মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৪৭
লেখনীতে: মিশু মনি
পারভীনের করুণ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে অর্ণবের মনে মায়া হলো। তিনি সন্তানের মতো স্নেহের ডোরে বেঁধেছেন অর্ণবকে। পরম মমতায় তাকে আপন করে নিয়েছেন। আজকের পর থেকে হয়তো আর এই সম্পর্কটা থাকবে না। অর্ণব গুটিগুটি পায়ে ঘরে প্রবেশ করে পারভীনের পাশে বসল।
পারভীন মানুষের সঙ্গে মিশতে অভ্যস্ত নন। তবুও অর্ণব পাশে বসামাত্র ওনার হৃদয়ে মায়ার উদ্রেক হলো। এই ছেলেটাকে সবসময়ের জন্য নিজের ছেলে বানিয়ে ফেলার সাধটাকে বুঝি তার মেয়েটা পূরণ হতেই দেবে না। তিনি একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে অর্ণবের দিকে তাকালেন।
অর্ণব মাথা নিচু করে মৃদু স্বরে বলল, ‘আন্টি আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনি হয়তো এতক্ষণে সবকিছু শুনেছেন। আসলে সব দোষ আমার। আমি একটা বোকা ছেলে। আপনার মেয়ের কথা বুঝতে পারিনি আমি। সবকিছু গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছি। কিন্তু এটা আমাকেই সমাধান করতে হবে। জীবনটা তো আর নাটকের মতো না। আমরা দুজন দুজনকে চাইনা, কেউ কাউকে পছন্দ করিনা, মিছেমিছি আমাদের বিয়ে দিয়ে দুজনের জীবনটা নষ্ট করে দিবেন না আন্টি।’
অর্ণব কথাটা বলতে গিয়ে বুঝতে পারল তার গলা কাঁপছে। কারণ শেষ বাক্যটা মিথ্যে ছিল। সামার তাকে পছন্দ করেনা সত্যি, তবে সে হৃদয়ের গহীন অরণ্যে ছোট্ট কুঁড়েঘর বানিয়েছে সামারের জন্য। গত কয়েকদিনে কাছ থেকে দেখার পর সামারের প্রতি তীব্র প্রেমের বাসনা জেগে উঠেছে তার। সে সামারকে চায়, এমনকি এখনও মনেমনে সে চাইছে, দূর্ঘটনার মতো তাদের বিয়েটা হুট করে হয়ে যেত যদি!
সামারের চোখে নায়ক সাজার জন্য পারভীনের কাছে এসে কথাগুলো স্বীকার করে নিলো অর্ণব। এতে হয়ত তাদের বিয়েটা হবেনা, তবে সামারের মনে নিশ্চয়ই তার জন্য একটা সহানুভূতির জায়গা তৈরি হবে। ভালবাসার তৃষ্ণা মানুষকে বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। অর্ণবের মাঝেও ভর করেছে সেই তৃষ্ণা। সামারকে পাওয়ার আশা সে ছাড়বে না।
বিনয়ের সুরে অর্ণব বলল, ‘আপনি আমাকে ছেলের মতো আপন করে নিয়েছেন আন্টি। আমি আপনার ছেলে হয়ে থাকবো। আমাদের সম্পর্কটা হাজার বছর স্থায়ী হোক সেই দোয়া করি। কিন্তু সামারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আপনি প্লিজ ওর ওপর কিছু চাপিয়ে দেবেন না।’
পারভীন স্থির চোখে অর্ণবকে দেখছেন। এই বিনয় মুগ্ধ করছে তাকে। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘এতদিন কথাগুলো আমাকে বলো নাই কেন তোমরা? আমাদেরকে সহজ সরল পেয়ে এভাবে মিথ্যাচার করে গেছো।’
‘ভুল বুঝবেন না আন্টি। আসলে আমি বিষয়টাকে গোলমেলে পাকিয়ে ফেলেছি। আব্বা আম্মাকে কষ্ট দিতে চাচ্ছিলাম না। পরে কিছু একটা বলে ওনাদেরকে ম্যানেজ করা যাবে সেই আশায়..’
অর্ণব আর কিছু বললো না। সামার এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। তার উপস্থিতি বুঝতে পেরে মাথাটা আরও নিচু করে ফেললো অর্ণব। ভদ্রতার সঙ্গে বলল, ‘আন্টি আমি সবাইকে ম্যানেজ করবো। আপনারা সামারকে কিছু বলবেন না। ওকে ওর পছন্দের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিবেন। তাতে ও সুখী হবে। মেয়ে সুখী হোক সেটা তো সব বাবা মায়েরাই চান।’
সামার ভেতরে ঢুকে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পারভীনের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মাকে দেখে এখন অসুস্থতায় শয্যাশায়ী মানুষের মতো মনে হচ্ছে। কী অসহায় দেখাচ্ছে ওনাকে! সামার জানেনা এরপর ওনার শারীরিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে। অনাকাঙ্ক্ষিত এই পরিস্থিতি যেন খুব দ্রুত সমাধান হয়ে যায়।
অর্ণব বলল, ‘আন্টি, প্লিজ কষ্ট পাবেন না। আমাকে মাফ করে দিন।’
অর্ণব উঠে দাঁড়াল। এরপর পারভীন কী বলবেন তা জানেনা সে। কিছু বললেও সেটাকে সামলে নেয়ার মতো শক্তি তার নেই। তাই যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে সরে যেতে চায় সে। সবকিছু সময়ের ওপর ছেড়ে দেয়াই এখন সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত।
অর্ণব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে সামার ভায়োলেটকে বলল, ‘আমার সঙ্গেই সবসময় কেন এমন হয় বলতো?’
সামারের হাত ধরল ভায়োলেট। মৃদু স্বরে বলল, ‘সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে আপু।’
পারভীনের দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে। তিনি ভাবছেন কীভাবে আত্মীয় স্বজনদের মুখ দেখাবেন। সবার কাছে তাকে কথা শুনতে হয়। কোনো অনুষ্ঠানে যেতে পারেননা এসবের ভয়ে। মেয়েদের বিয়ে না দিয়ে তিনি যেন জীবনের সবচেয়ে বড় অন্যায়টা করেছেন। কিন্তু তিনি কীইবা করতে পারেন। যার জীবন, সিদ্ধান্তটা তো তারই নেয়া উচিৎ।
সামার বলল, ‘আম্মু, আমাকে দোষারোপ করতে পারবা না। আমি বিয়ে করতে রাজি হইছি। অর্ণবকে বলছি বিয়ের আয়োজন করতে। এখন সেই বিয়ে করতে চাচ্ছে না। এটা কিন্তু আমার দোষ না।’
পারভীন চুপ করে রইলেন। সামার চুপ থাকতে পারল না। সে আবারও বলল, ‘আমি চাইনা আমার জন্য কেউ মরুক। আমাকে নিয়ে কারও না ভাবলেও চলবে।’
ভায়োলেট সামারের হাত চেপে ধরে বলল, ‘চুপ কর আপু।’
সামার মুখে কাঠিন্য এনে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বাড়িতে মেহমান গিজগিজ করছে। কারও সাথে দেখা হলেও বিরক্ত লাগছে তার। সিঁড়ি বেয়ে সোজা ছাদে চলে গেল সে। মেজাজটা অন্তত ক্ষিপ্ত।
ভায়োলেট অর্ণবের কাছে এসে বলল, ‘আমার আপু একটু অবুঝ। ও হয়তো আপনাকে উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলবে। হয়তো এতক্ষণে বলেও ফেলেছে। আপনি কিছু মনে করবেন না। তবে আমি বলবো, বিয়েটা আটকান। আপনার বাসায় কিছু জানানোর দরকার নেই। আমার মা বাবা সত্যিটা জেনে গেছেন। আমি ওনাদের চিনি। একটু পরেই সব শান্ত হয়ে যাবে। মা অভিমানী মানুষ, আপুও অভিমানী মেয়ে। তারা একে অপরের সঙ্গে রেগে থাকবে, এতটুকুই। এর বেশী কিচ্ছু হবে না। আপনি যেভাবে প্লান করে আপনার পরিবারকে সামলাচ্ছিলেন, সেভাবেই আগান। অসুবিধা হবেনা। ধীরেসুস্থে ওনাদেরকে ম্যানেজ করে নিলেই হবে।’
শান্ত গলায় এত সুন্দর করে ভায়োলেট কথাগুলো বলে গেল যে, কঠিন হলেও অর্ণবের ভালো লাগল শুনতে। সে ম্লান হেসে বলল, ‘থ্যাংক ইউ ভায়োলেট। আপনি সবকিছু খুব ভালো বোঝেন। আপনার বোনটা যদি বুঝতো!’
ভায়োলেট শুষ্ক হাসি টেনে বলল, ‘আপুর একটু মাথা গরম।’
‘শুধু মাথা না, ওর সবটাই গরম। এত রাগী, বদমেজাজি মেয়ে আমি আর একটাও দেখিনি।’
‘তাও তো আপনি ওকে ভালবাসেন।’
অর্ণব চমকে উঠলো। ভায়োলেটের চোখের দিকে তাকিয়ে এই সত্যটা স্বীকার করতে পারছিল না সে। তাই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখল। কীভাবে বুঝল এই মেয়েটা!
ভায়োলেট বলল, ‘আপনাকে একটা কথা বলবো অর্ণব ভাইয়া। পরিস্থিতি শান্ত হোক। সবকিছু স্বাভাবিক হোক। তারপর বলবো।’
ভায়োলেট চলে গেল সেখান থেকে। অর্ণব একটা নিশ্বাস ফেললো। সে সামারকে ভালোবাসে, এটা ভায়োলেটের মুখে শোনার পর কেমন যেন টনটন করছে বুকের ভেতর। সত্যিই সে ভালবাসে সামারকে। শেষ পর্যন্ত সে সামারকে প্রাপ্তির চেষ্টা অবশ্যই করবে।
অর্ণব রান্নাঘরে ঢুকে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আম্মা, শুনলাম আজ নাকি আমার বিয়ে দিতে চাও?’
‘সবাই বলছিল। আমরা সামারের মাকে জানিয়েছি। দেখি ওনারা কী বলেন।’
‘আম্মা, আমি আপনার একমাত্র ছেলে। ভালো চাকরি পাইছি। এইভাবে আমি বিয়ে করতে চাই না। আগে আমাকে একটু গোছাইতে দাও। দেখবা আমার আম্মাকে আমি রানীর মতো রাখবো। খুব ধুমধাম করে সবাইকে জানিয়ে বিয়ে করবো।’
‘এখন কাবিন করে রাখ। অসুবিধা কী? পরে সময়মত বিয়ে উঠাইয়া নিবো।’
‘না গো আম্মা। কাবিন করলে আমার ওপর প্রেশার আসবে। বিয়ের পর আগের মতো কিছুই হয় না। আমি টাকা পয়সা, চাকরি কিছুই গোছাইতে পারবো না। আগে একটু গোছাইতে দাও আমাকে।’
‘আচ্ছা বাবা, তুই যা ভালো মনে করিস।’
অর্ণব মায়ের মুখখানা ধরে তার মাথায় একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘খিদা লাগছে। কিছু খাইতে দাও। আর ওদেরকে একটু নাস্তা দাও। অনেক্ষণ সবাই না খেয়ে আছে।’
‘আচ্ছা দিচ্ছি। তুই বস।’
অর্ণব স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। সামার তাকে ভরসা করেছিল। শেষ পর্যন্ত এই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পেরেছে সে। আগামীকাল এখান থেকে সসম্মানে চলে গেলেই আর ঝামেলা নেই। বাকিটা নাহয় সময়ই বুঝে নেবে। তার হঠাৎ মনে পড়ল সামারের কথা। রাগে আগুন হয়ে কোথায় গেল মেয়েটা!
নাস্তার টেবিলে বসে জাহ্নবী সারল্যকে বলল, ‘আমাকে এক্ষুনি বের হতে হবে। অফিসে দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
‘দেরী হতে দিচ্ছে কে? আপনাকে অফিসে পৌঁছে দেয়ার জন্যই তো এত সকাল সকাল উঠলাম।’
মুচকি হাসলো জাহ্নবী। গত রাতে সারল্য’র বারান্দায় দাঁড়িয়ে কত গল্প করেছে ওরা! জীবনের গল্প, অতীতের গল্প, কত সুখ, ব্যথার গল্প। একটি রাতই দুজনকে এনে দিয়েছে আরও অনেক অনেক কাছে। মনের এত কাছাকাছি থাকা মানুষটাকে বাস্তবতায় কাছাকাছি পেয়ে জাহ্নবীর স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে সবকিছু।
সারল্য বলল, ‘আপনি শাড়িটা চেঞ্জ করলেন কেন? ওটা পরেই অফিসে চলে যেতেন।’
‘মাথা খারাপ? আমি শাড়ি পরে অফিসে যাবো?’
‘হ্যাঁ। এখন তো মেয়েরা শাড়ি পরে ইউনিভার্সিটিতে যায়, অফিসে যায়। আমার মায়ের শাড়িটা আপনাকে ভালো মানিয়েছিল। সত্যি বলতে এর আগে মা ছাড়া কাউকে কখনো মায়ের শাড়িতে দেখিনি।’
লাজুক ভঙ্গীতে হাসলো জাহ্নবী। কথাটা শুনতে বড্ড ভালো লেগেছে তার। মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল মুহুর্তেই।
সারল্য তার মাকে ডেকে বলল, ‘আম্মু তোমার শাড়িটায় জাহ্নবীকে ভালো মানিয়েছে। ওটা ওকে দিয়ে দাও।’
জাহ্নবী তৎক্ষনাৎ বলে উঠল, ‘আরে না না। আমি খুব কম শাড়ি পরি। আমার লাগবে না খালা।’
সারল্য বলল, ‘না আম্মু, তুমি ওকে দিয়ে দাও। তোমার তো অনেক শাড়ি।’
সারল্য’র মা মুচকি হেসে জাহ্নবীর পাশে এসে দাঁড়ালেন, ‘নিয়ে যাও মা। সারল্য এত করে বলছে যখন।’
‘খালা, লাগবে না।’
‘আমি দিচ্ছি তুমি নাও। তুমি আমাকে খালা বলে ডাকছো না? খালার তরফ থেকে উপহার মনে করে নাও।’
জাহ্নবী এবার আর না করতে পারলো না। সারল্য’র মা ঘরে গিয়ে একটা কাগজের ব্যাগে শাড়িটা তুলে দিলেন জাহ্নবী’র হাতে। কৃতজ্ঞতায় ওনাকে জড়িয়ে ধরে জাহ্নবী বলল, ‘আমাকে মায়ায় জড়িয়ে ফেললেন খালা।’
‘মাঝেমাঝে আইসো বাসায়। খালাকে দেখতে, কেমন?’
জাহ্নবী লাজুক হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘আসবো খালা।’
আরও একবার মহিলাকে আলিঙ্গন করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল জাহ্নবী। এখন তাকে বের হতে হবে। সারল্য চা শেষ করে অপেক্ষা করছে তার জন্য।
চলবে..
মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৪৮
লেখনীতে: মিশু মনি
দমকা হাওয়া বইছে। উড়ছে ধূলো। জাহ্নবী সবেমাত্র অফিস থেকে বেরিয়েছে। রিকশায় উঠতে না উঠতেই এমন ঝড়ো হাওয়া শুরু হল যে বসে থাকা মুশকিল। রিকশার হুড উড়িয়ে নিয়ে যায় যায় অবস্থা। রিকশাওয়ালা বললো, আপামনি একদিকে সাইড করি। আপনে নাইমা যান।
বিব্রতবোধ করলেও জাহ্নবীর ‘না’ বলার সুযোগ ছিল না। রিকশাওয়ালা তাকে একটা ফার্মেসীর সামনে নামিয়ে দিয়ে সরে পড়লো। ফার্মেসীর বারান্দায় আরও জন চারেক লোক দাঁড়িয়ে। হঠাৎ আসা দমকা হাওয়ায় শহরের সবকিছুই যেন এলোমেলো হওয়ার বাহানা খুঁজছে। একটা পলিথিন ফতফত করে উড়ছে ছেড়ে দেয়া বেলুনের মতো। চোখ খোলা রাখা যাচ্ছে না। কখন যেন ধুলাবালি নিজের গন্তব্য ভেবে ঠুস করে চোখের ভেতর উড়ে এসে জুড়ে বসবে।
জাহ্নবী অপেক্ষা করতে লাগল। বাতাসের তীব্রতা কমলে শুরু হল বৃষ্টি। বাতাসের তোড়ে বৃষ্টিকে ঠেলে একদিকে নিয়ে যায়। রাস্তায় রিকশা নেই, খানিক পরপর দু একটা গাড়ি টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শা করে চলে যাচ্ছে। জাহ্নবী বেশ কয়েকটা রাইড এপসে ঢুকে গাড়ি খুঁজল, পাচ্ছে না। ঝড়ের কারণে যেন এই ভর সন্ধ্যাতেই রাত নেমে এসেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটা সময় সারল্য’র কথা মনে হলো। কী এক স্পষ্ট নির্ভরতা জেগে উঠল মনে। জাহ্নবী আগামাথা কিছু না ভেবেই কল দিয়ে বসলো তাকে।
মিনিট দশেকের মধ্যেই সারল্য’র গাড়ি এসে দাঁড়াল রাস্তার পাশে। জানালার কাঁচ নামিয়ে সে জাহ্নবীকে ইশারায় ডাকলো। নির্ভরতার নিজস্ব একটা আনন্দ আছে। সেই আনন্দ খেলা করছে জাহ্নবী’র চোখেমুখে।
সে গাড়িতে উঠে বসতে বসতে বলল, ‘এই অসময়ে আপনাকে ডেকে পাঠালাম বলে বিরক্ত হোননি?’
‘না তো। আপনি কখন ডাকলেন, আমি নিজেই তো বললাম আসছি।’
‘সেই একই হলো। আমি ফোন করে এখানে বৃষ্টিতে আটকে আছি বলা মানেই আপনাকে আসার আহবান করা।’
‘আমি বিরক্ত হলে না এলেই পারতাম। এলাম কেন?’
‘তাই তো। এলেন কেন?’
সারল্য উত্তর না দিয়ে ম্লান হাসলো। গাড়ির কাঁচের ওপর ছিপছিপ করে বৃষ্টির জল পড়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। রাতের বৃষ্টিভেজা শহরে মোহময় ভালোলাগা এসে ভর করলো। জাহ্নবী বলল, ‘এত বিরক্ত লাগছিল দাঁড়িয়ে থাকতে! কখন গাড়ি পাবো তাও বুঝতে পারছিলাম না।’
‘ফোন করে ভালোই করেছেন। যদি কখনো শুনতে পেতাম এমন ঝড়ের কবলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধূলা খেয়েছেন, আমি কিন্তু খুব রাগারাগি করতাম।’
‘রাগারাগি? আপনি অন্য মানুষের সঙ্গে রাগ করতে পারেন?’
‘হ্যাঁ পারি। আপনি পারেন না?’
‘না। আমি কারও সঙ্গে রাগ করতে পারিনা। আমার সব রাগ শুধু নিজের সঙ্গে।’
কথাটা বলে জাহ্নবী জানালার বাইরে তাকায়। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা বলেই গাড়ি দ্রুত ছুটছে। রাস্তার পাশে কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ আর পলিথিনে মোড়ানো দোকানপাট গুলো দেখতে ভালো লাগছে তার। মনে হচ্ছে মেলা চলছিল, হুট করে ঝড় এসে সব তছনছ করে দিয়ে গেছে। তবে ঘঘন্টাখানেক পরেই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
সারল্য বলল, ‘বাসায় যাবেন এখন?’
‘এই সময়ে বাসা ছাড়া আর কই যাবো?’
‘রাস্তায়, রেস্তোরাঁয়, যেখানে খুশি সেখানে।’
কোনো অজানা কারণে আজ সারল্য’র মনটা ফুরফুরে। তার চমকপ্রদ বাচনভঙ্গিই স্পষ্ট বলে দিচ্ছিল তা। ঝড়ের কারণে জাহ্নবী’র মনে যে বিরক্তির উদ্রেগ হয়েছিল, তা নিমেষেই বিলীন হয়ে গেলো।
সে জানতে চাইলো, ‘যেখানে খুশি সেখানে চাইলেই যাওয়া যায়?’
‘হ্যাঁ, যাবে না কেন? এখন তাই বলে আবার স্বর্গে যেতে চাইবেন না।’
‘স্বর্গ বাদ দিয়ে যেখানে ইচ্ছে যেতে চাইলে যাওয়া যাবে? আপনার গাড়ি আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারবে?’
‘চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। গাড়িটা যদি আলাদীনের চেরাগ হয়ে থাকে আরকি।’
সারল্য মুচকি হাসলো। জাহ্নবী নিজেও হেসে ফেলল ফিক করে। রাস্তার দুপাশে ঘোলা পানির ঢল নেমেছে। ভেজা রাস্তায় পড়ে আছে ঝরাপাতা। এই শহরেও তবে গাছ আছে! ভাবে জাহ্নবী।
সারল্য জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় যাবেন বললেন না তো?’
‘বাসায়।’
‘এই যে বললেন যেখানে খুশি যাবেন।’
‘সেটা তো আপনি বলেছেন। আমার অতশত জায়গায় যাওয়ার খুশি জাগে না। ঘুরেফিরে বাসা আর অফিসেই যাওয়ার আছে। আর একটা জায়গা আছে, আমার বাড়ি।’
‘বাড়িতে যাওয়া হয়না?’
‘প্রায়ই যাই। বাবা মা, বোনরা আছে। আমার বোনরা আবার আমার মতো নয়। ওদের যাওয়ার অনেক জায়গা। কত জায়গায় ঘুরতে যায়, কত কাজ থাকে ওদের!’
বিস্ময়ের সুরে কথাটা বলে গেল জাহ্নবী। সারল্য এক পলক তার দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। জাহ্নবী জানালার কাঁচ খানিকটা নামিয়ে দিয়ে বৃষ্টির শীতল হাওয়াকে আহবান জানায়। মন ভরে যায় মিহি বাতাসে।
সারল্য বলল, ‘আপনার কখনো কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না?’
‘আগে করতো। দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে। এখন আর করে না।’
‘এখন করেনা কেন?’
‘কী জানি! হয়তো সুখে আছি তাই।’
জাহ্নবীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে সারল্য। জাহ্নবী সুখে আছে, এটা বিশ্বাস করতেই হবে তাকে। নয়তো কেউ জানালায় হাত রেখে অন্য খেয়ালে বৃষ্টি দেখতে দেখতে প্রফুল্ল হয় না। সুখী মানুষ গুলো দেখলেই চেনা যায়। ওদের চোখমুখ কানায় কানায় পূর্ণ থাকে সুখ দিয়ে। জাহ্নবী সেই অর্থে খুব সুখী!
সারল্য বলল, ‘আমায় সুখী হওয়া শেখাবেন? আপনার মতো?’
‘আমি? নিজেই বা অত সুখী হলাম কবে? সবেমাত্র শিখছি।’
‘বেশ তো। আমিও আপনার সঙ্গে সঙ্গে শিখব।’
জাহ্নবী মুচকি হেসে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা তাহলে একসঙ্গে সুখী হই। আমার বাড়ির সামনে যে চায়ের দোকানটা আছে, ওখানে গিয়ে দু কাপ চা খাই চলুন।’
‘অবশেষে এটাই আপনার যেখানে খুশি সেখানে যাওয়ার গন্তব্য ঠিক হলো?’
‘না। আমার যেখানে যেতে ইচ্ছে করছে সেখানে আজকে যাবো না। যাওয়া উচিৎও হবে না।’
‘কোথায় সেটা?’
‘আপনার বাড়ির খোলা বারান্দাটা।’
সারল্য চমকে ওঠে। তার হাল আমলের নোনা ধরা বারান্দাতেও কারও যেতে ইচ্ছে করে বুঝি? ওই বারান্দাটা শুধু তার একার জোরেই টিকে আছে। নয়তো কবেই ওটা ভেঙে গুড়িয়ে নতুন ডিজাইনে রূপ দেয়া তো। আগে ওখানে প্রায়ই বসতো সারল্য। বিয়ের পর আর খুব একটা বসা হয়নি। অনেক বছর তো বন্ধই ছিল বারান্দার দরজা’টা। জাহ্নবী একরাতে ক্ষণিকেই কি এমন খুঁজে পেলো সেখানে? সারল্য উৎসুক চোখে দু একবার জাহ্নবী’র দিকে তাকায়। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে না।
জাহ্নবী চুপচাপ। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। রাস্তা প্রায় ফাঁকাই বলা চলে। পৌঁছে যেতে খুব একটা সময় লাগলো না। চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করাতেই জাহ্নবীর খেয়াল হল। এতক্ষণ সে ডুবে ছিল কল্পনায়। তার কল্পনার বারান্দায় আরাম কেদারা ভিজছে, ভিজছে সিগারেটের অ্যাস্ট্রে।
একটা টেবিলে মুখোমুখি বসলো ওরা। গরম গরম চায়ের সুঘ্রাণে মুখরিত হয়ে আছে চারপাশ। আজ খুব একটা লোকজন আসেনি। মোটে চারজন বসে গল্পগুজব করছে। থেকে থেকে বাতাসের দমকা হাওয়ার শব্দ কানে আসছিল।
সারল্য চা খাওয়ার এক ফাঁকে বলল, ‘একটা কথা বলবো জাহ্নবী? কিছু মনে করবেন না তো?’
‘না। কিছু মনে করবো না। বলুন না?’
‘আমি তো আপনার বন্ধু তাইনা?’
‘আমিও সেটাই মনে করি।’
‘দেখুন একজন ভালো বন্ধু কিন্তু একজন ভালো বন্ধুর ব্যাপারে অনেস্টলি সবকিছু খুলে বলে। এটাই একজন বন্ধুর বৈশিষ্ট্য।’
জাহ্নবী ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো, ‘বুঝলাম না আপনার কথা।’
সারল্য ইতস্তত করে বলল, ‘থাক বাদ দিন।’
‘বাদ দিতে পারবো না। আপনি বলুন।’
সারল্য ম্লান হেসে বলল, ‘মা’র শাড়িতে আপনাকে ভীষণ অন্যরকম লাগছিল। ট্রেডিশনাল।’
জাহ্নবী মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ফেলল। জীবনে এই প্রথম কেউ তাকে এভাবে প্রশংসাবাক্য শুনিয়েছে। মনটা খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠল তার।
সারল্য বলল, ‘আমি বোধহয় ঠিক গুছিয়ে বলতে পারলাম না। আপনাকে শাড়িতে সবচেয়ে সুন্দর দেখায়। এটাই বলতে চেয়েছি..’
জাহ্নবী মৃদু হেসে বলল, ‘ধন্যবাদ। আমি কী তাহলে এখন থেকে সবসময় শাড়ি পরবো?’
‘পরতেই পারেন। যদি আপনার আরাম হয়।’
‘আমার আরাম হবে না। অভ্যেস নেই।’
‘তাহলে পরার দরকার নেই।’
সারল্য অন্যদিকে ফিরে চায়ে চুমুক দিলো। জাহ্নবী’র ঠোঁটে লাজুক হাসি। তার একইসাথে লজ্জাও লাগছে আবার আনন্দও হচ্ছে। কেউ একজন তাকে সুন্দর বলেছে। এতদিন ধরে সে ভেবেছিল, সে কেবলই একটা রক্তমাংসের মানুষ। যার চেহারায় নেই কোনো লাবণ্য, কোনো সৌন্দর্য। বয়সের ছাপে নুইয়ে পড়া একটা বাঙালি মেয়ে। এটাকেও যে সুন্দরের ব্যাখ্যায় বিশেষায়িত করা যায়, সেটা ধারণাই ছিল না জাহ্নবী’র।
সে আচমকা জানতে চাইলো, ‘এই বয়সেও কেউ সুন্দর থাকে?’
‘প্রত্যেকটা বয়স তার নিজের মতো সুন্দর। বয়স কখনো সৌন্দর্য কমায় না, বাড়ায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জ্ঞান বাড়ে, অভিজ্ঞতা বাড়ে, জীবনবোধ বাড়ে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ তখন আরও সুন্দর। শুধু চামড়ায় ভাঁজ পড়লেই সৌন্দর্য হারিয়ে যায় সেটা কে বলেছে আপনাকে?’
জাহ্নবী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘এই সমাজ বলে। এত বয়সেও বিয়ে করিনি বলে সমাজ আমাকে যাচ্ছেতাই করে ফেলেছে। এজন্য বহুদিন হল কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান, আত্মীয়ের বাসা, কোথাও যাই না।’
সারল্য বলল, ‘আপনার সাহস আছে বলতে হবে। এদেশের কয়টা মেয়ের এমন সাহস হয় বিয়ে না করে কাটিয়ে দেবার?’
জাহ্নবী যেন হঠাৎ খানিকটা দমে গেল। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে উত্তর দিলো, ‘কাটিয়ে দিচ্ছি কই? আমারও তো ইচ্ছে হয় কারও সঙ্গে ঘর বাঁধতে।’
‘তাহলে বাঁধছেন না কেন?’
‘পাচ্ছি না যে। ওরকম একজন মানুষ।’
জাহ্নবী’র শীতল স্থির চোখেও কীসের যেন ছটফটানি অনুভব করে সারল্য। এ কি মনের মতো কাউকে পাবার জন্য আকুলতা? এত বছর পেরিয়েও জীবনে নিজের কাউকে না পাওয়ার হাহাকার? কে জানে, হবে হয়তো। সারল্য এসব নিয়ে ভাবতে চায় না। ভালবাসা নিয়ে ভাবলে তার রাগ হয়। কেন রাগ হয়, জানেনা সে।
এমন সময় জাহ্নবী’র ফোন বেজে ওঠে। ভায়োলেট ফোন করেছে। কথা শেষ করে জাহ্নবী বলল, ‘আমার ছোটবোন আসবে বাসায়।’
‘তাহলে এখন উঠি?’
‘ওর আসতে আরও সময় লাগবে।’
কথাটা বলার পরপরই কেমন লজ্জা লজ্জা লাগতে শুরু করল জাহ্নবী’র। সারল্যকে এখানে এভাবে ধরে রাখার মতো নির্লজ্জ কবে হল সে! লজ্জা কাটাতে আরও দুই কাপ চা দিতে বলে দেয় জাহ্নবী। চায়ের পর্ব শেষ হলে যথারীতি বিদায়ের পর্ব চলে আসে। সারল্যকে ধন্যবাদ জানিয়ে জাহ্নবী নিজের বাসায় পা বাড়ায়।
ভায়োলেট ভিজতে ভিজতে এসে হাজির। ভেজা কাপড়ের তোয়াক্কা না করে ঘরে ঢুকেই সে বলল, ‘প্লেট ধুয়ে আন, গরম গরম খিচুড়ি খাবো।’
জাহ্নবী তোয়ালে এনে ওর মাথায় রেখে বলল, ‘আগে জামা বদলে আয়। এই বৃষ্টি বাদলার দিনে তোকে কে আসতে বলেছে?’
‘বৃষ্টির দিনেই তো গল্প করে মজা আপু৷ ঢাকায় আসার পর থেকেই তোমার এখানে আসার জন্য মন উতলা হয়ে আছে।’
‘যান আগে চেঞ্জ করে আসুন।’
প্যাকেট থেকে খিচুড়ি প্লেটে ঢালতেই লোভনীয় ঘ্রাণে জিভে জল আসার উপক্রম। সঙ্গে দুই পিস লেবু আর গরুর মাংস ভুনা। জাহ্নবীর খুশি খুশি লাগছে৷ এমন দিনে এরকম মজার খিচুড়ি না হলে জমে না।
ভায়োলেট জামাকাপড় বদলে বিছানায় এসে বসলো। খিচুড়ি মুখে দিয়েই সুস্বাদু কামড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। জাহ্নবী বলল, ‘কোথা থেকে আনলি এই অমৃত?’
‘অনেকদূর থেকে। সাধে কি এত ভিজেছি?’
‘তুই পারিসও বাবা৷ চিটাগাং গিয়ে কী কী দেখলি?’
‘ড্রামা সিরিজ। শুনবে? আগে খাওয়া শেষ করি দাঁড়াও।’
দুই বোন আয়েশ করে খিচুড়ি খেয়ে হাত ধুয়ে এসে বসল গল্প করতে। ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল ওরা৷ বাইরে থেকে ঝুম বর্ষণের মৃদু শব্দ ভেসে আসছে৷ জাহ্নবী জানালার কাঁচটা হালকা ফাঁক করে দেয়। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ওরা গল্প করে।
চট্টগ্রামে অর্ণবদের বাসায় ঘটে যাওয়া বৃন্তান্ত সব বড় বোনকে শোনায় ভায়োলেট। বলতে বলতে কখনো হাসে, কখনোবা সামারের চিন্তায় ব্যকুল শোনায় তার গলা। সব শুনে জাহ্নবী একটা গম্ভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘ওকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয় রে। সামার এত ছটফটে, কখন কী করে বসে তার ঠিক নেই।’
‘চিন্তা আমারও হয়। কোনোকিছু না ভেবেই সিদ্ধান্ত নেয় মেজোপু। আর যা মুখে আসে তাই বলে ফেলে। ভাগ্যিস ওখানে শেষ পর্যন্ত মানসম্মান রক্ষা হয়েছে।’
খানিক্ষণ পর নেমে আসে নিরবতা। দুজনেই চুপ করে বৃষ্টির শব্দ শোনে। হঠাৎ ভায়োলেট জানতে চায়, ‘তুমি কেমন আছো আপু?’
জাহ্নবী আনন্দিত গলায় বলল, ‘জীবনের সবচেয়ে সেরা সময়টা পার করছি রে৷ মনে হচ্ছে এতদিন আমি ঘুমে ছিলাম। ঘুম ভেঙে সবেমাত্র দুনিয়াটাকে দেখছি৷ কিংবা বলতে পারিস বাঁচতে শিখছি।’
ভায়োলেট জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি তো এটাই চেয়েছি৷ আমার এত ভালো বোনটা ঘরের এক কোণে অন্ধকার জীবনযাপন না করে একটু বাঁচতে শিখুক।’
‘জানিস আমি এতদিন ভেবেছি মানুষ কেন বাঁচে? আর এখন মনেহয় নিজের জন্য বাঁচাটাই সবচেয়ে দরকার৷ কেন আমার ভালো থাকার জন্য জীবনে কাউকে লাগবেই? নিজের জন্য নিযে বাঁচতে শিখি নি কেন এতদিন?’
জাহ্নবীর এই জোড়ালো সুন্দর কথাগুলো শুনতে স্বপ্নের মতো লাগছিল ভায়োলেটের। সে অভিভূত হয়ে বলল, ‘তোমার জীবন ভাবনা একেবারেই পাল্টে গেছে আপু!’
জাহ্নবী বলল, ‘হ্যাঁ রে। জীবনকে এখন আমি অন্যভাবে ভাবতে শিখেছি। আস্তে আস্তে শিখছি কীভাবে নিজের জন্যই বাঁচা যায়। আমার জীবনে কেউ নেই, কিছু নেই, এসব ভেবে এখন আর নিজেকে বোকা বানাই না। আমার জীবনে অনেক কিছুই হতে পারে। আমি যদি নিজেকে ভালো রাখতে শিখি, তাহলেই আমি ভালো থাকবো।’
খানিক্ষন চুপ থেকে জাহ্নবী বলল, ‘আমার একজন বন্ধু হয়েছে।’
উৎফুল্ল হয়ে ভায়োলেট জানতে চাইল, ‘তাই নাকি!’
জাহ্নবী মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘খুব ভালো একজন বন্ধু। যার সঙ্গে মন খারাপ, মন ভালোর গল্পগুলো খুলে বলা যায়।’
‘বাহ! যাক তুমি অবশেষে একজন বন্ধু পেলে। আমি কি তোমার বন্ধু নই আপু?’
জাহ্নবী ভায়োলেটের গাল টেনে দিয়ে বলল, ‘তুইও আমার বন্ধু। তুই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ভায়োলেট। তোর মতো করে আমাকে আর কেউ বোঝেনা।’
‘তোমার ওই বন্ধুটাও না?’
‘ওর সঙ্গে নতুন বন্ধুত্ব হয়েছে। এখনই কী আর এত বোঝাবুঝি বোঝা যায়? তোর স্টার্টআপ নিয়ে কী ভাবলি বল তো?’
‘সেটা নিয়ে আলাপ করবো বলেই এসেছি। আজ রাতে ঘুম নেই, জরুরি মিটিং হবে। অনেক প্লান রেডি। এবার শুধু একটা একটা করে কাজ করা বাকি।’
জাহ্নবী মুগ্ধ হয়ে ভায়োলেটের কথা শোনে। অন্ধকারেও টের পায় তার চেহারার দৃঢ়তা। নতুন কিছু শুরু করতে পারার আনন্দে জাহ্নবী উত্তেজিত বোধ করে৷
চলবে..
মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৪৯
লেখনীতে: মিশু মনি
জাহ্নবী’র দিনগুলো মধুর ব্যস্ততায় কেটে যাচ্ছে। ভায়োলেটের ব্যবসার শুরুটা তার হাত ধরেই হলো। অন্যদিকে নাদিরের ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে ও তার উপস্থিতি না থাকলে চলে না। নিজের অফিস শেষ করে এই দুই কাজে সময় দেয়ার পর নিশ্বাসটুকুও ফেলার সময় হচ্ছিল না জাহ্নবী’র। এরই মাঝে একদিন সারল্য’র সঙ্গে দেখা হলে সে বলল, ‘নানুবাড়িতে যাবো। যাবেন?’
জাহ্নবী চমকে উঠলো তার কথায়, ‘নানুবাড়ি!’
‘হ্যাঁ। একদিন না বলছিলেন আপনার গ্রামে যেতে ইচ্ছে করে? গ্রাম দেখতে যাবো চলুন। নানু অনেকদিন ধরেই ডাকছে। ক’দিন ধরে আম্মুও বলছে এবার একবার নানুবাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে। অনেকদিন বাপের বাড়ি যাওয়া হয়না আম্মুর। তাই ভাবলাম আপনাকেও বলি। যাবেন?’
নিঃসন্দেহে চমৎকার দাওয়াত। কত বছর হল জাহ্নবী গ্রামে যায় না। শুধুই কি গ্রাম! তার মাথায় কোথাও বেড়াতে যাবার স্মৃতিই মনে পড়ে না। সারাক্ষণ বাড়ি, বাড়ি, বাড়ি আর৷ বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ঘরের দমবন্ধ পরিবেশ ছেড়ে নিজের মতো বাঁচতে একলা বাসায় ওঠা। এখন তো মনপ্রাণ খুলে বাঁচতে ইচ্ছে জাগবেই।
‘অফিসের এত কাজ রেখে কীভাবে যাবো?’ জানতে চাইলো জাহ্নবী।
সারল্য’র নিষ্পাপ উত্তর, ‘অফিসে দুদিনের ছুটি নিলে খুব একটা অসুবিধা হবেনা।’
‘নাদির স্যারকে কী বলবো?’
‘জাহ্নবী, আপনি হাসালেন আমায়। আপনার কি মনে হচ্ছে নাদিরের কাজ আপনার জন্য আটকে থাকবে? ও নিজেই ওর কাজের জন্য এনাফ। তাছাড়া টিমের বাকিরা তো আছেই। আপনাকে কেউ মাথার দিব্যি দিয়ে রাখেনি।’
জাহ্নবী খানিক্ষন চুপ করে রইল। তার খুব গ্রামে বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছে সত্যি কিন্তু নিজের স্টার্টআপের কথাটা সারল্যকে এখনো জানায়নি সে। ভায়োলেট তার ওপর পরম নির্ভরতায় ব্যবসার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। অফিসের ইন্টেরিয়র ডিজাইন চলছে। কাজ শেষ হলেই নিজের চাকরি ছেড়ে জাহ্নবীকে ওর অফিসে বসতে হবে। এ সময় সে কীভাবে গ্রামে বেড়াতে যাবে? এ তো অসম্ভব ব্যাপার।
জাহ্নবী ম্লান হেসে বলল, ‘আপনার নিমন্ত্রণ পেয়ে খুশি হয়েছি। কিন্তু বোধহয় যাওয়া হবে না।’
‘ভেবে দেখুন। আম্মুকে বলেছি ব্যাগ গুছিয়ে ফেলতে। দু একের মধ্যেই যাবো।’
‘যান, ঘুরে আসুন। ভালো লাগবে।’
সারল্য চোখ পাকিয়ে জাহ্নবী’র দিকে খানিক্ষন তাকিয়ে থাকতে থাকতে উত্তর দিলো, ‘আমি জানি ভালো লাগবে আপনার।’
দুই রুমের একটা ছোট্ট অফিস নিয়েছে ভায়োলেট। নিজের মনমতো সেটা সাজানোর প্রয়াস চলছে। দেয়ালে জায়গা করে নিয়েছে অভিজাত পেইন্টিং। দুই রুমের হলেও তার কাজের প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে এখানে। জাভেদ আলী ব্যাংক থেকে টাকা ট্রান্সফার করে দিয়েছেন ভায়োলেটের একাউন্টে। একান্তই নিজের মতো করে সে সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছে।
অফিসের কাঁচের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে জাহ্নবী আনমনে কী যেন ভাবছে। ভায়োলেট তার পাশে এসে দাঁড়াল। মৃদু গলায় বলল, ‘কী দেখছো আপু?’
জাহ্নবী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কিছু না।’
‘ভাবছো তোমার কাঁধে অনেক বড় একটা দায়িত্ব দিয়ে ফেললাম?’
‘এরকম একটা দায়িত্ব আমার খুব প্রয়োজন ছিল। নিজের মেধাকে কাজে লাগানোর কোনো সুযোগই তো পাচ্ছিলাম না।’
‘এত ভালো একটা চাকরি পেয়েছো নিজের যোগ্যতায়, তাও এই কথা?’
‘চাকরিতে তো অন্যের নির্দেশে কাজ করি ভায়োলেট। নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে কিছু একটা করার মতো কাজ দরকার ছিল। থ্যাংকস রে।’
‘আর থ্যাংকস বলো না আপু। একদিন তুমিই বিরক্ত হয়ে বলবে আমার কাঁধ থেকে দায়িত্বের বোঝা নামিয়ে দে।’
‘মাইর খাবি এবার।’
খানিক্ষন চুপ থেকে জাহ্নবী বলল, ‘অফিস রেডি হওয়ার আগে আমার কোনো কাজ আছে? মানে দুদিনের ছুটি পাওয়া যাবে?’
ভায়োলেট ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে ফেলল, ‘আমাকে বস ভেবো না। তুমিই এখানকার বস।’
‘সেজন্যই বলছি। বস’রা কখনো ছুটি পায় না। তাদেরকে কে ছুটি দেবে?’
‘এই কোম্পানিতে ওসব হবেনা বাবা। যখন মন চাইবে ছুটি নেবে। নিজের রিফ্রেশমেন্টের জন্য।’
জাহ্নবী ইতস্তত করতে করতে বলেই ফেলল, ‘ঢাকার বাইরে আমার একটা দাওয়াত আছে। তোকে এক বন্ধুর কথা বলেছিলাম না? ওর ফ্যামিলি যাচ্ছে। আমাকে যেতে বলেছে। কী করবো বুঝতে পারছি না।’
ভায়োলেট হেসে বলল, ‘অবশ্যই যাবে। এরপর তো কাজে মন দিতে হবে। অফিসের কাজ আমি গুছিয়ে নেবো। তোমার এখন কোনো চাপ নেই। নিশ্চিন্তে ঘুরে এসে সবকিছু বুঝিয়ে নিও। বুঝেছো?’
জাহ্নবী দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করল, ‘যাবো?’
‘যাও। মনটা ফ্রেশ হবে।’
ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা বোধ করল জাহ্নবী। সে বহু বছর পর শহরের বাইরে যাবে। এই দম বন্ধ করা শহর ছেড়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যাবে। ইশ, ভাবলেই মন ভালো হয়ে যায়।
শহরের বাতি জ্বেলে ল্যাম্পপোস্ট গুলো দাঁড়িয়ে আছে। জাহ্নবী ও ভায়োলেট একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কারও সঙ্গে কোনো কথা বলে না। দুজনের চোখে অপরিসীম স্বপ্ন এসে নাড়া দিয়ে যায়। রঙিন, লাল, নীল স্বপ্ন। স্বপ্ন ধরার জন্য ওরা ছুটতে রাজি। এখন ছুটতে হবে, বহুদূর!
সারল্য ও তার মা রওনা দিচ্ছে গ্রামের উদ্দেশ্যে। তাদের সঙ্গে যাচ্ছে জাহ্নবী। লাগেজ গুছিয়ে সে বাসার সামনে অপেক্ষা করছে। সারল্য’র গাড়ি এসে দাঁড়াল সামনে।
জাহ্নবী ওর মাকে সালাম জানিয়ে বলল, ‘কেমন আছেন খালা?’
‘ভালো আছি মা। আসো, উঠে পড়ো।’
মহিলার পাশের সিটেই বসলো জাহ্নবী। গন্তব্যস্থল তার অজানা। সারল্য’র সঙ্গে এরপর খুব একটা কথা না হওয়ায় সে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পায়নি ওর নানুবাড়িটা কোথায়? তবে উত্তেজনার অন্ত নেই তার। কোথায় যাচ্ছে সেটাও তার জন্য বিস্ময়কর হয়ে থাকুক।
গাড়ি চালাচ্ছে ড্রাইভার। তার পাশের সিটে বসেছে সারল্য। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। চোখে চশমা। জাহ্নবী চমকে উঠলো ওকে দেখে। যেন রূপকথার গল্প থেকে উঠে আসা বিশুদ্ধ মানব। সারল্য পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘সকালে নাস্তা করেছেন?’
জাহ্নবী ইতস্ততবোধ করছে। ঘুম থেকে উঠতে তার দেরি হয়ে গেছে। তাই সকালে নাস্তা বানানো হয়নি। সারা রাত উত্তেজনায় দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি। ভোরবেলা ঘুমিয়ে সকাল নয়টায় রেডি হওয়াটা মোটামুটি কঠিন। তার ওপর সকালের নাস্তা? বায়ৃ রোজ নাস্তা বানানোর অভ্যাস থাকলেও এটা আজকে মিস হয়েছে তার। জাহ্নবী’র মুখ দেখে সারল্য কী ভেবে নিলো কে জানে। মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে।
কিছুদূর এগোতেই গাড়িতে উঠে পড়ল সারল্য’র বোন শার্লিন ও তার মেয়ে। জাহ্নবীকে দেখে আন্তরিকভাবে হাসলো সে। এতক্ষণে জাহ্নবী’র বিব্রতভাব কাটলো। শার্লিন সঙ্গে থাকলে সারল্য’র নানুবাড়িতে বেড়াতে যেতে তার জড়তাবোধ থাকবে না। নয়তো লজ্জায় একদিকে কুঁকড়ে যাচ্ছিল সে।
শহর পেরোতেই একটা রেস্তোরাঁয় গাড়ি দাঁড় করাতে বলে দিলো সারল্য। বলল, ‘নাস্তাপানি খেয়ে নেই৷
শার্লিন মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘এখনই দাঁড়াতে হবে কেন? এখনো অনেকটা পথ বাকি।’
‘জাহ্নবী সকাল থেকে কিছু খায়নি।’
শার্লিন আর কোনো উত্তর দিলো না। বিব্রতবোধ করল জাহ্নবী। বলল, ‘আমি কিছু খাবো না।’
সারল্য জোরগলায় বলল, ‘আরে নামুন তো। মা তুমিও আসো।’
ভাগ্নীকে কোলে নিয়ে সারল্য রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করল। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল জাহ্নবী। শার্লিন ওর দিকে তাকিয়ে ভদ্রতাসূচক হেসে বলল, ‘আসুন আপু।’
নাস্তার আইটেম বলতে পরোটা, ডাল, সবজি ও ডিম ভাজি। যাত্রাপথের নাস্তা হিসেবে এই ঢের। সারল্য ওর ছোট্ট ভাগ্নীকে খাবার তুলে খাওয়াচ্ছে। জাহ্নবীর মন কেমন করে। সারল্য’র মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল। নিঃসন্দেহে সারল্য খুব ভালো একজন বাবা। কিন্তু বাবার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। মাঝেমাঝে ভাগ্য আমাদের সঙ্গে এমন করে কেন!
সিলেটের ছায়াঘেরা এক গ্রামে সারল্য’র নানুবাড়ি। চা বাগানের ভেতর দিয়ে পথ চলার সময় জাহ্নবী অবাক চোখে সবকিছু দেখছিল। এর আগে কখনো সে চা বাগান দেখেনি। চোখের পলকেই চা বাগান পেরিয়ে একটা অদ্ভুত সুন্দর বাড়ির সামনে এসে তাদের গাড়িটা দাঁড়াল। বেশ বড়সড় বাড়িটা। পুরনো বাড়ির কয়েকটা ঘর দক্ষিণদিকে। বাড়ির সামনের দিকে নতুন করে একটা বিল্ডিং বানানো হয়েছে, আধুনিক ডিজাইনে। পুরনো বাড়িটার দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে, লালচে রঙের ঘরের পেছনে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় গাছ। ভেতরের মানুষ গুলো অনেক আন্তরিকতার সাথে সবাইকে গ্রহণ করলো। জাহ্নবী একটা সোফায় জড়োসড়ো হয়ে বসেছে। অস্বস্তি হচ্ছে তার। বাড়িতে ঢুকেই ছোট ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেছে সারল্য। সে একা বসে আছে এক কোণে।
এমন সময় মধ্যবয়সী এক লোক এসে জাহ্নবীকে বলল, ‘এখানে একা বসে আছেন যে? বারান্দায় আসুন।’
জাহ্নবী ভ্রু কুঁচকে ফ্যালফ্যাল করে লোকটার দিকে তাকালো। তিনি হেসে বললেন, ‘আমি ইমতিয়াজ, শার্লিনের মামা। আপনি নিশ্চয়ই ওর বন্ধু?’
জাহ্নবী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, ‘আমি সারল্য’র বন্ধু।’ কিন্তু সেটা না বলে চুপ করে রইল সে।
ইমতিয়াজ মামা বললেন, ‘বারান্দায় সবাই আছে। আসুন।’
নতুন ভবনের ভেতর দরজা দিয়ে বের হতেই পুরনো ভবনের বারান্দায় এসে পড়ল ওরা। সিমেন্টের ঢালাই দেয়া কালো রঙের শীতল মেঝের বারান্দা। একদিকে পাতা রয়েছে চৌকি, লম্বা লম্বা কয়েকটা পুরনো আমলের কাঠের চেয়ার ও একটা বেঞ্চি। সবাই সেখানে বসে গল্পগুজব করছেন। দীর্ঘদিন পর বাবার বাড়িতে এসে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছেন সারল্য’র মা।
তিনি জাহ্নবীকে আদর করে কাছে ডেকে বললেন, ‘আয় মা, এদিকে আয়। এখানে এসে বোস।’
জাহ্নবী বিমোহিত হল। মহিলা পরম যত্নে তাকে ‘তুই’ সম্বোধন করছে। এ এক অনাবিল আনন্দ! সে খুশিমনে ওনার পাশে চৌকিতে গিয়ে বসলো। চৌকিতে বসে আছেন ওনার মা অর্থাৎ সারল্য’র নানী, নানীর জা, ও তাদের পুত্রবধূরা। তিনি সবার সঙ্গে জাহ্নবী’র পরিচয় করিয়ে দিলেন। মুগ্ধতার রেশ এতটাই আচ্ছন্ন করে রাখল যে, অনেক্ষণ শুধু অবাক চোখে জাহ্নবী সবাইকে দেখে গেল। মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছিল না তার।
এমন সময় সারল্য বাচ্চাকাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে হৈ হুল্লোড় করতে করতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
চলবে..