড খারাপ হলো। গলায় একদফা কামড় লাগানোর মানে কি? নাটক ছিলো? প্রশ্নটা শুনে যদিও মেজাজ খারাপ লাগছে, কিন্তু সেটাকে হজম করে ঠান্ডা ভাবে বললো মেহনূর,

– আপনি নিজ জ্ঞানে একটু আগে কি করেছেন?

মাহতিম কোনোপ্রকার অস্বস্তি ছাড়াই ভাবলেশহীন সুরে বললো,

– কি করেছি?

রাগ লাগলো মেহনূরের। কথা কি এখন ভেঙ্গে বলতে হবে? এটা কি অতিরিক্ত হচ্ছে না? এরকম অস্বাভাবিক আচরণের মানে কি? তিরিক্ষি মেজাজে বলে ফেললো মেহনূর,

– আপনি আসলে চাচ্ছেনটা কি? আমাকে কি খুলে বলবেন? আপনার কি পিঠে খুব লেগেছে?

মাহতিমের পিছনে থাকা জানালা দিয়ে আলো আসছে। সেই আলোটা সরাসরি মেহনূরের মুখে পরেছে। মাহতিম পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে গাঢ় গলায় বললো,

– ব্যথাটা কোথায় লেগেছে সেটা কি এখনো বুঝো না?

দুই ভ্রু এক করে প্রশ্ন করলো মেহনূর,

– আপনি কি হেঁয়ালি ছেড়ে কথা বলতে পারেন না?

বাঁকা হাসিটা তীর্যক ভাবে ফুটলো। গাম্ভীর্য ব্যক্তিত্বটা এমনভাবে প্রকাশ পেলো, স্তব্ধ ভঙ্গিতে নির্বাক হলো মেহনূর। মানুষটা সম্মোহনী কায়দায় দৃষ্টি ছুঁড়ে নেভি শার্টটার স্লিভ ঠিক করলো, কোনো ভাবনা-চিন্তার সময় না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এক কদম এগিয়ে এসে নির্বিকার চিত্তে শাড়িতে হাত রাখলো। দৃশ্য দেখে কাঠ হয়ে গেলো মেহনূর, মুখটা জবানবন্দির মতো চুপ হয়ে গেলো। আঁচলটা ডানহাতে পেঁচিয়ে জোরে টান দিতেই শক্ত বুকের উপর ছিটকে পরলো মেহনূর। কড়া পারফিউমের সুগন্ধিটা আবারও শ্বাস টেনে অনুভব করলো সে। তার স্পর্শ ইন্দ্রিয় টের পাচ্ছে মাহতিম আনসারী থেমে নেই, আজ সে একটুও থেমে নেই। আধো অন্ধকারে পেয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো শাড়িমুক্ত করে ফেলেছে। বারবার ঢোক গিলে লজ্জার পরিধিটা সামাল দিচ্ছিলো মেহনূর, বুকটা ধুকধুক-ধুকধুক করে কাঁপছে। তার মখমলের ব্লাউজটা যেনো ইচ্ছে করে নাফরমানী করলো। শাড়ির শেষভাগটা মাহতিমের প্রবল টানে যখন খুলে গেলো, তখন কোমরের চিলতেখানি ফাঁকটা পরিদৃষ্ট হলো। শুষ্ক ঠোঁটে জিভ বুলালো মেহনূর, তখনই আবছা মতোন দেখতে পেলো নেভি শার্টটার টপ বাটন খুলে ফেলছে। একটা-একটা করে বোতাম খুলতেই শার্টটাকে অদূরে ছুঁড়ে মারলো। অযত্ন শার্টটা বিছানা স্পর্শ করে ফ্লোরের উপর পরলো। মেহনূরের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে তার ডানহাতটা ধরলো মাহতিম, সেটা টেনে এনে ঘাড়ে রাখতেই মেহনূরকে কোলে তুললো সে। মেহনূর একটুও কাঁপলো না, ভয়ও পেলো না। চুপচাপ বাঁহাতটাও বাড়িয়ে মাহতিমের গলা জড়িয়ে ধরলো। মাহতিম বুঝতে পারলো আজকের পর থেকে মেহনূর কখনোই বাধা দিবেনা। সেটা হোক মনের দিক দিয়ে, অথবা অন্য কোনো মাধ্যম। বিছানার দিকে ধীরেসুস্থে এগুতে লাগলো মাহতিম, তখনই মেহনূর সহজ গলায় বলে উঠলো,

– কিছু নিয়ে টেনশন করছেন?

চট করে মুখ ফেরালো মাহতিম, বিছানার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পরতেই মেহনূরের দিকে তাকালো। মেহনূর কি তার ভেতরের অবস্থাটা ধরে ফেলেছে? সাংঘাতিক! এটা হওয়া উচিত নয়। কিছুদিনের মধ্যেই যেটা ঘটতে যাচ্ছে সেটা কি ওর ধরা উচিত? নিশ্বাস ফেলে হাতদুটোর সমস্ত ভর বিছানায় নামিয়ে দিলো, বালিশে শুইয়ে দিলো মেহনূরকে। পায়ের কাছ থেকে পাতলা কম্বল নিয়ে নিজেও শয্যা গ্রহণ করলো। মেহনূর চুপ নেই, সে আবারও নির‍্যুত্তর মাহতিমকে প্রশ্ন করে বসলো,

– আপনি নিজেকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছেন কেন? কেন টেনশনের ব্যাপারটা লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন? আমাকে বলা যাবে না? আমিতো এখন সুস্থ, আগের মতো একটুও টেনশন করি না। আপনি আমার কাছে বিরাট কিছু লুকাচ্ছেন বুঝছেন! আপনি ভালোই অভিনয় করতে জানেন।

মেহনূরের কথাগুলো দু’কানে শুনলেও মৃদ্যু ঠোঁটে হাসলো মাহতিম, একটা কথারও জবাবদিহি করলো না। মেহনূরের উপর ঝুঁকে আঙ্গুলের ফাঁকে-ফাঁকে আঙ্গুল গুঁজে দিলো, বাঁহাতটা বিছানায় চেপে ডানহাতটা বালিশের উপর উঠালো। উষ্ণ নিশ্বাসগুলো মেহনূরের মুখের উপর পরছে, ভারী-ভারী নিশ্বাসের ভার সত্ত্বেও চোখে-চোখ রাখলো মেহনূর। নির্লিপ্ত গলায় হালকা সুরে বললো,

– আপনি মিশনে আছেন?

মুখের উপর দৃষ্টিলব্ধ চোখটা স্থির রইলো, শুধু মাথাটা নাড়িয়ে ‘ হ্যাঁ ‘ বোঝালো। উত্তরটা পেয়ে চোখের কপাট বন্ধ হলো মেহনূরের, বুকের শেষভাগ থেকে নিশ্বাস টেনে গভীরভাবে ছাড়লো। পুরো দৃশ্যটা নিঃশব্দে চেয়ে-চেয়ে দেখলো মাহতিম, তার বুকের নিচে চাপা পরা মানুষটা আর স্বস্তিতে নেই। আর মধ্যে সুড়সুড় করে ভয় ঢুকে গেছে, ভয়টা যেনো মুখের উপর না পড়ুক তার জন্য শ্বাসকার্য চালাচ্ছে। মাহতিম আঙ্গুলগুলো আলগা করে হাতজোড়া ছেড়ে দিলো, কাণ্ডকারখানায় চোখ খুলতে বাধ্য হলো মেহনূর। মাহতিমের নিরবতা তাকে ভীষণ ভীত করছে। এই মাহতিম তো নিরব থাকেনা। তার ব্যক্তিত্ব যতই অটল হোক, শক্ত হোক, সে মেহনূরের কাছে কঠোর হয়নি। তার নিরবতা যে তিরতির করে হিংস্রাত্মক দেখাচ্ছে এটা কে বোঝাবে? অনেকক্ষণ নিরব থাকার পর স্বাভাবিক হলো মাহতিম, মেহনূরের ঠোঁটের উপর ডানহাতের তর্জনী রেখে শান্ত গলায় বললো,

– এই মিষ্টি ঠোঁটদুটোর সৌভাগ্য তোমার অজান্তেই পেয়েছি এটা জানো?

মেহনূর শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকতেই মাথাটা ডানে-বামে নাড়িয়ে দিলো। ঠোঁটের উপর থেকে তর্জনী উঠালো মাহতিম, দেহের সবটুকু ভার ছেড়ে দিয়ে ওষ্ঠকার্যে ডুব দিলো। কিছু সময় পার করে মেহনূরের অধরজোড়া মুক্ত করলো, ঠোঁটদুটো টকটকে লালবর্ণ ধারণ করলে সেখানে দৃষ্টি রেখে উদাস গলায় বললো মাহতিম,

– এভাবে আদর করার সুযোগ নাও পেতে পারি। তোমাকে ভালোবাসি মেহনূর। এভাবে-সেভাবে-সবভাবেই ভালোবাসি। আমার দ্বারা কষ্ট পেলে আমার স্মৃতিগুলো নষ্ট করে দিও। জানি অবাক হচ্ছো, প্রচুর প্রশ্ন জেগেছে, কেনো এমন কথা বলছি তাও ভেবে পাচ্ছো না। সবসময় কিছু জিনিস না-বলাই ভালো, সবকিছু সহ্য করলেও মন কখনো সহ্য করতে পারে না। আমাদের মনটা সরল, মস্তিষ্কটা কঠিন। তোমার সবটাই সরল, কোনোটায় কঠিন নেই। আমার মনটা কঠিনই ছিলো, তুমি একটা অংশ ভেঙ্গে দিয়ে সরল করে ফেলেছো।

মেহনূর নির্ভীক ভঙ্গিতে বললো,

– আপনি আমাকে এরকম কথা কেন বলছেন?

মাহতিম হাসতে গিয়েও মলিন হয়ে গেলো। মেহনূরের কপালটায় সবটুকু আদর মাখিয়ে চুমু খেলো, পুনরায় চোখের ভেতর দৃষ্টি ছুঁড়ে সাধারণ গলায় বললো,

– বাস্তব সত্যের চাইতে মিথ্যার কল্পনা বেশি প্রিয়।

কথাটার কোনো মর্মই মেহনূর বুঝলো না। বুঝার কথাও ছিলো না। মাহতিম যে সূদুরপ্রসারী চিন্তাভাবনা রেখে কথাটা বলে দিয়েছে, সেটা সময়ের সাথে-সাথে মেহনূর ঠিকই ধরতে পারবে। তখন হয়তো আফসোসের সীমা তাকে যন্ত্রণায় ফেলে দিবে। মেহনূর গুমোটভরা মূহুর্তটা স্বাভাবিক করতে চাইলো, বালিশ থেকে একটুখানি মাথা তুলে মাহতিমকে পরশে-পরশে ছুঁয়ে দিলো। গ্লানিটুকু নিজের মধ্যে টেনে নেওয়ার ক্ষমতা থাকলে তাই করতো মেহনূর। অন্তত বুঝতে চাইতো কেনো মাহতিম শক্ত কথা বলছে। মাহতিম আক্ষেপের নিশ্বাস ছেড়ে চেষ্টা করলো স্বাভাবিক হওয়ার। দুষ্টু হাসি দিয়ে মেহনূরের মাথাটা চটান করে বালিশ থেকে উঁচুতে উঠালো। মেহনূরের গালদুটোয় ভরে-ভরে চুমু খেলো সে, হঠাৎ নিচু কন্ঠে বলে ফেললো,

– যদি আজকের পর আদর করার সুযোগ না পাই?

ভয়ে শিরদাঁড়া পযর্ন্ত কেঁপে উঠলো মেহনূরের। সমুদ্রের পানিতে হাবুডুবু খাওয়া মাহদির স্মৃতিটা ভেসে উঠতেই প্রচণ্ড ভীতু হলো। পিঠের উপর মাহতিমের ডানহাত চলছে, মখমলের ফিতাটা নির্ঞ্ঝাটে খুলে ফেললো মাহতিম। পুনরায় বালিশে মেহনূরের মাথা রেখে দিলো, মেহনূর ভয়জনিত ব্যাপারটা তুচ্ছ করতে পারলো না। তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করে বললো,

– কেনো পাবেন না? আপনি এমন আজগুবি কথা কেনো বলছেন? আপনি, আপনি আজ —

অকাট্য সত্যটা বলযে দিলো না মাহতিম। মেহনূরের নাকটায় চুমু খেয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,

– যদি এই মিশনে ম-রে যাই, আমিতো কোনোদিন ফিরবো না।

বাকরুদ্ধ হয়ে কয়েক মিনিট তাকিয়ে থাকলো মেহনূর। কিসের মিশন? কিসের শেষ? এই মিশন কেনো ওদের সুন্দর মূহুর্তগুলোয় ঢুকে পরলো? এইযে মাহতিম বহুদিন পর তার কাছে সবটুকু ভালোবাসা নিয়ে হাজির হয়েছে, আদরে-আদরে এক পরিপূর্ণ বন্ধনকে আহবান জানিয়েছে, সেখানে এই’ মিশন ‘ শব্দটাকে ছুড়ির মতো ধারালো শোনালো। এই শব্দটা যেনো কানদুটো ছিঁড়ে-ছিঁড়ে র-ক্তাক্ত করে দিলো। আকস্মিকভাবে চোখের কপাট বন্ধ করে নাক ফুলালো মেহনূর, দুচোখের কোল ঘেঁষে নোনাজল গড়িয়ে যাচ্ছে। কেনো জানি বুকের ভেতর অশনি আভাসের কু ডাকছে।

.

রাত প্রায় চারটের ঘর পেরিয়েছে। সবকিছু নির্জনতায় তলিয়ে আছে। গ্রাম্য কুকুরের ডাক ছাড়া তেমন কোনো সাড়াশব্দ নেই। রুমের ভেতরটা ঘুট্ঘুটে অন্ধকার, চোখের সামনে তিল পরিমাণ আলো নেই। তবুও বিড়াল-চক্ষুর মতো সবই দেখতে পাচ্ছে সুজলা। তার মাঝে-মাঝে মনেহয় তার চোখদুটো সম্ভবত অদ্ভুত জিনিস। এমন কিছু এই চোখদুটো দিয়ে দেখেছে, যা সাধারণ ব্যক্তি দেখেনি। একটা পৈশাচিক মানুষকে নানাভাবে রদবদল করতে দেখেছে। কিভাবে নিষ্পাপ হাসি দিয়ে ভেতরের জান্তব শয়তানটাকে মানুষের আড়ালে রাখে সেটাও আশ্চর্যের বিষয়। এই বাড়িতে বউ হিসেবে আসার পর যেসব শব্দবাণের স্বীকার হয়েছে সেটা শুধু বাড়ির দেয়ালগুলোই জানে। বাইরের বা উঠানের গাছও বুঝি অতোটা জানে না। কিন্তু এবার যেনো উৎসাহের বীজটা অঙ্কুরিত হচ্ছে। খুব শীঘ্রই যে হেস্তনেস্ত অবস্থার চূড়ান্ত সময় ঘনাবে এ নিয়ে দ্বিধা নেই। ঠিক এই দিনটির অপেক্ষায় তিনি যুগের-পর-যুগ এ বাড়িতে কাটিয়েছেন। শুধু ভয়ের জন্য মুখ খুলেননি। স্বামীর কর্তৃত্ব যখন হারিয়ে গেলো, তখন তিনটে সন্তান নিয়ে এ বাড়িতে থাকা যন্ত্রণার ছিলো। তবুও হাড়ভাঙ্গা কষ্টে, নানা লান্ঞ্চনার শিকার হয়ে ছেলেকে তিনি বিদেশ পাঠাতে পেরেছেন, কসম করিয়ে পাঠিয়েছেন যেনো ভুলেও এ বাড়ির সাথে যোগাযোগ না রাখে। এই যোগাযোগ তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। তার বিধবা মা ও ছোটো দুটো বোনের কথা চিন্তা করে আজও শাওন এমুখো হয়নি। ছেলেটা ভালোয়-ভালোয় বিদেশ থাকুক সবসময় এই প্রার্থনাগীতি গাইছেন। শানাজকে নিয়ে বড় চিন্তার একাংশটা আজ একটু আগে সেরে ফেলেছেন। ভয় একটাই, যদি মাহতিমকে কিছু করে ফেলে? ছেলেটা তাদের জীবনে শুধু রহস্য ভাঙতে আসেনি, যুগ-যুগ ধরে চলতে থাকা নিকৃষ্ট নিয়মকেও ভষ্ম করতে এসেছে। তার ভেতরকার চরিত্র সভ্য, বাহিরের আবরণটা আপনজনের কাছে নরম, কিন্তু এই ছেলের মধ্যে যেই আগুনের তেজ বিদ্যমান সেটা চাহনির মাঝে দৃশ্যমান। কেউ হয়তো চিন্তাও করতে পারছেনা মাহতিম আনসারী ছেলেটা কি পরিকল্পনায় এসেছে। মাহমুদা মেয়ের জামাইকে সরল ভাবলেও আজ সুজলার কথায় চরম বিষ্মিত হয়েছে। কথাগুলো শুনে বেচারীর মুখটা হা হয়ে গেছিলো। স্বাভাবিক হতে সময় লেগেছিলো। কিন্তু ভয়টা বোধহয় মেহনূরের জন্য পেয়েছিলো। কেউ আগ বাড়িয়ে ফুটন্ত কড়াইয়ে ঝাঁপাতে যাবে না। সেখানে নিজ গর্ভের সন্তান বিপদের মুখের দাঁড়িয়ে আছে। সামান্য একটা ধাক্কা দিলেই বিধবার খাদে পরে যাবে। সেই খাদ থেকে উঠানোর কেউ নেই, সাহস দেওয়ারও কেউ নেই। গুণে-গুণে আর বোধহয় একটা দিনই আছে। ভোরের আলো ফুটলেই রাত পযর্ন্ত শেষ সময়, এরপরই বোধহয় কাজে নামবে সে। কথার ধরনে সবটা বেফাঁস করেনি মাহতিম, খুবই চালাকির সাথে এটা বুঝিয়ে দিয়েছে সবাইকে বাড়ি থেকে অনত্র যেতে হবে। বৃষ্টির অজুহাতে সাপের উপদ্রব হবে এটা নেহাতই মিথ্যা ছিলো। মাহতিম নিজেই চাইছে এ বাড়ির মানুষগুলো নিরাপদে থাকুক। হয়তো এতোক্ষনে পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলেছে। অ-স্ত্রেশ-স্ত্রে সজ্জিত দলবলটা ছদ্মবেশে ঢুকেছে, নাকি নিজেদের বেশে ঢুকেছে এ নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। আর যাই করুক খেটে খাওয়া মানুষগুলো নিরাপদে থাকুক। তারা তো জানে না এখানে কেউ সাধু সেজে লোকনজরে মহান হয়ে আছে। ঘড়িতে এখন কয়টা বাজে? চারটা? নাকি সাড়ে চারটা? সময়টা কেনো জানি কাটতে চাইছে না।

.

হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমেছে। ভোরের আলো ফুটতে এখনো ঢের বাকি। জানালাটা বন্ধ করতে গিয়েও বন্ধ করলো না মেহনূর। বৃষ্টির সাথে যেই হাওয়াটা আসছে, সেটা খুবই প্রাণোচ্ছল। কম্বলটা টেনে এবার কান পযর্ন্ত ঢেকে দিলো। মানুষটা কি সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে। এমন ঘুমকাতুরে মুখটা দেখতে ক্লান্তি লাগে না, শান্তি লাগে। জানালা দিয়ে যেটুকু হাওয়া আসছে সেটা তার কপালে চুলগুলো থেমে-থেমে উড়িয়ে দিচ্ছে। কপালে হাত রেখে অবাধ্য চুলগুলোকে পেছনে ঠেলে দিলো, কিন্তু নাফরমানী করে বসলো। আবারও কপালের ধারে এসে লুকোচুরি খেললো। মেহনূরের ডানহাতটি এখনো তার মুঠোর ভেতর, অন্য হাতটা মেহনূরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। বুকের উপর মাথা রেখে ওম করা কাথায় গভীর ঘুম দিয়েছে। মাহতিম ওমন ভয়ংকর কথাগুলো কেন বললো? কেনো বললো কষ্ট পেলে স্মৃতি নষ্ট করতে? মানুষ কি হাজার কষ্ট পেলেও স্মৃতি নষ্ট করে? এমন বোকামি করার সাহস কারোর বুকে আছে? হঠাৎ এমন চিন্তার ভেতর ছেদ করে চাপা রিংটোন বাজছে। শব্দটা কোথা থেকে হচ্ছে সেটার খোঁজ করতেই বালিশের নিচে হাত ঢুকালো মেহনূর, বেশ বেগ খাটিয়ে ফোনটা টেনে আনলো। দেখেই বুঝতে পারলো এটা সদ্য কেনা নতুন ফোন, কিন্তু স্ক্রিনে ভেসে উঠা কলটা ঠিক আননোন। আননোন নাম্বার দেখে রিসিভ করলো না মেহনূর, তার উপর এটা মাহতিমের ফোন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই কলটা কেটে ম্যাসেজ আসলো। মেহনূর যেই ফোনটা রেখে দিতে নিচ্ছিলো, তখনই ম্যাসেজ দেখে থেমে গেলো। যদিও অনুমতি ছাড়া ম্যাসেজ চেক করা ঠিক না, কিন্তু মাহতিমের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে মন চাইলো না। মেহনূর নিজ থেকেই ম্যাসেজটা ওপেন করে সেটা পড়তে শুরু করলো। ঠোঁটে নাড়িয়ে পড়তে-পড়তেই বিস্ফোরিত চাহনিতে থেমে গেলো সে, ঠোঁটদুটো অস্বাভাবিক হয়ে থামতেই হা হয়ে গেলো!

– আনসারী স্যার, ইউর বডিগার্ড সালেহ্ ইজ ডেড।

চলমান .

#ফাবিয়াহ্_মমো .

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৫৯.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

শাড়িটা পেঁচিয়ে আকাশে তাকালো মেহনূর। টুপটুপ করে চুল নিঃসৃত পানি ফ্লোরে পরছে। তার উদাস দৃষ্টিদুটো মলিন আকাশে নিবদ্ধ। বাইরের আবহাওয়া আজ গুমোটপূর্ণ। চারধার কেমন ভুতুড়ে ভঙ্গিতে নিঃশব্দ হয়ে আছে, যেনো ভয়ংকর কিছু ধেয়ে আসার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি চালাচ্ছে। পুরো নীল আকাশটা কালো রঙে আক্রান্ত, যেনো বিশাল-বিশাল কালো মেঘেরা দিনের আলোটা গোগ্রাসে গিলে ফেলেছে। কোথাও কোনো আলো নেই, সন্ধ্যে নামা মূহুর্তের মতো সময় থমকে আছে। একটু আগে গোসল করে রুমে ফিরেছে মেহনূর। সকাল সাতটা বাজলেও সেটা বৈরি আবহাওয়ার জন্য বোঝা যাচ্ছে না। মাহতিম রুমে নেই, সে পরিপাটি হয়ে নাস্তার আসরে চলে গেছে। সালেহের মৃত্যুর সংবাদ শুনেও ভড়কায়নি লোকটা। এতো শক্ত মানুষ দেখেনি মেহনূর। মানুষ এতো কঠিন হয়? কিভাবে হয়? নিজের ছোট ভাই যেদিন মারা গেলো, সেদিনও তাকে ভড়কাতে দেখেনি। চুপচাপ দাফনকার্য শেষ করে ফিল্ডে ফিরে গেছে, যেনো মামুলি ঘটনায় উত্তেজিত হতে নেই। পিঠের ব্যান্ডেজটা খুলে দিলেও ক্ষতের মুখটা এখনো লাল হয়ে আছে, পুরো জায়গাটা উঁচুস্তম্ভের মতো ফুলে শেষ। যন্ত্রণাদায়ক ব্যথাটা হয়তো এখনো সহ্য করছে, কিন্তু চেহারা দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না। হাসি দিয়ে কথা বলাটা তার অদ্ভুত গুণ, পুরো অদম্য ব্যক্তিত্বটা হাসির মধ্যেই লুকায়িত। মাহতিম কিসের মিশনে এসেছে এ ব্যাপারে কিচ্ছু জানায়নি। গতরাতটা ছিলো সুন্দর, মাহতিমের ছোঁয়ায়-মায়ায় সময়ের গণ্ডি কিভাবে পেরিয়ে গেছে জানা নেই। মেহনূর শুধু এটুকু জানে, মানুষটা তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। হয়তো সেটা পাগলের মতোই। নয়তো ঘুমের ঘোরেও বিড়বিড় করে ‘ ভালোবাসি ‘ শব্দটা উচ্চারণ করতো না। দরজায় ঠকঠক শব্দ হলে ধ্যান ভাঙে মেহনূরের, আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পিছু তাকায় সে। দরজার কাছে নীল শাড়িতে দাঁড়িয়ে আছে সুরাইয়া, চোখ শক্ত, মুখ গম্ভীর। মেহনূর সৌজন্যতা দেখিয়ে রুমে আসতে বললে সুরাইয়া দেমাকী ভঙ্গিতে ঢুকলো। অহংকারে পা মাটিতে পরে না এমন কান্ড। মেহনূরের সামনে এসে শক্ত চোখে বললো,

– এখান থেকে ফুটবি কবে? বেহায়ার মতো এতোদিন ধরে বাপের বাড়িতে পরে আছিস লজ্জা করে না? আমারই তো তোর ঘটনা দেখে লজ্জা করছে। বর নিয়ে এখানেই সংসার পাতবি? যাবি না?

আশ্চর্য হয়ে গেলো মেহনূর। ভ্রুঁ কুঁচকে শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো,

– আমার থাকাথাকি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে কেনো? আমি তো কোনো ঝামেলা সৃষ্টি করছিনা।

সুরাইয়া দাঁত কটমট করে চোখ পাকিয়ে তাকালো। ফর্সা গালে ঠাস করে চড় লাগাতে ইচ্ছে করছে। শহরের হাওয়া-বাতাস খেয়ে একেবারে বখে গেছে। কুঁচকানো ঠোঁটটা স্বাভাবিক করে গজগজ রাগে বললো,

– তোর জামাই নিয়ে বিদেয় হ! তোর চেহারা দেখলেই থুথু মারতে ইচ্ছে করে। যেভাবে নাটক করে বিয়েটা করলি, সারা গ্রামে এখনো মুখ দেখাতে পারিনা।

মেহনূর পালটা জবাব দিতে গিয়ে হঠাৎ কিছু একটা দেখে থেমে গেলো। চোখদুটো ফ্লোরে রাখতেই সুরাইয়া একটু অবাক হলো। হঠাৎ এই বেহায়াটা চোখ নামালো কেন? কৌতুহলের বশে মাথা পিছু ঘুরালো সুরাইয়া, তৎক্ষণাৎ চরম ভয়ে কেঁপে উঠলো সে। একজোড়া তীক্ষ্মদৃষ্টি তার দিকে তাকিয়ে আছে, যেনো এখুনি চোখ দিয়ে হামলা করার আকাঙ্ক্ষা! সুরাইয়া থতমত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে রুমে নিরব পায়ে ঢুকলো মাহতিম, গায়ে হান্নান শেখের ঘিয়ে রঙের পান্ঞ্জাবী পরা। পাণ্ঞ্জাবীটা ফিটিং বলে হাতের পেশিগুলো ফুলেফেঁপে আছে, বুকের উপর আঁটসাঁট ভাব। হাতের স্লিভগুলো সযতনে কনুইয়ের ভাঁজে গুটানো। মাহতিমকে দেখে কটু কথার জন্য ভীত হলো সুরাইয়া। সেদিকে বিন্দুমাত্র দৃষ্টি না দিয়ে মেহনূরের জবুথবু মুখের দিকে তাকালো মাহতিম। হাতদুটো বুকের কাঁছে ভাঁজ করতে-করতে আদেশের সুরে বললো,

– ওকে কষে দুটো চড় লাগাও।

প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি তুলে মাহতিমের দিকে তাকালো মেহনূর, এদিকে সুরাইয়া পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। মেহনূরকে আবারও শঠতা গলায় আদেশ করলো মাহতিম,

– ওকে চড় লাগাতে বলেছি!

কন্ঠের তেজে দু’বোনই গা কাঁপিয়ে শিউরে উঠলো। মেহনূর প্রচণ্ড ভীতগ্রস্ত হলেও সুরাইয়ার দশা একদম কাঁদো-কাঁদো। মেহনূর ঢোক গিলে ডানহাত তুলতেই ঝট করে আবার নামিয়ে ফেললো। যতই হোক, মাসখানিকের জন্য হলেও সুরাইয়া ওর বড়। বড়দের গায়ে হাত তোলার নিয়ম নেই, আবার স্বামীর কথাও অমান্য করার অবস্থা নেই। করুণচোখে মাহতিমের দিকে তাকালো সে, মাহতিম কোনো সহানুভূতি দেখালো না। উলটো বাঁ ভ্রু-টা উঁচু করে কঠোর ভঙ্গিতে বললো,

– তুমি কি আমার অবাধ্য হতে চাইছো?

সাথে-সাথে পাগলের মতো ডানে-বামে মাথা নাড়ালো মেহনূর। একবার সুরাইয়ার ছলছল মুখের দিকে তাকালো, আরেকবার চোখ ঘুরিয়ে মাহতিমের শক্ত মুখটা দেখলো। নিরুপায় হয়ে মাহতিমের কাছে গেলো সে, মাহতিমের কনুইটা ছুঁয়ে চোখের দিকে তাকালো। ইশারায় যেনো বুঝিয়ে দিচ্ছে ‘ এবারের জন্য ছেড়ে দিন, আমি চড় মারতে পারবো না, আমাকে মাফ করুন ‘। রাগে-ক্ষোভে-জেদে এক ঝটকা দিয়ে মেহনূরের হাতটা সরিয়ে দিলো মাহতিম। রাগে ফুসফুস করে নিশ্বাস নিতেই সুরাইয়ার দিকে একপলক তাকালো সে, জোরালো কন্ঠে বললো,

– এক্ষুনি এখান থেকে বেরিয়ে যাও!

সিংহের থাবা থেকে মুক্ত ইঁদুর যেভাবে চালায়, সেভাবেই পা ছুটিয়ে পালালো সুরাইয়া। ধপ-ধপ পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেও কান্নার অস্ফুট আওয়াজটা মেহনূর শুনতে পেলো। সুরাইয়া ভালোই ভয় পেয়েছে, ভাগ্যিস চড়টা মাহতিম লাগায়নি। থাবার মতো হাতে থাবড়া খেলে জান বেরিয়ে যেতো। মাহতিম হাতদুটো আলগা করে সশব্দে রাগী নিশ্বাস ছাড়লো, মেহনূরকে অগ্রাহ্য করে বিছানা থেকে ফোন উঠালো। কাউকে কল করতেই বিছানায় বসলো মাহতিম। জরুরী কলটা রিসিভ হতেই কথা শুরু করলো। মেহনূর অভাগার মতো তাকিয়ে থেকে শেষমেশ কাছে আসতে নিলো। হাত উঠিয়ে বাধা দিলো মাহতিম, দাম্ভিকতার সাথে এক তুড়ি বাজিয়ে দরজা দিকে তর্জনী তাক করলো। অসহায়ের মতো তর্জনী ধরে-ধরে খোলা দরজায় দৃষ্টি দিলো মেহনূর, নিজের অপারগের জন্য মাহতিম তাকেও বেরিয়ে যেতে বলছে। তর্জনীটার কাছে নত স্বীকার করে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো মেহনূর, দরজার বাইইরে দু’পা ফেলতেই পেছন থেকে ধড়াস করে দরজা বন্ধ হলো। আর পিছু ফিরে তাকালো না মেহনূর, দোষটা নিজের ভেবে একপা-একপা করে চলে যেতে লাগলো। রাগের চোটে দরজাও বন্ধ করলেন? মনে-মনে প্রশ্নটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই মনক্ষুণ্ণ হলো মেহনূর। ভাবনাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলো।

.

খুবই সংযত কন্ঠে বলে উঠলো,

– স্যার, সালেহের ডেডবডি কি করবো? পাঠাবো, না রাখবো? ওর ফ্যামিলি এখনো জানে না। ব্যাপারটা কি করবো?

মাহতিম কিছু একটা ভেবে সেকেন্ডের ভেতর উত্তর দিলো,

– হেড অফিস থেকে আপডেট না পেলে আমি কিছুই করতে পারবো না। টিম কি রেডি?

চটপট উত্তর দিলো,

– জ্বী, স্যার রেডি। আপনি যেভাবে প্ল্যান বুঝিয়েছেন, সেখানে অল রেডি। স্যার, আপনি যদি একবার মেডিকেল চেকআপ করিয়ে নিতেন তাহলে ভালো হতো। আপনার ইন্ঞ্জুরিটা কোন স্টেজে আছে জানা যেতো।

মাহতিম সাথে-সাথে উত্তর দিলো,

– নাথিং সিরিয়াস। আমি ঠিক আছি। কোনো টেনশন নেই। আপাতত মেডিকেল চেকআপ লাগবে না। টিম রেডি করো। যেই-যেই সেক্টর আর পয়েন্টে মার্কিং করে দিয়েছি, সেখানে মানুষ পাঠাও।

জুনিয়র কর্মকর্তা সোহেল হতাশার নিশ্বাস ফেললো। লিডার ইন্ঞ্জুর্ড হয়ে আছে, অথচ মেডিকেল ট্রিটমেন্ট নিচ্ছে না। ক্ষুরের আঘাতে যদি এক ইন্ঞ্চিও ডেবে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষ ট্রিটমেন্ট ছাড়াই চিৎকার করে হাহাকার করতো। পুরো ডিপার্টমেন্ট তাকে বাঘের মতো ভয় পায়। ‘ ভালোর সাথে ভালো, খারাপের সাথে জঘন্য ‘ এই নীতিতে চলে বেড়ায়। মাহতিম কলটা রেখে দিলো, যা-যা বুঝানো দরকার সবই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাতে সময় কম! তাদের হাতে ইনফরমেশন এসেছে, আজ বা কাল বিরাট একটা অংশ পাচার করা হবে। সেখানে নারী-শিশু-যুবক তিনটা দলই বিদ্যমান। নারীদের বাইরে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, শিশুদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ হরণের চিন্তা সাজিয়ে রেখেছে, যুবকদের ভয় দেখিয়ে নানা নৃশংস কর্ম সাধনের চিন্তা করেছে। ড্রাগসের একটা বিশাল অংশও এতে যুক্ত আছে। পুরো ঘটনায় জড়িতদের এখনো ধরা যায়নি, কিন্তু একটি নেটওয়ার্কের সূত্র পেয়েছে মাহতিম। এখন সেটাই গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য মোল্লাবাড়িতে এসেছে সে। তার ধারণা হান্নান শেখ ওরফে কালার সরদার তার ব্যাপারে সবটাই জেনে গেছে, গতকাল হয়তো ধরে ফেলেছে মাহতিম মরেনি। তার মন বলছে হান্নান শেখ বিভৎস কিছুর পরিকল্পনার জন্য রাতে বাড়ি ফিরেনি। রুমের ভেতর পায়চারী করতে-করতে অনেক কিছুই চিন্তা করলো। প্রথমে এ বাড়ির সবাইকে অন্যত্র পাঠাতে হবে। এটার জন্য যোগ্য জায়গা ওই গ্রাম্য রেসোর্ট! এটাই সবচেয়ে বেটার অপশন। ইয়েস! ওখানে নিরাপত্তার ব্যাপারটা জোরদার রাখতে হবে, যেনো ভুল করেও ফাঁকফোঁকর ডিঙিয়ে জাল না ঢুকে। তারপর এই বাড়িটা খালি হয়ে গেলে একটা সশস্ত টিমকে রেডি থাকতে বলবে, যখনই হান্নান শেখ বাড়ির চৌকাঠায় পা ফেলবে তখনই এ্যাকশন! পায়চারী বন্ধ করে পা থামালো মাহতিম, চোখ বন্ধ করে গভীর নিশ্বাস নিলো। আজকের এই অপারেশন খুবই স্মার্টলি হ্যান্ডেল করতে হবে, একটুও অসতর্কতা এখানে কাম্য না। শরীরটা ফিট না হলেও মাইন্ড পুরোপুরি এক্টিভ আছে। দীর্ঘদিনের ফেরারি জীব এবার মুঠোর মধ্যে এসে যাবে। ভাবতে গেলেই গা-টা উত্তেজনায় ফেটে পরছে।

অচেনা মেয়ের শাড়ি পরার দৃশ্য দেখে লজ্জিত ছিলো মাহতিম। লজ্জায় নাস্তানাবুদ হয়ে নিজেই নিজেকে গালিগালাজ করলো। নিজের ভুলটা বড্ড বেশি ছিলো বলে রাতটা স্বস্তিতে কাটেনি। পরদিন সকালে শুনতে পেলো মেয়েটার অবস্থা করুণ! রাতে নাকি একশো চার ডিগ্রী পযর্ন্ত জ্বর উঠে গেছে। নিজেকে ধিক্কার দিতে-দিতে রুম থেকে বেরিয়েছিলো মাহতিম। অনুশোচনায় বিদ্ধ হয়ে কখন যে লাইব্রেরি কক্ষে পৌঁছে গেলো বুঝতে পারেনি। দরজাটা ফাঁক দেখে ঢুকেছিলো সে। সেখানে পুরোনো আলমারি পাশাপাশি বইয়ের ভাণ্ডার দেখে আশ্চর্য হয়েছিলো। একটা শেল্ফের কাছে গিয়ে বই নাড়াচাড়া করতেই হঠাৎ অদ্ভুত একটা জিনিস পেলো। উঁচু শেল্ফটার সবচেয়ে উপরের তাকটায় কিছু একটা রাখা। বস্তুটা দেখার পর চিনতে সময় লাগলো না, সাথে-সাথে এক থাবায় ওটা হাতের মুঠোয় নিলো। ভ্রুঁ কুঁচকে জিনিসটা দেখতেই বুকের ভেতর ধুকপুক অনুভব করলো। এটা মামুলি বস্তু না, এটা বিদেশ থেকে আমদানি করা খাস রেফারেন্সের রিভলবার। এসব জিনিস একমাত্র তাদের সাথেই থাকে, যারা দুষ্কৃতির সাথে জড়িত। রিভলবারটা চেক দিয়ে আগের জায়গায় রাখলো। মনের প্রথম খটকাটা না মিটতেই দ্বিতীয় খটকাটা দেখতে পেলো। এবার আর শান্ত রইলো না মাহতিম, রহস্যের ধোয়াটা হাতড়ে-হাতড়ে কাটিয়ে ফেললো। সারি-সারি বইয়ের ফাঁকে একটা পুরোনো টেবিল ক্যালেন্ডার রাখা, একটা তারিখের উপর গোল মার্ক করা। ছোট-ছোট চোখে কপালে ভাঁজ ফেলে সংখ্যাটার দিকে তাকালো মাহতিম। কয়েক মিনিট চুপচাপ একদম স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো, এরপরই আচমকা কপালের ভাঁজগুলো স্বাভাবিক হলো তার। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটতেই ক্যালেন্ডারটা হাতে নিলো, বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে সংখ্যাটার উপর ছুঁয়ে দিতেই পলাতক আসামীর কথা এ-টু-জেড মনে পরলো। জীবনের গরল মোড়টা এভাবে বাক ভাবতে পারেনি। যাকে তন্নতন্ন করে গোটা শহর খুঁজেছে, সেই আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি গ্রামের একজন গণ্যমান্য মানুষ। কতটা হাস্যকর ব্যাপার! একদিকে মানুষ পাচার, অস্ত্রের চোরাচালান, ড্রাগসের সওদাগিরি সবই করে, অন্যদিকে লুকিয়ে-লুকিয়ে গ্রামে এসে অন্যরূপে সেজে আছে। মানুষ যে দুনিয়ার সবচেয়ে চতুর জীব, এটাই সাক্ষাৎ প্রমাণ। ক্যালেন্ডারটা রেখে শার্লক হোমসের বইটায় পেলো আরেকটা ক্লু। সেখানে হার্ডকভারের শেষ পৃষ্ঠায় নীল কালিতে কিছু লিখে রেখেছে। ইংরেজি বর্ণমালায় শর্টকাটে লিখা, ‘ K S ZILL ‘ . সব রহস্য পানির মতো ঝরে পরলো, ‘ কালাম সরদার ঝিলতলা ‘ এটাই বুঝা যাচ্ছিলো। ওইদিন লাইব্রেরি কক্ষে বিশ্বজয়ীর হাসিটা দিতেই কানে মেয়েলি সুর বাজলো,

– দাদাভাই, আমি লজ্জার মাথা খেয়ে আজ বাধ্য হয়ে কিছু বলতে এসেছি। আমি কখনো চাইনি তোমার কোনো অপমান হোক। কিন্তু তোমার যেই বন্ধুর মেয়ে এখানে এসেছে, তার বড় ছেলেটা খুবই জঘন্য কাজ করেছে। আমি এসব একদমই সহ্য করতে পারিনা দাদাভাই। ওই লোকটার নাম সম্ভবত মাহতিম! লোকটা যা কাজ করেছে আমি এগুলো নিতে পারিনা! তুমিতো জানো, আমি তোমার কাছে কিছুই লুকাইনি, আজও লুকাবো না। সেদিন সবাই লিয়াকত কাকার বাড়িতে যখন গেলো, তখন ওই লোক ইচ্ছে করে আমার রুমে এসেছিলো। আমি গোসল করে শাড়ি পরছিলাম আর ওই লোক তখন,

হঠাৎ দরজায় ‘ টুকটুক ‘ করে আওয়াজ হলো। সমস্ত ধ্যান ভেঙ্গে বাস্তবে ফিরলো মাহতিম। দরজার দিকে চোখ যেতেই আবার শব্দটা শুনলো। ফোনটা বিছানায় রেখে দরজাটা খুলে দিলো। দরজার দুই পাল্লা ধরে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে দেখলো সে, কিছুটা ঝাঁঝ মাখানো কন্ঠে বললো,

– অপমান করে শান্তি পাওনি? কি চাও?

কথা শুনে মেহনূর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। চোখ তুলে মাহতিমের দিকে তাকাতেই আস্তে করে বললো,

– সময়। আপাতত সময়ই চাচ্ছি। দিবেন?

দুই মিনিট ভাবলো মাহতিম, এরপর নিজেই দরজা ছেড়ে মেহনূরকে ঢুকতে দিলো। মেহনূর ঘরে ঢুকলে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে বসলো। মেহনূর দরজাটা আঁটকে দিয়ে মাহতিমের কাছে আসলো। ওর পরিস্থিতিটা বুঝার আগেই প্রশ্ন করলো মাহতিম,

– বলো, কি বলতে চাও বলো।

প্রশ্ন শুনে নিরব মুখে কাছে আসলো মেহনূর। কোনোদিকে না তাকিয়ে মাহতিমকে চরম আশ্চর্য করে তার কোলে বসলো সে। মাহতিমের অবাক হওয়া দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে তার বুকটার আস্তানায় চলে এলো, পরম উষ্ণতায় নিজেকে জড়িয়ে নিলো সে। নিঃসঙ্কোচে দুহাত বাড়িয়ে মাহতিমের গলা পেঁচিয়ে ধরলো। চওড়া কাধটায় গাল লাগিয়ে চোখ বন্ধ করলো মেহনূর, নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

– রাগটা ঝেড়ে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন। কালরাতের মাহতিমটার মতো একটু আদর করে দিন। আবার কতোদিন পর আসবেন তাতো জানি না। রেগেমেগে এভাবে দরজা আঁটকে থাকলে চলবে? যতটুকু সময় আছে, সেখান থেকে একটু আমাকে দিয়ে যান।

নির্বাক মাহতিম কয়েক মূহুর্তের জন্য পিছলে গেলো। তার ভেতরে অনুভূতির জায়গায় প্রচণ্ড অনুকম্পা হচ্ছে। আসলেই তো সময় নেই। একটা ঘন্টার ভেতর সবাইকে রেসোর্টে পৌঁছানোর কাজ করতে হবে। মোল্লাবাড়িতে নজরদারির পাশাপাশি গোপন আস্তানাগুলোর উচ্ছেদ করতে হবে। তিন-তিনটা নৃশংস অভিযান পণ্ড করতে হবে। যদি বুলেটের একটা গুলি ব্রেনে বা হার্টে ঢুকে? তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর দৃশ্যটা কল্পনা করতেই জড়িয়ে ধরলো মাহতিম। শক্ত করে দুহাতের বন্ধন কঠোর করে মেহনূরকে বুকে চাপলো। চোখ বন্ধ করে আরো কঠোর করলে তুলোর মতো দেহটা বুকের মধ্যে যেন ঢুকে যেতে লাগলো। আদুরে মুখটা নাগাল না পেলেও ডানে মুখ বাড়িয়ে চুলে ঠোঁট রাখলো। সদ্য স্নান শেষে লাবণ্যময়ী দেহটাকে আষ্টেপৃষ্টে নিজের সাথে মিলিয়ে-জড়িয়ে শান্ত হলো মাহতিম। বাঁ-হাতটা মেহনূরের মাথায় রেখে চুলের চামড়া স্পর্শ করলো, আঙ্গুলে-আঙ্গুলে নম্রভাবে বুলিয়ে দিতেই শান্ত গলায় বললো,

– একা-একা সামলাতে পারবে তো?

মেহনূর নাছোড়বান্দার ভঙ্গিতে বললো,

– পারবো না। পারতেও চাই না। আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন।

হাসলো মাহতিম। প্রশ্ন করলো,

– কেনো? মেয়েরা তো বাবার বাড়িকে সবকিছু মানে। তাহলে আজ এই আবদার কেনো? তোমার তো খুশী হওয়া উচিত।

মেহনূর একটু চুপ থাকার পর মাথা তুলে তাকালো। মাহতিমের দিকে ফ্যালফ্যাল তাকাতেই মলিন হাসিতে বললো,

– আমার তো পোড়া কপাল, বাবার বাড়িতে বাবাই নেই।

ডান চোখ গলে টপ করে একফোঁটা পানি ঝরলো। ঠোঁটে এখনো মলিন হাসিটা ঝুলছে। দৃষ্টি নিচু করে রাখলে ওর ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো মাহতিম। মেহনূরের চিবুকে হাত রেখে প্রসন্ন দৃষ্টিতে বললো,

– আমি যতোদিন আছি, তোমার কোনোকিছুতে কমতি রাখবো না। আমি ম-রলেও তোমার ভয় নেই। মাহদির নামে যেই প্লটটা ছিলো ওটা তোমার নামে করে দিয়েছি। ফাইনেন্সিয়াল সমস্যাও ফিউচারে ফেস করতে হবেনা। তোমার নামে ডিপোজিট করা আছে, মাসে-মাসে টাকা যাবে। কখনো কোনো বিষয় নিয়ে ভয় পেলে সৌভিক আছে, নীতি আছে, মা আছে। ওদের যে কাউকে সমস্যার কথা বললেই হেল্প পাবে। কোনো ভয় নেই। শুধু একা থাকাটা শিখে নাও। আমি জানি তুমি পারবে। বলো পারবে না?

মেহনূরের ইচ্ছা করছে চিৎকার করে বলতে, ‘ আমি পারবো না ‘। কিন্তু মাহতিম কি এটা শুনতে পাবে? তার কি এটা পছন্দ হবে?

.

বাড়ির বাইরে মাইক্রোবাস দেখে অবাক হলেন সুজলা। সব মাল-পত্তর এক-এক করে তুলে দিচ্ছে মাহতিম। গাড়িটা কিভাবে জোগাড় হলো এই প্রশ্ন করতে গিয়েও ধন্দে পরলেন তিনি। শেফালি, সাবা, সুরাইয়া আপাতত কিছুই জানে না। তারা উৎসবমুখর ভঙ্গিতে মাইক্রোতে চড়ে বসেছে। মাহমুদার মুখ আজ গম্ভীর, শানাজ প্রচণ্ড অস্থির, মেহনূরের অবস্থা স্বাভাবিকই ঠেকছে। তাহলে মেহনূর কি এ বিষয়ে কিছুই জানে না? রেসোর্টে বেড়াতে যাওয়া যে বিরাট পরিকল্পনার অংশ, এটা কি জানে না? মাহতিম এখন পান্ঞ্জাবী পালটে শার্ট গায়ে দিয়েছে। খুবই ব্যস্ত ভঙ্গিতে সব গুছিয়ে ড্রাইভারকে দেখিয়ে দিচ্ছে। ড্রাইভার লোকটাকে দেখলে মাসুম, ভোলাভালা লাগে। কিন্তু সুজলা জানে এটা ওদের ছদ্মবেশ। ড্রাইভারটা মাহতিমেরই লোক। সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করলে সুজলা নিজেও গাড়িতে চড়লো। উনার ডানে শানাজ, বায়ে মেহনূর বসবে। কিন্তু মেহনূর এখনো মাহতিমের সাথে হাত লাগাচ্ছে। কাজ শেষে মাহতিম মাহমুদার দিকে তাকালো, গম্ভীর মুখটা দেখে কিছু বুঝতে পেরে ফিচেল হাসি দিলো,

– মা, ওখানে খুব সুন্দর পুকুর আছে। আরেকটু এগোলেই একটা নদীতীর দেখতে পাবেন। জায়গাটা চমৎকার। আপনার কোনো সমস্যা হবেনা।

মাহমুদার চেহারায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তিনি এসব কথায় অভ্যস্ত নন। কিন্তু ভেতরের ছটফটানি ভাবটা কাটাতে না পেরে মাহতিমের উদ্দেশ্যে বললেন,

– মাহতিম, বাবা একা থাকার দরকার নেই। তুমিও সঙ্গে চলো।

কথাটার গূঢ়ার্থ বুঝতে পারলো মাহতিম। মেহনূরও এখন সেই কথার প্রেক্ষিতে অটলভাবে তাকিয়ে আছে। জানালায় থাকা মায়ের হাতটা খুব সন্তপর্ণে ধরলো মাহতিম, স্নেহের চাহনিতে বললো,

– আমি আসবো মা, আমার জন্য একটু দুয়া রাখবেন। কাজটা শেষ করেই ফিরবো।

হাতটা দুহাতের ভেতর নিয়ে মৃদ্যু ঝাঁকুনি দিলো। সাংসারিক হাতটা ছেড়ে দিতেই মেহনূরকে উঠার জন্য ইশারা করলো। মেহনূর গাড়িতে উঠতেই স্লাইডিং ডোরটা টেনে দিলো মাহতিম, সাথে-সাথে ড্রাইভিং সিটের জানালা দিয়ে ড্রাইভারকে কিছু বুঝিয়ে দিলো। মেহনূর যে কথা বলার জন্য বাহানা করতে চাইছে সেটা চোখের তারায় ফুটে উঠেছিলো। মাহতিম পুরোপুরি সেটা ইগনোর করে গাড়ি স্টার্ট দিতে বললো, ড্রাইভার মাইনুদ্দীন গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে একটান দিতেই বাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাইরে চলে গেলো। ধূলো উড়তে লাগলো উঠানে, গাড়িটা চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হতেই পা ঘুরালো মাহতিম। বুকের ভেতর এখন পাথর চাপা নেই, ঠিকঠাক মতো পৌঁছালেই স্বস্তি। একপা-একপা করে বাড়ির দিকে এগোচ্ছে সে, মাথায় বিশাল ভাবনা নিয়ে চিন্তায় ডুবে আছে। সিড়িতে পা ফেলে মোল্লাবাড়ির দিকে এগোতেই ভেতরের অন্ধকার দৃশ্যটা দেখতে পেলো। ধীরে-ধীরে মানবশূন্য মোল্লাবাড়িটা অন্ধকারে তলিয়ে যেতে লাগলো। সূর্যটা আজ চালাকি করে আলো বিকোয়নি। বিকেল টাইম হলেও চারপাশে অন্ধকার নেমেছে। বাড়িতে ঢুকে আঙিনার চারপেয়ে চৌকিতে বসলো সে, অলসতার জন্য বাড়িতে লাইট জ্বালালো না মাহতিম। অন্ধকারে ডুবে থাকা বাড়িটায় চোখ বুলাতেই হঠাৎ দৃষ্টি থমকে গেলো! কেউ লাইব্রেরির কাছে দাঁড়িয়ে আছে! একটা কালো ছায়া স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! কোনো নড়াচড়া করছেনা ছায়াটা! মূহুর্ত্তেই লাফ দিয়ে উঠলো মাহতিম! বুঝতে পারলো সে মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে। সর্বনাশ!

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .