#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৪২
মৃ’ত্যুর খবর টা সাফারাতকে দিতেই ও মাথা চেপে ফ্লোরে বসে পড়ে। বিড়বিড় করে শুধু এতটুকুই বলে–‘ বাংলাদেশের টিকেট কাটো খালা মণি।’ টিকিট পাই তা-ও শুধু একটা। তাই সাফারাতকে পাঠিয়ে দিই আমরা। সিয়ার দাফনের পর দিন ছেলেটা বাংলাদেশ পৌঁছায়। মা’য়ের মুখটা শেষ বারের মতো দেখার সৌভাগ্য তার হয় নি।
আমরা সবাই টিকেট পেয়ে যাই দু’দিন পরের৷ এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এহমাদ বাড়িতে গিয়ে দেখি ঝড় বৃষ্টিতে আমার ছেলেটা গেটের বাহিরে দাঁড়িয়ে। গেইটের ধারে দাঁড়িয়ে একনাগাড়ে ওকে ভিজতে দেখে আমরা সকলে হতভম্ব হয়ে পড়ি। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আয়ান, তোমার খালু টেনেও ওকে এক চুল নড়াতে পারছিল না।
অকস্মাৎ এসবের কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম না। বাংলাদেশ আসার পর সাফারাত কেন আমার ফোন ধরে নি,সে কেন নিজের বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না আমার। কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছিল ছেলেটাকে এমন পরিস্থিতিতে দেখে। দারোয়ান কে বলি আমাদের ভিতরে ঢুকতে দিতে। সাথে সাথেই মুখের উপর না করে দেয় দারোয়ান। আমি যেন কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখছিলাম। সাফারাতকে নিয়ে এই বাসায় আসতেই আব্বা কে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে? আমার ছেলের এ অবস্থা কেন?তখন আব্বা -আম্মা দু’জনেই জীবিত ছিলেন। আব্বা এক এক করে সব খুলে বলে আমাকে। সিয়ার মৃ’ত্যু হয় আগুনে পুড়ে। কিচেনে রান্না করতে গিয়ে আগুনে পুড়ে যায় ও। সেদিন বাসায় কেউ ছিল না। সুফিয়া বেগম হসপিটালে ভর্তি ছিলেন। কারণ আগের দিন রাতে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল উনার। ফারুক নাকি অফিসে ছিল। ওকে দারোয়ান ফোন করে জানায় সিয়া আগুনে পুড়ে গেছে,ওরা হসপিটালে নিয়ে এসেছে ওকে। ফারুক তখন ওদের মুখের উপর বলে দেয় ” মরলে যেন ফোন করে জানায়। তার আগে একটা ফোনও যেন না করে। ”
সিয়ার দাফনের কাজটা পর্যন্ত সে করে নি। সাফারাতের চাচা হামিদ করে। কিন্তু ওরা’ও নিজেদের নিকৃষ্ট রূপ দেখিয়েছে। বাংলাদেশে এসেই যখন সাফারাত এই বাড়ির গেট পেরোয় দারোয়ানের মাধ্যমে সাফারাত কে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় তারা। সাফারাত যে ওদের কিছু হয় সম্পর্কে তা নিমিষেই অস্বীকার করে বলে, এই বাড়িতে সাফারাতের কোনো জায়গা নেই। বাড়িটা এখন ওদের। সুফিয়া বেগমের আহাজারিতে’ও ওরা সাফারাতকে ঢুকতে দেয় নি। ছেলেটা তখন পাথর হয়ে যায়। নিজের বাবার সাথে দেখা করতে চায়। ফারুক তার মুখের উপর বলে দেয়,” মায়ের সাথে সাথে তুমি ম’রে গেলেই পারতে সাফারাত। তাহলে কোনো পিছুটান থাকত না আমার। ”
একটা সন্তান যখন বাবার মুখে এমন বাক্য শুনে সে কি তখনই অর্ধ ম’রে যায় না?আত্মার মৃ’ত্যু হয় না? আমার ছেলেটা’ও শেষ হয়ে গিয়েছিল। আপন মানুষদের প্রতারণায় ওর অনুভূতিরা মৃত্যুবরণ করেছিল।
সিয়ার মৃত্যুর সাতদিন পরেই ফারুক সেই ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করে কানাডা পাড়ি জমায়। বছরের পর বছর অফিস থেকে মোটা অংকের টাকা নিজের একাউন্টে ট্রান্সফার করে সে। তা দিয়ে বউ নিয়ে কানাডায় নিজের সংসার সাজায়,বিলাসিতা করে। আর সাফারাত প্রতিনিয়ত ধুকে ধুকে মরছিল মা’য়ের উপর হওয়া এক একটা অত্যাচারের কথা জানতে পেরে,বাবার নিকৃষ্ট রূপ টা জানতে পেরে,চাচা-চাচীর প্রতারণা সহ্য করে। আমি ওকে এভাবে দেখতে পারছিলাম না। আমাদের লয়ার দ্বারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি বাড়িসহ সব সম্পত্তি সিয়া সাফারাতের নামে লিখে দিয়েছে ওর মৃ’ত্যুর কয়েকদিন পূর্বেই। আমি সাফারাতকে নিয়ে ওদের বাড়িতে যায়। সব জেনে ওর চাচা-চাচী চুপসে যায় নিমিষেই। মা’য়ের রুমে গিয়ে সিয়ার ডায়েরি টা খুঁজে বের করে সাফারাত। সিয়া ডায়েরি লিখতে পছন্দ করত। তাতে লিখে যায় ওর জীবনের প্রত্যেক টা মুহুর্ত। ফারুকের করা অত্যাচার, পরকীয়া সবকিছুই উল্লেখ থাকে। অত্যাধিক দরদী সিয়া নিজের ডায়েরি তে এটাও লিখে যায় এ পরিবারের প্রত্যেক টা মানুষকে যেন সাফারাত আগলে রাখে। মা’য়ের কথার খেলাপ করতে পারল না ও। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও চাচা-চাচী কে বাড়িতে থাকার অনুমতি দিল। দাদির সাথে একটা দিন কাটিয়ে পরের দিন-ই আমাদের নিয়ে পাড়ি দিল সে জার্মানিতে। সেদিন থেকেই সাফারাত চুপ হয়ে যায়। গম্ভীর খোলসে আবৃত করে নেয় নিজেকে। আমার কাছ থেকে সাজেশন চাইত জীবনে কি করলে এতটাই শক্ত হওয়া যাবে যাতে কেউ ভাঙার সুযোগ না পায়। আমি ওকে বলতাম মোটিভেশনাল বই পড়তে। বিভিন্ন বক্তার কাছে নিয়ে যেতাম। কম বয়সেই শিখালাম বিজনেস হ্যান্ডেল করতে। কারণ তখন ওদের বিজনেস নিভু নিভু ছিল। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আমরা সবাই এমন এক সাফারাতকে আবিষ্কার করি যাকে অতিশয় কষ্টও ছুঁতে পারে না। আজকের এই গম্ভীর, গাম্ভীর্য ভরা সাফারাত হওয়ার পেছনে রয়েছে ওর অপ্রকাশিত কষ্ট, কান্না। ছেলেটা কাঁদে নি,মা’য়ের মৃত্যুতে’ও না।
চৈত্রিকার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে যাচ্ছে। শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে ওর। এত অবিচার? এত কষ্ট?বাবা না-কি অমানুষ ছিল ফারুক?যেই লোক স্ত্রীর একটু বয়স করে বাচ্চা নেওয়ায় স্ত্রীকে অমানবিক, নিষ্ঠুরভাবে অবহেলা,অত্যাচার করেছে তারই আজ বুড়ো বয়সে সন্তান রয়েছে। আচ্ছা দোষটা কি সাফারাতের মায়ের ছিল?সন্তানটা তো লোকটারই অংশ ছিল। চৈত্রিকা কি-না সেই জা’নোয়ারের সাথে মিলিয়ে দিত চেয়েছিল সাফারাত কে?হ্যাঁ! জা’নোয়ার। এসব মানুষকে কখনও বাবা বলা যায় না। চৈত্রিকার ভেতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে অপরাধবোধে,নিজের করা চেষ্টায়। আলো বেগমের দু’হাত জড়িয়ে ধরল ও। ডুকরে কেঁদে উঠে ভাঙা গলায় বললো,
‘ আমি,,,,আমি ওই খারাপ মানুষটার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম খালা মণি। সাফারাতের সাথে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলাম উনাকে। ‘
আলো বেগম থমকে গেলেন। গলা উঁচিয়ে বললেন -‘ মানে?’
চৈত্রিকা সব খুলে বলল। আলো বেগম ওর হাত ধরে বললেন,
‘ এই মেয়ে সাফারাত যদি জানে ওই লোকের সাথে দেখা করার জন্য তুমি শপিংমলে গিয়েছিলে,ওর সাথে মিলিয়ে দিতে চেয়েছ তাহলে ছেলেটা শেষ হয়ে যাবে। তুমি ওর অন্যতম দুর্বলতা। ও নিজেকে যতই শক্ত জাহির করুক আমি তো জানি ওর সবটা জুড়ে তুমি। বর্তমান সময়ে ওর একমাত্র ভরসা,বিশ্বাসের স্থান তুমি। ‘
‘ আমি এই কারণে সবটা জানতে চেয়েছি খালা মণি। তবুও আমি ভুল করে ফেলেছি উনাকে লুকিয়ে। অজান্তেই উনার বিশ্বাসে আ’ঘাত করেছি। উনি জানলে হয়ত আমায় কখনও ক্ষমা করবেন না। ‘
‘ ঠিক আছে। ও জানে না তো। তুমি,,’
বলতে গিয়ে আলো বেগম থেমে গেলেন। চৈত্রিকা অশ্রুসিক্ত নয়নে উনার দিকে চেয়ে দেখল উনার দৃষ্টি ভয়ার্ত এবং দরজার দিকে নিবদ্ধ। দৃষ্টি অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকালো চৈত্রিকা। মুহুর্তেই থমকে গেল হৃদস্পন্দন, তার পুরো দুনিয়া। সাফারাত দাঁড়িয়ে আছে হাত মুঠো করে। রক্তবর্ণ দু চক্ষু। ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। তার মুখভঙ্গি স্পষ্ট জানান দিচ্ছে সব শুনে ফেলেছে সে। চৈত্রিকা উঠে দাঁড়াল। দৌড়ে তার কাছে পৌঁছানোর আগেই দূরে সরে গিয়ে লিফটে উঠে গেল সাফারাত। স্পর্শ করতে পারল না চৈত্রিকা তাকে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে উদ্যত হলেই আলো হাত টেনে ধরে বলল,
‘ ভিতর থেকে ফোন টা নিয়ে আসো। আমি ফোন দেই ওকে। তুমি চিন্তা করো না। আমি বুঝিয়ে বলব। ভুল বুঝে নি তোমাকে। ‘
চৈত্রিকা ছুটে গিয়ে ফোন আনল। আলো বেগম চিন্তিত হয়ে অনবরত কল দিতে লাগল সাফারাতের নাম্বারে। পাঁচ বারের বেলায় কল টা রিসিভ হল। লাউড স্পিকারে থাকায় কর্ণে ভেসে এল সাফারাতের ধীর কন্ঠস্বর। চৈত্রিকা ফুপিয়ে উঠল। কান্নার দরুন কথা বলতে পারল না মেয়েটা। কান্না গুলো গিলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তা-ও পারছে না। আলো বেগম ওকে বুকে জড়িয়ে বলে উঠল,
‘ কোথায় যাচ্ছিস?গাড়ির আওয়াজ কেন?কোথায় তুই সাফারাত। মেয়েটা কাঁদছে। জলদি ফিরে আয়। ওকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দে। ‘
‘ চৈত্র কোনো ভুল করে নি খালা মণি। উনি শুধু আমার বিশ্বাসে আ’ঘাত করেছেন আমার কাছ থেকে সবটা লুকিয়ে। ভুল টা আমার। যার হাতে নিজের আত্মা সঁপে দিলাম সেই মেয়েটা আমার আত্মার বিনাশ করল। উনাকে কাঁদতে বারণ করো খালা মণি। আমি ফিরে আসব কি-না জানিনা তবে আমার সুখ কে তোমরা আমার মতো করেই আগলে রেখো। কাঁদতে বারণ করো। হয়ত ফিরে আসব কষ্ট টা লাঘব হলেই।’
এতটুকু বলে স্তব্ধ হয়ে গেল সাফারাত। আলো বেগম ডেকে উঠতেই মলিন স্বরে বললো,
‘ আমার সন্তান কষ্ট পাবে কাঁদলে। চৈত্র প্রেগন্যান্ট খালা মণি। ‘
খুশির সংবাদ পেয়ে খুশি হবে না-কি সাফারাতের কথা শুনে কাঁদবে চৈত্রিকা?ওর যে পুরো দুনিয়া অন্ধকার হয়ে পড়েছে। হাতড়ে’ও ছুঁতে পারছে না ও সাফারাতকে। ঢোক গিলে উত্তেজিত, অস্থির কন্ঠে ডেকে উঠল সে,
‘ সাফারাত!’
সাফারাত শুনল। তবে কিছুই বলল না। চৈত্রিকা জোর গলায় আবারও ডেকে উঠল,
‘ এই সাফারাত? ফিরে আসুন প্লিজ। কোথায় যাচ্ছেন আপনি?বিশ্বাস করুন আমি ভালো থাকব না। শেষ হয়ে যাবে আপনার চৈত্র মাস। আপনাকে ছাড়া,,’
বাকি কথাগুলো থেকে গেল কন্ঠনালিতে। সাফারাত ফোন কেটে দিয়েছে ততক্ষণে। কান থেকে ব্লুটুথ টা একটানে খুলে সাফারাত গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল। দুর্বোধ্য হেসে সমাপ্ত করল চৈত্রিকার অসমাপ্ত কথাটা, বাক্যটা,
‘ আমিও আপনাকে ছাড়া থাকতে পারব না চৈত্র। কিন্তু একি করলেন আপনি? কেন তাজা করলেন আমার পুরোনো ক্ষত?’
সাফারাত গালে তরল কিছু অনুভব করল। চোখ দিয়ে এক ফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে গেল কি?চোখ বুঁজে ফেলল সে। ভেসে উঠল মা’য়ের সেই সুন্দর চাঁদ মুখখানা।
#চলবে,,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৪৩
উল্লাসে ভরপুর এপার্টমেন্ট নিমিষেই নিস্তব্ধতার চাদরে মুড়িয়ে গেল চৈত্রিকার রক্তজমানো চিৎকারে। চুপটি করে ফ্লোরে বসে রইল মেয়েটা এবড়োথেবড়ো হয়ে। চোখ,মুখের অবস্থা বিধস্ত। সাফারাত ফোন ধরছে না। ধরছে না বললে ভুল হবে তার মোবাইলে কল-ই ঢুকছে না। অপরপাশ থেকে বারংবার কর্ণপাত হচ্ছে মোবাইলটি বন্ধ। সিনথিয়া পাশে বসে ঝাপটে ধরল চৈত্রিকাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে অস্থির চিত্তে বলে উঠল,
‘ এই চৈত্র কথা বল। কান্না থামা। আমি শুনেছি তুই অনেক স্ট্রং। তাহলে এভাবে ভেঙে পড়ছিস কেন?সাফারাতের রাগ টা একটু বেশি। তোর সামনে থাকলে তোর উপর প্রভাব পড়ত তাই তো রাগ দমাতে কিছু টা দূরে গিয়েছে। চলে আসবে। আয়ান গিয়েছে ওকে খুঁজতে। ‘
‘ সব আমার জন্য হয়েছে। আমি উনাকে আ’ঘাত করেছি। কিছু লুকানো উচিত হয় নি আমার। এতটা বোকা কি করে হতে পারলাম আমি?’
ভাঙা গলায় কথাগুলো বলে চৈত্রিকা চোখের জল মুছে নিল। কারো সাহায্য ছাড়াই বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। আলো বেগম এগিয়ে আসতে নিলে মিহি স্বরে বললো,
‘ আমি পানি খাবো খালা মণি। তুমি বসো। ‘
সিনথিয়ার স্বর উদ্বিগ্ন শোনাল। তড়িঘড়ি করে বললো,
‘ তুই বস চৈত্র। আমি এনে দিচ্ছি। ‘
‘ প্রয়োজন নেই। আমি এতটাও দুর্বল হয়ে পড়ি নি। ‘
কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে এসে ডাইনিং টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস তুলে নিল চৈত্রিকা। চেয়ারে বসে গ্লাসের অর্ধ জল পান করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস। সেই সাথে টুপ করে এক ফোঁটা নোনতা জল গড়িয়ে পড়ল গ্লাসে। মিলেমিশে মিশ্রিত হয়ে গেল বর্ণহীন পানির সাথে। বিদ্রুপের স্বরে আওড়ালো,
‘ নিজের সুখ নিজের পায়ে ঠেলে দিলি চৈত্র। নিজের মতো করে গর্ভে ধারণ করা অস্তিত্ব টাকেও নিঃস্ব করার চেষ্টা করছিস?ওর কপালেও কি সুখ জুটবে না? বাবার আদর জুটবে না?যেমন করে তোর কপালে,সাফারাতের কপালে জুটল না!’
চৈত্রিকা নিজের মোবাইলটা খুঁজে আনল। সবাই অবাক হয়ে দেখছে ওকে। কিছুক্ষণ আগেই নেতিয়ে পড়া মেয়েটা হুট করেই সজীব হয়ে উঠেছে। একের পর এক অনবরত কল দিতে লাগল সাফারাতকে। বিশেষ লাভ হলো না। আলো বেগম গভীর চোখে ওকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। মেয়েটা স্ট্রং। নিঃসন্দেহে জীবনে অনেক স্ট্রাগল করেছে সে। নয়ত সদ্য মূর্ছা যাওয়া নরম মনের মেয়েটা এত সহজে শক্ত হতে পারত না। নিজের পূর্বের অভ্যাস বশত পরিস্থিতি বুঝেই হয়ত এমন অদল বদল,পরিবর্তন হয় ওর মনের।
চৈত্রিকা একাধারে ফোন করে যখন কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে পেল না মোবাইলটা এক সাইডে রেখে দিল। সিনথিয়া চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
‘ আয়ানকে ফোন দেই। পেল কি-না জিজ্ঞেস করি। ‘
নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফোন দিবে তার আগেই মোবাইলটা ভাইব্রেট করে উঠল। তৎক্ষনাৎ দ্রুত বেগে মোবাইলটা রিসিভ করল সিনথিয়া। অপর পাশ থেকে শ্রবণগ্রন্থিতে পৌঁছাল আয়ানের করুন স্বর।
‘ সাফারাত নেই সিনথিয়া। কোথাও নেই। বাড়িতেও যায় নি। চেনা পরিচিত সব জায়গায় খুঁজেছি কোথাও পাই নি। চার ঘন্টা ধরে খুঁজে যাচ্ছি। মোবাইল বন্ধ থাকায় লোকেশন ট্র্যাক করতে পারছি না। ‘
‘ কোথায় যাবে ও?তুমি ভালো করে খুঁজো। ‘
‘ হুম।’
আয়ান ফোন রেখে দিল। পাশে থাকায় সবটা শুনল চৈত্রিকা। বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে ওর। কিন্তু উপরে শক্ত রইল। অভ্যন্তরের কষ্টের ছাপ মুখে প্রকাশ করল না। লুকিয়ে নিল,চেপে নিল হৃদয়স্থলে।
_____________
পুরো একটা রাত পাড় হয়ে গেল অথচ সাফারাতের কোনো হদিস,খোঁজ খবর পাওয়া গেল না। চৈত্রিকার জোরাজোরিতে ওকে নিয়ে এহমাদ বাড়িতে এল সিনথিয়া, আলো বেগম। এখানেই এসেই বাঁধল আরেক বিপত্তি। কেউ ভালো করে কথা বলছে না চৈত্রিকার সাথে। উল্টো মেয়েটার বিধস্ত মুখখানি দেখেও একতাল কথা শুনিয়ে দিলেন প্রিয়ন্তীর মা। অনবরত দোষারোপ করতে লাগল চৈত্রিকাকে। ফাহমিদা, দিহান, মিম এলেও কারো সাথে কথা বলল না চৈত্রিকা। সারাটা সময় নিশ্চুপ রইল। টলমলে পায়ে প্রবেশ করে সুফিয়া বেগমের রুমে। গলায় তেজ ঢেলে সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করল,
‘ আপনি আমাকে মিথ্যে কেন বললেন দাদি?আজ আপনার কারণে আমার স্বামী আমার কাছে নেই। আমার অনাগত সন্তানের বাবা কাছে নেই। শুধুমাত্র আপনার জন্য আমি উনার বিশ্বাস, আত্মায় আ’ঘা’ত করেছি। ক্ষত বিক্ষত করেছি নিজের অজান্তেই। ‘
সুফিয়া বেগম চোখের চশমা খুলে অশ্রুসিক্ত আঁখিদ্বয় মুছে নিলেন। নরম স্বরে বলে উঠলেন,
‘ আমি জানি ফারুক যা করেছে তা ভুল নয় বরং অপরাধ। কিন্তু ও এখন নিজের ছেলেকে চায়। আমারও শেষ বয়সে এতটুকুই ইচ্ছে ছিল আত্মীয়তার মধ্যে সকল দূরত্ব ঘুচে যাক। তিলে তিলে কষ্ট পেতে থাকা সাফারাত ওর বাবার স্নেহ যেন পায়। ‘
রাগে থরথর করে কাঁপল চৈত্রিকার বদন,সমস্ত কায়া। মলিন মুখে মৃদু হাসল সে। তাচ্ছিল্যের স্বরে প্রতুত্তর করল,
‘ আপনি সঠিক দাদি। তবে এতে মায়ের সাথে ও সাফারাতের সাথে বেই/মানি হয়ে যেত। আল্লাহ হয়ত আমাকে এমন বেইমা/নি করা হতে সময় থাকতে বাঁচিয়ে দিলেন। ‘
কথাগুলো বলে দ্রুত গতিতে নিজেদের রুমে চলে এল চৈত্রিকা। নিজেদের রুম?হ্যাঁ! ওর আর সাফারাতের রুম। রুমের চার দেয়ালে,প্রত্যেকটা কোণায় কোণায় যেন ওদের ভালোবাসার ছড়াছড়ি। ভিন্ন ভিন্ন মুহুর্তের সাক্ষী। ডুকরে কেঁদে উঠল চৈত্রিকা মেঝেতে বসে। বিড়বিড় করে বললো,
‘ শুধু একবার। একবার আপনাকে পাই সাফারাত। আমি সবকিছু ঠিক করে দিব। কোথায় আপনি?কোথায় চলে গেলেন আমাদের ফেলে?আপনার চৈত্র মাস কষ্ট পাচ্ছে। অভিমান কি ভালোবাসার চেয়েও তীব্র?উঁহু! আপনার ভালোবাসা তীব্র, গভীর। ‘
মিম পড়নের শাড়ি টা সামলে দৌড়ে এলো। দু’চোখ টুকটুকে লাল হয়ে আছে তার। চৈত্রিকা দেখার আগে উল্টো ঘুরে অতি সন্তর্পণে মুছে ফেলল অবশিষ্ট জল টুকু। তবুও লাল রঙ কি ফিকে হয়?চৈত্রিকার পায়ের কাছে বসে গলায় দলা পাকিয়ে যাওয়া কান্না গুলো গিলে কথা বলার চেষ্টা করল। কন্ঠস্বর প্রভাবশূণ্য ,দানবিশেষ, নিষ্প্রাণ।
‘ আপু। তৈরি হয়ে নাও। আমরা এক জায়গায় যাবো। দিহান ভাইয়ার খোঁজ পেয়েছে। ‘
মেঝে থেকে চক্ষুদ্বয় তুলে চমকিত, চকচকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল চৈত্রিকা মিমের দিক। ক্রমাগত ব্যগ্র, অস্থির, কম্পনরত কন্ঠে জিজ্ঞেস করতে থাকে–‘ কোথায় উনি?’
মিম তাৎক্ষণিক জবাব দিল না। কিছু সেকেন্ড অতিবাহিত হতেই ছোট্ট করে বললো–‘ গেলেই দেখবে। ‘
চৈত্রিকার দৃষ্টির পরিবর্তন হলো। মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠল। জহুরি চোখে কিয়ৎপরিমাণ সময় চেয়ে থেকে বলে- ‘ তোর চোখ লাল কেন মিমু?কাঁদছিস কেন?’
মিম বোনকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে বলে উঠল-‘ তোমাকে এভাবে দেখে শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে আপু। প্লিজ তুমি নিজেকে সামলাও। ‘
________
গাড়ি এসে হসপিটালের সামনে থামতেই চৈত্রিকা মিমের দিকে বিপন্ন চোখে তাকাল। দিহানকে উদ্দেশ্য করে কড়া সুরে বললো,
‘ এখানে নিয়ে এলেন কেন?সাফারাত ও বাকি সবার কাছে নিয়ে চলুন। আপনার কি হসপিটালে কোনো কাজ আছে?থাকলে আমাকে এড্রেস টা বলে দিন, আমি ট্যাক্সি ধরে চলে যাব। ‘
অসহায় দৃষ্টিতে এক পলক চেয়ে দিহান গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। ধরা গলায় বললো,
‘ নেমে এসো। এখানেই সাফারাত। ‘
চৈত্রিকার বক্ষস্থল কেঁপে উঠল। কথা বলতে পারল না সে। কন্ঠনালি যেন চেপে ধরেছে কেউ। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল ভিতরে। পিছু পিছু ছুটে এল দিহান। হাঁপাতে হাঁপাতে রিসিপশনের মেয়েটাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না চৈত্রিকা। চোখ থেকে অঝোরে জল ঝরছে। দিহান বিচলিত কন্ঠে প্রশ্ন করে,
‘ সাফারাত এহমাদ? ‘
‘ আইসিউতে রেখেছেন উনাকে। ‘
‘ থ্যাংকস। ‘
জীবনটা সুন্দর হতে গিয়েও সুন্দর হলো না ছোট বয়স থেকে ধুকে ধুকে বাড়ন্ত ছাব্বিশ বছর বয়সী চৈত্রিকার। কিছু মাস পূর্বেই এই হসপিটালের করিডোরে দেখেছিল বাবার রক্তমাখা দেহ। তৎপরেই দেখেছিল বাবা নামক মানুষ টার মৃ’ত দেহ। আজ পুনরায় এই হসপিটালে ওর পদলি পড়েছে। চোখের সামনে ভাসছে প্রাণপুরুষের নিস্তেজ সুদর্শন,তাগড়া দেহখানা। কপালে ব্যান্ডেজ। রক্তাক্ত হয়ে আছে একপাশ। হাতে ব্যান্ডেজ। আইসিইউ রুমের বেডে শুয়ে মানুষ টা বড় বড় শ্বাস ফেলছে। হয়ত লড়াই করে যাচ্ছে বেঁচে থাকার। ছোট্ট গ্লাস থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চৈত্রিকা দুর্বোধ্য হাসল। পেটে এক হাত রেখে বললো,
‘ তোর মা’র কপালে সুখ ক্ষণিকের মেহমান ছিল। ‘
চিল্লিয়ে কাঁদার জায়গা নেই, প্রিয় মানুষটাকে কাছ থেকে স্পর্শ করার অনুমতি নেই। আলো বেগম করিডোরের পাতানো বেঞ্চে বসে নিরবে চোখের জল ফেলছেন। সাফারাত রাতে এক্সি/ডেন্ট করেছে। কিন্তু কেউ জানতে পারল না। আশেপাশের কিছু মানুষ হসপিটালে এডমিট করিয়ে দেয়। ডাক্তার রাতে চিকিৎসায় ব্যস্ত থাকায় পরিবারের কাউকে খবর দিতে পারে নি। চেনা পরিচিত হওয়ায় সকালেই ফোন দিয়ে দিহান কে জানায়। সাফারাতের অবস্থা ভালো না। জ্ঞান কবে ফিরবে তা-ও সঠিক বলা যাচ্ছে না। মাথার আ’ঘা’ত টা খুবই কঠিন,গভীর।
চুপ করে এক কর্ণারে নিজের জায়গা করে নিল চৈত্রিকা। সুখ হয়ত চৈত্রিকার আঁজলাতে ধরা দিতে রাজি নয়। তাই তো পালিয়ে যায় বারংবার। সুফিয়া বেগমের শরীর খারাপ হওয়ায় উনাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাথে প্রিয়ন্তীও চলে গিয়েছে। আয়ান সিনথিয়া ও আয়মানকে নিয়ে চলে গেল। পরে আবার আসবে,হসপিটালে বেশি মানুষ এলাউ না বিধায়। আলো, ফাহমিদা একপাশে বসে রইলেন। মেয়ের দিকে তাকাতে পারছেন না ফাহমিদা। এত জলদি মেয়ের সুখের সংসারের ইতি ঘটবে কে জানত!
সকাল পেরিয়ে মধ্যাহ্ন শুরু হয়। চৈত্রিকা তখনও ভাবলেশহীন হয়ে বসে আছে এক কর্ণারে। নিজের কাছে কাউকে ভিড়তে দিচ্ছে না। কারো স্বান্তনা বাণী চায় না তার।সাফারাতের চাচী তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। এগিয়ে এসে এক টানে বসা থেকে টেনে দাঁড় করালো চৈত্রিকাকে। অকস্মাৎ এহেন কান্ডে সকলে ঘাবড়ে যায়। চৈত্রিকা হতবাক, বাকরুদ্ধ। ফাহমিদা, আলো বেগম কাছে এলে উনি ধা’ক্কা দিয়ে চৈত্রিকাকে ফেলে দিলেন ফাহমিদার শরীরের উপর। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দু’হাতে মেয়েকে বুকে আগলে নিলেন ফাহমিদা। কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই চাচী দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন,
‘ আপনার এই মেয়েকে এখান থেকে নিয়ে যান। অপয়া,অলক্ষুণে মেয়ে একটা। এই মেয়ে যেই সংসারে যাবে সেই সংসার টিকবে না। নিজের ভাইয়ের খু/’নী সে। আজ সাফারাতও মর’তে যাচ্ছে ওর কারণেই। ‘
দিহান এগিয়ে আসতে নিলে মিম হাত চেপে ধরল। রেগেমেগে প্রস্থান করল দিহান। মা’কে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো চৈত্রিকা। প্রতিবাদী কন্ঠে বললো,
‘ আমি সাফারাতকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। আমি যদি অলক্ষুণে, অপয়া হয় তবে আপনারা কি?কালপিট?মুখোশধারী শয়তান?নিকৃষ্ট মানুষ। যারা কি-না আমার স্বামীর দুর্বল সময়ের অপেক্ষা গুণে। এহমাদ বাড়ি আমার,আমার স্বামীর। আমার সংসার। আপনার কোনো অধিকার নেই সাফারাত থেকে আমাকে দূরে সরানোর। সময় থাকতে সতর্ক হোন। অনেক রেহাই পেয়েছেন আপনারা। আমি সিয়া মা না,আমি চৈত্রিকা। সাফারাতের রুক্ষ শুষ্ক,তেজস্বী চৈত্র মাস। ‘
চৈত্রিকার একেকটা বাক্য, শব্দে যেন আক্রোশ ফেটে পড়ছে। কঠিন মুখভঙ্গি। চাচী ভড়কে গেলেন। মুখে যেন কুলুপ এঁটে গেল উনার নিমেষে।
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)