প্রেমময়ী তুমি পর্ব-৪৪+৪৫

0
518

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৪৪
#নিশাত_জাহান_নিশি

“উঁহু বউ। আজ রাতেই বিয়ের ডেইট ফিক্সড করব দেন কাল সকালে বাড়ি ফিরব।”

সোহানী লাজুক হাসল। স্বস্তির শ্বাস ফেলে নীড়কে তার বুকের পাঁজরে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। নীড়ের বাঁ কর্ণতলে গুঞ্জন তুলে বলল,,

“আমার কাছে সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে নীড়! কখনো ভাবী নি আপনাকে আমি স্বামী রূপে পাব। কিংবা আমরা এক ছাদের তলায় থাকব। একসাথে দুজনে সংসার করব। আমাদের মধ্যে আদোতে কখনো প্রণয় হবে!”

নীড় ভালোবাসার মোহে চিরাচরিতভাবে আবিষ্ট হয়ে উঠল। সোহানীর উষ্ণ ঘাড়ে একের পর এক ভালোবাসার পরশ ছোঁয়াতে লাগল। ঘোর জড়ানো গলায় বলল,,

“প্রণয় থেকে এবার শুধু মিলনের অপেক্ষা সোহা। আমি খুব এক্সাইটেড! বাচ্চার বাবা হওয়ার জন্য!”

“ইশশশ! এখনো কিছুই হলো না, আর এই লোক আছে শুধু বাচ্চার চিন্তা নিয়ে! আপনার মাথাতেই এসব দুষ্টু বুদ্ধি আসতে পারে।”

নীড় নেশাধরা দু’চোখে সোহানীর দিকে তাকালো। সোহানীর নাজুক ভাবনাচিন্তাগুলোকে সে মুহূর্তের মধ্যেই উল্টে পাল্টে দিলো। সোহানীকে পাওয়ার মোহে গভীরভাবে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল। উপায়ন্তর না পেয়ে সে ঘোর কাটিয়ে নিমগ্ন গলায় বলল,,

“তুমি চাইলে এখনই সব হবে সোহা! আর ইউ রেডি ফর দ্যাট?”

অতিশয় বিপাকে পড়ে সোহানী ছটফটে ভঙ্গিতে ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো! নীড়ের বেহায়া দৃষ্টি থেকে তার লজ্জামাখা দৃষ্টি আড়াল করার জন্য সে দু’হাত দ্বারা সমস্ত মুখমণ্ডল ঢেকে নিলো। দুড়ুদুড়ু বুকে অস্ফুটে গলায় বলল,,

“উঁহু! আজ নয় নীড়। যেদিন আমি বধূরূপে আপনার বাড়ি যাব আপনার রুমে যাব সেদিন সব হবে।”

বাঁকা হাসল নীড়। আদুরে হয়ে সোহানীকে পুনরায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। দুষ্টু গলায় বলল,,

“ওহ্ আচ্ছা! ফুলসজ্জার এক্সট্রা আদরের জন্য অপেক্ষা করছ না?”

রেগে ওঠে সোহানী নীড়ের বুকে অগনিত কি’ল-ঘুঁ’ষি মা’রতে লাগল। সোহানীকে না আটকিয়ে নীড় খিলখিলিয়ে হেসে বলল,,

“উফফস! বউরা মা’রলেও কেমন আদর আদর লাগে!”

,
,

দুপুর গড়িয়ে বিকেল ঘনিয়ে এলো। ঘড়িতে বিকেল চারটা বেজে প্রায় পঞ্চাশ মিনিট চলমান। চাঁদ, জায়মা এবং তাশফিয়া পুরো খাতা রিভাইস করে পরীক্ষার হল থেকে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনজনের চেহারাতেই অনাবিল হাসিখুশির ছাপ প্রতীয়মান! পরীক্ষা প্রত্যাশার তুলনায় খুব বেশি ভালো হয়েছে বিধায় তাদের খুশি যেনো আর ধরছেনা। সাপের পাঁচ পা পেয়ে গেছে তারা। চাঁদের পাশের মেয়েটা অনেকক্ষণ আগেই অসুস্থ শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে! জ্ঞান হারিয়ে যা ইচ্ছে তা অবস্থা হয়েছিল মেয়েটির। মূলত অভুক্ত থাকার কারণে শরীরে অকথ্য দুর্বলতা দেখা দেয় মেয়েটির। শরীর পুরোপুরি ছেড়ে দেয়। তার উপর অসহ্যকর গরম। সব মিলিয়েই মেয়েটার শরীরের করুন দুর্দশা হয়ে উঠেছিল। দু’ঘণ্টার বেশি পরীক্ষা দিতে পারেনি মেয়েটি! কোনোরকম টেনেটুনে পাশ মার্ক তুলে সে বাড়ি ফিরে গেছে। মেয়েটির এই দূরবস্থা দেখে চাঁদ মনে মনে নূরকে খুব থ্যাংকস দিচ্ছিল। নূরের জেদের জন্যই আজ আপত্তি থাকা সত্ত্বেও চাঁদ দুপুরের খাবার খেয়ে এসেছে। নয়তো আজ তারও মেয়েটির মতো অবস্থাই হতো! দুর্বল শরীর বাড়ি ফিরতে হতো। উফফ.. ভাবতেই তার গাঁ টা কাটা দিয়ে উঠল!

রিভাইস শেষে কারেক্ট পাঁচটায় সময়ের শেষ ঘণ্টা বাজার সাথে সাথেই চাঁদ, জায়মা এবং তাশফিয়া স্যারদের কাছে তাদের খাতা জমা দিয়ে হলরুম থেকে বের হয়ে এলো। তিনজনই খোশমেজাজে মাথায় পুনরায় হিজাব পেচিয়ে নিলো। ক্যাম্পাসে আশেপাশের ফ্রেন্ডসদের পরীক্ষা কেমন হয়েছে জানল এবং তাদের সাথে নানান ভঙ্গিতে কৌশল বিনিময় করল। অতঃপর চাঁদ বেশ উত্তেজিত হয়ে জায়মা এবং তাশফিয়াকে শুধালো,,

“এবার বল পরীক্ষা কেমন হলো তোদের? সব কমন না?”

জায়মা এবং তাশফিয়া খুশিতে দাঁত কেলিয়ে হাসল। চাঁদের দিকে হাসোজ্জল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সমস্বরে বলল,,

“দারুন হয়েছে রে। এতোটা ভালো হবে আশা করিনি। প্রশ্ন হাতে নিয়ে মাথা পুরাই গরম। কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখব হেব্বি কনফিউজড।”

চাঁদ ফিক করে হেসে দিলো। কোমরে দু’হাত গুজে জায়মা এবং তাশফিয়ার দিকে ট্যাড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অকপট গলায় বলল,,

“ওকে। এবার তাহলে আমাকে আইসক্রীম খাওয়া। ঐদিন কিন্তু আমি তোদের খাইয়েছিলাম। আজ শোধ বোধ হয়ে যাক!”

তাশফিয়া কিছু বলার পূর্বেই জায়মা তাশফিয়ার মুখের কথা টেনে নিলো। দৃঢ় গলায় বলল,,

“ওকে চল। আজ না হয় আমিই তোদের খাওয়া। আই থিংক ক্যান্টিন এখনও ওপেন আছে।।”

ক্যান্টিনে যাওয়ার পথে তাশফিয়া বেগড়া দিলো। নাক-মুখ কুঁচকে ক্ষীণ গলায় বলল,,

“এই না। ক্যান্টিনে গেলে এখন দাগাইয়া ফেলবে। কলেজের বাইরে চল।”

চাঁদ সহমত পোষণ করল৷ নাক ফুলিয়ে শাণিত গলায় বলল,

“ক্যান্টিনটা হুদাই দিছে। কে যায় ঐ বড়োলোকি ক্যান্টিনে? এরচেয়ে বরং রাস্তাঘাটের দোকানগুলো ভালো। ন্যায্যমূল্যে সব পাওয়া যায়। চড়া দামে কিছু কিনতে হয়না।”

তিনজনই খোশগল্পে লিপ্ত হয়ে মন্থর পায়ে হেঁটে কলেজের সুবিশাল গেইট পাড় হলো। গেইটের বাইরে পা রাখতেই অমনি তারা তিনজন নূর, মাহিন এবং আয়মনের মুখোমুখি হয়ে গেল! চাঁদ, জায়মা এবং তাশফিয়া থমকে দাঁড়ালো। তিনজনই ঐ তিনজনের দিকে বিস্মিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তাদের ধারণার বাইরে ছিল বাইরে তাদের জন্য নূর, মাহিন এবং আয়মন অপেক্ষা করছে! এতোগুলো ঘণ্টা একটানা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা কী কারো পক্ষে আদোতে সম্ভব? বাইকের উপর বসে নূর বিষয়টা নোটিশ করল! চাঁদের মুখমণ্ডলে সে চওড়া দুঃশ্চিন্তার ছাপ দেখতে পেল। ধপ করে সে বাইক থেকে নেমে পড়ল। শার্টের কলারটা উঁচিয়ে দু’কদম হেঁটে সে সোজাসুজি চাঁদের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। ঘর্মাক্ত এবং অবিন্যস্ত চুলগুলো দক্ষ হাতে বিন্যস্ত করে সে চাঁদের চিন্তিত মুখমণ্ডলে ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। চাঁদকে এসব চিন্তা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সে নীলাভ চক্ষুজোড়ায় জিজ্ঞাসা এনে বলল,,

“এক্সাম কেমন হলো?”

চাঁদ নিরুত্তর। কিয়ৎক্ষণ মৌনতায় কেটে যাওয়ার পর চোখে-মুখে বিস্ময়ী ভাব ফুটিয়ে তুলল। পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“আপনি এতক্ষণ অবধি এখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন?”

চাঁদের একরোঁখা প্রশ্নে নূরের তেমন কোনো ভাবান্তর হলোনা! সে একগুঁয়ে আবারও একই প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“আমি যা আস্ক করেছি তার আনসার দাও আগে। এক্সাম কেমন হয়েছে বলো?”

চাঁদ প্রফুল্ল হাসল। প্রত্যত্তুরে বলল,,

“ভালো হয়েছে।”

“শরীর টরীর খারাপ করেনি তো আবার?”

“উঁহু৷ তবে আপনাকে একটা থ্যাংকস দেওয়ার আছে!”

“কীসের থ্যাংকস?”

“শুধু আপনার জন্যই আজ পরীক্ষাটা আমি সুস্থভাবে দিতে পারলাম! আপনি জেদ না করলে হয়তো আজ না খেয়েই হলে আসতে হতো। আর পরীক্ষা না দিয়েই ঐ মেয়েটার মতো বাড়ি ফিরে যেতে হতো।”

নূর খানিক অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। পেছনের চুলগুলো টেনে সে মাথাটা নুইয়ে নিলো। চাঁদের মুখ থেকে তার প্রশংসা শুনে অদ্ভুত এক লজ্জাবোধ কাজ করতে লাগল! ভালোবাসার মানুষদের কাছ থেকে প্রশংসা শুনতে কার-ই না ভালো লাগে? পরিস্থিতি পাল্টাতে নূর ম্লান হেসে ক্ষীণ গলায় বলল,,

“আচ্ছা এখন এসব বাদ দাও। কী খাবে বলো?”

চাঁদ হা করে কিছু বলার পূর্বেই জায়মা আনন্দে লাফিয়ে উঠল। প্রফুল্লিত গলায় বলল,,

“আমরা আইসক্রীম খাব ভাইয়া।”

জায়মার দিকে তাকিয়ে নূর স্মিত হাসল। সায় জানিয়ে বলল,,

“আচ্ছা চলো। আমার সবগুলা কাজিনই হয়েছে আইসক্রীম পাগলী।”

নূর খোশমেজাজে সামনের দিকে হাঁটা ধরল৷ মনের আকাশে রংধনু দেখার মতো খুশি সে! চাঁদকে হয়তো একটু একটু করে ইমপ্রেস করতে পারছে সে। চাঁদের চোখ-মুখ দেখেই বেশ আঁচ করতে পারছে সে। একবার শুধু চাঁদকে সে মনের কথা বুঝাতে পারলেই হলো! বাকিটা ধীরে সুস্থে আগালেও কোনো সমস্যা নেই। এবার তার আর কোনো তাড়াহুড়ো নেই। মাথা নুইয়ে কিঞ্চিৎ হেসে চাঁদ এবং জায়মা নূরকে অনুসরণ করল। আইসক্রীম খাওয়ার জন্য তাদের তৃষ্ণার্ত গলা আঁকুপাকু করে উঠল। আয়মন ট্যাড়া দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ যাবত ভয়ার্ত তাশফিয়াকে প্রত্যক্ষণ করল। অতঃপর ভ্রু উঁচিয়ে তাশফিয়ার মুখোমুখি দাড়ালো। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই? তুমিও কি আইসক্রীম খাবা?”

তাশফিয়া থতমত খেলো। শুকনো ঢোক গিলে চোখ উঠিয়ে ভীরু দৃষ্টিতে আয়মনের দিকে তাকালো। প্রত্যত্তুরে শুধু ডানে বায়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। আয়মন বুকের পাঁজরে দু’হাত গুজল। উদ্বেগি হয়ে পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“তুমি কি এখনো আমাকে ভয় পাও?”

তাশফিয়া শুষ্ক দৃষ্টিতে আয়মনের দিকে তাকালো। হাতের ফাইলটা শক্তভাবে আঁকড়ে ধরল। কাঠ কাঠ গলায় বলল,,

“হ্যাঁহ্যাঁ!”

“কিন্তু কেন? এখন কি আমি তোমাকে আর বকি?”

তাশফিয়া ডানে বায়ে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। আয়মনের ভয়ে সে অর্ণগল শুকনো ঢোঁক গিলতে লাগল। অস্থির দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে চাঁদ এবং জায়মাকে খুঁজতে লাগল। মনে মনে আওড়ে বলল,,

“এর আবার কী হলো হঠাৎ? এভাবে আমার পথ আটকে দাঁড়ালো কেন? ঐদিনের পর থেকে তো একে আমি য”মের মতো ভয় পাই। বুঝে না কেন উনি? ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন দেখলেও কি বুঝে না?”

আয়মন মনে মনে ব্যাপক হাসল! মনে মনে অভিসন্ধি কষিয়ে বলল,,

“সাহসী মেয়েটাও এখন আমাকে দেখে ভয় পায়! একে এভাবে ভয় পেতে দেখলে পৈশাচিক আনন্দ পাই আমি! আই ডোন্ট নো হোয়াই! বাট এর ভয়ার্ত মুখটা দেখি আজকাল ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠছে আমার! অভ্যেস হয়ে দাঁড়াচ্ছে না তো আবার?”

দুজনের জল্পনা কল্পনার মাঝে মজনু মাহিন এসে ব্যাঘাত ঘটালো! দেবদাসের মতো পাগলাটে রূপ ধারণ করে সে তাশফিয়ার দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। স্পাইক করা চুলগুলো টেনে তীক্ষ্ণ গলায় তাশফিয়ার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“এই? তোমার বোন তিথী কোথায়? আসেনি কেন আজ?”

তাশফিয়া নড়েচড়ে উঠল। মাথা উঁচিয়ে বিশৃঙ্খল দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো। প্রত্যত্তুর করার বদলে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“তিথী কেন এখানে আসবে ভাইয়া? ওর কলেজ তো এটা না।”

“তোমাকে পিক করতে আসেনা?”

“উঁহু। ওর পরীক্ষার সেন্টার তো পড়েছে অন্য কলেজে। সে নিজেই হয়তো এখন পরীক্ষা দিয়ে হল থেকে বের হয়েছে।”

মাহিন উদগ্রীব হয়ে উঠল। হতাশার মাঝেও আশার আলো খুঁজে পেল। মনটা আকুপাকু করে উঠল। উচাটন গলায় শুধালো,,

“কোন কলেজে? কলেজের নামটা বলো?”

তাশফিয়া এক ঠেলায় মুখ ফসকে বলে ফেলল,,

“মহিলা কলেজে।”

কলেজের নামটা বলেই তাশফিয়া মুখে হাত চেপে ধরল। হতভম্ব দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো। মাহিন খুশিতে দেঁতো হাসল। তাশফিয়ার দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,,

“থ্যাংকস তাশফিয়া।”

আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না মাহিন! পিছু ঘুরে পার্ক করে রাখা আয়মনের বাইকে ওঠে পড়ল। অগোছালো চুলগুলো হাতে ঠেলে পুনরায় সেট করল। প্যান্টের পকেট থেকে কালো রঙের সানগ্লাসটা বের করল। দাবাং স্টাইলে সানগ্লাসটা চোখে পড়ে বাঁকা হেসে আয়মনের দিকে তাকালো। খুশিতে দড়বড় গলায় বলল,,

“তোর ভাবির সাথে দেখা করে আসছি।”

আয়মন উজবুক দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো। মাহিন এতক্ষণে বাইক স্টার্ট করে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। মাহিনের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আয়মন জোরে চিৎকার করে বলল,,

“এই ভা’তা’র? মহিলা কলেজ চিনিস তুই? ছুটলি যে খামোখা?”

“গুগল ম্যাপ আছেনা? অসুবিধা হবেনা।”

তাশফিয়া ভড়কে উঠল। অপরাধী গলায় বলল,,

“ওহ্ শিট। এ আমি কী করলাম? এখন তো তিথী আমাকে গনধো’লা’ই দিবে!”

আয়মন পিছু ঘুরে তাশফিয়ার দিকে তাকালো। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“মানে?”

“মানে তিথী আমাকে বারণ করেছিল মাহিন ভাইয়ার সাথে দেখা হলে যেনো ভুলেও তিথীর সম্পর্কে কিছু না বলি। এখন তো আমি সব বলে দিলাম। এবার কী হবে আমার?”

আয়মন ব্যগ্র হাসল। এক চোখ টিপে তাশফিয়ার দিকে তাকালো। রসালো গলায় বলল,,

“কিছু হবেনা! আমি আছি না?”

তাশফিয়ার মাথা ঘুরে এলো! দুনিয়াটা ঝাপসা হয়ে উঠল। আয়মনের টিটকারিপূর্ণ কথাবার্তা শ্রবণ করার মতো শক্তি হয়ে উঠল না তার! তৎক্ষনাৎ সে মাথা নুইয়ে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। আয়মন পেছন থেকে তাশফিয়ার নাম ধরে ডেকে উঠল। পুনরায় শ্লেষাত্মক গলায় বলল,,

“আরে ফাইজলামি না! আমি সত্যিই আছি।”

তাশফিয়া আর একটিবারের জন্যও পিছু ফিরে তাকালো না। ফাইলটা বুকের সাথে লেপ্টে ধরে দাঁতে দাঁত চাপল। তেজী গলায় বিড়বিড় করে বলল,,

“লা’ফা’ঙ্গা’র কোথাকার! সুযোগ পেলে বিড়ালও বাঘের রূপ ধারণ করে। শুধু বন্ধুত্ব নষ্ট হবে বলেই চেপে যাচ্ছি! নয়তো এই লা’ফা’ঙ্গারকে এক্ষণি মজা বুঝাতাম!”

,
,

নীরবে নিভৃতে পাশাপাশি হেঁটে চলছে নূর এবং চাঁদ! তাদের দুজনের পাশেই জায়মা, আয়মন এবং তাশফিয়া মন্থর পায়ে হেঁটে চলছে। আকাশে একঝাঁক কালো বৃষ্টির ঘনঘটা! পেঁজা তুলোর ন্যায় মেঘেরা দলবেঁধে ছুটোছুটি করছে বিস্তীর্ণ আকাশজুড়ে। গাছ-গাছালিরা সেই আকাশঝরা বৃষ্টির অপেক্ষায় প্রায় হেলেদুলে নাচছে! বৈরী বাতাসের তাণ্ডবে এদিক থেকে ওদিক ছিটকে পড়ছে ওরা। মহাপ্রলয়ঙ্করী ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে! পৃথিবী ভর্তি চাতকপ্রাণ মানুষদের মনের আশা বুঝি এক্ষণি পূর্ণ হতে চলল। শিথিলতার স্বাদ পাবে এখন তারা মনপ্রাণ জুড়ে। আকাশের বিদঘুটে ভঙ্গিমা দেখে মনে হলো যেনো এই বুঝি ঝুম বৃষ্টিতে তলিয়ে পড়ল গোটা ধরণী। শুরু হলো টুপটাপ বৃষ্টি! বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল বিস্তীর্ণ ধরণী।

রাস্তাঘাট প্রায় জনমানবশূণ্য। সবাই একপ্রকার দৌঁড়ে ফুটপাতের দোকান গুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে। কেউ আবার ছাতা মাথায় দ্রুত পায়ে হেঁটে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে যাচ্ছে। বড়ো বড়ো বাস, ট্রাক এবং অন্যান্য বড়ো যানবাহনগুলো ফুল স্পিডে ধেঁয়ে চলছে। রিকশা, অটো রিকশা এবং সাইকেলে আরোহন করা যাত্রীগুলো ফেঁসে গেছে প্রায় মহাফ্যাসাদে। মাথায় পলিথিন পেচিয়ে এবং বিস্তীর্ণ গাড়িতে ভারী পর্দা পেচিয়ে গাড়িচালকরা যাত্রীদের শতভাগ নিরাপদে রাখার চেষ্টা করছে। বিকট শব্দে আকাশে বজ্রপাত হচ্ছে! ভয়ে কেঁপে উঠছে আশেপাশের প্রতিটি প্রাণ। সন্ধ্যা হওয়ার পূর্ব সময়টা তো এমনিতেও অনেকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। তার উপর আকাশের নিগূঢ় রুক্ষতা! সব মিলিয়ে আকাশ যেনো বিভৎস রূপ ধারণ করেছে। নূর, চাঁদ, জায়মা, আয়মন এবং তাশফিয়া তাদের হাঁটা থামিয়ে পাশের একটি দুতলা বিশিষ্ট রেস্টুরেন্টে ঠায় নিলো। দ্রুত পায়ে হেঁটে তারা রেস্টুরেন্টের দু’তলায় ওঠে গেল। সবাই বৃষ্টিতে প্রায় কাক ভেজা হয়ে গেছে। প্রথমে তারা পরীক্ষার ফাইলগুলো নিরাপদে গোল টেবিলের উপর রাখল। অতঃপর রেস্টুরেন্টের খালি একটা কোণায় তারা পাঁচজন খোলা বেলকনি দিয়ে ঝরে যাওয়া বৃষ্টিগুলোকে দেখতে লাগল। নূর এবং আয়মন হাত দ্বারা ভেজাক্ত মাথাটা ঝাড়তে শুরু করল। চাঁদ, জায়মা এবং তাশফিয়া তাদের মাথায় আবৃত হিজাবটা মাথা থেকে খুলে নিংড়ে নিচ্ছে। চাঁদ খুব বিরক্ত পুরো বিষয়টাতে। নাক-মুখ বিদঘুটেভাবে কুঁচকে সে গাঁয়ের ওড়নাটা ঝেড়ে বলল,,

“ধ্যাত। বৃষ্টি আসার আর সময় পেলনা।”

নূরের ভেজালো আসক্ত দৃষ্টি জোড়া পড়ল হঠাৎ চাঁদের সিক্ত মুখমণ্ডলে। ওড়না থেকে নিংড়ানো পানি ছিটকে এসে হঠাৎ নূরের নীলাভ লোচনদ্বয়ে ছিটকে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই নূর চোখজোড়া বুজে নিলো। চাঁদের বিমূর্ত দৃষ্টি পড়ল হঠাৎ নূরের দিকে। অসহায় দৃষ্টিতে সে সরি চাইতে যাবে অমনি চাঁদ থমকে দাঁড়ালো। বৃষ্টিতে সিক্ত থাকার দরুন নূরের মোহময় মুখটা যেনো পূর্বের তুলনায় আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠল! স্নিগ্ধতার এক প্রতীক মনে হলো। নিদারুন এক মোহমায়া কাজ করতে লাগল। ভেজালো চুলগুলো থেকে পানি নিঃসরণ হওয়ার দরুন নূরের চুলগুলো ঝরঝরা হয়ে উঠল। তীব্র বাতাসের প্রভাবে চুলগুলো খানিক উড়তে লাগল। চাঁদ অপলক দৃষ্টিতে নূরকে দেখতে লাগল! নূরের নেশাধরা মুখমণ্ডলে তার হারিয়ে যাওয়া দেখতে পেল! কী আছে এই ছেলেটার নিবিষ্ট মুখমণ্ডলে? কোন অদ্ভুত চঞ্চলতা কাজ করে আজকাল তাকে ঘিরে? তার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ না হয়ে পারেনা। এ যেনো নিতান্তই এক করণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে! যাকে হেলাফেলা করা সম্ভব নয়।

ইতোমধ্যেই নূর ফট করে চোখজোড়া খুলে নিলো। বাইরে তাকিয়ে মৃদু হেসে মাথাটা ঝাকালো। তিন থেকে চারবার মাথাটা ঝাকিয়ে সে হাতের মুঠোয় দু’ফোঁটা বৃষ্টিকে বন্দি করে নিলো। ব্যগ্র হেসে চাঁদের চোখে-মুখে বৃষ্টির পানিগুলো ছিটালো! উত্তেজিত গলায় বলল,,

“আই রিয়েলি লাভ দিজ ওয়েদার।”

চাঁদ ফিক করে হেসে দিলো। বিড়বিড়ে গলায় বলল,,

“ইশশশ! কেমন ছোটো বাচ্চাদের মতো আচরণ করছে!”

চাঁদ নিজেও এবার বাইরে দু’হাত মেলে দিলো। উল্লাসিত ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিদের ছুঁয়ে দিতে লাগল। ঠোঁটের কোণায় ফুটিয়ে তুলল হৃদয় কাঁপানো এক হাসি। নূরের বুকটা চিনচিন করে উঠল! বেসামাল হয়ে সে বাইরে রাখা চাঁদের হাত দুটোতে নিজের হাত ছুঁইয়ে দিলো। চাঁদের হাতের নিচে তার দু’হাত বাড়িয়ে দিলো। অমনি চাঁদ হাসি ভুলে হঠকারি দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। দৃষ্টিতে গাঢ় গভীর কৌতূহল এবং সংকোচ ফুটিয়ে তুলল। নূর ম্লান হাসল। চাঁদের কর্ণতলে মুখ ঠেকালো। বেখেয়ালি গলায় গুঞ্জন তুলে বলল,,

“কেউ একজন বলেছিল বৃষ্টি নাকি তার খুব প্রিয়। খোলা জানালায় হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিকে ছোঁয়া তার এক অমোঘ স্বপ্ন! সেই থেকে রাতের বেলায় আমি আর দু’চোখ এক করতে পারিনি! সেই স্বপ্নচারিনীর অমোঘ স্বপ্নকে পূরণের চেষ্টায় আজ আমি পারলাম, ইয়েস আজ আমি পারলাম তার দু’হাতে হাত বাড়িয়ে দিতে! বৃষ্টিকে ছুঁয়ে দিতে।”

চাঁদ থমকালো। বিস্ফোরক দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। আঁচ করতে পারল সে-ই হয়তো নূরের সেই স্বপ্নচারিণী! নূর প্রেমময় দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। পুনরায় কর্ণতলে গুঞ্জন তুলে বলল,,

“আজ আমি আমার সেই স্বপ্নচারিণীর সব উইশ পূরণ করব! সে একদিন বলেছিল না? তার সবকটা উইশের কথা? আজ এক এক করে আমি তার সব উইশ পূরণ করব!”

না চাইতেও চাঁদ কাঠ কাঠ গলায় বলল,,

“কিন্তু আপনার সেই স্বপ্নচারিণী তো স্পেস্ফেকলি বলেনি আপনাকেই সেই উইশগুলো পূরণ করতে হবে।”

“বলতে হবে কেন হ্যাঁ? তার সাথে কী আমার বলাবলির সম্পর্ক?”

“তাহলে কীসের সম্পর্ক?”

“সব কথা কি তাকে বলে বুঝাতে হবে?”

“হ্যাঁ হবে! কারণ, সে আপনাকে বিশ্বাস করে না!”

নূর তেজস্ক্রিয় দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। হতবিহ্বল গলায় বলল,,

“কী?”

“আপনার ভাষ্যমতে তো সে পার্ফেক্ট নয় তাইনা? শুধু আপনি কেন? কারো লাইফেই সে পার্ফেক্ট নয়!”

নূরকে উপেক্ষা করে চাঁদ বিষণ্ণ মনে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো! নূর নির্বোধ দৃষ্টিতে চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। এখনো সেইদিনের কথাটা চাঁদ মনে রেখেছে তা ভেবেই নূর হয়রান হয়ে উঠল। আয়মন, জায়মা এবং তাশফিয়া অনেকক্ষণ পূর্বেই তাদের বুকড করা টেবিলে চলে এসেছিল। জায়মা এবং তাশফিয়া পাশাপাশি বসে নানাধরনের গল্প-গুজব করছিল। আয়মন হাতে মেন্যু কার্ড নিয়ে বসে আছে। মেন্যুতে সে খাবারের আইটেম দেখছে কম তবে উঁকি ঝুঁকি মেরে তাশফিয়াকে দেখছে বেশি!

#চলবে…?

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৪৫
#নিশাত_জাহান_নিশি

নূরকে উপেক্ষা করে চাঁদ বিষণ্ণ মনে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো! নূর নির্বোধ দৃষ্টিতে চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। এখনো সেইদিনের কথাটা চাঁদ মনে রেখেছে তা ভেবেই নূর হয়রান হয়ে উঠল। আয়মন, জায়মা এবং তাশফিয়া অনেকক্ষণ পূর্বেই তাদের বুকড করা টেবিলে চলে এসেছিল। জায়মা এবং তাশফিয়া পাশাপাশি বসে নানাধরনের গল্প-গুজব করছিল। আয়মন হাতে মেন্যু কার্ড নিয়ে বসে আছে। তবে সে মেন্যুতে খাবারের আইটেমগুলো দেখছে কম উঁকি ঝুঁকি মেরে তাশফিয়াকে দেখছে বেশি!

জায়মার সাথে গভীর কথোপকথনে লিপ্ত থাকায় তাশফিয়া এদিক-ওদিক দৃষ্টি ঘুরাতে পারছেনা। তাই স্বাভাবিকভাবেই সে বুঝতে পারছেনা পিপাসায় কাতর একজোড়া তৃষ্ণার্ত চক্ষু তাকে নির্ভেজাল চাহনিতে দেখছে! হঠাৎ তাশফিয়ার মাঝে কী এমন বিশেষ কিছু খুঁজে পেল আয়মন যার কারণে সে এতোটা সম্মোহিত দৃষ্টিতে তাশফিয়াকে খুঁটে খুঁটে দেখছে? তা বুঝার-ই অন্তপ্রাণ চেষ্টা করে চলছে আয়মন। মুখ দেখে যদি মনের কথা বুঝা যায়!

ইতোমধ্যে চাঁদও এসে আয়মন, জায়মা এবং তাশফিয়ার সাথে যোগ দিলো। বিমূঢ় হৃদয়ে সে এক আকাশ মন খারাপকে সঙ্গী করে মাথা নুইয়ে বসল জায়মা এবং তাশফিয়ার পাশে। নূরের প্রতি খুব অভিমান জমে আছে তার। ঐদিন নূরের ঐ কটূক্তিটায় চাঁদ ভেতর থেকে বেশ আঘাত পেলেও সেই আঘাতটা সে তখন বাইরে প্রকাশ করেনি! হাসিমুখে বিষয়টা এড়িয়ে গেছে। চাঁদের মতে পৃথিবীর কোনো মানুষ-ই পার্ফেক্ট নয়। সবার মাঝেই দু’একটা খুঁত থাকে। ভালো-খারাপ মিলিয়েই মানুষ। নিজে একজন মানুষ হয়ে অন্য একজন মানুষের খুঁত খোঁজাটা বোকামী। একটা মানুষ যেমনই হোক আল্লাহ্ তাকে ভালোবেসেই সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টিকর্তার সেই সীমাহীন ভালোবাসার কাছে কার মধ্যে কী আছে না আছে সেসব ম্যাটার করেনা। সব অবস্থাতেই আল্লাহ্’র কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করা উচিৎ। তাশফিয়ার থেকে কোমল দৃষ্টি সরাতেই আচম্বিতে আয়মনের সূক্ষ্মদৃষ্টি পড়ল চাঁদের উপর। উদ্বেগি হয়ে সে মুখের সামনে থেকে মেন্যু কার্ডটা সরিয়ে নিলো। সামনের দিকে খানিক ঝুঁকে এসে তৎপর গলায় চাঁদকে শুধালো,,

“এই কী হইছে তোর? মুখ ফোলাইয়া রাখছস কেন?”

জায়মা এবং তাশফিয়ারও টনক নড়ল এবার। দু’জনই আলাপচারিতা ভুলে অধীর দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা আয়মন এখন তিলকে তাল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। চাঁদের মনের কথা না শোনা অবধি সে কিছুতেই ক্ষান্ত হবেনা। একদম লঙ্কা কাণ্ড বাঁধিয়ে ছাড়বে। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য চাঁদ চট করে মাথাটা উপরের দিকে তুলে নিলো। বিমূঢ়তা ভুলে জোরপূর্বক হেসে আয়মনের দিকে তাকালো। আমতা আমতা সুরে বলল,,

“কই কী হইছে? মুখ ফোলাইছি কই?”

আয়মন সন্দেহজনক দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ চাঁদকে পর্যবেক্ষণ করল। অতঃপর ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“নূর কই?”

“করিডরে।”

“নূর কিছু বলছে তোকে?”

“কই না তো!”

“তাহলে মুখ ফোলাইছিলি কেন?”

“তুমি একটু বেশিই দেখো ভাইয়া।”

“নূরকে ফালাইয়া হঠাৎ এখানে আসলি কেন? সন্দেহ হবেনা?”

“ওখানে ঠাণ্ডা লাগছিল ভাইয়া। বাইরে ঝড়ো হাওয়া বইছে। শীত শীত লাগছিল।”

আয়মন এবার ক্ষান্ত হলো। স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে সোফার পেছনের গদিতে হেলান দিলো। শান্ত স্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী খাবি বল?”

“হালকা কিছু খাব। দুপুরে খেয়ে এসেছি। পেট ভর্তি খাবার। তুমি এক কাজ করো জায়মা এবং তাশফিয়াকে জিজ্ঞেস করো ওরা কী খাবে।”

তাশফিয়া অস্বস্তিবোধ করল। জায়মা কিছু বলার পূর্বেই তাশফিয়া ইতস্তত গলায় মাথা নাড়িয়ে চাঁদকে বলল,,

“তোরা যা খাবি আমিও তাই খাব। আলাদা করে আমার কোনো পছন্দ নেই।”

আয়মন মেন্যু কার্ডে মনোযোগ দিলো। বিজ্ঞ দৃষ্টিতে পুরো মেন্যু কার্ডটা এক ঝলক দেখল। অতঃপর গম্ভীর গলায় তাশফিয়াকে বলল,,

“সবারই কিছু না কিছু পছন্দ থাকে। তোমারও থাকা উচিৎ। না হয় লোকজন তোমাকে এলিয়েন ভাববে!”

তাশফিয়া রাগী রূপ ধারণ করল। আড়চোখে আয়মনের দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলল,,

“আইছে আমারে জ্ঞান দিতে। আর কত বড়ো সাহস? আমাকে ইনডিরেক্টলি এলিয়েন বলে? কিছু বলিনা বলে এই লোকটা দেখি বহুত আশকারা পেয়ে গেছে।”

আয়মন মনে মনে হেঁতো হাসল। ব্যগ্র গলায় বলল,,

“জানি মনে মনে আমাকে অনেক বকাঝকা দেওয়া হচ্ছে। আমিও দেখব কতক্ষণ অবধি এই মানবী শান্ত রূপে থাকতে পারে!”

আয়মন মাথা চুলকালো। চাঁদের দিকে সরল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। জিজ্ঞাসু গলায় বলল,,

“চিকেন মম অর্ডার করি কী বলিস?”

চাঁদ মাথা দুলালো। আয়মন ওয়েটারকে ডেকে চিকেন মম’র অর্ডার বুঝিয়ে দিলো। নূর রাগে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে! করিডরের গ্রীলে কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর সে ঘুঁষি মারছে তো কিছুক্ষণ লাথ মারছে! নিজের প্রতি নিজের-ই খু্ব ঘৃণা জন্ম নিচ্ছে তার। ঐদিনের বলা কথারটার তাৎপর্য সে আজকের দিনে এসে বুঝতে পারছে। চাঁদকে জোশের বসে ঐ কথাটা বলা মোটেও উচিৎ হয়নি তার। যার জন্য সে এখন খুব বাজেভাবে পস্তাচ্ছে। চাঁদের মনে তার প্রতি একটু খারাপ ধারণা জন্ম নেওয়া মানেই হলো চাঁদকে তার হারিয়ে বসা! তার দুর্বল জায়গা সাদমানকে বুঝতে দেওয়া! দুঃশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল নূর। মাথাটা পাগল পাগল করছে তার। কিছুতেই যেনো নিজেকে স্থির করতে পারছেনা সে। দ্রুত বেগে সে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। তুখোড় রাগ দেখিয়ে আয়মনের পাশে এসে বসল। রক্তিম মুখশ্রীতে সামনাসামনি বসে থাকা চাঁদের দিকে তাকালো। নূরের এই বিভৎস রূপ দেখে চাঁদ ভড়কে উঠল। থমথমে দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। তৎক্ষণাৎ শার্টের কলারটা পেছনের দিকে এলিয়ে দিলো নূর। সামনের চুলগুলো টেনে গলায় নমনীয়তা এনে চাঁদের দিকে খানিক ঝুঁকে এসে বলল,,

“আগে যা বলছি সব ভুলে যাও ওকে? আগের কথা সব বাদ। এখন বর্তমান নিয়ে ভাবো, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবো। তোমার সামনে এখন নূরের যেই শান্ত রূপটা বসে আছে সেই রূপটাকে এখন গ্রহণ করো।”

চাঁদ মুখ খুলল। তেজী দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। এতোদিনের জমানো সমস্ত রাগ অভিমান ঝাড়ার সিদ্ধান্ত নিলো। কোনোদিকে কালক্ষেপণ না করেই সে উত্তেজিত গলায় বলল,,

“কী গ্রহণ করব হ্যাঁ? কী গ্রহণ করব? কুমিল্লায় আসার পর থেকেই দেখছি আপনি অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছেন। সারাক্ষণ আমার পেছনে আদাজল খেয়ে পড়ে আছেন! একদণ্ডের জন্যও আমাকে শান্তি দিচ্ছেননা। যা আমি কখনো আপনাকে নিয়ে ভাবিনি বা ভাবতে চাইও নি সেই ভাবনা চিন্তাগুলোই আপনি বেশি করে আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। কী লাভ হচ্ছে এতে বলুন? কী লাভ হচ্ছে? এসব করে আপনি কী প্রমাণ করতে চাইছেন হ্যাঁ? কী প্রমাণ করতে চাইছেন? আপনি আমাকে পছন্দ করেন? ভালোবাসেন? আগে তো আমার চঞ্চলতা নিয়ে আপনার হাজারটা প্রবলেম ছিল! কম ইনসাল্ট করেন নি আপনি আমাকে। আপনার কথার ঝাঁজে আমি কেঁদেছি অবধি। ভেতরে ভেতরে খুব আঘাত পেয়েছি। তবুও উপরে উপরে হাসিমুখে সব মেনে নিয়েছি। ঐ রোজ মেয়েটার জন্য আপনি আমাকে কম অপমান অপদস্ত করেননি। কম হুমকি ধামকি দেননি। কাজিন হিসেবেও মিনিমাম সম্মানটুকু দেননি। কিন্তু কী হলো হ্যাঁ? শেষ পর্যন্ত পেরেছেন তাকে ধরে রাখতে? পেরেছেন তাকে আগলে রাখতে? তাই কোনোকিছুতেই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা ভালো নয় বুঝেছেন? আর আপনিও আমার সাথে এসব ফালতু বাড়াবাড়ি করা কমিয়ে দিন! আপনিও ভালো থাকুন। আর আমাকেও ভালো থাকতে দিন। এসব ফালতু ইমোশন নিজের কাছেই রাখুন! দয়া করে আমাকে এসব আর দেখাতে আসবেনা। সত্যি বলছি মন থেকে আপনাকে আমি একরত্তিও পছন্দ করিনা! আর ভালোবাসা তো দূরে থাক।”

নূর সম্পূর্ণ শকড হয়ে বসে রইল। চাঁদের রুক্ষতা তার ভেতরটাকে ছিন্নভিন্ন করে তুলল। মাথায় এক প্রকার অসহ্য যন্ত্রণার অনুভব হলো তার। চাঁদকে সে ঘুনাক্ষরেও বুঝাতে পারছেনা সেই যন্ত্রণার কথা। আর একদণ্ড চাঁদের মুখোমুখি বসে থাকা মানে হলো মরণ তার চোখের সামনে দেখা! নিজেকে কোনোরকম ধাতস্থ করল নূর। শুকনো ঢোঁক গিলে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আমার ইমোশন তোমার ফালতু মনে হয়?”

“হ্যাঁ হয়! ফালতু-ই মনে হয়। ফালতু না হলে হুট করেই আমার প্রতি এতো ইমোশন জন্ম নিলো কোথা থেকে শুনি হ্যাঁ?”

নূর নির্বিকার গলায় বলল,,

“হুট করেই কিন্তু ভালোলাগা ভালোবাসা হয়ে যায় না। এর দীর্ঘ একটা প্রসেস থাকে। আমি তোমাকে এক দুইদিনে ভালোবাসিনি। ভালোবাসা হতে সময় লেগেছে। লাভ এট ফার্স্ট সাইড। বিশ্বাস করো না তুমি এতে?”

“না করিনা। মোট কথা আমি আপনাকে সহ্য করতে পারিনা! আর জোর করেও কারো প্রতি ইমোশন আনা যায়না। আমিও আমার মনকে কোনো ভাবেই জোর করতে পারিনা।”

নূরের মুখ থেকে আর কোনো কথা বের হলোনা। চোখে বেদনার একসমুদ্র জল নিয়ে সে জায়গা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। হনহন করে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকা আয়মন এবার বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। চাঁদের দিকে সে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। খরখরে গলায় বলল,,

“বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেললি না? কারো ইমোশনকে এভাবে ফালতু বলার রাইট নেই তোর।”

“বাড়াবাড়ি আমি করিনি৷ করেছে তোমার ফ্রেন্ড! তুমিই বলোনা পাঁচ ছয়মাসের ব্যবধানে কীভাবে সম্ভব নতুন করে আবার আমাকে ভালোবেসে ফেলা? ভালোবাসা কী এতোই সহজ?”

“যেদিন তুইও নূরকে মন থেকে ভালোবাসতে পারবি না? সেদিন তুইও বুঝতে পারবি কীভাবে সম্ভব একবারের একটুখানি চাহনিতেই কাউকে ভালোবেসে ফেলা! তার সাথে গোটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার সংকল্প করা।”

নূরের পিছু পিছু ছুটল আয়মন। তবে লাভ কিছু হলোনা এতে! ঝুম বৃষ্টিতে নূর রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে সোজা রাস্তায় নেমে গেল। ভেতর থেকে এক অভেদ্য গোঙানির আওয়াজ নির্গত হচ্ছে তার। শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। একতরফা রাগে-জেদে-দুঃখে দাঁতে দাঁত সংঘর্ষ হচ্ছে। অর্ধফাঁকা রাস্তায় সে বৈরাগ্যের মতো দিশাহীনভাবে হেঁটে চলছে! এলোমেলো তার সমস্ত চিন্তাভাবনা। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক জ্বলন হচ্ছে। যার প্রভাবে তার চোখ থেকে টলটলিয়ে পানি ঝরছে! বৃষ্টির ফোঁটার সাথে চোখের সেই জলগুলো মিশে আশপাশটা ঝাপসা হয়ে এলো তার। রাস্তা-ঘাট, যানবাহন কিছুই ঠাওর করতে পারলনা সে। হঠাৎ করেই পিছন থেকে জোরে জোরে গাড়ির হর্ণ বাজতে লাগল। অতিষ্ট হয়ে উঠল নূর এই জোরালো হর্ণের আওয়াজে। পিছু ঘুরে তাকাতেই দেখল বড়ো একটি ট্রাক ধেঁয়ে আসছে তার দিকে! সঙ্গে সঙ্গেই সে পিছু হটে দাঁড়ালো। তীব্র আতঙ্কতায় ডান হাত দ্বারা কান দুটো চেপে ধরল। হতাশায় মোড়ানো রক্তিম চোখজোড়া বুজে সে গর্জণ করে বলল,,

“আমার ইমোশনকে তোমার ফালতু মনে হয় না? আমার ভালোবাসাকে তোমার বাড়াবাড়ি মনে হয়? কু’ত্তাটার মতো যে তোমার মন জোগানোর জন্য আমি সারাটাক্ষণ তোমার পেছনে পড়ে থাকি বুঝতে পারো না তুমি? ওকে ফাইন! আজ থেকে নূর আর তার ভালোবাসা তোমার কাছে জাহির করবেনা। তার হৃদয় নিংড়ানো কোনো অনুভূতির কথাও তোমার কাছে প্রকাশ করতে যাবেনা। তোমাকে পাওয়ার আক্ষেপে তার মরণব্যধি দেখা দিলেও সে তোমার কাছে ধরা দিবেনা। কারণ, তোমরা কেউ আমার অনুভূতি বুঝোনা! তোমরা শুধু বেগ বুঝো, আবেগ বুঝোনা!”

আয়মন মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। রেস্টুরেন্টের বর্হিপথে সে থম মেরে দাঁড়িয়ে নূরের হারিয়ে যাওয়া দেখল। বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা চাঁদের কথায় নূর ঠিক কতখানি আঘাত পেয়েছে। এখন তার পিছু ছুটেও আর কোনো লাভ নেই। খারাপ কিছু ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা সে এখন থেকেই বেশ আঁচ করতে পারছে! অন্যদিকে তাশফিয়া এবং জায়মা চাঁদকে হাত দ্বারা পিঞ্চ করছে। চাঁদ রাগের চোটে এসব এলোপাথাড়ি কী বলে ফেলল তার জন্য তারা চাঁদকে বকতে আরম্ভ করল। বিশেষ করে জায়মা খুব রেগে গেল চাঁদের উপর। চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে কঠিন গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এসব কী বললি তুই নূর ভাইয়াকে হ্যাঁ? কিছুদিন আগে না বললি নূর ভাইয়াকে দেখলে তোর অন্যরকম ফিলিংস কাজ করে? ভালোলাগা কাজ করে? তাহলে আজ কেন এমন অন্য সুরে কথা বললি হ্যাঁ? কেন নূর ভাইয়াকে এভাবে হার্ট করলি?”

চাঁদ পুরোপুরি শান্ত রইল। সোজাসাপটা গলায় বলল,,

“দেখ জায়মা? নূর ভাইয়াকে আমার জাস্ট ভালো লাগে। লোকজন বলেনা ক্রাশ? আমারও নূর ভাইয়াকে ক্রাশই মনে হয়! উনাকে পেতে হবে, ভালোবাসতে হবে, সম্পর্কে জড়াতে হবে এমন কোনো ফিলিংস এখনো কাজ করেনা! তো এখন আমি কী করব হ্যাঁ? কেনো উনার এসব ওভার পজেজিভনেসকে এভাবে সায় দিব?”

“ওকে ফাইন মেনে নিলাম। নূর ভাইয়ার প্রতি তোর কেবল ভালোলাগা কাজ করে। তবে যদি দুইদিন পর ঠিক উনার প্রতিই তোর ভালোবাসা কাজ করে তখন কী করবি হ্যাঁ? পারবি তখন এই মুখ নিয়ে উনার সামনে দাঁড়াতে? এতোকিছুর পরেও তুই আশা করিস উনি তোকে গ্রহণ করবে?”

“তুই একটু বেশিই ভাবছিস জায়মা। যে জায়গায় আমাদের পরিবারের বড়ো মেয়ে ঐ বাড়ির বড়ো ছেলের বউ। সেই জায়গায় আমিও একই পরিবারে নতুন কেউ হতে যাব? দূরে থাকলেই সম্পর্ক ভালো থাকে জানিস? সম্পর্ক বাড়ানোর চেয়ে এখন যে সম্পর্কটা আছে তাকে ধরে রাখাটাই শ্রেয়।”

জায়মা আর কথা বাড়ালোনা। চাঁদের প্রতি তার রাগ জমতে লাগল। ধপ করে সে চেয়ারে টেনে বসে পড়ল। জায়মার সাথে সাথে তাশফিয়াও বসল। দুজনই মন খারাপ করে বসে রইল। চাঁদ বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই এড়িয়ে গেল। বেপাত্তা হয়ে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে রইল।

,
,

মধ্যরাত প্রায় তিনটা। ঘুমের তীব্র রেশ ছড়িয়ে পড়েছে বৃষ্টির তাণ্ডবে শিথীল রূপ ধারণ করা এক আংশিক ভূমণ্ডলে। আরামদায়ক ঘুমে লিপ্ত ঘুমপ্রিয় মানুষরা। তবে ঘুম নেই শুধু আয়মনের চোখে। তার রুমের লাইন এখনো জ্বলছে! মাহিন এবং নূরকে নিয়ে সে পড়েছে মহাফ্যাসাদে! দুজনই জ্বরে প্রলাপ বকছে! বৃষ্টিতে বেশি সময় ধরে ভেজার দরুন দুজনেরই তুখোড় জ্বর উঠেছে! নূর ভিজেছিল বিচ্ছেদের তাড়নায়। আর মাহিন ভিজেছিল তিথীকে ক্যাম্পাসের কোথাও খুঁজে না পেয়ে! তিথীকে না দেখার বিরহ থেকে! আয়মনের দু’পাশে দুইভাই তাদের ভালোবাসার মানুষদের নাম ধরে চ্যাচাচ্ছে আর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে! একজন চাঁদ বলে বুলি আওড়াচ্ছে তো অন্যজন তিথী বলে ফ্যাস ফ্যাস করছে। দুই অদ্ভুতূড়ে প্রেমিকের মাঝখানে পড়ে আয়মন মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। কী করবে না করবে কোনো উপায়ন্তর খুঁজে পাচ্ছেনা সে। দুজনেরই কপালে হাত রাখা যাচ্ছেনা। শরীরের টেম্পারেচার উর্ধ্বগতিতে। এতো রাতে সে সাবরিনা আবরারকেও ডেকে দিতে পারছেনা। বয়স্ক শরীর। ঘুম ভেঙে গেলে সমস্যা। এইদিকে জ্বরে ভুক্ত দুই রোগীকেও মাথায় জলপট্টি দিতে পারছেনা। জায়গা থেকেই কোনোভাবে উঠতে পারছেনা সে। দুজনই আয়মনকে তাদের মাঝখানে বন্দি করে রেখেছে! এরমধ্যেই মাহিন ঘোরের তাড়নায় অস্পষ্ট সুরে বলল,,

“তুমি কই গেলা তিথী হ্যাঁ? আমারে ছাইড়া কই গেলা? পুরো ক্যাম্পাসটা খুঁইজাও তোমারে পাইলামনা। বৃষ্টিতে একা একা ভিজে এখন আমার তুখার জ্বর বেঁধে গেল। তুমি পাশে থাকলে তো শরীরটা এমনিতেও গরম থাকত! তোমার হাতে হাত ধরে রাখলে এভাবে জ্বর টর বাঁধত না।”

নূর হঠাৎ চট করে শোয়া থেকে ওঠে দাঁড়ালো। উদোম শরীরে সে নড়বড়ে শরীর নিয়ে রুমের দরজার দিকে হাঁটা ধরল! গোঙাতে গোঙাতে বলল,,

“এরে পানি ঢালতে হবে আয়মর। গরম পানি এর গাঁয়ের উপর ঢেলে চামড়া শুদ্ধ ছিলতে হবে! মেয়েদের এভাবে পাগলের মতো ভালোবাসতে নেই! এরচেয়ে ভালো আগুনে পুড়ে মরে যাওয়া!”

প্রস্থান নিলো নূর। আয়মন নির্বোধ দৃষ্টিতে নূরের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। খিটখিটে গলায় বলল,,

“শা’লার মাথা কী গেছে? সত্যিই কী মাহিনকে ছিলবে আজ?’

এলোমেলো পায়ে হেঁটে নূর রাস্তা ভুলে সোজা বাড়ির সদর দরজায় চলে এলো! কম্পিত হাতে দরজার খিলটা খুলতেই সে ছোট্টো পুচির মুখোমুখি হয়ে গেল! নূরকে দেখামাত্রই পুচি শান্ত স্বরে ম্যাও ম্যাও বলে ডেকে উঠল। কোমড়ে ভর করে সে স্থির রূপে দাঁড়ালো। ঝাপসা চোখে পুচির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল নূর। দরজা থেকে দু’কদম হেঁটে সে ধপ করে পুচির মুখোমুখি বসে পড়ল! পুচির দিকে খানিক ঝুঁকে এসে মিনমিনে গলায় বলল,,

“তুই হঠাৎ এখানে কেন হুম? তোর মালকিন কই?”

পুচি জিভ চেটে পুনরায় ম্যাও বলে ডেকে উঠল। অসহায়ের মতো ভাব নিলো। পুচির শরীরের গন্ধ থেকে নূরের হাচ্চি কাশি শুরু হলো। বিতৃষ্ণা হয়ে নূর নাক ঢেকে নিলো। ঢুলুঢুলু চোখে পুচির দিকে তাকালো। বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল,,

“তোর মালকিনের খুব ভাব না? একটা ছেলে তার ভালোবাসায় পাগল বলে তাকে যা ইচ্ছে তা বলে অপমান করবে? মেয়েরা এত নিষ্ঠুর কেন হয় জানিস? কেন তারা ছেলেদের মনের গাঢ়-গভীর অনুভূতিগুলো বুঝতে চায়না বল তো? কেন তারা আমাদের অনু্ভূতি নিয়ে মজা করে জানিস তুই?”

অমনি চাঁদের আবির্ভাব ঘটল একতলার সিঁড়িতে! হন্ন হয়ে সে পুচিকে খুঁজতে লাগল। ভয়ার্ত গলায় পুচির নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আয়মনদের ফ্ল্যাটের সামনে চলে এলো। চাঁদকে এক ঝলক দেখা মাত্রই নূরের চোখের কোণায় জল জমে এলো। অচিরেই সে মাথা নুইয়ে নিলো। নাক টেনে দুঃখ সংবরণ করল। চাঁদের গলার আওয়াজ পেয়ে কী হলো জানিনা পুচি হঠাৎ দৌঁড়ে নূরের পিছনে আশ্রয় নিলো! নূরের পিঠের সাথে একাত্নভাবে মিশে রইল। মনে হলো যেনো নূর ছাড়া পৃথিবীতে তার আরও আপন কেউ নাই। পুরো বিষয়টাতে নূর বেশ অবাক হলো! পুচির আবার কী হলো? কেন সে চাঁদের গলার আওয়াজ পেয়েও নূরের পেছনে নিজেকে লুকালো? কী মাজরা লুকিয়ে আছে এর ভিতরে?

এরমধ্যেই চাঁদের আকস্মিক দৃষ্টি পড়ল অসহায় ভঙ্গিতে বসে থাকা নূরের দিকে। দ্রুত পা ফেলে সে নূরের দিকে এগিয়ে এলো। বিমূর্ষ হয়ে বসে থাকা নূরের দিকে উজবুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। উদ্বেগি গলায় শুধালো,,

“কী ব্যাপার? এই মাঝরাতে আপনি এখানে কী করছেন?”

চাঁদের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলানোর সাহস পেলনা নূর। তাই সে মাথা নুয়ানো অবস্থাতেই প্রত্যত্তুরে বলল,,

“কিছুনা। তুমি এতো রাতে এখানে কী করছ?”

“পুচিকে খুঁজতে এসেছিলাম। দিন দিন ফাজিল হয়ে যাচ্ছে পুচিটা৷ বারবার পড়ার মাঝখানে এসে আমাকে ডিস্টার্ব করছিল। তাই রাগের চোটে দু’ঘা দিয়েছিলাম! এরপর থেকে আর খুঁজে পাচ্ছিনা। আপনি দেখেছেন পুচিকে কোথাও?”

#চলবে…?

[রি-চেইক করা হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]