উপন্যাস: মেঘফুল
পরিচ্ছদ: ৪১
অর্ণবদের বাড়িটা বিশাল। শহর ছেড়ে খানিকটা দূরে, নির্জন একতলা বাড়ি। শীতল বাড়িটাতে প্রবেশ করেই এক ধরনের শান্তি শান্তি লাগতে শুরু করেছে। সামার চাইলেও রাগ করতে পারছে না। অথচ ওর খুব ইচ্ছে করছে অর্ণবের সঙ্গে কর্কশ স্বরে কথা বলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে।
ভায়োলেট সবচেয়ে আনন্দে আছে এখানে এসে। এমন নিস্তব্ধ পরিবেশ, পাখির কিচিরমিচির আর সবুজে ঘেরা বাড়ি ওর ভীষণ ভালো লাগে। জাহ্নবী সঙ্গে এলে দারুণ হতো। খুব খুশি হতো বড় আপা।
দোতলায় ছাদ। ঝলমলে রোদে বসে সামার আচার খাচ্ছে। অর্ণবের মায়ের সঙ্গে তার তীব্র রাগ থাকলেও ওনার হাতে তৈরি আচারের বয়াম কোলে নিয়ে চেটেপুটে আচার খেতে তার মন্দ লাগছে না। মহিলা নিশ্চয়ই রান্নাও ভালো করেন। যারা ভালো আচার বানায়, তারা নিঃসন্দেহে ভালো রান্নাও জানে।
ছাদ থেকে অর্ণবকে দেখা যাচ্ছে। পরনে ট্রাউজার ও স্যান্ডো গেঞ্জি। গাছ থেকে কুমড়া পাড়ছে সে। সামার ইশারা করে ওপরে আসতে বলল অর্ণবকে।
গেঞ্জি পরে ওপরে যেতে লজ্জা করছিল অর্ণবের। সে একটা টি শার্ট পরে ওপরে এলো। ‘এত রোদে বসে আছেন কেন?’ জানতে চাইলো অর্ণব।
‘চামড়া পোড়াচ্ছি। কালো হয়ে গেলে বিয়েটা ভেঙে যাবে।’
‘বিয়ে তো ভাংবোই। এ নিয়ে আপনার নিজেকে কষ্ট দেয়ার প্রয়োজন নেই।’
‘বিয়েটা দু একদিন পর ভাঙুন। ভেবেছিলাম জায়গাটা আমার ভালো লাগবে না। কিন্তু এখানে এসে আশেপাশের প্রকৃতি দেখে ইচ্ছে করছে দুটো দিন থাকি।’
অর্ণব খানিকটা অবাক হয়। সামারকে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি সে। অদ্ভুতুড়ে মেয়েটির কখন কী সাধ জাগে, তার মতো বোকাসোকা মানুষের পক্ষে বোঝা মুশকিল। সে বিভ্রান্ত চোখে চেয়ে রইল।
সামার বলল, ‘আচারটা খুবই মজা হয়েছে।’
‘আমি গোসল করতে যাবো, আসি।’
‘শুনুন, আপনাদের এখান থেকে পাহাড় কতদূরে?’
‘বেশ দূরে। আপনি যেতে চান?’
‘হ্যাঁ। নিয়ে যাবেন পাহাড়ে?’
অর্ণব কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলো, ‘একটা গাড়ি ঠিক করি। কাল সকালে সবাই মিলে যাবো।’
‘সবাই মিলে যাবো না। আপনি আর আমরা দুইবোন যাবো।’
এবারও ভীষণ বিস্মিত হল অর্ণব। কখনো তীব্র রোদের মতো ঝাঁঝালো, আবার কখনো শীতের রোদেলা দিনের মতো মিঠে আচরণ করা মেয়েটাকে তার বিশ্বাস হচ্ছে না। একইসাথে মানুষ কীভাবে দুই ধরনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাস করে, জানা নেই তার।
বিভ্রান্তি নিয়ে অর্ণব নিচে নেমে এলো। তিনজন মিলে ঘুরতে গেলে মেয়েটার জন্য ভালোই হবে, ইচ্ছেমতো চিৎকার চেঁচামেচি করতে পারবে অর্ণবের সঙ্গে। তার রাগ সহ্য করার জন্য তাকে আজ থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।
নাদির স্যারের সঙ্গে বেশ কিছুদিন আগেই জাহ্নবী ফেসবুকে যুক্ত হয়েছে। আজ সারল্যকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি পোস্ট দিয়েছেন। জাহ্নবী কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। তারপর কোনোকিছু না ভেবেই সারল্য’র নাম্বারে একটা মেসেজ পাঠায়, শুভ জন্মদিন।
বিপরীতে আরেকটা মেসেজ এলো, ‘ধন্যবাদ জাহ্নবী। আপনি কীভাবে জানলেন আমার জন্মদিন আজ?’
জাহ্নবী গম্ভীর মুখে বসে রইল। তার কী সারল্যকে আরও একটা টেক্সট পাঠানো উচিৎ? কিন্তু সে তো মানুষটিকে এড়িয়ে চলতে চায়। জাহ্নবী দ্বিধাগ্রস্ত মুখে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে উত্তর দেয়, ‘আমি ওনাকে বন্ধু ভাবছি। স্রেফ বন্ধু হিসেবেই শুভেচ্ছা জানাচ্ছি তাকে।’
পরক্ষণেই জাহ্নবীর মনে হল, ওনার সুন্দরী স্ত্রী যদি মেসেজ দেখে বিরক্ত হয়! না থাক। অযথা কারও ব্যক্তিগত জীবনে অনুপ্রবেশের ইচ্ছে তার নেই। আর কোনো ফিরতি মেসেজ দেয় না সে। ফোনটা নিঃশব্দে রেখে দেয়।
অফিস শেষ হবার কিছুক্ষণ আগে নাদির স্যার জাহ্নবীকে জানালেন, আজ সারল্য ভাইয়ার জন্মদিন। একটা কেক কাটবো। বাইরের কেউ থাকবে না, আমাদের টিমের কয়েকজন। আপনি থাকবেন কিন্তু।
সহজ হওয়ার চেষ্টা করলো জাহ্নবী। হাতমুখ ধুয়ে চুল আঁচড়ে নিলো। অফিস শেষে সারল্য’র জন্য একটা ছোট্ট উপহারও কিনলো সে। তারপর নাদিরের সঙ্গেই রওনা দিলো রেস্তোরাঁর উদ্দেশ্যে।
সারল্যকে নিয়ে টিমের পাঁচজন মিলে কেক কাটা হল। আজ তার বিশুদ্ধ মুখে বিষাদের স্পষ্ট ছাপ। জাহ্নবীর কেমন যেন লাগে। এই মানুষটাকে মলিনমুখো মানায় না মোটেও। কী হল আজ তার? প্রিয়জনের সাথে ঝগড়া নয়তো?
জাহ্নবী হাসিমুখে সারল্য’কে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার জন্মদিন খুব খারাপ কেটেছে?’
‘না, খারাপ কাটবে কেন? এইযে আপনারা কেক কেটে শুভেচ্ছা জানালেন। ভালোই তো কাটল।’
‘আর কেউ শুভেচ্ছা জানায়নি?’
‘বন্ধু বান্ধব সবাই জানিয়েছে।’
‘কেক কাটেনি আর কেউ?’
‘না।’
‘আপনার স্ত্রী, মেয়েও না?’ তীব্র কৌতুহল থেকে জাহ্নবী প্রশ্নটি করে বসলো। মুহুর্তেই তার চোখের দিকে তাকালো সারল্য। তার নামের মতোই সরলতা ফুটে উঠেছে বদনে। নিষ্পাপ সারল্য!
সে বলল, ‘আমার মেয়ে জানেই না আজ আমার জন্মদিন।’
‘আপনার স্ত্রী জানেন না? সরি পারসোনাল প্রশ্ন করছি।’
‘আমার স্ত্রী নেই।’
‘আমি আপনার স্ত্রীকে দেখেছি, মিথ্যা বলবেন না।’
‘সে এখন শুধুই আমার মেয়ের মা, আর আমার প্রাক্তন স্ত্রী।’
মুহুর্তেই জাহ্নবীর তনুমনে প্রচণ্ড শব্দে সবকিছু এলোমেলো হতে আরম্ভ করল। রেস্তোরাঁর নীল আলো, অভিজাত পরিবেশের ঘ্রাণকে ছাড়িয়ে চাপা বেদনা তাকে চেপে ধরল আষ্ঠেপৃষ্ঠে। যে মানুষটাকে এতদিন শুদ্ধতম পুরুষ বলে জানতো সে, সেই মানুষটির হৃদয় জুরে হাহাকার। তীব্র বেদনা নিয়েও কী অবলীলায় সবার সঙ্গে মিশছে সে!
জাহ্নবীর কষ্ট হতে থাকে সারল্য’র জন্য। সারল্য ম্লান হেসে বলল, ‘বাদ দিন আমার কথা। জন্মদিন এখন শুধুই একটা দিন, যেদিন আমার বয়স এক বছর বেড়ে যায়। এর বেশী কিছুই না। এখন আর কোনোভাবেই এটাকে স্পেশাল দিন বলে মনে হয় না।’
জাহ্নবী গম্ভীর মুখে বসে রইল। কিছু বলতে গিয়ে টের পেলো তার গলা দিয়ে কোনো স্বর আসছে না। সারল্য’কে এমন ব্যথাতুর বদনে দেখার কষ্টটা তাকেও সমান ব্যথায় ভরিয়ে তুললো।
সারল্য মুহূর্তেই মুখে হাসি টেনে এনে বলল, ‘আজকে আমি ট্রিট দিবো। আপনি বসুন। কী খাবেন বলুন তো?’
জাহ্নবী একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। অন্যদিকে গিয়ে বাকিদের সাথে সহজ ভঙ্গীতে কথা বলতে লাগল সারল্য। জাহ্নবী অবাক চোখে সেদিকে চেয়ে থাকে। একজন নিঃসঙ্গ মানুষের কষ্ট তাকে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়।
খাবার খাওয়া শেষে সবাই আড্ডায় মেতে ওঠে। তাদের সঙ্গে হাসিতে যোগ দেয় সারল্য। জাহ্নবী’র হাসি আসে না। সে গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। একসময় সারল্য নিজেই জানতে চায়, ‘আপনার কী মুড অফ? অবশ্য সবসময়ই আপনি অফ মুডে থাকেন। আজকে সাইলেন্ট মুডে আছেন।’
‘জেনারেল মুডে আসবো। আপনি আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবেন?’
‘কোথায়?’ চমকে উঠে জানতে চাইলো সারল্য।
জাহ্নবী বলল, ‘যাবেন? আমার খুব প্রিয় একটা জায়গায়।’
‘কী হবে ওখানে গিয়ে?’
‘গেলেই দেখতে পাবেন। চলুন।’
রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে জাহ্নবী রিকশা ডেকে উঠে পড়ল। রিকশায় উঠতে উঠতে সারল্য বলল, ‘দয়া দেখাচ্ছেন?’
‘আপনাকে দয়া দেখানো যায় না।’
‘কেন যায় না?’
‘দয়া জিনিসটা সবার জন্য নয়। আপনি দয়ার অনেক উর্ধ্বে।’
সারল্য প্রত্যুত্তর দেয় না। রিকশায় উঠে পড়ে সে। ঢাকা শহরের উষ্ণ আবহাওয়ায় দুলে দুলে চলতে থাকে রিকশা। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে জাহ্নবীর একটুও জড়তা বা সংকোচ বোধ হচ্ছে না।
শাহবাগে সাড়ি সাড়ি ফুলের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো রিকশা। ভ্রু কুঁচকে সারল্য জানতে চাইলো, ‘এখানে কী হবে?’
‘আসুন।’
জাহ্নবীর পাশে হাঁটছে সারল্য। তার চোখে ব্যাপক বিস্ময়। জাহ্নবী ফুলের দোকানে গিয়ে ঢুকল। ডানে বাঁয়ে, সবখানে ফুল। এত ফুলের মাঝে সে যেন আরেকটি ফুল হয়ে ফুটল। স্বচ্ছ হাসি দেখা গেল তার ঠোঁটে। সারল্যকে ডেকে বলল, ‘ফুল দেখুন। কত রকমের ফুল আছে এখানে বলুন তো?’
‘তা আমি কী করে জানবো?’
ওরা হাঁটতে হাঁটতে সবগুলো দোকান পেরিয়ে গেল। আবার উলটো পথে হাঁটা ধরলো জাহ্নবী। সারল্য মুচকি হেসে বলল, ‘আপনি এখানে কেন পায়চারি করছেন?’
‘আপনিও আমার সঙ্গে পায়চারি করুন।’
দুপাশে অজস্র ফুল রেখে ওরা হাঁটছে। হরেক রকম ফুলের ঘ্রাণে চারপাশ সুরভিত। থরে থরে রাখা লাল গোলাপ, হলুদ গাঁদা, সাদা কিংবা হলুদ ফুলের রকমারি বাহার। সারল্য এগিয়ে গিয়ে এক ঝাঁক ফুলের ঘ্রাণ নিলো। আবারও ঘ্রাণ নিলো। আহ! কী যে ভালো লাগছে…
কথাটা বলে তৃতীয়বারের মতো ফুলের ঘ্রাণ নিলো সে। মনটা বিশুদ্ধতায় ভরে উঠল। জাহ্নবী বলল, ‘ফুল হচ্ছে আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর সবচেয়ে পবিত্র জিনিস। এ জন্যই এটা আমার প্রিয় জায়গা।’
সারল্য কোনো উত্তর দিলো না। জাহ্নবী বলল, ‘আজ আমি আপনাকে ফুল উপহার দেবো। কাউকে ফুল উপহার দেয়ার মানে কী জানেন?’
‘না জানিনা। আমাকে আপনি পছন্দ করেন?’
জাহ্নবী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উত্তর দেয়, ‘উফফ না। কাউকে ফুল উপহার দেয়া মানে হচ্ছে তাকে পবিত্র শুভেচ্ছা জানানো।’
‘অন্যভাবে জানালে সেটা পবিত্র হয় না?’
‘ফুলের মতো নিষ্পাপ, কোমল আর কিচ্ছু হতে পারে না।’
‘মানলাম। দিন ফুল কিনে দিন।’
জাহ্নবী হেসে বলল, ‘আপনার কোন রঙের ফুল পছন্দ?’
‘জানিনা। বোধহয় সাদা।’
জাহ্নবী আবারও মুচকি হাসলো। একগুচ্ছ সাদা দোলনচাঁপা ফুল কিনলো সে। সবুজ পাতার ভেতর সাদা ফুল। ফুলগুলো সে এগিয়ে দিলো সারল্য’র দিকে। সারল্য ফুল হাতে নিয়ে বলল, ‘থ্যাংকস। এই প্রথম কেউ আমাকে ফুল উপহার দিলো।’
‘ওয়েলকাম।’
ফুলের টাকা শোধ করে জাহ্নবী নেমে এলো রাস্তায়। সারল্য বলল, ‘আমিও আপনাকে ফুল উপহার দিতে চাই।’
‘কেন? আজ তো আমার জন্মদিন না।’ বিস্ময়ের সঙ্গে উত্তর দিলো জাহ্নবী।
সারল্য বলল, ‘আপনার মনটা অনেক ভালো। যাদের মন ভালো, তাদেরকে ফুল উপহার দিতে হয়।’
‘বাঃ আমার কাছ থেকে শিখে আমাকেই শোনাচ্ছেন এসব?’
হেসে ফেলল সারল্য। শব্দ করে হাসলো। এক হাতে দোলনচাঁপা ফুল নিয়ে সে দোকানে দোকানে ঘুরতে লাগল। জাহ্নবী বলল, ‘আপনার পছন্দের ফুল দিন।’
‘আমি আসলে কনফিউজড কোনটা নেবো।’
জাহ্নবী হেসে ফেলল। ফুলের ঘ্রাণে দেহমন জুরে এক ধরনের প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে ততক্ষণে। সারল্য বলল, ‘আপনি ওইযে একটা চায়ের দোকান দেখতে পাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ পাচ্ছি।’
‘ওখানে গিয়ে বসুন। চা, ফুচকা মুচকা যা ভাল্লাগে অর্ডার দিন। আমি ফুল নিয়ে আসছি।’
জাহ্নবী মাথা দুলিয়ে বলল, ‘আচ্ছা।’
ধীরপায়ে এগিয়ে গেল সে দোকানের দিকে। পাশাপাশি কয়েকটা ফুচকার দোকান। চা-ও পাওয়া যায় এখানে। সে একটা বেঞ্চিতে এসে বসলো। দূর থেকে দেখল দুজন ছেলেমেয়ে ফুল কিনছে। ছেলেটা ফুল কিনে দিচ্ছে মেয়েকে। কী অপূর্ব! আজ তাকেও একজন ফুল উপহার দেবে, ভাবতেই অবাক লাগছে তার।
জাহ্নবী এক প্লেট ফুচকা নিয়ে বসলো। সারল্যকে দেখা যাচ্ছে না। অগত্যা ফুচকা খেতে শুরু করল সে। এমন সময় একটা কিশোর ছেলে এক ডালি ভর্তি ফুল নিয়ে এসে রাখল জাহ্নবীর সামনে। ভীষণ অবাক হয়ে জাহ্নবী বলল, ‘এসব কী?’
ছেলেটা দাঁত বের করে হাসলো। ফুল রেখে চলে গেল সে। সারল্যকে আসতে দেখা যাচ্ছে। নির্বিকার ভঙ্গীতে সারল্য এসে দোকানীকে চা দিতে বললো। জাহ্নবী’র বিস্ময় এখনো কাটেনি। সে বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘এত ফুল কেন এনেছেন!’
সারল্য মুচকি হেসে বলল, ‘কোনটা নেবো কনফিউজড হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল সবগুলো ফুল কেন নিচ্ছি না।’
‘এতগুলো ফুল আমি কী করবো?’
‘এই দুইটা দোলনচাঁপা দিয়ে আমি যা করবো।’
‘খুব সারপ্রাইজড হয়েছি। বসুন। ফুচকা খান।’
‘না ম্যাডাম, আমি বাইরের ফুচকা খাইনা।’
জাহ্নবী কয়েক পলক সারল্য’র দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ কেঁপে উঠল সে। এই তো তার পান্নাবাহার। তার পাশে বসে চা খাচ্ছে। তাকে কিনে দিয়েছে এক ডালি ফুল! জাহ্নবী বুক ভরে নিশ্বাস নেয়। ফুলের ঘ্রাণে ভরে যায় বুক।
একটা রিকশা নিয়ে উঠে পড়ল তারা। সারল্য’র কোলের ওপর ফুলের ডালি। সে জাহ্নবীকে বাসায় পৌঁছে দেবে বলেছে। জাহ্নবী এই প্রথম কোনো আপত্তি জানায়নি। রিকশায় মৃদু বাতাসে ফুলেল ঘ্রাণ ভাসছিল। জাহ্নবী’র কাছে এই সন্ধ্যা, এই রাত ঠিক স্বপ্নের মতো।
চলবে..
উপন্যাস: মেঘফুল
পরিচ্ছদ: ৪২
ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মৃদুমন্দ হাওয়ার সাথে শহুরে রাত্রি পেয়েছে পূর্ণতা। রিকশার ক্রিংক্রিং শব্দ আর গাড়ির হর্ণের তালে জাহ্নবী’র স্বপ্নস্বপ্ন লাগার ভ্রম ভঙ্গ হয়। রিকশায় চড়ে কখনো এত আনন্দ পায়নি সে। পান্নাবাহার এত যত্ন করে ফুলের বিশাল ডালিটা কোলে নিয়ে বসে আছে, মনে হচ্ছে এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য সে আর কখনো দেখেনি।
সারল্য বলল, ‘একটা কথা বলবো জাহ্নবী?’
‘বলুন।’
উদাস গলায় সারল্য বলল, ‘আমার খুব মন খারাপ ছিল আজ। স্পেশাল দিনগুলো আমি খুব গুরুত্ব নিয়ে সেলিব্রেট করতে পছন্দ করি। অথচ আমার জীবন থেকে সব স্পেশাল দিন বিলীন হয়ে গেছে। কী অদ্ভুত না!’
জাহ্নবীর ইচ্ছে করল সারল্য’র মুখখানা একপলক দেখতে। কিন্তু এত কাছাকাছি বসে আছে তারা, ঘাড় ঘুরিয়ে তার মুখের দিকে তাকাতে লজ্জা পাবে সে। তাই ফুলের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘আমি তো আপনার দিনটা স্পেশাল করে দিলাম। এটার কী কোনো দাম নেই? নাকি আরও আরও বিশেষ কিছু করতে হবে?’
জাহ্নবীর কথায় হেসে ফেলল সারল্য। সত্যিই আজ এই মেয়েটার কাণ্ডে তার দিনের শেষ ভাগটুকু খারাপ কাটেনি। অদ্ভুত ধরনের নতুন এক অভিজ্ঞতার ভেতর প্রবেশ করেছে সে।
জাহ্নবী বলল, ‘আপনি খুব তারাতাড়ি আমার বন্ধু হয়ে গেছেন। আমার জীবনে আসলে কখনো কোনো বন্ধু ছিল না। নাদির স্যার আমার প্রথম বন্ধু। তার সূত্রে এইযে আপনার সঙ্গেও আমার বন্ধুত্ব হল। স্যারের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ফুরাবে না কখনো।’
‘আপনার কখনো বন্ধু ছিল না?’ বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চায় সারল্য।
জাহ্নবী ম্লান হেসে বলল, ‘আপনার কী মনেহয় এই পৃথিবীতে আপনি একাই খুব নিঃসঙ্গ? আপনার চাইতেও একাকী, অসহায় মানুষ এখানে আছে।’
‘হুম। আমার জীবনটা আগে অন্যরকম ছিল। হাসি, আড্ডা, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ভরপুর। গত আড়াই বছরে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে।’
জাহ্নবী বিষয়টাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় বলল, ‘আপনার বন্ধুরা সবাই অনেক ফ্রি মাইন্ডের। আমার ভালো লেগেছে। আচ্ছা, আপনি কি প্রায়ই ওখানে চা খেতে আসেন?’
‘কোথায়?’
‘টি মিট টোস্টে?’
‘যখন খুব একা লাগে তখন আর বন্ধুরা ডাকলে আসি।’
‘এখন তো দোকানের সামনেই আপনার একজন বন্ধু বাস করে।’
সারল্য মুচকি হেসে বলল, ‘ঠিক আছে। এখন থেকে আপনাকে ডাকবো।’
মনেমনে দারুণ খুশি হল জাহ্নবী। এলোমেলো বাতাসে কানের পাশে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো উড়ে এসে মুখের ওপর পড়ছিল। সরাতে ইচ্ছে করল না। আজকে রংধনু ভাললাগায় মেতে উঠেছে মন।
বাসার সামনে পৌঁছে রিকশা ভাড়া দেয়ার সময় ছোটখাটো একটা তর্ক হয়ে গেল। দুজনেই ভাড়া পরিশোধ করতে চায়। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলো জাহ্নবী। সারল্য ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে জাহ্নবীকে বলল, ‘আপনি ফুলের ডালি নিয়ে ওপরে যেতে পারবেন বলে মনে হয় না। আমি পৌঁছে দিয়ে আসি।’
‘না, না। তার দরকার নেই। দাড়োয়ান চাচাকে একশো টাকা দিলেই উনি পৌঁছে দেবেন। আপনাকে আর কষ্ট দিতে চাইনা।’
‘ফুলের মতো চুপচাপ থাকুন। ফুল হয়ে যান। পারলে ডালির ওপর বসে পড়ুন। আপনাকেও বাসায় রেখে আসতে পারবো।’
জাহ্নবী মুচকি হেসে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আসুন। কিন্তু আমার তো মেয়েদের ফ্ল্যাট। আপনাকে চা খেতে বলতে পারবো না।’
‘আমি চা খাওয়ার লোভে ওপরে যাচ্ছি না।’
মুখ টিপে হাসলো জাহ্নবী। সারল্য ফুলের ডালি নিয়ে লিফটে প্রবেশ করল। লিফটের আয়নায় ওকে খেয়াল করছিল জাহ্নবী। তার শুদ্ধতম মানুষটাকে এখন আরও বেশী বিশুদ্ধ দেখাচ্ছে।
ফ্ল্যাটের দরজায় ডালি রেখে সারল্য বলল, ‘আমি তাহলে আসি।’
‘দরজা থেকে আপনাকে বিদায় দিতে আমার খারাপ লাগছে।’
‘তাহলে সিঁড়ি থেকে দিন।’
‘হা হা হা।’
জাহ্নবী শব্দ করে হাসলো। দরজা খুলে ডালিটাকে ভেতরে রেখে সে বলল, ‘চলুন। আপনাকে টি মিট টোস্ট থেকে এক কাপ চা খাওয়াই।’
‘রাত দশটা বাজে।’
‘তো?’
‘সারাদিন অফিস করে আপনি ক্লান্ত।’
‘আমি ক্লান্ত সেটা আমার চাইতে আপনি বেশী টের পাচ্ছেন?
‘তা পাচ্ছি না।’
‘তাহলে চলুন, চা খেয়ে আমার অপরাধবোধটা কমাই।’
‘When tea meet toast’ নামের দোকানটিতে প্রবেশ করতে এতটা ভালো কখনোই লাগেনি জাহ্নবীর। আজ খুব একটা ভীড় নেই। একটা টেবিলে মুখোমুখি বসলো তারা। জাহ্নবী’র মাঝে নেই কোনো জড়তা, নেই কোনো ভয়ডর। সে নির্দ্বিধায় উঠে গিয়ে দুই কাপ চা ও তিন ধরনের টোস্ট দিতে বললো। সঙ্গে অনুরোধ করল তার প্রিয় সেই গানটা বাজাতে।
এরপর চেয়ারে এসে বসলো সে। তাকালো পান্নাবাহারের দিকে। মধুর সুরের প্রিয় সেই গানটা বেজে উঠল তখন।
“তোমাকে বুঝিনা প্রিয়, বোঝো না তুমি আমায়..
দূরত্ব বাড়ে যোগাযোগ নিভে যায়।”
বুকের ভেতর চিনচিন করে ওঠে জাহ্নবী’র। এই তো সেদিন প্রথম দেখা, এই গানটাই বাজছিল তখন। সারল্যকে দেখে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল সে। আবারও ফিরে পেয়েছিল নতুনভাবে। একটা নতুন জন্ম হয়েছে তার। এই তার পান্নাবাহার।
সারল্য’র কথায় জাহ্নবী’র সম্বিত ফিরল, ‘আপনি বিয়ে করেননি কেন?’
জাহ্নবী চমকে উঠল। তার বলা উচিৎ ‘আপনাকে পাইনি বলে’। কিন্তু এটা নিছক মিথ্যা বলা হয়ে যায়। তাই সত্যিটাই বলল সে, ‘একটা বয়স পর্যন্ত আমার ছেলেদের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। প্রেম, সংসার এসবের প্রতিও না।’
‘আর এখন?’
সারল্য’র চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা শুনে জাহ্নবী কেঁপে উঠল। এখন তার মনের অবস্থা বোঝার মতো সাধ্যি কী তার নিজেরও আছে!
সে লাজুক হেসে মাথা নামিয়ে ফেলল। উত্তর দিলো না। সারল্য আর এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। চা চলে এসেছে। চায়ের মগে টোস্ট চুবিয়ে খেতে শুরু করল সারল্য।
জাহ্নবী মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। মনে হচ্ছে সারল্য একটা ছোট্ট শিশু। তার প্রিয় গানটা ততক্ষণে শেষ। পুরোটা সময় একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে ছিল সে। হঠাৎ যেন ধাক্কা খেলো। লাজুক হেসে চায়ের কাপ তুলে নিলো জাহ্নবী। বলল, ‘চায়ের বিলটা আমি দিয়েছি কিন্তু।’
‘বন্ধুদের ভেতর এরকম থাকতে হয়না জাহ্নবী।’
‘বন্ধুদের ভেতরেই এরকম থাকতে হয়।’
‘হয় না।’
‘তাহলে আপনার ফুলের ডালি ফেরত দেবো, নেবো না।’
সারল্য হাসতে হাসতে বললো, ‘উফফ বাবা। মানলাম, আপনিই ঠিক। আমিই ভুল। বন্ধুদের মধ্যে এরকম হয়। এখন থেকে আমি আর কোনো বিলই দেবো না। সব আপনি দেবেন।’
জাহ্নবী হেসে বলল, ‘দেবো।’
‘এক বালতি চা খাবো আজকে।’
‘খান। পরে শরীরের রক্তকণিকা গুলো চা কণিকায় পরিণত হবে।’
‘আমি চা মানব হয়ে যাবো।’
দুজনেই হেসে উঠল। জাহ্নবী মুগ্ধ হয়ে দেখল ওই মানুষটার হাসি। ওর পলক ফেলতে ইচ্ছে করে না। কেবল ইচ্ছে হয় আজন্মকাল ধরে চেয়ে থাকি মানুষটার বিশুদ্ধ মুখের পানে।
পান্নাবাহারকে বিদায় দিয়ে বাসায় এসে অনেক্ষণ ফুলের ডালি নিয়ে বসে রইল জাহ্নবী। ওর বাসায় থাকা প্রত্যেকটা মেয়েকে ফুল উপহার দিলো। ভায়োলেটকে এক গুচ্ছ ফুল দিতে ইচ্ছে করছে। তাকে ফোন করল জাহ্নবী। কিন্তু কলটা রিসিভ হল না।
নির্জন ঘরটাতে শুতেই ঘুমে চোখ বুজে এসেছে ভায়োলেটের। ঘুমের ঘোরে সে শুনতে পাচ্ছে সামারের গলা। তার পাশেই শুয়েছে সামার। আরজুর সাথে ফোনে কথা বলছে। এখানে আসার কথা জানেনা আরজু। জানলে নির্ঘাত আজ এত হেসে হেসে কথা বলতে পারত না সামার। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ভায়োলেট।
জানালায় মৃদু শব্দ হচ্ছে। খসখস শব্দ। সামার ফোন সরিয়ে বারকয়েক ভায়োলেটকে ডাক দিলো। সাড়া না পেয়ে ভয়েই শিউরে উঠল সে। খসখস শব্দটা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ফোন কেটে দিলো সামার। ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। শব্দটা যাচ্ছে না। ভায়োলেটও উঠছে না। বাধ্য হয়েই অর্ণবকে কল দিলো সে। শব্দের কথা জানাতেই অর্ণব দ্রুত চলে এলো।
দরজা খুলে দিয়ে সামার বলল, ‘শুনতে পাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ। আমি দেখছি।’
জানালা খুলে কিছুই দেখতে পেলো না অর্ণব। বলল, ‘বাইরে গিয়ে দেখে আসি।’
‘না, যাবেন না। আমার ভয় করছে।’
‘জিনিসটা বাইরে। আমি গিয়ে দেখি কীসের শব্দ।’
‘আমিও যাবো।’
অর্ণব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সামারকে সঙ্গে নিয়ে বাসা থেকে বের হল সে। বাড়ির পেছন দিকের জানালার পাশে শব্দের উৎপত্তি খুঁজতে এসেছে তারা। অর্ণবের হাতে টর্চ লাইট। জানালার কাছে আলো ধরতেই একটা কালো প্রাণী দেখে লাফ দিয়ে অর্ণবকে জাপটে ধরল সামার। অর্ণব চমকে ওঠে। সামারের উষ্ণ শরীরে বাসন্তী সুবাস। তার শরীরে চনমনে ঢেউ এসে দোলা লাগে। বুকটা টনটন করে ওঠে। অর্ণব মৃদু স্বরে বলল, ‘ওটা একটা কুকুর। ময়লার বিন থেকে পলিথিনের ঠোঙা নিয়ে এসেছে। সেটারই খসখস শব্দ শুনেছেন।’
ধীরেধীরে অর্ণবকে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ায় সামার। ওর লজ্জা লাগছে। লাজুকতা কাটাতে কিছুটা রাগমিশ্রিত স্বরে সে বলল, ‘আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন? যান কুকুরটাকে তাড়িয়ে দিন।’
অর্ণব হা করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সে তাকে যেভাবে জাপটে ধরে রেখেছিল, তাতে কুকুর তাড়াতে যাওয়ার সুযোগ সে কোথা থেকে পাবে! মেয়েটার স্বভাবটাই এমন। অর্ণবকে সবসময় ঝাড়ির ওপর রাখতে পারলে আনন্দিত হয় সে।
অর্ণব কুকুর তাড়িয়ে দিয়ে এসে বলল, ‘চলুন।’
এবার আগে আগে হাঁটছে সামার। ভয়ের বিন্দুমাত্র আভাস নেই তার মাঝে। অর্ণব মনেমনে বলল, ‘অদ্ভুত!’
ঘরে ঢোকার আগে সামার বলল, ‘আমার খুব খিদে পেয়েছে।’
‘আচ্ছা মাকে ডেকে দিই।’
‘না, না। ওনাকে ডাকলে লজ্জা পাবো৷ আপনি কিছু একটা এনে দিন।’
‘আমি দেখছি ফ্রিজে কী আছে।’
সামার বৈঠকখানায় সোফায় বসে পড়ে। মিনিট খানেকের মাথায় ফিরে এলো অর্ণব। হাতে একটা বাটি। সে বাটিটা সামারের সামনে রেখে বলল, ‘পেস্ট্রি আর মিষ্টি আছে। হবে?’
মুচকি হেসে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সামার খেতে আরম্ভ করল। এক কামড় দিয়েই রাগের সুরে বলল, ‘এত ঠাণ্ডা একটা খাবার আপনি আমাকে খেতে দিলেন?’
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অর্ণব বলল, ‘ওরে বাপ এটা ফ্রিজ থেকে বের করেছি। ঠাণ্ডা তো হবেই। একটু অপেক্ষা করে তারপর খান।’
সামার উত্তর দিলো না। কোঁচকানো ভ্রু নিয়ে সে অর্ণবের দিকে তাকিয়েই রইল। মুশকিলে পড়েছে অর্ণব। তাকে একা বসিয়ে রেখে ঘরে যেতে পারছে না, আবার এখানে বসে থাকতেও বিব্রত লাগছে তার। সে মাথা নিচু করে গম্ভীর হয়ে গেল।
সামার মিষ্টি খাচ্ছে। রাগ ঝড়ে গেছে তার। খাওয়া শেষ করে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে বলল, ‘ থ্যাংক ইউ সো মাচ।’
‘এখন ঘরে যান।’
‘আমরা কালকে কখন বের হচ্ছি?’
‘সকালের নাস্তা খেয়ে।’
ঘরে চলে গেল সামার। ঠায় বসে রইল অর্ণব। তার শরীর ও মন অদ্ভুতভাবে দোলাচলে দুলছে। আবারও এই মেয়েটাকে ভালবাসতে শুরু করেছে সে। কিন্তু তাকে কখনোই পাবেনা জেনেও ভালবাসাটা নিতান্তই ভুল। মনকে এই ভুল করা থেকে কীভাবে আটকে রাখবে সে? ভালবাসা তো আটকে রাখা যায় না। যতটা আটকাতে চেষ্টা করা হয়, ততটাই তীব্র হয় মায়া। সেই মায়া কাটিয়ে বেরিয়ে আসা কঠিন, ভীষণ কঠিন।
চলবে..
উপন্যাস: মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৪৩
সকালের নাস্তা খেয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে তারা তিন জন- অর্ণব, সামার ও ভায়োলেট। পারভীন কঠিন মুখ করে রেখেছেন। নির্লজ্জের মতো মেয়েগুলো অর্ণবের সঙ্গে ঘুরতে চলে গেল, অথচ তাদেরকে সঙ্গে নেয়ার প্রয়োজন মনে করল না। এ ধরনের স্বভাব একদমই পছন্দ করেন না তিনি। অথচ নিজের মেয়েই সেই স্বভাব ধারণ করে বসে আছে।
গাড়ির দ্বিতীয় আসনে বসলো সামার ও ভায়োলেট। ড্রাইভারের পাশের সিটে অর্ণব। সোনালী আলো গাড়ির কাঁচের ওপর এসে পড়ছে। আনন্দে ঝিলমিল করছে সামার। এইমুহুর্তে তাকে দেখে নিঃসন্দেহে সুখী মেয়ে বলে মনে হবে। তথাপি অর্ণব জানে, যেকোনো মুহুর্তে হারিকেনের সলতের মতো দপ করে জ্বলে উঠবে সে।
সামার ফোনে মেসেজিং করতে করতে মিটিমিটি হাসছে। লুকিং গ্লাসে সেই দৃশ্য দেখে বুকে ব্যথা করে অর্ণবের। সামারের প্রতি তার দূর্বলতা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এই দৃশ্য হজম করা তার জন্য খুবই কঠিন।
সে চাইলো দৃশ্যে ব্যাঘাত ঘটুক। তাই গাড়ি দাঁড় করাতে বলল রাস্তার পাশে। সামার মুখ তুলে চাইলো, ‘এখানে নামবো কেন?’
‘একটা দারুণ জিনিস দেখাবো, আসুন।’
গাড়ির দরজা খুলে দিলো অর্ণব। সামার ও ভায়োলেট নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। আশেপাশে দু একটা বাড়ি ছাড়া এই ফাঁকা রাস্তায় দারুন হবার মতো আর কিছুই খুঁজে পেলো না তারা। অর্ণব আশেপাশে তাকিয়ে বলল, ‘আরে এখানে একটা দোকান ছিল তো! কোথায় গেল সেটা?’
চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখছে সে। সামার রাস্তায় নেমে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অর্ণব অভিনয়টা ঠিকঠাক জানেনা। তবুও তাকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। এখানে কস্মিনকালেও কোনো দোকান ছিল না। অথচ তাকে দেখে মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি এখানে একটা দোকান না থাকাটা অপরাধ।
সামার বলল, ‘কীসের দোকান ছিল?’
‘চায়ের। এত অসাধারণ চা বানায়। আপনি এক কাপ খেয়ে উঠতেই পারবেন না। কমছে কম চার পাঁচ কাপ খাবেনই। কিন্তু দোকানটা দেখছি না কেন!’
‘হয়ত সরিয়ে ফেলেছে। আর নয়তো আপনার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।’
‘আমার ভুল হচ্ছে!’
‘হতে পারে এখানে কোনো দোকান ছিলোই না।’
চমকে উঠলো অর্ণব। ধরা পড়ার ভয়ে মুখ কাচুমাচু করে সে সামারের দিকে তাকালো। সামার বলল, ‘আপনি যে দোকানের কথা বলছেন, সেটা হয়তো অন্য কোথাও। চলুন কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখি।’
অর্ণব হাফ ছেড়ে বাঁচল। মনেমনে নিজেকে গালি দিলো সে। কিসের দুঃখে মিথ্যে বলতে গিয়েছিল, এই ভেবে আক্ষেপ হল তার। সামার একজন পথচারীকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে একটা চায়ের দোকান ছিল। আপনি জানেন ওটা কোথায়?’
লোকটা খানিক্ষন চুপ করে থেকে উত্তর দিলো, ‘আমি বলতে পারছি না। এ এলাকায় খুব কম এসেছি আমি।’
‘ধন্যবাদ।’
লোকটা চলে গেলে সামার অর্ণবকে বলল, ‘বাদ দিন। চা খেতে হবেনা। গাড়িতে উঠুন।’
অর্ণব গোবেচারার মতো মুখ করে গাড়িতে এসে ওঠে। ভায়োলেট বলল, ‘আমাদেরকে চা খাওয়াতে না পেরে ভাইয়ার খুব মন খারাপ হয়েছে। সামনে কোথাও একটা দোকানে চা খেয়ে নিলেই হবে। আপনি মন খারাপ করবেন না।’
অর্ণব কোনো উত্তর দেয় না। সে জেনেশুনেই গাড়ি দাঁড় করিয়েছে এখানে। এখন তার আনন্দ পাওয়া উচিৎ। কিন্তু অদ্ভুত কারণে সে আনন্দ পাচ্ছে না, বরং মিথ্যে বলার কারণে অনুশোচনা হচ্ছে। সে বেশ বুঝতে পারল, এসব তাকে দিয়ে হবেনা।
আবারও ফোনে মত্ত হয়ে গেল সামার। অর্ণবের কিছু করার নেই বলেই এই দৃশ্যটি হজম করা ছাড়া উপায় রইল না। কিছুদূর আসার পর একটা চায়ের দোকান দেখে গাড়ি থামাতে বলে সামার। গাড়ি থেকে নেমে সে জানতে চাইলো, ‘এটার কথা বলেছিলেন?’
অর্ণব চুপ করে রইল। সে বিভ্রান্ত। কী উত্তর দেবে জানা নেই তার। সামার তাদের সবাইকে চা দিতে বলে রাস্তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়৷ বেশ খোলামেলা জায়গা। সূর্য অনেক লখানি মাথার ওপর উঠে গেছে। ঝিলমিল করা রোদে দুই হাত মেলে দিয়ে সামার দাঁড়িয়ে রইল। বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে সে। অর্ণবের বুকের ভেতর কেমন যেন হয়! মন ভালো হয়ে যায় তার। সামারের প্রেমে নিজেকে নব আঙ্গিকে আবিষ্কার করে সে।
চা হয়ে গেছে। সামার চায়ের কাপ হাতে নিয়ে লম্বা করে একটা চুমুক দিয়ে বলল, বাহ!
অর্ণব চমকে ওঠে। চা ভালো হয়েছে! কীভাবে ঘটলো এই কাকতালীয় ঘটনা?
বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল অর্ণব। চায়ে চুমুক দেয় সে নিজেও। সত্যিই অসাধারণ চা হয়েছে। তার মনে দোলা লাগে। প্রেমে পড়লে সবকিছুই ভালো লাগে নাকি সত্যিই চা’টা এতটা ভালো হয়েছে সেটা বোঝার জন্য সামারের দিকে তাকায় সে।
সামার দ্রুত এক কাপ শেষ করে আরও এক কাপ চেয়ে নিলো। বলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছিলেন। খুব ভালো হয়েছে। এক কাপে মন ভরেনি। আমি বললাম না আপনারই ভুল হয়েছে জায়গা চিনতে। দোকানটা এখানেই ছিল, আপনি হয়তো ওখানে ভেবে ভুল করেছেন।’
অর্ণব উত্তর না দিয়ে হাসলো। প্রতি একশো বছরে কী এমন কাকতালীয় ঘটনা ঘটে! নিজেকে সুধালো সে। অনেক্ষণ হাসি লেগে রইল তার মুখে। চা শেষ করে তারা উঠে পড়ল গাড়িতে।
সামার এবার আর ফোন বের করল না। মুগ্ধ হয়ে বাইরের প্রকৃতিকে হৃদয়ে ধারণ করছে সে। সবুজে ঘেরা আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে তাদের গাড়ি। সামার ড্রাইভারকে বলল, ‘গাড়ির গতি কমিয়ে দিন।’
সময়ের মৃদুমন্দ গতিতে এগিয়ে চলল জাহ্নবী’র জীবন। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ফোন হাতে নিয়েই সে দেখল সারল্য’র মেসেজ, “ধন্যবাদ জাহ্নবী। আজকের সন্ধ্যাটা সুন্দর করে দেবার জন্য।”
রাত সাড়ে বারোটায় মেসেজটি পাঠিয়েছে সারল্য। জাহ্নবী’র দিনের শুরুটা খুব চমৎকারভাবে হল এই মেসেজ দেখে। সে গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে হাতমুখ ধুয়ে এসে বসল। অফিসে যেতে হবে তাকে।
অফিসে পৌঁছে জাহ্নবী কাজে মন দেয়। কাজ করতে খুব ভালো লাগছে তার। ফুরফুরে লাগছে। পাশের ডেস্কের মেয়েটির এলিয়ে দেয়া চুল দেখে জাহ্নবী অনেক্ষণ তাকিয়ে রইল। আগে মেয়েটি ছিল কোঁকড়াচুলো। এখন সব চুল সোজা হয়ে খানিকটা লম্বাও হয়ে গেছে। ওপরে ঝিলিক দিচ্ছে হালকা বাদামী রং। জাহ্নবী’র খুব শখ জাগছে হঠাৎ। চুলগুলোকে লালচে করে ফেলার।
অফিস থেকে বেরিয়ে একটা পার্লারে এসে ঢোকে সে। পছন্দসই একটা ‘হেয়ার কাট’ দিয়ে চুলে লালচে রং করে। আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখে সে মুগ্ধ হয়, কতদিন পর চেনা জাহ্নবী’র বাইরে কাউকে দেখল সে!
ঠিক দুদিন পর সারল্য’র নাম্বার থেকে ফোন এলো। জাহ্নবী চমকে ওঠে। হাসিমুখে ফোন কানে ধরতেই সে শুনতে পেলো সারল্য’র উদ্বিগ্ন গলা, ‘জাহ্নবী, আপনার ব্লাড গ্রুপ কি?’
‘বি পজেটিভ।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কি আজকে একজনকে ব্লাড দিতে পারবেন?’
‘জি পারবো। কোথায় আসতে হবে বলুন?’
‘ল্যাবে এইডে চলে আসুন। আমিও আসছি।’
‘কী হয়েছে বলুন তো আমাকে?’
পান্নবাহার একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘ক্লারার নানু মানে আমার শাশুড়ী মায়ের অপারেশন হয়েছে। ইমার্জেন্সি ব্লাড দিতে হবে।’
জাহ্নবী দ্রুত তৈরি হয়ে নিলো। সারল্য’র স্ত্রীও নিশ্চয়ই সেখানে থাকবে। দেখা হবে দুজনের। যে মেয়েটকে একদিন তার হিংসে হয়েছিল, যাকে দেখে নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ বলে মনে হয়েছিল তার। আজ আবার তার সঙ্গে দেখা হবে। রক্ত দিতে হবে তার মাকে। প্রকৃতির এই অদ্ভুত খেলা বোঝার সাধ্য তার মতো ক্ষুদ্র প্রাণীর নেই।
জাহ্নবী হাসপাতালে চলে এলো। অপেক্ষা করছিল সারল্য। জাহ্নবীকে নিয়ে ওপরে চলে এলো সে। বলল, ‘ডোনার ম্যানেজ করেই রেখেছিল ওরা। অপারেশনের আগে এখানেই কার যেন জরুরি ভিত্তিতে ব্লাড দরকার হয়েছিল। ক্লারার মা ডোনারকে বলেছে আপনি ওনাকে দিয়ে দিন। আমার মায়েরটা পরে দেখা যাবে। ওরা আশা করেছিল আম্মার ব্লাড লাগবে না।’
সারল্য’র উদ্বিগ্ন মুখখানা দেখে বড্ড মায়া হল জাহ্নবীর। পরিবারের সকলেই ছুটে এলো তাদেরকে দেখে। এদের মধ্যে সারল্য’র স্ত্রীও আছে। এলোমেলো চুলেও মেয়েটাকে কী অপূর্ব লাগছে দেখতে!
মেয়েটা জাহ্নবীকে বলল, ‘আপনি ভালো আছেন?’
‘জি। চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘থ্যাংক ইউ আপু।’
মেয়েটা ডাক্তারের কাছে ছুটে গেল। ক্লারা এসে জাপটে ধরল ওর বাবাকে। মেয়েকে কোলে তুলে নিলো সারল্য। আদর করে দিয়ে বলল, ‘আমার আম্মুটা, মন খারাপ কোরো না।’
‘বাবা, এই আন্টিটা আমাদেরকে পিজ্জা খাইয়েছিল না?’
‘হ্যাঁ মা। এখন এসব বলে না। আম্মু খুব টেনশনে আছে না?’
‘আমিও খুব টেনশনে আছি বাবা।’
‘ওরে আমার সোনা মা রে।’
ক্লারাকে কোলে নিয়ে পায়চারি করতে লাগল সারল্য। ডাক্তার এসে জাহ্নবীকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। সারল্য ইশারায় বোঝাতে চাইল, ‘আপনি যান, আমি আছি।’
সব আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে জাহ্নবীকে বেডে শুইয়ে দেয়া হল। সারল্য ক্লারাকে নিয়ে এসে বসলো তার পাশে। রক্তদানের পুরোটা সময় বলতে গেলে পাশেই বসে রইল সে। বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে জাহ্নবীকে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করলো। এর মাঝে দু’বার তার স্ত্রী এসে জাহ্নবীকে দেখে গেছে। জাহ্নবী অবাক হয়ে খেয়াল করছে সারল্য ও তার স্ত্রী খুব স্বাভাবিকভাবে থাকার চেষ্টা করছে কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথা বলছে না।
কাজ শেষ হলে উঠে পড়ল জাহ্নবী। মেয়েটা কিছু খাবার নিয়ে এসেছে তার জন্য। জাহ্নবী বলল, ‘এসবের কী দরকার ছিল আপু?’
‘আপু, আপনি যে আমার কী উপকার করলেন।’
কথাটা বলেই সে সারল্য’র দিকে তাকালো। চোখাচোখি হল তাদের। মেয়েটি সারল্য’কে কী বোঝাতে চাইছে জাহ্নবী তা ধরতে পারল না। হয়তোবা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। কিন্তু দুজন আলাদা হয়ে গেলেও তাদের এই চোখাচোখি জাহ্নবী’র সহ্য হল না। বুকের ভেতর এক ধরনের সুক্ষ্ম ব্যথা টের পেলো সে।
ক্লারা ঘুমিয়ে পড়েছে সারল্য’র কোলে। এই মায়াবী দৃশ্যের সমাপ্তি ঘটল যখন তার স্ত্রী বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে নেয়। সারল্য বলল, ‘আমি আছি। সমস্যা নেই।’
‘তুমি অনেক টায়ার্ড। বাসায় যাও।’
‘এখানে থাকি…’
কথা শেষ করতে পারল না সারল্য। ক্লারার মা বলল, ‘না। থাকতে হবেনা। আমরা সবাই আছি। তুমি বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও।’
ম্লান হাসল মেয়েটি। সারল্য একটা নিশ্বাস ফেলে জাহ্নবীকে বলল, ‘আসুন।’
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে জাহ্নবী ভাবতে লাগল, একটা সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়াকে বলে বিচ্ছেদ। কিন্তু বিচ্ছেদ হলেই সবকিছু শেষ হয় না, সম্পর্ক কিছু একটা রেখে যায়। যা রেখে যায়, তার কোনো নাম হয়না।
সারল্য জানতে চাইলো, ‘অনেক রাত হয়েছে। পাঠাও পাবো কীনা কে জানে। সিএনজি নেবো?’
জাহ্নবী খানিকটা বিব্রত হয়ে বলল, ‘সরি, কীভাবে যে বলি..’
‘কোনো সমস্যা?’
‘আমার বাসার গেট বন্ধ হয়ে যায় এগারোটায়। এখন তো সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। এত রাতে দাড়োয়ানকেও মনে হয় পাবো না।’
সারল্য কিছু একটা ভেবে ঝট করে উত্তর দিলো, ‘আমার বাসায় যেতে আপনার আপত্তি আছে? বাড়িতে আম্মু আছে, আমার বোন, ভাগ্নী আছে।’
জাহ্নবী ইতস্তত বোধ করল। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়েই সে ভাবছিল আজকে বাসায় যাবে কীভাবে। বাড়িওয়ালা অনেক কড়া। রাত এগারোটায় গেট বন্ধ হওয়ার পর দাড়োয়ানকে পাওয়া যাবে কী না নিশ্চিত ছিল না সে। এর আগে কখনো সে রাত করে ফেরেনি। আজ রাতটা হাসপাতালেই থেকে যাবে ভাবছিল সে। সারল্য’র প্রস্তাবে ভীষণ চমকে উঠেছে।
সারল্য বলল, ‘চিন্তার কিছু নেই। আমার আম্মু অনেক মিশুক। আপনার অসুবিধা হবে না। কাল সকালে আমি আপনাকে অফিসে রেখে আসবো। আমি তো ভেবেছিলাম রাতটা হাসপাতালেই কাটিয়ে দেবো। ও তো আমাকে থাকতেই দিলো না..’
জাহ্নবী বলল, ‘আপনাকে সত্যিই অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে।’
‘আপনাকেও। সারাদিন অফিস করে ফিরেছেন, আমি তখনই ফোন দিয়েছি। আপনার প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা।’
জাহ্নবী ম্লান হাসলো। রাস্তার ওপাশে আলো জ্বলতে থাকা ‘আড্ডা’ রেস্টুরেন্টের দিকে চোখ গেল তার। মনে পড়ে গেল সেই রাতের কথা। এখানেই পার্টি হয়েছিল নাদির স্যারের। মখমলি ব্লাউজের সঙ্গে শাড়ি পরে সাজগোজ করে এসেছিল সে। কিন্তু ফিরে গিয়েছিল ব্যথাতুর হৃদয় নিয়ে। সেদিন রাতেই পান্নাবাহারের স্ত্রীকে প্রথম দেখেছিল সে। স্লিভলেস গাউন পরা, গলায় হিরের নেখলেস। অপূর্ব রূপবতী মেয়েটিকে দেখে তার হিংসে হয়েছিল, কষ্ট হয়েছিল। পান্নাবাহারকে মন থেকে সরিয়ে ফেলতে রাতের পর রাত নির্ঘুম বিষাদে কেটেছিল তার।
সারল্য’র ডাকে জাহ্নবী সম্বিত ফিরে পেলো, ‘যাবেন না?’
‘হুম, চলুন।’
রাস্তার পাশে হাঁটতে শুরু করল তারা। একটা রাইড পেয়ে গেছে। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে করতে সারল্য একজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে নিলো, ‘আমি বলছিলাম ক্লারাকে আজ নিয়ে যাই? কালকে সকালেই নিয়ে আসবো নাহয়?’
ওপাশ থেকে কী উত্তর এলো বোঝা গেল না। তবে নিশ্চয়ই ‘না বোধক’ কিছু। সারল্য একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে জাহ্নবীকে বলল, ‘আসুন, গাড়ি এসে গেছে।’
গাড়িতে উঠে বসলো দুজনে। জাহ্নবী জিজ্ঞেস করল, ‘ক্লারাকে অনেক মিস করেন তাইনা?’
‘হুম, তা তো করবোই। আমার মেয়ে তো।’
সারল্য’র কণ্ঠে স্পষ্ট বিষাদ অনুভব করল জাহ্নবী। সে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করতে চাইল না। কেবল বলল, ‘কষ্ট পাবেন না। কঠিনকে মেনে নিন সহজে।’
‘হুম, মেনেই তো নিয়েছি।’
‘আন্টি কিছু মনে করবেন না তো আমাকে দেখে?’
‘কী মনে করবে?’
‘এত রাতে অপরিচিত একজন মেয়ে আমি, আমার লজ্জা লাগছে।’
‘ধুর, আপনি তো আমার বন্ধু। সবচেয়ে বড় কথা, আজকে এত বড় একটা উপকার করলেন।’
জাহ্নবী চুপ করে রইল। দ্রুত পৌঁছে গেল তারা। সারল্য’র বাড়িতে এই প্রথম এসেছে সে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কলিংবেল চাপল সারল্য। মিনিট দুয়েক লাগল দরজা খুলতে। একজন মেয়ে দরজা খুলে জাহ্নবীকে দেখে ভড়কে গেলেন। সারল্য বলল, ‘ও আমার বোন শার্লিন। শার্লি, ও জাহ্নবী, আমার বন্ধু। মা ঘুমিয়েছে রে?’
‘হ্যাঁ, মাত্র ঘুমালো।’
শার্লিন জাহ্নবীকে ভেতরে আসার আমন্ত্রণ জানায়। স্মিত হেসে জাহ্নবী বলল, ‘এত রাতে আপনাদের বিব্রত করলাম। সরি আপু।’
‘ইটস ওকে। আসুন।’
ওদেরকে লিভিংরুমে রেখে শার্লিন ঘরের ভেতরে চলে গেল। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো জাহ্নবী। মৃদু হলুদ আলোয় ঘরটাকে স্বর্গীয় লাগছে। সারল্য বলল, ‘আপু আপনাকে রুমে নিয়ে যাবে। ফ্রেশ হয়ে নিন। খিদেও পেয়েছে বোধহয়। আমি খাবার গরম করে দিতে বলি।’
‘এত ব্যস্ত হবেন না প্লিজ।’
শার্লিন ফিরে এসে বলল, ‘আপু, আপনি ফ্রেশ হবেন, আসুন।’
ঘুম ঘুম চোখে একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন। দেখে বোঝাই যাচ্ছে তিনি সারল্য’র মা। বয়সের ভাড়ে নুয়ে পড়া চেহারাটাতেও কী ভীষণ মায়া!
জাহ্নবী উঠে গিয়ে ওনাকে সালাম করলো। চোখ টেনে ভ্রু ওপরে তুলে জাহ্নবীকে দেখলেন তিনি।
সারল্য বলল, ‘আম্মু, উনি জাহ্নবী। উনিই জারার মাকে ব্লাড দিলেন। হসপিটাল থেকে আসলাম।’
‘খুব ভালো কাজ করেছো তুমি মা।’
মহিলা জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরলেন। মায়ের শরীরের পরম সুঘ্রাণ পেলো জাহ্নবী। সে বলল, ‘অনেক রাতে কষ্ট দিলাম খালা আপনাকে।’
‘না গো, কীসের কষ্ট। তুমি হাত মুখ ধুয়ে আসো। আমি খাবারটা গরম করে দেই। তুমি নাহয় গোসলই করে ফেলো, খুব ভালো লাগবে। বাথরুমে গরম পানি আছে।’
জাহ্নবী ভদ্রতাসূচক হাসলো। মহিলা শার্লিনকে বললেন, ‘তোর ঢিলেঢালা একটা ড্রেস থাকলে দে না ওনাকে। কিছু মনে করোনা মা, শার্লিন অনেক শুকনা তো।’
শার্লিন বলল, ‘আমি দেখছি আপু। আমার অনেক টপস আছে, শার্ট আছে, ওগুলো আপনার হবে। কিন্তু প্যান্ট তো হবে না।’
শার্লিনের মা বললেন, ‘স্কার্ট আছে না তোর?’
জাহ্নবী বলল, ‘খালা, আপনি আমাকে আপনার একটা শাড়ি দিন, আমি শাড়ি পরবো।’
‘শাড়ি পরবে!’ বিস্মিত হলেন মহিলা।
‘অসুবিধা নেই, আমি শাড়িতেই কমফোর্ট ফিল করি।’
মহিলা স্মিত হাসলেন। জাহ্নবী কথাটা বলে চুপ করে রইল। তার শাড়ি পরার অভ্যাস নেই। কখনো শাড়ি পরেও না সে। আজ কেন যেন মন থেকে শাড়ি পরার সাধ জাগছে। পান্নাবাহারের মায়ের ব্যবহার করা শাড়ি পরলে তার শান্তি শান্তি লাগবে। সেই অনুভূতিটা পেতে চায় সে।
মহিলা জাহ্নবীকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। আলমারি থেকে একটা সুন্দর শাড়ি বের করে দিলেন তিনি। সঙ্গে একটা ব্লাউজও দিলেন। জাহ্নবী শাড়ি ও তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। শাড়িতে হাত বুলিয়ে ঘ্রাণ নেয় সে। মা মা একটা ব্যাপার আছে এই শাড়িতে। সঙ্গে মিশে আছে ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ। ওর হৃদয়টা ভরে গেল প্রশান্তিতে। এই সুখটুকু তার জীবনে বড্ড প্রয়োজন ছিল।
গোসল সেরে বেরিয়ে জাহ্নবী চুল মুছে নেয়। একা একা শাড়ি পরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় সে। সারল্য’র মা ঘুম জড়ানো চোখ নিয়েই তাকে শাড়ি পরিয়ে দেয়। জাহ্নবীর ভীষণ আপন আপন লাগে ওনাকে। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। মায়েরা মেয়েদেরকে শাড়ি পরিয়ে দেয়। কিন্তু পারভীন কখনো তার কাছে আসেনা, তাকে শাড়ি পরিয়ে দেয়া তো অলীক স্বপ্ন!
শাড়ি পরে খাবার টেবিলে চলে আসে জাহ্নবী। ওর প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে মহিলা ছেলেকে ডাক দিলেন, ‘পিকলু, খেতে আয়।’
জাহ্নবী মনেমনে হাসল, ‘সারল্য’র ডাক নাম তাহলে পিকলু!’
সে অপেক্ষা করে পান্নাবাহারের জন্য। গোসলের পর ভীষণ সতেজ লাগছে তার। শাড়ি পরে খুব লজ্জা লজ্জা লাগছে। লজ্জাটাকে আড়াল করে সহজ হওয়ার চেষ্টা করলো সে। আগেই বলেছে শাড়িতে সে আরামবোধ করে। এখন মোটেও অস্বস্তিতে পড়া যাবে না।
চলবে..