আলো আধারের খেলা পর্ব-২১

0
262

#আলো আধারের খেলা
#পর্ব_২১
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

জান্নাত একটিবারের জন্য বলে নি যে, সে আলাদা করে খাবে।বা রুয়েল নিজেও এ ব্যাপারে কিছু বলে নি।আসলে ঊর্মি নিজেই অতিষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো।তার অসহ্য লাগছিলো জান্নাত এবং রুয়েলকে।এতোদিন একা একা থেকেছে তো,হঠাৎ করে জান্নাত তার সংসারে আসায় তার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিলো। সেজন্য তার নিজের মনের কথা জান্নাতের উপর চাপিয়ে দিলো।জান্নাত শুধু একদিন একটু দেরীতে উঠেছে ,আর তাতেই ঊর্মি রেগে আগুন হয়ে গেছে।

জান্নাত শুধু ঘরে বসে থেকে কাঁদছে।কারণ সে তো কখনোই আলাদা হতে চায় নি।তাহলে ঊর্মি কেনো এভাবে তাকে দোষারোপ করছে।জান্নাতের কিছুই ভালো লাগছে না।সে তখন মনে মনে ভাবলো,কেনো যে তার বিয়ে হলো?বিয়ে না হলেই বেশি ভালো হতো।নিজের বাড়িতে বেশ ভালো ছিলো সে।আজ দিয়ে জান্নাত একটা জিনিস ভালোভাবেই বুঝে গেলো।শুধু স্বামী ভালো হলেই হয় না।স্বামীর বাড়ির লোকদের ও ভালো হতে হয়।

রুয়েল এখন শো রুমে যাবে।সেজন্য জান্নাতকে বললো কোনো কান্দাকাটি করবেন না খবরদার।আর ভাবি তখন রাগ করে আলাদা হওয়ার কথা বলেছে।এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।এই বলে জান্নাতের কপালে একটা কিস করে বললো,এবার একটু হাসুন জান্নাত।আপনার চোখের পানি একদম সহ্য হয় না আমার।এই বলে রুয়েল জান্নাতকে জড়িয়ে ধরলো।কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকার পর বললো, কি আনবো আসার সময়?আপনি কি খাবেন বলেন?
–খাবো না কিছু।
–আচ্ছা ঠিক আছে।যা খেতে মন চাইবে শুধু ফোন করে বলবেন।আসার সময় নিয়ে আসবো।
জান্নাত রুয়েলের কথা শুনে মাথা নাড়লো।আর স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো।কারণ যত মন খারাপই হোক না কেনো তার রুয়েল কথা বললে নিমিষেই তার মন ভালো হয়ে যায়, সব দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যায় তার।ছেলেটা আসলেই যাদু জানে।এমন ভাবে কথা বলে কিছুক্ষন আগে কি ঘটেছিলো সব ভুলে যায় জান্নাত।রুয়েল চলে গেলো।কিন্তু যেতে ধরে আবার ফিরিয়ে এলো সে।আর জান্নাতের কপালে আরো একটা কিস করলো।জান্নাত এতোক্ষণে একটু হেসে উঠলো।

এদিকে ঊর্মি রাগ করে তার স্বামী আর সন্তানের জন্য শুধু দুপুরের খাবার রেডি করছে।কারণ সে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে আর একসাথে থাকবে না।জান্নাত আর রুয়েলকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে।আর তারা শহরের বাসায় থাকবে।

রুয়েল চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই রুয়েলের মা এলো জান্নাতের রুমে।আর বললো,তুমি এভাবে রুমে বসে আছো কেনো?রান্না করতে হবে না?

জান্নাত সেই কথা শুনে রান্নাঘরের দিকে যেতে ধরলো। তখন রুয়েলের মা বললো, ঊর্মিকে গিয়ে আগে সরি বলো।তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।আর বলবে ভাবি,কখনোই আর উঠতে লেট হবে না।আমার ভুল হয়ে গেছে ভাবি।এবারের মতো ক্ষমা করে দাও।

জান্নাত তার শাশুড়ীর কথা শুনে বললো,মা আমি তো কোনো অন্যায় করি নি।আর আমার দোষ টা কোথায়? কি জন্য আমাকে এসব বলতে হবে?

–তুমি তো বড্ড জেদি মেয়ে।যা বলছি সেটাই শোনো।তুমি হলে ছোট।আর ছোটরাই সবসময় নত হয়।যাও ঊর্মির হাত ধরে সরি বলো।

জান্নাত তার শাশুড়ীর কথা শুনে ঊর্মির কাছে চলে গেলো।আর তার শাশুড়ীর কথামতো ঊর্মির হাত ধরে বললো,ভাবি আমার ভুল হয়েছে।আর উঠবো না দেরী করে।আপনি মাথা টা ঠান্ডা করুন।আমি আলাদা হতে চাই না।আমরা সবাই মিলেমিশে একসাথেই থাকতে চাই।

ঊর্মি জান্নাতের কথা শুনে বললো, না ভাই,আমি আর একসাথে থাকতে চাই না।যার যার সংসার তাই তাই করে খাও।আর তুমি যতই মুখে বলো না কেনো আমাদের সাথে একসাথে থাকতে চাও,তোমার মন কিন্তু আলাদা হওয়ার কথা শুনে খুশিই হয়েছে।অযথা সংসারে ঝামেলা করতে চাই না আমি।নিজের স্বামীর কামাই খায়া কেনো আমি অন্য মানুষের কথা শুনবো।আমি বলবো এক কথা আর তুমি রুয়েল কে বলবে অন্য কথা।যার জন্য সংসারে নিত্যদিন অশান্তির সৃষ্টি হবে।

জান্নাত সেই কথা শুনে বললো,ভাবি আমি মোটেও এমন মেয়ে নই।তাহলে কেনো আমাকে অযথা দোষারোপ করছেন?কেনো বার বার বলছেন,জান্নাত আলাদা হতে চাচ্ছে।আমি কিন্তু মন থেকে বলছি ভাবি,সত্যি আমি আলাদা হতে চাই না।আমি সংসারে কোনো অশান্তিও চাই না।

ঊর্মি তখন তার বুকে চড় দিয়ে বললো,যাও সব দোষ আমার।তুমি কোনো দোষ করো নি।কারণ তুমি একদম ধোয়া তুলসিপাতা।তোমার কোনো দোষ থাকতেই পারে না।তুমি তো নিজেকে ওলি আউলিয়া ভাইবা বসে আছো।আমাদের মতো খারাপ মানুষের সাথে একসাথে খাওয়ার কোনো দরকার নেই।

রুয়েলের মা তখন বললো,ঊর্মি তুমি এরকম করছো কেনো?কেনো হঠাৎ আলাদা হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগছো?

–মা!কি বলছেন এসব?আমাকে দোষারোপ করছেন আপনি?আমি আলাদা হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগছি?হ্যাঁ হ্যাঁ এখন তো আমাকেই দোষারোপ করবেন।এখন ছোট ছেলে বিয়ে করেছে।আমার কি আর দরকার আছে।ছোট ছেলের বউ এর হাতের খাবেন।ভালো, খুব ভালো।বুঝেছি,সবাই একজোট হয়েছেন।যান,আজ থেকে আপনি আপনার ছোট ছেলের মধ্যে খাবেন।আপনাকেও চাই না আমাদের।

জান্নাতের শাশুড়ী ঊর্মির কথা শুনে আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে গেলো।ঊর্মি কি সব ভুলভাল বলছে।তিনি কখন বললেন ছোট ছেলের সাথে আলাদা থাকবেন?এই ঊর্মি টা কেনো যে এরকম অশান্তি শুরু করছে সংসারের মধ্যে?রুয়েলের মা ভয়ে আর একটি কথাও বললো না।কারণ ঊর্মির কথার সাথে তিনি কিছুতেই পেরে উঠবেন না।খুবই ব্যবহার খারাপ ঊর্মির।

জান্নাত ঊর্মির এমন খারাপ ব্যবহার দেখে আবার তার রুমে চলে গেলো।তার মন টা আবার খারাপ হয়ে গেলো।সে বুঝতেই পারছে না সারাবছর এই রকম একটা জঘন্য মহিলার সাথে থাকবে কি করে?যিনি একেক বার একেক কথা বলে।যার মিনিটে মিনিটে কথার স্বর চেঞ্জ হয়।

দুপুরবেলা রুয়েল আর রুবেল ভাত খেতে আসলো বাসায়।
কিন্তু রুয়েল যখন বাসায় এসে শুনলো কোনো খাবার রান্না করে নি জান্নাত।আর ঊর্মি আলাদা করে শুধু নিজের টা রান্না করেছে, তখন রুয়েলের মাথা একদম গরম হয়ে গেলো।একদিকে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরেছে রুয়েল।ভেবেছিলো গোসল করে খাওয়াদাওয়া করে কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে আবার দোকানে যাবে, তা না করে কি সব ঝামেলা শুরু করেছে ঊর্মি।রুয়েল চিৎকার করতে করতে ঊর্মিকে ডাকতে লাগলো।

ভাবি!ভাবি!বের হয়ে আসেন তো একটু।

রুয়েলের চিৎকার শুনে রুবেল বের হয়ে এলো।আর বললো,কি হয়েছে?এভাবে চিৎকার করছিস কেনো?

–ভাবি কোথায়?ভাবিকে ডাকুন।কি জন্য উনি এমন করছেন আমি জিজ্ঞেস করতে চাই?

–তোর ভাবি অসুস্থ।শুয়ে আছে।যা বলার আমাকে বল।

রুয়েল সেই কথা শুনে নিজেই ঊর্মির কাছে চলে গেলো।আর বললো,আপনার সমস্যা টা কোথায়?বলবেন কি?কেনো সংসারে এরকম অশান্তির সৃষ্টি করছেন?আপনি যে আলাদা আলাদা করছেন, জানেন আলাদা হলে কি হবে?দেন আমার ভাগগুলো বের করে দেন।বিল্ডিং থেকে কত ভাড়া আসে তার হিসাব দেন।আমার গাড়ি কই, কত টাকা আসে তাড়াতাড়ি হিসাব দেন।রুয়েল একদম রেগে আগুন হয়ে গেলো।সে এক নিঃশ্বাসে কথা বলতে লাগলো।

ঊর্মি তখন অসুস্থ রোগীর মতো মিনমিনিয়ে বললো,কি হয়েছে তোর আবার?কেনো এরকম চিৎকার চেঁচামেচি করছিস?আমার শরীর ভালো নেই।যা বলার ধীরে সুস্থে বল।এতো জোরে কথা শুনলে আমার প্রবলেম হয়ে যাবে।

রুয়েল তখন বললো, দুপুরের খাবার কোথায়?তুমি বলে শুধু নিজেদের টা রান্না করেছো আমাদের খাবার কোথায়?

ঊর্মি তখন বললো, কেনো জান্নাত রান্না করে নি?

–না করে নি।আপনি নাকি বলেছেন আলাদা করে রান্না করতে।সেজন্য ও রান্না করে নি।

ঊর্মি তখন বললো, আমি তো এসব রাগ করে বলেছি।তাই বলে ও রান্না করবে না?আমি কি ওকে রান্না করতে বারণ করেছি?এই মেয়েটা যে আসলে কি চাচ্ছে সত্যি আমার মাথাতে ঢুকছে না।এই বলে ঊর্মি আস্তে আস্তে উঠে দাড়ালো।আর বললো,আমার শরীর টা ভালো নয়।সেজন্য সবার জন্য রান্না করতে পারি নি।শুধু হিয়া আর দিয়ার জন্য একটু করেছি।সেখান থেকে একটু তোর ভাই ও খেলো।
এখন আমি কি করতে পারি বল?জান্নাত যদি ভাত না রান্না করে সেটাও কি আমার দোষ?আমার সাথে তোরা এরকম শুরু করেছিস কেনো?কোনদিকে যেতে বলছিস আমাকে?

রুয়েল এখন কাকে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না।সেজন্য রুয়েল রাগ করে বাহিরে চলে গেলো।তার এসব অশান্তি ভালো লাগছে না।বিয়ে করে কই একটু শান্তি তে থাকবে উলটো অশান্তি শুরু হইছে সংসারের মধ্যে।

এদিকে রুয়েল রুম থেকে বের হতেই ঊর্মি রুবেল কে বললো,এই কু,,,বাচ্চা! কত করে বলেছি বিল্ডিং দুই টা নিজের নামে কর,বাচ্চাদের নামে কর।দরদ মাইরা যে ভাইকে দিয়েছিস,সে তো কথায় কথায় বিল্ডিং এর ভাগ চায়।এই বিল্ডিং দুইটা ভাগ হয়ে গেলে আমরা খাবো কি?চলবো কিভাবে?টাকা পাবো কোথায়?
রুবেল সেই কথা শুনে বললো, সেটাই তো ভাবছি।এ তো দেখি কথায় কথায় বিল্ডিং এর ভাগ চায়।কি করা যায় এখন?
ঊর্মি তখন মুখ ভেংচিয়ে বললো, বসে থেকে আংগুল চোস?তুই আর কি করতে পারবি?আমি এতো করে বলেছি আমাদের ভবিষ্যৎ আছে।আর রুয়েল তো বিদেশেই ছিলো।বিল্ডিং দুই টাতে আজ যদি শুধু তোমার নাম দিতে তাহলে কি কথায় কথায় বিল্ডিং এর ভাগ চাইতো?আমাদের পা ধরে বসে থাকতো সে।

রুবেল তখন বললো,এসব ভাগাভাগি তো তুমি শুরু করছো?তোমাকে কে বলেছে সংসার আলাদা করার কথা?একটা কথা ভেবেচিন্তে বলো না।রুয়েলকে যদি আলাদা করে দেই তাহলে তো ও সবকিছু ভাগ করে নেবে।তখন তো ফাঁসবো আমরাই।সেজন্য ভুল করেও আর সংসার ভাগ করার কথা বলবে না।মিলেমিশে থাকো সবাই।

–কিন্তু আমার যে অসহ্য লাগছে জান্নাতকে।আমি সহ্য করতে পারছি না ওই মেয়েকে।বাসা থেকে বের হতে পারছি না আমি।সবাই শুধু বলছে একজনের বউ স্টাইল করে ঘুরে বেড়ায় আর আরেকজনের বউ কত সুন্দর পর্দা করে চলাফেরা করে।এসব আমার ভালো লাগছে না।সেজন্য কোথাও গেলে আমাকেও বোরকা পড়তে হচ্ছে।আমার কিন্তু এসব অসহ্য লাগছে।এই বলে ঊর্মি চিৎকার দিয়ে উঠলো।

রুবেল সেই কথা শুনে বললো, আমি তো চাই নি জান্নাতকে এ বাড়িতে বউ করে আনতে।তুমিই তো বুদ্ধি দিলে।বললে,মেয়েটা সহজ সরল।আমি যেভাবে বলবো সেভাবেই চলবে।তাহলে এখন সহ্য করো জ্বালা।আমাকে খবরদার এর মধ্যে টানবে না।এই বলে রুবেল দোকানে চলে গেলো।

ঊর্মি তখন মনে মনে ভাবলো,মেয়েটাকে তো এনেছিলাম রুয়েলের মনে জায়গা করে নেওয়ার জন্য,যাতে সে ভাবে আমরা ওর জন্য খুব চিন্তা করি।ওর খুব ভালো চাই।যাতে বিদেশ যাওয়ার পরও রুয়েল আমাদেরই টাকা দেয়।কিন্তু এখন তো বিদেশ গেলোই না।উলটো বসে বসে খাচ্ছে সংসারে।কি করি এখন?কিছুই বুঝতে পারছি না।

কিছুক্ষন পর রুয়েল আবার বাসায় আসলো।আর হোটেল থেকে জান্নাত আর তার মায়ের জন্য খাবার নিয়ে আসলো।রুয়েল তার মায়ের খাবার টা রুমে দিয়ে আসলো। আর জান্নাতের খাবারটা এনে জান্নাতের হাতে দিলো।আর বললো,তাড়াতাড়ি খাবারগুলো বের করুন।আর খেয়ে নিন।
জান্নাত চুপচাপ থাকলো।কারণ তার এখন কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।আর এসব খাবারদাবার কিছুতেই এখন তার গলা দিয়ে নামবে না।

হঠাৎ হিয়া আসলো রুমে।আর বললো,চাচ্চু!চাচ্চু!তুমি কি আনলা হাতে করে?তোমার হাতে ওটা কিসের ব্যাগ দেখলাম?
–কই কি মা?
–আমি তো দেখলাম।এই বলে টেবিলের উপর রাখা বিরিয়ানির প্যাকেট টার উপর চোখ গেলো তার।আর সে সাথে সাথে চিৎকার করে বললো,বিরিয়ানি এনেছো তুমি?দাও আমাকে।

রুয়েল তখন বললো, মামুনি তুমি তো এইমাত্র ভাত খেলে।আরেকটু পরে খাও।আমি তোমার জন্য বিকেলবেলা আবার আনবো।

–না আমি এটাই নিবো।

জান্নাত তখন বললো,দিয়ে দেন না ওকে।ওরকম করছেন কেনো?

–তাহলে আপনি এখন কি খাবেন?

–লাগবে না খাওয়া।তাছাড়া আমার খেতে ইচ্ছেও করছে না এখন।

হিয়া তখন বললো, ও এগুলো চাচীমনির জন্য এনেছো?আমার জন্য আনো নি?এই বলে হিয়া রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

#চলবে,