#শেষ_থেকে_শুরু
কলমে :লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:২৪
ডাক্তারের সামনে বসে আছে আবির। দুদিনে ওর বাবার শরীর বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে। কথা বলতে না পারলেও হাটতে চলতে পারছে। উনার কন্ঠনালীতে সমস্যা হয়েছে তবে ক্রমান্বয়ে ঠিক হয়ে যাবে। বাবাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া নিয়ে বেশ চিন্তা হচ্ছে। যে বা যারা এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ওরা যদি ঠিক পাই তবে আবারও আক্রমণের চেষ্টা করছে যেটা ও কিছুতেই হতে দিবে না। দরকার হলে বাবার সঙ্গে একজন লোক রাখবে। সজীবকে নিয়ে জান্নাতকে দেখতে যাওয়ার সময় হঠাৎ ফোন এসেছিল তাই হন্তদন্ত হয়ে এখানে ছুটে এসেছে। তবে এটাই স্বস্তি যে উনি ঠিক আছে। ডাক্তার বললেন উনাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ায় ভালো হবে। হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে আছেন বাড়িতে ফিরলে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে। আবির ডাক্তারের কথায় বাধ্য হয়ে রিলিজ করে নিলো। অরিন আর আরাফাত আছে সঙ্গে। ওদের সহযোগিতাই আবির বাবাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসলো।। ফারজানা হকের খুশীর সীমা নেই। কতদিন পরে লোকটা বাড়িতে ফিরেছে।। আবির মাকে বুঝিয়ে দিলো কিছুতেই বাবাকে নজরের বাইরে রাখা যাবে না। রুমে সিসি ক্যামরা সেট কর দিলো তবে এটা অতি গোপনে রাখলো। সব ঠিকঠাক করে রুম থেকে বাইরে আসতেই আরাফাতের সঙ্গে ওর দেখা হলো। আবির ভ্রু কুচকে বলল,
> মুখটা এরকম কেনো ভাইয়া? কিছু বলবেন?
আরাফাত মলিন হেসে বলল,
> বাড়িতে ফিরতে হবে আমি চাইছিলাম অরিন আমার সঙ্গে যাক। আম্মা বারবার বলছেন। উনি কেমন মানুষ তুমি তো জানো?
আবির ওষ্ঠে হাসি ফুটিয়ে বলল,
> আপনার স্ত্রীকে আপনি নিয়ে যাবেন এতে অনুমতির কি আছে?তাছাড়া ভাইয়া আমিও আপনার সঙ্গে একমত। মন দিয়ে সংসার করুন এসব ঝামেলা আমি সামলে নিবো।
আরাফাত লাজুক হেসে বলল,
> সংসার করার সময় চলে যাচ্ছে না। সময় হলে সব হবে। তারআগে বলো রোহানের সঙ্গে তোমরা কি করেছো? বড়ভাবির মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। রোহান বাড়ি ছাড়া। তাছাড়া বাচ্চার বিষয়টা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।
আবির শব্দ করে হেসে ফেলল। দারুন মজা পেয়েছে রোহানকে বোকা বানিয়ে । ওর খুব অহংকার ছিল নিজেকে মাত্রাতিরিক্ত চতুর ভাবতো।সব গুড়িয়ে দিয়েছে আবির।আরাফাত মুগ্ধ হয়ে আবিরের হাসি দেখছে। ছেলেটা যে কিছু একটা অঘটন ঘটিয়েছে এতে সন্দেহ নেই। আবির হাসি থামিয়ে ওকে প্রথম থেকে শেষ পযর্ন্ত সংক্ষেপে বলে দিলো। আরাফাত হতবাক রোহান যে এমন চরিত্রের আগে ভাবেনি। উপর থেকে সত্যিই মানুষ চেনা যায়না। মানুষ চেনা সহজ না। আবিরের কথার ওর ধ্যান ভাঙলো,
> ভাইয়া আমি একটু আসছি। দরকারি কাজ আছে।
> আচ্ছা
আবির ওর উত্তরের অপেক্ষা না করে বেরিয়ে আসলো। মন খারাপ হচ্ছে জান্নাতের জন্য। মেয়েটার কাছে যাওয়ার আগে শুধু বাধা আসছে। ইচ্ছে করছে একবারে নিজের কাছে নিয়ে আসতে কিন্তু ওদিকে যে লেডি হিটলার আছে। কিছুতেই জান ছাড়বে তবুও মেয়েকে ছাড়বে না। আবির কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মির্জা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামালো। হুটকরে জান্নাতকে বাসা থেকে আনা যাবে না। কিভাবে আনবে ভাবতে হবে। দুপুর হয়ে গেছে প্রায়। এই সময় হৈমন্তী বাড়িতে থাকবে না। আবির উপযুক্ত সময় ভেবে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে আসলো। আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাড়িতে কে আছে ওর জানা নেই। যাবে কি যাবে না ভাবতে ভাবতে ভেবতে,, চলে আসলো। একপা দুপা করে ভেতরে গিয়ে ওর চোখ চড়কগাছ। মেইন দরজা খোলা রয়েছে তাই আবিরে ভেতরে আসতে সমস্যা হয়নি। জান্নাত আপেল কাটার ছুরি নিয়ে খেলছে। ওর হাতের কিছুটা কেঁটে গিয়ে রক্ত ঝরছে কিন্তু মেয়েটা সেসব বুঝতে পারছে না। সামনে থাকা আপেলটাতে কোপ দিচ্ছে। আশেপাশে কেউ নেই। আমেনা বেগমের দরজা খোঁলা আছে। ভদ্রমহিলা উঁকি দিয়ে দিয়ে দেখছে। আবির দৌড়ে গিয়ে মেয়ের হাত থেকে ছুরিটা ফেলে দিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলো। আবিরকে দেখে জান্নাতের ওষ্ঠে হাসি ফুঁটে উঠলো। হাতের কাটা অংশটা দেখিয়ে ঈশারা করছে ফু দিয়ে ব্যাথা কমিয়ে দেওয়ার। আবির ওর হাত নিয়ে সামান্য ফু দিয়ে হাতে চুমো এঁকে দিলো ঠিক তখনই আমেনা বেগম ছুটে এসে ঝাঝালো কন্ঠে বলল,
> ওকে ধরলে কেনো? তুমি হঠাৎ এই বাড়িতে কি করছো?
আবির থতমত খেয়ে গেলো। ভদ্রমহিলার আগের সবটা মনে আছে। তবে ওর এখন ভয় না রাগ হচ্ছে। মেয়েটার হাতে ছুরি দেখেও উনি চুপচাপ দেখছে। আবিরকে চুপচাপ ভাবতে দেখে উনি আবারও বললেন,
> কি হলো উত্তর দাও? হৈমন্তীর সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে তাইনা? এই বাচ্চার বাপ কে? আমাকে কিছুই বলা হচ্ছে না কেনো?
আবির বুঝতে পারলো হৈমি আমেনা বেগমকে কিছু বলেনি। কথাটা ভেবে ওর মাথায় চট করে একটা দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেলো। মুখে লজ্জা লজ্জা ভাব এনে বলল,
> শাশুড়ি আম্মা মেয়েটা আমার নিজের। বিশ্বাস না হলে কাগজপত্র দেখাতে পারি। একদম বৈধভাবে মেয়ের বাবা আমি কোনো দুই নাম্বারি নেই।
আমেনা বেগমের মেজাজ খারাপ হচ্ছে। রোহানের কাণ্ডকীর্তি উনার কানে এসেছে। কি যুগ এসে গেছে সব বিয়ের আগেই বাচ্চার বাপ মা হয়ে যাচ্ছে। উনি লজ্জায় মরে যাচ্ছেন সেই সঙ্গে সমাজ সংস্কারের উপরে ধিক্কার জানাচ্ছেন। আবির কিছু ভেবে ভ্রু কুচকে মুখ কঠিন করে বলল,
> ওকে নিয়ে যাচ্ছি। আমি দেরিতে আসলে এতক্ষণে কি হতো আল্লাহ্ ভালো জানে। আপনি ঝগড়া ছাড়া কিছু পারেন বলে তো মনে হচ্ছে না। আমার মেয়ের কিছু হলে বুঝতেন আপনার এই তিড়িং বিড়িং ঝগড়া করার মজা। সামনের নির্বাচনে আপনাকে আমি নিজ দায়িত্বে এমপি বানাবো ভাবছি। সংসদ থেকে শুরু করে দেশটাও কাপিয়ে দিতে পারবেন। আন্তর্জাতিক সম্পদ আপনি। আপনাকে ঘরে রেখে দেশের ক্ষতি করবো না। আসছি এখন।
আবির আমেনা বেগমকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসলো। এখানে থাকলেই বিপদ। ভদ্রমহিলা এবার বাড়িতে তুফান তুলবে তাঁতে ওর কি। হৈমন্তীর উপর দিয়ে সেই তুফান প্রবাহিত হবে এটাই ওর শাস্তি। মেয়েকে না নিয়ে কাজের লোকের ভরসাতে রেখে বাইরে গেছে কত সাহস তাঁর। বাড়িতে ফিরলে বুঝবে মজা। আবির কিছু বলতে পারবে না কিন্ত আমেনা বেগম তো পারবে। মেয়ে একা ছিল ভেবেই ওর রাগ হচ্ছে। গাড়িতে বসে সেক্রেটারি জাবেদকে বলে দিল খাবার তৈরী করতে। ও এখুনি অফিসে আসছে। তাছাড়া মেয়েকে নিয়ে একটু ঘুরতে বের হবে। আবির জান্নাতের কাটা হাতটা ভালো করে পরিস্কার করে দিয়েছে। সামান্য কেটেছে কিন্তু রক্ত বের হয়েছে বেশখানিক। আবির বারবার মেয়ের হাতটা ঠোঁটে স্পর্শ করছে। এক হাতে ওকে জড়িয়ে রেখে আরেক হাতে ড্রাইভ করছে। জান্নাত অবাক চোখে আশেপাশটা দেখছে। আবির বারবার মেয়ের মুখের দিকে তাঁকিয়ে দেখছে। দিনদিন এমন হচ্ছে মেয়েটাকে ছেড়ে থাকতে ওর কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতো মায়া মেয়েটার মুখে ভুলে থাকা কষ্টের। আজকের দিনটা মেয়েটাকে নিজের কাছে রাখলে মন্দ হবে না। কথাটা ভেবে ও সিদ্ধান্ত নিলো মেয়েকে আজ ও কোথাও পাঠাবে না নিজের কাছেই রাখবে।
_________________
থমথমে মুখ করে বসে আছে রোহান। মন মেজাজ ভালো নেই। মায়ের হাতে জীবনে প্রথমবার থাপ্পর খেয়েছে সেই দুঃখে মরে যেতে মন চাইছে। তাছাড়া এই খবরটা বোন দুলাভাই থেকে শুরু করে নিকটবর্তী সব আত্মীয়দের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। ঝড়ো হাওয়াই আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। মান সম্মান বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। কিন্তু যাকে কেন্দ্র করে এতো কিছু সেই মেয়েটা ঠিকই বাড়ির মধ্যমনি হয়ে ঘুরছে। মেয়েকে সকালবেলায় অনিমার ভাই দিয়ে গেছে। আজ অনুষ্ঠানের কথা ছিল কিন্তু হচ্ছে না। সবাইকে মানা করা হয়েছে। বাড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কোনো একটা উপলক্ষে অনুষ্ঠান করা যাবে। রুহীকে পেয়ে সকলেই মোটামুটি বেশ খুশী শুধু রোহান ছাড়া। ভেবেছিল সব মিথ্যা প্রমাণ করে ফেলবে কিন্তু তেমন কোনো পথ খালি নেই। অনিমা সব প্রমাণ নিয়ে হাজির হয়েছে। আবির আর ওর সব বন্ধুরা অনিমাকে সাহায্য করেছে ভেবেই রাগ আরও বাড়ছে। এরকম বন্ধু থাকলে শত্রুর অভাব হবে না। কতো যত্ন করে বাঁশ দিলো রোহান আজীবন মনে রাখছে। সকালবেলায় বাইরে চলে গিয়েছিল কিন্তু এখন আবার ফিরে আসতে হলো। মায়ের ফোন পেয়ে আর অপেক্ষা করেনি। ইচ্ছে না থাকলেও অনিমার সঙ্গেই থাকতে হবে। সুখে থাকার অভিনয় করাটা ভীষণ কষ্টের। সময় খারাপ যাচ্ছে মাথা ঠাণ্ডা রাখাটা জরুরি। অনিমা ওকে আশেপাশেও ঘেঁষতে দিবে না এটা ও অভার শিউর। মেয়েদের মন থেকে একবার বের হয়ে গেলে সেখানে ফিরে যাওয়া বেশ কঠিন। নয়তো ভুলিয়ে ভালিয়ে সব আদায় করা যেতো।
******
অফিসে পা তুলে বসে আছে ফরহাদ। দুদিন আগে কানে এসেছে হৈমন্তী ফিরে এসেছে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মেয়েটা একটা বাচ্চা নিয়ে ফিরেছে। বাচ্চাটা কার এটা ওর বোধগম্য হচ্ছে না। মেয়েটা গিয়েছিল একা আর ফিরলো ডাবল হয়ে। আবার বিয়ে করেছে বলে তেমন কোনো নিউজ পাচ্ছে না। বিশ্বস্ত একজন চরকে দিয়ে খবর এনেছে। বিয়ে হলে নিশ্চয়ই বরকে সঙ্গে আনতো নাকি অন্য আরো বাচ্চা? হৈমন্তীর নরম স্বভাবের কথা ফরহাদের জানা আছে। নিশ্চয়ই কারো বাচ্চা পালছে। কথাটা ভেবে ফরহাদের কপালে ভাজ পড়ে গেলো। ফাজিল মেয়ে নিজের বাচ্চাকে ভাইকে দিয়ে এখন পরের বাচ্চা পালছে। ফরহাদ ওকে ছাড়বে না। একবার হাতে পেলে ঘরে বন্দী করে রাখছে। ওর থেকে মুক্তি পাওয়া কি এতোই সহজ? ও যত্ন নিয়ে হৈমন্তীর সকল খারাপ গুণগুলো সুধরে দিবে। পাখি খুব উড়াউড়ি করেছে আর করতে দেওেয়া যাবে না। খুব তাড়াতাড়ি ওকে নিজের কাছে নিয়ে আসবে। এমনভাবে লুকিয়ে রাখবে পৃথিবীর কেউ খোঁজ পাবে না। হৈমন্তীকে নিয়ে আসবে তবে রনির বিষয়ে একটু ভাবনা আছে। রাজীবের ছেলে মেয়ে নেই। ওর সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার মাধ্যম হচ্ছে রনী। কথায় বলে রক্ত রক্তকে চিনতে ভূল করেনা। বড় হয়ে রনি যখন জানবে রাজীব ওর বাবা না তখন ও নিজ দায়িত্বে ফরহাদের কাছে ধরা দিবে। সেদিনের অপেক্ষা ও নিশ্চয়ই করবে। কিন্তু হৈমন্তীকে তো ছাড়লে ওর চলবে না। লতার প্রেমে অন্ধ না হলে মেয়েটা ওর পায়ের কাছে পড়ে থাকতো। কথাটা ভেবেই লতার উপরে ওর রাগ হচ্ছে। ফরহাদ অস্থির হয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলো।
**
শাশুড়ি শায়লা বানুর সঙ্গে তুমুল ঝগড়া চলছে লতার। বয়সের ভারে এমনিই উনার অবস্থা খারাপ তারপর আবার লতার সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে ঝগড়া করতে গিয়ে উনার অবস্থা বেহাল। হাপিয়ে উঠেছেন। সকাল থেকে না খেয়ে আছেন। কাজের মহিলা আসেনি তাই বাড়িতে আজ রান্না হয়নি। ফরহাদ বাড়িতে খুব কম আসে। লতা বাবলুকে নিয়ে বাইরে খেয়ে এসেছে কিন্তু শায়লা বানুর অবস্থা তো ভালো না। ইচ্ছে করলেই বাইরে যেতে পারেন না। হাটতে চলতে কষ্ট হয়। কতবার একটা ভালো ডাক্তার দেখানোর কথা বলে কেঁদেছেন কিন্তু কে নিয়ে যাবে? লতা এসবে ধার ধারে না। শায়লা বানু ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে বাধ্য হয়ে রান্নাঘরে গিয়েছিলেন কিন্তু রান্না করতে পারেননি। রান্নাঘর নোংরা হয়েছে তাতেই ক্ষেপে আছে লতা। একটা দুটো কথা থেকে বিশালাকার ঝগড়া শুরু হয়েছে। ফরহাদ হঠাৎ বাড়িতে ফিরে মা আর লতার মধ্যে এরকম ঝগড়া দেখে বিরক্ত হলো। এমনিতেই লতার উপরে রাগ ছিল সুযোগ পেয়ে দৌড়ে গিয়ে লতার পেটে লাথি বসিয়ে দিলো। লতা ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে গিয়ে পেট ধরে যন্ত্রণায় চিৎকার দিয়ে উঠলো। ওর চিৎকার ফরহাদের কান পযর্ন্ত পৌঁছনোর সময় পেলো না। ছেলেটা ওর চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে দরজা বাইরে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলল,
> তোর মেয়াদ শেষ। তোকে একবছর আগেই আমি ডিভোর্স দিয়েছি। কাগজপত্র সব উকিলের কাছে আছে। বাবলু যে কালুর ছেলে সেসবের প্রামাণ ও আমার কাছে আছে। ছেলেকে নিয়ে যেখানে পারিস চলে যা। পুলিশের কাছে যাবি যেতে পারিস আগেই আমি ব্যবস্থা করে রেখেছি। খুব রাজরাণী হওয়ার শখ ছিল পূরণ করে দিলাম। মরার আগে আফসোস করতে পারবি না। আর হ্যাঁ কালু তোর জন্য অপেক্ষা করছে। ওকে একটা রিকশা কিনে দিয়েছি তোদের দিনকাল ভালো যাবে। বিয়েটা করে নিস। তোর যা স্বভাব।
ফরহাদের কথা শুনে লতার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হলো। ও দ্রুত ফরহাদের পা জড়িয়ে ধরতে গেলো কিন্তু ও দিলো না। সরে গিয়ে নাক ছিটকে বলল,
> দূরে থাক, তুই নিজেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেছিস আমি না। আমার বিশ্বাস নিয়ে খেলা করেছিস। তোকে ক্ষমা করা যায় না। আমি নিজের স্ত্রী সন্তান ছেড়ে তোকে সুখের সমুদে ভাসিয়ে রাখবো কোন সুখে?
লতা পেটে হাত রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
> ক্ষমা করে দাও প্লিজ। আমি কথা দিচ্ছি কখনও তোমার কথা অমান্য করবো না। সব শুনবো প্লিজ দয়া করো।
ফরহাদ চড়া গলাই বলল
> তুই যাবি নাকি দারোয়ান ডাকবো?
লতা বুঝলো আর যাইহোক এই বান্দার মন গলবে না। ওকে চলে যেতেই হবে। তাই রাগে চিৎকার করে বলল,
> তুই হৈমন্তীকে পাওয়ার জন্য এসব করছিস তো ওকে তুই কখনও পাবি না।তোকে অভিশাপ দিচ্ছি।
ফরহাদ অভিশাপ পযর্ন্ত শুনলো না।ছুটে গিয়ে ওর গালে জোরে একটা থাপ্পড় দিয়ে দিলো। বাবলু দূরে দাঁড়িয়ে মায়ের উপরে হওয়া অত্যাচারগুলো দেখছে। লতার শরীর দুমড়ে মুচড়ে মাটিতে পড়ে আছে। অচেতন হয়নি জ্ঞান আছে তবে না থাকার মতো। গেটের কাছে কালু উকি দিচ্ছিলো। ফরহাদ ওকে ডেকে নিয়ে বাবলু আর লতাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য হুকুম দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। শায়লা বানু ভীতিকর চোখে তাঁকিয়ে আছে। এই ছেলের সঙ্গে যেনো উনার কোনো পরিচয় নেই। কাকে দেখছে ছেলের রূপে ভেবেই ভয় করছে। ফরহাদ হন্তদন্ত হয়ে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলো। হৈমন্তীকে ফিরিয়ে আনতে হলে ঘর খালি করাটা জরুরি ছিল। অর্থসম্পদের অভাব নেই সেই সঙ্গে আছে যথেষ্ট ক্ষমতা আর কি চাই ওকে নিজের করে পেতে?
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
#শেষ_থেকে_শুরু
কলমে :লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:২৫
অফিস থেকে বাড়িতে ফিরেছে হৈমন্তী। সারাদিন একটুও বিশ্রামের সুযোগ হয়নি। মেয়েটাকে বাড়িতে রেখে যেতে মন সাড়া দেয়না তবুও কিছু করার নেই। ওকে সঙ্গে নিলে রোদ গরমে বাইরে বাইরে ঘুরাঘুরি করলে অসুস্থ হয়ে যাবে। তাছাড়া হঠাৎ এখানকার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতেও বেশ ঝামেলা হচ্ছে। রাতে কাশি হচ্ছে। হৈমন্তী শুক্রবারে মেয়েকে নিয়ে ভালো একটা ডাক্তারের কাছে যাবে বলে ঠিক করেছে। ক্লান্ত হয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে কাজের মেয়েকে ডাক দিয়ে বলল,
> রমেলা আপা জান্নাতকে আনো। খাবার দিয়েছো ওকে?
রমেলা ধীরপায়ে কাচুমাচু হয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। আমেনা বেগম মেয়ের গলা শুনে প্রস্তুতি নিচ্ছেন কড়া করে কিছু কথা শুনিয়ে দেওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ আগে অরিনকে বাড়িতে দিয়ে অফিসে গেছে আরাফাত। চয়নিকা নিজের রুমে আছে। দুদিন মায়ের বাড়িতে ছিল। মন খারাপ ছিল তবে এখন বেশ ভালো। আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। তবে নিজের ভাইয়ের উপরে ওর ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে। রমেলাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হৈমন্তী ভ্রু কুচকে বলল,
> কথা বলছো না কেনো?যাও ওকে নিয়ে আসো যাও।
রমেলা ভয়ে ভয়ে বলল,
> আফা আপনে যখন ওরে আমার কাছে রাইখা গেলেন তখনই আম্মা আমারে কইলো উনার লাইগা সুপ করে আনতে। আমি তাড়াতাড়ি করি চলে গিয়েছি জান্নাত আম্মা ছুরি নিয়ে খেলা করতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছে। আম্মা কইছিলেন দেখবো কিন্তু দেখিনি আমারে দোষ দিবেন না।
হৈমন্তী ছটফট করে উঠলো। মেয়ের হাত কেটে গেছে শুনেই বুকের মধ্যে ধপ করে উঠেছে। না জানি তার কতটা কষ্ট হয়েছে। ও দ্রুত উঠে ঘরের দিকে যেতে গেলো কিন্তু পা চলল না। রমেলা বলে উঠলো,
>ছোট আম্মাই তো বাড়িত নেই।
হৈমন্তীর বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটাচ্ছে। বড় কোনো দুর্ঘটনা হয়েছে কিনা বুঝতে পারছে না। হাতটা বেশি কেটেছে নাকি যে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। মনেমনে ভাবলো আর কখনও ওকে চোখের অদেখা করবে না। কথাগুলো ভেবে দ্রুত কন্ঠে বলল,
> হেয়ালি না করে সোজাসুজি বলো জান্নাত কোথায়? ওর কিছু হলে কিন্তু খবর আছে। কাউকে ছাড়বো না আমি। আম্মা কিভাবে পারলো আমার মেয়ের হাতে ছুরি দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে। পাষাণ হৃদয় তাঁর। সেকি করে বুঝবে আমার কষ্ট। তাড়াতাড়ি বলো জান্নাত কোথায়?
হৈমন্তী কেঁদে ফেলল। এটাই যে ওর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। যাকে আকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চেয়েছে। হৈমন্তীর কান্না দেখে রমেলা ঘাবড়ে গেলো। হঠাৎ পাশ থেকে আমেনা বেগম ঝঙ্কার দিয়ে বলে উঠলো,
> সে তাঁর বাপের সঙ্গেই আছে। কান্নাকাটি করে গঙ্গা যমুনা বানিয়ে দেওয়ার কিছু হয়নি। তোমাকে মেয়ে ভাবতেও আমার লজ্জা লাগছে। পেটে থাকতেই যদি তোমাকে মেরে ফেলতাম তাহলে এই দিনটা আমাকে দেখতে হতো না। তোমার জন্য ওই ছেলেটা আমাকে এতগুলো কথা শুনিয়ে দিয়ে গেলো। কতবড় সাহস হলে সে আমাকে বলে আমি নাকি সংসার থেকে শুরু করে দেশ পযর্ন্ত কাঁপিয়ে দিতে পারি সেই ক্ষমতা আমার আছে। তাঁর মেয়ের কিছু হলে আমার তিড়িং বিড়িং ঝগড়া করা বের করে দিবে হুমকি দিয়েছে। আরও কতগুলো আজেবাজে কথা বলে গিয়েছে। বড়দের সম্মান করতে জানেনা বেহায়া ছেলে।
আমেনা বেগম একদমে কথাগুলো বলে থামলো।হৈমন্তী বুঝতে পারলো না কথাগুলো কে বলেছে। ও জিঞ্জাসু দৃষ্টিতে রমেলার দিকে তাকাতেই রমেলা প্রথম থেকে শেষ পযর্ন্ত বলে দিলো। হৈমন্তী স্বস্তির পেলো এটা ভেবে যে জান্নাত আবিরের কাছে আছে। আমেনা বেগমের কথাগুলো শুনে ওর খারাপ লাগছে না বরং মজা লাগলো। আবির উত্তম মাধ্যম দিয়ে গেছে বেচারা সেটা হজম করতে পারছে না বলে রাগে ফুসছে। হৈচৈ দেখে চয়নিকা আর অরিন নিচে নেমে এসেছে। ওরা শুনেছে কথাগুলো। তবে একটা বিষয়ে ওদের ভাবাচ্ছে। আবির কেনো মেয়েটাকে নিজের মেয়ে বলছে। তাছাড়া মেয়েটা ওর কাছে কেমন শান্ত হয়ে থাকে। চয়নিকা সুযোগ পেয়ে বলল,
> হৈমি তুমি জান্নাতকে বাড়িতে একা রেখে গিয়েছো আমাকে বলবে না? তোমার সহস দেখে হতবাক। দুদিন আগেও মেয়েটা বাইরে চলে গিয়েছিল আবির নিয়ে গিয়ে বিকালে দিয়ে গেছে। আচ্ছা আবিরের সঙ্গে তোমার কি যোগাযোগ আছে?
হৈমন্তী ঢোক গিলে বলল,
> যোগাযোগ নেই ভাবি। সেদিন দেখা হলো আমাকে চিনতে পযর্ন্ত পারলো না তাহলে কিসের কি?
চয়নিকা বিষয়টা চিন্তা করলো। আমেনা বেগম এখনো বকবক করছে। হৈমন্তী এবার ভ্রু কুচকে বলল,
> আম্মা তুমি আমাকে দেখতে পারো না ঠিক আছে তাই বলে ছোট মেয়েটার ক্ষতি করতে চাইবেন? উনি না আসলে কি হতো বলোতো?
> আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি। ওই ছেলের সঙ্গে তোর কিসের সম্পর্ক? জান্নাতের বাপ ও তাইনা? ছিঃ আমি সত্যি অনুমান করেছি। ভেবেছিলাম ফরহাদের সঙ্গে সব মিটমাট করে তোর নিজের ঘরে ফিরিয়ে দিবো। তার আগেই তুই এইসব করেছিস?
হৈমন্তীর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কথা হচ্ছে আবিরকে নিয়ে সেখানে ফরহাদকে টানাটানির করার কি দরকার। শয়তানের নাম নিয়ে ডাকাডাকি করে তাকে হাজির করার মানে হয়। হৈমন্তী দাঁতে দাঁত রেখে ফিসফিস করে বলল,
> এটা আমার আর মিস্টার আবিরের মেয়ে শুনেছো? এখন তোমার যা মন চাই করো।
হৈমন্তী গটগট করে হেটে চলে আসলো। অরিন ওর পেছনে পেছনে আসলো। ওর চোখেমুখে জিঞ্জাসু চিহ্ন। তবে চয়নিকা একটুও শাশুড়ির কথাবার্তা বিশ্বাস করেনা। ওর মতে এই ভদ্রমহিলা তিল থেকে তাল বানাতে উস্তাদ। তাছাড়া বাচ্চাটা বেশ কিউট যেকেউ পছন্দ করবে। মেয়েটার উপরে আবিরের মায়া জন্মানোটা স্বাভাবিক বিষয়। ও আর মাথা ঘামালো না। রনিকে নিয়ে চলে গেলো। আমেনা বেগম ফুঁলছে। ফরহাদ মাঝে মাঝেই উনাকে ফোন করে খোঁজখবর নেই। কি সুন্দর করে আম্মা ডাকে জান প্রাণ ঠান্ডা হয়ে যায়। আর এদিকে এই ছেলেটা ঠোঁট কাটা স্বাভাবের। লজ্জা শরমের বালাই নেই।
☆☆
থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে হৈমন্তী। অরিন ওর পাশে বসে ফিসফিস করে বলল,
> ভাইয়া হয়তো তোমার মেয়ে বলে জান্নাতকে নিজের মেয়ে বলেছে। জানোই তো কেমন পাগলামি করে প্লিজ কিছু মনে করোনা। আম্মাকে কতগুলো বাজে কথা শুনিয়ে দিলো। আম্মা খুব চটে গেছেন।
হৈমন্তী রেগে থাকতে পারলো না শব্দ করে হেসে ফেলল। মনে মনে ভাবলো এসব আবিরের পক্ষেই সম্ভব। অরিন কৌতূহলী হয়ে জিঙ্গাসা করলো,
> তুমি রেগে নেই?
> রাগবো কেনো? মিস্টার আবির আর যায় করুক আমার ক্ষতি করবেন না। আমি উনাকে বিশ্বাস করি। তাছাড়া রোহান ভাইয়ার বিষয়টা নিয়ে উনার উপরে রেগে থাকা যায়না। একটা মেয়েকে কিভাবে রক্ষা করলো ভাবো?
অরিন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। শাশুড়ির সঙ্গে নিজের ভাই বেয়াদবি করেছে বিষয়টা সবাই ভালো চোখে দেখবে না। শাশুড়ির সামনে যেতে ওর ভয় লাগে। দম আটকে আসার মতো অবস্থা। হৈমন্তী ডাকে ওর ধ্যান ভাঙলো,
> উনাকে একটু ফোন দিয়ে বলবে মেয়েটাকে দিয়ে যেতে?
অরিন প্রশ্ন না করে আবিরকে ফোন করলো। প্রথমবারের পরে ফোন রিসিভ হলো। অরিনের হ্যালো বলার আগেই আবির দাঁত বের করে হেসে বলে উঠলো,
> ওদিকের কি অবস্থা সব ঠিক আছে? শাশুড়ি সাহেবা ভালো আছেন?
অরিন কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
> ভাইয়া তুমি দিনদিন বেহায়া হয়ে যাচ্ছো। লজ্জা শরমের বালাই নেই। তুমি একটা ইয়ে।
আবির শব্দ করে হেসে বলল,
> ভদ্রমহিলা আমাকে এইসব বলেছে তাইনা? উনার সঙ্গে আমার বেশ জমবে। শশুর বাড়িতে এবার দেখি ঘনঘন আসতে হবে।
অরিন ভ্রু কুচকে বলল,
>এমন ভাব করছ মনে হচ্ছে এটা আমার না তোমার শশুর বাড়ি। শুনো আমার শাশুড়ি তোর উপরে ভীষণ বিরক্ত। তুমি জান্নাত মাম্মাকে দিয়ে যাও। হৈমি অপেক্ষা করছে।
> ওকে বল মেয়েকে আজ পাচ্ছে না। দিনরাত কাজ করছে,কাজ করতেই বল। মেয়েকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আর ফোন করবি না। সময় হলে আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসবো।
আবির শেষের কথা গুলো বেশ কড়াভাবে বলে রেখে দিলো। অরিন হতাশ চোখে হৈমন্তীর দিকে তাকিয়ে বলল,
> কি হবে?
হৈমন্তী কিছু ভেবে নিয়ে বলল,
> কষ্ট করে আজকের রাতটা পার করে ফেলবো চিন্তা করোনা। উনার কাছেই থাক না আজকের দিনটা।
অরিন উত্তর করলো না রুমে ফিরে আসলো। আরাফাত সারাদিন বাড়িতে আসেনি অরিন বুঝে নিয়েছে লোকটা হয়তো ওকে এড়িয়ে চলছে কিন্তু কেনো? লজ্জা পাচ্ছে নাকি কাজের চাপে এমন করছে বুঝতে পারছে না। এতগুলো দিন পার হয়েছে ওদের সম্পর্ক একটুও এগোতে পারেনি। তবে সামান্য হলেও বন্ধুত্বটা হয়েছে। লোকটাকে ভরসা করা যায়। সব সময় মুখ দেখেই বুঝতে ফেলে কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে। প্রিয়জন বুঝি এমনিই হয়।
☆
গোসল করে রেডি হলো হৈমন্তী। সন্ধ্যা সাতটায় একটা মিটিং আছে। কয়েকধাপে কাজকর্ম চলছে। সবাইকে এক সঙ্গে মিটিংয়ে ডাকা হয়েছে। দীর্ঘ প্রজেক্ট শেষ করতে অনেকটা সময় লাগবে। হৈমন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে কালো রঙের ড্রেসের সঙ্গে মিলিয়ে একটা কালো হিজাব পরে নিলো। বেরিয়ে যাওয়ার আগে আয়নায় ভালো করে একবার নিজেকে দেখে নিলো। মেয়েটার জন্য খারাপ লাগছে। জীবনে প্রথমবার মেয়েটার মুখ না দেখে বাইরে যাচ্ছে। আগে তো সব সময় সঙ্গে রাখতো। এখানে এসেই যত ঝামেলা। হৈমন্তী ঠিক করেছে আগামীকাল থেকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করবে যা হয় হবে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ও বেরিয়ে গেলো। রাজীব বসে ছিল ওকে বাইরে যেতে দেখে উঠে আসলো। হৈমন্তী মলিন হেসে বলল,
> এইটুকু রাস্তা আমি যেতে পারবো। তুমি চিন্তা করোনা। বাড়িতে থাকো আর আম্মাকে সামলাও আমার উপরে সে ক্ষিপ্ত হয়ে আছে।
> আম্মা দিনদিন এমন হয়ে যাচ্ছে কেনো আল্লাহ্ ভালো জানে। বয়স হচ্ছে বুদ্ধি কমছে। সব সময় খিটখিটে মেজাজে থাকে।
হৈমন্তী মলিন হাসলো। কি উত্তর দিবে নিজের মায়ের সম্পর্কে বুঝতে পারলো না। মাকে নিয়ে খারাপ কথা বলতে বা শুনতে একটুও মন সাড়া দিচ্ছে না। উনি যেমন আছে থাক। হৈমন্তী কথা এড়িয়ে গিয়ে বাসা থেকে বের হলো। সন্ধ্যার নামাজ পড়ে বের হয়েছে। সাতটায় মিটিংয়ের টাইম ঠিক হলেও আটটা বেজে যাবে ওর জানা আছে। হৈমন্তী বাড়ির গাড়িতেই একটা রেস্টুরেন্টর সামনে এসে নামলো। ড্রাইভারকে বলে দিলো চলে যেতে। যাওয়ার সময় অফিসের গাড়িতে করে পৌঁছে দিবে নয়তো ফোন করে নিবে। হৈমন্তী গাড়ি বিদায় করে ভেতরে চলে গেলো।
________________
মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে ফেরেনি আবির। সেক্রেটারি জাবেদের হয়েছে যত ঝামেলা। হুকুম শুনতে শুনতে বেচারা ক্লান্ত। আবির মেয়েকে নিয়ে একটা আবাসিক হোটেলে উঠবে সেই বন্দবস্ত করতে হচ্ছে। যদিও এটা আবিরের চেনাজানা হোটেল। কখনও রাতে থাকা হয়নি তবে অফিসের কাজের জন্য আসা লাগে। দূর থেকে যারা আসে তাদের থাকার জন্য এখানে রুম বুক করতে হয়। আবির মেয়েকে নিয়ে সেখানেই উঠবে। বাড়িতে ফিরলে আরশী হয়তো মায়ের একগাদা প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। হৈমন্তী যদি রাজি থাকতো এসব করতেই হতো না। সামান্য অনিমার জন্য এতকিছু করলো আর নিজের ভালোবাসার জন্য করতে পারতো না। পুরো পৃথিবীর বিপক্ষে গিয়ে মেয়ে আর বউয়ের পাশে থাকতো। আফসোস লেডি হিটলার বুঝতে পারে না। কথাগুলো ভেবে আবিরের রাগ হচ্ছে। হৈমন্তীকে নিয়ে ও আর ভাববে না তবুও কিভাবে জানি ওর ভাবনাতে মেয়েটা এসে উঁকি ঝুকি কাটে যায়। বেহুদ্দা মেয়ে একটা। জান্নাত বিছানার মাঝখানে বসে খেলছে। মেয়েটার দিকে তাঁকালে মনটা শীতল হয়ে যায়। আবিরের ধ্যান ভাঙলো জাবেদের কন্ঠ শুনে।
> স্যার সব ঠিকঠাক করে ফেলেছি আসুন।
> কেনাকাটা করতে বলেছিলাম সেসব?
> সব রেডি। আপনি চলুন রাত হচ্ছে স্যার।
> চলো।
আবির মেয়েকে নিয়ে উঠে আসলো। হোটেল গিয়ে খেতে হবে।মেয়েকে নিয়ে সারাদিন প্রচুর ঘোরাঘুরি হয়েছে। অফিসের একটা মেয়েকে দিয়ে জান্নাতকে গোসল করিয়ে নিয়েছিল। মেয়েটা থমথমে মুখে আবিরের হুকুম মতো দুধ গরম করে এনেছে বারবার। আবির বুঝতে পারেনি এর মুখের এই অবস্থা কিভাবে হলো। অন্যদিন তো হাসিখুশি থাকে। আবির তেমন পাত্তা দিলো না। মেয়েদের সাইকোলজি বেশ জটিল। সহজে বোধগম্য হয় না। আবির মেয়েকে নিয়ে আবাসিক হোটেলে গিয়ে উঠলো। জাবেদ চলে আসতে চেয়েছিল কিন্তু আবির ওকে ছাড়লো না। যদি কিছু দরকার হয় তখন ঝামেলা হবে। হোটেলে এসে আরেক ঝামেলা শুরু হলো জান্নাত কিছুতেই রুমে থাকতে চাইছে না। বাইরে বেরিয়ে এসে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো। আবির আর জাবেদ মিলে ওকে বারবার সামলে নিচ্ছে। হোটেলের ম্যানেজার দাঁত বের করে হাসছে। আধা ঘন্টার মধ্যেই দুজনেই ক্লান্ত হয়ে গেলো কিন্তু জান্নাতের কিছুই হলো না। না পেরে আবির মেয়েকে জোর করে বুকের সঙ্গে নিয়ে রুমে চলে গেলো। আবির মনে মনে ভাবলো মেয়েটা মায়ের মতোই হয়েছে। কখন কি মর্জি হয় বোঝা কষ্ট। বেশ কিছুক্ষণ মেয়েটা কান্নাকাটি করে বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে ঘুমিয়ে গেলো। আবির বেশ খুশী। রাতের মতো ঝামেলা শেষ কিন্তু যদি মাঝরাতে ক্ষুধা পাই রুমে যা ছিল সব শেষ। ও হন্তদন্ত হয়ে বাইরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখলো জাবেদ ঘুমিয়ে বিভোর। রাত দশটার বেশি বেজে গেছে। আবির ওকে আর না জাগিয়ে রুম লক করে ম্যানেজারকে বলে বেরিয়ে আসলো। জুস কিছু ফল আর কিনতে হবে।। বাচ্চা পালন করাও বেশ কষ্টের। মেয়েকে খালি পেটে রাখা ঠিক হবে না ভেবে পাশের একটা দোকানে ঢুকে পড়লো। রাস্তায় মানুষজন কম হয়ে গেছে। বেশি রাত হয়নি তবুও এমন নির্জন কেনো বুঝতে পারলো না। দোকানদারকে জিঞ্জাসা করে নিলো। বিরোধী দল রাস্তা অবরোধ করেছে আন্দোলন চলছে। গাড়ি চলছে না। সারাদিন জান্নাতকে নিয়ে বিজি ছিল তাই এসবের খোঁজ রাখেনি। আবির আর সময় নষ্ট করলো না রাস্তায় নামলো। পায়ে হেটেই বের হয়েছিল।
☆☆
মিটিং শেষ করে রাস্তায় নেমে হতবাক হলো হৈমন্তী। রাস্তায় একটা গাড়িও নেই। যারা ছিল তাদের বাসা আশেপাশে হওয়ার জন্য সকলেই হেটে চলে গেলো। একা পড়ে গেলো শুধু হৈমন্তী। কারো থেকে সাহায্য নিতে কেমন বিবেকে বাঁধছে। তাছাড়া বাড়ি থেকে আসার সময় ভূলে ফোন রেখে এসেছে। ভাবলো সামনে এগিয়ে গেলে কোনো গাড়ি নিশ্চয়ই পাবে। রাস্তা অবরোধ হয়েছে কথাটা কিছুক্ষণ আগে শুনেছে। আসার সময় তেমন কিছুই চোখে পড়েনি। কথাগুলো আনমনে ভাবতে ভাবতে বেশ কিছুদূর চলে আসলো ঠিক এমন সময় কয়েকজন ওর দিকে ছুটে আসলো। হৈমন্তী ভয় পেয়ে গেলো। ও পাশে সরে আসলো ভেবেছিল এরা হয়তো যারা আন্দোলন করছে ওদের দলের হবে কিন্তু ছেলেগুলার ওকে অবাক করে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। আর চারদিক থেকে ওকে ঘিরে ধরলো। হৈমন্তী চিৎকার দিতে ভূলে গেছে। একটা ছেলে অনবরত ফোনে কথা বলছে,
> মেয়েটাকে পেয়েছি। এখানেই মেরে ফেলবো নাকি উঠিয়ে আনবো? এখানে মারলে ঝামেলা শেষ কোথাও নিতে হবে না।
ওপাশ থেকে কি বলছে শোনা যাচ্ছে না। হৈমন্তী ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। মারিয়াম আন্টির কথা বারবার মনে পড়ছে।।ভাবলো আজকেই হয়তো জীবনের শেষ দিন। ছেলেগুলার ওর হাত ধরে টানতেই হৈমন্তী জোরে চিৎকার দিয়ে বসলো। সঙ্গে সঙ্গে ওর আওয়াজ থেমে গেলো। ওর মুখটা বেঁধে ফেলা হলো। একটা ছেলে ধাঁরালো চাকু বের করে ওর দিকে এগিয়ে আসতেই কয়েকজন উল্টো ছেলেগুলার উপরে আক্রমণ করে বসলো। হৈমন্তী হাপাতে হাপতে বসে পড়লো ঠিক তখনই কেউ একজন ওকে ধরে ফেলল। হৈমন্তী ঝাপসা চোখে লোকটাকে দেখতে পেলো না। জ্ঞান হারালো। যখন জ্ঞান ফিরলো, চোখ খুঁলে তাকাতেই আবিরের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।