প্রেমময়ী তুমি পর্ব-৩৬+৩৭

0
536

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৩৬
#নিশাত_জাহান_নিশি

“আলবাত লাগবে। তোমার প্রতিটা বিষয় নিয়েই আমার কথা বলা লাগবে। কিছুদিন পর যখন আমার ঘাড়ে উঠবা তখন তো এমনিতেও আমার কাছে তোমার হাজারটা জবাবদিহি করতে হবে! তাই আগে থেকে প্র্যাক্টিস করে রাখা ভালো না?”

পূর্বের তুলনায় আরও অধিক কঠোর হয়ে উঠল চাঁদ! নাক-মুখ খিঁচে দাঁড়ালো। কৌতূহলী ভাব মিইয়ে তা তুখোর রাগে পরিণত হলো। অবিলম্বেই নাক ফুলিয়ে চাঁদ কর্কশ গলায় শুধালো,,

“পাগল হইছেন যে বাসায় জানে?”

নূর কদাচিৎ হাসল! নাক ঘঁষে চাঁদের অতি নিকটে দাঁড়ালো। ভ্রু যুগল উঁচিয়ে ভাবলেশ গলায় বলল,,

“জানে বলেই তো পাগলামির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিলাম! পাগল হয়ে তোমার মন ছোঁয়ার চেষ্টায় রইলাম!”

চাঁদ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। নূরের বেহায়াপনায় চরম বিরক্ত সে। রাগে গজগজ করে সে নূরকে রীতিমতো হুমকি ধামকি দিয়ে বলল,,

“আমি না আপনাকে ঠিক গলা টি’পে মে’রে ফেলব! এভাবে কা’মড়ে কুমড়ে আপনাকে ঠিক করা যাবেনা। জানে মে’রে এরপর আপনাকে ঠিক করতে হবে।”

নূর ফিক করে হেসে দিলো। চাঁদের রাগান্বিত মুখমণ্ডলে বিদ্রুপাত্নক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ঠাট্টার স্বরে বলল,,

“জানে মা’রলে আমাকে ঠিক করবা কীভাবে হ্যাঁ? ম’রার পর মানুষকে আবার ঠিক করা যায় নাকি?”

চাঁদ তার নির্বুদ্ধিতার জন্য জিভ কাটল। মাথা নুইয়ে নূরের সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। পিছু ঘুরে বাড়ির ভেতরের দিকে রওনা হলো। নিচু গলায় বলল,,

“হাত-পা ভে’ঙে এরপর আপনাকে ঠিক করতে হবে বুঝছেন? যখন দেখো তখনই আমার পেছনে লেগে থাকো। কেন ভাই? আপনার কী কোনো কাজকর্ম নেই না-কি?”

উচাটন নূর হয়ে চাঁদের পেছনে পেছনে হাঁটা ধরল। প্রসঙ্গ পাল্টে বেশ তৎপর গলায় বলল,,

“এই চাঁদ শোনো? আয়মনকে তোমার সরি বলা উচিৎ।”

চাঁদ থমকালো। চোখে-মুখে বিষন্নতার ছাপ ফুটিয়ে তুলল। ভেতরের নিগূঢ় ব্যথায় মাথা নুইয়ে নিলো। ভগ্ন গলায় বলল,,

“প্রয়োজনে পা ধরে ক্ষমা চাইব! তবুও ভাইয়াকে আমি মানিয়ে ছাড়ব। কারণ, এই প্রথমবার আমি আমার ভাইয়াকে এতোটা হার্ট করেছি!”

চোখে জল নিয়ে চাঁদ এক ছুটে আয়মনদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়ালো। উতলা হয়ে ফ্ল্যাটের কলিংবেল চাপতে লাগল। অস্থিরতায় তার বুকটা ভীষণ কাঁপতে লাগল। কান্নায় গলা জড়িয়ে আসলো। চাঁদের পিছু পিছু নূরও ছুটে এলো। হন্ন হয়ে চাঁদের পাশাপাশি দাঁড়ালো। চাঁদ অসহায় দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। কান্নাজড়িত গলায় বলল,,

“আচ্ছা? আয়মন ভাইয়া কিছু করে বসল না তো?”

নূর বিরক্তি প্রকাশ করল। নাক সিটকে বলল,,

“আরেহ্ ধ্যাত। কিছু করবে মানে? আয়মন কি ছোটো বাচ্চা? যে সামান্য বিষয় নিয়ে অবুঝের মতো কাজ করবে? তাছাড়া মাহিন তো আয়মনের সাথে আছেই। খামোখা দুঃশ্চিন্তা করছ তুমি।”

নূর এবার কলিং বেল চাপার বদলে দরজা ধাক্কাতে লাগল। আয়মনদের ফ্ল্যাট আজ পুরো ফাঁকা আজ। তার বাবা-মা এবং সাব্বির একজন নিকট আত্নীয়ের বার্থডে পার্টিতে গেছে। যে পার্টিটায় না গেলেই নয়। মুখ রক্ষা হবেনা। আয়মনকেও অনেক সেঁধেছিল যাওয়ার জন্য। তবে নূর এবং মাহিনকে পেয়ে আয়মন সাফ না করে দিলো। ফাঁকা বাড়ি দেখে চাঁদ ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। খারাপ কিছুর আভাস পেতে লাগল। তিন থেকে চারবার দরজা ধাক্কানোর পর মাহিন দরজা খুলে বের হয়ে এলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নূর এবং চাঁদের দিকে তাকালো। চাঁদ উদগ্রীব হয়ে কিছু বলার পূর্বেই নূর মাহিনের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী রে? দরজা খুলতে এতো লেইট করলি কেন? দুইটায় মিলে ভেতরে কী করছিলি?”

“আরেহ্ আমি তো একটু ওয়াশরুমে ছিলাম। তাই লেইট হচ্ছিল দরজাটা খুলতে।”

পাশ থেকে চাঁদ ব্যতিব্যস্ত গলায় শুধালো,,

“আচ্ছা আয়মন ভাইয়া কই?”

মাহিন সরু দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। রূঢ় গলায় বলল,,

“কই আবার। রুমে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। একের পর এক সিগারেট গিলছে। কী দরকার ছিল বলো? ওরে এতোগুলো মানুষের সামনে এভাবে ইনসাল্ট করার? দোষ তো তোমার ফ্রেন্ডেরও ছিল তাইনা? তোমার ফ্রেন্ডকেও কিছু বলতে পারতা। তা না করে তুমি একতরফা আয়মনকেই দোষ দিলা?”

চাঁদ ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। রোষভরা গলায় বলল,,

“আমি ঐ ফ্রেন্ডসদের সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখবনা! তাদের নাম্বারটাও ব্লক লিস্টে ফেলে দিব। তাছাড়া তিথী ও তো আপনার গাঁয়ে হাত তুলেছিল ভাইয়া। তাই তাদের দুজনকেই আমি ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে আউট করে দিব।”

মাহিন পেছনের চুলগুলো টেনে ধরল। বাঁকা হেসে চাঁদের দিকে তাকালো। বেহায়া গলায় বলল,,

“আচ্ছা যাই করো আর না করো। তিথীর নাম্বারটা আমাকে একটু দিও তো! তার চড়টা শুধু আমার গালে লাগেনি! ডিরেক্ট মনে লেগেছে!”

চাঁদ এবং নূর ভড়কে উঠল! হতবাক দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো। নিস্তব্ধতা ভেঙে নূর রুক্ষ গলায় শুধালো,,

“তোর জন্য আমি ঐ জংলী মেয়েটার সাথে ফাইট করে এলাম আর সেই তুই কিনা এখন ঐ মেয়েটার ফোন নাম্বার চাচ্ছিস? তোরা সবাই মিলে কী শুরু করলি হ্যাঁ? একজন তো এতক্ষণ তার ফ্রেন্ডের হয়ে সাফাই গাইল! নিজের ভাইকে সবার সামনে ইনসাল্ট করল, তাকে জঘন্যভাবে আঘাত করল। আর সেই তুই এখন ঐ উড়নচণ্ডী মেয়েটার হাতের চড় খেয়ে মেয়েটার ফোন নাম্বার চাচ্ছিস? হলোটা কী তোদের হ্যাঁ?”

মৃদু হেসে মাহিন মাথা চুলকালো। লজ্জামাখা গলায় বলল,,

“কুচ কুচ হোতা হে ভাই। তু নেহি সামঝেগি!”

আনমনা হয়ে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো মাহিন। তিথীকে সর্বত্র ফিল করতে লাগল। উদাসচিত্তে সে সোফার উপর ধপ করে বসে পড়ল। পেছনের গদিতে মাথা ঠেকিয়ে নেত্র যুগল বুজে অতি সূক্ষ্মভাবে তিথীকে অনুভব করতে লাগল! সিক্ত প্রেমের রিক্ত অনুভূতিতে মশগুল হয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল! নূর এবং চাঁদ হতভম্ব হয়ে মাহিনের মজনুগিরি দেখছে। এ যেনো এক নতুন রূপে মাহিনকে আবিষ্কার করছে তারা! মাহিনের এই মিচকে হাসি আর একরত্তিও সহ্য করতে পারলনা নূর। রাগে গাঁ রি রি করে উঠল তার। দ্রুত পায়ে হেঁটে সে মাহিনের পাশে বসল। মাহিনের শার্টের কলার টেনে ধরে তার মুখোমুখি বসালো! চোয়াল শক্ত করে বলল,,

“তুই কিছুতেই ঐ মেয়েটার সাথে কোনোরকম সম্পর্কে জড়াবিনা মাহিন। আমি কিন্তু তোকে ওয়ার্ণ করছি।”

মাহিন গাঁ ছাড়া ভাব নিলো। বিষয়টাকে আমলে না নিয়ে স্মিত হাসল। স্বাভাবিক গলায় বলল,,

“হঠাৎ করে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে আমি কী করতে পারি বল? তার চোখে-মুখে এতো বেশি মায়া কাজ করছিল যে তার মায়ায় আমাকে জড়াতেই হলো!”

নূর চোয়াল শক্ত করল। চোখ গরম করে মাহিনের দিকে তাকালো। তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় বলল,,

“মায়া-টায়া এসব ছাড় মাহিন। ঐ মেয়েকে আমি কিছুতেই ভাবি হিসেবে মেনে নিতে পারবনা। যে মেয়েটা তোর গালে অন্যায়ভাবে চড় মেরেছিল।”

“তুই মানবিনা তো ঘাড় মানবে! আমি যদি ঘাড়ত্যাড়া চাঁদকে ভাবি হিসেবে মেনে নিতে পারি তবে তুই কেন আমাকে চড় মারা মেয়েটাকে ভাবি হিসেবে মেনে নিতে পারবিনা?”

চাঁদ তাজ্জব দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো! দুই ভাই ঝগড়ার মধ্যে গোপন কথাটা এভাবে ফাঁস করে দিবে তা সবার ভাবনার বাইরে ছিল। উৎসুক হয়ে চাঁদ মাহিন এবং নূরের মুখোমুখি দাঁড়ালো। তাদের দুজনকে প্রশ্ন করার উদ্দেশ্যে মুখটা হা করল। অমনি নূর লোহিত দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো। মাহিন তার ভুলের জন্য জিভ কাটল। মিনমিনে দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। বাঁজখাই গলায় চাঁদ প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী বললেন মাহিন ভাই? আমি আপনার ভাবি? আপনার কোন ভাইয়ের বউ লাগি আমি?”

মাহিন থতমত খেলো। নূরের রাগমিশ্রিত ফোঁস ফোঁস আওয়াজ তার কানে তীক্ষ্ণভাবে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল! মাহিনের শার্টের কলারটা নূর আরও শক্তপোক্তভাবে চেপে ধরল! ভয়ঙ্কর কিছুর ইঙ্গিত দিতে লাগল। ভয়ে নেতিয়ে উঠল মাহিন! অবুঝ ভাব নিতে বাধ্য হলো। নির্বোধ গলায় পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কোন ভাবি? কার ভাবি? তুমি কার কথা বলছ চাঁদ?”

চাঁদ কোমরে হাত গুজল। ভ্রু যুগল উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“নগদে পল্টি? আপনারা দুই ভাই-ই দেখছি সেইম? কোনো অমিল নেই আপনাদের মাঝে?”

নূর বেশ বুঝতে পারল চাঁদকে এভাবে দমানো যাবেনা। প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলবে মাহিনকে। আর মাহিনও চাঁদের চাপে পড়ে গুপ্ত সব কথা ফাঁস করে দিবে। তাৎক্ষণিক মাহিনের শার্টের কলারটা ছেড়ে দিলো নূর। শানিত দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। নীরস গলায় বলল,,

“তোমার এখানে কী হ্যাঁ? বড়দের মাঝখানে তুমি কী করছ? তোমাকে না একবার বলছি আয়মনকে সরি বলতে? তার রাগ ভাঙাতে? তা না করে তুমি আমাদের দুইভাইয়ের কথার মাঝখানে এসে টক্কর মারছ?”

অপমানিত বোধ করল চাঁদ। নূরের উপর সাংঘাতিক চটে বসল। রাগে ধেই ধেই করে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। মনে মনে নূরকে হাজারটা গালি-গালাজ করতে লাগল। চাঁদের যাওয়ার পথে নূর ত্যাড়া দৃষ্টিতে তাকালো। শক্ত গলায় পেছন থেকে বলল,,

“এই একদম গালি-গালাজ করবানা! যদি এখন নাকেমুখে ওঠে না আমার? তো তোমার কিন্তু খবর আছে।”

চাঁদ থমকালো। জিভ কেটে আনমনে বলল,,

“এই লোকটা বুঝল কেমনে আমি তাকে গালি-গালাজ করছিলাম?”

বিস্ময়ে বশীভূত হয়ে চাঁদ পিছু ঘুরে তাকালো। কৌতূহল কাটাতে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী? আমি আপনাকে গালি-গালাজ করছিলাম?”

নূর বাঁকা হাসল। ব্যগ্র গলায় বলল,,

“কু’ত্তা তো মাস্ট বি বলছ!”

তাৎক্ষণিক চাঁদ নূরের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। হঠকারি গলায় বলল,,

“বাপরে! এ তো দেখছি অন্তর্যামি! না বললেও মনের কথা সব পড়ে নিতে পারে।”

দ্রুত পায়ে হেঁটে চাঁদ জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। সোজা আয়মনের বেডরুমে প্রবেশ করল। উন্মুক্ত শরীরে আয়মন বিছানার উপর বসে ধুমছে সিগারেট ফুঁকছে! রাগে-দুঃখে-যন্ত্রনায় তার ভিতরটা সিগারেটের মতোই পুড়ছে। আয়মনের এই বিমূর্ষ অবস্থা দেখে চাঁদের মনটা পুনরায় ব্যথীত হয়ে উঠল। মাথা নুইয়ে সে গভীর শোকে তলিয়ে পড়ল। ধীর পায়ে হেঁটে আয়মনের মুখোমুখি দাঁড়ালো। চাঁদকে একনজর দেখামাত্রই আয়মন মুখটা ঘুরিয়ে নিলো! তীব্র রাগ প্রকাশ করল। চাঁদ চুপটি করে আয়মনের মুখোমুখি হাঁটু গেড়ে বসল। আয়মনের বিমূঢ় মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে অস্থির শ্বাস ছাড়ল। মায়ামোহ গলায় বলল,,

“আমার দিকে তাকাবে না ভাইয়া?”

আয়মন নিরুত্তর। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে সে দুঃখ নিবারণ করতে ব্যস্ত। চাঁদকে যথেষ্ট এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে সে। নাছোড়বান্দা চাঁদও জেদ ধরে বসে আছে। অপ্রত্যাশিতভাবে আয়মনের পা চেপে ধরল সে! অপরাধী গলায় অনর্গল বলতে আরম্ভ করল,,

“সরি সরি সরি ভাইয়া। প্লিজ একটা বার আমার দিকে তাকাও প্লিজ। তোমার এই ছোটো বোনটাকে মাফ করে দাও প্লিজ। তুমি যতক্ষণ অবধি আমার দিকে ক্ষমার দৃষ্টিতে তাকাবা না ততক্ষণ অবধি আমি তোমার পা ছাড়বনা।”

আয়মন অধীর হয়ে উঠল। চাঁদের পাগলামো দেখে তার মন ক্রমশ বিগলিত হতে লাগল। চাঁদের দিকে মায়াময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ক্ষীণ গলায় বলল,

“পা টা ছাড় বলছি চাঁদ।”

“না ছাড়বনা। তুমি যতক্ষণ অবধি আমাকে ক্ষমা করবে না ততক্ষণ অবধি আমি তোমার পা ছাড়বনা।”

“ছেলেমানুষী করিস না চাঁদ। প্লিজ পা টা ছাড়।”

“না ছাড়বনা বললাম তো।”

“তাহলে ঐসময় সবার সামনে আমাকে এভাবে ইনসাল্ট করলি কেন হ্যাঁ?

“ভুল হয়ে গেছে ভাইয়া! আর কখনো হবেনা।”

“তোর একটা ভুলের জন্য আজ সবার চোখে আমি কালার হয়ে গেলাম। তোর ফ্রেন্ডদের চোখেও ছোটো হয়ে গেলাম। আমাকে নিচে নামিয়ে তুই তাদের উপরে উঠিয়ে দিলি? খুব হার্ট হয়েছি আজ তোর ব্যবহারে। এই প্রথমবার আমি তোর প্রতি এতোটা নারাজ হয়েছি।”

“বোনের একটা ভুল ক্ষমা করা যায়না ভাইয়া? তুমি তো জানো তোমার এই বোনটার মাথায় একদমই বুদ্ধি-শুদ্ধি নেই। শুধু গাঁয়েই লকলক করে বড়ো হয়েছে সে। বুদ্ধিতে বড়ো হয়নি। তবে আমি কথা দিচ্ছি তাশফিয়া এবং তিথীর সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখবনা। তারা দুজন-ই আমার ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে আউট।”

“থাক হয়েছে। কিচ্ছু করার দরকার নেই। তোদের সম্পর্কটা যেরকম আছে সেরকমই থাক। তবে মেয়ে দুটোকে আমি মার্ক করে রাখলাম। যদি পুনরায় আমার সামনে পড়েনা? তো তখন কিন্তু আমি তাদের ছাড়বনা। ফর দ্যা গড সেইক পরের বার আমাকে বেগড়া দিতে আসিসনা।”

“উঁহু৷ আমি আর কখনো তোমাদের মাঝখানে যাব না ভাইয়া। তুমি যেভাবে পারো শোধ নাও! তবে আমাকে এবার মাফ করে দাও।”

মলিন হাসল আয়মন। চাঁদকে তার পা থেকে উঠিয়ে নিলো। চাঁদের দু’বাহুতে ধরে তাকে নিয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। চাঁদকে একাত্নভাবে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। নরম স্বরে বলল,,

“যা হয়েছে সব ভুলে যা। আয়মন কখনো তার ছোট্টো চাঁদের সাথে এতক্ষণ রাগ করে থাকতে পারেনা!”

চাঁদ মৃদু হাসল। আয়মনকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরল। আন্তরিক গলায় বলল,,

“আমি জানতাম ভাইয়া। তুমি কখনো আমার সাথে বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারবেনা।”

এরমধ্যেই নূরের আগমন ঘটল দুজনের মাঝখানে। রাগে বোম হয়ে নূর আয়মনের দিকে তেড়ে এলো। নিঠুর গলায় বলল,,

“এই আয়মন তুই মাহিনকে থামাবি কিনা বল? ঐ ঝগড়ুটে মেয়েটার প্রেমে পড়ছে ইডিয়টটা! যে মেয়েটা ওর গালে চড়ে মেরেছে।”

আয়মন রাগে চোয়াল শক্ত করল। চাঁদকে এক ঝটকায় তার বুকের পাঁজর থেকে সরিয়ে সোজা হাঁটা ধরল ড্রয়িংরুমের উদ্দেশ্যে। রাগমিশ্রিত মুখমণ্ডলে সে খড়তড় গলায় বলল,,

“শত্রুর সাথে প্রেম? ইম্পসিবল!”

মাহিনকে আজ হেস্তনেস্ত করবে বলে নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগল আয়মন। চাঁদ উদ্বিগ্ন হয়ে আয়মনকে থামানোর জন্য তার পিছু পিছু হাঁটা ধরল। নূর হঠাৎ পেছন থেকে চাঁদের বাঁ হাতটা টেনে ধরল! প্রশ্নবিদ্ধ গলায় বলল,,

“এই কই যাও তুমি?”

চাঁদ দাঁড়ালো। পিছন ঘুরে সরু দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। অস্থির গলায় বলল,,

“আয়মন ভাইকে থামাতে।”

“এতো পাকামো করতে হবেনা তোমার। আমাকে এখন সময় দিবা তুমি! ঐ কাজটার থেকে এখন এই কাজটা বেশি ইম্পর্টেন্ট।”

চাঁদ বিশৃঙ্খল শ্বাস ছাড়ল। নূরের লাগামহীন কথাবার্তায় সে ঘোর তিক্ততা প্রকাশ করল। রূঢ় গলায় বলল,,

“ঢাকা থেকে আসার সময় কার মুখটা দেখে এসেছেন শুনি? এতো ফাও চিল্লাচ্ছেন কেন? আর এসব কী লাগামছাড়া কথাবার্তা বলছেন? বিহেভিয়ার এতো চেঞ্জ কেন?”

“আমার সবকিছুই তো তোমার কাছে লাগামছাড়া মনে হয় তাইনা? এতো অস্বস্তি কেন আমাকে নিয়ে? কী ক্ষতি করছি আমি তোমার হ্যাঁ?”

“কম ক্ষতি করেছেন আমার? দেখা হওয়ার পর থেকেই তো ক্ষতি করে আসছেন। আপত্তি সত্ত্বেও বার বার আমাকে বিরক্ত করছেন।”

রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে নূর চাঁদের হাতটা ছেড়ে দিলো। অসহ্যকর গলায় বলল,,

“যাও ভাগো। আর ভুলেও আমার সামনে আসবানা।”

ছাড়া পেয়ে চাঁদ স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। ভেংচি কেটে বলল,,

“আমার বয়ে গেছে আপনার মতো ইরেটেটিং একটা ছেলের সামনে পড়তে!”

এক দৌঁড়ে চাঁদ ড্রয়িংরুমে চলে এলো। হিংস্র বাঘের মতো গর্জে ওঠে নূরও চাঁদের পিছু পিছু হাঁটা ধরল। আয়মন এতক্ষণে মাহিনের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়েছে! প্রেমে পড়া তার আজ বের করবে। প্রেমের ভূত আজ তার মাথা থেকে নামিয়ে-ই ছাড়বে! দুজনের ফাইটিং দেখে নূর তার আক্রোশ ভুলে গেল। চাঁদকে ছেড়ে মাহিনকে চেপে ধরল! তাজ্জব দৃষ্টিতে চাঁদ তাদের তিনজনের পাগলামি দেখতে লাগল। আপাতত জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা তার!

,
,

রাত প্রায় এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট ঘড়িতে। রাতের খাবার সম্পন্ন করে সবাই যে যার রুমে চলে গেলে ঘুমোতে। নূর এবং মাহিন নিচ তলায় চলে এলো আয়মনদের ফ্ল্যাটে। আয়মনের বেডরুমেই তারা একজোট হয়ে ঘুমুবে। তিনজন মারামারি করে বেশ ক্লান্ত! তবুও মাহিনের মুখ থেকে তিথী নামের শব্দটা তারা দূর করতে পারলনা! প্রতিটা ক্ষণ, প্রতিটা মুহূর্তে সে তিথী নামটাই কেবল জপ করছে। মনে হচ্ছে যেনো তিথী ছাড়া আর কোনো শব্দ-ই নেই এই জগতে। নূর এবং আয়মন অতিষ্ট হয়ে উঠল মাহিনের এই মজনুগিরিতে! তাই তারা এই পিনিক কাটাতে ইমরান হাসমির ওল্ড মুভিগুলো দেখে সেই পিনিক কাটানোর চিন্তা-ভাবনা করল! বন্ধুরা একসাথে হলেই একেকজন ডার্টি মাইন্ডেড হয়ে ওঠে!

চাঁদ এবং জায়মা তাদের পড়ার রুমে বসে একমনে পড়তে ব্যস্ত। দুইদিন পড়েই তাদের পরীক্ষা। রাত জেগে পড়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তাদের হাতে। যে করেই হোক সামনের পরীক্ষাটা তাদের ভালো করতে-ই হবে। দুজনের পুরো আকর্ষণ-ই এখন পড়ার মধ্যে। পুচি একটু আগে-ই চাঁদের সাথে ঘ্যান ঘ্যান করে কেবলই চাঁদের কোলে ঘুমুলো। এরমধ্যে সোহানীও আবার ফ্ল্যাক্সে করে হট কফি দিয়ে গেছে তাদের দুজনের জন্য। ঘুম পেলে কিংবা বোর লাগলে তারা দুজনই যেনো কফিটা খেয়ে নিজেদের চাঙা করে তুলতে পারে।

রাতের খাবারের পর নীড়ের গরম গরম কফি খাওয়ার অভ্যেস আছে। তাই নীড়ের জন্যও সোহানী এক মগ গরম কফি নিয়ে তাদের বেডরুমে প্রবেশ করল। অমনি সোহানীর আকস্মিক দৃষ্টি পড়ল নীড়ের দিকে। উন্মুক্ত শরীরে নীড় শুধুমাত্র নিচে একটা জিন্স প্যান্ট পড়ে বিছানার উপর বসে আছে! খুব মনযোগ দিয়ে সে ফোন টিপছে। নাক-মুখ খাঁড়া হয়ে আছে তার। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভীষণ রেগে আছে সে! বিশেষ করে নাকের ডগা-টা তার অতিরিক্ত ফুলে আছে। মনে হচ্ছে যেনো যাকে সামনে পাবে তাকেই সে অ্যাটাক করবে। তাৎক্ষণিক সোহানী শুকনো ঢোঁক গিলল! কাঠ কাঠ গলায় বিড়বিড় করে বলল,,

“এই হনু’মাননটা আবার এভাবে ফুলে আছে কেন? আজ কি আমাকে আস্ত চি’বিয়ে খাওয়ার প্ল্যানিং করেছে?”

সোহানী মানে মানে করে জায়গা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। পিছু ঘুরে সামনে পা বাড়াতেই নীড় শক্ত গলায় পেছন থেকে সোহানীকে ডাকল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“এই কই যাও? জামাই কি আরও একটা আছে তোমার?”

সোহানী থতমত খেলো। বুকে থুঃথুঃ ছিটালো! অতিশয় বিপাকে পড়ে পিছু ফিরে তাকালো। কম্পিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আপনি তো ফোনে ব্যস্ত ছিলেন, না? কীভাবে দেখলেন আমাকে?”

ফোনের স্ক্রীন থেকে চোখ উঠিয়ে নীড় ধারালো দৃষ্টিতে সোহানীর দিকে তাকালো। খরখরে গলায় বলল,,

“তোমার মতো কি আমার মনযোগ শুধু একদিকেই থাকে? প্রতিটা দিকেই আমার সমান মনযোগ রাখতে হয়। এমনি এমনি এতো বড়ো পরিবারের দায়িত্ব নিচ্ছিনা বুঝলে?”

সোহানী উৎকন্ঠিত দৃষ্টিতে নীড়ের শানিত দৃষ্টিতে তাকালো! অধীর গলায় বলল,,

“আমি একটু পরে আসছি হ্যাঁ?”

তড়িৎ বেগে নীড় বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। দ্রুত পায়ে হেঁটে সোহানীর দিকে এগিয়ে গেল। সোহানী ভয়ে কাঁপতে আরম্ভ লাগল। শঙ্কিত গলায় বলল,,

“আরে আরে কোথাও যাচ্ছি না তো আমি। আপনি এমন করছেন কেন?”

সোহানীর হাত থেকে কফির মগটা ছিনিয়ে নিলো নীড়। ডেস্কের উপর আওয়াজ করে মগটা রাখল। সোহানীকে উপেক্ষা করে রুমের দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দিলো। পিছু ঘুরে তেজী গলায় সোহানীকে বলল,,

“যাও। এবার বের হয়ে দেখাও।”

নিরুত্তর সোহানী। এক দৌঁড়ে বিছানার উপর বসে পড়ল! নীড়ের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। শঙ্কিত গলায় বলল,,

“কোথাও যাবনা আমি।”

ডেস্কের উপর থেকে কফির মগটা হাতে তুলে নিলো নীড়। বেশ ভাব নিয়ে মগটায় চুমুক দিলো। পরিস্থিতি আয়ত্তে এনে ভীতসন্ত্রস্ত সোহানীর দিকে তাকালো। শান্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কফিটা কে বানাইছে?”

সোহানী ভীরু দৃষ্টিতে নীড়ের দিকে তাকালো। শুষ্ক গলায় বলল,,

“আআআমি।”

“আরও একটু চিনি লাগত! মিষ্টি কম হইছে।”

“আচ্ছা আমি চিনি নিয়ে আসছি।”

তড়িঘড়ি করে সোহানী জায়গা থেকে ওঠে গেল। সামনের দিকে পা বাড়াতেই নীড় তার বাম বাহু দ্বারা সোহানীর কোমর আঁকড়ে ধরল! রোমাঞ্চকর গলায় বলল,,

“কোথাও যেতে হবেনা তোমাকে। মিষ্টি আমার শরীর ছুঁয়ে আছে! এতোটুকুও বুঝো না তুমি?”

#চলবে…?

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৩৭
#নিশাত_জাহান_নিশি

“কোথাও যেতে হবেনা তোমাকে। মিষ্টি আমার শরীর ছুঁয়ে আছে! এতোটুকুও বুঝো না তুমি?”

রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে সিক্ত নীড়! তার নিমগ্ন দৃষ্টিজোড়া সোহানীর লজ্জামাখা লাল টুকটুকে মুখশ্রীতে সীমাবদ্ধ। বুঝতে কিছুটা বেগ পেতে হলেও শেষ অবধি সোহানী বুঝতে পেরেছে নীড় কোন জাতীয় মিষ্টির কথা বলতে চেয়েছে! তাই তার লজ্জার মাত্রা অত্যধিক বেড়ে গেল। তৎক্ষনাৎ নীড়ের নির্লজ্জ চাহনি থেকে তার লজ্জাময় দৃষ্টি সংকুচিত করে নিলো। অবিলম্বেই মাথা নুয়াতে বাধ্য হলো। নীড়ের উষ্ণ হাতটা এখনও সোহানীর নরম তুলতুলে কোমর ছুঁয়ে আছে! অবাধ বিচরণ চলছে কোমরের সর্বত্র জুড়ে। ক্ষণে ক্ষণে সোহানী তার স্নায়ুতন্ত্রে শুড়শুড়ে এক হাঁসফাঁস অনুভূতি পাচ্ছে। বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ উভয় প্রকার উদ্দীপনায় সে ক্রমাগত মত্ত হয়ে উঠছে। অতি দ্রুত এই দমবন্ধকর অনুভূতি থেকে মুক্তি পেতে চায় সে। এই জড়তা কাটিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলতে চায়। দ্বিধাময় দৃষ্টিতে সোহানী নীড়ের নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকালো। ক্ষীণ গলায় বলল,,

“ছাড়ুন প্লিজ। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে।”

নীড় নিরুত্তর। বিষয়টাকে বেশি আমলে নিলো না। সোহানীর আড়ষ্ট দৃষ্টি থেকে মগ্ন দৃষ্টি সরিয়ে সে ডান হাতে থাকা কফির মগটায় লম্বা এক চুমুক দিলো। পর পর কফিতে দুটো চুমুক দেওয়ার পর নীড় পুনরায় আবিষ্ট দৃষ্টিতে সোহানীর দিকে তাকালো। মৌনতা ভেঙে দুষ্টু গলায় বলল,,

“কফিটা আগে শেষ করতে দাও। এরপর দেখছি।”

সঙ্গে সঙ্গেই সোহানীর কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠল! নীড়ের দুষ্টু হাসির পিছনে প্রখর রোমাঞ্চতার আভাস পেল। যা এই মুহূর্তে সোহানীর হৃদয়টাকে ভূমিকম্পের ন্যায় কাঁপিয়ে তুলল। মনে তৈরি হওয়া ভয়-ভীতিকে আরও পাকাপোক্তভাবে তৈরি করে তুলল। দুড়ুদুড়ু বুকে সোহানী নীড়ের দিকে বিমূর্ত দৃষ্টিতে তাকালো। এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার জন্য অসহায় ভাব নিলো। কাঠ কাঠ গলায় বলল,,

“এখনি ছেড়ে দিন প্লিজ। আমি একটু ওয়াশরুমে যাব।”

নীড় চটে বসল। গরম দৃষ্টিতে সোহানীর দিকে তাকালো। তিক্ত গলায় বলল,,

“আমার কাছে এলেই তোমার ওয়াশরুমে পায় না?”

রাগে গজগজ করে সোহানীর কোমরটা ছেড়ে দিলো নীড়! কফির মগটা সশব্দে ডেস্কের উপর রাখল। খিটখিটে মেজাজে বলল,,

“মুডটাই নষ্ট করে দিলো। সবকিছুতেই বেগড়া দিতে হবে এই মেয়েটার।”

সোহানী ভীরু দৃষ্টিতে নীড়ের দিকে তাকালো। ভয়াল গলায় বলল,,

“সত্যিই আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল।”

“অস্বস্তি হওয়ার কারণটা কী হ্যাঁ? অস্বস্তি হওয়ার কারণটা কী? আমি কি তোমাকে কিছু করার উদ্দেশ্যে কোমর পেঁচিয়ে ধরেছিলাম? তোমাকে কাছ থেকে অনুভব করার জন্য-ই ধরেছিলাম। তাছাড়া তুমি না চাইলে আমি কখনো তোমাকে ফোর্স করবনা কিছু করার জন্য। আসার পর থেকেই দেখছি তুমি আমার থেকে দূরে দূরে থাকছ। আমার কাছে আসতে ইতস্ততবোধ করছ। যা আমাকে খুব হার্ট করছে। আমি তো নিজ থেকেই তোমার কাছে আসছি তাইনা? তাহলে এখন কেন এত প্রবলেম তোমার হ্যাঁ? আমার কাছে আসতে কীসের এত বাঁধা তোমার?”

সোহানীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। মাথা নুইয়ে সে নাক টানতে লাগল। মনে মনে আওড়ে বলল,,

“একটা মেয়ে এত সহজে তার স্বামীর কাছে ধরা দিতে চায়না নীড়! ছলা-কলা করে স্বামীদের-ই তাদের স্ত্রীদের মানিয়ে হয়। তাদের চাহিদা পূরণ করতে হয়। আপনি তো অল্পতেই রেগে যাচ্ছেন নীড়। কীভাবে আমার মনের ভাব বুঝবেন বলুন?”

বিষন্ন মনে সোহানী জায়গা থেকে প্রস্থান নেওয়ার পূর্বেই নীড় পেছন থেকে সোহানীকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল! রাগান্বিত ভাবমূর্তি পাল্টে আহ্লাদী হয়ে সোহানীর পিঠে মুখ ঠেকালো! কোমরে দু’হাত পেচিয়ে সোহানীর কানে আচ্ছন্ন গলায় গুঞ্জন তুলে বলল,,

“মন খারাপ করলে কিন্তু ফার্স্ট নাইটে একটুও ঘুমাতে দিবনা! আমি যেভাবে ধরেছি ঠিক সেভাবেই থাকবা৷ একটুও নড়াচড়া করবানা! যদি এবারও আমার কথার নড়চড় হয়না? তো দেখবা জোর করে কীভাবে নিজের অধিকার বুঝে নিই।”

মুহূর্তের মধ্যেই সোহানীর মনটা শান্ত হয়ে এলো। মনোক্ষুণ্ণতা মিইয়ে প্রফুল্লতায় ভরে উঠল। পরম আবেশে সে চক্ষু জোড়া বুজে নিলো। ম্লান হেসে এক জায়গায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল। জোর করে সে নীড়কে পেতে চায়না। স্ব-ইচ্ছায় মন থেকে পেতে চায়। নীড়ের কাছাকাছি থাকলে হয়তো সে ইচ্ছেটা খুব শীঘ্রই জাগ্রত হবে তার! সোহানীর নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠল নীড়। ঘাড়ে এক একে করে ভালোবাসার পরশ ছোঁয়াতে লাগল। চোখ বুজে সোহানীকে খুব কাছ থেকে ফিল করতে লাগল।

,
,

পুচিকে এইমাত্র কাঁথার তলায় ঘুম পাড়িয়ে এলো চাঁদ। এবার একটু ধীরে-সুস্থে পড়া যাবে। ম্যাথেও ঠিকভাবে কনসেন্ট্রেট করা যাবে। জায়মা অবশ্য অনেকক্ষণ আগে থেকেই ম্যাথ করা শুরু করে দিয়েছে। তবে চার নম্বর ম্যাথটাতে এসে সে আটকে গেছে। ম্যাথটা মিলাতে না পেরে রাগে সে কলম কামড়াচ্ছে। বার বার ব্যর্থ হওয়ার পরেও ম্যাথটা মিলানোর চেষ্টা করছে। চাঁদ স্কেল টেনে যেই না ম্যাথটা শুরু করতে যাবে অমনি জায়মা চাঁদকে ডাকল। বিরক্তিকর গলায় বলল,,

“চাঁদ শোন না? ম্যাথটা মিলাতে পারছিনা। তুই একটু দেখবি?”

“চাল হাট! আমি তো এখনো আগের ম্যাথগুলাও করতে পারি নাই। তুই আছিস তোরটা নিয়ে।”

“চার নম্বর ম্যাথটা খুব কঠিন রে। আই থিংক আমাদের আয়মন ভাইয়াকে ডাকা উচিৎ।”

চাঁদ উজবুক দৃষ্টিতে জায়মার দিকে তাকালো। প্রশ্নবিদ্ধ গলায় বলল,,

“পাগল হইছস? রাত কয়টা বাজে দেখেছিস? সবাই এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। তো আয়মন ভাইয়া কি আমাদের জন্য এখনও জেগে থাকবে?”

“তবুও। আয় না একটু দেখে আসি।”

জায়মার আবদারকে চাঁদ আমলে নিলো না। একরোখা গলায় বলল,,

“আরও একটু চেষ্টা কর পারবি। আর এখন না পারলে রেখে দে, সকালে ভাইয়াকে দেখাস।”

“এক্ষণি না করলে সকালে আর ইচ্ছে হবেনা চাঁদ। এমনিতেও আমরা কিন্তু ম্যাথ কম বুঝি। তাই এই বিষয়টাতে জোর দেওয়া খুব-ই প্রয়োজন। তাছাড়া এখন আমাদের হেলায় একমিনিট নষ্ট করা মানে আগামী পরীক্ষায় ডাব্বা মেরে আসা।”

চাঁদ অপারগ দৃষ্টিতে জায়মার দিকে তাকালো। সত্যিই এখন একমিনিট নষ্ট করা মানে আগামী পরীক্ষায় খারাপ করে আসা। মাথা নাড়িয়ে জায়মার কথায় চাঁদ সম্মতি জানালো। উপায়ন্তর খুঁজে না পেয়ে পাশ থেকে সেলফোনটা হাতে তুলে নিলো। আয়মনের নাম্বারে ডায়াল করে জায়মাকে লক্ষ্য করে বলল,,

“দাঁড়া ভাইয়াকে আগে কল দিই। দেখি রিসিভ করে কিনা।”

পর পর চারবার ডায়াল করা হলো আয়মনের নাম্বারে। কিছুতেই ফোনটা তুললনা আয়মন। ঐ পাশ থেকে কোনোরকম সাড়া না পেয়ে চাঁদ এবার নাক-মুখ কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করল। ফোনটা ঝট করে হাত থেকে রেখে দিলো। জায়মার দিকে তাকিয়ে নাক সিটকে বলল,,

“ছাড় তো। নিজে নিজে যা পারিস কর। বেস্ট ফ্রেন্ডসদের কাছে পেয়ে এখন আমার ফোনটা তুলতেও সমস্যা হচ্ছে উনার! না জানি কী কী করে বেড়াচ্ছে তিন শ’য়তান মিলে। একেকটা ব’দের হাড্ডি। মাথা ঠিক থাকেনা তিনজন একসাথে হলে। দেখ ফাঁকা বাড়ি পেয়ে না তিনোটা মিলে বিদেশী ওয়াইন গিলছে!”

জায়মাও নাছোড়বান্দা। চাঁদের কথায় দ্বিমত পোষণ করল সে। ঝট করে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। চাঁদকেও টেনেটুনে বসা থেকে দাঁড় করালো! চাঁদের হাত টেনে ধরে জেদি গলায় বলল,,

“চল নিচতলায় হানা দিই! আয়মন ভাইয়াকে ধরে আনি। দেখে আসি তিনোটা মিলে সত্যি সত্যি কী করে বেড়াচ্ছে।”

চাঁদ অবাক হলো। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আজ তোর কী হইছে একটু বলবি? হঠাৎ পড়ালেখার প্রতি এত ইন্টারেস্ট জেগে উঠল? এমনিতে তো রাতের বেলাও একরত্তি পড়তে বসিসনা তুই! আর আজ কিনা এই মাঝরাতে-ই তোর পড়ার পিনিক উঠল?”

জায়মা মুখটা কালো করে নিলো। মাথা নুইয়ে বিমূর্ষ গলায় বলল,,

“লাস্ট পরীক্ষাটা আমার খারাপ হইছে রে। তাই আগামী পরীক্ষাগুলো খারাপ হোক আমি চাইনা।বাকি চারটা পরীক্ষায় আমি খুব সিরিয়াস। সিরিয়াস মানে সিরিয়াস। আমার সাথে সাথে তোকেও সিরিয়াস হতে হবে।”

চাঁদকে কিছু বলার সময় সুযোগ দিলো না জায়মা। তাকে নিয়ে টেনেটুনে দরজার কাছে চলে এলো। ইতোমধ্যেই জায়মার দৃষ্টি পড়ল চাঁদের ওয়াড্রবের উপর। ডেইরি মিল্ক দুটো এমনি এমনি পড়ে আছে উপরে। দুটো থেকে একটা ডেইরি মিল্কের মুখ খোলা। ক্রিমিনেস বাইরে থেকেই টইটম্বুর! লোভে জায়মার জিভ লকলক করে উঠল! আগপাছ না ভেবে সে অন্য হাত দিয়ে ডেইরি মিল্কটা হাতে তুলে নিলো। টুপ করে ডেইরি মিল্কটা মুখে তুলে সে লোভাতুর গলায় বলল,,

“আহ্! মজা!”

রাগে গজগজ করে চাঁদ জায়মার হাত থেকে ডেইরি মিল্কটা কেড়ে নিলো! কঠিন গলায় বলল,,

“কে না কে দিয়েছে এটা। অমনি তোর জিভ লকলক করে উঠল? না জেনেই খাদকের মতো আচরণ করতে শুরু করলি?”

“যেই দিক। একটু খেতে দে না রে। জিভে জল চলে এলো আমার।”

ডেইরি মিল্কটা বিছানার উপর ছুড়ে মারল চাঁদ! জায়মার হাত ধরে রুম থেকে প্রস্থান নিলো। রাগে ফোঁস করে বলল,,

“জীবনেও খাস নি নাকি? আঙ্কেল তোকে কখনও কিনে এনে খাওয়ায়নি?”

“ইন্ডিয়ানগুলা তো খাওয়ায় নি! একটু খেলে কী এমন হবে বল তো? একটু দে না, আমি খাব!”

“চুপ থাক। তোর মতো রাক্ষস একটা মেয়ে আমি জীবনেও দেখিনি! এতক্ষণ তো খু্ব পড়ে টড়ে ছিঁড়ে ফেলছিলি। অভার সিরিয়াসনেস দেখাচ্ছিলি! আর এখন খাবারের পিছনে লেগে পড়লি? জোর করে আমাকে পড়ার টেবিল থেকে উঠিয়ে ছিলিনা? এবার তোকেও আমি টানতে টানতে নিচে নিয়ে যাব৷ বাইরে ভূতের কাছে ছেড়ে দিয়ে আসব!”

ভয়ে জায়মা চুপসে গেল! ভূতের কথা শুনতেই তার হরর ফিল্মগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। সর্বাঙ্গ ভয়ে কাঁপতে লাগল। কম্পিত গলায় সে চাঁদকে বলল,,

“চচচল ফিফিরে যাই। ম্যাম্যাম্যাথ করা লালাগবেনা আমার।”

“লাগবে! লাগতেই হবে। তোকে আজ আমি ম্যাথ করা লাগিয়েই ছাড়ব।”

জায়মাকে টেনে-হেছড়ে নিয়ে চাঁদ নিচতলায় নেমে এলো। নির্ভীক হয়ে আয়মনদের ফ্ল্যাটের দরজায় ধাক্কা মারল। অমনি অমনি দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল! কোনো চোট-পাট করতে হলোনা। চাঁদ অবাক হলো। তবে ভয় পেল না। উল্টোদিকে জায়মা সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গেল। মুখে একহাত চেপে সে পূর্বের তুলনায় ভয়ে আরও বেশি কাঁপতে লাগল। এই মুহূর্তে চাঁদ ভয় পাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখল। বুকে সাহস সঞ্চার করে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমের ভেতর ঢুকে পড়ল। অমনি অন্ধকারে তাদের চোখজোড়া ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এলো! ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত পুরো ড্রয়িংরুম। আশেপাশের রুমগুলোতেও আলো বন্ধ। কোথাও কোনো আলোর ছিটিফোঁটা নেই। শুধু হাতের ডান পাশের রুম থেকে আলোর সূক্ষ্মরশ্মি দরজা ভেদ করে ড্রয়িংরুম অবধি বের হয়ে আসছে। আলোর ছটা এতোটাই সূক্ষ্ম যে আশপাশটা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছেনা। শুধু চোখেই খানিক ঠাওড় করা যাচ্ছে। ভেতর থেকে ঈষৎ গান-বাজনার আওয়াজও ভেসে আসছে। বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা, রুমে টিভি চলছে অথবা ল্যাপটপ চলছে। উপায়ন্তর খুঁজে না পেয়ে চাঁদ জায়মার হাতটা ছেড়ে আয়মনের রুমের দিকে রওনা হলো। হনহন করে হেঁটে আয়মনের রুমের দরজায় হাত লাগাল। অমনি দরজাটা ফট করে খুলে গেল! হঠকারিতায় মুখটা হা করে চাঁদ দরজা ঠেলে রুমের ভেতর প্রবেশ করল। অমনি চাঁদের চক্ষুজোড়া লজ্জায় ভেঙে এলো। সঙ্গে সঙ্গেই সে পিছু ঘুরে দাঁড়ালো৷ নাক-মুখ সিটকে বলল,,

“ছিঃ!”

সঙ্গে সঙ্গেই নূর, মাহিন এবং আয়মন ভড়কে উঠল! একেকজন মুভির ঘোর কাটিয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। টিভিতে এখনো ইমরান হাশমির কি’সিং সিন চলছে! অস্থির দৃষ্টিতে নূর, মাহিন এবং আয়মন আশেপাশে রিমোটটা খুঁজতে লাগল। কোথাও রিমোটটা খুঁজে না পেয়ে নূর পাওয়ার অফ করা ছাড়াই দৌঁড়ে টিভিটার সুইচ অফ করে দিলো! কম্পিত গলায় চাঁদকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“তুতুতুমি এখানে কী করছ?”

ঘৃণায় চাঁদের মুখ থেকে কথা বের হচ্ছিলনা! রুচিতে কুলোচ্ছিল না এই জায়গায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার। মুখ ঢেকে সে হন্তদন্ত হয়ে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। নূর মাথায় হাত দিয়ে হতাশ দৃষ্টিতে আয়মন এবং মাহিনের দিকে তাকালো। তারা দুজনও মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে! অনুতাপ অনুশোচনায় ভুগছে। লাজভরা দৃষ্টিতে মাহিন নূরের দিকে তাকালো। নিচু গলায় বলল,,

“তোকে আমি বারণ করছিলাম না? এখন হলো তো?”

নূর বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। রূঢ় গলায় বলল,,

“আমাকে কী বলছিলি হ্যাঁ? কী বলছিলি? আর এখানে খারাপের কী আছে? মুভিই তো দেখছিলাম নাকি? সো এখানে ভালো-খারাপ সিন থাকতেই পারে। ইট’স নরমাল।”

আয়মন কপাল চাপড়ে উবুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। লজ্জায় তার মাথা কাটা গেল। বিমূঢ় গলায় বলল,,

“আর একমাসও আমি চাঁদের মুখোমুখি হতে পারবনা! চাঁদের চোখে চোখ ও মিলাতে পারবনা।”

নূর হন্ন হয়ে চাঁদের পিছু ছুটল। জায়মা এবং চাঁদ এতক্ষণে সদর দরজার দিকে পা বাড়ালো। জায়মা উতলা হয়ে ঐ রুমে কী ঘটেছে তা জানতে চাইল৷ চাঁদ লজ্জায়-ঘৃণায় মুখ খুলে কিছু বলতে পারছেনা জায়মাকে। বাকশক্তি হারিয়েছে সে। অমনি পেছন থেকে চাঁদের হাতটা টেনে ধরল নূর! শান্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কই যাচ্ছ?”

নূরের দিকে একটি বারের জন্যও ফিরে তাকালনা চাঁদ। নূরের ছোঁয়ায় তার গাঁ টা যেনো রি রি করে উঠল। নূরের হাতটা ছাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠল সে। হাতটা ঝেড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“হাতটা ছাড়ুন বলছি।”

“ছাড়ব। তবে এর আগে আমার কথাটা শোনো।”

“আমি আপনার কোনো কথা শুনতে চাইনা।”

“শুনতে হবে। কারণ তুমি আমাকে ভুল বুঝছ।”

“আপনার মতো খারাপ একটা লোককে নতুন করে আর ভুল বুঝার কী আছে?”

“চাঁদ তুমি কিন্তু আমাকে সত্যিই ভুল ভাবছ। তুমি যা দেখেছ ইট’স নরমাল। প্রতিটা মুভিতেই এমন ভালো-খারাপ অনেক সিন থাকে। আমরাও সেই সিনটাই দেখছিলাম। খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা এই সিনটা দেখছিলাম না। তুমি চাইলেই কিন্তু এটা নরমালভাবে নিতে পারো।”

“আমার কাছে এটা মোটেও নরমাল মনে হয়নি! উল্টো আপনাদের প্রতি খারাপ ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। এবার হাতটা ছাড়ুন প্লিজ। ফালতু সময় নষ্ট না করে আমাদের পড়তে হবে।”

চাঁদের হাতটা ছেড়ে দিলো নূর৷ ভাবশণ্য গলায় বলল,,

“তোমার চোখে নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করার মতো সত্যিই কিছু নেই! তুমি আমাকে খারাপ ভাবলেও আমার কিছু আসবে যাবেনা। কারণ, ভালো-খারাপ দুটো মিলিয়েই আমি তোমার!”

শেষের কথাগুলো নূর এতোটাই থমথমে গলায় বলেছিল যে চাঁদের কান অবধি সেই কথাগুলো পৌঁছালো না! গটগট করে চাঁদ জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে জায়মাকে বলল,,

“শখ মিটেছে এবার ম্যাথ করার? আর কখনও চিল্লাবি রাতে-বিরাতে আয়মন ভাইয়াকে ডাকার? তাদের প্রাইভেট টাইমিংয়ে গিয়ে ডিস্টার্ব করার?”

জায়মা এতক্ষণে বুঝে গেছে চাঁদ কেন রিয়েক্ট করে আয়মনের রুম থেকে বের হয়ে গিয়েছিল! তাই সে রাগান্বিত চাঁদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকালো। মুখে হাত গুজে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। দুজনই এবার নিঃশব্দে নিজেদের পড়ার রুমের দিকে অগ্রসর হলো।

নূর অগ্নিশর্মা হয়ে চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। সশব্দে সদর দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিলো। দ্রুত পায়ে হেঁটে আয়মনের রুমে প্রবেশ করল। রুমের দরজাটাও ভালোভাবে লক করে বিছানার উপর ধপ করে বসল। মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা মাহিনের দিকে আগ্রাসী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কড়া গলায় বলল,,

“তোর আ’বাল মার্কা পি’নিকের ঠেলায় আজ এতোকিছু ঘটল! বাইরের দরজাটাও লাগাতে ভুলে গিয়েছিলাম আর ভেতরেরটাও। এই একটা ভুলের জন্য আজ কতোবড় একটা ব্ল্যান্ডার হয়ে গেল। চাঁদের চোখে আজীবনের জন্য খারাপ হয়ে গেলাম।”

,
,

পড়ার টেবিলে বসে তাশফিয়া আনমনে চোখের জল ছাড়ছে! সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলো তাকে বার বার পোড়াচ্ছে! বিশেষ করে চাঁদের রুক্ষতা তাকে বড্ড কষ্ট দিচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকে অনেকবার তাশফিয়া চেষ্টা করেছিল চাঁদের সাথে একটিবার যোগাযোগ করার। তবে প্রতিবার চাঁদের নাম্বারটা ব্যস্ত আসছে। জায়মার নাম্বারেও সে অনেকবার ট্রাই করেছিল। অনুরূপভাবে জায়মার নাম্বারটাও ব্যস্ত আসছে! আজ তার একটা ভুলের জন্য এতোদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেল! অচিরেই তাদের সম্পর্কের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হলো। সেই কষ্টটা-ই যেনো কিছুতে সামাল দিতে পারছেনা তাশফিয়া। ক্ষণে ক্ষণে মনটা কেঁদে উঠছে তার।

তাশফিয়ার চাপা আর্তনাদে শোয়া থেকে ওঠে গেল তার মা মিস জেসমিন হক! ঘুম পাতলা হওয়ার দরুন হালকা শব্দেও উনার ঘুম ভেঙে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কান্নায় ভেঙে পড়া তাশফিয়ার নাক টানার শব্দে উনি কাঁচা ঘুম থেকে ওঠে পড়তে বাধ্য হলেন। ঘুমন্ত চোখে তাশফিয়ার দিকে আচ্ছন্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,,

“কী রে মা? কী হয়েছে? তুই কাঁদছিস কেন?”

#চলবে…?