#কৃষ্ণচূড়ার_এক_সন্ধ্যা – [শেষাংশ]
লাবিবা ওয়াহিদ
———————–
–“পাপা, আসবো?”
নিজ রুমে বসে অফিসের কিছু ফাইল ঘাটছিলেন আরমান সাহেব। পরিচিত মেয়েলি কন্ঠস্বর শুনে থমকালেন৷ বোঝার চেষ্টা করলেন, আদৌ ঠিক শুনেছেন কি না!? ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বিষয়টি জানান দিতেই চট করে মাথা তুলে তাকালেন আরমান সাহেব। না, ভুল শুনেননি তিনি। সত্যিই রায়া দাঁড়িয়ে তার চৌকাঠে। ঢিপঢিপ শব্দ করে উঠলো আরমান সাহেবের হৃদয়। হাসার চেষ্টা চালিয়ে আরমান সাহেব শুধায়,
–“আসো, প্রিন্সেস। কতদিন আসো না তুমি পাপার রুমে!”
রায়া অধর জোড়া প্রসারিত করে রুমে প্রবেশ করলো। এক পা দু পা করে এগিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। আরমান সাহেব তার সকল ব্যস্ততা ফেলে সিঙ্গেল সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং মেয়ের পাশে এসে বসলেন। মেয়ের কাছে তার সমস্ত ব্যস্ততা ফিঁকে। কতদিন মেয়ের এমন স্বাভাবিক আচরণ অনুভব করেননি, কতদিন মেয়ের পাশে বসে গল্প করতে পারেননি। আরমান সাহেব পরম আদরে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। রায়া তার পাপার দিকে অনিমেষ তাকিয়ে বলে,
–“আমায় স্বাভাবিক দেখে খুশি হয়েছো পাপা?”
আরমান সাহেবের চোখের কোণ ভিঁজে ওঠে। কে বলেছে তিনি সুখ অনুভব করেন না, দুঃখ অনুভব করেন না? নিজের দাম্ভিকতা ধরে রাখেন বলে সে যান্ত্রিক মানুষ নয়। এই দাম্ভিকতা তার শক্তি। আরমান সাহেব উচ্ছাসের সাথে আওড়ায়,
–“খুব খুশি মামুণি। কতদিন পর আমার অপেক্ষার অবসান ঘটলো।”
–“শুনবে না? আমার সুস্থতার কারণ?”
–“শুনবো। তুই বল!”
আরমান সাহেবের চোখে-মুখে আনন্দের রেশ। তার ধারণা অনুযায়ী বর্তমানে যেই সাইকোলজিষ্ট রায়ার ট্রিটমেন্ট করেছে সে-ই কারণ। মনে মনে ভেবে নিলো রায়ার সাথে আড্ডা শেষ করেই বিশাল পেমেন্ট ওই সাইকোলজিষ্ট এর একাউন্টে পাঠাবে। রায়া মুচকি হেসে বললো,
–“আমার স্বাভাবিক হবার কারণ নিথি ভাবী। রায়িন ভাইয়ার বউ। তার সংস্পর্শে এসেই আমি আমার স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছি, নতুনভাবে বাঁচতে শিখেছি। তুমি জানো পাপা, আমার ভাবী চমৎকার মানুষ!”
আরমান সাহেব থমকালেন। বিষ্ময়ের সাথে তাকিয়ে রয় রায়ার পানে। রায়া পুণরায় বললো,
–“আমার ডিপ্রেশনে তোমরা আমাকে সেভাবে বুঝোনি, যেভাবে নিথি ভাবী আমায় বুঝেছে। তোমরা ভেবেছিলে কাড়ি কাড়ি ওষুধ আর সাইকোলজিষ্টেই আমার সুস্থতা, সঙ্গতে নয়। আমরা শহরের সৌখিন মানুষেরা বড্ড অবুঝ, জানো পাপা? আমরা টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে ছোট ছোট খুশী এবং সুখগুলো হারিয়ে ফেলি। অথচ এই ছোট সুখগুলোর মধ্যকার সুখটা বিশাল বড়ো, যা অন্তরকে বরফের ন্যায় ঠান্ডা করে। দখিনের হাওয়ার ন্যায় প্রশান্তি দেয়।”
অনিমেষ তাকিয়ে রয় আরমান সাহেব রায়ার পানে। রায়ার হাসি মুখটায় হঠাৎ বিষণ্ণতার ছায়া নামলো। রায়া মুখটা ঘুচে মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো,
–“নিথি ভাবীর প্রতি তোমার ব্যবহার আমি উপলব্ধি করি পাপা। কিন্তু নেচার দেখো। তোমার করা তুচ্ছ মেয়েটাই তোমার মেয়ের সুস্থতার কারণ। আচ্ছা পাপা! গুণ, আচরণ, সৌন্দর্য কী আদৌ স্ট্যাটাস দিয়ে হয়? স্ট্যাটাস তো শিক্ষা দেয় না। স্ট্যাটাস তো অস্থায়ী, ক্ষণিকের। কিন্তু শিক্ষা? আজীবনের। তোমার এবং মায়ের দেয়া শিক্ষা তো তোমরা দিয়েছো, তোমাদের স্ট্যাটাস নয়! স্ট্যাটাস থাকলেই কেউ সৎ মানুষ হয় না পাপা।
তুমি যদি না বুঝো আমার কিছুই করার নেই। তবে একটা কথা শুনে রাখো, ওই একটা মেয়ের উছিলায় তোমার এই মেয়েটাকে জীবিত এবং স্বাভাবিক দেখছো। যদি তাকে মানতে না পারো তাহলে তুমি আমায় হারাবা পাপা।”
বলেই রায়া এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আরমান সাহেব সেখানেই মূর্তির ন্যায় রয়। তার ভেতরটা রায়া ক্ষ’ত-বিক্ষ’ত করে চলে গেছে। কথাগুলো আরমান সাহেবকে জ’ঘ’ন্যরকম বি’ক্ষ’ত করেছে। চোখের সামনে ভাসছে নিথির নিষ্পাপ মুখখানা। নিরবতায় বসে রয় অনেকক্ষণ। সময় কোন দিক দিয়ে ফুরিয়ে গেলো আরমান সাহেব উপলব্ধি করতে অক্ষম!
———————
–“তোরা পৌঁছাইছিস?”
–“হ্যাঁ। সবে ফ্রেশ হয়ে বসলাম। তোর কাজ কতদূর?”
রাব্বি হসপিটালের কেবিনে উঁকিঝুঁকি মেরে বলে,
–“কাজ তো অনেকদূর এগিয়ে গেছে। শা** রে বারে পাইছিলাম গতকাল রাতে। সারারাত এত জামাই আ’দর করসি যে এখন হসপিটালের বেডে ব্যান্ডেজ দেখছে আর কাঁতরাচ্ছে। হোয়াট এ সুইট সিন! ওয়েট আমি পিকচার সেন্ড করবো নে, তোরে!”
–“এসব বাদ! কোনো কেস টেস হয়েছে?”
–“খবর পেলে তো? সুন্দর করে ডক্টরদের বুঝাইছি রাস্তাতে পরেছিলো, আর আমরা মানবতার খাতিরে উঠায় এনে ভর্তি করাই দিছি। মনে হয় না এক মাসের আগে উঠতে পারবে!”
–“এরপর আর কোনো ঝামেলা করবে?”
–“মনে হয় না! যা আ’দর দিছি, শোধরায় যাওয়ার কথা। যদি না শুধরায়, আমরা আছি। তুই টেনশন নিস না, এঞ্জয় ইওর হানিমুন!”
রায়িন ফোন রেখে দিলো। ওদিকের সব মিটমাট দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তখনই নিথি ফ্রেশ হয়ে এসে চুল মুছতে ব্যস্ত হয়ে পরে। রায়িন উপলব্ধি করলো রুমে এক সুবাস ছড়িয়ে পরেছে। এটা কী নাম না জানা শ্যাম্পুর নাকি সাবানের? তবে সুবাসটা মাতাল করার মতো। রায়িন একমনে তাকিয়ে রয় নিথির দিকে। নিথি রায়িনের এরূপ দৃষ্টি দেখেও না দেখার ভান করে রইলো।
–“দেখো, দেখো। তোমার ফিলিংস আমি এই কয়েকদিনে বের করেই ছাড়বো। ছেলে হয়ে নিজের ফিলিংস বুঝো না! কোন নিরামিষ আমার কপালে জুটছে হুহ্!”
মনে মনেই কথাগুলো আওড়ায় নিথি। সবটা লক্ষ্য করতে করতে চুল ছেড়েই নিথি বের হতে নিলো। অমনি রায়িন ছুটে চট করে নিথির হাত ধরে আটকালো। নিথি থেমে রায়িনের দিকে ফিরে তাকায়। ভ্রু-দ্বয় কুচকে নিথি বললো,
–“হাত ধরলেন কেন?”
–“চুল ছেড়ে কই যাচ্ছো তুমি?”
–“অর্ণব ভাইয়ার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। এছাড়া চুল তো ভেঁজা। ভেঁজা চুল কেউ বাঁধে নাকি?”
অর্ণবের নাম শুনে রায়িনের মেজাজ গরম হতে শুরু করলো। রায়িন চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে নিথিকে টানতে টানতে বিছানায় বসিয়ে দেয় এবং বলে,
–“এত পকপক করার দরকার নেই। চুপ করে বসে থাকো। চুল শুকালে বেঁধে তারপর বের হবা। নয়তো কেচি নিয়ে সব চুল কেটে হাতে হাতে ধরাই দিবো!”
নিথি মুখ বাঁকালো। অনুভূতি প্রকাশ না করে হুমকি দিচ্ছে, সাহস কতো! নিথি এবার লজ্জার মাথা খেয়ে বলে,
–“ভেঁজা চুলে বের হলে কী সমস্যা? কেউ তো আমার চুল ধরে বসে থাকবে না!”
–“তুমি চাও তোমার চুল ধরে বসে থাকতে?”
–“অবশ্যই না!”
রায়িন যেন শুনলোই না নিথির উত্তর। নিথির পিছে বসে নিথির চুলে নাক ডুবালো। নিথি চমকে সরতে চাইলেই রায়িনের বলিষ্ঠ হাত জোড়া নিথির কোমড় শক্ত বাঁধনে আবদ্ধ করলো। শীতল স্পর্শে নিথি থরথর করে কেঁপে রায়িনের বুকের সাথে লেপ্টে গেলো। ওদিকে রায়িন যেন কোনো এক সুখের সাগরে ভেসে গেলো। অজানা সুখ লুকায়িত এই নিথির নিকট। কোন চৌম্বকীয় শক্তি রায়িনকে সেই প্রথম থেকে নিথির দিকে টানতো? রায়িনের প্রতি নিথির অগাধ ভালোবাসা নাকি বিবাহ নামক পবিত্র বন্ধন? তবে রায়িন উপলব্ধি করেছে এই সরল ছোট্ট মেয়েটি ব্যতীত আজকাল ভিষণ শূণ্যতা অনুভব হয় তার। অফিসে সময় কাটালে নিথির চিন্তাতেই বারংবার বুদ হয়ে পরে সে।।
পরেরদিন আরমান সাহেবের কল এলো। নিথির সাথে কথা বলে অনেকক্ষণ ক্ষমা চাইলেন। নিথি বারংবার বলেছে তার প্রতি কোনো ক্ষোভ জমিয়ে রাখেনি। তাও আরমান সাহেব মানতে নারাজ। বড্ড অনুতপ্তে ভুগছেন যে তিনি! সকালের নাস্তা সেরে দু’জন ঘুরতে বের হলো। সেখানেও অর্ণবের দেখা মিললো। অর্ণবকে পেতেই যেন রায়িনকে ভুলে বসলো নিথি। রায়িন ওদের দেখছে এবং ফুঁসছে। পুরো দেহে যেন আ’গু’ন লাগছে এবং ফোস্কা পরছে। এক ঘন্টা চললো এরকম। রায়িনের রাগের মাত্রাও হুড়হুড় করে বেড়ে গেলো। একসময় নিথির পিছে গিয়ে নিথিকে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের দিকে ফেরালো। নিথি আকস্মিক ঘটনায় বিষ্মিত। বিষ্ময়ের সাথে তাকিয়ে রয় রায়িনের মুখপানে। মুখশ্রীতে রাগের ঝলকানি উপলব্ধি করতে পারছে নিথি। সামান্য ঢোঁক গিলে নিলো। রায়িন এবার অর্ণবের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলে,
–“এখানে আমরা হানিমুন করতে এসেছি। যেহেতু আমরা নিউ কাপল, আমাদেরও প্রাইভেসির প্রয়োজন। আমার কথার মানে আশা করছি বুঝেছেন? আসছি!”
বলেই নিথিকে টানতে টানতে অন্যদিকে নিয়ে যায় রায়িন।
———————
–“আপনি তো আমায় ভালোবাসেন না! তাহলে কেন আমায় স্পেস দেন না? আমি তো নিজেও জানি এখানে হানিমুনের নামে ঘুরতে আসছি। আপনার সময় প্রয়োজন, আপনি সময় নিচ্ছেন। মাঝখান দিয়ে আমায় কেন বলির পাঠা বানাচ্ছেন!”
রায়িন চোখ রাঙিয়ে নিথির দিকে তাকিয়ে রয়। নিথি চোখে-মুখে মিথ্যা রাগের আভাস ফোটানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। রায়িন রেগে নিথির দিকে দু’কদম এগিয়ে গেলো। মুহূর্তে-ই মুখ চেপে ধরলো নিথির। নিথি ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। পরপর কোমড়ে শক্ত বাঁধন উপলব্ধি করলো। অতঃপর অধরে নরম স্পর্শ। নিথি থমকে গেলো। বিষ্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো যেন। চোখ বড়ো বড়ো করে করে তাকিয়ে রয় নিথি। হাঁটু জোড়া থরথর করে কাঁপছে। হার্টবিট থেমে গেছে তার। ক্রমশ রায়িনের গরম নিঃশ্বাস নিথির নাকে, গালে পরছে। রায়িন এতটা ঘনিষ্ঠ হবে নিথির ভাবনারও বাহিরে ছিলো। একসময় রায়িন নিথিকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। নিথি হাঁপাতে থাকে। এতক্ষণ যেন জান কেড়ে বসেছিলো রায়িন। রায়িন দূরে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
–“ভালোবাসি বলে চেঁচালেই ভালোবাসা হয়ে যায় না। সব ভালোবাসা প্রকাশে সুন্দর হয় না, অপ্রকাশ্যেও হয়। এই বলে তুমি আমার ফিলিংস নিয়ে খেলবা? মুখে বললেই কী সব হয়ে যায়?”
রায়িনের দিকে তাকানোর সাধ্যি নিথির নেই। তবে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে রায়িনের কথাগুলো। এর মানে রায়িন তাকে ভালোবাসে? তার ভালোবাসার মানুষটা তাকে ভালোবাসে? শুধু তাকে? নির্বিঘ্নে মনের মধ্যে শীতল অনুভূতি ছেঁয়ে যায়।
আরও দুইদিন পর দু’জন বাড়িতে ফিরলো। সকলের জন্যেই টুকটাক শপিং করা হয়েছে। শারমিন আক্তার এবং আদনের জন্যেও। নিথি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামীকাল সেগুলো দিয়ে আসবে সাথে ওদের সাথেও দেখা করে আসবে। কতদিন হলো প্রিয় ভাইটার সাথে দেখা হয় না। আজ নিথি সবচেয়ে সুখী মানুষ। সেদিনের পর থেকে রায়িন খুব বেশি সেন্সিটিভ হয়েছে নিথির প্রতি। এখন নিথির নিজ থেকে রায়িনের কাছে যাওয়া লাগে না বরং রায়িন তার মানসিক শান্তির জন্যে বারংবার নিথিকে নিজ বাহুডোরে আবদ্ধ করে। সে কী অসীম ভালোলাগার অনুভূতি। নিথি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। আকাশে লক্ষ তাঁরার ভীড় জমেছে। তাদের মাঝে কেন্দ্রবিন্দু অর্ধ চাঁদ। সেটাতেই অনিমেষ তাকিয়ে আছে নিথি। বারংবার মনে পরছে কৃষ্ণচূড়ার এক সন্ধ্যার ঘটনা। সেই সন্ধ্যায় প্রথম রায়িনকে নিকট হতে অনুভব করেছিলো। নিথির ভাবনার মাঝে হঠাৎ রায়িন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আবেশে চোখ বুজে এলো নিথির। রায়িন আকাশের পানে তাকিয়ে বলে,
–“আমার জীবন পূর্ণ করেছো তুমি। সৃষ্টিকর্তা এক অসাধারণ সুন্দর জীবনসঙ্গিনী দিয়েছে আমায়। অমায়িক সুন্দর রশ্মি তুমি নিথি, তুমি আমার জীবনের রশ্মি।”
প্রশান্তির ঢেউ খেলে গেলো নিথির সর্বাঙ্গে। আজ সে সুখী মানুষ, সবচেয়ে সুখী মানুষ। না জানি কোন পূর্ণ করেছিলো, যার জন্যে আল্লাহ তাকে তার ভালোবাসার মানুষটিকেই পাইয়ে দিয়েছে। এই সুখ যে কল্পনারও ঊর্ধ্বে। মনে মনে আল্লাহ’র দরবারে লাখো লাখো শুকুরিয়া আদায় করলো, সবকিছুর জন্যে!
~সমাপ্ত!
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।