উপন্যাসঃ “মেঘফুল”
পরিচ্ছেদঃ ২৯
লেখাঃ মিশু মনি
আজ অফিসে জাহ্নবীর সঙ্গে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটতে চলেছে। অন্য কারও জন্য বিষয়টা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রথমবার পড়ছে জাহ্নবী। তাই তার কাছে বিষয়টা খানিকটা বিব্রতকর। তাকে অফিসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নিয়ে নাদির স্যারের বাসায় যেতে হবে। নাদির ইনজুরিতে আছে। তাকে কাগজগুলো দেখিয়ে স্বাক্ষর করে নিতে হবে। একা একা যেতে পারবে কী না সেই আতংকে জাহ্নবী অনেক্ষণ দম আটকে বসে রইল।
সিএনজিতে উঠে জাহ্নবী ফোন করল ভায়োলেটকে। ওর সঙ্গে কথা বললে ভেতর থেকে সাহস সঞ্চারিত হয় জাহ্নবী’র। ভায়োলেট ফোন রিসিভ করলো না। তীব্র নার্ভাসনেস নিয়ে জাহ্নবী নাদির স্যারের বাসায় ঢুকল।
বেশ বড় ড্রয়িংরুমের এক কোণায় জড়োসড়ো হয়ে বসল জাহ্নবী। একটা মহিলা ওকে শরবত দিয়ে গেলেন। মহিলা মানুষ দেখার পর ওর আতংক কিছুটা কমেছে। তবুও মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, সে বেশ আড়ষ্ট।
মহিলা কিছুক্ষণ পর এসে জানালেন, ‘আপনি আমার সঙ্গে আসেন। ওনার রুমে নিয়ে যাইতে বলছে।’
জাহ্নবী উঠে দাঁড়াল। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ওর। ফিসফিস করে মহিলাকে বলল, ‘রুমে আপনিও থাকবেন।’
অবাক চোখে মহিলা জাহ্নবী’র দিকে তাকালো। কুঁচকানো ভ্রু দেখে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল জাহ্নবী। রুমে ঢোকার আগ মুহুর্তেও সে মহিলাকে বলল, ‘আপনিও থাকবেন রুমে কিন্তু।’
দরজা ঠেলে নাদিরের রুমে ঢুকে জাহ্নবীর ইতস্তত বোধ পুরোটাই কেটে গেল। নাদির বিছানায় শুয়ে আছেন, হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত ব্যান্ডেজ। চোখেমুখে অসুস্থতার ভয়ংকর ছাপ। পাশেই একজন তরুণী চিন্তিত মুখে ওনার সেবা করছে। চেয়ারে বসে রয়েছেন একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা। জাহ্নবী লজ্জায় পড়ে গেল। তার ভয় পাওয়ার কোনোই কারণ ছিল না। মহিলাটি এখনও চোখ বড়বড় করে জাহ্নবীর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে জাহ্নবী লজ্জায় মুখ তুলতে পারল না।
তরুণী সহাস্যে জাহ্নবীকে বলল, ‘প্লিজ বসুন। সরি আমি আপনাকে রিসিভ করতে পারলাম না বলে। ও একটু পরপর এত অস্থির হয়ে যাচ্ছে, তাই ওকে রেখে এক মুহুর্ত সরতে পারছি না।’
‘কী হয়েছে ওনার?’
আন্তরিক ভঙ্গিতে জানতে চাইলো জাহ্নবী। আড়ষ্টতা আপনা আপনি কেটে গিয়েছে।
মেয়েটি উত্তর দিলো, ‘একটা সিএনজির চাকা পায়ের ওপর দিয়ে চলে গেছে। বড় ধরনের কিছু ঘটতে পারত। এখনো ভয়েই কুঁকড়ে আছে ও। মা, আপনি রুমে যান। আমি দেখছি। উনি আমার শাশুড়ী মা।’
চেয়ারে বসে থাকা বৃদ্ধা ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ হল জাহ্নবী’র। তরুণী তাহলে নাদির স্যারের স্ত্রী! মিছেমিছি আতংকে মরে যাচ্ছিল সে। এখানে সবকিছু তার কল্পনার চাইতেও সুন্দর!
তরুণী নাদিরকে ডেকে বললো, ‘এই ওঠো তো। লক্ষিটি, দেখো কে এসেছে।’
ধীরেধীরে চোখ মেলল নাদির স্যার। শুকনো মুখে হাসার বৃথা চেষ্টা করে বলল, ‘আপনাকে অযথা কষ্ট দিতে হল মিস জাহ্নবী।’
‘না, স্যার। আমি আসলে বুঝতে পারিনি আপনি এতটা অসুস্থ। আমি ভেবেছিলাম ইমেইলে সবকিছু স্ক্যান করে পাঠালেই তো হয়ে যাবে। সরি স্যার, আমি বুঝতে পারিনি।’
‘আরে ধুর। দেখেছ তন্বী, মেয়েটা কত সাধাসিধে? জাহ্নবী, আমি তো মরেই যেতে বসেছিলাম। রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা বাস দ্রুত স্পিডে এসে ধাক্কা দিতে যাচ্ছিল। অল্পের জন্য চাপা পড়িনি। কিন্তু জান বাঁচলেও সিএনজির চাকার নিচে পা পড়ে গেছে।’
তন্বী নরম গলায় বলল, ‘প্লিজ নাদির। এই দৃশ্য বারবার মনে করো না। তাহলে তুমি আরও ভয় পাবে। ভুলতে চেষ্টা করো। তোমার কিচ্ছু হয়নি।’
নাদির বলল, ‘জাহ্নবীর জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করো। আমি কাগজপত্র গুলো দেখতে একটু সময় লাগতে পারে। আপনার অসুবিধা নেই তো?’
জাহ্নবী আন্তরিক ভঙ্গীতে উত্তর দিলো, ‘না স্যার। কোনো অসুবিধা নেই। আপনি সময় নিয়েই দেখুন।’
‘আমি কাজের ব্যাপারে অনেক সিন্সিয়ার বুঝেছেন? আমি চাইলেই এখন কাজটা আটকে রাখতে পারতাম। কিন্তু একটা সাইন দিলেই যখন হয়ে যাবে, তখন এতগুলো টাকার ডিল আটকে রাখার মানে হয় না।’
‘আপনার মতো ভালোমানুষদের জন্যই পৃথিবীটা টিকে আছে।’
‘ভালোমানুষ কিন্তু বেশিদিন টিকে না জাহ্নবী। এরা তারাতাড়ি পরপারে চলে যায়।’
তন্বী চোখ পাকিয়ে কাঁদোকাঁদো সুরে বলল, ‘আর একবার এসব উলটা পালটা কথা বললে আমি কিন্তু চলে যাবো। যেদিকে চোখ যায় চলে যাবো।’
মুখের ওপর আঙুল রাখলো নাদির। তন্বী পেছনে দাঁড়ানো মহিলাকে বলল, ‘ খালা, আপনি ওনার নাস্তার ব্যবস্থা করুন।’
সেই মহিলাটি জাহ্নবীর দিকে এক পলক দৃষ্টিপাত করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। জাহ্নবী বলল, ‘স্যার, আমি বাইরে বসি?’
‘ এখানে বসতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে?’
‘না স্যার।’
তন্বী বলল, ‘ ঠিক আছে আপু, আপনি ড্রয়িং রুমে বসুন। আমি জরুরি দরকার হলে ডাকবো আপনাকে।’
জাহ্নবী ঘর থেকে বের হওয়ার পর শুনতে পাচ্ছিল তন্বীর গলা, ‘ বাবু প্লিজ কাগজপত্র রাখো, রেস্ট নাও। সারাদিন সময় পাবে এগুলো দেখার।’
‘মেয়েটাকে বসিয়ে রাখবো সারাদিন?’
‘ওকে চলে যেতে বলো। কাজ শেষ হলে আমরা ফাইল অফিসে ওনার কাছে পৌঁছে দেবো।’
‘আমাকে এত ভালোবাসো কেন তন্বী?’
আর কোনো কথা শোনা গেল না। জাহ্নবী ড্রয়িং রুমে চলে এসেছে। একদিকে বিশাল কাঁচের দেয়ালের ওপাশে শহুরে বিল্ডিং মাথাচাড়া দিচ্ছে গর্বিত ভঙ্গিমায়। সোফার ওপর কেউ একজন বসে আছেন।
জাহ্নবী দৃষ্টি সরিয়ে অন্যপাশে রাখা সোফায় এসে বসলো। কয়েক মুহুর্ত কেটে গেল নিরবে। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখল জাহ্নবী।
‘খালা, চায়ে আরেকটু চিনি লাগবে।’
‘আনতেছি।’
খালা এবার জাহ্নবীকে চা দিতে এলেন। ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে খালার দিকে তাকালো জাহ্নবী। সেই মহিলা! যাকে জাহ্নবী তার সঙ্গে ঘরে থাকতে বলেছিল। লজ্জা পেয়ে ম্লান হাসল জাহ্নবী। চায়ের কাপ নিয়ে দৃষ্টি ঘোরাতেই দেখল তার সামনের সোফায় বসে আছে ‘পান্নাবাহার’!
জাহ্নবী প্রথমে এটাকে মনের ভুল ভেবে অবজ্ঞা করার চেষ্টা করেও পারল না। দিনদুপুরে আলোয় ঝলমলে এই ঘরে তার দৃষ্টিবিভ্রম হতে পারে না। উনি সত্যিই পান্নাবাহার। পরনে বাদামী রঙা শার্ট, চোখে চশমা।
জাহ্নবী’র বুক কাঁপছে। এক চুমুক চা খেয়ে বাইরের দিকে তাকালো সে। শান্তিমত বসে থাকতেও পারছে না আর।
তন্বী এসে পান্নাবাহারকে জিজ্ঞেস করল, ‘কতক্ষণ হল এসেছেন?’
‘একটু আগেই।’
‘রুমে যান।’
‘চা শেষ করে যাচ্ছি।’
পান্নাবাহারের গলার স্বর টুকুও মাথায় গেঁথে গেল জাহ্নবী’র। তাকে জোর করে ভুলতে চেষ্টা করেছিল সে। চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে মনকে বুঝিয়েছিল, তার সঙ্গে দেখা হওয়ার ব্যাপারটা পুরোটাই ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। আমি আর তাকে নিয়ে ভাবতেও চাই না।
ভাগ্য কী তবে এই চেয়েছিল! কাজের সূত্রে নাদির স্যারের বাসায় এসে এভাবে আচমকা দেখা হয়ে যাবে দুজনের, তারপর? আবারও জাহ্নবী কষ্ট পাবে দীর্ঘ কয়েকটা দিন।
তন্বী জাহ্নবীকে বলল, ‘আপু, আপনি অফিসে চলে যান। কাজ শেষ হলে আমি ফাইলটা অফিসে পাঠিয়ে দেবো। স্যার আপনাকে কিছু বলবে না। ওটা নাদির ম্যানেজ করে নেবে।’
‘আচ্ছা।’
‘আর আপু, আপনি লাঞ্চ করে যাবেন। আমি রান্নাবান্না করতে পারছি না। খালা রান্না করছে। আপনার খেতে অসুবিধা নেই তো?’
‘সরি, আমি আজকে খেতে পারবো না। অন্য একদিন না হয়..’
জাহ্নবী কথাটা বলেই পান্নাবাহারের দিকে তাকাল। ইচ্ছেকৃত ভাবে তাকিয়েছে, তা নয়। অজান্তেই দৃষ্টি চলে গিয়েছে তার দিকে। পান্নাবাহার টি – টেবিলের ওপর খানিকটা ঝুঁকে এসে চামচ দিয়ে ধীরেধীরে চায়ের কাপে চিনি মেশাচ্ছে, ঝুনঝুন আওয়াজ উৎসারিত হচ্ছে সেখান থেকে। নরম ধোঁয়ায় তার চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে উঠছে ধীরেধীরে। চোখ থেকে আলগোছে চশমা খুলে টেবিলে রাখল পান্নাবাহার। তারপর পরম যত্নে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। জাহ্নবীর মনে হল, এতটাও নান্দনিক ভাবে কাউকে চা খেতে দেখেনি কখনো সে!
তন্বী বলল, ‘ খেয়ে যাবেন আপু। আপনাকে না খেয়ে আমি যেতে দিচ্ছি না। আমার শাশুড়িকে আসতে বলি, ওনার সঙ্গে কথা বলুন।’
তন্বী ভেতরে চলে গেল। পান্নাবাহারের চা’ও যেন ফুরিয়ে গেল দ্রুত-ই। সে নাদিরের ঘরের দিকে পা বাড়াল।
জাহ্নবী’র হৃদয় ভরে গেল এক শুভ্র নির্মল আনন্দে। ভাললাগার অমোঘ স্রোতে ভেসে যেতে লাগল তনু মন। কিছুক্ষণ আগেও যে অজানা আতংক বিরাজ করছিল তার মনে, মুহুর্তেই তা রূপ নিলো শুদ্ধ খুশির জোয়ারে।
নাদির সাহেবের মা সোফায় এসে বসলেন। মুখটা মলিন। ছেলের শোকে তিনি ভীষণ ভেঙে পড়েছেন। জানতে চাইলেন, ‘তোমার নাম কি মা?’
‘জাহ্নবী।’
‘ভাত খেয়ে যেও।’
‘আচ্ছা।’
‘তুমি করে বলাতে কিছু মনে করোনি তো?’
‘না আন্টি। আপনি নিশ্চিন্তে বলতে পারেন।’
‘তোমার বয়সী আমার একটা মেয়ে আছে, বড় মেয়ে। ও কানাডায় থাকে। ভাইয়ের একসিডেন্টের কথা শুনে পাগল হয়ে গেছে।’
আবেগঘন হয়ে উঠল মায়ের গলা। জাহ্নবী বলল, ‘আন্টি, উনি আল্লাহর রহমতে দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবেন। আল্লাহ ওনাকে বড় ধরনের বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন।’
‘সেটাই শোকরিয়া। দোয়া কোরো আমার ছেলের জন্য। অফিস থেকে ছুটি দিয়েছে। তাও সে কাজ করবেই। এমন পাগল ছেলে।’
‘আসলে বড় একটা প্রজেক্ট তো, স্যার এতদিন দেখাশোনা করেছেন। তাই..’
নাদির সাহেবের মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। কাজের মেয়েকে ডাকলেন তিনি, ‘সাহিদা, রান্না হলে মেহমানকে খেতে দাও।’
সাহিদা ছুটে এলো, ‘পরায় হয়ে গেছে। আমি রেডি করতেছি।’
জাহ্নবী বলল, ‘এত ব্যস্ত হবেন না প্লিজ। আমার খিদে নেই।’
‘তুমি তাহলে খেতে বসো মা। এই টেবিলে বসো। আমাকে থাকতে হবে?’
‘না, আন্টি৷ আপনি ভেতরে যান।’
সাহিদা খাবার রেডি করছে। টেবিলে বসে অস্বস্তি হল জাহ্নবী’র। এই মহিলা তার সম্পর্কে কী যে ভাবছে, আন্দাজ করেই ওর দমবন্ধ লাগে। একদিকে পান্নাবাহার হৃদয়াঙ্গনে বসে দোতারা বাজিয়ে চলেছে। এমনই মন কেমনের ক্ষণ এসেছে তার জীবনে!
খাবার ঠিকমতো খেতে পারল না জাহ্নবী। বারবার চমকে উঠছে, এই বুঝি পান্নাবাহার এসে পড়ে। কিন্তু না, আর দেখা হল না তার সাথে। খুব সম্ভবত লোকটা জাহ্নবী’র দিকে তাকায়ও নি। সে একা একাই তাকে নিয়ে জল্পনা কল্পনা বুনে চলেছে। হায়রে ভাগ্য! কেন আবার দেখা করালি..
জাহ্নবীকে বিদায় দিতে তন্বী নিজেই এসেছিল ড্রয়িংরুমে। শেষবারের মতো পান্নাবাহারকে দেখার আক্ষেপ নিয়ে জাহ্নবী ফিরে এলো অফিসে।
ব্যস্ততায় কেটে গেল পুরোটা দিন। আনন্দ বেদনার কাব্য চলছে মনের থিয়েটারে। কাজকর্ম ভালো লাগছে না, ইচ্ছে করছে বাসায় গিয়ে লম্বা ঘুম দিতে।
নামাজকক্ষ থেকে আসরের নামাজ পড়ে বেরিয়ে জাহ্নবী ডেস্কের দিকে এগোচ্ছে, এমন সময় পান্নাবাহারকে দেখে থমকে দাঁড়াল।
সে এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনাকেই খুঁজছিলাম। ফাইলটা দিতে এসেছিলাম আমি।’
জাহ্নবী অনেক্ষণ কথা বলতে পারল না। ওড়নায় আবৃত তার মাথা, কেবল উন্মুক্ত মুখমণ্ডল, ভীষণ বিশুদ্ধ দেখাচ্ছে তাকে। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না সে।
পান্নাবাহার নিজেই বলল, ‘নাদির আপনার ফোনে কল করেছিল, পাচ্ছিল না।’
অনেক্ষণ পর ইতস্তত গলায় জাহ্নবী বলল, ‘ড্রয়ারে ছিল ফোন। আমি আসলে..’
‘নিন।’
জাহ্নবী ফাইলটা হাতে নিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ।’
‘ওয়েলকাম।’
ফাইলটা দিয়ে চলে যেতে উদ্যত হল পান্নাবাহার। জাহ্নবী’র গা শিউরে উঠল। ধীরপায়ে ডেস্কে এসে বসলো সে। মুহুর্তের জন্য চারপাশ থেকে সবকিছু ভীষণ অপরিচিত হয়ে উঠল তার কাছে। দুহাতে মুখ ঢেকে আপনমনে জাহ্নবী বলল, ‘কেন আমার সঙ্গে এমন হচ্ছে? এত বছর কেন মন তুই অবাধ্য হোস নি? এই বয়সে এসে তোর কী এমন করা মানায়?’
চলবে..
উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ৩০
লেখাঃ মিশু মনি
‘মেয়েদের সমস্যাটা কোথায় বলো তো? প্রেম হওয়ার এক দু’মাস যেতে না যেতেই তোমরা বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লাগো?’
আরজু’র কাছ থেকে এমন কথা কখনোই আশা করেনি সামার। আরজু সবকিছু ভালো বোঝে, সামারের সম্পর্কে সে ভালোভাবেই অবগত। তবুও রাগের কপট স্বরে আরজু এমন কথা বলে বসবে সেটা নিতান্তই দুঃখজনক।
সামার বলল, ‘ বিয়ের প্রসঙ্গ কে আগে তুলেছিল আরজু? তুমি না আমি?’
‘আমিই তুলেছিলাম। সেটা তো কথার কথা। আমি বলতেই পারি, আমরা কবে বিয়ে করবো? তাই বলে তুমিও এমন লাফালাফি শুরু করে দেবে সেটা আমার অজানা ছিল।’
‘আমি লাফালাফি করছি না মোটেও। তুমি তোমার সময়মত সবকিছু কোরো। এখন যেহেতু অর্ণব ভাইয়াকে তোমার ব্যাপারে বলে ফেলেছি, সঙ্গে বাবা মাকেও জানাতে বলেছি। ওনার সঙ্গে তুমি অন্তত দেখা করো। তারপর বাসায় কথা বলতে হলে আমি সেটা ম্যানেজ করবো।’
আরজু দুই হাত জোর করে বলল, ‘প্লিজ মাফ করো। এইমুহুর্তে আমি কোনো পারিবারিক ঝামেলায় যেতে পারবো না। আমি এমনিতেই নানান ধরনের টেনশনে আছি। আমাকে কিছুদিন সময় দাও।’
সামার হতবাক হয়ে রইল অনেক্ষণ। আরজু এমন অসহায় ভঙ্গীতে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে, এটা অপ্রত্যাশিত। নিজেকে সামলে নিয়ে সামার বলল, ‘ তোমাকে তো আজকেই বিয়ে করতে বলছি না। আজকে অর্ণবের সঙ্গে দেখা করতেও আপত্তি আছে?’
‘অর্ণবও তোমাদের ফ্যামিলি মেম্বারের মধ্যেই পড়ে। এখন ফ্যামিলির ব্যাপার গুলো নিয়ে কথা না বললেই নয়?’
সামার আর কথা বাড়ানোর প্রয়োজন মনে করলো না। আরজুকে মুক্ত করে দেয়া উচিৎ তার। যতটা মুক্ত করে দিলে ঘুরেফিরে তার কাছেই ফিরে আসতে হবে। বিয়ের মতো একটা ব্যাপারকে জোর করে কারও ওপর চাপিয়ে দেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও নেই সামারের।
খানিকটা সময় নিরবে কেটে যাওয়ার পর আরজু বলল, ‘কিছু খাবে না? অর্ডার দাও?’
সামার মেন্যুতে চোখ বুলিয়ে দুই কাপ কফি’র অর্ডার দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল। ভেতরে রাগ গর্জে উঠছে তার। জনবহুল রেস্টুরেন্টে বসে আরজুর সঙ্গে তিরিক্ষি মেজাজে কথা বলার মতো অপরাধ সে করবে না। আরজু মাথা গরম টাইপের ছেলে। পাছে হিতের বিপরীত হয়ে যাবে।
দুজনে চুপচাপ কফি শেষ করে উঠে যেতে উদ্যত হল আরজু। সামারের হাতের ওপর হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘তোমাকে তো জোর করে বিয়ে দিচ্ছে না। বিয়ে নিয়ে বাসায় এখন কোনো প্রেশার নেই। কাজেই আমরাও নিজেদের মতো কিছুদিন সময় কাটাই, তারপর এই সিদ্ধান্তে আসি? আমার ওপর ভরসা রাখো সামার। আমি তোমাকে ভালবাসি।’
শেষ লাইনটা শুনে বুকের ভেতর কোথাও যেন রিনঝিন বাজনা বেজে উঠল। সেই পুরনো সুর! যতবারই আরজু তাকে মুখ ফুটে ভালবাসি বলেছে, আপন রঙে এই সুর বেজে উঠেছে সামারের হৃদয়ে। আজ মন খারাপের ক্ষণেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই একটা বাক্য কীভাবে এত শক্তিশালী হয়, তা জানা নেই সামারের।
আরজু উঠে এসে সামারের কপালে আলতো চুম্বন করে বলল, ‘আজ আমাকে উঠতে হবে। জরুরি কাজ আছে লক্ষিটি।’
‘ঠিক আছে। যাও।’
‘রাগ করে আছো?’
‘না।’
‘তোমাকে রিকশায় তুলে দেই?’
‘না। তুমি যাও। আমি আরও কিছুক্ষণ এখানে বসে থাকবো।’
‘তাহলে আমিও থাকি?’
‘তোমার তো জরুরি কাজ আছে।’
‘আমার কাজ নিশ্চয়ই তোমার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ নয়।’
পুনরায় নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল আরজু। সামারের হাত মুঠোয় চেপে রইল সে। নানান ঢঙে প্রেমের কথা বলে প্রেমিকার মন ভালো করে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল।
সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে বেরিয়েই সামার’কে ফোন করল অর্ণব। আনন্দমুখর কণ্ঠে বলল, ‘আমি এখন থেকে সারা রাত ফ্রি আছি ম্যাডাম। কিছু কথা বলবেন বলেছিলেন?’
সামার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘না ভাইয়া। আজকে আর বলার নেই কিছু। অন্য একদিন বলবো।’
‘এর আগেও একটা কথা বলবেন বলে আর বলেন’নি কিন্তু।’
‘সেটা আর শোনার প্রয়োজন নেই আপনার।’
সামার ফোন রেখে দিলো। সে জানতেও পারল না, ফোনের বিপরীত দিকে থাকা মানুষটা কী ভীষণ হতাশ হয়েছে৷ আজ তার সঙ্গে দেখা হবে ভেবে অর্ণব বেলীফুলের মালা কিনে সযত্নে পকেটে রেখে দিয়েছিল। পকেটেই দুমড়ে মুচড়ে গেল সেই ফুল!
বিছানায় শুয়ে আছে জাহ্নবী। অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘর। মশার গুণগুণানী ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই এখানে। বুকে বালিশ জড়িয়ে রেখে জাহ্নবী ঘুমানোর চেষ্টা করছে দুই ঘন্টা যাবত। কিছুতেই ঘুম আসছে না। তন্দ্রাঘোর ও পান্নবাহারের ঘোর, দুইয়ে মিলে এক আজব জটিলতায় ভুগছে সে। নিজেকে বারবার বোঝাতে চেষ্টা করছে, আজকে যা কিছু ঘটেছে, সবই সত্যি। তবুও তার মনে হচ্ছে, আজকের দিনটা একটা স্বপ্নময় দিন। পান্নাবাহারের সঙ্গে তার দেখাই হয়নি। এই ঘোর নিয়ে বেশিক্ষণ শান্তিতে থাকা যায় না।
ফোন বেজে উঠল। ভায়োলেট কল দিয়েছে। জাহ্নবী রিসিভ করতেই গাড়ির হর্ন ভেসে এল। ভায়োলেটের কণ্ঠ চাপা পড়েছে সেখানে।
‘হ্যালো আপু..’
‘ শুনতে পাচ্ছিস?’
‘হ্যাঁ। আপু আমি আসছি। আর দশ মিনিট লাগবে। তুমি বাসায় আছো তো?’
‘হ্যাঁ বাসায় আছি। চলে আয়। খুব ভালো হবে।’
‘আপু, আমি বাজারে আছি। কিছু লাগবে তোমার?’
‘না।’
‘কই মাছ নিয়েছি। নতুন আলু দিয়ে কইমাছের ঝোল রান্না করবে। বাসায় নতুন আলু আছে?’
‘ না, নেই।’
‘আমি নিয়ে আসছি তাহলে। তুমি ফাস্টফুড খাবে?’
‘ তোর কিছু খেতে ইচ্ছে করলে নিয়ে আয়।
‘আচ্ছা’ বলে ফোন রেখে দিলো ভায়োলেট। জাহ্নবী ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিলো। আলোর স্ফুরণে ঘোর খানিকটা কেটে গেল তার। ভায়োলেট এলে অনেক মজা হবে। ওর গল্প শুনে রাত কাটিয়ে দিতে পারবে জাহ্নবী। পান্নাবাহারকে নিয়ে ভেবে ভেবে অস্বস্তিতে মরে যেতে হবে না তার।
ঠিক দশ মিনিটের মাথায় চলে এল ভায়োলেট। চিকেন মোমো ও বার্গার নিয়ে এসেছে। এক হাতে তরতাজা কই মাছ ও নতুন আলু। জাহ্নবী মাছগুলোকে রান্নাঘরে রেখে এসে বলল, ‘রাতে থাকবি তো?’
‘ হ্যাঁ। কাল তো অফিস নেই তোমার। বসো আপু, আগে গরম গরম খেয়ে নিই।’
নাস্তা খেতে খেতে আড্ডায় মেতে উঠল ওরা। জাহ্নবী কই মাছের ঝোল রান্না করছিল আর পাশেই দাঁড়িয়ে গল্প শোনাচ্ছিল ভায়োলেট। এক পর্যায়ে জাহ্নবী জানতে চাইলো, ‘হ্যাঁ রে ভায়োলেট, রুশো এখন কোথায়?’
ভায়োলেট খানিক্ষণ পলকহীন চোখে জাহ্নবীকে দেখল। চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠল তার। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘জানি না!’
‘জানিস না! রুশোর সঙ্গে শেষ কবে কথা হয়েছে তোর?’
ভায়োলেট অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। রুশোর কথা মনে হলেই আপনার জগত থেকে দূরে সরে যায় সে। চলে যায় রুশোর স্বপ্নীল জগতে। যে জগতে ভায়োলেটের জন্য ছিল মহিমাময় প্রেম, ঈর্ষান্বিত হবার মতো আবেগ। এখনো সেই প্রেমের ছোঁয়া লেগে আছে ভায়োলেটের দেহ ও মন জুড়ে।
জাহ্নবী বলল, ‘আচ্ছা থাক, বলতে হবে না। রাতে শুনবো।’
ভায়োলেট ম্লান হাসলো। খেয়েদেয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল ওরা দু’বোন। জাহ্নবী ভায়োলেটকে জড়িয়ে ধরে জানতে চাইলো, ‘সেদিনের পর কী হয়েছিল রে? ও তোকে খাতায় আই লাভ ইউ লিখে দিয়েছিল। তারপর?’
ভায়োলেট মুচকি হেসে বলল, ‘সেই দিনগুলো এত সুন্দর ছিল রে আপু! এত সুন্দর.. আমি কল্পনাতেও এত সুন্দর দিনের কথা ভাবতে পারতাম না। রুশো আমাকে সেইসব আনন্দ এনে দিয়েছিল। ওইদিন রাতে আমি বাসায় ফিরে আম্মুর মোবাইল নিয়ে আসি। অনেক দুঃসাহস হয়েছিল আমারও। তুমি বাড়িতে ছিলে না। মেজো আপু পড়তে বসেছিল। আমি আম্মুর ফোন নিয়ে ছাদে চলে যাই। এক ঘন্টা কথা হয় রুশো’র সঙ্গে। রুশো আমাকে সেদিন বলেছিল প্রথম দেখাতেই আমার জন্য ওর মনে কী ধরনের ফিলিংস হয়েছিল। এক মুহুর্তের দেখাতেই ও আমাকে এত প্রবলভাবে ভালবেসে ফেলেছিল, আমি সব কথা শুনতে শুনতে কেঁদে ফেলি। ও জানতে চাইলো, কাঁদছো কেন?’
‘কাঁদছি কই?’
‘আমি তো নাক টানার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। গলাটাও ভেজা ভেজা।’
‘গলা ভেজা না, গাল ভিজে গেছে।’
‘গলার স্বরটা ভেজা ভেজা শোনাচ্ছে রে পাগলী।’
‘আমাকে পাগলী বলবে না।’
‘একশবার বলবো। এখন বলো কাঁদছো কেন?’
‘আমি নিচে যাবো এখন। হয়তো এতক্ষণে আমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে। আম্মুর ফোনটা দিয়ে আসতে হবে। আর কথা হবে না। আবার কখন, কবে কথা বলতে পারবো আমি জানিনা। আমার খুব ছটফট লাগছে। অস্থির অস্থির লাগছে। এমন কেন হচ্ছে আমার?’
রুশো মধুর গলায় বলল, ‘ওরে আমার পাগলীটা রে। আমার সঙ্গে কথা বলতে না পারলে তোমার কষ্ট হবে?’
‘ খুব হবে। আমার খুব অস্থির লাগছিল। পুরোটা দিন আমি শুয়ে ছিলাম। অনেক কেঁদেছি। আপনার জন্য মন কেমন করছিল। আপনার কাছে যেতে ইচ্ছে করছিল। অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। আমি থাকতে পারিনি, তাই আম্মুর ফোনটা নিয়ে এসেছি।’
‘আমার মনটাকেও এবার এলোমেলো করে দিলে তুমি। শোনো, তুমি রুমে যাও। আজ রাতে তুমি আমার সাথে দেখা করতে পারবে?’
অবাক হয়ে ভায়োলেট জানতে চাইলো,, ‘কীভাবে!’
‘ তোমাদের বাসায় দাঁড়োয়ান আছে?’
‘হ্যাঁ আছে।’
‘ ওকে। বাসার ছাদে আসবে তুমি। পারবে?’
‘ পারবো। ছাদের চাবি আছে। কিন্তু আপনি আসবেন কীভাবে? ‘
‘ সেটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। রাত ঠিক সারে বারোটায়। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তুমি ছাদে আসবে।’
ভায়োলেট আরও অস্থির হয়ে উঠল। বাসার ছাদে রুশো কীভাবে আসবে, সবাইকে ফাঁকি দিয়ে এত রাতে সে নিজেই বা কী করে ঘর থেকে বের হবে, যদি কারও হাতে ধরা পড়ে যায়! শত দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে রইল ভায়োলেট। মুহুর্তের জন্যও রুশোকে নিয়ে তার মনে বাজে চিন্তা আসেনি। অচেনা একটা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যাবে, সেটাও মাথায় আসেনি। রুশো তার অচেনা মানুষ নয়, হাজার বছরের চেনা একজন।
সে রাতে খেতে পারল না, পড়াশোনায় মনযোগ দিতে পারল না। পুরোদস্তুর অসুস্থ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল সে!
রাত বারোটায় পা টিপে টিপে ছাদে এলো ভায়োলেট। ছাদের দরজা খোলাই ছিল। পাঁচতলা বাড়ির দোতলায় তারা থাকে। তাকে আরও দুইটা ফ্ল্যাটের দরজা পেরিয়ে আসতে হয়েছে। কেউ দেখে ফেললে কঠিন দুঃখ পেতে হবে তাকে। হারাতে হবে রুশোকেও।
কিন্তু না, তাকে অবাক করে দিয়ে রুশো বাসার ছাদে এসে হাজির! ভায়োলেট নিজেকে সামলাতে পারেনি। ছোট্ট মেয়েটি রুশোকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল।
রুশো ওর মুখখানা ধরে বলেছিল, ‘কাঁদিস না পাগলী। আর কখনো এভাবে ছাদে আসতে বলবো না। আমরা চিঠি লিখবো ঠিক আছে? তুই আমাকে চিঠিতে সব লিখবি, তোর মনে যত কথা আছে সব। আমিও লিখবো। এতটা বছর আমি কিভাবে কাটিয়েছি, কিভাবে প্রত্যেকটা রাত ঘুমানোর আগে তোকে নিয়ে ভেবেছি, সব বলবো তোকে। খুব সাবধানে রাখবি আমার চিঠি গুলো। এইযে এইটা প্রথম চিঠি।’
রুশো ভায়োলেটের হাতের মুঠোয় একটা চিঠি ভরে দিলো। চোখের জলে সিক্ত হচ্ছে কিশোরী ভায়োলেট। কয়েক ফোঁটা অশ্রুর সাক্ষী হয়েছিল চিঠি’টা। কেন সেদিন ওভাবে কেঁদেছিল তার রহস্য আজও খুঁজে পায় না সে!
জাহ্নবী ভায়োলেটকে জড়িয়ে ধরে আছে এখনও। রুশোর কথা শুনতে শুনতে তার নিজেরই ভীষণ আপন মনে হচ্ছে রুশোকে। ভায়োলেটের হাত খপ করে ধরে জাহ্নবী জানতে চাইলো, ‘সেদিন কেউ টের পায়নি তো?’
‘না। আমি পা টিপেটিপে রুমে চলে এসেছিলাম। কেউ কিছু টের পায় নি। তারপর ঘরে এসে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় রুশোর চিঠিটা মেলে ধরি।’
‘ইস! কী সুন্দর অনুভূতি রে। কী ছিল চিঠিতে?’
‘চিঠিতে কী ছিল তা আমি মুখে বলতে পারবো না। তবে হৃদয়ের সমস্ত আবেগ উজাড় করে দিয়ে ও লিখেছিল। চিঠি পড়ে নতুন করে প্রেমে পড়েছিলাম আমি। ওইদিন রাতে বালিশে মুখ গুঁজে অনেক কেঁদেছি। কিশোরী ছিলাম তো, বাচ্চা মেয়ে। আবেগে ভরপুর ছিলাম। অল্পতেই কেঁদে ফেলতাম। এখন তো ভাবলেও হাসি পায়।’
জাহ্নবী উদাস গলায় বলল, ‘আমার একটুও হাস্যকর মনে হচ্ছে না। তোদের প্রেমের গল্পটা আসলেই ঈর্ষান্বিত হবার মতো ছিল।’
‘গল্প তো আরও বাকি আছে আপু। এটা তো দ্বিতীয় দিনের গল্প শুনলে। রুশো কিভাবে ছাদে উঠলো সেটা তো শোনোই নি। আরও বহু বহু গল্প জমে আছে আমার ভেতরে। সযত্নে আগলে রেখেছি। শুধু রুশোকেই রাখতে পারিনি।’
‘রুশোর কী হয়েছে বলবি না?’
‘বলবো। সব বলবো।’
চলবে..
উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ৩১
মিশু মনি
ভায়োলেটের উঠতি যৌবন, চেরীফুলের ন্যায় বিশুদ্ধ ও নির্মল আবেগে ভরপুর। তার সমস্ত আবেগ উথলে উঠল চিঠিতে। রুশোর কাছে নিজেকে জগতের শ্রেষ্ঠ প্রেমিকা হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা চালিয়ে গেল সে।
চিঠির মাধ্যমেই কথা চলতে লাগল দুজনের। যে কথা না বললে অস্থিরতা কমে না, যে কথা ভাবলেই বুকের ভেতর টালমাটাল স্রোত বইতে থাকে, যে কঠিন অপেক্ষায় কেটেছে রুশো’র চারটা বছর – সমস্তকিছুই লিখে ফেলল চিঠিতে। রোজ রাতে ভায়োলেট পড়াশোনা শেষ করে নিয়ম করে চিঠি লিখতে বসতো।
প্রায়ই হুটহাট সে ভায়োলেটকে চমকে দিতো। কলেজ থেকে বেরিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছে ভায়োলেট, হঠাৎ পাশে রুশোর গলা শুনতে পেতো। সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গীতে যে জানতে চাইতো, ‘চেয়ারে বসবে নাকি ঘাসের ওপর?’
ভায়োলেট চমকে মুখ ঘুরিয়ে রুশোকে দেখে চোখ বড়বড় করে ফেলত। রুশো বলত, ‘মানে রেস্টুরেন্টে বসবে নাকি খোলা আকাশের নিচে কোথাও?’
ভায়োলেট মুচকি হেসে রুশোর বাহু চেপে ধরে বলত, ‘তুমি আসবে বলো নি তো?’
‘ বলে আসতে হবে?’
‘ যদি আমি আজকে কলেজে না আসতাম।’
‘ গত রবিবার তো আসোনি। আমি যে দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করে ফিরে গেছি, তারপর যখন শুনেছি তুমি কলেজে আসোই নি, আমি কী কিছু বলেছি?’
ভায়োলেট ভীষণ অবাক হয়ে বলতো, ‘সে কী! তুমি রবিবার এখানে এসেছিলে? আমাকে বলোনি কেন?’
‘সব কিছু বুঝি তোমায় বলতে হবে?’
‘এই কাঠফাটা রোদে অপেক্ষা করবে আর আমাকে বলতে হবে না?
‘কাঠফাটা রোদ, রুশোর তালুফাটা রোদ তো নয়।’
‘মারবো রুশো। খুব মারবো তোমাকে।’
‘রাস্তায় মেরো না, লোকজন আমাকে ইভটিজার ভাব্বে।’
‘চুপ।’
ভায়োলেট কিঞ্চিৎ অভিমান করতো। রুশোর হাত ছেড়ে দিয়ে সে নিজের মতো হাঁটত। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মনে হতো, এই পথচলা প্রশান্তির। যেন স্বর্গের উদ্যান বেয়ে হেঁটে চলেছে দুজনে। ঢাকা শহরের কোলাহল, ফুটপাতে ভীড় ঠেলে যাওয়া মানুষ, হকারের বেচাকেনার সুর, সবকিছুই ভালো লাগার পরশ মেখে দিতো।
একদিন খুব ভোরে ভায়োলেট বাড়ির পাশে পার্কে দৌড়ানোর জন্য বেরিয়েছিল। গাছের পাতায় শাড়ির মতো জড়ানো কুয়াশা দেখে মুগ্ধ হয়েছিল সে। রুশোকে চিঠিতে জানিয়েছিল সেই কথা। দুদিন পর সে আবার যেদিন পার্কে এলো, আচমকা রুশোকে দেখে হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। সঙ্গে ছিল মেজো আপু সামার। ভায়োলেট ইশারায় রুশোকে বলল, ‘আমার বড় আপু।’
খানিক বাদে রুশো সামারের সামনে এসে হাজির। জানতে চাইলো, ‘আপু, এই ইয়োগা আমাকে শেখাবেন?’
সামার চোখ তুলে রুশোকে এক পলক দেখে নিলো। রুশো হাসিমুখে বলল, ‘আমি রুশো। আপনাকে আপু ডাকতে পারি? এই ইয়োগা শেখার অনেক ইচ্ছে আমার। যদি আপনার আপত্তি না থাকে।
ঝাকড়া চুলের রুশোকে দেখে সামারের মন গলে গিয়েছিল বটে। সামার বড্ড মিশুক একটা মেয়ে। রুশোকে ইয়োগা শেখাতে শেখাতে দুজনের দারুণ ভাব জমে গিয়েছিল। রুশো ভায়োলেটের সঙ্গেও পরিচিতি হল। ভাবটা এমন, আজকেই প্রথম দেখা তাদের। এরপর থেকে প্রায়ই মেজো আপুর সঙ্গে রুশোর দেখা হতো। দুজনে একসঙ্গে ইয়োগা করত, পাশে দাঁড়িয়ে থাকত ভায়োলেট।
যেদিন সামার অনেক বেলা অবধি ঘুমাতো, ভায়োলেট একাই বেরিয়ে পড়ত জগিংয়ে। সেদিন দুজনে শিশির ভেজা ভোরে একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে মন খুলে কথা বলতো। কতই না মধুর ছিল সেই সকালগুলো! ভায়োলেটের খুব ইচ্ছে করে এমন সকাল গুলো আবার ফিরে পেতে।
জাহ্নবী একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘ তোর রুশোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে রে আমার।’
‘ রুশোর সঙ্গে আমার কৈশোরের প্রেম। এতটা মায়ায় ভরা! ও আমাকে অসংখ্য সারপ্রাইজ দিতো আপু। আমরা হাসতে হাসতে পথ চলতাম। বৃষ্টিতে পলিথিন গায়ে মুড়িয়ে রিকশায় চেপে ঘুরতাম। ও আমাকে চমকে দিতো খুব। কখনো কখনো আমার ক্লাস রুমে এসে হাজির হতো। বলত, আতিক নামে একজনকে খুঁজতে এসেছি। এখানে কি আতিক নামে কেউ আছে? আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চলে যেত। এত পাগলামি করত এই ছেলেটা।’
ভায়োলেট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কৈশোর পেরিয়ে তার ধীরেধীরে যৌবনে পদার্পণ। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে লম্বা ছুটি পেয়েছিল সে। সেবার গ্রামে ঘুরতে গিয়েছিল। গ্রাম থেকে রুশোকে চিঠি লিখেছিল একবার। একদিন রুশো সেই গ্রামে এসে হাজির!
গ্রামের মেঠোপথ ধরে তারা একসঙ্গে হেঁটেছে, রুশো ধানক্ষেত থেকে ধানের শিষ ছিঁড়ে তার বেণীতে দুলিয়ে দিয়েছে। সে এক অন্যরকম গল্প!
জাহ্নবী জানতে চাইলো, ‘কীভাবে রে? তোর পরীক্ষার পর তুই আর আম্মু যশোরে গিয়েছিলি তাইনা? ওখানে রুশো কিভাবে গেল?’
ভায়োলেট হেসে বলল, ‘ চিঠি পোস্ট করেছিলাম যেই ঠিকানা থেকে, সেখানে এসে হাজির। কীভাবে যেন বাড়িও খুঁজে বের করেছে। একদিন বিকেলে নানুভাইয়ের সঙ্গে বসে নারকেল দিয়ে ছাতু খাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি রুশো আসছে। সঙ্গে একটা লোক। আমি তো চিৎকার দিতে দিতে নিজেকে সামলেছি। লোকটা এসে নানুভাইয়ের সঙ্গে রুশোকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এই ছেলেটা একটা কাজে এসেছে। কিছুদিন থাকবে এখানে। আপনার গল্প শুনেছে যেন কার মুখে। তাই এসেছে আপনার সঙ্গে দেখা করতে। পরে মনে হল, নানুর গল্প আমিই করেছিলাম ওর কাছে। ও নানুভাইয়ের নাম জানতে চেয়েছিল, আমি নামও বলেছি। তখন কী আর জানতাম এই পাগলটা নানুবাড়ি খুঁজে বের করবে।’
ভায়োলেট পুরনো স্মৃতি স্মরণ করে হেসে উঠল। জাহ্নবীও হাসছে। কিছু প্রেম এত সুন্দর হয়! ছবির মত দেশ বলে যেমন একটা কথা আছে, তেমনই এ যেন গল্পের মতো প্রেম।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চোখ ভিজে উঠতে লাগল ভায়োলেটের। রুশোকে নানুভাই খুবই পছন্দ করেছিলেন। ওর মতো মিশুক একটা মানুষকে পছন্দ না করে থাকতে পারে বুঝি কেউ?
রুশো নানুভাইকে দেশ বিদেশের প্রাচীন ইতিহাসের গল্প শোনাতো। ফলে লাভ হল একটা। নানুভাই রুশোর সঙ্গে গল্প করার জন্য দুদিন পরপরই রুশোকে ডেকে পাঠাতেন। আড়ালে দাঁড়িয়ে ভায়োলেট রুশোকে দেখত। চোখ বুজলেই মনে হত, সে রুশোর বুকে উষ্ণ আদরের স্পর্শ পাচ্ছে। কখনো নানুভাইয়ের পাশে বসে সেও মন্ত্রমুগ্ধের মতো রুশোর গল্প শুনতো।
‘সেবার ছুটিতে দুজনে স্বপ্নের মতো দিন কাটিয়েছিলাম!’ বলতে বলতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ভায়োলেট।
জাহ্নবীর বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল সে। জাহ্নবী কখনো ভায়োলেটকে কাঁদতে দেখে নি। হতবিহ্বল হয়ে ভায়োলেটের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সে বলল, রুশো তোকে অনেক ভালবাসত তাই না রে?
‘ বুঝতে পারছ না এখনো? বেশী ভালবাসা সবসময় সুখের কারণ হয়না রে আপু।’
‘ তোরা কেন আলাদা হয়ে গেলি ভায়োলেট?’
‘ খুব তুচ্ছ একটা কারণে। খুব ছোট্ট একটা গল্প। শুনলে তুমি বলবে, এমন তুচ্ছ কারণে কেউ কাউকে ছেড়ে চলে যায় নাকি? কেউ কেউ যায়। রুশো খুব অভিমানী, জেদী। সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক গুলো হয়ত তুচ্ছ কারণেই ভেঙে যায়। কিন্তু আমার মনে হয় কী জানো আপু? এখনো রুশো আমার। যেন ও আমাকে ঘিরে রেখেছে সবসময়। ওর ভালবাসার স্পর্শ এখনো অনুভব করি আমি। ও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে এটা কখনো মনেই হয় না।’
জাহ্নবী বলল, ‘কাঁদিস না লক্ষী বোন আমার। আমি তো জানিনা কী কারণে তোরা আলাদা হয়ে গেছিস। কারণটা আমাকে বলা না গেলে বলিস না। কিন্তু তুই রুশোকে যেভাবে এখনো অনুভব করিস, আমার মনেহয় সেও তোকে একইভাবে মিস করে।’
ভায়োলেট ডুকরে কেঁদে উঠল, ‘এত দিন হয়ে গেল আপু! ও আমাকে মিস করলে ঠিকই একবার আমার কাছে আসত ই। যতই রাগ থাকুক, কষ্ট থাকুক। ঠিকই আসতো। আমাকে ও যেভাবে ভালবাসতো, তাতে কখনো এতদিন রাগ করে থাকা যায় না।’
‘ও হয়তো কোনো সমস্যায় জড়িয়ে আছে। ভুল বুঝিস না।’
‘ মাঝেমাঝে আমিও তাই ভাবতাম। এখন আর ভাবি না। কখনো মনেহয়, রুশো হয়তো আমাকে ভুলে যেতে পেরেছে। হয়তো কাউকে বিয়ে করে সুখে সংসার করছে।’
‘ভায়োলেট!’
‘ যখন ভাবি যেখানে আমার থাকার কথা ছিল সেখানে রুশোর সাথে অন্য কেউ, আমি ভাবতে পারি না কিছু।’
জাহ্নবী বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। চোখ মুছল ভায়োলেট। উঠে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এসে বসলো। ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘আপু, এত রাতে কি চায়ের দোকানটা খোলা আছে?’
‘আমি চা করে দেই?’
‘আচ্ছা দাও। চিনি বেশী করে দেবে।’
জাহ্নবী চমকে উঠলো। তার পান্নাবাহারের কথা মনে পড়ে গেল। পান্নাবাহার চায়ে চিনি বেশী খায়। তার গোলগাল মুখটা ভেসে উঠছে জাহ্নবী’র চোখের সামনে।
রান্নাঘরে ঢুকে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল জাহ্নবী। রুশোর মতো পাগল প্রেমিকের কথা মনে পড়ছে তার। কী এমন তুচ্ছ কারণে ওরা এত কষ্ট পাচ্ছে? ভায়োলেট যতটা কষ্ট পাচ্ছে, একই কষ্ট কী রুশোও পায় নি?
ভায়োলেটের কথা শুনে মনে হচ্ছে রুশোর সঙ্গে তার বেশ আগেই বিচ্ছেদ হয়েছে। যখন রুশো তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে, কীভাবে সহ্য করছিল মেয়েটা? কতটা কষ্ট হয়েছিল তার, ভাবতেই জাহ্নবীর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। আজ রাতে রুশোর প্রসঙ্গে আর একটা কথাও বলবে না ভেবে মনস্থির করল সে।
চা নিয়ে এসে জাহ্নবী দেখল ভায়োলেট ঘুমিয়ে পড়েছে। খুব দ্রুত মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়তে পারে। এতদিন ধরে ভায়োলেটের ঘুমন্ত মুখ দেখে জাহ্নবী’র মনে হতো, ভায়োলেট জগতের সবচেয়ে সুখী মেয়ে। তার মতো করে ঘুমাতে না পারার আক্ষেপ হতো তার। এই প্রথম ভায়োলেটকে দেখে জাহ্নবী’র মনে হচ্ছে, মেয়েটা ভীষণ দুঃখী। ওর চোখে ঘুম নয়, দুঃখ লেগে আছে।
চলবে..