মেঘফুল পর্ব-৩৮+৩৯+৪০

0
295

উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ৩৮
লেখাঃ মিশু মনি

জাভেদ আলীকে সঙ্গে নিয়ে আলোচনায় বসেছে তার দুই মেয়ে জাহ্নবী ও ভায়োলেট। কথা শুরুর আগেই ক্রমাগত ঘামছে জাহ্নবী।

ভায়োলেট আগে মুখ খুলল, ‘বাবা, তোমাকে একটা কথা বলবো। রাগ করতে পারবে না।’
‘রাগ করার মতো কথা তোরা বলবিও না আমি জানি।’ হেসে উত্তর দিলেন জাভেদ আলী।

ভায়োলেট এক পলক জাহ্নবীর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বাবা, আজকের কথাটা রাগ করার মতোই। আমি জানি এটা তোমাকে বলা ঠিক হবে না, কিন্তু তুমি ছাড়া তো আর কেউ নেই বলার মতো।’
‘আহা না বললে বুঝবো কীভাবে মা?’
‘বাবা আমি একটা ব্যবসা করতে চাই।’
‘ব্যবসা করবি! তুই?’
‘হ্যাঁ। আমি আর আপু দুইজন মিলে। জাভেদ আলী দুই মেয়ের মুখের দিকে তাকান। জাহ্নবী ঘামছে এখনও। বাবার খুব কাছের হয়েও তাকে ভীষণ ভয় পায় সে।
ভায়োলেট বলল, ‘আমার পুরো বিজনেস প্লান রেডি। দুই বছর ধরে এটাকে গড়ে তুলেছি। তুমি কী শুনতে চাও?’

জাভেদ আলী উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ‘অবশ্যই শুনতে চাই। আমার দুই মেয়ে আমার কলিজার টুকরা। তারা বিজনেস করবে আর সেই আইডিয়া আমি শুনবো না?’
‘বাবা, আগে বলো আমাদের ওপর তোমার ভরসা আছে তো?’
‘এতদিন পরেও তোরা বুঝতে পারছিস না আমার তোদের ওপর ভরসা আছে কী না?’

জাহ্নবী বলল, ‘আব্বু, আমরা সবসময় যা করতে চেয়েছি, তুমি আমাদেরকে সেটারই অনুমতি দিয়েছো। আমি অনেক বিয়ে ভেঙে দিয়েছি, তুমি কখনো কিছু বলো নি। কিন্তু এখন যেটা বলবো সেটা শোনার পর হয়তো ভাব্বে এটা আমাদের ছেলেমানুষী আবদার। আসলে এটা কোনো ছেলেমানুষী নয়। এই আইডিয়া সফল হলে আমাদের সমাজের উন্নতিতে যেমন কাজ করবে, তেমনই ভায়োলেটের এতদিনের গড়ে তোলা স্বপ্নটাও পূরণ হবে।’

জাভেদ আলীর চোখে ও মুখে তীব্র কৌতুহল ফুটে উঠল। মেধাবী মেয়েদেরকে নিয়ে তিনি সবসময়ই গর্ববোধ করেন। তার মেয়েরা আর যাই করুক, কখনো অন্যায় আবদার করবে না, এই বিশ্বাস তার আছে।
ভায়োলেট তার পুরো ‘স্টার্টআপ’ পরিকল্পনা বাবাকে খুলে বললো। সবটা শুনে মাথা ঝাঁকালেন জাভেদ আলী। অনেক্ষণ গম্ভীর মুখে বসে থেকে তিনি আইডিয়া নিয়ে ভাবলেন। বাবার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে জাহ্নবী ও ভায়োলেট একে অপরের হাত চেপে ধরে আতংকিত হয়ে পড়ল।

জাভেদ আলী বললেন, ‘এই আইডিয়া তোর মাথায় এসেছে মা?’
ভায়োলেট বলল, ‘হ্যাঁ বাবা। তোমার ভালো লাগে নি?’
‘অনেক বড় আইডিয়া। এই বিজনেস দাঁড় করাতে অনেক অভিজ্ঞ লোকজন দরকার।’
‘আমার সবকিছু ঠিক করা আছে বাবা। কোন সেক্টরে কোন ধরনের লোক নিয়োগ দিতে হবে সব কিছু ভেবে রেখেছি।’
‘তাহলে তো ভালো। কিন্তু অভিজ্ঞ লোকদের বেতনও দিতে হবে অনেক।’
‘তা তো দিতেই হবে।’
‘কিন্তু মা, ব্যবসার শুরুতে সবাইকে বেতন দেয়ার মতো এত টাকা তো আসবে না।’

ভায়োলেট মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ বাবা। সেজন্য বেশী করে ইনভেস্ট করতে হবে। তুমি কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা করো না। আমার সব প্লান রেডি। শুধু ইনভেস্টমেন্ট পেলেই কাজটা শুরু করবো।’
‘ইনভেস্ট করতে কত টাকা লাগবে?’
‘প্রথম ধাপে বিশ লাখ লাগবে বাবা।’

জাভেদ আলী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘হুম। এরকম এমাউন্ট আমিও ভাবছিলাম। ইনভেস্ট করবে কে ব্যবসায়?’
জাহ্নবী মুখ খুলতে যাচ্ছিল। ভায়োলেট তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘বাবা, ইনভেস্টর পাচ্ছি না। আমরা তো নতুন উদ্যোক্তা, ব্যাংক থেকে লোন দেবে না আমাদের। আর আমার তো তেমন কেউ পরিচিত নেই যার কাছে এত টাকা চাইতে পারি।’
জাভেদ আলী গম্ভীর মুখে বললেন, ‘হুম। বুঝতে পারছি।’
‘একজনকে রাজি করানো যেত, উনি বেশী ইন্টারেস্ট চান। প্রতি মাসে যদি ব্যবসা থেকে এত পরিমাণে টাকা সুদ দিতে হয়, ব্যবসা করবো কী করে বলো?’
‘তাহলে কী করতে চাস মা? ব্যাংক হোক বা কোনো প্রতিষ্ঠান, ইনভেস্ট করলে তাদেরকে ইন্টারেস্ট দিতেই হবে।’
‘আমি কারও কাছে লোন নিতেই চাই না।’
‘তাহলে?’

জাভেদ আলী মেয়েদের মুখের দিকে তাকালেন। একজন বাবা জন্মের পর থেকে পরম আদরে মেয়েদের বড় করে তুলেছেন। এত বছর পর সেই মেয়ের মুখ দেখে ঘটনা বুঝতে তার অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। জাহ্নবী ও ভায়োলেটের মুখ দেখে তিনিও সবকিছু স্পষ্ট অনুধাবন করতে পারছেন।

খানিক্ষন চুপ থেকে তিনি বললেন, ‘তোদের কোনো ইচ্ছে তো কখনো অপূর্ণ রাখিনি মা।’
জাহ্নবী বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বাবা ভায়োলেট একদিন তোমাকে একটা ফ্ল্যাট নয়, একটা বাড়িই তৈরি করে দেবে দেখো। তুমি সবাইকে গর্ব করে বলবে, আমার মেয়ে অমুক কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা।’

জাভেদ আলী স্তব্ধ হয়ে থাকেন। জাহ্নবী বাবাকে জড়িয়ে ধরে আবেগপ্রধান হয়ে পড়ে। ভেজা গলায় বলে, ‘বাবা, তুমি ওকে ব্যবসা করার টাকা দাও। ও আমাদের সবাইকে রাজপ্রাসাদ বানিয়ে দেবে। ভায়োলেট অনেক ট্যালেন্টেড একটা মেয়ে।’
বলতে বলতে গলা ধরে আসে জাহ্নবী’র। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে থাকে। আর কিছু বলতে পারে না সে। ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ভায়োলেট কিছু বলে না, শান্ত হয়ে বসে থাকে বাবার পাশে। জাভেদ আলী কোনো কথা বলেন না।

কয়েক মুহুর্ত কেটে যায় নিরবে। ভায়োলেট স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘মাকে কিছু বলো না বাবা। রেগে যাবে।’
‘আচ্ছা।’
‘আমি আর কিছুক্ষণ তোমার পাশে বসে থাকি?’
জাভেদ আলী মাথা ঝাঁকান। তার মুখে কোনো শব্দ আসে না। মেয়েদের ওপর যথেষ্ট ভরসা করেন তিনি। কিন্তু এতগুলো টাকা দিয়ে দিলে তাদের ভবিষ্যতে আসলেই কী ঘটবে তা কেউ জানে না। শঙ্কা, দ্বিধা ও উত্তেজনা নিয়ে তিনি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন।

সকালে ঘুম ভাঙার পর জাহ্নবী ফোন হাতে নিয়ে দেখে, নাদির মেসেজ পাঠিয়েছে। জরুরি মিটিংয়ে বসতে চাইছে সে। আজকে ছুটির দিন। দুপুরে একসাথে খাবার খেয়ে আলোচনায় বসার নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। জাহ্নবী ঘুম লেপ্টে থাকা চোখ মুখে পানির ছিটা দিতে দিতে আয়নায় তাকিয়ে ভাবে, ‘আমার ভাগ্যে এ কোন অদ্ভুত পরিস্থিতি এসে জুটল! এক জীবনে যাকে দেখে আপন ভেবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম, তার সঙ্গে আমার কখনোই এক হওয়া সম্ভব না। সেই মানুষটার সঙ্গেই আমার বারবার মুখোমুখি হতে হবে। প্রকৃতি এভাবে খেলা না করলেও পারত।’

রেস্তোরাঁর এক কোণায় বসেছে তারা। পান্নাবাহারের পরনে সাদা পাঞ্জাবি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। জাহ্নবীর সঙ্গে আজ চোখাচোখি হল না তার।
আলোচনা শেষ করতে করতে বিকেল গড়িয়ে এলো। নাদির খুব দ্রুত অফিসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের ব্যবসায় নামবে। এখানে উপস্থিত সবাইকে পাশে চায় সে। জাহ্নবী’র বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘আমি পারবো না থাকতে।’ কিন্তু বলতে পারল না। প্রথমত, নাদির স্যারের দেয়া সম্মানকে তুচ্ছ করতে চায় না সে। আর দ্বিতীয়ত, তার অভিজ্ঞতার প্রয়োজন।

বিদায়ের সময় নাদির জাহ্নবীকে বলল, ‘আমার গাড়িতে চলুন, আপনার ওদিকেই যাচ্ছি। নামিয়ে দেবো।’
জাহ্নবী বারংবার ‘না, না’ বললে রীতিমতো জোর করেই জাহ্নবীকে গাড়িতে উঠতে বাধ্য করল নাদির। গাড়ি চালাচ্ছে পান্নাবাহার। পেছনের সিটে নাদিরের সঙ্গে বসলো জাহ্নবী।

নাদির অনেকটা সময় ব্যবসা নিয়ে কথা চালিয়ে গেল। হঠাৎ একটা ফোনকল আসায় কথায় বিরতি দিলো সে। ফোন রেখে বলল, ‘আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে। ভাইয়া, তুই ওনাকে নামিয়ে দিয়ে আসবি?’
‘আচ্ছা, দিয়ে আসবো।’

মুহুর্তেই গাড়ি থেকে নেমে গেল নাদির। জাহ্নবী অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেল। পান্নাবাহার গাড়ি চালু করে জানতে চাইলো, ‘কোথায় যাবেন যেন?’
জাহ্নবী উত্তর দিলো না। মাথা নিচু করে বিরক্তিভাব কাটানোর চেষ্টা করছে সে।
পান্নাবাহার আবারও জানতে চাইলো, ‘কোথায় যাবেন? কিছু হয়েছে?’
‘না তো।’
‘কথার জবাব দিচ্ছেন না।’
‘আপনি বরং আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন, আমি একটা গাড়ি নিয়ে চলে যাবো।’

পান্নাবাহার পেছন ফিরে তাকাল, ‘কেন?’
চোখাচোখি হল দুজনাতে। হঠাৎ জাহ্নবী’র বুকের মধ্যিখানে ধক করে ওঠে। সে মৃদুস্বরে উত্তর দেয়, ‘আপনাকে কষ্ট দিতে চাচ্ছি না।’
‘আপনি গাড়ি থেকে নেমে গেলে কী গাড়ি আমাকে একা একাই বাসায় পৌঁছে দেবে? আমাকে চালাতে হবে না?’
‘তা বলছি না। আবার অতদূর যাবেন..’
‘অতদূরটা কোথায় সেটা বলতে অসুবিধা কিসে? নাকি আমাকে বাসার ঠিকানা বলতে চান না? ভয় পাচ্ছেন? আরে বাবা বিনা দাওয়াতে যাবো না আপনার বাসায়।’
‘আমি কী সেটা বোঝাতে চেয়েছি?’
‘এখন তো সেটাই মনে হচ্ছে।’
‘বেশী বেশী মনে হচ্ছে। আপনার মেয়ে কেমন আছে?’
‘ভালো আছে। ও সবসময় ভালোই থাকে। হাসিখুশি, আনন্দমুখর।’

জাহ্নবী আর কিছু বলল না। পান্নাবাহার বলল, ‘গাড়ি এভাবে চলতে থাকলে ঢাকা পেরিয়ে যমুনায় গিয়ে পড়বো।’
জাহ্নবী মৃদুস্বরে বাসার ঠিকানা বলতে বাধ্য হল। বাসার কাছাকাছি পৌঁছে পান্নাবাহার জানতে চাইলো, ‘চা খাবেন?’

জাহ্নবী ক্ষণিকের জন্য হতভম্ব হয়ে যায়। এই সেই দোকান যেখানে প্রথমবার পান্নাবাহারকে দেখেছিল সে। আজ সেই দোকানেই পান্নাবাহার তাকে চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে!
জাহ্নবী উত্তর দেয়, ‘ না। এতদূর কষ্ট করে আসার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘ওয়েলকাম। ভাবলাম আপনার উছিলায় আমারও এক কাপ চা খাওয়া হবে। আজ আর খাওয়া হল না।’
বাসার সামনে গাড়ি দাঁড় করালো পান্নাবাহার। জাহ্নবী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নেমে গেল গাড়ি থেকে। পান্নাবাহার গাড়ি ঘুরিয়ে ইশারায় বিদায় জানালো তাকে। ভেতর থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে জাহ্নবী’র। প্রকৃতি এত অদ্ভুত খেলা খেলে কেন মানুষকে নিয়ে!

বাসায় প্রবেশের সাথে সাথেই ভায়োলেটের ফোন। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ভায়োলেট বলল, ‘আপু, বাবা আমাকে বিশ লাখ টাকা দিচ্ছে ব্যবসা করার জন্য।’
জাহ্নবীর ইচ্ছে করছে আনন্দে লাফিয়ে উঠতে। স্বপ্ন পূরণের এক অদম্য বাসনা ভেতর থেকে উঁকি দেয়। খুশির জোয়ারে ভাসতে ভাসতে জাহ্নবী বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করতেই তার মনে ভেসে উঠল এক অপূর্ব দৃশ্য। সে হেঁটে যাচ্ছে তার কর্পোরেট অফিসে। আশেপাশে বসে থাকা সব স্টাফ দাঁড়িয়ে তাকে ‘গুড মর্নিং ম্যাম’ বলছে। জাহ্নবী লাজুক হেসে তাদেরকে বলে, ‘প্লিজ আমাকে ম্যাম ডাকবেন না। আমাকে আপনারা আপা ডাকতে পারেন।’

চলবে..

উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ৩৯
লেখাঃ মিশু মনি

সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে সামার। দুপুরের ঘুম। ভায়োলেট জানালার পর্দা সরিয়ে দিতেই বিকেলবেলার মিষ্টি রোদ এসে ঘরে ঢুকল। মন ভালো হয়ে গেল তার। ঠিক তখনই ঘরে প্রবেশ করলেন পারভীন। হাতে ধরা মোবাইলটা সামারের দিকে এগিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘অর্ণবের মা, কথা বল।’

হতভম্ব হয়ে পারভীনের দিকে তাকিয়ে রইল সামার। হাই তুলতে তুলতে মোবাইল কানে ধরে সে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম শাশুড়ী আম্মা, ভালো আছেন?’
পারভীনের এবার হতভম্ব হওয়ার পালা। সামার বলল, ‘জি আম্মা আমিও ভালো আছি। আমি একটু ঘুমাচ্ছিলাম। ফ্রেশ হয়ে এসে কল দেবো শাশুড়ী আম্মা।’

সামার মোবাইল এগিয়ে দিলো পারভীনের দিকে। কোনোমত কথা বলা শেষ করেই ভয়ংকর রেগে পারভীন বললেন, ‘এত বেয়াদবি কার কাছে শিখেছিস সামার? মুরুব্বিদের সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলে?’
‘শাশুড়ীকে শাশুড়ী ডাকলেও বেয়াদবি হয়ে যায় মা?’
‘চুপ কর বেয়াদব মেয়ে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমি বেয়াদব। এখন যাও তো মা।’
পারভীন রাগে গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এ ঘর থেকে শোনা গেল তার মেজাজী গলা, ‘আমিও দেখবো তুই কতদূর যাইতে পারিস। মান সম্মান কিচ্ছু নষ্ট করবি তো তোর মায়ের মরা মুখ দেখবি তুই।’

সামার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। ভায়োলেট বলল, ‘প্লিজ আপু থাম। আমি মাকে সামলাচ্ছি।’
কিন্তু সামলানো আর হল না। ইতিমধ্যেই তিনি অর্ণবকে কল দিয়ে বাসায় আসতে বলে দিয়েছেন। অফিস থেকে দ্রুত বেরিয়ে চলে এসেছে অর্ণব। সামার হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করার জন্য অপেক্ষা করছে।

ভায়োলেট বলল, ‘টেবিলে নাস্তা দিয়েছে আপু, খেতে যা।’
‘তোরটা রুমে নিয়ে আসলি, আমারটাও রুমে নিয়ে আসলে কী হতো।’
‘তোকে টেবিলে গিয়ে খেতে হবে। গিয়ে দ্যাখ কী অপেক্ষা করছে তোর জন্য।’
‘স্পেশাল কিছু বানানো হয়েছে নাকি আমার জন্য?’
কথাটা বলতে বলতে সামার ডাইনিংয়ে প্রবেশ করেই ভিড়মি খেয়ে গেল। চেয়ারে বসে আছে অর্ণব সাহেব। পরনে ফর্মাল শার্ট, প্যান্ট ও টাই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সদ্য অফিস শেষ করে ফিরেছে।

সামার পিছিয়ে যেতে গিয়েও এগিয়ে গেল। অর্ণবের পাশাপাশি চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো সে। নাস্তার বাটি এগিয়ে নিয়ে খেতে শুরু করল। অর্ণব মাথা নিচু করে বসে আছে তখনও।
সামার বলল, ‘খান। বসে আছেন কেন?’
বিব্রত ভঙ্গিতে অর্ণব খাবার খেতে শুরু করে। এমন সময় পারভীন প্রবেশ করলেন ঘরে। নিজের হাতে অর্ণবকে আপ্যায়ন করে তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘কতদিন হলো তুমি আসো না বাবা। মাঝেমাঝে আসলে আমরা কত খুশি হই।’
‘জি আন্টি। আমার এখন কাজের চাপ একটু বেশী। অফিস থেকে সোজা এখানে এলাম।’
‘চাপ তো থাকবেই। তাই বলে বাবা মাকে ভুলে গেলে হবে?’

সামারের বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘নিজের মেয়েকে তো কখনো আসতে বলো না, পরের ছেলের জন্য এত দরদ?’ কিন্তু বলতে পারল না। মাঝেমাঝে কথা হজম করতে হয়।
পারভীন বললেন, ‘তোমার মা বাবা ভালো আছেন?’
‘জি আন্টি।’
‘খেয়েদেয়ে সামারকে নিয়ে একটু বাইরে যেও৷’

অর্ণব চমকে ওঠে। পাশে বসা মেয়েটার সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়। মেয়েটির চোখে আগুনের ফুলকি। মাকে রাগ দেখাতে গিয়েও সংবরণ করে নেয় সে।
মৃদু স্বরে উত্তর দেয়, ‘মা আমি আজ বাইরে যাবো না। ইচ্ছে করছে না।’
‘আমি যেতে বলেছি সামার।’
‘আজকে না।’
‘আজকেই যা। যা যা কিনতে দেবো দুইজন মিলে কিনে নিয়ে আসবি।’

সামার চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইল। তার ইচ্ছে করছে রাগে গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দিতে। নাস্তার টেবিল থেকে উঠে দ্রত জামাকাপড় পরে সামার বেরিয়ে এলো। অর্ণবের খাওয়া তখনো শেষ হয়নি।
সামার বলল, ‘উঠুন।’

পারভীন অগ্নিমূর্তি ধারণ উঠলেন, ‘ছেলেটাকে খাওয়া থেকে টেনে তুলে নিয়ে যাবি নাকি?’
মেয়ের কাণ্ড কারবার কিছুই বুঝতে না পেরে দিশেহারা হয়ে যান তিনি। সামার মুখ শক্ত করে বসে রইল।
পরিস্থিতি দেখে হাত ধুতে যায় অর্ণব। পারভীন কিছু বলার আগেই সে বলে, ‘আমার খাওয়া হয়ে গেছে আন্টি।’

পারভীন আর কথা বাড়ালেন না। এমনভাবে তাকালেন, যার অর্থ- আমিও দেখবো তুই কতদূর যেতে পারিস।
দুই মা মেয়ের মাঝে অদৃশ্য এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি হয়েছে। পারভীন বরাবরই রূঢ় প্রকৃতির হলেও কখনো এমন বিতণ্ডায় পড়তে হয়নি তাকে। তিনি সামারের হাতে টাকা তুলে দিয়ে বলে দিলেন অর্ণবের জন্য জামাকাপড়, জুতা ও একটা ওয়ালেট কিনে দিতে। সামার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো প্রত্যুত্তর দিতে পারল না।

বাসা থেকে বেরিয়ে একটা অর্ণব দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। সামার একটা রিকশা ডেকে নেয়। জড়োসড়ো হয়ে বসল অর্ণব। কোনো আচরণে সামারকে বিরক্ত করার ইচ্ছে তার নেই।

সামার বলল, ‘আপনি যে ঝামেলা পাকিয়েছেন, এটা থেকে আমায় উদ্ধার কীভাবে করবেন বলুন তো?’
অর্ণব ইতস্তত করতে করতে বলল, ‘আর কিছুদিন ম্যানেজ করে নিন প্লিজ। তারপর আমি বাসায় জানাবো আপনার সঙ্গে আর কোনো বনিবনা হচ্ছে না।’

সামার চোখ বড়বড় করে তাকালে অর্ণব ঝটপট উত্তর দেয়, ‘আপনার দোষ দেবো না। বলবো আমারই আপনাকে ভালো লাগে না। আশাকরি এটা শুনলে আপনার মা বাবাও আর কিছু বলবেন না।’
‘বলবেন না হয়তো। কিন্তু আম্মু ভয়ংকর রেগে যাবে আপনার ওপর। আর কোনোদিনও আম্মু আপনার মুখ দেখতে চাইবে না।’
‘দেখার প্রয়োজনও নেই।’

সামার কয়েক পলক তাকিয়ে রইল অর্ণবের পানে। তারপর একটা বড় শ্বাস নিয়ে বলল, ‘ইদানীং আমার মন মেজাজ ভালো যাচ্ছে না। আমি একটা হইচই করা টাইপের মেয়ে। অথচ কয়েকদিন ধরে সারাটা ক্ষণ মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকে। কারণটা কী জানেন?’
‘আমার জন্য?’
‘হ্যাঁ, আপনার জন্য।’

অর্ণবের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। নিজেকে আরও অপরাধী মনে হতে লাগে তার।
সামার বলল, ‘আপনার জন্য না। এত দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। আসলে সময়টাই খারাপ যাচ্ছে। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আগের মত আড্ডা, চিল এসব হচ্ছে না। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। আরজুর সঙ্গে কথা বলে শান্তি পাচ্ছি না। আবার বাসায় যতক্ষণ থাকি, মাকে মনেহয় আমার শত্রু। মানসিকভাবে খুবই যন্ত্রণার মধ্যে আছি আমি।’

অর্ণব কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো, ‘আপনি যতটা রাগী, ততটাই ভালো আপনার মন। অনেক নরম মনের মেয়ে আপনি।’
‘কীভাবে বুঝলেন?’
‘আমার ওপর এতটা রেগে থাকার পরও নিজের দুঃখের কথা আমাকে বললেন। সাধারণত মেয়েরা নিজের কষ্টের কথা কারও সাথে সহজে শেয়ার করে না।’
‘আমি এমনই। মনের কথা চেপে রাখতে পারি না। যা মনে আসে সঙ্গে সঙ্গে সবার সাথে শেয়ার করি।’
‘এ জন্যই বললাম আপনার মনটা অনেক নরম।’

সামার বলল, ‘আচ্ছা শুনুন, মা বলেছে আপনার জন্য কিছু কেনাকাটা করতে। আমি আপনাকে টাকা দিয়ে দেই, আপনি নিজে পছন্দ করে কিনে নিতে পারবেন না?’
অর্ণব কী বলবে বুঝে উঠতে সময় লাগল। নিজেকে নিয়ে আর কোনো বিব্রত অবস্থা সৃষ্টি করার ইচ্ছে তার নেই। তাই বলল, ‘আমার কিছু লাগবে না। আপনি বললে আমি রিকশা থেকে নেমে যাই।’
‘ কিছু লাগবে না সেটা মা জানে। সে সাধ করে কিনে দিতে চায়। আপনি আপনার ইচ্ছেমত কিনে নেবেন। আমার আসলে আপনার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করার কোনোই ইচ্ছে নেই।’

অর্ণব ভীষণ অপমানিত বোধ করল৷ চোখ বন্ধ করে কথাটা হজম করল সে। তারপর বলল, ‘মামা রিকশা থামান। আমি নেমে যাচ্ছি। আর আপনি আপনার মাকে বলবেন যা যা কেনার কথা ছিল সব কিনে দিয়েছেন।’
লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নেমে গেল অর্ণব। সামার বলল, ‘করছেন কী? রিকশায় উঠুন।’
‘আমার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করার ইচ্ছে যার নেই, সেটা শুনেও তার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর মতো ছেলে আমি নই। ভয় পাবেন না, আগামী কয়েকদিন আমি আপনাদের বাসায় যাবো না। আন্টিকে ফোন করে ধন্যবাদ জানিয়ে দেবো।’

অর্ণব পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে রিকশা ওয়ালাকে একটা একশো টাকার নোট এগিয়ে দেয়। সামার রাগত স্বরে বলল, ‘আপনি কী করে ভাবলেন আপনার টাকা আমি নেবো? মামা আপনি টাকা নেবেন না।’
অর্ণব রিকশাওয়ালাকে বলল, ‘মামা আপনি এইটা রাখেন। উনি দিতে চাইলে নিয়েন। আমার ভাড়া আমি দিয়ে দিচ্ছি।’
‘ত্রিশ টাকা দিলেই হবে।’ রিকশাওয়ালা বলেন।
‘ ঠিক আছে সত্তর টাকা আমাকে ফেরত দেন।’

রিকশাওয়ালা সত্তর টাকা ফেরত দিলে দ্রুত রাস্তা ছেড়ে ফুটপাত ধরে হাঁটা শুরু করলো অর্ণব। সামার হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। রাগ হচ্ছে, খুব রাগ। সামারের সঙ্গে এতটা ইগো দেখানোর সাহস কখনো কারও হয়নি।
রিকশা টেনে অর্ণবের পাশে দাঁড়িয়ে সামার বলল, ‘রিকশায় উঠুন।’
‘আপনি যেখানে ইচ্ছে যান।’
‘উঠতে বলেছি আপনাকে। এত তেজ কাকে দেখাচ্ছেন আপনি? ‘
‘আপনি এত তেজ কাকে দেখাচ্ছেন? আমি আপনার বয়ফ্রেন্ড না। আপনার গোলামও না।’

সামার ভয়ংকর রেগে গেল। রিকশা থেকে নেমে অর্ণবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি আমাকে রাগ দেখিয়ে রিকশা থেকে নেমে যান, আবার আমার মুখের ওপর বড়বড় কথাও বলেন। সাধারণ ভদ্রতাবোধ নেই আপনার?’

অর্ণব নিজেও রাগে লাল হয়ে উঠেছে, ‘সাধারণ ভদ্রতা আপনার নেই। থাকলে একটা ছেলের মুখের ওপর বলতে পারতেন না, আপনার সঙ্গে কেনাকাটা করার ইচ্ছে আমার নেই।’
‘তাহলে কী করতাম? নাচতে নাচতে আপনার সঙ্গে কেনাকাটা করতাম? এতদিন আপনার বুদ্ধি শুনেছি, তারমানে এই না আমাকে আপনার সঙ্গে সবকিছু করতে হবে।’

অর্ণব একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি তো করতেও বলছিনা আপু। আপনি আপনার মতো যেখানে ইচ্ছে যান। আমি আপনার মাকে জানাবো, আপনি আমাকে কেনাকাটা করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।’

সামার চুপ করে রইল। রিকশাওয়ালা অবস্থা বুঝে রিকশা ঘুরিয়ে চলে গেলেন। সামার সেদিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘ শালার রিকশা ও..’

সামার ব্যাগ থেকে টাকা বের করে অর্ণবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এগুলো নিয়ে যান। আম্মুর দেয়া পাঁচ হাজার টাকা। শার্ট, প্যান্ট, জুতা আর ওয়ালেটের জন্য। আর এক্সট্রা ত্রিশ টাকা রিকশা ভাড়া।’

অর্ণব একগাল হেসে বলল, ‘অদ্ভুত মেয়ে আপনি। রিকশা ভাড়ার টাকা আমি দিয়েছি বলে সেটাও ফেরত দিতে চাইছেন। হাসি পাচ্ছে আমার।’
‘হাসুন। টাকাগুলো নিয়ে তারপর যান।’
‘টাকা আমি নেবো না। আপনাকে বলেছে কিনে দিতে, টাকা দিতে বলেনি। আমার কী নূন্যতম আত্মসম্মান বোধ নেই? আমি আপনার কাছে টাকা নেবো?’

সামার উত্তর খুঁজে না পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। একটা শ্বাস নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। চলুন।’
‘মাথা খারাপ? এর পরেও আমি আপনার সঙ্গে যাবো?’
‘যাবেন। আর নয়তো এই টাকাটা নেবেন। কারণ এটা আমি আমার কাছে রাখবো না।’

অর্ণব হতভম্ব হয়ে উত্তর দিলো, ‘অদ্ভুত! টাকাটা আপনি যা খুশি করতে পারেন। আমার কিছু যায় আসে না।’
‘আপনি হয় টাকাটা নেবেন আর নয়তো আমার সঙ্গে যাবেন। এই টাকা আমি নিজের কাছে রাখতে পারবো না। আর মাকেও ফেরত দেয়া সম্ভব না।’

অর্ণব কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার নিজের আচরণ এখন নিজের কাছে লজ্জাজনক লাগছে। সামারকে তার এই আচরণের জন্য ‘সরি’ বলা উচিৎ। একটা মেয়ের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝগড়া করাটা মোটেও ভালো মানুষের কাজ নয়। ‘ধেৎ’ শব্দটা উচ্চারণ করে অর্ণব বলল, ‘চলুন।’

দুজনে ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করল। এবার আর রিকশা নেয়া হয় না। কারও মুখে কোনো কথা নেই। পাশাপাশি হাঁটতে গিয়ে দুজনেরই রাগ কমে যেতে থাকে।
কাছেই একটা শো রুম পেয়ে সেখানে ঢোকার কথা বলে অর্ণব। সামার সায় দেয়। ভেতরে ঢুকে দুজনেই কয়েক মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
সামার বলল, ‘আপনি পছন্দ করুন, আমি বিল দিচ্ছি।’
‘আমার আসলে নিতেই ইচ্ছে করছে না।’
‘তাহলে সেটা আম্মুকে ফোন করে জানান।’
‘এটাও এইমুহুর্তে সম্ভব না।’
‘আমরা কী এখন এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ম্যানিকুইন দেখবো?’

অর্ণব অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হেসে ফেলল। অবস্থা বেগতিক। হেঁটে হেঁটে দু একটা শার্ট নেড়চেড়ে দেখল সে। তারপর ইউ টার্ন নিয়ে ঘুরতেই মেয়েদের জামাকাপড়ে চোখ গেল। একটা টপস হাতে নিতেই সামার এসে বলল, ‘বাসায় মেয়েদের টপস পরে থাকেন নাকি?’
অর্ণব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উত্তর দেয়, ‘এটা দেখে ভালো লাগল।’
‘তাহলে নিন। রুমে পরে থাকবেন। পরে অফিসে গেলে কিন্তু লোকজন হাসাহাসি করবে, সেটা ভুলে যাবেন না।’
অর্ণব হেসে বলল, ‘আমি এটা আপনার জন্য দেখছি।’
‘আমার জন্য কেন?’
‘আপনি আমাকে শপিং করিয়ে দেবেন আর আমি হা করে সেগুলো গলাধঃকরণ করব?’

সামার মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘ওরে আমার আত্মসম্মান রে। গলাধঃকরণ মোটেও হা করে করেননি, আমি জোর করে করাচ্ছি। আপনার জন্য শার্ট দেখেন, আমার জন্য কিছু লাগবে না।’

অর্ণব হাতে টপস নিয়েই ছেলেদের সাঁড়িতে চলে এলো। দু একটা শার্ট দেখতে দেখতে সামারকেও দেখতে বলে সে। সামার মুখে রাগের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে শার্ট খুঁজতে থাকে। দুই মিনিটের মাথায় একটা শার্ট ও প্যান্ট খুঁজে অর্ণবের হাতে ধরিয়ে দেয় সে।

অর্ণব টপসের বিল পরিশোধ করে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সামার এটা কিছুতেই নেবে না। অর্ণব হাতে দুইটা শপিং ব্যাগ নিয়ে কোনদিকে যাবে বুঝে উঠতে পারে না।

হঠাৎ সামারের ফোনে একটা মেসেজ আসে। হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকতেই সে দেখল মেসেজটা আরজু পাঠিয়েছে। তাদের কেনাকাটা করার ছবি। সামার শার্ট দেখছে আর তারই পাশে টপস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব।
সামার ফোন থেকে মুখ তুলে বলল, ‘ শিট!’

অর্ণব চমকে উঠলো। কিছু না বলেই সামার শো- রুম থেকে বেরিয়ে যায়। অর্ণব বেরিয়ে এলো পিছুপিছু। সামার বলল, ‘আপনি আর আসবেন না। পারলে আমাকে এই ঝামেলা থেকে উদ্ধার করুন।’

কথাটা বলেই হনহন করে হেঁটে চলে গেল সামার। অর্ণব দুইটা শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে বোকার মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কী হলো হঠাৎ, কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। সামারকে ‘সরি’ বলা আর হলো না তার।

চলবে…

উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ৪০
লেখাঃ মিশু মনি

বিকেলের পড়ন্ত রোদে জানালার পর্দাটা ঝিলমিল করছে। ঘুম ভাঙা চোখে সেদিকে চেয়ে আছে জাহ্নবী। হঠাৎ খেয়াল হল বালিশের নিচে ফোনটা কাঁপছে। শব্দ হচ্ছে ভূ-উ-উ-উ।
জাহ্নবী ফোন হাতে নিলো। অপরিচিত নাম্বার। ফোন কানে ধরে সে বলল, ‘হ্যালো..’
‘জাহ্নবী বলছেন?’
‘জি। কে বলছেন?’
‘আমি সারল্য।’
‘সারল্য কে?’
‘সারল্য আমি।’

জাহ্নবী চোখ কচলে উঠে বসলো। অপরিচিত কণ্ঠস্বর, কখনো না শোনা নাম। ভ্রম লেগে যাচ্ছে তার। চুপ করে রইল সে।
ওপাশ থেকে সারল্য নামের ব্যক্তিটি বলল, ‘আমাকে চিনতে পারছেন না? সেদিন একসঙ্গে মিটিং করলাম? নাদিরের বিজনেস মিটিং।’

জাহ্নবী মনে করার চেষ্টা করল। সেদিন মিটিংয়ে বেশ কয়েকজন লোক ছিল। সবাই তাদের মতো মতামত দিয়েছে, জাহ্নবীর মতের প্রশংসাও করেছে কয়েকজন। কিন্তু তাদের মধ্যে সারল্য কে হতে পারে, সেটা কিছুতেই সে মনে করতে পারছে না।

সারল্য বলল, ‘চিনতে পারেননি এখনও?’

জাহ্নবী না চিনেও চেনার ভঙ্গীতে বলল, ‘হ্যাঁ। বলুন।’
‘এদিকে আমি একটা কাজে এসেছিলাম। গাড়ি এনেছি সাথে। নাদির বলল আপনাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে।’

জাহ্নবী আড়মোড়া ভেঙে একটা বড় করে শ্বাস নিলো। জানালায় রৌদ্রমুখর পর্দাটা দেখতে ওর ভীষণ ভালো লাগছে। ঘুমের ঘোর কাটাতে সে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলো। নাদির স্যার আজকেও একটা মিটিং ডেকেছেন। আজ ওয়েবসাইট ডিজাইনটা দেখাবেন সবাইকে। জাহ্নবী ভুলেই গিয়েছিল মিটিংয়ের কথা।
শুক্রবার আজ। ছুটির দিন বলে সে লম্বা ঘুম দেয়ার পায়তারা করেছিল গত রাতেই। সারা রাত জেগে ভোরবেলা ঘুমিয়েছে। সেই ঘুমের দৈর্ঘ্য বিকেল তিনটায় গড়াবে এটা ভাবেনি সে।

জাহ্নবী বলল, ‘আমি একা চলে যেতে পারবো।’
‘আপু, আমরা এখন একই টিমের মানুষ। এক প্রকার কলিগ বলা যায়। একসাথে অনেকদূর কাজ করতে হবে। এতটা পর ভাব্বেন না প্লিজ।’

জাহ্নবী কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘আচ্ছা ভাই। আপনি কোথায় আছেন এখন?’
‘আমি বাজারের রোডের মাথায় আছি। আপনাকে অনেক্ষণ আগেই কল দিয়েছিলাম।’
‘আমি ঘুমে ছিলাম ভাই।’
‘বুঝতে পেরেছি আপু। আপনি তাহলে রেডি হোন। আমাকে কল দিলেই আপনার বাসার নিচে চলে আসবো।’
‘আচ্ছা ভাইয়া।’

জাহ্নবী ফোন রেখে রাস্তার দিকে তাকালো। আজ লম্বা ঘুম দিয়েছে সে। এখন খিদেয় পেট মোচড় দিচ্ছে। রান্না করে তারপর খেতে হবে তাকে। ইচ্ছে করছে বাইরে খেয়ে নিতে। কিন্তু মিটিং তো আরও দেড় ঘন্টা পর। এতক্ষণ লোকটাকে বাইরে অপেক্ষা করাতেও তার খারাপ লাগছে।

জাহ্নবী দ্রুত তৈরি হয়ে সারল্য’কে ফোন করে বাসার ঠিকানা বলে দিলো। পেটে ক্ষুধা আর লম্বা ঘুমের পর ফোলা ফোলা চোখ মুখ নিয়ে বের হল সে। মনেমনে আজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল, মিটিংয়ে নিশ্চয়ই পান্নাবাহারও আসবে। সে তার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করবে, অতীতের সবকিছু ভুলে যেতে হবে তাকে।

গেটের বাইরে একটা কালো রঙের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। গাড়ির গ্লাস নামিয়ে যে লোকটা তার সঙ্গে কথা বলল, তাতে রীতিমতো ভিড়মি খাওয়ার জোগাড় হল তার। এ তো পান্নাবাহার নিজে!

জাহ্নবীর মনটা বিরক্তিতে ভরে গেল। মাত্রই সে এই লোকের কথা ভাবছিল। গাড়িতে উঠে বসতে বসতে জাহ্নবী জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নাম সারল্য?’
‘হ্যাঁ। আপনি জানতেন না?’
‘না। জানলে কি আর এত চমকাতাম?’

পান্নাবাহার হেসে বলল, ‘আপনি কী অন্য কাউকে আশা করেছিলেন?’
‘তা নয়। আমি আসলে আপনার নামটা জানতাম না। বাসার নিচে কে অপেক্ষা করছে সেটা সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না আমার।’
‘ওহ।’

সারল্য অঅর্থাৎ জাহ্নবীর পান্নাবাহার গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। গলি পেরিয়ে মেইন রাস্তায় এসে উঠল গাড়ি। সারল্য’র মুখে সম্ভবত চুইংগাম। দ্রুত চিবোচ্ছে সে।
জানতে চাইলো, ‘আপনি কি খুব চুপচাপ প্রকৃতির?’
‘হুম।’
‘আমিও চুপচাপ প্রকৃতির।’

জাহ্নবী কিঞ্চিৎ ত্যাড়া সুরে উত্তর দিলো, ‘আপনাকে দেখে সেটা মনে হচ্ছে না।’
‘হা হা হা। পরিচিত কারও সাথে আমি অতটাও চুপচাপ থাকতে পারিনা।’
‘আমি আপনার পরিচিত?’

সারল্য মুখ টিপে হেসে বলল, ‘অবশ্যই পরিচিত। আমার মেয়ের কাছেও আপনি পরিচিত। ওকে পিৎজা খাইয়েছেন। সে এখন চেনে আপনাকে।’

জাহ্নবী চোয়াল শক্ত করে বসে রইল। এই বিরক্তিকর পথটা কখন শেষ হবে সেই প্রহর গুণছে সে। দ্রুত ফুরিয়ে যাক পথ। লোকটার পাশে বসে থাকতে খুব অসহ্য লাগছে তার।

পথকে দ্রুত ফুরাতে বললে সে আরও দীর্ঘ হয়ে যায়। আজও তাই হল। জ্যাম আর সিগন্যালে বসে থাকতে থাকতে অসহ্যকর হয়ে উঠল সব। জাহ্নবীর করুণ মুখ দেখে কিছু একটা আন্দাজ করতে পারল সারল্য। সে জানতে চাইলো, ‘কোনো প্রবলেম হচ্ছে আপনার?’
‘না।’ মুখ কঠিন রেখেই উত্তর দেয় সে।
‘আমার মনে হচ্ছে কোথাও একটা সমস্যা আছে। আচ্ছা দুপুরে কী খেয়েছেন?’
‘কিছু খাইনি।’
‘সে কী! কেন?’
‘আপনার ফোন পেয়েই ঘুম ভেঙেছে আজ। এই প্রথম আমি এত দীর্ঘ সময় ঘুমালাম। রান্না করা ছিল না। খেতে হলে রান্না করে খেতে হবে।’
‘আপনি একা থাকেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘মা কিংবা শাশুড়ীকে সঙ্গে রাখতে পারেন। হাজব্যান্ড রান্না করে দেয় না?’

জাহ্নবী একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল পান্নাবাহারের দিকে। মন আনচান করে উঠল তার। এই বয়সী একটা মেয়ের স্বাভাবিকভাবেই স্বামী, সন্তান, শ্বশুরবাড়ির মতো বিশাল পরিবার নিয়ে আনন্দে থাকার কথা। তাকে দেখলে নিশ্চিতভাবেই বিবাহিত মনে হয়। সে তো সিনেমার নায়িকা নয়। বয়সের ছাপটা তার চেহারায় যথেষ্টই ফুটে আছে।

জাহ্নবী বলল, ‘আমি বিয়ে করিনি।’
‘সত্যি! আরে বাহ। আপনি তো দারুণ মজার জীবন কাটাচ্ছেন তাহলে।’

জাহ্নবী মুখ ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকাল। জ্যাম ছাড়ার নাম নেই। তবে এখন বসে থাকতে বিরক্ত লাগছে না। মজার জীবন কাটানোর কথা শুনে তার হাসতে ইচ্ছে করছে। এই জীবনটা কোনো অর্থেই তার কাছে মজার নয়। ভীষণ তিক্ত একটা জীবন তার। একাকীত্ব, সমাজের লোকদের কটু কথা আর মায়ের চোখের কাটা হয়ে এতদিন বাঁচতে হয়েছে তাকে। একটা ছেলের কাছে এই জীবনটা যতটা সুন্দর মনেহয়, একটা মেয়ের কাছে ততটাই যন্ত্রণার।

জাহ্নবী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ছেড়ে দিয়েছে জ্যামও। দ্রুত ছুটল গাড়ি। পান্নাবাহারের চুইংগাম চিবানো এখনও থামছে না। এই একটা চুইংগাম সে অনেক্ষণ ধরে চিবোচ্ছে। জাহ্নবী মাঝেমাঝে তার দিকে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। পথটা দ্রুত ফুরিয়ে গেল এবার।

মিটিং শুরু হতে আরো অনেক সময় বাকি। জাহ্নবীকে বসিয়ে রেখে সারল্য উঠে গেল। একা বসে রইল সে। সারল্য’র পরনে সাদা পাঞ্জাবি। খুব সম্ভবত নামাজ শেষ করে বেরিয়েছিল সে।

একজন ওয়েটার বিরিয়ানির প্লেটার দিয়ে গেল জাহ্নবী’র সামনে। জাহ্নবী হতচকিত হয়ে জানতে চাইলো, ‘আমি তো খাবার অর্ডার করিনি?’
‘স্যার দিতে বলেছেন।’
‘সাদা পাঞ্জাবি পরা স্যার?’
‘জি ম্যাডাম।’

জাহ্নবীর মন কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। মানুষটা ভীষণ ভালো। তার এইমুহুর্তে খাবারের খুব প্রয়োজন ছিল। নিজেই বসে বসে ভাবছিল কিছু খাবে কী না। এদিকে লোকজন খুব একটা আসে না। জায়গাটা রেস্তোরাঁর তবে মূল রেস্তোরাঁ থেকে বিভক্ত। এটা সম্ভব ভিআইপি জোন, প্রত্যেকের আলাদা করে বুকিং করতে হয়।

জাহ্নবী আশেপাশে একবার তাকিয়ে খেতে শুরু করল। পান্নাবাহারকে খেতে বলা উচিত। অপেক্ষা করেও লাভ হল না। এলো না সে। জাহ্নবী একা একাই খাবারটা খেয়ে নিলো। এর ফাঁকে ওয়েটার এসে জানতে চাইলো আরও কিছু লাগবে কী না। দুইটা কোল্ড ড্রিংকস দিতে বললো জাহ্নবী। তবে একটা ড্রিংকস রেখে দিল সারল্য’র জন্য।

খাওয়া শেষ করে জাহ্নবী চুপচাপ বসে রইল। সারল্য আর এলো না। একেবারে নাদির স্যার সহ চলে এলো সে। জাহ্নবী নাদিরের সামনে ওকে ধন্যবাদ দিতে পারল না। নাদির জানতে চাইলো, ‘কী অবস্থা?’
‘এইতো স্যার ভালো।’
‘বোন, দোহাই লাগে এখন আমাকে স্যার বইলো না। উই আর ফ্রেন্ডস।’
‘ওকে স্যার।’
‘মাইর দিবো মেয়ে একটা।’

জাহ্নবী ফিক করে হেসে ফেলল। নাদির আরও দুজন বন্ধুকে রিসিভ করতে গেলে জাহ্নবী সারল্যকে বলল, ‘ধন্যবাদ।’
‘স্বাগত।’
‘এটা আপনার জন্য দিতে বলেছিলাম।’
জাহ্নবী কোমল পানীয়ের বোতলটা এগিয়ে দেয় সারল্য’র দিকে। সে সহাস্যে বোতলটা নিয়ে বলল, ‘থ্যাংক ইইইউউ।’

কৃতজ্ঞতাসূচক হাসলো জাহ্নবী। অদ্ভুত ব্যাপার, এই মুহুর্তে তার একটুও অস্বস্তি কিংবা বিরক্তি হচ্ছে না। বরং পান্নাবাহারকেও তার একজন বন্ধু বলে মনে হচ্ছে। সারল্য, কী সুন্দর নাম! মানুষটার বিশুদ্ধ চেহারার মতোই তার নামটা। ওনার অপূর্ব মুখে সরলতার প্রতিচ্ছবি।

নাদিরের ব্যবসা সংক্রান্ত মিটিং শেষে খাবারের অর্ডার দেয়া হল। জাহ্নবী সহজ হতে চেষ্টা করছে সবার সঙ্গে। তাদের পাঁচ জনের টিম। এই টিম নিয়েই নাদির শুরু করতে যাচ্ছে নিজের বহুল প্রতিক্ষীত ব্যবসা। জাহ্নবী খুব উত্তেজিত বোধ করছে। খুব শীঘ্রই তারও এমন একটা নিজস্ব ব্যবসা হবে। তারা দুই বোন মিলে কাজ করবে সেখানে। অনেক গুলো কর্মচারী তাকে ‘আপা’ বলে ডাকবে। ভাবলেই আনন্দের শিহরণ বয়ে যায় তার মাঝে।

রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে জাহ্নবী সারল্য’র কথা ভেবে হাসছিল। ফোনে ছেলেটার কণ্ঠস্বর একদমই আলাদা। চিনতে পারেনি সে। বাসার সামনে তাকে দেখে কী আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল জাহ্নবী! তাকে মনের মানুষের আসন থেকে সরিয়ে বন্ধুর আসনে বসাতে পেরে জাহ্নবী’র বেশ হালকা লাগছে।

সামারের মনটা আজ খুবই ভালো। দুদিন আগে আরজুর সঙ্গে ঝগড়া শুরু হয় তার। সেদিন অর্ণবের সঙ্গে কেনাকাটা করতে দেখে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিল আরজু। অর্ণবের সাথে তার বিয়ের কথাবার্তা হওয়ার ব্যাপারটা সামারই তাকে বলেছে। ব্যস, তারপর থেকেই অর্ণব শত্রু হয়ে গেছে আরজুর। নিজের প্রিয়তমাকে হবু জামাইয়ের সঙ্গে দেখলে যে কারোরই মাথা খারাপ হবে। তার মাথা ঠিক করতে দুদিন সময় লেগে গেছে সামারের। অবশেষে আজ ঝগড়া মিটিয়ে আবারও সবকিছু ঠিক করতে পেরে সামার আনন্দে ঝলমল করছে।

কিন্তু আনন্দ বোধহয় তার কপালে সইছে না আজকাল। জাভেদ আলী মেয়েদের ডেকে জানালেন, আগামী পরশু আমরা সবাই মিলে চিটাগাং যাচ্ছি, অর্ণবদের বাসায়।

আকাশ থেকে পড়ল সামার। নিজেকে সামলে নিতে পারল না সে। রেগে আগুন হয়ে জানতে চাইলো, মানে কী এসবের?
‘তোর শাশুড়ী বারবার করে ডাকছেন। পারভীনও চাইছে ওনাদের বাড়িটা দেখে আসতে। তাছাড়া তোর মা অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যায় না। চট্টগ্রাম জায়গাটা দেখে আসুক।’
‘তাহলে মাকে নিয়ে যাও। আমরা কেন?’
‘পাগলী মা আমার। রাগ করছিস কেন? অর্ণবও যাবে তো। আমরা যাচ্ছি অথচ হবু ছেলের বউ যাবে না, সেটা ওনারাই বা মানবে কেন।’

সামারের ইচ্ছে করল বাবার মুখের ওপর কড়া করে কিছু কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু বাবাকে আঘাত দিয়ে কথা বলতে পারবে না সে। জাভেদ আলী ভীষণ নরম মানুষ, ভালো একজন বাবা। ঝামেলাটা সামার নিজেই পাকিয়েছে। এখন বাবার সঙ্গে রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। বাবা জানেন তিনি মেয়ের নিজের পছন্দ করা ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছেন। হুট করে তাকে কিছু বলে ফেলা অন্যায়।

সামার বেশ বুঝতে পারছে সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এর লাগাম টেনে ধরতে না পারলে সত্যি সত্যি অর্ণবের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যাবে। যা করার তাকেই করতে হবে। চট্টগ্রাম গিয়ে ওর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বিয়েটা যেভাবেই হোক ভেঙে ফেলতে হবে তাকে। কিন্তু অর্ণবের বাসায় যাওয়ার ব্যাপারটা কিছুতেই আরজুকে জানানো যাবে না।

সোমবার রাতে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে রওনা দিলো তারা। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে আগে থেকেই অপেক্ষা করছে অর্ণব। সেদিনের ঘটনার পর সে এখনও সামারের সামনে দাঁড়াতে লজ্জায় নীল হয়ে যাচ্ছে।
একটা কেবিন বুক করা হয়েছে। সামার ও ভায়োলেটের ট্রলিটা অর্ণব নিজ দায়িত্বে ট্রেনে তুলে দিচ্ছে দেখে ভেতরে ভেতরে রাগ হল সামারের। পারভীন ও জাভেদ আলী একই আসনে বসলেন। মুখোমুখি আসনে বসলো সামার ও ভায়োলেট। সামার ফোনের স্ক্রিনে মত্ত হয়ে উঠেছে। অর্ণব কেবিনে নেই। হয়তো ট্রেন ছাড়ার পর আসবে সে। কিন্তু শেষে দেখা গেল অন্য একটা বগিতে নিজের আলাদা টিকেট কেটেছে সে। এটা শুনে বেশ স্বস্তি পেলো সামার।

ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পর অর্ণব কেবিনে এলো। সঙ্গে করে খাবার ও চাওয়ালাকে নিয়ে এসেছে। পারভীন ওর কর্তব্যপরায়ণ ভাব দেখে অভিভূত। তিনি আড়চোখে সামারকে লক্ষ করছিলেন। কিন্তু মেয়ের চোখে অর্ণবের প্রতি কোনো প্রেম দেখতে না পেয়ে যারপরনাই চিন্তিত তিনি।

অর্ণব কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলে সামারও সঙ্গে বের হল। পেছন থেকে ডাকল ওকে, ‘শুনুন।’
অর্ণব এগিয়ে এসে বলল, ‘সরি।’
‘কেন?’
‘সেদিনের জন্য।’
‘বাদ দিন। এখন যেটা বলবো সেটা শুনুন। আপনার বাড়িতে গিয়ে আসল ঘটনা আংকেল আন্টিকে খুলে বলবেন। আমাদের মধ্যে কোনো প্রেম, ভাললাগা কিচ্ছু নেই। আমরা কোনো বিয়েশাদির মধ্যেও নেই।’
‘আচ্ছা।’

শুকনো মুখে উত্তর দিলো অর্ণব। সামার রেগে বলল, ‘আপনি এমন ক্যান?’
ড্যাবড্যাব চোখ করে অর্ণব সামারের দিকে তাকাল। সামার বলল, ‘বোকা, হাবাগোবা, বিদঘুটে একটা ছেলে আপনি। আমি এ ধরনের মানুষজন একদমই সহ্য করতে পারিনা।’
‘আমাকে সহ্য করারও দরকার নেই। যেভাবে সবসময় খারাপ আচরণ করেন, সেভাবেই করুন। আর বেশী দিন তো আমাকে পাবেন না।’

সামার এবার সত্যিই ভীষণ লজ্জিত অনুভব করল। অর্ণবের সাথে করা তার খারাপ আচরণ গুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল চোখের সামনে। কিছু বলতে পারল না সে।

অর্ণব বলল, ‘সত্যিটা প্রকাশ পেলে আপনার মা আর আমার মুখ দেখতে চাইবে না বলেছেন। আমিও আর মুখ দেখাতে কখনো যাবোনা আপনাদের বাড়িতে। সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। আর একটু সহ্য করুন। হাতজোড় করে বলছি।’

সামার লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘ওয়াশরুম কোনদিকে?’
‘আসুন।’
ওয়াশরুমে প্রবেশ করল সামার। অর্ণব ট্রেনের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। সামার বেরিয়ে এসে দাঁড়ায় তার পাশে। শীতল বাতাসে সাঁইসাঁই করে উড়ছে তার চুল। অন্ধকার রাতের শহর ছেড়ে ছুটে চলেছে তূর্ণা এক্সপ্রেস। হঠাৎ করেই ভালো লাগতে শুরু করল সামারের। দীর্ঘদিন পর ট্রেনে উঠেছে সে। তিক্ত মেজাজ ঝেড়ে ফেলে ভ্রমণটাকে উপভোগ করতে লাগল।

অর্ণব বলল, ‘ঠাণ্ডা লাগবে। কেবিনে যান।’
‘আর একটু দাঁড়াই।’
‘আচ্ছা।’

চলছে গাড়ি.. চলবে মেঘফুল..