গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব-২৮+২৯

0
290

#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_আটাশ

চোখের সামনে বাবা-মায়ের সাদা কাপড় জড়ানো লা’শ কোনো সন্তানের পক্ষে’ই সহ্য করার ক্ষমতা নেই। ফাইজা’র গগন কাঁপানো চিৎকারে সবার হৃদয় কেঁপে উঠছে বার বার। ফাইজার সামনেই ফারদিন এক কোনে চুপিসারে দাড়িয়ে আছে। ওর বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সহ্য করতে পারছেনা ফাইজার চোখের পানি। এই আহাজারি’র শব্দে ফারদিন নিস্তব্দ, নিশ্চুপ হয়ে আছে। কি করে স্বান্তনা দিব সদ্য বাবা-মা হারা মেয়ে’টাকে? কোনো ভাষা কি আছে? তনুজা ফাইজা’কে বুকে আগলে রেখে চোখের পানি ফেলছে। সায়মা খানম একটু দূরে বসে আছে। মেয়ে’টাকে স্বান্তনা দেওয়ার মতো শব্দ খুঁজে পাচ্ছেন সে? ফাইজা’র গলা ভেঙে গেছে চেঁচিয়ে কান্নার ফলে। কিছুক্ষন পরেই দাফন করা হবে হাসনাত সাহেব আর নাদিয়া বেগম’কে।

–সবাই চিরকাল বেঁচে থাকেনা মা। এত’টা ভেঙে পড়িস না। আমি আছি তো। আমি তোর মা না বল? আমি তোকে আগলে রাখব। তুই আর কান্না করিস না মা। তুই অসুস্থ হয়ে যাবি….

তনুজা কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলে উঠলো। ফারদিন টলমল চোখে তাঁকিয়ে আছে ফাইজা’র দিকে এক নজরে। তনুজার কথা শুনে ফাইজা চিৎকার করে বললো…….

–এইসব কিছু আমার জন্য হয়েছে। আমি আমার বাবা-মা’কে মে’রে ফেলেছি। আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। আমার ও ম’রে যাওয়া উচিত…..

বলেই তনুজার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে একেক’টা জিনিস সব ফেলে দিলো। পা’গলের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকলো” আমার ম’রে যাওয়া উচিত”। ফাইজা’কে থামানোর যথেষ্ট চেষ্টা করছে তনুজা আর আরজা। আরজা খবর শুনে’ই ছুটে এসেছে। জেহের বাইরে খাটিয়ার সামনে বসে আছে। ফাইজা’র পাগলামি গুলো নিশ্চুপ হয়ে টলমল চোখে দেখছে ফারদিন।
টেবিলে থাকা একটা বড় ফ্লাওয়ার ভাজ নিয়ে নিজের মাথায় আঘাত করার জন্য প্রস্তুত হতে’ই ফারদিন গিয়ে ধরে ফেললো। ফাইজা ফারদিনের দিকে অশ্রভর্তি চোখে অসহায় চাহনী’তে দিতে’ই ফারদিন ফাইজা’কে শক্ত করে বুকে চেপে ধরলো। ফারদিনের স্পর্শে ফাইজা আরো বেশি কান্নায় ভেঙে পড়লো। আরজা ও দাড়িয়ে মুখ চেপে কান্না করতে করতে বাইরে চলে এলো। তনুজা ফারদিন’কে ইশারা করতে’ই ফারদিন বুঝতে পারলো। তাই, চোখের ইশারায় যেতে বলে নিজে ফাইজা’কে শান্ত করতে বলে উঠলো…..

—আমি আছি তো। কেনো এত’টা ভেঙে পড়ছো। আজ থেকে তুমি আর আমি দুজনেই এতিম। আমরা দুজনেই সমান। আল্লাহ কি সবাই’কে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখবে। একদিন আগে পরে সবাই’কে তার কাছে যেতে হবে। এখন তুমি এত’টা ভেঙে পড়ছে তোমার বাবা-মা দুজনে কষ্ট পাবে। তারা তো দেখছে তোমাকে?

ফারদিনের স্বান্তবা বানী শুনে ফাইজা ফারদিন’কে আরো বেশি আকড়ে ধরে বললো…..

–আমি পারব না। বিশ্বাস করুন আমার দম আটকে যাচ্ছে। আমি ম’রে যাব। আমি থাকতে পারব না….

ফারদিন আর উওর না দিয়ে চুপ করে রইলো। সাথে সাথে ওর দুচোখ বেয়ে অশ্রু ফোটা গড়িয়ে পড়লো।
____________________________________________
ছেলেরা তো সবার মতো শব্দ করে কাঁদতে পারেনা। চাইলেও কাঁদতে পারেনা। জেহের ড্রয়িং রুমে বসে বসে বোনের আহাজারির শব্দ শুনছিলো। কিন্তু ভেতরে যাওয়ার সাহস হচ্ছেনা। কি বলে বোন’কে স্বান্তনা দিবে সে? ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে নিঃ শব্দে চোখের পানি ফেলছিলো। আরজা ড্রয়িং রুমে পা দিয়ে জেহের’কে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো জেহেরের দিকে। জেহেরের পাশে বসে ওর কাঁধে সাহস করে হাত রেখে বললো…..

–আপনি এত’টা ভেঙে পড়লে ফাইজুর কি হবে ভাইয়া? প্লিজ নিজেকে শক্ত করুন। এখন আপনি ছাড়া আর কে আছে ওর?

স্বান্তনা বানী পেয়ে জেহের নিজেকে সামলাতে পারলো না। হুট করে আরজা’কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। অপ্রত্যাশিত ঘটনায় আরজা খানিকক্ষণ চমকে গেলেও নিজেকে সামলে জেহের পিঠে রাখলো।
____________________________________________
নাদিয়া বেগম আর হাসনাত সাহেব’কে জানাযার জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। তাই ফাইজা’কে শেষ বারের মতো তাদের সামনে নিয়ে আসলো ফারদিন। সাদা কাফনের থেকে নাদিয়া বেগমের মুখ’টা খুলে দিতে’ই ফাইজা চিৎকার করে খাটিয়ার সামনে লুটিয়ে পড়লো। খাটিয়া ধরে জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো….

–মা ও মা একবার উঠো না মা। আমি থাকতে পারব না তোমাকে ছাড়া। আমাকেও নিয়ে যাও তোমার সাথে…..

বলেই পাশে রাখা হাসনাত সাহেবের খাটিয়া ধরে বললো….

–বাবা তুমি না বলে ছিলে তুমি আমাকে ছেড়ে কোনো দিন যাবে না। তাহলে এইভাবে এখন নিশ্চুপে সুয়ে আছো কেনো? উঠো না বাবা।

বলেই পাগলের মতো কাদতে লাগলো। জেহের ফারদিনের পাশে দাড়িয়ে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। উপস্থিত স্কবার চোখ অশ্রুসিক্ত। জেহের বোনের পাগলের মতো অবস্থা দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বোন’কে জড়িয়ে ধরলো। ভাইয়ের ভরসা পেয়ে ফাইজা গগন বিদায়ক চিৎকার করে উঠলো।

–ভাই আমি আর তুই একা হয়ে গেলাম। আমরা কি নিয়ে বাঁঁচব ভাইয়া। আমাকেও মে’রে ফেল তুই। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া। বুক ফেটে যাচ্ছে। গলা ছিড়ে যাচ্ছে। নিশ্বাস ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে। আমাকে মে’রে ফেল প্লিজ। আমি থাকতে পারব না….

জেহের সহ্য করতে না পেরে নিজেও শব্দ করে এইবার কেঁদে দিলো। দুই পাশে দুইটা খাটিয়া রাখা তার মাঝে বসে দুই ভাই বোন বিলাপ করে যাচ্ছে। দৃশ্য’টা সহ্য করার মতো না।
____________________________________________
দাফন শেষ হতে’ই ফারদিন আর জেহের এক সাথে রুমে প্রবেশ করলো। ফাইজা সেন্সলেস হয়ে আছে। ওর দুই পাশে বসে আছে আরজা আর তনুজা আর সায়মা খানম। ফাইজা’কে এই অবস্থায় দেখে ফারদিন আর জেহের দুজনেই দৌড়ে গেলো ওর সামনে। দুজনেই এক সাথে অস্থির হয়ে প্রশ্ন করে বসলো…

–ওর কি হয়েছে? কি হয়েছে?

তনুজা ঠান্ডা মাথায় উওর দিলো…..

–খাটিয়া নিয়ে যাওয়ার পর চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে সেন্সলেস হয়ে গেছে। শরীর ভীষন দূর্বল তাই স্যালাইন দিতে হবে। তোমরা ব্যবস্থা করো তাড়াতাড়ি…..

ফারদিনের জান বেড়িয়ে যাচ্ছে ফাইজার মুখের দিকে তাঁকিয়ে। মেয়ে’টা আর কত কষ্ট সহ্য করবে? ফারদিন এখনো জানেনা ফাইজার বাবা-মাকে পরিকল্পনা করে হ’ত্যা করা হয়েছে। ফাইজা’কে কিছুক্ষনের মধ্যে স্যালাইন দেওয়া হলো। সারাদিন সবার উপরে ধকল গিয়েছে বিধায় ফারদিন’কে ফাইজার কাছে রেখে সবাই একটু অন্য রুমে গিয়েছে। জেহের’ বোনের অবস্থা দেখে পাগল পাগল হয়ে গেছে। সদ্য বাবা-মাকে হারিয়ে এভাবেই ভেঙে পড়েছে৷ বোনের মুখ চেয়ে নিজেকে শান্ত রেখেছিলো এতক্ষন৷ এখন সেই বোনের এই অবস্থা মেনে নিতে পারছেনা। জেহের কে জোর করেই তনুজা অন্য রুমে নিয়ে গেছে।
____________________________________________
মধ্য রাত ফাইজা’র সেন্স আসতে’ই চোখ খুলে তাঁকা’তেই দেখলো ফারদিন নিচে বসে ওর এক হাতে আকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। অন্য হাতে স্যালাইন চলছে। ফারদিন’কে দেখে’ই কেনো যেনো ওর শরীর রাগে জ্বলে উঠলো। হাত’টা জোর করে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই ফারদিন জেগে উঠলো। ফাইজা’কে সজাগ দেখে লাফিয়ে দাড়িয়ে পড়ে অস্থির কন্ঠে বললো….

–তোমার কষ্ট হচ্ছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? পানি খাবে? কি হয়েছে?

ফাইজা ফারদিনের অস্থির কন্ঠ শুনে লাফিয়ে উঠলো। এক টানে স্যালাইন’টাকে খুলে ফেললো। এতে অবশ্য ওর হাত দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করলো। ফাইজার কান্ডে ফারদিন অবাক হয়ে তাঁকিয়ে আছে। রক্ত বের হতে দেখে ভয় পেয়ে ফাইজার হাত’টা ধরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো….

–কি করছো কি? রক্ত বের হচ্ছে তো? পাগল হয়ে গেছো তুমি?

ফারদিনের কথায় ফাইজা এইবার ও’কে ধাক্কা মে’রে দূরে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বললো….

–আমার কাছে আসবেন না একদকম। আপনার জন্য আজ আমি বাবা-মা হারা। তাদের মৃ’ত্যুর জন্য শুধু মাত্র আপনি দায়ী। চলে যান আপনি চোখের সামনে থেকে। নয়তো আমি কি করব নিজেও জানিনা। চলে যান বলছি…..

কথাগুলো শুনেই ফারদিন যেনো আকাশ থেকে পড়লো। ওর মাথা ঘুরে গেলো মুহূর্তে’ই। কি বলছে মেয়ে’টা এইসব? ফারদিন অবাক স্বরে বলে উঠলো….

–কিসব বলছো তুমি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? দেখো এটা একটা এক্সিডেন্ট। আর এক্সিডেন্টের উপর আমাদের কারোর হাত থাকেনা। প্লিজ নিজেকে সামলে নাও……

ফাইজা এইবার দ্বিগুন রাগ নিয়ে চারদিকে কিছু খুঁজতে লাগলো। টেবিলের উপর ফোন’টা দেখে ছুটে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ’টা বের করে ফারদিনের হাতে ফোন ধরিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো…..

–দেখুন। আমার বাবা-মা’কে খুন করা হয়েছে। কে করেছে আশা করি আপনাকে বুঝাতে হবেনা। আপনাকে ভালোবাসা আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল। আমার ভুলের জন্য আমার বাবা-মা’কে জীবন দিতে হলো। চলে যান আপনি…….

ওদের চেচামেচি’তে সবাই তড়িঘড়ি করে ছুটে এলো। তনুজা এসেই ফাইজা’কে ধরে প্রশ্ন করলো…..

–চেঁচাচ্ছিস কেনো? শরীর খারাপ করবে? একি হাত দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে কেনো? কি করেছিস তুই…..

ফাইজা উওর না দিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। আর ফারদিনের দিকে রাগী চাহনী দিয়ে আছে। ফারদিন ফোন’হাতে নিস্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে। ফাইজা পুর্নরায় চেঁচিয়ে উঠার আগেই ফারদিন বড় পা ফেলে রুমের বাইরে চলে গেলো। সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এখানে কি হচ্ছে তারা কিছুই বুঝছেনা। ফারদিন চলে যেতে’ই ফাইজা তনুজা’কে জড়িয়ে কেঁদে উঠলো। আর সবাই প্রশ্ন বিদ্ধ চোখে ওর দিকে চেয়ে রইলো।
____________________________________________
ফারদিন নিচে নেমে এসে’ই ফোন’টা আছাড় মে’রে ভেঙে ফেললো। রাগে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো…..

–আমি এত’টা বোকা কি করে হতে পারলাম? তিথী ভয়ংকর জেনেও কেনো চুপ করে বসে রইলাম সময়ের অপেক্ষায়। আজ আমার জন্য’ই ফাইজা’র এই অবস্থা? সত্যি তো আমি দায়ী এইসবের জন্য। এখন কি করব আমি….

বলেই চুল খামচে ধরলো দুই হাতে। রাগে দাতে দাত চেপে বলে উঠলো…..

–যার জন্য আজ তুমি এতিম হলে? যার জন্য আজ তোমার এই অবস্থা। তাকে এত’টা ভয়ংকর মৃ’ত্যু দিব যে কেউ কল্পনা ও করতে পারছেনা। ইটস মাই প্রমিস………

#চলবে

#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_উনত্রিশ

সদ্য বাবা-মা হারা মেয়ে’টা ভাইয়ের কোলে মাথা রেখে নিশ্চুপে চোখের জন্য ফেলছে। ভাই পরম আবেশে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মাথার উপর সিলিং শব্দ করে ঘুরছে। ফাইজার দৃষ্টি সেদিকে রেখে বলে উঠলো……..

–আমরা এখান থেকে চলে যাব ভাইয়া….

ফাইজার কান্না মাখা কন্ঠ স্বরে চলে যাব কথা’টা শুনে জেহের অবাক স্বরে বলে উঠলো……

–চলে যাব মানে? আমরা আমাদের বাসা ছেড়ে কোথায় যাব?

জেহের কথা শুনে ফাইজা পূর্নরায় বিস্ফোরিত স্বরে বললো…

–আমরা গ্রামের বাড়ি চলে যাব। এখানে থাকলে আমি দম বন্ধ হয়ে ম’রে যাব ভাইয়া। এই বাড়ির প্রত্যেক’টা কোনায় কোনায় বাবা-মায়ের স্মৃতি’তে জর্জরিত। আমি এখানে থাকতে পারব না ভাইয়া। প্লিজ আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে চলো প্লিজ…….

বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। জেহের চোখ ও অশ্রুসিক্ত। বোনের আবেগ জড়ানো কথাগুলো শুনে চুপ করে আছে। কি উওর দিবে ও? সত্যি’ই তো এই বাড়ি’টা যে বাবা খুব সখ করে টাকা জমিয়ে একটা ফ্লাট কিনেছিলো। কষ্ট করে অর্জন করা টাকা দিয়ে কেনা এই ফ্লাটে রয়েছে হাজার মধুমাখা স্মৃতি, ভাই বোনের খুনশুটি, আর চারজনে মিলে হাসির স্মৃতি। কি করে ভুলবে এগুলো? কথাগুলো ভাবতে’ জেহেরের ও দম বন্ধ হয়ে আসচ্ছিলো। নিজেকে সামলে শান্ত কন্ঠে বললো…..

–আমরা চট্রগ্রাম চলে যাব। আমি তো ফ্লাটে একা থাকি। এখন থেকে তুই আর আমি থাকব। আর এই বাসা’টা না হয় ভাড়া দিয়ে দিব….

জেহের কথা শুনে ফাইজা জোরে বলে উঠলো……

–“নাহ” এই বাসায় আমার বাবা-মা’য়ের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এই বাসায় আমি অন্যের হাত লাগতে দিব না। এমনি থাকবে বাসা….

জেহের ও আর কথা বাড়ালো না। বোনের কথা মেনে চুপ করে রইলো। বাবা-মা চলে গেছে দুইদিন হলো। বোন’টা এখনো প্রতি মুহূর্ত চোখের পানি ফেলছে। দুইদিনের ফাইজার চেহারা’ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চোখ গুলো ফুলে উঠেছে। ফারদিন হাজার বার ফোন দিয়েছে কিন্তু ফাইজা ফোন বন্ধ করে রেখেছে। তনুজা ফাইজা আর জেহেরের সাথে রয়েছে। জেহের মনে মনে ঠিক করলো কালকে’ই চলে যাবে। ফাইজার ফারদিনের উপর এক অজানা রাগ জমে আছে। ফারদিনের কথা মাথায় এলেও পাত্তা দিচ্ছে না। ফারদিন প্রতিদিন বাসায় এসেছিলো কিন্ত ফাইজা নিজের রুমের দরজা এক মিনিটের জন্য ও খুলে’নি।
____________________________________________
ফারদিন নিজের রুমের বেলকনি’তে বসে আছে গিটার নিয়ে। দুই রাত নির্ঘুম কাটানোর ফলে ওর চোখ মুখ ফুলে লাল হয়ে আছে। বার বার ফাইজা’র পাগলামি গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ফাইজা’র অবহেলা গুলো মেনে নিতে পারছেনা ও? কিন্তু মেয়ে’টার এই বা কি দোষ? ফারদিনের ও নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। ও যদি সময়ের অপেক্ষা না করে তিথী’কে তখনি শাস্তি দিতো তাহলে আজ ফাইজার এমন অবস্থা হতো না। ফারদিন ভাবতে ভাবতে গিটারে সুর তোলার চেষ্টা করতে লাগলো। শূন্য লাগছে মনের ভেতর’টা। চোখ বন্ধ করে সুর তোলার চেষ্টা করতে লাগলো। গুমড়ানো গলায় গাইতে লাগলো…….

চোরাবালি মন তোমার,
কেনো শুধু লুঁকিয়ে থাকো?
একটু আড়াল হয়ে আমায় দেখো?(২)
যদি কোনো চিত্র আঁখি
পৃথিবীর সবচেয়ে দামী
সেই চিত্র’তে তুমি…
Perfectly বসো……
কেনো লাগে শূন্য শূন্য বলো?
তোমায় ছাড়া এত
তুমি কি তা বলতে পারো?
কেনো লাগে শূন্য শূন্য বলো?
তোমায় ছাড়া এত
তুমি কি তা বলতে পারো?

এইটুকু গেয়ে গিটার’টা বুকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে দিয়ে বলে উঠলো…..

–আমার খুব শূন্য লাগছে জান। কেনো এমন করছো তুমি আমার সাথে? আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছিনা। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার…..

বলেই নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। কয়েকদিন আগেও রাতে যখন ফাইজা’র রুমে যেতো তখন ফারদিন মেইন দরজা দিয়েই যেতো। আর দরজা খুলে দিতো ফাইজা’র মা নিজে। যেহেতু ফারদিন ফাইজা’র স্বামী সেহেতু ফারদিন’কে আটকানোর প্রশ্ন উঠেনা। ছেলে’টা আকুল আবেদন ফেলতে পারে’নি সে? তাই প্রতি রাতেই ফারদিন যখন তাদের বাসায় যেতো তখন সে দরজা খুলে দিতো। এটা কেউ জানতো না তারা দুজন বাদে। না খেয়ে প্রথম দিন গিয়েছিলো তাই ফাইজা’র মা নিজ হাতে ও’কে জোর করে খাইয়ে দিয়েছিলো। কথা গুলো মনে উঠতে’ই ফারদিনের নিজের মায়ের কথা মনে পড়লো। ফাইজা’র মায়ের ভালোবাসা দেখে ভেবেছিলো এই বুঝি এক মায়ের ভালোবাসা পেতে চলেছে। কিন্তু কে জানতো ওর ভাগ্য’টা এত খারাপ যে কোনো মায়ের আদর,স্নেহ,ভালোবাসা ওর কপালে নেই। ছেলে’টা ভালো নেই। কি করে বুঝাবে সবাই’কে? ফাইজা’কে ছাড়া যে ও শূন্য। কি করে বাঁঁচবে ও? কথা গুলো ভাবার সময় রুম থেকে ফোনের আওয়াজ ভেসে আসতে’ই ফারদিন চোখের জল গুলো মুঁছে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। চেনা নাম্বার পেয়ে তড়িঘড়ি করে ফোন রিসিভ করে বলে উঠলো…..

–গট এনি ইনফরমেশন? টেল মি কুইক……

ফারদিনের অস্থির কন্ঠ শুনে ওপাশ থেকে ছেলে কন্ঠে ভেসে আসলো….

–স্যার পেয়ে গেছি। তিথী ম্যাডামের বড় গ্যাং রয়েছে। স্যার আপনার পেছন থেকে আপনার আপন মানুষ’টাই আপনাকে ছু’ড়ি মে/রেছে। …..

এইটুকু বলে ছেলেটা থেমে যেতেই ফারদিন উত্তেজিত কন্ঠে একটু চেঁচিয়ে বলে উঠলো…..

–স্যা এভ্রিথিং ক্লিয়ার’লি……

ফারদিনের রাগী স্বর শুনে ছেলে’টা থমকানো কন্ঠে বললো…..

–স্যার তিথী ম্যাডামের সাথে নিরব স্যার ও যুক্ত।

নিরব নাম’টা শুনেই ফারদিনের মাথা হালকা ঘুরে গেলো। নিজের কান’কে যেনো নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না। নিরব ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে ওর সাথে বেঈমানী করতে পারলো? কথাটা কেনো যেনো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছেনা ফারদিনের? ফারদিন চিৎকার করে বলে উঠলো…..

–তুমি ঠিক বলছো তো?

–জ্বী স্যার কোনো সন্দেহ নেই। আমার কাছে সব প্রমান আছে। এই দুইদিন তারা কোথায় গেছে? কি কি বলছে সব কিছুর প্রমান আমার কাছে আছে। আপনি বললে এক্ষুনি আপনাকে সব মেইল করে দিচ্ছি……

ছেলে’টার দৃঢ় কন্ঠ স্বর শুনে ফারদিন কিছুক্ষন থমকে দাড়ালো। ছেলে’টাকে সব মেইল করতে বলে ফোন’টা রেখে ঘাড়ের দুইপাশে হাত রেখে বিছানায় বসে পড়লো। আপন মানুষ’রা কেনো সব সময় বিশ্বাসঘাতকতা করে? নিরব কেনো এইসব করলো? ভেবে দাতে দাত চেপে ফারদিন বলে উঠলো……

–বিশ্বাস ঘাতকতা’র শাস্তি তোকে খুব ভয়ংকর ভাবে দিতে হবে। তোদের দুজনের মৃত দেহ দেখেও মানুষ কেঁপে উঠবে। সময় ফুরিয়ে এসেছে তোদের…..

বলেই হালকা রহস্যময় হাসি দিয়ে উঠলো।
____________________________________________
পরের দিন সকালে উঠে’ই ফারদিন ফাইজা’দের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আজ যে করে হোক ফাইজা’র সাথে কথা বলে ছাড়বে? ওর অভিমান ভাঙাবে। তাই সকাল সকাল উঠে’ই রওনা হলো। ফাইজার বাসার সামনে এসে গাড়ি’ থামিয়ে উপরে উঠে বাসার দরজায় তালা ঝুলানো দেখে ওর মাথায় বাজ পড়লো। আবার ভাবলো ওরা হয়তো বাইরে গেছে? তাই কিছু না ভেবে ফাইজার নাম্বারে কল দিলো। কিন্তু ওপাশ থেকে মেয়েলী কন্ঠে কেউ “ফোন বন্ধ আছে ” বলে উঠলো। ফারদিন বুকের ধুকপুক বেড়ে চলেছে। হারানোর ভয় জেগে উঠছে। জেহের নাম্বারেও কল দিয়ে বন্ধ পেলো। উপায়ন্তর না পেয়ে অনেক ভেবে চিন্তা তনুজার নাম্বারে কল দিয়ে উঠলো। একবার রিং হয়ে কে’টে গেলো। দ্বিতীয় বার কল দিতেই ওপাশ থেকে তনুজা ব্যস্ত গলায় বললো…..

–হ্যা,কে বলছেন?

ফারদিন থমকে থমকে বললো….

–আন্টি আমি ফারদিন। একটা কথা জানার জন্য ফোন দিলাম….

তনুজার হ্যা সূচক বানীর পেয়ে’ই ফারদিন নিঃশ্বাস আটকে বলে উঠলো….

–ফাইজা’রা কি আপনার ওইখানে? আসলে বাসায় তালা ঝুলানো তাই?

তনুজা এইবার করুন স্বরে বলে উঠলো…..

–ফাইজা তো জেহেরের সাথে চট্রগ্রাম চলে গিয়েছে কাল রাতে। মেয়ে’টা খুব ভেঙে পড়েছে এখানে থেকে। তাই জেহের নিজের সাথে নিয়ে গেছে। তুমি চিন্তা করোনা। ওর নিজেই তোমাকে ফোন দিবে মন’টা ঠিক হোক একটু….

বলেই ব্যস্ত আছি বলে তনুজা ফোন রেখে দিতে’ই। ফারদিনের হাত থেকে ফোন’টা নিচে পড়ে গেলো। ওর কানে বাজছে “ফাইজা চট্রগ্রাম চলে গিয়েছে “। হাটু ভেঙে দরজার সামনে বসে পড়লো। সাথে সাথে চোখ বেয়ে পানির ফোটা গড়িয়ে পড়লো।

#চলবে

[ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ]