#বাবুইপাখির অনুভূতি
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🕊️
— পর্বঃ৪০+৪১+৪২
_________________
ভেজালো শরীর নিয়ে হসপিটালের করিডোর দিয়ে আদ্রিয়ানকে নিয়ে যাচ্ছে আহিসহ আরো কিছু হসপিটালের লোকেরা। আহির চোখ বেয়ে পানি পড়ছে খুব। হুট করে কি থেকে কি হয়ে গেল ভাবতেই তাঁর কষ্ট হচ্ছে? নিলয়কে ফোন করে সব বলেছে সে। হয়তো আর কিছুক্ষনের মধ্যেই নিলয় এসে পৌঁছাবে এখানে। এমন সময় সেখান থেকে যাচ্ছিল শুভ। কারন আহি আদ্রিয়ানকে নিয়ে শুভর হসপিটালেই এসেছে।’
পেসেন্টের জায়গায় নিজের ভাইকে অচেতন অবস্থায় দেখে ভিশনভাবে অবাক হয় শুভ। সাথে বুকটাও কেঁপে উঠে তাঁর। শুভ আদ্রিয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরে হতভম্ব গলায় বলে উঠল,
‘ ভাইয়া তুমি,
বলেই আদ্রিয়ানের মাথার নিচ থেকে রক্ত বের হতে দেখে চমকে উঠে বললো সে,
‘ এসব কি করে হলো?’ ওনাকে কে নিয়ে এসেছে?’ (সামনের লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে)
শুভর কথা শুনে আহিকে দেখিয়ে বললো লোকগুলো,
‘ উনি..
উওরে শুভ পিছনে এক পলক তাকাতেই আহিকে দেখে আরো যেন অবাক। অবাক চোখেই বললো সে,
‘ তুমি। এসব কি করে হলো, ভাইয়ার কি এক্সিডেন্ট হয়ে ছিল?’
শুভর কথা শুনে আহি অবাক চোখে বলে উঠল,
‘ ভাই, উনি তোমার ভাই হয়?’
‘ হুম আমার বড় ভাই, এসব কি করে হলো?’
‘ সব পড়ে বলবো আগে আদ্রিয়ানকে দেখো,ওনাকে বাঁচাও প্লিজ আমার জন্যই আজ ওনার এমন অবস্থা হয়েছে প্লিজ ওনাকে বাঁচিয়ে তোলো।’
‘ বাঁচাতে তো আমাকে হবেই?’
বলেই আর দেরি না করে আদ্রিয়ানকে নিয়ে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে চলে যায় শুভ। আদ্রিয়ানের ক্যান্ডিশন খুবই ক্রিটিকাল। মাথা দিয়ে অনেকখানি ব্লাড বের হয়ে গেছে। যার কারণে অবস্থা সত্যি খারাপ।’
এমন সময় আহির সামনে একজন নার্স এসে বললো,
‘ ম্যাম, আপনাকে আমার সাথে যেতে হবে পেসেন্টের ভর্তির কিছু নিয়ম আছে যেগুলো আপনাকে পূরণ করতে হবে?’
উওরে আহিও বেশি কিছু না ভেবে তাড়াতাড়ি চলে গেল নার্সটির সাথে।’
কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আনুমানিক নাম, বয়স সবকিছুই বললো আহি সামনের একজন মেয়েকে। হঠাৎই মেয়েটি বলে উঠল,
‘ আপনি পেসেন্টের কি হন?’
মেয়েটির কথা শুনে আহি কি বলবে বুঝতে পারছে না। আহিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবারো বলে উঠল মেয়েটি,
‘ কি হলো কথা বলছেন না পেসেন্টর কি হন আপনি?’
‘ জ্বী আমি ওনার বন্ধু,
এরই মধ্যে সেখানে একপ্রকার দৌড়ে এসে হাজির হলো নিলয়। আহিকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দৌড়ে এসে হতভম্ব হয়ে বললো সে,
‘ আদ্রিয়ান কোথায় আহি?’
‘ ওনাকে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে নেওয়া হয়েছে শুভ দেখছে ওনাকে।’
উওরে নিলয় আর কিছু না বলেই চললো সামনে। আর আহিও ফরমটা নিয়ে চলে যায় নিলয়ের পিছু পিছু।’
_____
চিন্তিত মাখা মুখ নিয়ে বসে আছে আহি। আর তাঁর সামনেই পায়চারি করছে নিলয়। টেনশনে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তাঁদের। বেশ অনেকক্ষণই হয়ে গেছে শুভ আদ্রিয়ানকে নিয়ে ইমারজেন্সির ওয়ার্ডের ভিতরে আছে। কি হবে না হবে ঠিক বুঝতে পারছে না আহি। বার বার নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে নিজেকে। আজ আদ্রিয়ানের কিছু হয়ে গেলে আহি কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। এমন সময় আহির ফোনটা বেজে উঠল উপরে রিনির নাম্বার দেখে ফোনটা তুলেই কান্না ভেঁজা কন্ঠ নিয়ে বললো,
‘ রিনি?’
সাধারণত রিনি এই সময় ফোন করেছিল তাঁর আর শুভর ভালোবাসার কথাটা বলার জন্য কিন্তু আহির এমন কান্নার স্বর শুনে চিন্তিত মাখা মুখ নিয়ে বললো সে,
‘ কি হয়েছে তুই কাঁদছিস কেন?’
উওরে আহি কাঁদতে কাঁদতেই আদ্রিয়ান আর তাঁর সাথে হয়ে যাওয়া ঘটনা খুলে বললো রিনিকে। রিনি তো চরম অবাক আহির কথা শুনে। অবাক হয়েই বললো রিনি,
‘ তুই কাঁদিস না আমি এক্ষুনি আসছি?’
উওরে আহি আর কিছু না বলে ফোন কেটে দেয়। এরই মাঝে ইমারজেন্সি ওয়ার্ড থেকে বের হয় শুভ। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ, আহি শুভকে দেখেই দৌড়ে চলে যায় তাঁর কাছে তারপর বলে,
‘ কেমন আছে উনি?’
উওরে শুভ মাথা নিচু করে বলে,
‘ মাথা থেকে প্রচুর রক্ত বের হয়েছে যার কারনে রক্ত শূন্যতা দেখা দিয়েছে। ইমারজেন্সি রক্ত লাগবে?’
শুভর কথা শুনে নিলয় বলে উঠল,
‘ তাহলে রক্ত দিচ্ছো না কেন?’
‘ ভাইয়ার জন্য (A+) পজিটিভ রক্ত লাগবে যেটা বর্তমানে আমাদের কাছে নেই। আরো কিছু জায়গায় খোজ করা হয়েছে রক্তের কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না বর্তমানে। আর ২ ঘন্টার মধ্যে রক্ত না পেলে ভাইয়াকে বাঁচানো খুবই টাফ।’
শুভর কথা শুনে আহির বুকটা যেন দক করে উঠলো এখন কি করবে সে। তাঁর নিজের ব্লাড গ্রুপও এ+ পজিটিভ নয়। ভীষণভাবে কান্না পাচ্ছে তাঁর। অন্যদিকে নিলয় সেও ব্যর্থ তাঁর ব্লাড গ্রুপও এ+ পজিটিভ নয়। নিলয় নিরাশ হয়ে বললো,
‘ আমি দেখছি খুঁজে তুইও দেখ?’
বলেই ফোনটা বের করে কল করলো নিলয়। আর শুভ সেও উল্টোদিকে হেঁটে চললো রক্তের খোঁজে। শুভর চোখ ছলছল করছে ভাইয়াটার কিছু হয়ে গেলে সে কি নিয়ে বাঁচবে সে তো একেবারেই অনাথ হয়ে যাবে। ভাবলেই কেমন একটা লাগছে শুভর। বেশি না ভেবে দ্রুত রক্তের খোঁজে এগিয়ে গেল সে।’
আর অন্যদিকে আহি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে পড়লো সামনের চেয়ারে। কি করবে না করবে কিছুতেই মাথায় আসছে না তাঁর। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলো রিনি আহিকে এভাবে বসে থাকতে দেখে দৌড়ে গিয়ে বললো সে,
‘ আহি, কেমন আছে আদ্রিয়ান ভাইয়া?’
উওরে ছলছল চোখে রিনির দিকে তাকিয়ে বললো আহি,
‘ ভালো না, শুভ বলেছে ইমারজেন্সি (এ+) পজিটিভ রক্ত লাগবে। কিন্তু কোথাও এই রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। আর ২ ঘন্টার মধ্যে রক্ত না দিলে আদ্রিয়ানকে নাকি বাঁচানো যাবে না। ওনার কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না রিনি। আমার নিজের ব্লাড গ্রুপও (এ+) পজিটিভ নয়। তোর কি গ্রুপ?’
‘ (Ab+)
হতাশ আহি। আহির চেহারা দেখে বলে উঠল রিনি,
‘ চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।’
উওরে আহি কিছু বললো না। হঠাৎই রিনি বলে উঠল,
‘ এ নীরব ভাইয়ার রক্তের গ্রুপও তো (এ+),
রিনির কথা শুনে আহিও বলে উঠল,
‘ হুম তাই তো আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।তাড়াতাড়ি ফোন কর।’
‘ কিন্তু ভাইয়া কি আসছে ঢাকায়?’
‘ সিওর জানি না সকালেই মার সাথে আন্টিকে বলতে শুনেছিলাম আজকে নাকি আসবে।’
‘ দাঁড়া ফোন করে দেখছি?’
বলেই ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে নীরবের নাম্বারে কল করলো সে।’
___
ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় রাত বারোটা ছাড়িয়ে গেছে। পুরো শহরটাই অন্ধকারে ঘেরা। যদিও বাহিরে ল্যামপোস্ট থাকায় অনেকটাই আলোকিত বাহিরটা। বৃষ্টির শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ আগেই, কিন্তু আকাশটা এখনো মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে। চারপাশ বেয়ে হাল্কা বাতাস বইছে। এসবের মাঝেই মন খারাপ করে পড়ার টেবিলের সামনে চুপচাপ বসে আছে নীরব। মনটা আজ বড্ড বেশিই খারাপ তাঁর। অথৈর কাছ থেকে ফিরে আসার পর থেকেই কিছু ভালো লাগছে না নীরবের। কেমন যেন সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সাথে বুকের ভিতরও শূন্যতা কাজ করছে। এমন সময় নীরবের ভাবনাগুলোর মাঝেই তাঁর ফোনটা বেজে উঠল। উপরেই রিনির নাম্বার দেখে অবাক হয় সে। এত রাতে রিনি ফোন করেছে ভেবেই চটজলদি ফোনটা তুললো সে। পরক্ষণেই রিনির সব কথা শুনে সেও আর বেশি না ভেবে বলে উঠল,
‘ আসছি আমি কোন হসপিটালে?’
””
পাশাপাশি কিছুটা দুরত্ব রেখে দুই বেডে শুয়ে আছে নীরব আর আদ্রিয়ান। এই মুহূর্তে নীরবের শরীর থেকে সরাসরি আদ্রিয়ানের শরীরে রক্ত দেওয়া হচ্ছে। কয়েক মুহূর্তে আগেই নীরব এসেছে এখানে। নীরবকে পেয়ে প্রায় সবাই একটু চিন্তিত মুক্ত। নীরবকে আজ ঠিক টাইমে না পেলে যে কি হতো কে জানে?’
কয়েক ঘন্টা পর,,
ইমারজেন্সি ওয়ার্ড থেকে বের হলো নীরব। নীরবকে দেখেই এগিয়ে গেল আহি রিনিসহ সবাই। আহি কৃতজ্ঞতার স্বরে বললো,
‘ তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া। তুমি সময় মতো না আসলে না জানি কি হতো?’
‘ হয়েছে আর কিছু বলতে হবে না।’
এরই মাঝে শুভ নীরবের হাত ধরে বললো,
‘ আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনি ঠিক টাইমে না আসলে হয়তো আমার ভাইয়াকে,, বলতে গিয়েও বলতে পারলো না শুভ। শুভর কথা শুনে নীরব নিজেও শুভর হাত ধরে বলে,
‘ ইট’স ওকে আর তাছাড়া আমি তেমন কিছুই করিনি যা করার সব তুমিই করেছো আমি জাস্ট একটুখানি রক্ত দিয়েছি।’
‘ এটাই তো অনেক আমি সারাজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।’
এরই মাঝে একজন নার্স এসে বললো শুভকে,
‘ স্যার পেসেন্টকে কি ঘুমের ঔষধ পুস করে দিবো।’
উওরে শুভ কিছু না বলে চলে যায় ভিতরে তারপর আদ্রিয়ানকে দেখে সে নিজেই ইনজেকশন পুস করে দেয়। আপাতত আদ্রিয়ান বিপদ মুক্ত ভেবেই সস্থির নিশ্বাস ফেললো সে।’
____
করিডোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আহি। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যতদিন না আদ্রিয়ান সুস্থ হবে ততদিন সে নিজেই আদ্রিয়ানের সেবাযত্ন করবে। এতে যদি তার নিজেকে অপরাধী মনে করার ভাবটা একটু কমে। আহি ভেবে নিয়েছে কিছুদিনের ছুটি নিবে সে হসপিটাল থেকে। কিন্তু ফেমেলিকে কি বলবে সে?’
এমন সময় তাঁর কাঁধে হাত রাখলো রিনি। হঠাৎই কিছু একটা ভেবে বলে উঠল আহি,
‘ তোর একটু হেল্প লাগবে রিনি?’
হুট করে আহির মুখে এমন কথা শুনে বেশ অবাক হয়েই বললো রিনি,
‘ মানে?’
!
!
!
!
!
#চলবে…..
#বাবুইপাখির_অনুভূতি🕊️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🕊️
— পর্বঃ৪১
_________________
হসপিটালে কিছু নার্সদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিলয়। এর একমাত্র কারন হলো আদ্রিয়ানকে দেখাশোনা করার দায়িত্ব নেবে এঁরা। আদ্রিয়ানকে বাড়িতে নেওয়ার পরও তাঁর সাথে একজন নার্সকে নেওয়া হবে এমনই এক এগ্রিমেন্ট করতে চাইছে নিলয়। এমন সময় আহি এসে হাজির হলো নিলয়ের সামনে কিছুটা নীরব কন্ঠেই বললো সে,
‘ নিলয় ভাইয়া আমার আপনার সাথে কিছু কথা আছে?’
হুট করে কথার মাঝখানে আহির কন্ঠ শুনে বলে উঠল নিলয়,
‘ কিছুক্ষন অপেক্ষা করো আহি ওনাদের সাথে কথা বলেই আসছি আমি।’
‘ কথাটা আর্জেন্ট ভাইয়া আর আমার কথা শোনার পর হয়তো এনাদের প্রয়োজন হবে না আপনার।’
আহির এবারের কথা শুনে নিলয় বেশ অবাক হয়ে নার্সগুলোকে যেতে বলে আহির সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ মানে?’
‘ মানে এটাই আদ্রিয়ানকে দেখার জন্য কোনো নার্সকে লাগবে না ভাইয়া।’
‘ তোমার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না আহি?’
‘ আমি এটাই বলতে চাইছি যতদিন না আদ্রিয়ান পুরোপুরি সুস্থ হয় ততদিন ওনার সেবাযত্ন করার সব দায়িত্ব আমি নিবো ভাইয়া।’
‘ কিন্তু আহি?’
‘ কোনো কিন্তু নয়, আজ যা হয়েছে তার সম্পন্নটাই আমার জন্য, তাই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যতদিন না উনি সুস্থ হন ততদিন ওনার সব দায়িত্ব আমি নিবো ভাইয়া। প্লিজ মানা করবেন না।’
আহির কথা শুনে নিলয় কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে উঠল,
‘ ঠিক আছে আহি তুমি যা বলছো তাই হবে।’
‘ ধন্যবাদ ভাইয়া।’
উওরে নিলয় আর কিছু না বলে চলে যায় অন্যদিকে। আর আহি সেও বেশি কিছু না ভেবে বসে পড়ে আদ্রিয়ানের রুমের বাহিরে থাকা একটা চেয়ারে। আজ আর সে বাড়ি ফিরবে না একসাথে কাল সকালে যাবে। নীরব আর রিনি চলে গেছে অনেকক্ষণ আগেই যাওয়ার আগে তাঁর জন্য এক সুট জামাকাপড় দিয়ে গেছে রিনি যেটা আহি অনেক আগেই পড়ে নিয়েছে। আহি নীরবকে বলে দিয়েছে আজকে রাতটা যেন বাবা মাকে কিছু একটা বলে ম্যানেজ করে নেয়। নীরবও ঠিক আছে বলে চলে যায়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেল ভাবতেই বার বার চোখ ভেসে আসছে আহির।’
_____
সকাল_৭ঃ০০টা…
আচমকাই ঘুম ভেঙে যায় আহির। পরক্ষণেই সে কোথায় আছে সেটা ভাবতেই চটজলদি বসা থেকে উঠে বসে সে। সামনের আদ্রিয়ানের রুম, আর কিছুক্ষনের মধ্যেই হয়তো আদ্রিয়ানকে কেভিনে শিফট করা হবে। আহি বেশি কিছু না ভেবে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো তারপর তাকালো সামনে কাঁচের দরজাটা দিয়ে ভিতরে।’
চুপচাপ শুয়ে আছে আদ্রিয়ান। আর তাঁর পাশেই চুপচাপ বসে আছে শুভ। চোখ ছলছল করছে তাঁর,বহুবছর পর আজ প্রথম শুভ আদ্রিয়ানের এত কাছাকাছি বসে আছে আর আদ্রিয়ান কিছু বলছে না তাঁকে। শুভর চোখ ছলছল করছে কাল যদি নীরব ঠিক টাইমে না আসতো তাহলে কি হতো এটা ভেবে এখনো তাঁর খারাপ লাগছে। শুভ আস্তে আস্তে আদ্রিয়ানের হাত স্পর্শ করলো তারপর বললো,
‘ কাল যদি তুমি আমায় ছেড়ে চলে যেতে ভাইয়া তাহলে আমার কি হতো বলো? আমি তো একদমই এতিম হয়ে যেতাম। তুমি জানো না ভাইয়া আমি কাল কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাইয়া তুমি কি আমায় কোনোদিনও ক্ষমা করবে না। আমি তোমায় জড়িয়ে ধরতে চাই, আমিও তোমার সাথে থাকতে চাই। আমার একা একা ওই বড় বাড়িতে আর ভালো লাগে না। কবে তুমি বুঝবে আমায় আর ক্ষমা করবে ভাইয়া।’
এইরকম হাজারো কথা বলছে শুভ আদ্রিয়ানকে। তাঁর মনে যত কথা আছে সবই বলছে সে। যদিও সে জানে তাঁর কোনো কথাই আদ্রিয়ানের কানে পৌঁছাবে না এখন। আদ্রিয়ানের ঘুম ভাঙতে এখনও ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। শুভ ভেবে নিয়েছে আদ্রিয়ানের ঘুম ভাঙার আগেই সে চলে যাবে। কে জানে হয়তো তাকে দেখে আবারো রেগে যাবে আদ্রিয়ান?’
অন্যদিকে আহি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল শুভ আর আদ্রিয়ানকে। যদিও শুভর কথাগুলো তাঁর কান অবদি আসে নি। তবে আহি বুঝতে পেরেছে আদ্রিয়ান আর শুভর মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। কারন আজ শুভর কথা না শুনলেও সেদিন কবর স্থানে বসে আদ্রিয়ানের কথা শুনেছিল সে। আহি ছোট্ট শ্বাস ফেলে হাঁটা শুরু করলো উল্টোদিক দিয়ে। তাকে এখন যেতে হবে কিছু কাজ আছে সেগুলো সেরে আবার আসবে সে। নিলয়কে বলা আছে তাই আপাতত কাউকে কিছু না বলেই হসপিটাল থেকে বের হবে আহি।’
____
কলিং বেল বাজতেই আহির মা এসে দরজা খুললো সামনেই আহিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো সে,
‘ তুই এসেছিস?’
মায়ের কথা শুনে আহিও ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠল,
‘ হুম মা।’
‘ কাল নীরব বললো তুই নাকি হসপিটালে কোনো কারনে আঁটকে পড়ায় বাড়ি আসতে পারবি না।’
‘ হুম একটু জরুরি ছিল তাই আসতে পারি নি আমি ফোন করে বলতাম কিন্তু হসপিটালে নীরব ভাইয়ার সাথে দেখা হয়ে যাওয়ায় ওনাকেই বলে দিয়েছিলাম।’
‘ যাক নাস্তা করবি তো, তোর ফেবারিট রুটি আর আলুভাজি করেছি?’
‘ হুম করবো তুমি টেবিলে খাবার বারো আমি আসছি, বাবা কি ঘুমাচ্ছে?’
‘ না উনি তো চারদিনের জন্য তোর নানু বাড়ি গেছে?’
মায়ের কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
‘ কেন?’
‘ কি নাকি কাজ আছে।’
‘ ওহ।’
এতটুকু বলে চলে যায় আহি। মনে মনে বাবা না থাকাতে তাঁর খুব ভালো হয়েছে।’
আধ ঘন্টা পর,
নিজেকে ফ্রেশ করে ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো আহি। ততক্ষণে তাঁর মা খাবার বেরে রেখে বসে আছে টেবিলের সামনে। আহি বেশি কিছু না ভেবে বসলো মায়ের পাশে থাকা চেয়ারে তারপর এক টুকরো রুটি মুখে দিতে দিতে বলে উঠল,
‘ মা আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে?’
‘ হুম বল।’
‘ মা আমি এক সপ্তাহ বা তাঁর বেশি কিছুদিন বাড়িতে আসতে পারবো না।’
আহির কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে বললো আহির মা,
‘ কেন?’
‘ আমি একজন পেসেন্টকে দেখা শোনা করার দায়িত্ব নিয়েছি। আর তাঁর জন্য,
‘ আমি তোর কথা কিছু বুঝতে পারছি না আহি?’
মায়ের কথা শুনে, আহি ভেবেছিল বানিয়ে কিছু মিথ্যে কথা বলবে কিন্তু এখন ভাবছে না সত্যি কথাই বলবে সে। আহি তাঁর খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে অপরাধী কন্ঠে বলে উঠল,
‘ মা, তুমি আগে কথা দেও আমার সব কথা শোনার পর তুমি রাগ করবে না আর আমি যা করতে চাইছি তাতেও বারন করতে পারবে না।’
আহির কথা শুনে আহির মার যেন কেমন লাগলো মেয়েটাকে আজকে একদমই অন্যরকম লাগছে। আহির মা আহির দিকে তাকিয়ে বললো,,
‘ কিছু কি হয়েছে আহি?’
উওরে আহি নীরব কন্ঠে এঁকে এঁকে কাল রাতে হয়ে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বললো তাঁর মাকে। আহির মা তো সব শুনে অবাক হয়ে বললো,
‘ তাঁর মানে কাল রাতে নীরব আমায় মিথ্যে কথা বলেছে?’
‘ নীরব ভাইয়ার কোনো দোষ নেই মা আমি ওনাকে মিথ্যে বলতে বলেছিলাম।’
আহির কথা শুনে কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে উঠল আহির মা,
‘ এখন কেমন আছে ছেলেটি?’
‘ জ্ঞান ফেরেনি এখনো তবে ডাক্তার বলেছে খুব তাড়াতাড়ি ঠিক যাবে। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি মা আদ্রিয়ান যতদিন না সুস্থ হয়ে ওঠে ততদিন ওনার সব দায়িত্ব আমি নিবো। তুমি প্লিজ বারন করবে না কাল থেকে আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। আমার জন্যই আজ ওনার এই অবস্থা।’
উওরে আহির মা কি বলবে বুঝতে পারছে না। মাকে চুপ থাকতে দেখে আহি তাঁর মায়ের হাত ধরে বললো,
‘ আমার জন্যই সব হয়েছে মা, কাল আদ্রিয়ান না থাকলে হয়তো তুমি তোমার মেয়েকে আর পেতে না।’
এতটুকু বলে আহি পুরো খাবার শেষ না করেই চলে যায় তাঁর রুমের দিকে। কিছু জামাকাপড় নিবে সে।’
____
রুমে ঢুকতেই তাঁর কাছে চলে আসলো তাঁর পিচ্চি খরগোশ ছানাটা। আহি খরগোশ ছানাটাকে কোলে নিয়ে বললো,
‘ শোন সবসময় ভালো মতো থাকবি, মায়ের কথা শুনবি আর একদম দুষ্টমি করবি না আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো।’
এতটুকু বলে খরগোশটাকে একটা চুমু দিয়ে বসিয়ে দেয় খাটের ওপর। তারপর আলমারি থেকে অল্প কয়েকটা জামা নিয়ে বেরিয়ে যায় সে রুম থেকে।’
আহিকে যেতে দেখে আহির মা চলে যায় আহির কাছে তারপর কাঁধে হাত দিয়ে বলে,
‘ আহি,
হুট করেই মায়ের কথা শুনে আহি দাঁড়িয়ে পড়ে তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ হুম বলো মা।’
উওরে আহির মা হেঁসে বলে উঠল,
‘ আদ্রিয়ান সুস্থ হয়ে গেলে এখানে নিয়ে আসিস আমি নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবো।’
আহির মায়ের কথা শুনে মুহূর্তের মধ্যে হাসি ফুটে উঠলো আহির। সে তাঁর মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
‘ ঠিক আনবো মা, থ্যাংক ইউ মা।’
‘ চিন্তা করিস না তোর বাবাকে আমি ম্যানেজ করে নিবো।’
উওরে আহি খুশি হয়ে আরো একবার ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। এখান থেকে সোজা নিজে যে হসপিটালে কাজ করে সেখানে যাবে আহি তারপর কিছুদিনের ছুটি চেয়ে সোজা আদ্রিয়ানের কাছে যাবে সে। এসব ভাবতে ভাবতেই চললো আহি।’
অন্যদিকে নিজের রুমের বেলকনি থেকে আহিকে যেতে দেখে নীরব বেশ বুঝতে পেরেছে আহি কোথায় যাচ্ছে?’ তবে বেশি ভাবলো না সে। আহি যেটা করছে সেটা মটেও রং কাজ নয়।’
____
রৌদ্রময়ী দুপুর। জানালার কার্নিশ বেয়ে আসছে রূপালী রোদ্দুর সাথে রোদ্দুরে মাখা মিষ্টি বাতাস। বাতাসে জানালার পাশে থাকা রঙিন পর্দাটা উঠছে বারংবার। আর এসবের মাঝেই টেবিলের উপর বসে আছে অথৈ। আজ সকালেই কাকিমার বাড়ি থেকে ফিরেছে তাঁরা। মনটা খুবই খারাপ অথৈর। নীরবকে সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। চোখের চশমাটাও পড়ে আছে টেবিলের উপর। বইগুলো সব এলেমেলো হয়ে আছে টেবিলে। হঠাৎই অথৈর চোখ যায় তাঁর সেই লাল ডাইরিটার দিকে, যে ডাইরিতে সে তাঁর অনুভূতিগুলো লিখেছিল। অথৈ বেশি কিছু না তাঁর চোখে চশমাটা লাগিয়ে হাত দিলো আবারো সেই ডাইরিতে। শুরু থেকেই এঁকে এঁকে সব দৃশ্য আর অনুভূতিগুলো দেখতে লাগলো সে। সেই প্রথম নীরবের সাথে তাঁর দেখা। সাইকেলে করে আসা সেই চশমা পড়া ছেলেটা, একসাথে মাছ ধরা, আম গাছের নিচ থেকে হাত ধরে দৌড়ানো, এঁকে এঁকে সব ছবিগুলোতে চোখ বুলিয়ে চলে যায় অথৈ একটা সাদা পৃষ্ঠার কাছে। তারপর হাতে কলম নিয়ে কিছু লিখতে থাকে সে, আজ আর নিজের অনুভূতি লিখবে না অথৈ।লিখবে তাঁর অনুভূতি ভেঙে যাওয়ার গল্প। এঁকে এঁকে নীরবকে না বলা সব কথা লিখছে অথৈ, আজকের এই গল্পে শুধু সে আর নীরবই থাকবে না সাথে থাকবে একজন প্রান প্রিয় বান্ধবীর কথাও।’
ছোট্ট দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মনের সব কথাগুলো ডাইরির পৃষ্ঠায় লিখছে অথৈই। সব শেষে লেখার একদম লাস্ট পৃষ্ঠায় এসে তাঁর চোখ বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো ডাইরির পাতায়।
খুব কষ্ট হচ্ছে অথৈর। মনে মনে ভাবলো সে ‘গল্পটা এমন না হলেও তো পারতো’।
এমন সময় তাঁর ভাবনার মাঝে ডাক পড়লো অথৈর, তাড়াতাড়ি নিজেকে স্বাভাবিক করে ডাইরিটা বন্ধ করে টেবিলের উপর রেখেই বেরিয়ে যায় সে রুম থেকে। আর আবারো টেবিলের কর্নার জুড়ে লেপ্টে থাকে অথৈর সেই লাল ডাইরিটা। আজ আর সেটা উড়ছে না বাতাসে, হয়তো অথৈর অগোছালো লেখাতেই নিস্তব্ধ সে।’
____
রাত_৮ঃ০০টা….
আদ্রিয়ানকে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে আহি। আর আদ্রিয়ানও চুপচাপ আহির দিকে তাকিয়ে চুপচাপ খাচ্ছে। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। সকালেই আদ্রিয়ানের জ্ঞান ফিরে। জ্ঞান ফিরে সবার আগে আহিকেই দেখে সে। আর তখন নিলয়ই বলে আহিই তাঁর যত্ন নিবে যতদিন না সে সুস্থ হয়। উওরে আদ্রিয়ান তখন কিছু না বললেও মনে মনে ভীষণ খুশি হয়। হঠাৎই আদ্রিয়ান কাশতে শুরু করে আদ্রিয়ানকে কাশতে দেখে আহিও চটজলদি টেবিলের উপর থাকা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে পানি খাইয়ে আদ্রিয়ানকে। আদ্রিয়ানও বেশি কিছু না ভেবে শুধু পানি খেতে খেতে তাকিয়ে থাকে আহির মুখের দিকে।’
অতঃপর আহি আদ্রিয়ানকে খাবার খাইয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে দিয়ে বলে,
‘ এখন আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।’
আদ্রিয়ানও চুপচাপ শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। কারন তাঁর মাথা যন্ত্রনা করছে।’
এরই মধ্যে রুমে ঢুকলো নিলয়। আহিকে দেখেই বলে উঠল সে,
‘ আহি শোনো?’
নিলয়ের কথা শুনে আহিও বেশি কিছু না ভেবে এগিয়ে আসে নিলয়ের দিকে তারপর বলে,
‘ জ্বী বলুন?’
উওরে নিলয় এক পলক আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে আস্তে বলে উঠল,
‘ তোমার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে আহি?’
‘ হুম বলুন?’
‘ এখানে নয় বাহিরে চলো।’
নিলয়ের এভাবে ফিসফিস করে কথা বলা শুনে বেশ অবাক হয়েই বললো আহি,
‘ ঠিক আছে চলুন।’
উওরে নিলয় আর কিছু না বলে চটজলদি বেরিয়ে আসে আদ্রিয়ানের ক্যাভিন থেকে। আহিও যাওয়ার আগে একবার আদ্রিয়ানের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে চলে যায় নিলয়ের পিছন পিছন,,
!
!
!
!
!
#চলবে…..
#বাবুইপাখির_অনুভূতি🕊️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🕊️
— পর্বঃ৪২
_________________
বেশ আগ্রহ নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে আহি নিলয়ের সামনে। কিন্তু নিলয় এখনও কিছু বলছে না তাঁকে। নিলয়কে চুপ থাকতে দেখে বলে উঠল আহি,
‘ কি হলো ভাইয়া চুপ করে আছেন যে কি বলবেন আমায়?’
উওরে নিলয় বেশি কিছু না ভেবে বলে উঠল আহিকে,
‘ আহি তুমি যেহেতু রাতে আদ্রিয়ানের কাছে থাকবে আইথিংক তোমার ওর ব্যাপারে কিছু সিক্রেট জিনিস জানা উচিত।’
নিলয়ের কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে বললো আহি,
‘ মানে?’
‘ আদ্রিয়ানের একটা দুর্বল বিষয় আছে?’
‘ আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না আমি?’
‘ বলছি তোমায়,
তখন আদ্রিয়ান খুব ছোট। এতটুকু বলেই আদ্রিয়ান সাথে হয়ে যাওয়া সেই সব ঘটনাগুলোর কথা বললো নিলয়। আদ্রিয়ানের রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া, তাকে কিডন্যাপ করা, হাত পা বেঁধে রাখা, কুকুরের ডাক, রক্তের ছাপ আর সব শেষে আহির আদ্রিয়ানকে সাহায্য করা। আহি তো সব শুনে চরম অবাক। সে তো বিশ্বাসই করতে পারছে না ছোট বেলায় সে যে ছেলেটাকে বাঁচিয়ে ছিল সে আদ্রিয়ান ছিল। আসলেই জীবনটা যেন একটা গোলাকার বৃত্ত। নিলয় আহিকে সব ঘটনা খুলে বলে উঠল,
‘ আর সেদিনের সেই ভয়টা এখনও আদ্রিয়ানের যায় নি আহি, আর সেই ভয়টাই রোজ রাতে আদ্রিয়ানকে তাড়া করে। এমন অনেক সময় গেছে আদ্রিয়ান রাতে না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে আর যেদিন ঘুমিয়েছে তাও ঘুমের ঔষধ খেয়ে। যেহেতু তুমি আদ্রিয়ানের কাছাকাছি থাকবে কিছুদিন তাই আমার মনে হলো এই জিনিসগুলো তোমার জানা উচিত।’
নিলয়ের সব কথা শুনে আহির মনে পড়লো শ্রীমঙ্গলের সেই ঝড় বৃষ্টিতে কাটানো রাতের কথা। যে রাতে সে থেকে ছিল আদ্রিয়ান সাথে আর হুট করেই আদ্রিয়ান ঘুমের ঘোরে কিছু একটা নিয়ে ভয় পেয়েছিল খুব। সেদিন রাতে এই বিষয়টা নিয়ে ওতটা না ভাবলেও এখন যে সত্যি অবাক লাগছে আহির। সাথে খারাপও কারন ভয়টা তো আদ্রিয়ান আহির কুকুরের জন্যই পেয়েছিল। ছোট্ট দীর্ঘ শ্বাস ফেললো আহি। তারপর বললো,
‘ বুঝতে পেরেছি ভাইয়া,কিন্তু ওনার এই সমস্যার কোনো ট্রিটমেন্ট করেন নি কেন?
‘ ট্রিটমেন্ট করেনি বললে ভুল হবে আহি, অনেক কিছুই করেছি কিন্তু কোনো কিছুতেই এর সমাধান মেলে নি কারন এটা আদ্রিয়ান কোনো শারীরিক সমস্যা নয় যে ঔষধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে এটা হলো ওর ভয়। ছোট বেলার ভয় দেখে এটা আরো বেশি আঁকড়ে আছে আদ্রিয়ানকে। তাই কিছুতেই কিছু হচ্ছে না তবে?’
নিলয়ের কথা শুনে বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো আহি,
‘ তবে কি ভাইয়া?’
‘ একটা জিনিস বলবো তোমায়?’
‘ হুম বলুন ভাইয়া।’
‘ আদ্রিয়ানের এই সমস্যা সমাধান যদি কেউ করতে পারে তাহলে সেটা হলে তুমি?’
নিলয়ের এবারের কথা শুনে আহি অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছে গিয়ে বললো,
‘ আমি মানে?’
‘ সবই বলছি তোমায়?’
এতটুকু বলে আহিকে জড়িয়ে ধরার বিষয়টাও বললো নিলয় আহিকে। নিলয়ের কথা শুনে আহি কি বলবে বুঝতে পারছে না। আহিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো নিলয়,
‘ আমি জানি আহি তোমার মনে কি চলছে এখন, অবাক করার বিষয় কি জানো আদ্রিয়ান তোমায় ভালোবাসে আহি। আমি তো কখনো ভাবতেই পারি নি আদ্রিয়ান কাউকে ভালোবাসবে। আমি এটাও জানি আহি তুমি নীরবকে ভালোবাসতে। কিন্তু নীরব অন্যকাউকে। আপাতত তোমায় এতটুকুই বলবো তুমি চাইলেই আদ্রিয়ানের সমস্যার সমাধান করতে পারবে। আবার এমনও হতে পারে তুমিও একটা সময় আদ্রিয়ানকে ভালোবেসে ফেলবে।’
নিলয় আরো কিছু বলবে তাঁর আগেই নিলয়ের ফোনটা বেজে উঠল উপরে অফিস থেকে ফোন আসায় আহির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ অফিস থেকে ফোন আসছে আহি আমাকে এখন যেতে হবে পড়ে আবার আসবো। এমনিতে রাতে কোনো প্রবলেম হলে আমায় ফোন করো ঠিক আছে। আর সবশেষে বলবো,
‘ জীবনে যা হয়ে গেছে সব ভুলে যাও আহি, সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করো। দেখবে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
এতটুকু বলে ফোনটা তুলে ‘হ্যালো’ বলে বেরিয়ে যায় নিলয়। আর আহি জাস্ট অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে নিলয়ের যাওয়ার পানে। সবকিছুই কেমন যেন অগোছালো লাগছে আহির। আহি আনমনেই এগিয়ে চললো আদ্রিয়ানের কেভিনের দিকে।’
সাদা বেড সিটে বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে আদ্রিয়ান। মাথায় ব্যান্ডেজ করা তার। আহি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল আদ্রিয়ানের দিকে। তারপর বসলো আদ্রিয়ানের বেডের পাশ দিয়ে থাকা একটা চেয়ারে। তারপর তাকালো সে আদ্রিয়ানের মুখের দিকে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না ছোট বেলায় সে যে ছেলেটাকে বাঁচিয়ে ছিল সেই আদ্রিয়ান। আহি আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
‘ জীবনটা খুব গোল বলুুন, সেই কবে কোন ছেলেকে বাঁচিয়ে ছিলাম,তাঁর সাথে এইভাবে দেখা হবে আমার এটা তো কখনো ভাবিই নি আমি। সত্যি আজব লাগছে বিষয়টা।’
রাত বারোটা ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগে এখন প্রায় একটার কাছাকাছি। পুরো হসপিটালের সব কেভিনগুলোই প্রায় স্তব্ধ। আশেপাশের লোকজনগুলো প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে এখন। হসপিটালের আনাচে-কানাচেতে টুকিটাকি মানুষের আনাগোনা তখন। ক্যাভিন নাম্বার ৫০৪, আদ্রিয়ানের বেডের ওপর মাথা দিয়ে নিশ্চুপে ঘুমিয়ে আছে আহি। অনেকক্ষণ আগেই একা একা বকবক করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। আহির পাশেই কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে আদ্রিয়ান। আজ আবারো তাঁকে আঁকড়ে ধরলো তাঁর সেই দুঃস্বপ্ন, ভাঙাচোরা বাড়ি, রক্তের ছাপ, কুকুরের ডাক, দৌড়ে আসা সেই মেয়েটি, তাঁকে জড়িয়ে ধরার মুহূর্ত, বাবা মায়ের নিথর দেহ, সবকিছুই ভেসে আসতে লাগলো আদ্রিয়ানের চোখের সামনে। ভয়ে বুক কেঁপে উঠল তাঁর। মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করছে আদ্রিয়ান, ঘেমে একাকার হয়ে গেছে সে। হুট করেই চোখ খুলে উঠে বসলো আদ্রিয়ান। আচমকা কিছু একটা অনুভব হতেই চোখ খুলে তাকালো আহি। সামনেই আদ্রিয়ানকে বসে থাকতে দেখে কিছুটা চমকে উঠে বললো সে,
‘ কি হলো আপনার?’
উওরে আদ্রিয়ান চুপ। ঘেমে একাকার হয়ে গেছে সে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে আদ্রিয়ানের। আদ্রিয়ান তাঁর মাথাটাকে ধরে চুপচাপ বসে রইলো কিছুক্ষন। আদ্রিয়ানের কান্ড দেখে আহি বেশ বুঝতে পেরেছে নিশ্চয়ই আদ্রিয়ান আবার কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছে। আহি কিছু একটা ভেবে সামনের টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে এগিয়ে দিল আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ানও অল্প একটু পানি খেল তবে কিছু বললো না। আজ রাতে আর সে ঘুমাতে পারবে না এটা বেশ বুঝতে পেরেছে আদ্রিয়ান। আহি আদ্রিয়ানকে ধরে বিছানায় শুয়ে দিলো তারপর ওর পাশে বসে বললো,
‘ এত ভয় পাওয়ার কি আছে আমি তো আছি আপনার সাথে?’
বলেই আদ্রিয়ানের মাথায় হাত রাখলো আহি। আহির কাজে বেশ অবাক হয়েছে আদ্রিয়ান। তবে কি আহি জানে তাঁর সমস্যার কথা। আদ্রিয়ান শুধু তাকিয়ে রইলো আহির মুখের দিকে। তবে কিছু বললো না। আদ্রিয়ানকে এখনও বসে থাকতে দেখে আহি বেশ বুঝতে পেরেছে আদ্রিয়ান হয়তো আজ রাতে আর ঘুমাবে না। হঠাৎই আহি উঠে দাঁড়ালো তারপর আদ্রিয়ানের রুমে থাকা কাঁচের জানালাটার পাশে থাকা সাদা পর্দাটা সরিয়ে থাইগ্লাস খুলে দিল। সাথে সাথে রাতের জোৎসা ভরা চাঁদের আলো এসে পড়লো আদ্রিয়ানের রুমে। আদ্রিয়ানের রুম থেকে স্পষ্ট চাঁদ মামাকে দেখা যাচ্ছে। আদ্রিয়ান নীরবেই তাকিয়ে রইলো সেদিকে। আহি আবার চলে আসলো আদ্রিয়ানের কাছে তারপর বললো,
‘ আজকের চাঁদটা খুব সুন্দর তাই না।’
উওরে আদ্রিয়ান আহির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ হুম।’
‘ কিছু কথা বলবো আপনায়?’
উওরে শুধু তাকায় আদ্রিয়ান আহির দিকে। আদ্রিয়ানকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে আহিও বলে উঠল,
‘ জানেন তো আমার না বিশ্বাসই হচ্ছে না সেই ছোট বেলায় কোন ছেলেকে বাঁচিয়ে ছিলাম সেই আপনি?’
আহির এবারের কথা শুনে আদ্রিয়ান অবাক চোখে তাকালো আহির দিকে তারপর নীরব কন্ঠে বললো,
‘ তাঁর মানে তুমি?’
‘ আমায় সব বলেছে নিলয় ভাইয়া, তবে বেশি ভাববেন না দেখবেন ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
উওরে তেমন কিছু বললো না আদ্রিয়ান। শুধু বিস্ময় মাখা মুখ নিয়ে তাকিয়ে রইলো সে আহির দিকে। আহি আদ্রিয়ানের পাশে বসলো তারপর বললো,
‘ রাত তো এখনও অনেক বড়। বাকি রাতটা কি না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিবেন। তবে আপনি এমনটা করতে চাইলে আমার কিন্তু কোনো আপত্তি নেই।’
আহির কথা শুনে আদ্রিয়ান নিশ্চুপেই বলে উঠল,
‘ আমি তো ঘুমাতে চাই আহি কিন্তু আমার দুঃস্বপ্ন আমায় ঘুমাতে দিচ্ছে কই, সেই ভাঙাচোরা বাড়ি, রক্তের ছাপ, কুকুর ছানার নিথর দেহ, আমার বাবা মায়ের মৃত দেহ সবকিছুই ভেসে আসে আমার সামনে। এই জিনিসটা যেন আমার লাইফের একটা অভিশপ্ত বিষয়।
আদ্রিয়ানের কথা শুনে আহি কি বলবে বুঝতে পারছে না। আদ্রিয়ানের কথা শুনে ভীষণই খারাপ লাগছে আহির। আহি বেশি না ভেবে বলে উঠল,
‘ আচ্ছা চলুন আজ রাতে আর ঘুমানোর প্রয়োজন নেই গল্প করেই কাটিয়ে দেই আমরা।’
‘ আমার গল্প ভালো লাগে না।’
‘ আপনি না বড়ই অদ্ভুত আচ্ছা গল্প ভালো না লাগলে আর কি করার যায় তবে,
হঠাৎই কিছুক্ষন ভেবে বলে উঠল আহি,
‘ গান শুনবেন তবে?’
বলেই নিজের মোবাইল আর ইয়ারফুন বের করে একটা আদ্রিয়ানের কানে, আর একটা নিজের কানে লাগিয়ে দিল আহি। তারপর সুন্দর একটা ভিডিও গান ছেড়ে শুনতে লাগলো দুজন। আদ্রিয়ানও কিছু বললো না কারন তাঁর ভালো লাগছে।’
বাহিরে অন্ধকারে ঘেরা জোৎসা ভরা আলো, চাঁদ মামা উঁকি মারছে জানালা বেয়ে, হাল্কা ঠান্ডা মিশ্রিত বাতাস বইছে। আর এসবের মাঝেই আলোকিত বাল্বের আলোয়, পাশাপাশি বসে ইয়ারফুনের গান শুনছে আহি আর আদ্রিয়ান। আদ্রিয়ান নিশ্চুপেই তাকিয়ে আছে আহির মুখের দিকে। এই প্রথম কোনো রাত কাটাবে আদ্রিয়ান, যে রাতে সে একা রাত জাগবে না তাঁর সাথে অন্য একজনও থাকবে। আনমনেই মুচকি হাসলো আদ্রিয়ান। আর আহি মোবাইল দেখতে এতটাই ব্যস্ত যে তাঁর দিকে যে কেউ তাকিয়ে আছে এটা বুঝতেই পারি নি সে।’
_____
সকাল ৮ঃ০০টা___
পাশাপাশি বসে আদ্রিয়ানের কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে আহি আর আদ্রিয়ান সে তাকিয়ে আছে আহির মুখের দিকে। কাল প্রায় শেষ রাতের দিকে আদ্রিয়ান কাঁধে মাথা দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে আহি। আহি ঘুমিয়ে পড়তে আদ্রিয়ান ওর কানে থাকা ইয়ারফুন খুলে গান অফ করে বসে থাকে চুপচাপ। ঘুম আর হয় নি তাঁর, আহিকে দেখতে দেখতে রাত পাড় করে দেয় সে। এর মধ্যে হঠাৎই নড়েচড়ে উঠলে আহি। আহিকে উঠতে দেখে আদ্রিয়ানও দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। এরই মধ্যে সূর্যের আলো মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় আহির নিজেকে আদ্রিয়ানের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাতে দেখে এক প্রকার হকচকিয়ে উঠে সে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে আদ্রিয়ানকে সুন্দর মতো শুয়িয়ে দেয় সে।”
সময়টা সকাল ১০ঃ০০টার কাছাকাছি, মুখে মাস্ক আর চোখে কালো চশমা পড়ে আদ্রিয়ানের রুমে ঢুকে শুভ। কারন সে চায়না আদ্রিয়ান তাঁকে চিনে ফেলুক।’
বেডে চুপচাপ বসে আছে আদ্রিয়ান। এমন সময় তাঁর রুমে ঢুকলো একজন ডক্টর। মুখে মাস্ক আর কালো চশমা দেখে বেশ অবাক আদ্রিয়ান। মাস্কটা মানা যায় কিন্তু এইভাবে কালো চশমা পড়ে কেউ পেসেন্টের কাছে আসে এটা যেন সত্যি অবাক করার বিষয়। আদ্রিয়ানের পাশেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল আহি, শুরুতে সেও একটু অবাক হলেও পরক্ষণেই ওটা যে শুভ এটা বুঝতে পেরে আর বেশি ভাবলো না সে। অন্যদিকে শুভ আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় আদ্রিয়ানের দিকে। তারপর আদ্রিয়ানের বেডের পাশে থাকা ফাইলটা আর একবার চেক করে আদ্রিয়ানকেও দেখতে লাগলো। তারপর হাল্কা কন্ঠ চেঞ্জ করে বললো সে,
‘ আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো ভা, এতটুকু বলেও থেমে যায় শুভ। তাঁর কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
‘ আইমিন মাথায় বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে না তো?’
ডক্টরের কথা শুনে আদ্রিয়ানও বলে উঠল,
‘ খুব বেশি নয় আচ্ছা আমি বাড়ি কবে যেতে পারবো ডক্টর?’
‘ এই তো চার পাঁচদিন পরই যেতে পারবেন?’
‘ ওহ,
‘ হুম, আচ্ছা আমি এখন যাই তবে কোনো প্রবলেম হলে অবশ্যই জানাবেন ( আহির দিকে তাকিয়ে)
বলেই এক প্রকার জোরপূর্বক বেরিয়ে লাগলো শুভ। কারন আদ্রিয়ানের চাহনী তাঁর খুব একটা ভালো লাগছে না। না জানি চিনে ফেললো কি না। হঠাৎই আদ্রিয়ান ছেলেটির যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল,
‘ এক মিনিট ডক্টর,
আদ্রিয়ানের কথা শুনে বুক ধড়ফড়িয়ে উঠলো শুভর। তবে কি চিনে ফেললো তাঁকে আদ্রিয়ান?’
!
!
!
!
!
#চলবে…..