প্রেমময়ী তুমি পর্ব-৩২+৩৩

0
539

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৩২
#নিশাত_জাহান_নিশি

“এবার তুমি আমাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যাবে চাঁদ! নতুন করে আবারও আমার মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করবে। আমাকে পেয়ে তুমি উদ্ভ্রান্ত হয়ে যাবে। আমার মায়ায় তুমি এতোটাই মারাত্মকভাবে জড়িয়ে পড়বে যে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করতে তোমার বুকটা লক্ষ্যাধিকবার কেঁপে উঠবে!”

পাশ থেকে মাহিন গলা ঝাড়লো! গরমের তাড়নায় অতিষ্ট হয়ে গাঁয়ে পরিহিত সাদা রঙের শার্টটা পেছনের দিকে এলিয়ে দিলো। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে এদিক-ওদিক তাকালো। অসহ্যকর গলায় বলল,,

“এই এবার ফিনিশ হয়েছে তোর হিরোপান্তি? ফর দ্যা গড সেইক গাড়িটা একটু সাইড কর ভাই। গরমে জান বের হয়ে যাচ্ছে।”

সানগ্লাসের উপর থেকে নূর ভ্রু যুগল উঁচিয়ে মাহিনের দিকে তাকালো! কিয়ৎক্ষণ সেই একই নিরক্ষর দৃষ্টিতে মাহিনকে পর্যবেক্ষণ করল। অতঃপর ভাবশূণ্য গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কেন রে ভাই? তোরও কী আমার মতো প্রেয়সীর ঠোঁটের আইসক্রিম খাওয়ার স্বাদ জেগেছে?”

চোখ দুটো লাল করে মাহিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। তেজী গলায় বলল,,

“আজিব! আমার প্রেয়সী আসবে কোত্থেকে হ্যাঁ? প্রেম-ই তো এখনো হয় নি আমার। আর প্রেয়সী তো সেখানে দিবাস্বপ্ন!”

ঝট করে মাহিনের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো নূর। আইসক্রিমটায় পুনরায় বাইট বসালো। ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিয়ে তৃপ্তির সাথে আইসক্রিমটা গিলে খেলো। কঠিন গলায় বলল,,

“তো কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান না করে চুপচাপ বসে থাক। গাড়িটা এখন সাইড করা যাবেনা। আমার একটু ভুলের জন্য প্রেয়সীর কাছে আমি ধরা খেতে চাইনা!”

“ধরা তো তুই এমনিতেও খাবি ভাই। কারণ, আমাদের গাড়িটা এখন চাঁদদের বাড়িতেই যাবে! আর গাড়িটাকে একবার দেখলেই চাঁদ চোখ বুজে বলতে পারবে গাড়িতে এক্সেক্টলি কে ছিল!”

“বাড়িতে যাওয়ার পর ধরা খেলে আই হেভ নো প্রবলেম। তবে রাস্তার মাঝখানে ধরা পড়লে বহুত সমস্যা রে ভাই। এই মেয়ে যা বিচ্ছু! দেখা গেল রাস্তার মাঝখানেই আমাকে গন ধোলাই দিলো! এর সাথে বিশ্বাস নেই কিন্তু।”

“তার মানে তুই এখন গাড়িটা সাইড করবিনা তাই তো?”

“হ্যাঁ ঠিক তাই। চুপচাপ বসে সিগারেট গিল। আমার চিল মুডটা নষ্ট করিস না ঘ্যান ঘ্যান করে।”

মাহিন ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। নিরুপায় হয়ে নূরের কথা মেনে নিলো। প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের একটা প্যাকেট বের করল। লাইটার দিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে জোরে এক টান দিলো সিগারেটটায়। নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করে বিদ্বেষি দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো৷ নূর বাঁকা হাসল! আইসক্রিম খাওয়ার শেষ পর্যায়ে এসে শ্লেষাত্নক গলায় মাহিনকে বলল,,

“হাউ স্ট্রেঞ্জ না মাহিন? তোর এই ভাই প্রেয়সীর মুখের আইসক্রিম খাচ্ছে আর তুই তার পাশের সিটে বসে সিগারেট টানছিস! প্রেমে এলার্জি থাকলে এরমই হয় রে ভাই! ঢাকায় তো আর কম মেয়ে দেখাইনি! মনের মতো একটাও প্রেয়সী পেলিনা!”

মাহিন চোয়াল শক্ত করল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“ভাট না বকে কুইকলি কারটা ড্রাইভ কর। বাড়ির সবাই হয়তো অলরেডি খালামনির বাড়ি পৌঁছে গেছে। আমরাই পেছনে পড়ে গেলাম।”

নূর কদাচিৎ হাসল। ব্যগ্র গলায় বলল,,

“কুল ভাই কুল। এতো রাগছিস কেন? আই সোয়ার, এই কুমিল্লাতেই আমি তোর জন্য একটা প্রেয়সীর ব্যবস্থা করে দিব! প্রেয়সীর মুখের আইসক্রিম খেতে আমি তোকে হেল্প করব!”

রাগে বোম হয়ে মাহিন তার হাতে থাকা সিগারেটটা জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে মারল! গম্ভীর গলায় বলল,,

“ধ্যাত! তোর সাথে কথা বলাই বেকার!”

,
,

চাঁদ দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এক পর্যায়ে এসে থেমে গেল! চাঁদের পিছু পিছু জায়মা এবং তাশফিয়াও দৌঁড়ে এলো। দুজনই পেরেশান হয়ে চাঁদকে দুপাশ থেকে চেপে ধরল। সমস্বরে বলল,,

“এই তুই ঠিক আছিস তো?”

চাঁদ কুঁজো হয়ে হাঁপাতে লাগল। এক টানে মাথা থেকে সাদা হিজাবটা খুলে নিলো। ঘর্মাক্ত মুখণ্ডলে জায়মা এবং তাশফিয়ার দিকে তাকালো। ক্লান্ত গলায় বলল,,

“ঠিক আছি। কিন্তু আমার আইসক্রিম?”

জায়মা স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। চাঁদ ঠিক আছে শুনে যেনো সে প্রাণ খুঁজে পেল। বুকে হাত রেখে জায়মা শুকনো গলায় চাঁদকে শুধালো,,

“কী হয়েছিল চাঁদ একটু বলবি? তোর চিৎকার শুনে তো আমরা ভেবেছিলাম তোর আবার খারাপ কিছু হলো নাকি।”

রুদ্ধকর শ্বাস ফেলে চাঁদ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কোমরে হাত গুজে নিজেকে স্থির করল। শুষ্ক গলায় বলল,,

“কেউ আমার হাত থেকে আইসক্রিমটা কেড়ে নিয়েছে জায়মা! চোখের পলকেই সবকিছু হয়ে গেল বিশ্বাস কর। লোকটাকে ঠাওর করতে পারিনি আমি। সবকিছু কেমন যেনো ঘোলা ঘোলা লাগছিল আমার।”

তাশফিয়া উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। নির্বোধ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“সিরিয়াসলি চাঁদ? দিনে-দুপুরে কেউ এসে তোর হাত থেকে আইসক্রিমটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল আর তুই টের-ই পেলিনা? আর এই যুগে এতো বড়ো কার নিয়ে কে কার আইসক্রিম ছিনতাই করতে আসে ভাই? এর লজিক তো আমি বুঝলাম না।”

চাঁদ হয়রান হয়ে কয়েক দফা শ্বাস ছাড়ল। তৎপর গলায় বলল,,

“জানিনা আমি। কিচ্ছু জানিনা। এই প্রথম কোনো আজব ঘটনা ঘটল আমার সাথে। জানিনা কার শকুনের দৃষ্টি পড়েছে আমার উপরে। যদি একবার ঐ শুকুনকে হাতের কাছে পাইনা? তো আই সোয়ের একে আমি ডা’ণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করব!”

জায়মা শান্ত ভঙ্গিতে চাঁদের কাঁধে হাত রাখল। চাঁদকে নিয়ে সামনে হাঁটা ধরল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ভাবছাড়া গলায় বলল,,

“আচ্ছা বাদ দে এসব। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন বাড়ি ফিরে চল। বিকেল সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে অলরেডি। বাড়ি ফিরতে আর একটু দেরি হলেই দেখবি আয়মন ছুটে আসবে। আর তখন আমাদের একশটা জবাবদিহি করতে হবে।”

তাশফিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাঁদ এবং জায়মার দিকে তাকালো। কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আচ্ছা তোদের এই আয়মন ভাইয়াটা কে রে? যখনই শুনি তখনই ঐ আয়মন ভাইয়া। এই আয়মনটা কে?”

অমনি আয়মনের আবির্ভাব ঘটল চাঁদ, জায়মা এবং তাশফিয়ার সম্মুখে! বাড়ি ফিরতে তাদের দুজনের দেরি হচ্ছিল দেখে আয়মন বাইক নিয়ে হন্ন হয়ে ছুটে এসেছে তাদের খোঁজে! চাঁদ এবং জায়মাকে একত্রে দেখামাত্রই আয়মন বাইক থেকে নেমে এলো। রক্তিম চক্ষুজোড়া নিয়ে চাঁদ এবং জায়মার মুখোমুখি দাঁড়ালো। কঠিন গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“ঘড়িতে কয়টা বাজছে হ্যাঁ? কী করছিলি তোরা এতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?”

প্রবল ভয়ের বশবর্তী হয়ে চাঁদ এবং জায়মা মাথা নুইয়ে নিলো। প্রত্যত্তুরে কী বলবে তাই ভাবছিল। তবে চাঁদ এখনই আয়মনকে ঐ ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করতে চাইছেনা। আরেকটু সয়ে রয়ে জানাতে চাইছে। অপরদিকে, তাশফিয়া গরম চোখে আয়মনের দিকে তাকাচ্ছে! আক্রোশিত ভাব নিয়ে কোমরে হাত গুজে আয়মনকে দেখছে। পরক্ষণেই আয়মনকে উদ্দেশ্য করে তাশফিয়া তটস্থ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই আপনি সেই ছেলেটা না? যে ছেলেটা ঐদিন আমাকে দেখে বাজে গানটা গাইছিলেন?”

তাৎক্ষণিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে আয়মন তাশফিয়ার দিকে তাকালো। অমনি আয়মনের রক্তিম চক্ষুজোড়া আরও টগবগে রক্তিম হয়ে উঠল! মাথায় তার অঢেল রাগ চেপে বসল। সেইদিনের সেই চড়ের আওয়াজটা তার কানে সূক্ষ্মভাবে বাজতে লাগল! অবিলম্বেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আয়মনের। চড়ের প্রতিশোধ নিতে সে মরিয়া হয়ে উঠল। রাগান্বিত ভাব নিয়ে তাশফিয়ার মুখেমুখি দাঁড়ালো। কড়া গলায় বলল,,

“ইউ ইডিয়ট গার্ল। আজ তো আপনার ছাড় নেই আমার হাত থেকে! এতোদিন ধরে অনেক খুঁজেছি আপনাকে কিন্তু পাইনি। আজ যখন আপনাকে হাতের কাছে পেয়েছি সেই সুযোগ আমি কিছুতেই হাতছাড়া করবনা।”

অনর্গল কথাগুলো বলে আয়মন যেই না হাত উঠিয়ে তাশফিয়ার গালে চড় বসাতে যাবে অমনি উত্তেজিত হয়ে চাঁদ এবং জায়মা আয়মনের হাত টেনে ধরল! বিস্ফোরিত গলায় সমস্বরে বলল,,

“আরেহ্ ভাইয়া থামো। কী করছ কী তুমি?”

তাশফিয়া ভয়ে এতক্ষণে হাত দ্বারা চোখ-মুখ ঢেকে নিয়েছিল! হঠাৎয়ের মধ্যে ঘটনাটা ঘটে যাওয়ায় তাশফিয়া বড্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এই পর্যায়ে এসে চাঁদ এবং জায়মার অভয় পেয়ে তাশফিয়া মুখ থেকে হাতটা সরালো। পিটপিটে চোখে আয়মনের দিকে তাকালো। চাঁদ এবং জায়মা আয়মনকে ঠেলতে ঠেলতে পেছনের দিকে নিয়ে এলো। তবুও যেনো আয়নকে সামলানো যাচ্ছেনা! গরম চোখে তাশফিয়ার দিকে তাকাচ্ছে। হাত-পা ছুড়াছুড়ি করে তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় চাঁদ এবং জায়মাকে বলছে,,

“এই আমাকে ছাড় তোরা। তোরা জানিস না এই মেয়েটা আমার সাথে ঐদিন কী করেছে।”

চাঁদ হাঁপিয়ে ওঠা গলায় আয়মনকে বলল,,

“কী করেছে ভাইয়া?”

“চড় মেরেছিল ঐদিন এই মেয়েটা আমাকে!”

চাঁদ এবং জায়মা থম মেরে গেল! অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে পিছু ফিরে তাশফিয়ার দিকে তাকালো। তারা দুজন যেনো বিশ্বাসই করতে পারছেনা তাশফিয়া এই কাজটা করেছে! তাশফিয়া শুকনো মুখে চাঁদ এবং জায়মার দিকে তাকালো। ভয়ে খানিক ঘাবড়ে উঠল। ক্ষীণ গলায় বলল,,

“আমি কী করব বল? তোদের এই ভাইয়াটাই তো ঐদিন আমাকে দেখে বাজে গানটা গাইছিল। তাই আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। ঠাস করে গালে চড় বসিয়ে দিয়েছি।”

আয়মন এতক্ষণে চাঁদ এবং জায়মার কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে রুদ্রাক্ষের ন্যায় গরম হয়ে তেড়ে এলো তাশফিয়ার দিকে! শার্টের কলার ঝেড়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল,,

“হ্যালো এক্সকিউজ মি। ঐদিন ইচ্ছেপূর্বকভাবে আমরা আপনাকে দেখে গানটা গাই নি ওকে? বন্ধুরা মিলে এয়ারফোনে গান শুনছিলাম। আর তখনই আমাদের সামনে আপনার উদয় ঘটল। কিছু না বুঝে, শুনেই ঠাস করে আমার গালে চড় বসিয়ে দিলেন। তাছাড়া ঐদিন নূরের মুখ থেকে গানটা জোরে বের হয়েছিল। আমার মুখ থেকে নয়। সেক্ষেত্রে দোষ যদি হতো তবে নূরের হতো আমার নয়। চড়টাও নূরের গাঁয়ে পড়ত আমার গালে নয়। অন্যায় করেছিল একজন আর আপনি তার শাস্তি দিয়েছিলেন অন্যজনকে৷ এখন এর ফল তো আপনাকে ভোগ করতেই হবে!”

আয়মন আবারও গরম হয়ে হাত উঠিয়ে তাশফিয়ার দিকে তেড়ে আসতেই চাঁদ এবং জায়মা দুইদিক থেকে আয়মনকে চেপে ধরল। চাঁদ মৃদু আওয়াজে ভীতসন্ত্রস্ত তাশফিয়াকে বলল,,

“এই তাশফিয়া তুই এখন পালা এখান থেকে। আগামী পরীক্ষায় আমাদের দেখা হচ্ছে ওকে?”

আল্লাহ্’র নাম জপ করতে করতে তাশফিয়া জান নিয়ে জায়গা থেকে পালালো! পিছু ঘুরে আর একবারও তাকালো না। এখান থেকে পালিয়ে গেলেই সে যেনো এখন জানে বাঁচে! কিছুদূর যেতেই তাশফিয়া রিকশা করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আয়মন নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে উঠল। চাঁদ এবং জায়মাকে গাঁ থেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তেজস্ক্রিয় গলায় বলল,,

“এই তোরা আমাকে ছাড় বলছি। আজ এই মেয়েটাকে আমি কিছুতেই ছাড়বনা। আমার হাত থেকে এই মেয়ের আজ নিস্তার নেই।”

জায়মা তিক্ততা প্রকাশ করল। বিরক্তিমাখা গলায় বলল,,

“ভাইয়া প্লিজ থামো। তাশফিয়া আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ড হয়। তুমি আমাদের সামনে ওর সাথে এমন আক্রমনাত্নক ব্যবহার করতে পারোনা। তাকে ইনসাল্ট করতে পারোনা।”

চাঁদও জায়মার কথায় সহমত পোষণ করল। আয়মনকে চেপে ধরে উঁচু গলায় বলল,,

“হ্যাঁ ভাইয়া প্লিজ শান্ত হও তুমি। যা হওয়ার হয়ে গেছে। দোষ হলে এখানে সম্পূর্ণ দোষ ঐ নূরের বাচ্চার হয়েছে! পারলে ঐ বজ্জাত নূরকে ধরো তুমি। তাকে মা’রধর করো! কারণ, সে তোমাকে ইচ্ছেপ্রণোদিতভাবে ফাঁসিয়েছে! অযথা তুমি আমার ফ্রেন্ডের পিছনে লেগেছ কেন হ্যাঁ?”

আয়মন এবার কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলো। ছোটোছুটি থামিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালো। শান্ত গলায় চাঁদকে শুধালো,,

“তার মানে তুই বলছিস এখানে সম্পূর্ণ দোষ নূরের ছিল?”

“হ্যাঁ নূরের-ই তো ছিল! নূর কেন তাশফিয়াকে দেখে এতো জোরে গানটা টান দিতে গেল হ্যাঁ? আর পরে কেন ব্যাপারটা ক্লিয়ার করল না? নূরের তো রাইট ছিল ব্যাপারটাকে হ্যান্ডেল করার।”

আয়মন ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টা ভাবল। মনে মনে যোগ-বিয়োগ কষিয়ে চাঁদের কথার সত্যতা বিচার করল। পরক্ষণে-ই আবার আয়মন উত্তেজিত হয়ে উঠল। তটস্থ গলায় বলল,,

“আর একবার ঐ নূরের বাচ্চাকে সামনে পেয়ে নিই! শালাকেও যদি আমি মেয়েদের হাতের চড় না খাওয়াই তো আমার নামও আয়মন নয়!”

___________________________________

চারিদিকে সন্ধ্যা নেমে আসতেই চাঁদ, জায়মা এবং আয়মন তাদের বাড়ি ফিরে এলো। আয়মন তার বাইকটা বাড়ির আঙিনায় পার্ক করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। চাঁদ এবং জায়মা দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। দুজনই বেশ ক্লান্ত এবং অবসন্ন। ক্ষুধায় পেট চোঁ-চোঁ করছে দুজনেরই। তাছাড়া আজ একের পর এক যে অভাবনীয় ঘটনাগুলো ঘটল তার জাল থেকে যেনো তারা কেউ-ই বের হতে পারছেনা। চাঁদকে টপকে জায়মা আগে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। কারণ জায়মাকে এখন সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠতে হবে। কারণ, তিনতলাটা হলো জায়মাদের। দুতলা চাঁদদের এবং একতলাটা আয়মনদের। আয়মনের বাবার সাথে জায়মার বাবার খুব ভালো সম্পর্ক। তাই তারা একসাথেই জায়গা জমি ক্রয় করে এই তিনতলা বিশিষ্ট বাড়িটা বানায়। এর সুবাদে চাঁদের মা এবং জায়মার মা দুই বোন মিলে একই বাড়িতে থাকতে পারে। এক সাথেই থাকা-খাওয়া করতে পারে।

জায়মাকে অনুসরণ করে চাঁদ সদর দরজার কাছে আসতেই হঠাৎ চোখ পড়ল পার্কিং এরিয়ায় পার্ক করে রাখা সাদা মাইক্রোকারটির দিকে! মুহূর্তের মধ্যেই কপাল কুঁচকে নিলো চাঁদ। পিছনে থাকা আয়মনকে লক্ষ্য করে বলল,,

“কী ব্যাপার ভাইয়া? আমাদের বাড়িতে কি আজ গেস্ট এসেছে?”

প্যান্টের পকেটে চাবিটা ঢুকিয়ে নিলো আয়মন। ভাবলেশ গলায় বলল,,

“আমি কী করে জানব? আমিও তো মাত্র বাড়িতে এলাম। হয়তো আব্বুর বন্ধু-টন্ধু এসেছে।”

অমনি আয়মনের আকস্মিক দৃষ্টি পড়ল বাড়ির পেছনের ফাঁকা গ্রাউন্ডে। যে গ্রাউন্ডটার ঝোপঝাড় কেঁটে আয়মন মাত্র একমাস আগেই একটা ক্রিকেট খেলার মাঠ বানিয়েছিল। এলাকায় খোলা কোনো মাঠ নেই বিধায় খেলাধূলা করতে তাদের অনেক অসুবিধা হয়। সেই অসুবিধা দূর করার জন্যই মূলত আয়মনের এই সিদ্ধান্তটি নেওয়া। এখন খেলাধূলার পাশাপাশি এই মাঠটিতে বসে ফ্রেন্ড সার্কেল মিলে নিরিবিলি আড্ডাও দেওয়া যায়। বাড়ির কোনো ছোটো খাটো অনুষ্ঠানও এই জায়গাটিতে অনায়াসে করা যায়। সচকিত দৃষ্টিতে আয়মন ক্রিকেট খেলতে থাকা নূর, মাহিন, সাব্বিরের পাড়ার কয়েকটা ফ্রেন্ড সার্কেলের দিকে তাকালো! নূর ব্যাটিং করছে এবং মাহিন বলিং করছে। মাত্র লম্বা একটা চার মেরে নূর এবং সাব্বির দৌঁড়ে তাদের জায়গা পরিবর্তন করল। চার মারার খুশিতে নূর লাফ ঝাপ মারতে লাগল। আয়মনের বিস্ময়াত্নক দৃষ্টি এখনো স্থির নূরের দিকে। বিস্ময়জনক দৃষ্টতে আয়মনকে দেখে চাঁদ ভ্রু কুঁচকালো। দ্বিধায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“হোয়াইট’স হ্যাপেনিং ভাইয়া? তুমি এভাবে মাঠের দিকে কী দেখছ? তোমার ফ্রেন্ডসরা কী খেলতে চলে এসেছে?”

ঘোর কাটিয়ে আয়মন এবার প্রফুল্ল হাসল। আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে লাফাতে শুরু করল। উত্তেজিত গলায় বলল,,

“ইয়েয়েয়েস! নূর এবং মাহিন এসে গেছে!”

আয়মন আর এক মুহূর্ত ব্যয় করল না। এক ছুটে বাড়ির পেছনের গ্রাউন্ডে চলে গেল। খুশিতে নাচতে নাচতে নূর এবং মাহিনকে লক্ষ্য করে উল্লাসিত গলায় বলল,,

“আজ তো আমাদের ইদ লেগে গেল ইয়ার!”

আয়মনকে দেখামাত্র নূর এবং মাহিন হেসে উঠল। ব্যাট বল রেখে দুজনই আয়মনের কাছে দৌঁড়ে এলো। নূর কদাচিৎ হেসে ব্যগ্র গলায় বলল,,

“হ্যাঁ মামা। আজ তো তোর চড় খাওয়ারও ছয়মাস পূরণ হয়ে গেল!”

উচ্ছ্বাস ভুলে আয়মন বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো! আয়মনের মুখভঙ্গি দেখে নূর হু হা করে হেসে উঠল। নূরের এই গাঁ জ্বলা হাসি দেখে রাগে আয়মনের গাঁ রি রি করে উঠল! পুরনো ঘাঁ তার তাজা হয়ে উঠল। চোয়াল শক্ত করে কিছু বলার পূর্বেই মাহিন আয়মনের কাঁধে হাত রেখে প্রসঙ্গ পাল্টানোর পায়তারা করল। খিটখিটে মেজাজে বলল,,

“কেয়া ইয়ার? এতমাস পর আমাদের দেখা হলো আর তোরা কী চড় থাপ্পড় নিয়ে পড়ে গেছিস।”

মাহিনের কথায় আয়মন মুড অন করে নিলো। চড়ের প্রসঙ্গ ভুলে আবেগে ঘনীভূত হয়ে তিনজন তিনজনকে জড়িয়ে ধরল। লাফিয়ে লাফিয়ে তারা আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল! মনে হলো যেনো কতবছর পর তাদের একসাথে দেখা। কত আবেগ, কত ভালোবাসা, কত অপেক্ষা নিয়ে আবারও তাদের একসাথে হওয়া। বন্ধুত্বের সম্পর্কটাই যেনো এমন হাজার হাজার মিশ্র অনুভূতির সংমিশ্রণ। বন্ধুত্ব মানেই হলো- “একটি আত্মা, দুটি জান।”

নূরের নামটা শোনামাত্রই চাঁদ কেমন যেনো অন্যমনস্ক হয়ে গেল! চোখ দুটো তার অদ্ভুত নেশায় চঞ্চলা হয়ে উঠল। সেই চঞ্চলা চোখকে চাঁদ আর বাঁধ সেঁধে রাখতে পারলনা! দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে এক চোখা দৃষ্টিতে পেছনের খালি গ্রাউন্ডে উঁকি মারল! দূর থেকে হাসোজ্জল অবস্থায় নূরকে দেখামাত্রই তাৎক্ষণিক চাঁদ চোখজোড়া বুজে নিলো! শুকনো ঢোক গিলে জায়গা থেকে সরে এসে দেয়ালে পিঠ ঠেঁকিয়ে দাঁড়ালো। বুকটা তার অসম্ভবভাবে কাঁপতে আরম্ভ করল। কম্পিত বুকে সে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। সন্দিহান গলায় বলল,,

“সত্যিই কি ঐ মাতালটা এসেছে?”

চোখজোড়া খুলে চাঁদ পুনরায় এক চোখে বাড়ির পেছনের গ্রাউন্ডে তাকালো। অমনি তার দৃষ্টির সামনে থেকে নূর উধাও হয়ে গেল! চাঁদ তাজ্জব বনে গেল। চোখ কচলে আবারও পূর্ণদৃষ্টিতে গ্রাউন্ডে তাকালো। এবারও নূরকে কোথাও দেখতে পেলনা! চাঁদ এবার উদ্বেগী হয়ে উঠল। শুকনো ঢোক গিলে বলল,,

“মাতালটা গেল কই? একটু আগে তো এখানে-ই ছিল!”

উদগ্রীব হয়ে চাঁদ দেয়ালের পাশ থেকে সরে আসতেই হঠাৎ তার কণর্কুহরে কারো উত্তপ্ত নিশ্বাসের অনুভূতি পেল! থতমত খেয়ে উঠল চাঁদ! শীঘ্রই বুকে থুঃথুঃ ছিটিয়ে চোখ বুজে নিলো। ভয়ার্ত গলায় বলল,,

“মাগো! কে আবার আমার কানে এমন উত্তপ্ত হাওয়া দিলো? এই বাড়িতে আবার ভূত-প্রেতের আছড় হলো না তো?”

চাঁদের কাণ্ডকীর্ত দেখে নূর হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছিলনা! তবে এই মুহূর্তে তার হাসতে বড্ড ইচ্ছে করছে। তবে এখনই হেসে দিলে চলবেনা! চাঁদকে আরও কাছ থেকে পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখতে হবে! চোখের তৃষ্ণা তার মিটিয়ে নিতে হবে। চাঁদের নিশ্বাসে আরও গাঢ়ভাবে মিশতে হবে। চাঁদের নেশায় মত্ত হয়ে উঠল নূর। একটু একটু করে চাঁদের কানের লতিতে জোরদার ভাবে মুখ ঠেঁকালো। নেশা ভরা গলায় বলল,,

“আমি এখানে।”

চাঁদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। নূরের গলার স্বর শুনে চোখজোড়া খুলে নিলো। মাথাটা বাঁ পাশে ঘুরালো। অমনি তার দৃষ্টির সীমানায় শরীরের অর্ধেক জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নূরকে দেখতে পেল! কানের লতি থেকে নূর মুখটা সরিয়ে বাঁকা চাহনিতে চাঁদের দিকে তাকালো। বেখায়ালী দৃষ্টিতে চাঁদের বুকের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“ইউ আর লুকিং সো হ’ট!”

চাঁদ বিষম খেলো! কম্পিত দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। হিজাব দ্বারা বুকটা ভালোভাবে ঢেকে নিলো। নিজেকে ঠিকঠাক করে চাঁদ এবার উজবুক দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। চাঁদের অবস্থা দেখে নূর ফিক করে হেসে দিলো। কাঁধটা বাঁ দিকে খানিক বাঁকা করে আসক্ত গলায় বলল,,

“এভাবে ফ্যাল ফ্যাল চোখে আমার দিকে তাকিও না প্লিজ! ভুলভাল কিছু ঘটে গেলে কিন্তু তখন আমায় খুঁজে পাবেনা! তোমাকে বদনাম করে আমি নিরুদ্দেশ হবো। যেনো তোমার খুঁজে আমি নই…তবে তুমি আমার খুঁজে দিশেহারা হয়ে ওঠো!”

#চলবে…?

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৩৩
#নিশাত_জাহান_নিশি

“এভাবে ফ্যাল ফ্যাল চোখে আমার দিকে তাকিও না প্লিজ! ভুলভাল কিছু ঘটে গেলে কিন্তু তখন আমায় খুঁজে পাবেনা! তোমাকে বদনাম করে আমি নিরুদ্দেশ হবো। যেনো তোমার খুঁজে আমি নই…তবে তুমি আমার খুঁজে দিশেহারা হয়ে ওঠো!”

তৎক্ষনাৎ চাঁদের মাথা ঘুরে এলো! নিষ্ক্রিয় দৃষ্টিতে নূরের নেশালো দু’চোখে তাকালো। এক নিমিষেই ভেতরটাকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দেওয়ার মতো মারাত্নক নেশাভরা চাহনি নূরের! ক্রমশ নূরের সেই নেশাক্ত চাহনি গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল। চাঁদ যেনো ক্রমাগত ডুবে যাচ্ছিল সেই গহীন চাহনিতে! তক্ষণি হঠাৎ চারিদিকে মাগরিবের আযান পড়ে গেল। আযানের মধুর ধ্বনিতে চাঁদ সম্বিত ফিরে পেলো। শুকনো ঢোক গিলে নূরের দিকে তাকালো। ঢুলুঢুলু শরীরে দেয়ালের সাথে আরও ঘেঁষে দাঁড়ালো। দুড়ুদুড়ু বুকে দম বন্ধ হয়ে আসার অনুভূতি পেল। মনে মনে আওড়ে বলল,,

“হলো কী এই লোকটার? এমন মজনু টাইপ কথাবার্তা বলছে কেন? হাব-ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেনো আজও আবার দু’ঘোট মেরে এসেছে!”

চাঁদের মায়াবিনী দু-চোখ থেকে এতক্ষণে দৃষ্টি সরলো নূরের। সেই চঞ্চলা দৃষ্টি এখন স্থির হলো চাঁদের কপালের ভাজে পড়ে থাকা বেহায়া চুলগুলোর দিকে! বারে বারে চুলগুলো চাঁদের চোখে-মুখে উড়ে পড়ছিল। যার কারণে চাঁদের মনোহরা দু’চোখে তাকাতে নূরের বেশ ডিস্টার্ব হচ্ছিল! দেয়ালে এক হাত ঠেকিয়ে নূর জোরে শ্বাস নিলো। মন্থর গতিতে চাঁদের কপালে পড়ে থাকা চুলগুলোতে ফুঁ দিলো। অমনি চুলটা উড়ে মাথায় তার জায়গা গ্রহণ করে নিলো। মুখে তপ্ত শ্বাসের হাওয়া পেয়ে চাঁদ ঝট করে চোখজোড়া বুজে নিতে বাধ্য হলো। গাঁয়ের প্রতিটা লোমকূপ তার হুড়হুড় করে দাঁড়িয়ে পড়ল। অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ডুবে গেল। সহসা সেই অনুভূতি কাটিয়ে উঠতে পারছিল না সে। চোখ মেলেও কোনোদিকে তাকাতে পারছিল না। উত্তেজনায় যেনো ভেতরে ভেতরে দুমড়ে-মুচড়ে ম’রছিল সে। চাঁদের এই নিমগ্ন অবস্থা দেখে নূর তৎক্ষণাৎ জায়গা থেকে সরে দাঁড়ালো। সরু চাহনিতে চাঁদের উতলা মুখমণ্ডলে তাকালো। গলা খাঁকিয়ে শ্লেষাত্মক হেসে বলল,,

“ক্লাইমেক্স তো অলরেডি শেষ মিস চাঁদ! সো এবার আপনি ফিল নেওয়াটা বন্ধ করুন। আপনার ফিল নেওয়া দেখে এবার আমারও সাংঘাতিক ফিল হচ্ছে!”

নূরের এহেন বেহায়াপূর্ণ কথাবার্তায় চাঁদ সম্বিত ফিরে পেলো। তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে অগ্রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তবে হয়রানির বিষয় হলো নূর তার সামনে থেকে কোথায় যেনো উধাও হয়ে গেল! ছটফটিয়ে ওঠে চাঁদ বুকে এক গাঁধা থুঃথুঃ ছিটালো। অধীর দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকালো। কম্পিত গলায় বলল,,

“মাতালটা কি আবার হাওয়া হয়ে গেল?”

এই মুহূর্তে নিজেকে ধাতস্থ করার জন্য চাঁদ কয়েক মিনিট সময় নিলো। অতঃপর আর এক মুহূর্তও ব্যয় না করে ধুকপুক বুকে দৌঁড়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। অস্থিরমনা হয়ে সিঁড়ি টপকে দু’তলায় ওঠে গেল। কম্পিত হাতে দু’তলার কলিংবেল চাপতেই কেউ এসে দরজাটা খুলে দিলো। ব্যাকুল চাহনিতে চাঁদ অগ্রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ভয়ে আবারও দু’কদম পিছিয়ে গেল! দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নূর! ঠোঁটে তার অফুরান বাঁকা হাসির রেখা। নূরকে আবারও সামনে দেখে চাঁদ তাজ্জব বনে গেল। মনে মনে আওড়ে বলল,,

“এই লোকটা আবার এখানে কখন এলো? এর সাথে কী জ্বিন-ভূত আছড় করল না-কি?”

চাঁদের মৌনতা দেখে নূর মনে মনে খুব হাসল। তবে তা বাইরে প্রকাশ করল না। দু’কদম এগিয়ে এসে চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়ালো৷ এই প্রথম চাঁদের সাথে দেখা হয়েছে এমন একটা ভাব নিলো। মিষ্টি হেসে বলল,,

“হায়।”

চাঁদ শুকনো ঢোক গিলল। কাঠ কাঠ গলায় বলল,,

“আআআপনি এএখানে ককখন এলেন?”

“এখানে কখন এলাম মানে? আমি তো প্রথম থেকেই এখানে ছিলাম!”

“তাহলে ওখানে কে ছিল?”

“কোনখানে?”

“আরেহ্ নিচতলায়।”

“কই আমি তো ছিলাম না!”

“ছিলেন না মানে? আপনি-ই তো নিচের গ্রাউন্ডে আমার গাঁয়ের সাথে একদম ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলেন। অদ্ভুত চাহনিতে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। কানে কানে কীসব আজগুবি কথা বলেছিলেন। আমার চুলে ফুঁ দিচ্ছিলেন। আজব আজব আচরণ করছিলেন।”

নূর অবুঝ ভাব নিলো! ভ্রু জোড়া সরু করল। নির্বোধ গলায় বলল,,

“সিরিয়াসলি? আমি তোমার সাথে এসব করছিলাম? সত্যিই কি ওটা আমি ছিলাম? তুমি ঠিক দেখেছ তো?”

চাঁদ শুষ্ক মুখে নূরের দিকে তাকালো। ভয়ার্ত গলায় বলল,,

“হ্যাঁ আপনি-ই তো ছিলেন। একটুও ভুল হয়নি আমার। হলফ করে বলতে পারি ওটা আপনি-ই ছিলেন।”

ভাবশূণ্য ভঙ্গিতে নূর চাঁদের মাথায় গাড্ডা মারল। হেয়ালি কণ্ঠে বলল,,

“তোমার মাথাটা গেছে বুঝলা? সেই কখন-ই তো আমি আয়মনের সাথে দেখা করে উপরে ওঠে গেছি! তো নিচতলায় তুমি আমাকে কীভাবে দেখবা বলো?”

মাথায় চক্কর এলো চাঁদের! আলুথালু চোখে সে নূরের দিকে তাকালো। চাঁদের বর্তমান অবস্থা দেখে নূর মনে মনে তৃপ্তির হাসি হাসল! চাঁদ উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠল। কী হচ্ছে না হচ্ছে এসব ভেবে চিন্তিত হয়ে উঠল। অমনি সিঁড়ি বেয়ে আয়মন এবং মাহিনের আগমন ঘটল। তারা দুজন এসে চাঁদ এবং নূরের মুখোমুখি দাঁড়ালো। হাঁপানো গলায় আয়মন নূরকে বলল,,

“কীরে? সেই কখন তো উপরে ওঠে এলি। এখনও নামার নাম নিলি না।”

আয়মনের কথায় চাঁদ বিষম খেলো! তবে তো নূর সত্যিই বলছিল। অনেক আগেই নূর উপরে ওঠে গেছে। তাহলে ঐ সময় চাঁদের সামনে কে ছিল? কোনোভাবে মাহিন চাঁদের সাথে ঐসময় দুষ্টুমি করেছিল না তো? চাঁদ এবার সন্দেহজনক দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“মাহিন ভাইয়া। আপনি-ই কি তাহলে ঐ সময় আমার সাথে ব’জ্জাতিগুলো করছিলেন?”

মাহিন ভড়কে উঠল। বোকা দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। উজবুক গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“মানে? আমি কখন কী করছিলাম?”

ধরা পড়ার ভয়ে নূর এবার প্রসঙ্গ পাল্টাতে মরিয়া হয়ে উঠল! আয়মনকে লক্ষ্য করে অনর্গল বলল,,

“আরেহ্ ভাই, তোর বোনের মাথাটা গেছে! একে তাড়াতাড়ি বিয়ে দে না হয় ভালো কোনো সাইকোলজিস্ট দেখা। কখন থেকে কীসব ভাট বকছে! একে একে সবাইকে বিভ্রান্ত করছে।”

চাঁদের চোখের দিকে তাকিয়ে নূর একচোখ টিপল! ফটাফট মাহিনের কাঁধে হাত রেখে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। যেতে যেতে চাঁদকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“তোমার কোনো পছন্দের পাত্র থাকলে বলতে পারো চাঁদ। আমরা দেখে-শুনে বিয়ে পড়িয়ে দিব। তবে-ই যদি তোমার একটু আগের বলা ফিলিংস গুলো কমে! আই মিন কারো তোমার গাঁ ঘেঁষে দাঁড়ানো, চোখে চোখ রাখা, কানে কানে কথা বলা, চুলে ফুঁ দেওয়া। এসব আর কী!”

আয়মন এবং মাহিন দুজনই বেকুব দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। তার কথার আগা মাথা কিছুই খুঁজে পেলনা তারা। তবে চাঁদ এবার বিপুল জিদ্দি হয়ে উঠল। হাত-পা কচলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আয়মনের দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“ভাইয়াআআআআ… ঐ নূরের বাচ্চাকে বলো চুপ করতে। একদম আমার সাথে হিটলারি না করতে।”

আয়মনকে প্রত্যত্তুর করার সুযোগ দিলো না চাঁদ। হনহন করে দরজা ঠেলে ড্রয়িংরুমে ঢুকে পড়ল। সামিয়া আহমেদের রুম থেকে সাবরিনা আবরার এবং হাবিব আবরারের হাসি-ঠাট্টার আওয়াজ কানে এলেও চাঁদ সেদিকে মনযোগ দিলো না! গুমরো মুখে ঝট করে তার রুম ঢুকে পড়ল। দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে ফাইলটা বিছানার উপর ছুড়ে মারল। গাঁ থেকে হিজাবটা খুলে রাগে গজগজ করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। আয়নায় তার রাগী প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“নূরের বাচ্চা নূর! কুমিল্লা বয়ে এসেছিস আমার সাথে ফস্টি-নস্টি করতে? আমার সাথে মজা নিতে এসেছিস তুই? আর একবার আমার সাথে মজা করতে আসিস তুই, ঠিক ঠেং ভেঙে রেখে দিব তোর!”

উড়নচণ্ডী ভাব নিয়ে চাঁদ ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। ফ্রেশ হয়ে প্রথমে তার খালামনি এবং আঙ্কেলের সাথে দেখা করবে এরপর হালকা জাতীয় কিছু খাবার খাবে তারপর নিশ্চিন্ত মনে পড়ার টেবিলে পড়তে বসবে। পরের এক্সামটা খুবই কঠিন তার। তাই যার প্রিপারেশন তাকে আজ রাত থেকেই খুব ভালোভাবে নিতে হবে।

তখনি চাঁদের রুমের দরজা ঠেলে নূর ধীর পায়ে হেঁটে চাঁদের রুমে প্রবেশ করল! পুরো রুমে একবার সূক্ষ্ম দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো। কদাচিৎ হেসে ধপ করে চাঁদের বিছানায় শুয়ে পড়ল। মাথায় এক হাত রেখে উপরে তাকালো। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলল। সম্মোহনী গলায় বলল,,

“তোমার মনকে হয়রান করে তুলতে-ই আমি ফিরে এসেছি চাঁদ! এতো সহজে আমি তোমার কাছে ধরা দিবনা! প্রয়োজনে সারাজীবনভর তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি অপেক্ষা করব। তোমার ভালোবাসা পাওয়ার আশায় নিজেকে প্রতিনিয়ত দ্বগ্ধ করব। সেই দ্বগ্ধের আগুনে জ্বলে পুড়ে নিজেকে খাঁটি সোনায় পরিণত করব! তবেই যেনো তোমার মন গলে আমার ভালোবাসায়।”

,
,

রুমের দরজা ভেতর থেকে লক করে সোহানী বিছানার উপর বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে! তার কান্নার প্রধান এবং অন্যতম কারণ হলো নীড়। নীড়ের আজ এই বাড়িতে আসার কথা ছিল। সোহানীকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথাবার্তা ভাঙ- চূড়ের কথা ছিল। কিন্তু আজ সে আসেনি! কাজের বাহানায় খুব সূক্ষ্মভাবে সোহানীকে উপেক্ষা করে গেছে। বিয়ের এতোগুলো মাস পরেও নীড় সোহানীকে এখনো মন থেকে মেনে নিতে পারেনি বলে সোহানীর ধারণা। তাই তো বিয়ের এতোগুলো মাস পরেও বউয়ের প্রতি তার নেই কোনো যত্ন, ভালোবাসা, টান বা মায়া। সোহানী এই বিষয়টাতে খুব বেশি আ’হত। যার কারণে তার কান্নার মাত্রা ক্রমাগত বেড়ে চলছে।

কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে সোহানী এক পর্যায়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। নীড়ের জন্য ঘটা করে পড়া লাল শাড়িটা একটানে গাঁ থেকে খুলে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে ঠিক হেচকি তুলে ফেলল। চোখ জোড়া অসম্ভব লাল হয়ে উঠল তার। তুখার জেদ দেখিয়ে সে হাত থেকে লাল চুড়ি জোড়া খুলে নিতেই হঠাৎ তার রুমের দরজায় টোকা পড়ল। অবিশ্বাস্যভাবেই নীড়ের গলার আওয়াজ তার কানে তীক্ষ্ণভাবে বিঁধে গেল! তব্ধিত দৃষ্টিতে সে দরজার দিকে তাকালো। না হাসল না কাঁদল। কোনোরকম প্রতিক্রিয়া-ই করল না। পুরোপুরি থম মেরে গেল। পকেটে হাত গুজে নীড় ধীর গলায় সোহানীর নাম ধরে ডাকল। দরজায় টোকা মেরে বলল,,

“সোহানী শুনছ? দরজাটা খোলো।”

অনুভূতিশূণ্য হয়ে সোহানী অর্ধ ন’গ্ন অবস্থাতেই দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমের দরজাটা খুলে দিলো। রুদ্ধকর শ্বাসে এক ঝলক নীড়ের দিকে তাকালো। ঘটনার আকস্মিকতায় নীড় বেচারা শুকনো ঢোক গিলল! সোহানীর অর্ধন’গ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে ৪৪০ ভোল্টের ঝটকা খেলো! সঙ্গে সঙ্গেই নীড় সোহানীর শরীরের উপর থেকে গোল গোল চোখজোড়া সরিয়ে নিলো। অবিলম্বেই মাথা নুয়াতে বাধ্য হলো। অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে এড়াতে শার্টের কলার ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। থমথমে গলায় বলল,,

“এর আবার কী হলো? ফার্স্ট নাইটের প্রিপারেশন কি এখন থেকেই নিচ্ছে?”

নীড়ের মিনমিনিয়ে বলা কথাগুলো সোহানীর খাড়া কান অবধি কথাগুলো পৌঁছাতে বেশি সময় নিলো না! নীড়ের কুচুটে কথায় এতক্ষণে সোহানীর ঘোর কাটল! রিয়েক্ট করতে গিয়েও বেচারি থেমে গেল। কারণ, এই মুহূর্তে নীড়ের সাথে তার কথা বাড়াতে একদম ইচ্ছে করছে না। সম্বিত ফিরে পেয়েও সে নীড়ের অস্বস্তিবোধ কাটাতে অস্বীকৃতি জানালো! বিষাদ ভুলে বেশ ভাব নিয়ে পিছু ঘুরে রুমে ঢুকে পড়ল। নীড়কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। ডান হাতে থাকা বাকি চুড়িগুলো এক এক করে খুলতে লাগল। নীড়কে এই মুহূর্তে সে বেশ ব্যস্ততা দেখালো। নীড় তার আশেপাশে আছে বলেও গ্রাহ্য করল না। এমনকি নীড়কে রুমে ঢুকতেও বলল না। নাক টেনে কেঁদে তার নিজস্ব কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ব্যাপারটায় নীড় বেশ অবাক হলো! সোহানীর দিক থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে সে বিনা অনুমতিতে রুমে ঢুকে পড়ল। দরজা আটকে ভীতু গলায় বলল,,

“তাওয়া বেশ গরম হয়ে আছে! কখন গাঁয়ে ফোঁসকা পড়ে আল্লাহ্ মালুম।”

সোহানীর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নীড় শার্টের কলার থেকে টাই-টা খুলল। ধীর পায়ে হেঁটে এসে সোহানীর পেছনে দাঁড়ালো। আয়নায় সোহানীর কান্নায় এবং রাগে লাল হয়ে থাকা ফোলাফালা মুখমণ্ডলের দিকে তাকালো। শার্টের কলারটা ঠিক করে ইতস্তত গলায় বলল,,

“এক গ্লাস পানি দেওয়া যাবে?”

সঙ্গে সঙ্গেই সোহানী হাতে থাকা চুড়িগুলো ফ্লোরে ছুড়ে মারল! রক্তিম চোখে পিছু ঘুরে দাঁড়ালো। অবিশ্বাস্যভাবেই নীড়ের শার্টের কলার চেপে ধরল! মৃদু চিৎকার করে বলল,,

“কেন বাইরে থেকে পানি খেয়ে আসিস নি? অফিসের হ’ট স্টাফরা তোকে ঠিকঠাকভাবে পানি খাইয়ে আমার কাছে পাঠায়নি? এখন কেন আমার কাছে এসেই তোর পানির পিপাসা পেয়ে বসল হ্যাঁ?”

নীড় ভড়কে উঠল! শান্ত-শিষ্ট সোহানীর এহেন আক্রমনাত্নক রূপ দেখে শুকনো ঢোক গিলল। নির্ভীক গলায় বলল,

“তওবা তওবা! এসব কী নাউজুবিল্লাহ্ মার্কা কথা-বার্তা বলছ তুমি?”

“আমি নাউজুবিল্লাহ্ মার্কা কথা-বার্তা বলছি না?আমি নাউজুবিল্লাহ্ মার্কা কথা-বার্তা বলছি? তুই যে পিপাসা মিটিয়ে আসতে পারিস নি এটার বেলায় কিছুনা? আর এই কারণেই তুই বাধ্য হয়ে এখন আমার কাছে ছুটে এলি। আমি তো তোর লাইফে শুধুমাত্র একটা অপশন। আমাকে মেনে নিতে তো তোর হাজারটা সমস্যা, হাজারটা বাঁধা। কারি কারি সময়ের প্রয়োজন। অনুর ঘোর তো তোর মাথা থেকে এখনও কাটেনি। তাই তো এতগুলো মাসের মধ্যেও তুই একবার নিজ থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিস নি। আমার ভালো-মন্দের খোঁজ রাখিস নি। কেমন আছো, কী করছ ব্যস এতোটুকু অবধিই সীমাবদ্ধ ছিলি।”

সোহানীকে শান্ত করার জন্য নীড় তৎপর হয়ে উঠল। শান্ত কণ্ঠে বলল,,

“কুল সোহানী। প্লিজ বি কুল। তোমার পড়ালেখার ক্ষতি হবে বলেই তো আমি খুব ভেবেচিন্তে তোমার খোঁজ-খবর নিতাম। বিনা প্রয়োজনে দিনে একবারের বেশি তোমার খোঁজ নিতাম না। ভাবতাম এতে হয়তো তোমার মাইন্ড ডাইভার্ড হতে পারে। পড়ালেখার ক্ষতি হতে পারে। আর তাছাড়া আজকের আসার ব্যাপারটা ছিল সারপ্রাইজ! মা বলছিল হুট করে এসে তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে।”

নীড়ের একটা কথাও সোহানী কানে তুলল না! এতদিনের পুষিয়ে রাখা সব রাগ, অভিমান একত্রে ঝাড়তে আরম্ভ করল। রাগে আরও বোম হয়ে উঠল। শার্টের কলারটা জোরালোভাবে চেপে ধরল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“গর্দভ ভেবেছিস তুই আমাকে হ্যাঁ? গর্দভ ভেবেছিস? তুই যে মস্ত বড়ো একটা ঢ’পবাজ তুই কী মনে করিস আমি জানি না, না? বিয়ে করা বউয়ের প্রতি তোর না আছে কোনো টান না আছে কোনো আদর-মোহাব্বত। না আছে কোনো গুরুত্ব। শালা কপালটাই খারাপ আমার! তোর মতো একটা দায়িত্বহীন, পাষাণ, ভণ্ড একটা ছেলেকে বিয়ে করে!”

নীড় এবার ক্ষেপে উঠল। এক ঝটকায় শার্টের কলার থেকে সোহানীর হাতটা শক্ত হাতজোড়া ছাড়িয়ে নিলো। চোয়াল শক্ত করে সোহানীর থুতনি চেপে ধরল! তীক্ষ্ণ গলায় বলল,,

“আমি দায়িত্বহীন না? আমি পাষাণ, আমি ভণ্ড? তোর উপর আমার কোনো টান নেই, কোনো আদর-মোহাব্বত নেই? এবার আমি তোকে বুঝাব আদর-মোহাব্বত ঠিক কাকে বলে!”

হিংস্র হয়ে নীড় মুহূর্তের মধ্যেই সোহানীর ঠোঁ’টে ঠোঁ’ট ডু’বিয়ে দিলো! দেয়ালের সাথে তাকে চে’পে ধরল। হঠকারি দৃষ্টিতে সোহানী বেখবর নীড়ের দিকে তাকালো। হাঁসফাঁস করে উঠল নীড়ের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য। দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার নীড়ের এই হঠাৎ অত্যা’চারে। ছাড়া পেতে চাইছিল সে এই অ’ত্যাচার থেকে। অবশেষে প্রচুর ক্ষেপে ওঠে সোহানী শরীরে শক্তি সঞ্চার করে দু’হাত দ্বারা জোরচে এক ধাক্কা মা’রল নীড়ের বুকের পাঁজরে। অমনি নীড় সোহানীর গাঁ থেকে ছিটকে পড়ল এক গজ দূরে! ঘর্মাক্ত অবস্থায় হাঁপাতে হাঁপাতে সোহানী এক দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। কম্পিত হাতে ভেতর থেকে ওয়াশরুমের দরজাটা লক করে দিলো। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়তে লাগল। নীড় রাগী দৃষ্টিতে ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকালো। শার্টের কলার ঝেড়ে মৃদু আওয়াজে বলল,,

“কই পারলি না তো আমার ভালোবাসা নিতে! আদর, মোহাব্বত নিতে। মুখে মুখে আবার হুমকি দিতে জানিস আমি তোকে ভালোবাসি না, আদর-যত্ন করি না। তোর শরীরের প্রতিই শুধু আমার ভালোবাসা নেই বুঝেছিস? তোর মনের প্রতিও আমার অনেক ভালোবাসা! যা আমি তোকে আস্তে ধীরে বুঝানোর চেষ্টা করছিলাম! কিন্তু তুই এর সুযোগ দিলি না আমাকে। এর আগেই আমাকে রাগিয়ে দিলি।”

সোহানী ভয়ে সিঁটিয়ে আছে! নীড়কে রাগিয়ে দেওয়ার ফল সে হারে হারে ভোগ করছে। আজ রাতটা সে ওয়াশরুমেই কাটিয়ে দেওয়ার প্ল্যানিং করছে! কিছুতেই ঐ হিংস্র নীড়ের মুখোমুখি হতে পারবে না সে।

,
,

চাঁদ ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো। টাওয়াল হাতে নিয়ে মুখটা মুছতে মুছতে রুমে প্রবেশ করল। অমনি তার শিথিল দৃষ্টি পড়ল বিছানার উপর পড়ে থাকা দু’টি গিফট বক্সের দিকে। কৌতূহলী হয়ে চাঁদ বিছানার দিকে দৌঁড়ে এলো। টাওয়ালটা হাত থেকে রেখে লাল এবং নীল ‌র‌্যাপিং বক্সে মোড়ানো গিফট বক্সগুলো হাতে নিলো। বক্সগুলো হাতে নিয়ে পুরো রুমটাতে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। মূর্তায়মান ভাব-ভঙ্গি নিয়ে আনমনে বলল,,

“আজব। এই গিফট বক্সগুলো আমার রুমে কোত্থেকে এলো? আজ তো এই বাড়িতে কোনো প্রোগ্রামও ছিল না। প্রোগ্রাম হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা ছিল না। তাহলে গিফট’স গুলো কে রেখে গেল আমার রুমে?”

উদগ্রীব হয়ে চাঁদ গিফট বক্সগুলো খোলার সিদ্ধান্ত নিলো। ব্যস্ত ভঙ্গিতে প্রথমে লাল র‌্যাপিংয়ে মোড়ানো গিফট বক্সটা খুলল। পুরো বক্সটা খোলার পর ভেতরের গিফটটা দেখে চাঁদ সঙ্গে সঙ্গেই খুশিতে ঝলমল করে উঠল! ঐদিন চাঁদ মেলায় গিয়ে ঠিক এরকমই একটা গাজরা ফুল পছন্দ করেছিল। তবে সাথে পর্যাপ্ত টাকা না থাকার দরুন গাজরাটা ছাড়াই তাকে বিষন্ন মনে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। ঐ সময় তার পাশে জায়মা ছিল। তার মানে জায়মা-ই চাঁদকে চুপিসারে এই গিফটটা দিয়ে গেছে? চাঁদকে হঠাৎ চমকে দেওয়ার জন্য। খুশিতে হতবিহ্বল হয়ে চাঁদ তার চুলে গাজরাটা গুজে নিলো। আয়নায় তার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল। গাজরাটা তার চুলে কতোখানি স্যুট করল তা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ ট্রায়াল দেওয়ার পর চাঁদ গাজরাটা মাথা থেকে খুলে রাখল। নীল র‌্যাপিংয়ে মোড়ানো গিফট বক্সটা খুলল। অমনি ইন্ডিয়ান দুটো সফট এন্ড সিল্কি ডেইরি মিল্ক সে দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গেই লোভে চাঁদের চক্ষুজোড়া লাল হয়ে উঠল! আর এক মুহূর্ত দেরি না করে চাঁদ জিভ চেটে ডেইরি মিল্কের প্যাকেটটা খুলল। তাৎক্ষণিক ডেইরি মিল্কটায় বাইট বসাতেই দরজা ঠেলে রুমের ভেতর পুচি প্রবেশ করল! অনেকক্ষণ পর চাঁদকে দেখে পুচি আহ্লাদি হয়ে দৌঁড়ে ছুটে এলো চাঁদের কাছে। তৃপ্তি সহকারে চোখ বুজে চকলেট খেতে থাকা চাঁদের কোলে এসে বসল। চাঁদের খাওয়া দেখে পুচি নিজেও এবার জিভ চাটতে লাগল! চাঁদের গাঁয়ে থাবা বসিয়ে ম্যাও ম্যাও বলে ডাকতে লাগল। ইঙ্গিত করতে লাগল তাকেও একটু দিতে। চাঁদের এবার ধ্যান ভাঙল। চোখ খুলে সে পুচির দিকে তাকালো। ম্লান হেসে পুচির মুখে একটু চকলেট ঢুকিয়ে দিলো। মৃদু্ হেসে বলল,,

“নে তুইও একটু খা।”

পুচিও চোখ বুজে চকলেটটা চু’ষতে লাগল। চাঁদের মতোই তৃপ্তি করে সে চকলেটটা খেতে লাগল। অমনি চাঁদের মাথায় এলো এই ইন্ডিয়ান চকলেটটা জায়মা কোথায় পেল? ইন্ডিয়া থেকে তো কেউ জায়মাদের বাড়ি আসেনি বা ইন্ডিয়ায় তো জায়মাদের কোনো আত্নীয়-স্বজনও থাকেনা! তবে কোথা থেকে এই চকলেট? শীঘ্রই টনক নড়ে উঠল চাঁদের। চকলেটটা তাড়াহুড়ো করে সে হাত থেকে ছুড়ে মেরে বিছানার উপর রাখলো। পুচি দৌঁড়ে এসে চকলেটটায় থাবা বসাতে লাগল। জিভ চেটে চাঁদকে বুঝালো তাকে আরও একটু চকলেট দিতে। পুচির আবদারকে প্রশ্রয় না দিয়ে চাঁদ পুচিকে কোলে তুলে নিলো। দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে বের হতে হতে বলল,,

“আগে জায়মার সাথে একটু দেখা করে আসি। আসলেই জায়মা এই গিফটস গুলো আমাকে দিলো কি-না কনফার্ম করে আসি।”

তৎপর হয়ে চাঁদ রুম থেকে বের হতেই সাবরিনা আবরারের মুখোমুখি হয়ে গেল। বুকে দু’হাত গুজে উনি অভিমানী দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালেন। রাগান্বিত গলায় বললেন,,

“এই কয়েকমাসে ভুলে গেছিস খালামনিকে না? সে কখন বাড়িতে ফিরেছিস অথচ এখনও অবধি আমার সাথে দেখা করলিনা।”

পুচিকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো চাঁদ। সাবরিনা আবরারের রাগ ভাঙানোর জন্য জাপটে ধরল উনাকে। মুচকি হেসে আনন্দঘন গলায় বলল,,

“তোমাকে কী করে ভুলি বলো তো খালামনি? তোমার মতো একটা মিষ্টি খালামনিকে ভোলা কি আদো সম্ভব?”

“অমনি শুরু হয়ে গেছে ঢঙ না? নিজে ভুল করে আবার আমাকে ফিটিং দেওয়া হচ্ছে?”

“সত্যি বলছি খালামনি। আমি তোমাকে মোটেও ফিটিং দিচ্ছিনা। বাড়ি ফিরে এসে খুব ক্লান্ত লাগছিল বিশ্বাস করো। তাই ভেবেছিলাম একটু ফ্রেশ হয়ে নেই এরপর না হয় তোমার সাথে দেখা করর।”

“আচ্ছা যা মানলাম। তোর কথাটাই বিশ্বাস করে নিলাম। এবার বল এক্সাম কেমন হয়েছে?”

“আলহামদুলিল্লাহ্ খুব ভালো হয়েছে খালামনি।”

“খেয়েছিস কিছু?”

“না খালামনি। এখনো কিছু খাইনি।”

চাঁদকে বুকের পাঁজর থেকে উঠিয়ে নিলেন সাবরিনা আবরার। চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,,

“কী বলিস তুই? এখনো কিছু খাসনি? এভাবে না খেয়ে দেয়ে থাকলে তো পেটে পিত্তি পড়ে যাবে। আয় আয় তাড়াতাড়ি খাবার টেবিলে আয়। খালামনি তোকে খাইয়ে দিচ্ছি। সামিয়াটা হয়েছে একদম অন্যমনস্ক। এখনো নিজের সন্তানদের প্রতি যত্ন নিতে শিখেনি। মেয়েটা সেই কখখন কলেজ থেকে ফিরেছে, অথচ এখনও অবধি মেয়েটা খেয়েছে কিনা সেই খবরটাও নিলো না। আসার পর থেকেই দেখছি রান্নাঘর নিয়ে পড়ে আছে। কী এমন রান্না করছে আল্লাহ্ জানে।”

চাঁদ ব্যস্ত হয়ে উঠল। সাবরিনা আবরারের খপ্পর থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। উত্তেজিত গলায় বলল,,

“থাক না খালামনি। আমি একটু পরে খাই? আসলে জায়মার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা ছিল। তাই এক্ষণি আমার উপরে যেতে হবে।”

“আমি তো জায়মার কাছ থেকে এইমাত্র এলাম। খেয়ে-দেয়ে একদম ফিটফাট জায়মা। আর তুই কিনা এখনও না খেয়ে আছিস? কেন এতো খাবারের প্রতি তোর অনীহা বল তো?”

“আমি ফিরে এসে খাব খালামনি। প্লিজ এখন আমাকে একটু যেতে দাও। ইট’স আর্জেন্ট প্লিজ।”

“খুব জরুরি কিছু?’

“হ্যাঁ খালামনি। খুব জরুরি।”

“আচ্ছা যা। তবে তাড়াতাড়ি ফিরিস। খালামনি তোর জন্য খাবার মেখে বসে থাকব।”

চাঁদ মুচকি হাসল। প্রত্যত্তুরে বলল,,

“ঠিক আছে খালামনি।”

সাবরিনা আবরারকে উপেক্ষা করে চাঁদ দৌঁড়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে গেল। অস্থির মনে তিনতলায় ওঠে পড়ল। অনবরত কলিংবেল চাপতে লাগল। অমনি কেউ এসে সদর দরজাটা খুলে দিলো। স্থির দৃষ্টিতে চাঁদ অগ্রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আবারও বাঁকা চাহনিতে দাঁড়িয়ে থাকা নূরকে দেখতে পেল! চাঁদের বিমূর্ত অবস্থা দেখে নূর বুঝতে পারল চাঁদ ঠিক কী কারণে এতটা উতলা হয়ে উঠেছে। গলা ঝাঁকিয়ে নূর চাঁদের চঞ্চলা দু’চোখে তাকালো। চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল,,

“গিফট’স গুলো সাদমান তোমার জন্য পাঠিয়েছে! আমাদের সাথে সে আসতে পারেনি কিছু ব্যস্ততার কারণে৷ তাই শুভেচ্ছা হিসেবে এই গিফট’স গুলো তার তরফ থেকে তোমার জন্য পাঠানো! পছন্দ হয়েছে তো গিফট’স গুলো?”

#চলবে…?