সুখের নেশায় পর্ব-৫৬

0
581

#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৫৬

‘ আমি পারতাম সেদিন আলো আপাকে বলে দিতে যে ফারুকের সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক আছে। ফারুক আমাকে ভালোবাসে,আলো আপাকে না। কিন্তু চেয়েও আমি বলতে পারি নি। মন,মস্তিষ্ক কেমন অচল হয়ে পড়েছিল। কি করব,কি বলবো তা কিছুই মাথায় আসছিল না। সঠিক পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কারণ একটাই আমি যেমন আলো আপাকে অনেক ভালোবাসি,তেমন ফারুক কেও। তবুও সিদ্ধান্ত নিলাম ফারুক কে বলবো আলো আপার কথা। আমার ভীষণ ভালোবাসার চেয়ে ওই মেয়ের অতিরিক্ত ভালোবাসার প্রখরত্ব অধিক। ফারুকের সাথে আমার সম্পর্ক আছে এটা আলো আপাকে আমি কখনও মুখে বলতে পারবো না,তার চেয়ে বরং ফারুককে আপার কথা জানায়। সিদ্ধান্ত মতে,আমি ফারুক কে বলি আলো আপার মনের সমস্ত কথা। এক মুহুর্তে আমি ত্যাগী নারী হয়ে উঠেছিলাম। ফারুকের পা জড়িয়ে বলেছিলাম আপাকে যেন বিয়ে করে। কিন্তু ফারুক রাজি হয় নি। কর্ণপাত করে নি আমার আকুতি-মিনতি। বরঞ্চ সে আমায় বুকে আগলে ধরে বলেছিল–‘ দেখো সিয়া,আমি আলোকে ভালোবাসি না,তোমাকে ভালোবাসি। তোমার সাথে আমার একটা সম্পর্ক আছে। ‘ প্রেম’ নামক সম্পর্ক। যদিও আমি তোমার কথা মেনে আলো কে বিয়ে করি কখনও ওকে মেনে নিতে পারবো না। আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে আপন করার সাহস জোগাতে পারব না। এতে আমি নিজেও কষ্ট পাবো,আলোও পাবে। একতরফা ভালোবাসায় কভু নাহি সুখ মিলে,অনুরাগ তো দু’তরফা হতে হয় যেন সন্ধিক্ষণ দীর্ঘ না হয়। ভালোবাসা বিহীন সংসার হবে কিন্তু আলো সুখী হবে না,আমিও, তুমিও না। বোনের জন্য ভাবতে গিয়ে তুমি বোনকে আরও ধ্বংস করে দিবে সাথে আমাকেও। নিজেও ভেঙে পড়বে। তুমি কি চাও তিন তিনটা জীবনে দুঃখের কৃষ্ণতা লেপে যাক নাকি লম্বা সময়ের অসুখের চেয়ে ক্ষীণ সময়ের অসুখ ভালো?আজ আলো কষ্ট পাবে কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওর সকল ক্ষত শুকিয়ে যাবে,নতুন করে সাজবে জীবন। কিন্তু আমার আর ওর বিয়ে হলে কখনও জীবনে রঙ পাবে না। কখনো না। এখন তুমি ওর,আমার,নিজের জীবন বরবাদ করতে চাও?’

সেদিন ফারুকের সেই কথাগুলোর প্রেক্ষিতে আমি কিছু বলার ভাষা হারিয়ে প্রায় শূন্য। কারণ ওর বলা প্রত্যেক টা বাক্য সত্য এবং সঠিক ছিল। কি করে আমি আপার জীবনে দুঃখ ডেকে আনতে পারি?সেদিন পুরো মধ্যাহ্ন পুরো রাত অনেক ভাবি। তখনও কোনো সিদ্ধান্ত না নিতে পেরে আমি যখন মলিন মুখে বারান্দায় পায়চারি করছি তন্মধ্যে আগমন ঘটে বাবার। হুট করেই বাবা আমার জীবনের অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত নেয় যা শুনে আমি কয়েক পলকের জন্য স্তব্ধ হয়ে পড়ি। আমার ও ফারুকের সম্পর্কে অবগত ছিল বাবা। সেটার রেশ ধরেই জানালেন ছোটখাটো করে ঘরোয়াভাবে আকদ করিয়ে ফেলতে চান আগামীকাল। সেই সময়টা তে জীবনের এমন এক কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি যেখান হতে পরিত্রাণের উপায় পাচ্ছিলাম না। কারণ বাবা আমার কাছ থেকে কথা নেয় আমি যেন ফারুকের সাথে বিয়েতে আপত্তি না করি। আর ফারুকও আমাকে চাই। নিজের ভালোবাসা, ফারুকের ভালোবাসা,বাবার ইচ্ছে সব মিলিয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সবার খুশি,সুখ,ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি এক কঠোর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। যেই আমি দিন রাত এক করে সমীকরণ মিলাতে গিয়ে মূর্খতার ট্যাগ নিজের গায়ে জড়াচ্ছিলাম বারংবার সেই আমি মাত্র কয়েক ঘন্টায় বাবাকে জানায় আমি ওনার কথায় রাজি। আকদের জন্য তৈরি হওয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত আলো আপাকে ফোন করে সবকিছু বলতে ইচ্ছে হয় কিন্তু আমার ভিতরকার সত্তা আমায় বাধা দেয়। ভাবায়,এতে আপুর কষ্টের পরিমাণ পাহাড়সম হবে। হয়ত হঠাৎ করে শুনলে এক সেকেন্ড কিংবা অতিশয় দীর্ঘ এক সময়ের জন্য ভুল বুঝবে আমাকে তবুও যে নিরুপায় আমি। কি করে বুঝাবো ওই মেয়েটাকে ফারুকের সাথে তোমার মঙ্গল নয়,বরং ক্ষতির এবং ক্ষতের পরিমাণ টা-ই অধিক হবে। কেননা,ভালোবাসার মানুষকে পেয়েও ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা অত্যাধিক ও অতি করুন যা এখন আমি হারে হারে টের পাই।

ভালোবাসার মানুষ পেলেও সত্যিকারের ভালোবাসা আমার কপালে জুটে নি। এখন নিজের প্রতি অনেক গর্ব হয়। কোনো এক কালে আপাকে ভবিষ্যতে ভালোবাসা না পাওয়ার মতোন মৃ*ত্যু যন্ত্রণা থেকে বাঁচিয়েছিলাম। আজ বুঝতে পারলাম আপাকে শুধু কষ্ট না স্বামীর অত্যা*চার,নির্যা’তন,পর নারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের,অন্তরঙ্গ হওয়ার দৃশ্যখানা দেখা হতেও বাঁচিয়ে দিলাম। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় আপা তুমি ভাগ্যবতী, বেঁচে গেলে তুমি। শুরুতে মানুষটা যেমনই ছিল দিনশেষে তো তোমাকে চোখে হারায়। তোমার আধবয়স্ক, বৃদ্ধবয়সের বিশস্ত সঙ্গী দুলাভাই। অথচ আমি যাকে সর্বস্ব উজার করে ভালোবাসলাম,সূচনায় যেই ব্যক্তি মধুরতায় মাখিয়ে নিল আমায়, দিনশেষে সে এক নর*পিশাচ। তুমি জিতে গেছো আপু,আমি তোমাকে এক দান’বের হাত থেকে বাঁচিয়েছি। জানি কখনও এটা বলা হবে না আমার,শুধু অব্যক্ত অনুভূতি হিসেবে অক্ষরে অক্ষরে সজ্জিত থাকবে চিরকাল আমার ডায়েরির পাতায় পাতায়। তবে আপুকে আমি আমার সুখ দিয়ে দিয়েছি। সাফারাত নামক সুখ। মন বলছে এত অত্যা/চারের ভিড়ে বোধ-হয় আমার আর নিঃশ্বাস নেওয়াটা হবে না,তাই ছেলেটাকে একজন বিশস্ত মানুষের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। এদিক থেকে আমি ভাবলেই বড্ড শান্তি পাই। আপুর মতো করে কেউ আগলে রাখতে পারবে না আমার গম্ভীর মুখো,চাপা স্বভাবের সাফারাতকে। মা ও মিনার মা’য়ের চেয়েও আমার সব থেকে ভরসাযোগ্য মানুষ টা তুমি আপু। ভালো রেখো আমার সাফারাতকে। আমি জানি কখনও এটা আমার মুখে বলতে হবে না, আমার ছেলে এমনিতেই ভালো থাকবে। তাই সকল কিছু চিরতরে চাপা পড়ে থাকুক ডায়েরির ভাঁজে।

ডায়েরি টা হাত ফসকে মেঝেতে পড়ল। এলোমেলো হয়ে গেল পৃষ্ঠাগুলো। অকস্মাৎ অনুশোচনার দুয়ারে দাঁড়িয়ে গেলেন আলো বেগম। কাঁদলেন না,অশ্রু বিসর্জন দিলে নেহাৎ লজ্জা বলে বিবেচিত হবে। কেন একটা বারও মনে জাগে নি সিয়া তো একদিক দিয়ে ভালোই করেছিল তার জন্য। আজ হয়ত সিয়ার জায়গায় তিনি থাকতেন,বৃদ্ধ বয়সে এসে স্বামীর পরকীয়া সহ্য করতে হতো আঁচলে মুখ চেপে। হয়ত কোনোদিনও বিন্দুমাত্র সুখী হতেন না,সারাক্ষণ ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করে মা’রা যেতেন। এতো এতো বিশস্ত মানুষ হিসেবে ছিলেন একটা মেয়ের কাছে যে নির্দ্ধিধায় তার সুখ ওনার কোলে ঢেলে দিলেন তাকেই কি-না সারাটাজীবন হিংসা করে গেল। রাগে-হিংসায় মে’রে ফেলার মতো ডিসিশন টা নিতেও কুণ্ঠাবোধ করলেন না। হায়রে রাগ!আসলেই, রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। আজ সব হারিয়ে ফেলেছেন আলো বেগম।

এত সময় অব্দি নিরবে দাঁড়িয়ে ছিল সাফারাত, চৈত্রিকা উভয়েই। ফ্লোরে এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা ডায়েরির দিকে চৈত্রিকা দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। কি আছে এতে!আলো বেগমের মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এমন কিছু আছে যা উনাকে অনুতাপের আগুনে দাউদাউ করে পুড়িয়ে মারা’র জন্য যথেষ্ট। সাফারাত বড় বড় পা ফেলে দরজা টা মেলে দাঁড়িয়ে পড়ল। রোষপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠল,

‘ অতিরিক্ত ভালো চাইতে গিয়ে আগুনে জ্বলসে ছাই হয়েছে আম্মু। আমি জ্বলবো না,কারো ভালোও করতে যাবো না। করার আগে মানুষের আসল রূপ টেনে হিঁচড়ে বের করে সিদ্ধান্ত নিব। আপনি এখনই আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যান। গেট লস্ট। ‘

আলো বেগম চোখ তুলে তাকালেন। কি নিরীহ সেই চাহনি!কালো মেঘে পুরো মুখশ্রী ঢাকা পড়েছে ওনার। ক্রোধ, হিংসা মানুষকে কেবল ধ্বংস-ই করে এবং তা চিরন্তন সত্য। আলো বেগম দুই পা এগিয়ে গিয়ে চৈত্রিকা দু’হাত ধরতে নিলে তৎক্ষনাৎ সরিয়ে আনে ও। মুহুর্তেই সাফারাতের ন্যায় পাষণ্ড রূপ ধারণ করলো। কাঠ কাঠ গলায় বললো,

‘ আপনি আমাকে ছুঁবেন না। ‘

আলো বেগম অসহায় দৃষ্টিতে চাইলেন। চক্ষু কোটর ভিজে উঠেছে। অবজ্ঞা,কঠোর,তীক্ষ্ণ শব্দ কলিজা ভেদ করে ওনার সমগ্র অভ্যন্তর রক্তাক্ত করে দিল নিমেষে। ধীরস্থির গতিতে হেঁটে দরজা পর্যন্ত এসে সাফারাতের দিকে চাইলে সে বিরক্তভরা কন্ঠে বললো,

‘ এতো ছলনাময়ী রূপ দেখার সময় অবশিষ্ট নেই আমার কাছে। বেরিয়ে যান। ফারদার আসবেন না। ‘

কিছু কিছু মুহুর্ত মৌন মুখে পার করতে হয়। আলো বেগমও করলেন। বেরিয়ে গেলেন তিনি। দরজা টা ঠাস করে লাগিয়ে রুমে চলে গেল সাফারাত। চৈত্রিকা চেষ্টা করেও তার চেহারার অভিব্যক্তি দেখতে সক্ষম হলো না।

উপুড় হয়ে ডায়েরি টা তুলতে চেষ্টা করলে একটা চিকন মেয়েলি হাত ডায়েরি টা তুলে ওর হাতে ধরিয়ে দিল। নিঃশব্দে কাঁদছে প্রিয়ন্তী। সব শুনেছে ও এতক্ষণ নিভৃতে। চৈত্রিকাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে উঠল মেয়েটা। ক্রন্দনরত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
‘ তুমি ও ভাইয়া ছাড়া আমাদের আশেপাশে আর ভালো মানুষ কে ভাবী?’
চৈত্রিকার বুকটা কেঁপে উঠল। প্রশ্ন টা তো কঠিন নয় তবুও কেন হৃদয়স্থলে কম্পন ছড়িয়ে পড়ল?কেন উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না?শুধু বলতে মন চাইল– ‘ ভালো মানুষ চিনতে হলে তোমাকে বছরের পর বছর মানুষটার সঙ্গে চলতে হবে, এতে হয়ত তুমি ঠকে যাবে, প্রতা’রিত হবে আবার সুখীও হবে। সবটায় অজানা ও সময়ের খেল।’
____________

দিবাকর অন্তরীক্ষে জায়গা করলো সবে। বার্লিনের পিচ ঢালা রাস্তা ধরে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে এক চেনাজানা হসপিটালের উদ্দেশ্যে। ক্ষণে ক্ষণে গাড়ির গতি বেড়ে চলেছে। সেই সাথে বাড়ছে চৈত্রিকার জল গড়িয়ে পড়ার পরিমাণ। ওষ্ঠদ্বয় এক করে শব্দহীন কাঁদছে ও। শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। ব্যাথায় অসার সমস্ত গা। সাফারাত পিছনের দিক ঘাড় বাঁকিয়ে দেখছে না। প্রচন্ড গতিতে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত সে। প্রিয়ন্তী চৈত্রিকার শরীর টা বার বার চাদর দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে। দু’পাশের জানালার কাচ তুলে দিয়েছে সাফারাত। আজকাল জার্মানির সকল শহর,অলিগলিতে শীতের রাজত্ব। সেই রাজত্বে চৈত্রিকার অবস্থা নাজেহাল।

হসপিটালের সামনে গাড়ি থামাতেই সিনথিয়া,ফাইয়াদ,আয়ান এগিয়ে আসল। চক্ষুদ্বয় বেশ ফোলা ফোলা। সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসেছে তার ছাপ সুস্পষ্ট। নিজেদের দেহ খানি বড় বড় জ্যাকেটে আবৃত করে রেখেছে। সাফারাত হুড়মুড়িয়ে গাড়ি থেকে নামল। দরজা খুলে কোলে তুলে নিল চৈত্রিকাকে। অন্তঃসত্তা চৈত্রিকার দেহের ওজন বেশ। তবুও সাফারাত কি নির্বিকার ওকে আগলে রেখে পা বাড়াচ্ছে। হসপিটালে ঢোকার মুহুর্তে নিভু নিভু চোখে দেখল চৈত্রিকা আয়মানকে। আঁখিপল্লব ঝাঁকিয়ে করুণ দৃষ্টি মেলে রেখেছে ছেলেটা। পেইন ওঠার পর থেকে সাফারাত নিশ্চুপ। চৈত্রিকাকে যখন ওটিতে ঢোকানো হবে সাফারাত ওর হাত টা আঁকড়ে ধরলো। সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল,
‘ ফিরে আসবেন কিন্তু। ‘
একদম পরিস্ফুটভাবে অনুভব করে চৈত্রিকা সাফারাতের অশ্রুমাখা,গম্ভীর স্বর। কে বলবে উপর দিয়ে কঠিন ভাব ধারণকৃত লোকটার অভ্যন্তর কাঁদছে। ঝড়ের বেগে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে সে।

#চলবে,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)