তুমি আমার পর্ব-১৫

0
575

#তুমি_আমার
#পর্ব_১৫
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত

ভর সন্ধ্যায় উবু হয়ে শুয়ে পা নাচিয়ে ফেইসবুকিং করছে সিরাত।এখন এটাই তাঁর নিত্য দিনের সাথী।অবসর সময়ে একটি গার্লস গ্রুপে চ্যাটিং করে।ফেইসবুকে অহরহ মানুষের সান্নিধ্যে এসে সকলের দুঃখ কষ্টগুলো শুনে নিজের কষ্টকে তুচ্ছ মনে হয় তাঁর।সবার জীবন আর ওর জীবনে অনেক ফারাক।সার্চ লিস্টে সবার উপরে আবরার আবেশ নামটা জ্বলজ্বল করে।কারণ দিনে অনেকবার এই আইডিতে ঢুকে সে।কি পোস্ট হলো কয়টা মেয়ে লাইক দিলো কয়টা মেয়ে কমেন্ট করলো সবকিছুর হিসেব আছে তাঁর কাছে।কমেন্ট বক্সে কিছু কিছু মেয়েদের ন্যাকামি দেখে রেগেও যায়।আবার নিজেই নিজেকে ঠান্ডা করে।ফোন টিপাটিপি করছে হঠাৎ হুড়মুড় করে ওর মা রুমে এসে ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে নিলেন হাতে।ঘটনায় আকস্মিকতায় হতবাক সে।অবাক চোখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মায়ের দিকে।ওর মা আলমারি থেকে সুন্দর একটি থ্রি পিস হাতে ধরিয়ে তাড়াতাড়ি চুল ঠিক করে বাহিরে আসতে বললেন।সিরাত হতভম্ব কেন কথাটি জিজ্ঞেস করে কোনো জবাব পেলো না।হতাশ হয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে জামাটা পরে চুলগুলে বেনি করে বেড়িয়ে এলো।ড্রয়িংরুমে এসেই শক খেলো খান বাড়ির সবাই বসে আছে।তিন্নি ভাবী, আরু,আবিদ ভাইয়া,আঙ্কেল আন্টি শুধু মিঃ আবেশ নিঁখোজ।তাছাড়া রিয়া আর আয়েশাও আছে।ওকে দেখে মিঃ খান ডেকে তার পাশে বসালেন।মাথায় হাত বুলিয়ে নানা বুঝবাক্য শুনালেন তিনি।সেও ভদ্র রমনীর ন্যায় মাথা নেড়ে গেলো একাধারে।এক পর্যায়ে উনি সিরাতের বাবাকে বললেন,

-‘তা শুভ কাজে দেরী কেন আর?মেয়ে হাজির এবার আংটি পরিয়ে দিক।আর পরের সপ্তাহে বিয়ে’।উনার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালো সিরাত।সামনের সপ্তাহে বিয়ে মানে!সিরাতের আব্বু বললেন,

-‘কি বলছো এত তাড়াতাড়ি বিয়ে এটা হয় না।অন্ততপক্ষে ওর এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ হউক।তারপর ভাববো’।বাবার কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো সিরাত।কিন্তু উনি মানতে নারাজ।তবুও জোরপূর্বক এক মাসের সময় নিয়েছেন তিনি।

পাশাপাশি বসে আছে সিরাত আর আবেশ।আবেশের হাতে একটি ডায়মন্ড রিং ঝলমল করছে।আবেশ হাতের দিকে তাকিয়ে আছে অনেক্ষণ হলো।আরু পাশ থেকে বললো,

-‘ভাইয়া আংটি টা পরাও।এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে বুঝিনা আমি’।তিন্নি বললো,

-‘আরে বাবা বিয়ে করা বউকে আংটি পরাতে এত সময় নিচ্ছ তবে বিয়ের আগে হলে কি করতে’।সকলে হাসতে শুরু করলো।গলা পরিষ্কার করে আবেশ বললো,

-‘কাকে পরাবো আর কোথায় পরাবো সেটাই বুঝতে পারছি না।ওর হাত পা কিছুই দেখা যাচ্ছে না।এই সিয়াম তোর বোনের কি হাত নেই নাকি?শেষমেশ বন্ধু হয়ে একটা প্রতিবন্ধীকে আমাকে গছিয়ে দিচ্ছিস’।সিয়াম ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে বললো,

-‘দেখ ভাই আমার বোনের হাত পা সবই আছে। এখন তোর বউয়ের হাত পা না থাকলেও থাকতে পারে সেটা আমি জানি না।তবে কি শেষ পর্যন্ত তুই একটা লোলা মেয়ের স্বামী হলি বলে হাসতে লাগলো সবাই।সিরাত চোখ গরম করে তাকালো ভাইয়ের দিকে।সামনে গুরুজন আছে তাও কেউ মানছে না। তবুও হাসছে সবাই।এদিকে আবেশকে চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে ওর।ওড়নার নিচে হাত লুকিয়েছে বলে এত বড় অপমান।আবেশ একটু ভেবে বললো,

-‘তোর বোনের না থাকলেও আমার বউয়ের সবই আছে।লজ্জায় লুকিয়ে রেখেছে ব্যাপার না।বউ তো আমারই’। ওড়নার নিচ থেকে হাত টেনে বার করে ফট করে আংটি পরিয়ে দিলো।আবেশের আজকের ব্যবহারে হতবাক সিরাত।এই কেমন আবেশকে দেখছে সে।নিজের হাত এগিয়ে দিয়ে বসে আছে আবেশ।তিন্নি সিরাতকে দিয়ে ওর হাতে পরিয়ে দিলো।আবেশের বাবা আর সিরাতের বাবার মুখে এখন তৃপ্তির হাসি।তাঁর মেয়ের বিয়ে এবার সে নিজের স্বপ্ন অনুযায়ী দেবে।

সিরাতের রুমে বসে আছে আবেশ।মুখে তাঁর এক চিলতে হাসি।এই মেয়েটার রুম বরাবরই সুন্দর গুছানো আর পরিপাটি থাকে শুধু আজকেই ভিন্ন।অগোছালো এলোমেলো।কোথাও কোনো কিছুই ঠিক নেই।মুখ গোমড়া করে রুমে ঢুকলো সিরাত।বাইরে থেকে ঠেলে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে তিন্নি আর রিয়া।আবেশের সাথে কিছু কথা বলতে চায় সে।রুমে ঢুকেই আবেশের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে দূরুত্ব নিয়ে দাঁড়ালো।আবেশ সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে।সিরাতকে দেখে বললো,

-‘কথা গুছানো শেষ এবার বলে ফেলো’।সিরাত আমতা আমতা করতে লাগলো।ওড়নার কোণায় হাত পেঁচিয়ে বললো,

-‘একচুয়েলি এভাবে এই বিয়েটার খুব কি প্রয়োজন ছিলো’?

-‘প্রয়োজন নেই বলছো’।সাবলীল ভাষায় জবাব দিলো আবেশ।সিরাত স্পষ্ট ভাষায় বললো, ‘ নাহ নেই’।বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। নিজের শার্ট টেনে ঠিক করতে করতে বললো,

-‘তাহলে এক্ষুণি চলো।আমিও সেটাই চাই।কি দরকার সবাইকে এত খাটানোর।নিজেও খাটলাম না অন্যকেও কষ্ট দিলাম না।জামা কাপড় লাগবে না ওগুলো তোমার বর কিনে দেবে চলো’।আবেশের কথায় চোখ আপনাআপনি বড় হয়ে গেলো সিরাতের।এই লোক বলছে টা কি।আজকে কি পাগল টাগল হয়ে গেলো নাকি।নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,

-‘আমি এটা বলিনি।বলতে চাইছি আর মাএ কয়েক মাস পর আমার ফাইনাল এক্সাম।এখন এসব বিয়ে সংসার ঝামেলা না বাড়ালে কি নয়।এসবে তো আমার লেখাপড়ার ক্ষতি হবে।তাছাড়া আপনিও তো মন থেকে।বাকীটা শেষ করার আগে আবেশ বললো,

-‘এর কোনোটাতেই আমার হাত নেই।সবটাই তোমার বাবা আর আমার বাবার ইচ্ছা।তোমার মত আমিও আজকে সবটা জেনেছি।আর পড়াশোনা সেটা এখানে থেকে উফ তাহলেই হয়েছে।তারচেয়ে ওখানে ভালো হবে।আমার কথা বাদ দাও তুমি বলো তুমি কি চাও।মানতে পারো নি নাকি পেরেছো’।ফেঁসে গেলো সিরাত।এবার কি জবাব দেবে সে।কি করে বলবে এটা মেনে নিয়েছে আর না মানারই বা কি আছে এটা তো ওর অনেক দিনের ইচ্ছা।আবেশের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ভুলে গেলো সে।আজ ওই চোখে কিছু একটা আছে এক্সট্রা কিছু।আবেশের দৃষ্টিও স্থির। চুপ করে রইলো সে আবেশ বললো,

-‘মৌনতা সম্মতির লক্ষণ।তাও যদি তোমার কোনো আপওি থাকে সেটা তোমার বাবাকে বলো আমি কিছু জানিনা’।ফট করে জবাব দিলো,

-‘আপনার কথা তো বললেন না।আপনি কি চান’?

-‘আমার চাওয়া পাওয়া নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।আমার টা আমি দেখে নেবো’।বাঁকা হেসে বললো আবেশ।

-‘দেখে নেবো বললে তো হবে না।সময় থাকতে দেখে নিন।পরে বউ রেখে বাইরে পরকিয়া করে বেড়ালে তো আমি মানবো না’।নিমিষেই চোখ মুখের অবস্থা বদলে গেলো আবেশের।চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তাঁর।রাগে ফুঁসে উঠলো সে।আচমকা সিরাতকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-‘তোমার আমাকে কি মনে হয় মিস সিরাত আমি ক্যারেক্টারলেস।মেয়েদের পেছনে ঘুরা ছাড়া আমার কোনো কাজ নেই।পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য তখন ওইভাবে কথা বলেছিলাম আর তুমি কি ভাবলে ছিঃ।এতদিনে এই চিনলে আমায়’।হনহন করে বেরিয়ে গেলো আবেশ।এখানে থাকলে আরো ভয়ংকর কিছু ঘটিয়ে ফেলবে সেই আশংকায় দ্রুত প্রস্থান করলো।সিরাত হ্যাবলার মতে তাকিয়ে রইলো।আজ বোধহয় একটু বেশিই বলে ফেলেছে সে।এভাবে ঘুমন্ত বাঘকে খোঁচা মারা উচিৎ হয়নি তাঁর।

🍁🍁🍁
কয়েকদিন হলো গভীর রাতে সেই মাস্ক পরা লোকটা আর আসে না।আরু এখন নিশ্চিন্তে থাকে।তবে রাতে ঘুমাতে পারে না।বারবার রাদিফ নামক লোকটা মাথায় ঘুরপাক খায় তাঁর।সামনাসামনি ভালোবাসি বলার সাহস নেই তাঁর।কারণ তাঁর মতো একজন মানুষ কেন ভালোবাসবে এই কলেজ পড়ুয়া মেয়েটাকে।যেখানে তাঁর পুরো ক্যারিয়ার সেট।অনায়াসে তাঁর সমকক্ষ কোনো স্মাট সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে পারে সে।তবে এত কিছুর পরও নিজের উছাতন মনকে বুঝাতে অক্ষম সে।মুখে কথাগুলো আওড়ালেও মন কেনো বাধা মানতে নারাজ।সে ভালোবাসে এটাই ঠিক।

আগামী সোমবার টেস্ট এক্সাম শুরু সিরাতের।চলছে লাস্ট সময়ের প্রস্তুতি।সেদিনের পর কেটে গেছে দুদিন।আবেশ আগের মতোই গম্ভীর মুখে কোনোকথা নেই।ক্লাস নেয় চলে যায়।তবে মাঝেমধ্যে দুষ্টামির জন্য আরু সিরাতকে কথা শুনিয়ে দেয়।গতকাল ক্লাসে আরু আর সিরাত ফিস ফাস কথা বলছিলো সেজন্য দুজনকে আলাদা আলাদা সিটে বসে ক্লাস করতে হয়েছে।সকলের বেলায় একটু আধটু ছাড় দিলেও শুধু মাএ ওরাই আছে কড়া শাসনে।সেদিনের ব্যাপারটা যে এখনও আবেশের মাথায় গেঁথে রয়েছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে সিরাত।কিন্তু তবুও সে চুপ।কাঁজলের সাথে মেলামেশা একটুও কমেনি তাঁর।আগের মতোই ওদের সম্পর্ক।দেখলেই রাগে গা পিওি জ্বলে যায়।তবুও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে চলেছে।মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে কলার ধরে গুন্ডি মেয়েদের মতো বলতে,

-‘ওই আর যদি তোকে এই মেয়ের সাথে দেখি তাহলে হা পা ভেঙ্গে ঘরে বসিয়ে রেখে দেবো।ভালোয় ভালোয় বলছি ভালো হয়ে যা নইলে খবর আছে’।কিন্তু সাহস হয়ে উঠে না তাঁর।টিফিন টাইমে ক্যান্টিনে না গিয়ে কলেজ প্রাঙ্গণে হাঁটছে সিরাত।দূর থেকে আবেশ কাঁজলকে দেখে ওখান থেকে না খেয়ে সরে এসেছে সে।কিছুক্ষণেই আবেশের রুমে ডাক পরলো সিরাতের।একজন পিয়নের মাধ্যমে খবর পাঠিয়েছে সে।এই প্রথম আবেশ ওকে তার কক্ষে ডেকে পাঠালো ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত রহস্যজনক ঠেকলো তাঁর কাছে।কপালের ঘামগুলো মুছে হাত ঘড়িতে টাইম দেখে ছুটলো ওর কেবিনের দিকে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সিরাত আর আরু।ও একা আসতে ভয় পাচ্ছে বিধায় আরুকে সাথে নিয়ে এসেছে।দুই মিনিট হলো দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু ভিতরে ঢোকার বা নক করার সাহস হয়ে উঠছে না কারো।সিরাত লম্বা একটা দম নিয়ে দরজায় হাত দিতে দরজা খুলে গেলো।ভিতরে পা রাখার আগেই পুরুষালী কণ্ঠস্বর শুনে থেমে গেলো সে,

-‘তোমাকে একা আসতে বলেছি সাথে কোনো সাঙ্গু পাঙ্গু আনতে বলি নি’।ব্যাস হয়ে গেলো।দুজনে হা হয়ে গেলো।সিরাত একটা ঢোক গিলে আরুর দিকে তাকালো।আরু ইনোসেন্ট ফেস নিয়ে হেসে হেসে প্রস্থান করলো।আজ কি আছে তাঁর ভাগ্যে কে জানে।সেদিনের কথাগুলোর জন্য কোনো শাস্তি দেবেন নাকি।শাস্তি কথাটা ভেবে হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো তাঁর।

#চলবে