প্রেমময়ী তুমি পর্ব-৫০+৫১

0
483

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৫০
#নিশাত_জাহান_নিশি

“হেই সুন্দরি? আমি তো এদিকে!”

তিথী থতমত খেয়ে উঠল। আকাশ থেকে টুপ করে মাটিতে পড়ার মতো অনুভূতি হলো। ঘোমটার তলা থেকে সে রাগে গজগজ করল। বুকে দু’হাত চেপে বিড়বিড় করে বলল,,

“মহা মুশকিলে পড়লাম তো। ছাগলটা আমাকে দেখল কীভাবে? এর মনোযোগ তো ঐসময় অন্য জায়গায় ছিল। সেই গভীর মনোযোগ ভেদ করে তো আমাকে দেখার কথা না!”

তিথীর মৌনতা মাহিনের কাছে ঝড়ের পূর্বাভাস বলে মনে হলো! সেই ঝড়কে আরও একটু উস্কে দেওয়ার জন্য মাহিন বিনা সংকোচে তিথীর কানের কাছে মুখ ঠেকালো৷ হেঁতো হেসে রসালো গলায় বলল,,

“এবার তুমি আমার হাত থেকে পালাবা কীভাবে সুন্দরি? পালানোর তো সব রাস্তা বন্ধ! যতই বাঁধা বিপত্তি আসুক এবার তোমাকে আমি আমার করেই ছাড়ব। সে এবার যেভাবেই হোক।”

দাঁতে দাঁত চেপে তিথী মাথা থেকে ঘোমটাটা সরিয়ে নিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে মাহিনের দিকে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। চোখের লেলিহান আগুনে মাহিনকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে বলল,,

“রিলিফের মাল পাইছেন আমাকে হ্যাঁ? যেভাবেই হোক আমাকে আদায় করে ছাড়বেন? কেন আসেন আমার সাথে ছাগলের মতো ম্যাঁ ম্যাঁ করতে হ্যাঁ? বুঝেন না বিরক্ত হই?”

তিথীর বলা প্রথম উক্তিটায় মাহিন বেশ চটে গেল! শিথিলতা ভুলে সে দাহ্য পদার্থে পরিণত হলো। তিথীর দিকে লোহিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“নিজেকে এত তুচ্ছ ভাবো তুমি ছিঃ! আমার ভালোবাসাকেও তোমার তুচ্ছ মনে হয়? তাই তুমি রিলিফের পন্যের সাথে নিজেকে কম্পেয়ার করলা? আমার ভালোবাসাকে অপমান করলা? তোমাকে একটা নজর দেখার জন্য আমি কী কী না করেছি। মাথায় হাজারটা কাজের বোঝা নিয়েও আমি তোমার কাছে ছুটে এসেছি। এই পনেরোটা দিন আমি তোমাকে ছাড়া কীভাবে কাটাইছি শুধু আমি জানি। আর তুমি কিনা.. ছিঃ!”

হনহন করে মাহিন জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। হলের ভেতরে না ঢুকে সে তুখোর রাগের বশবর্তী হয়ে বাইক নিয়ে হল থেকে বের হয়ে গেল! তিথী মানব মূর্তিতে রূপান্তরিত হলো! তাজ্জব দৃষ্টিতে মাহিনের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। কিয়ৎক্ষণ নীরবতায় ডুবে রইল। অতঃপর সম্বিত ফিরে পেতেই সে মাথা ঝাঁকালো। নিজের অপরাধ সে বুঝতে পারল। মাথা নুইয়ে গোমড়ো মুখে বলল,,

“শিট৷ রাগের বশে কী না কী বলে ফেললাম আমি উনাকে! নিশ্চয়ই খুব হার্ট হয়েছেন উনি। উনার কাছে একবার ক্ষমা চাওয়া উচিৎ। সত্যিই তো কতটা পেরেশান হয়ে উনি আমার কাছে ছুটে এসেছিলেন! সব তো আমার নিজের চোখেই দেখা। এতকিছু বুঝার পরেও কেন নাটকটা করলাম আমি? ছ্যাঁ, আই হেইট মাই মাইন্ড!”

বাইক ঘুরিয়ে বাড়ির রাস্তায় মোড় নিতেই হঠাৎ সাদমানের দিকে দৃষ্টি পড়ল মাহিনের! ফুটপাতের দোকানগুলোতে দাঁড়িয়ে সাদমান একের পর এক সিগারেট ফুঁকছে! দেখতে ভীষণ নিষ্ক্রিয় দেখাচ্ছে তাকে। চোখ দুটো লাল বর্ণ ধারণ করেছে। বিরহে কাতর হয়ে আছে সে। দিন-দুনিয়ার কোনো খবর নেই তার! সাদমানের এই বিবর্ণ মুখশ্রী দেখে মাহিন বাইকটা থামিয়ে দিলো। রাস্তার পাশে বাইকটা পার্ক করে সে দৌঁড়ে এলো সাদমানের কাছে। উদ্বিগ্ন হয়ে সাদমানের কাঁধে হাত রাখল। উত্তেজিত গলায় শুধালো,,

“কী রে? কী হইছে তোর? এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?”

মাহিনের দিকে এক নজর তাকালো সাদমান। সঙ্গে সঙ্গেই তার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো! কাঁধ থেকে সে এক ঝটকায় মাহিনের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। হিংস্রাত্নক হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“আমার খবর তোদের নিতে হবেনা বুঝেছিস? দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে! তোরা সবক’টা এক। প্রতারক, বেইমান, স্বার্থপর!”

মাহিন হতবাক হয়ে একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। জোরে শোরে এক ধাক্কা খেলো। সাদমানের দিকে আশ্চর্যিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। শুকনো ঢোঁক গিলে পুনরায় শুধালো,,

“কী হইছে তোর বলবি তো? আমাদের কোনো কথায় তুই হার্ট হয়েছিস?”

“হ্যাঁ হয়েছি! তোর ভাই নূর আমাকে হার্ট করছে। সে তার কথা রাখছেনা। চাঁদের ধারে কাছে ঘেঁষবে না বলেও সে চাঁদের সাথে টই টই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছলাকলা করে চাঁদকে হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে! যে জায়গায় আমাদের মধ্যে কথা হয়েছিল চাঁদ শুধু আমার। চাঁদের উপর শুধু আমার-ই অধিকার।”

“নূর কখনও তার ওয়াদা ভাঙতে পারেনা সাদমান। হয়তো চাঁদ চেয়েছিল বলেই চাঁদকে নিয়ে তার বের হতে হয়েছে। তুই অযথা নূরকে দোষারোপ করা বন্ধ কর প্লিজ।”

সাদমান আক্রমনাত্নক হয়ে উঠল! মাহিনের শার্টের কলার চেপে ধরল সে। চোয়াল শক্ত করে মাহিনের হতবিহ্বল দু’চোখে ধারালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,

“হ্যাঁ যা বুঝেছি বুঝেছি। ভাইয়ের হয়ে সাফাই দিতে এসেছিস? রক্ত তো রক্তকেই টানবে তাইনা? আমার হয়ে কেন টানবে? তবে একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ মাহিন। নূর যদি সত্যি সত্যিই চাঁদের দিকে হাত বাড়ায় না? তবে কিন্তু আমি নূরের হাত কে’টে রেখে দিব! তোকে জানিয়ে রাখলাম। সাবধান করে দিস তোর ভাইকে।”

মাহিনকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে সাদমান জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। আচম্বিত দৃষ্টিতে মাহিন এখনো সাদমানের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। এই প্রথম সাদমানকে সে এতটা হিংস্র হতে দেখল। যা তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটার জন্য খুবই ক্ষতিকারক। এক নিমিষেই সব সম্পর্ক নষ্ট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। গাড়ির হর্ণ কর্ণতলে ভেসে আসতেই মাহিন তার সম্বিত ফিরে পেল। মুখশ্রীতে লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছে সে প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করল। তড়িঘড়ি করে নূরের নাম্বারে ডায়াল করল। কনফার্ম হতে চাইল নূর আসলে কোথায় আছে। নূর আদোতে চাঁদের সাথে আছে কিনা, সাদমানের অভিযোগ ঠিক কিনা! এদিকে চাঁদকে নিয়ে নূর এইতো পাঁচ মিনিট হলো মাত্র হসপিটালে এসে পৌঁছালো। পরিচিত ডক্টর বিধায় এপয়েন্টমেন্ট নিতে তার বেশি দেরি কাঠ-খড় পোড়াতে হয়নি। চেম্বারের ভেতরে ঢুকবে ডক্টর দেখাবে আর চলে আসবে। ব্যস এটুকুই। মাহিনের কল পাওয়া মাত্রই নূর তাড়াহুড়ো করে কলটা পিক করল। চাঁদকে ডক্টরের কেবিনে ঢুকিয়ে দিয়ে সে হসপিটালের এক কর্ণারে এসে দাঁড়ালো। মাহিনের সাথে কথা বলার জন্য। ব্যস্ত গলায় নূর হ্যালো বলতেই মাহিন ঐ পাশ থেকে কঠিন গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই কই তুই?”

“চাঁদকে নিয়ে একটু হসপিটালে এসেছিলাম। কেন?”

“কে বলছে তোকে চাঁদকে নিয়ে হসপিটালে যেতে?”

“মানে? কে বলবে মানে? তুই এভাবে কথা বলছিস কেন?”

“চাঁদের কি কোনো গার্জিয়ান নাই? তোকেই কেন চাঁদের সাথে আসতে হবে হ্যাঁ? আয়মন ছিলনা বাড়িতে? চোখে দেখিস নি তাকে?”

“কী যা তা বলছিস তুই হ্যাঁ? চাঁদের কাজিন আমি। অবশ্যই আমি তার গার্জিয়ান। আমার রাইট আছে চাঁদকে নিয়ে হসপিটালে আসার।”

“সাদমানকে তুই কী কথা দিয়েছিলি হ্যাঁ? তোদের মধ্যে কী কী কথা হয়েছিল বল? কেন তুই নিজের ওয়াদা ব্রেক করছিস?”

“কেন? তোকে বলতে যাবে কেন? সাদমান কি তোর আশেপাশে আছে?”

“সাদমানের সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়েছে। কেন গেলি তুই চাঁদকে নিয়ে হসপিটালে? তুই কিন্তু সাদমানকে কথা দিয়েছিলি চাঁদের আশেপাশে ঘেঁষবি না তুই। তারপরেও কেন এসব করছিস? কেন বন্ধুত্বের মধ্যে শত্রুতা তৈরী করছিস?”

নূর শান্ত হয়ে এলো! গলা নামিয়ে বলল,,

“আমি কী করতাম বল? চাঁদ আমাকে ছাড়া হসপিটালে আসছিল না! ওর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না জাস্ট। কষ্ট হচ্ছিল আমার। ভালোবাসি আমি ওকে! কষ্ট হবেনা বল? তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাকে নিয়ে হসপিটালে আসা। এছাড়া আমার হাতে আর কোনো উপায় ছিলনা।”

এরমধ্যেই হঠাৎ পেছন থেকে চাঁদ কাঁচুমাচু স্বরে নূরকে ডেকে উঠল! মাথা নুইয়ে আবদারসূচক গলায় বলল,,

“নূর ভাইয়া।”

ফোনটা কানে রেখেই নূর দ্রুত বেগে পিছু ফিরে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদ অসহায় গলায় বলল,,

“আপনিও আমার সাথে চলুন না নূর ভাইয়া। আমি একা চেম্বারে যেতে পারবনা!”

ঝট করে নূর ফোনটা কেটে দিলো। বড়ো বড়ো পা ফেলে চাঁদের দিকে এগিয়ে এলো। শান্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কেন? ভয় পাচ্ছ?”

“খুব! ভয়ে আমি আমার সমস্যার কথাগুলো খুলে বলতে পারছিনা নূর ভাইয়া।”

হুট করেই চাঁদের হাতটা আঁকড়ে ধরল নূর! হাঁটতে হাঁটতে ডক্টরের চেম্বারে ঢুকে পড়ল৷ চাঁদ উৎফুল্লিত দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে রইল। বিড়বিড় করে বলল,,

“আপনি কী শুধুই আমার ক্রাশ নূর ভাইয়া? নাকি এরচেয়েও বিশেষ কিছু? কেন আপনার স্পর্শ এখন আমার এত ভালো লাগে বলুন? কেন আপনি আশেপাশে থাকলে আমার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ মেয়েটি মনে হয়?”

ডক্টরের সামনেই চেয়ার টেনে বসল দুজন। মিস নায়লা মিষ্টি হেসে নূরের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন! মিষ্টি রঙের চুড়িদারে উনার শুভ্র মুখশ্রীতে আরও দ্বিগুন শুভ্রতা ছড়িয়ে পড়ছিল। দ্বিধা নিয়ে নূর মিস নায়লার দিকে তাকালো। শার্টের কলারটা ঠিক করে গলা ঝাড়লো। মিস নায়লাও নূরের দেখাদেখি গলা ঝাড়লেন। নরম কণ্ঠে শুধালেন,,

“কেমন আছো নূর?”

মলিন হাসল নূর। জবাবে বলল,,

“ভালো আছি আপু। আপনি কেমন আছেন?”

“এইতো চলছে কোনোরকম। তো বলো কী খবর তোমার? পড়ালেখা কেমন চলছে?”

“চলছে আগের মতোই। যেমন দেখেছিলেন।”

“আচ্ছা বুঝলাম। তো অনার্স কমপ্লিটের পর প্ল্যান কী হ্যাঁ?”

“বিসিএস দেওয়া! যদি ভাগ্যে থাকে তো ভালো কিছু হবে!”

“হুম লেগে থাকো। সফলতা নিশ্চয়ই আসবে।”

“জি আপু। দো’আ করবেন। একচুয়েলি আমার কাজিনকে নিয়ে আপনার কাছে আসা। আপনি ওর ফেসটা দেখলেই বুঝতে পারবেন আসলে ওর সমস্যাটা কী।”

মিস নায়লা দৃষ্টি ঘুরিয়ে একবার চাঁদের দিকে তাকালেন। নূরকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন ছুড়লেন,,

“তোমার কাজিন?”

“জি আপু। দুদিন পরই আমার বড়ো ভাইয়ার সাথে ওর বড়ো আপুর বিয়ে। এরমধ্যেই মুখের চৈত্রিশটা বাজিয়ে রেখেছে। তাই ইমার্জেন্সি আপনার কাছে নিয়ে আসা।”

চাঁদ ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসতে লাগল। মিস নায়লার সাথে নূরের এত ভাব ভঙ্গিমা তার একদম পছন্দ হলোনা। বিশেষ করে মিস নায়লার নূরের দিকে তাকানোর ভঙ্গি তার পছন্দ হচ্ছেনা! ডাল কুচ কালা হে এমন মনে হচ্ছে। মিস নায়লা কিছুক্ষণ বিজ্ঞ দৃষ্টিতে চাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে উনি নূরের দিকে তাকালেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন,,

“ইনফেকশন হয়েছে মুখে। কিছু মেডিসিন নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।”

নূর স্বস্তির শ্বাস ফেলল। বিনিময়ে মৃদু হেসে বলল,,

“প্রোপার্লি মেডিসিন নিলে ঠিক হয়ে যাবে তো আপু?”

“মেয়েটা কী শুধুই তোমার কাজিন হয়?”

পাশ ফিরে চাঁদের দিকে একবার তাকালো নূর। অধীর আগ্রহ নিয়ে চাঁদ নূরের দিকে তাকাতেই নূর অভিমানে তার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। জোরপূর্বক হেসে মিস নায়লাকে বলল,,

“হুম। অনলি কাজিন!”

চাঁদ ছোটো খাটো একটা আঘাত পেল! তাড়াহুড়ো করে সে মাথাটা নুইয়ে নিলো। মিস নায়লা তৃপ্তির হাসি হাসলেন! মিষ্টি গলায় নূরের দিকে প্রশ্ন ছুড়লেন,,

“তা তোমার বড়ো ভাইয়ার বিয়েতে আমাকে ইনভাইট করবে না?”

নূর ভীষণ লজ্জা পেল। কেন আগেই সে মিস নায়লাকে ইনভাইট করলনা সেজন্য সে জিভ কাটল। গলা ঝাকিয়ে মিস নায়লাকে বলল,,

“অফকোর্স আপু। ইনভাইট করবনা কেন? আপনার ইনভিটিশন রইল কিন্তু ভাইয়ার বিয়েতে। চলে আসবেন ওকে? আমি কোনো বারণ শুনবনা”

মিস নায়লা ফিক করে হেসে দিলেন। জবাবে বললেন,,

“ঠিক আছে আসব। তোমার ফোন নাম্বারটা দিয়ে যাও তো! অনেক বছর পর আমাদের দেখা হলো। লাস্ট মেবি দুইবছর আগে দেখা হয়েছিল। অমিত ভাইয়ার কোচিংয়ে।”

নূর বিনাসংকোচে তার ফোন নাম্বারটা মিস নায়লাকে গড়গড় করে বলে ফেলল। মিস নায়লাও হাসোজ্জল মুখে নাম্বারটা উনার ফোনে টুকে নিলেন। পাশ থেকে চাঁদ সাপের ফোঁস ফোঁস করছিল! শুধু পরিস্থিতির চাপে পড়ে কিছু বলতে পারছিলনা। পুরো বিষয়টাতে সে খুব বিরক্ত। বিশেষ করে নূরের প্রতি খুব বিরক্ত! মিস নায়লার সাথে নূরের রসিকতা তার কোনোভাবেই পছন্দ হচ্ছেনা। একবার ফোন নাম্বার চাওয়াতেই দিয়ে দিতে হবে? জুনিয়রের সাথে কীসের এত রসিকতা? এত ভাব-ভঙ্গিমা?

চাঁদের সব সমস্যা জানার পর মিস নায়লা প্রেসক্রিপশান লিখে দিলেন চাঁদকে। নূর মিস নায়লাকে পেমেন্ট করতে নিলেই মিস নায়লা বাঁধ সাঁধলেন! পেমেন্টটা উনি নিতে চাইলেন না। নূর হাজার জোর করার পরেও পেমেন্টটা উনি নিলেন না। পরিশেষে পেমেন্ট পে করা ছাড়াই নূর চাঁদকে নিয়ে চেম্বার থেকে বের হয়ে এলো। তাড়াহুড়ো করে হসপিটাল থেকে বের হয়ে পাশের ফার্মেসিতে গেল। প্রেসক্রিপশান অনুযায়ী সমস্ত ঔষধ কিনে নূর চাঁদকে নিয়ে রিকশায় উঠল। মুখ গোমড়া করে বসে আছে চাঁদ! চোখ তুলে কিছুতেই নূরের দিকে তাকাচ্ছে না। ভীষণ রেগে আছে সে নূরের সাথে।

চারিদিকে তখন মাগরিবের আযান পড়ল। মাথায় বড়ো করে ঘোমটা টেনে নিলো চাঁদ। পুরো মুখটা সে ওড়নার আঁচলে ঢেকে নিলো। নূর আড়চোখে চাঁদের দিকে তাকালো। তবে কিছু বলল না। চাঁদ আর চুপ করে থাকতে পারলনা। নীরবতা তাকে বড্ড পোড়াচ্ছিল। ঘোমটার তলা থেকে সে রূঢ় গলায় নূরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“মেয়েটাকে আপনি আগে থেকে চিনতেন?”

“হ্যাঁ। সিনিয়র আপু। তিন বছরের সিনিয়র।”

“শুধুই কি সিনিয়র আপু? নাকি অন্যকিছু?”

“অন্যকিছু বলতে কী মিন করতে চাইছ?”

“আমি মিন করতে যাব কেন? হাবভাব দেখে বুঝেননি?”

“না বুঝিনি! তুমিই বলো?”

“বুঝে নিন কী বলতে চাইছি। এমন একটা নাটক করছে মনে হচ্ছে যেনো ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানেনা। ন্যাকা।”

“আরেহ্ ভাই। বুঝাইয়া বলবা তো কী হইছে? আমি তোমার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতেছিনা!”

উড়নচণ্ডী হয়ে চাঁদ মাথার ঘোমটাটা ফেলে দিলো। তেজী দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। মুখটা ব্যঙ্গ করে ঝাঁঝালো গলায় বলল,,

“আহাম্মক তুমি? কিছু বুঝো না না? নাক টিপলে দুধ বের হয়? সিনিয়র আপু তোমাকে লাইন মারতে চায় তুমি বুঝো না?”

#চলবে…?

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৫১
#নিশাত_জাহান_নিশি

“আহাম্মক তুমি? কিছু বুঝো না, না? নাক টিপলে দুধ বের হয়? সিনিয়র আপু তোমাকে লাইন মারতে চায় তুমি বুঝো না?”

নূর উজবুক দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। চাঁদ এতক্ষণ যা যা বলল সব তার ধারণার বাইরে ছিল।তার মাথাতেই আসলে এই বিষয়টা ঢুকেনি! এত বছর পর হঠাৎ মিস নায়লার সাথে দেখা হওয়ার পর তার আচরণে নূরের কোনো প্রকার সন্দেহ জাগেনি। কোথাও কোনো খারাপ লাগাও কাজ করেনি। তবে বিষয়টা যে চাঁদের চোখে বাজবে নূর তা সত্যিই ভাবতে পারেনি! ভ্রু যুগল খড়তড়ভাবে সংকুচিত হয়ে এলো নূরের। চাঁদের শাণিত দৃষ্টির কাছে তার হঠকারি দৃষ্টি নিরর্থক ঠেকল। মনে মনে নূর বেশ বুঝতে পারল চাঁদ ভেতরে ভেতরে জ্বলছে! যার প্রতিক্রিয়া সে বাইরে থেকে বেশ টের পাচ্ছে। তবে হঠাৎ এই জ্বলে ওঠার কারণ নূর বুঝতে পারলনা! তাই সে বিষয়টাতে সম্পূর্ণ গাঁ ছাড়া ভাব নিলো। চাঁদের জ্বলনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করল। উল্টে চাঁদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সরু রাস্তায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। শার্টের কলারটা ঠিক করে ভাবলেশহীন গলায় বলল,,

“হ্যাঁ তো? লাইন মারে তো কী হইছে? আমি সিঙ্গেল মানুষ লাইন মারতেই পারে!”

চাঁদের শকুনী দৃষ্টি নূরের শান্ত মুখমণ্ডলে সীমাবদ্ধ! কিছুতেই সে তার দুর্ণিবার রাগকে নিবারণ করতে পারছেনা। ধাক্কা মেরে নূরকে রিকশা থেকে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে! সে কিন্তু তার সবটা দিয়ে চেষ্টা করছে নিজেকে স্থির করতে। নূরকে নিয়ে এত না ভাবতে। তবুও তার এলোমেলো ভাবনাচিন্তাগুলো তাকে ক্রমশ নাজেহাল করে তুলছে। নূরকে নিয়ে ভাবাতে বাধ্য করছে। বেহায়া অনুভূতিদের সে সামলে রাখতে পারছেনা। ধৈর্য্যশক্তিতে কুলাচ্ছে না। একরোঁখা জেদের সাথে না পেরে সে দাঁতে দাঁত চাপল৷ নূরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“যেই না সিনিয়র আপু লাইন মারতে শুরু করল অমনি আপনি হুট করে সিঙ্গেল হয়ে গেলেন না?”

দৃষ্টি ঘুরিয়ে নূর স্থির দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। বাঁ পাশের ভ্রুটা উঁচু করে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কেন? রোজের সাথে আমার ব্রেকাপ হওয়ার পর কী আমি কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম? না কেউ আমাকে তার সাথে সম্পর্কে জড়ানোর জন্য আমাকে হ্যাঁ করেছিল কোনটা?”

তৎক্ষনাৎ চাঁদ মাথা নুইয়ে নিলো। নূরের খোঁচা মারা কথা সে বেশ বুঝতে পারল। সত্যিই তো চাঁদ সেদিন নূরকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। নূরের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলায় নি। উল্টে একবুক কষ্ট দিয়ে নূরকে ফিরিয়ে দিয়েছিল! তখন কে জানত নূরের প্রতি তার হঠাৎ ভালোলাগা জন্ম নেওয়া শুরু করবে। ক্রাশবয় থেকে প্রেমে পরিণত হবে! আসলেই মানুষ যখন কাছে থাকে, খুব গুরুত্ব দিয়ে স্পেশাল ফিল করায়, অকারণে ভীষণ জ্বালায়, বাড়াবাড়ি রকমের যত্ন নেই তখন আমরা তার গুরুত্ব বুঝিনা৷ অবজ্ঞা পাওয়ার পর যখন সেই মানুষটা আমাদের থেকে দূরে সরে যায়, একটু একটু করে আমাদের অবহেলা করতে শুরু করে, আমাদের ভুলতে শুরু করে তখনই আমরা তার গুরুত্ব বুঝি! তখন হয়তো চাইলেও কিছু করার থাকেনা। শুধু অনন্ত আফসোস ছাড়া! এসব ভাবতে ভাবতেই চাঁদের বুকটা ভারী হয়ে এলো। নিজেকে সে যতটা সম্ভব গুটিয়ে নিলো। জবাবে চুপ রইল। নূর নিজেও আর চাঁদকে ঘাঁটাল না। চাঁদের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সরু রাস্তায় মনোযোগ দিলো।

,
,

রাতের ডিনার শেষে সোহানী তার রুমে এলো ঘুমুতে। তখন ঘড়িতে রাত প্রায় এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট চলমান। নীড় ধৈর্য্যহারা হয়ে অনেকক্ষণ যাবত সোহানীর নাম্বারে এক নাগাড়ে ডায়াল করেই চলছে। অথচ সোহানী লাপাতা। রুমে না থাকার দরুন সে ফোনটা এতক্ষণ তুলতে পারেনি। আর ঐদিকে নীড় কিছু না বুঝেই সোহানীর উপর রাগ ঝাড়ছে! রাগে এই মুহূর্তে সোহানীকে তার আস্ত চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে! ধৈর্য্য নিয়ে নীড় এখনও সোহানীর নাম্বারে ডায়াল করেই চলছে। প্রায় দশ নম্বার কলটা সোহানীর ফোনে ঢুকতেই সোহানী রুমে তাড়াহুড়ো করে এসে ফোনটা তুলল। অবিচল হয়ে ফোনটা কানে তুলতেই অমনি নীড় চ্যাচিয়ে উঠল! বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই কই ছিলা তুমি হ্যাঁ? কই ছিলা তুমি? ফোন তুলতে এত লেইট হলো কেন?”

সোহানী শুকনো ঢোঁক গিলল। কাঠ কাঠ গলায় বলল,,

“আআরে আআমি তো খাখাইতেছিলাম।”

“খাওয়ার সময় ফোনটা সাথে নেওয়া যায়না, না? ফোনটা কি শুধু বালিশের তলায় ঘুম পারানোর জন্যই রেখেছিলে?”

“আরে হইছে তো৷ এত রেগে যাচ্ছেন কেন? শান্ত হোন এবার একটু। কিছু না বুঝে ঘ্যাট ঘ্যাট করেই চলছেন।”

“শান্ত হব কীভাবে শুনি? শান্ত হব কীভাবে? আধঘণ্টা ধরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছি। সেই চিন্তা আছে তোমার? ভাবো তুমি আমার কথা?”

“মানে? কই আপনি? বাড়িতে না?”

“আজ্ঞে না। বাড়িতে না। তোমাদের হলরুমের পেছনের গেইটে আছি! তাড়াতাড়ি বের হয়ে এসো। রেদার ফার্স্ট নাইটে আমাকে খুঁজে পাবেনা। মশাই আমাকে কামড়ে খেয়ে ফেলবে!”

“আরে এসব আপনি কী বলেন? এতরাতে ঐ চিপায় আপনি কী করছেন?”

সোহানীর বোকা সোকা কথাবার্তায় রাগে নীড়ের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল! চোয়াল শক্ত করে বলল,,

“মশার কামড় খাইতে আইছি। বুঝছ এবার?”

নীড়ের রাগটা সোহানী এবার বুঝল। সন্তপর্ণে দুষ্টুমি থামিয়ে দিলো সে। ব্যস্ত গলায় বলল,,

“আচ্ছা আসছি আমি। আর একটু ওয়েট করুন।”

তৎক্ষণাৎ কলটা কেটে সোহানী মাথায় বড়ো করে একটা ঘোমটা টেনে নিলো। সাইড ব্যাগ থেকে স্যাভলনের কৌটোটা বের করে সে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে বের হয়ে গেল। বাড়ির সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে পা টিপে টিপে হেঁটে বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা হলরুমের পেছনের দিকে চলে এলো। গভীর অন্ধকারে ঢাকা হলরুমের পেছনের দিকটা। জায়গাটা ফাঁকা এবং খুবই ছমছমে সংকীর্ণ। আলোর কোনো ব্যবস্থাও নেই এখানে। কারণ, জায়গাটাই হলো পরিত্যক্ত৷ প্রয়োজন ছাড়া এখানে কেউ আসেনা। সুষ্ঠু ব্যবহারের অভাবে জায়গাটা নর্দমায় পরিণত হয়েছে। ভয়ে সোহানী ঘাবড়ে উঠল। দূরে থেকে নীড়ের অবয়বও সঠিক বুঝা যাচ্ছেনা। সোহানী খালি চোখে কিছুই ঠাওড় করতে পারছেনা। ভয় ক্রমশ বাড়তে লাগল তার। ভীরু পায়ে হেঁটে সে সামনে এগুতে লাগল। আলোর একরত্তি ছিটেফোঁটাও কোথাও খুঁজে পেলনা সে। উপায়ন্তর খুঁজে না পেয়ে সে মৃদুস্বরে নীড়ের নাম ধরে ডেকে উঠল। অমনি কিছুদূর দাঁড়িয়ে থাকা নীড় তার ফোনের ফ্ল্যাশলাইটটা অন করল। দৌঁড়ে এসে সোহানীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। নীড়কে দেখামাত্রই সোহানী স্বস্তির শ্বাস ফেলল। বুকে হাত চেপে ধরে বলল,,

“উফফ। ভয় পেয়েছিলাম খুব।”

নীড় উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে সোহানীর দিকে তাকালো। সোহানীর মাথায় হাত রেখে ব্যস্ত গলায় বলল,,

“এখন ঠিক আছো?”

সোহানী মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। মৃদু হেসে নীড় ঝট করে সোহানীকে বুকে জড়িয়ে নিলো! একাত্নভাবে সোহানীতে মিশে রইল৷ সোহানীও নীড়ের মাঝে অনাবিল শান্তির নীড় খুঁজে পেল। আষ্টেপৃষ্টে নীড়কে জড়িয়ে ধরল। ভালোবাসা গাঢ় হতে লাগল। তীব্র প্রেম মেশানো গলায় নীড় সোহানীকে বলল,,

“আহ্ শান্তি৷ ছটফট করছিলাম এতক্ষণ এই শান্তিটার জন্যই৷ সিরিয়াসলি আমি পারছিলাম না আর তোমাকে ছাড়া থাকতে সোহানী। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তোমাকে পুরোপুরি কাছে পেতে আরও দুটো দিন অপেক্ষা করতে হবে। ভাবতেই গাঁ রি রি করছে।”

সোহানী মিষ্টি হাসল। নীড়ের কাঁধে দীর্ঘ এক ভালোবাসার পরশ ছুঁইয়ে দিলো! আদুরে গলায় বলল,,

“ভালোবাসা দেখি উতলে উতলে পড়ছে আপনার হু? কবে খেকে আমাকে এত ভালোবাসতে শুরু করলেন?”

“উঁহু। এখন বলবনা! সব ফার্স্ট নাইটে সব বলব।”

“আরও দুদিন অপেক্ষা করতে হবে?”

“আমি অপেক্ষা করতে পারলে তুমি কেন পারবেনা?”

“আচ্ছা যান পারব।”

নীড়কে তার শরীর থেকে সরিয়ে নিলো সোহানী। নীড়ের হাতটা টেনে ধরে অস্থির দৃষ্টিতে নীড়কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। নীড়ের হাতে, বুকে, পায়ের নলিতে সত্যিই মশার কামড়ের দাগগুলো লাল হয়ে দু’চোখে স্পষ্টত। মুখ ভাড় করল সোহানী। ব্যথীত দৃষ্টিতে নীড়ের দিতে তাকালো। ব্যস্ত গলায় বলল,,

“দেখি আর কোথায় কোথায় মশা কামড়িয়েছে বলুন। স্যাভলন লাগিয়ে দিচ্ছি।”

নীড় অবাক হলো। নির্বোধ গলায় শুধালো,,

“সিরিয়াসলি? তুমি স্যাভলন এনেছ?”

“হ্যাঁ৷ কেন? স্যাভলন না লাগাতে তো জ্বালা বন্ধ হবেনা।”

“কে বলল তোমাকে? স্যাভলন লাগালে জ্বালা কমে?

“কেউ বলেনি। তবে আমি এটা অনেকবার ট্রাই করেছি। এটা আসলেই কার্যকর। আপনিও একবার লাগিয়ে দেখুন না।”

নীড়ের প্রতি সোহানীর এত চিন্তা, উদ্বিগ্নতা এবং যত্নশীলতা দেখে সোহানীর প্রতি তার ভালোবাসা আরও দ্বিগুন বেড়ে গেল! সন্তোষজনক দৃষ্টিতে সে সোহানীর দিকে তাকালো। সোহানীকে সায় জানিয়ে মুচকি হেসে বলল,,

“ওকে লাগিয়ে দাও। তুমি যা বলবে তাই রাইট হবে।”

সোহানী মুচকি হাসল। নীড়ের অভয় পেয়ে সে মশার কামড়ে ফুলে লাল হয়ে থাকা জায়গা গুলোতে একটু একটু করে স্যাভলন ঘঁষে দিতে লাগল। নীড় অপলক দৃষ্টিতে সোহানীকে দেখতে লাগল। পরম ভালোবাসায় সিক্ত হতে লাগল। প্রশান্তির শ্বাস ফেলে মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,,

“খুব ভাগ্য করে আমি তোমাকে পেয়েছি সোহানী! উপর ওয়ালা যা করেন নিশ্চয়ই ভালোর জন্যই করেন। তুমি আমার ভাগ্যে ছিলে বলেই ঐদিন অপ্রত্যাশিতভাবে আমার বিয়েটা ভেঙেছিল! আল্লাহ্’র কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া সোহানী। আমার ভাগ্যে তোমার মতো শ্রেষ্ঠ কাউকে রাখার জন্য। আমি সত্যিই তোমাকে পেয়ে ধন্য।”

,
,

সাদমান, নূর এবং মাহিন তিনজন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। মূলত সাদমানের রাগ ভাঙানোর জন্যই তিনজন জড় হয়েছে। সন্ধ্যা থেকেই সাদমান নূরের কোনো ফোন কল’স তুলছিলনা। নীড়ের বিয়ের কাজে তাকে সবার প্রথমে থাকার কথা ছিল কিন্তু সন্ধ্যা থেকেই নূরদের বাড়ির আশেপাশেও তার দেখা মিলল না। বিষয়টাতে নূর বেশ আঘাত পেল। সাদমানের অনুপস্থিতি তাকে পোড়াতে লাগল। নিজেকে সে অপরাধী ভাবতে লাগল। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই মাহিনকে নিয়ে রাতে-বিরাতে সাদমানের বাড়িতে ছুটে আসা।

সাদমানকে নিয়ে তারা বাড়ির ছাদে ওঠে এলো৷ রুমে থাকলে তারা তাদের মধ্যকার ঝামেলাগুলো নিয়ে খোলসাভাবে কথা বলতে পারবেনা৷ সাদমানের পরিবার তাদের মনোক্ষুণ্ণতান কারণ টের পেয়ে যাবে। সবাই দুঃশ্চিন্তা করবে। যার কারণে এই রাতের বেলায়ই তাদের ছাদে ছুটে আসা। সাদমান রাগে গজগজ করছিল৷ হাত-পা তুমুল বেগে কচলাচ্ছিল। হাত দুটো মুষ্টিমেয় করছিল! নূর আজ বাড়ি বয়ে এসেছে বলে আজ বেঁচে গেল! অন্য কোথাও হলে সাদমান এখনই নূরের টুটি চেপে ধরত! সাদমানের রাগের কারণ নূর বেশ বুঝতে পারল। নিজেকে নত করে সে সাদমানের মুখোমুখি দাঁড়ালো। নাক টেনে নিচু গলায় বলল,,

“আজকের ঘটনাটার জন্য আমাকে মাফ করে দে সাদমান। আসলে আমি ইচ্ছে করে চাঁদকে…

আর কিছু বলতে পারলনা নূর! সাদমান অত্যধিক রাগে নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে উঠল। হুট করেই নূরের শার্টের কলার চেপে ধরল। রাগে ফুপিয়ে ওঠে বলল,,

“আমি তোর মুখ থেকে আর একটা কথাও শুনতে চাইছিনা নূর! তুই এখন থেকে আমার শত্রু! কারণ তুই আমার ভালোবাসার দিকে হাত বাড়িয়েছিস। আমাকে ঠকিয়েছিস।”

পাশ থেকে মাহিন চোয়াল শক্ত করল। সাদমানকে শাসিয়ে মৃদুস্বরে চিৎকার করে বলল,,

“কাজটা তুই ঠিক করছিসনা সাদমান। নূরের কলারটা ছাড় বলছি। নূরকে যা বলার বলতে দে। না হয় তুই এখনই আমার হাতের মার খাবি!”

নূর বিরক্তবোধ করল। মাহিনকে থামিয়ে বলল,,

“আহ্ মাহিন৷ তুই থাম তো। সমস্যাটা আমার সাথে সাদমানের। আমরা দুজন ঠিক বুঝে নিব। তুই এর মধ্যে আসিসনা তো। তাছাড়া সাদমানের রাইট আছে আমার গাঁয়ে হাত তোলার। প্রয়োজনে আমাকে জানে মে’রে ফেলার! আমার তরফ থেকে কোনো অভিযোগ থাকবেনা এতে।”

মে’রে ফেলার কথাটা শুনে সাদমানের অন্তর্আত্তা কেঁপে উঠল! রাগের অতিরিক্ত ঘোর থেকে বের হয়ে এলো। অবিলম্বেই নূরের শার্টের কলারটা ছেড়ে দিলো! দু’কদম পিছু হটে গেল। নূরের দিকে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল৷ সাদমানের অস্থিরতা দেখে নূর মলিন হাসল। শার্টের কলারটা ঝেড়ে সাদমানের দিকে এগিয়ে এলো। শান্ত স্বরে বলল,,

“দেখলি তো? আমাদের ফ্রেন্ডশিপ কতটা স্ট্রং? জাস্ট মে’রে ফেলার কথাটা মুখ থেকে উচ্চারণ করতেই তুই কেমন ঘাবড়ে গেলি? ভয়ে-অস্থিরতায় দু’কদম পিছিয়ে গেলি। এবার বুঝে নে এসব মেয়েলি ভালোবাসার চেয়ে আমাদের ফ্রেন্ডসদের ভালোবাসাটা কত গভীর! চাঁদ আজ চলে গেলে বা চিরতরে তোর হয়ে গেলে আমি নতুন কাউকে পেয়ে যাব। তাকে পেয়ে আবার চাঁদকে ভুলে যাব! যেমনটা চাঁদকে পেয়ে আমি রোজকে ভুলে গিয়েছিলাম! জীবন কারো জন্য থেমে থাকেনা জানিস? আজ আমি মরে গেলে কাল দুইদিন। উর্ধ্বে গেলে চার থেকে পাঁচমাস সবাই আমাকে মনে রাখবে। এরপরে বছরের পর বছর কেটে যাবে কেউ আমাকে মনে করবে না। সবাই আমাকে ভুলে যাবে। আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এমন তো সবকিছুতেই বল? তুই শুধু শুধু এসবের মাঝে চাঁদকে টেনে এনে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা নষ্ট করছিস। মেয়েদের ব্যাপারে এখন আমার অনুভূতি নিতান্তই তুচ্ছ হয়ে গেছে! আজ একজন তো কাল অন্যজন! এভাবেই কেটে যাবে আমার জীবন! আমার জীবনে হয়তো নির্দিষ্ট কেউ আসবেনা। যে কোনো বাঁধা-বিপত্তি ছাড়াই আমার হবে। যাকে পেতে আমাকে কোনো প্রতিযোগীতায় নামতে হবেনা। ভাগ্যের কাছেও বার বার হেরে যেতে হবেনা। চাঁদকে আমি তোর নামে লিখে দিলাম, যা! চাঁদ শুধু তোর। একান্তই তোর। কলেজের ক্রাশবয় ছিলাম আমি। এখনও আছি। চাইলে এখনও হাজারটা মেয়ে পটাতে পারি। আর মাঝখানে তুই শুধু শুধু সেন্টি খাচ্ছিস চাঁদকে নিয়ে। এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝাড় ওকে? জীবনকে উপভোগ কর। এক জীবনে যতটুকু পেতে চাস তার পিছনে দৌঁড়াতে থাক।”

সাদমান সন্দিহান দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে রইল। থমথমে গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“তাহলে আজ কেন তুই চাঁদকে নিয়ে বের হয়েছিলি বল? কেন দুজন একই রিকশায় উঠলি?”

হু হা শব্দে হেসে উঠল নূর। হাসির রেশ ধরেই বলল,,

“আরে বাধ্য হয়েছিলাম বের হতে। মনে আছে তোর নায়লা আপুর কথা? আমাদের তিন ব্যাচ সিনিয়র ছিল? অমিত ভাইয়ার কোচিংয়ে আমাদের রোজ দেখা হতো? তো আপু অনেকদিন ধরেই খুব রিকুয়েস্ট করছিলেন উনার সাথে একবার দেখা করার জন্য। পেশায় কিন্তু উনি একজন নামকরা স্কিন স্পেশালিষ্টও। তাই ভাবলাম যেহেতু উনার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি তো চাঁদকে সাথে করে নিয়ে যাই। একসাথে দুটো কাজ সেরে আসি। দেট’স ইট৷ এর বাইরে আমার আর কোনো ইন্টেনশন ছিলনা। চাইলে তুই চাঁদকেও জিজ্ঞাসা করতে পারিস। যদি বিলিভ না হয় তো!”

সাদমানের সন্দেহজনক দৃষ্টি এখনও নূরের দিকে বহাল রইল। একরোঁখা গলায় পুনরায় শুধালো,,

“সত্যি বলছিস?”

নূর গাঁ ছাড়া ভাব নিলো। ধীর গলায় বলল,,

“আরেহ্ ভাই। বিলিভ না হলে চাঁদকে জিজ্ঞেস করে দেখনা। গড়গড় করে সব বলে দিবে। জানিস? উনি আমার ফোন নাম্বারও নিয়েছেন! চাঁদ আইডিয়া করে বলছে উনি নাকি আমাকে লাইন মারার চেষ্টা করছেন।”

শেষোক্তিটা বলেই নূর উচ্চশব্দে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে সে বাঁকা ত্যাড়া হয়ে যাচ্ছিল। সাদমান তাজ্জব দৃষ্টিতে নূরকে দেখতে লাগল। নূরকে দেখতে খুবই স্বাভাবিক লাগছিল৷ একটা কথাও অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিলনা। পাশে দাঁড়িয়ে মাহিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মাথা নুইয়ে বিষাদ মাখা গলায় বলল,,

“আমি জানি নূর তুই অভিনয় করছিস! সাদমানের সাথে তুই অভিনয় করছিস। বুক ফেঁটে যাচ্ছে তোর, তবুও মুখ ফুটছেনা!”

জেদী ভাব ভুলে সাদমান সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হলো। মলিনভাবে হাসার চেষ্টা করল। খামোখা হাসতে থাকা নূরের কাঁধে হাত রাখল। শিথিল কণ্ঠে বলল,,

“চাঁদকে কিছু আস্ক করতে হবেনা। আমি বুঝতে পেরেছি তুই সত্যি বলছিস। চল আমরা রুমে যাই।”

উৎফুল্ল মনে হাসির ঝংকার নিয়ে সাদমান প্রস্থান নিলো। মনে মনে তার খুশির বন্ধ্যা বইছিল। নূর হাসি ভুলে ছাদের কার্ণিশে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। শরীরটা হঠাৎ তার ভীষণভাবে কেঁপে উঠল। নিকৃষ্ট বিষাদের গহীন ছাপ মুখমণ্ডলে ফুটে উঠল। মাহিন উদগ্রীব হয়ে দৌঁড়ে এলো নূরের দিকে। ভরাট গলায় শুধালো,,

“কেন মিথ্যে বললি তুই সাদমানকে হ্যাঁ? তোর অনুভূতি তুচ্ছ? রোজকে ভুলতে পেরেছিস বলে তুই চাঁদকেও ভুলতে পারবি?”

নূর একপলক মাহিনের দিকে তাকালো। গলা ঝেড়ে ভগ্ন গলায় বলল,,

“পৃথিবীটা খুব স্বার্থপর মাহিন! এই স্বার্থপর পৃথিবীতে তুই যত আবেগ দেখাবি ততই তোর ক্ষতি ডেকে আনবি। নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করবি। নিজের দুর্বলতা কখনও কারো কাছে ফুটিয়ে তুলতে নেই। রোজ কোথাও না কোথাও একটু স্বার্থপর ছিল বলেই এত সহজে আমাকে ছাড়তে পেরেছিল। আমিও স্বার্থপর বিধায় রোজকে ভুলে চাঁদকে ভালোবাসতে পেরেছিলাম। শুধু একটুখানি ভালো থাকার আশায়, একটু ভালোবাসা পাওয়ার লোভে। স্বার্থ ছাড়া কী আছে এতে। এই স্বার্থের খেলায় পরিশেষে এসে আমিই ঠকে গেলাম! সবাই ঠিক রইল, মাঝখান থেকে আমি বদনাম হলাম! চাঁদও আমাকে বদনাম করল আর সাদমানও। অথচ এই দুজনই আমার জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি অংশ। যাদের ছাড়া আমি অচল, নিষ্প্রাণ।”

সোজা হয়ে দাঁড়ালো নূর। চোখের কার্ণিশ ঘেঁষে চিকচিক করতে থাকা নোনাজলগুলো জোর করে চোখের ভেতর ঢুকিয়ে নিলো! বৃহৎ আকারে দু’দুটো বিশৃঙ্খল শ্বাস ছাড়ল। ঈষৎ হেসে মাহিনের কাঁধে হাত রেখে বলল,,

“চল। আমরা সাদমানের রুমে যাই৷ খানা-পানি কিছু খাই।”

জায়গা পরিত্যাগ করল নূর। মাহিন ঘাড় বাঁকিয়ে নূরের যাওয়ার পথে ব্যথীত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে ঠেকল যে চাইলেই সবকিছু ঠিকঠাক করা যাচ্ছেনা। পরিস্থিতির চাপে পড়ে সবাই এখানে ভোক্তভোগী। কিছু করতে চাইলে এখানে একমাত্র চাঁদ-ই কিছু একটা করতে পারবে! এর বাইরে আর কারো সাধ্য নেই পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার। কয়েকদফা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহিন ছাদের দরজায় পা বাড়ালো। অমনি তার প্যান্টের পকেট থেকে তার সেলফোনটি বেজে উঠল। বিরক্ত হয়ে মাহিন প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকালো। গরম কণ্ঠে বলল,,

“উফফ! এতরাতে আবার কে কল করল?”

তিক্ততা নিয়ে মাহিন ফোনটা চোখের সামনে ধরতেই আননোন একটা নাম্বার তার ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল। তৎক্ষনাৎ কপাল কুঁচকালো মাহিন। সন্দিহান গলায় বলল,,

“এতরাতে আননোন নাম্বার থেকে আবার কে কল করল?”

দ্বিধা দ্বন্ধ ভুলে মাহিন কলটা এবার তুলল। ফোনটা কানে ধরেই অধীর গলায় বলল,,

“হ্যালো। কে?”

ঐপাশ থেকে তিথী শুকনো ঢোঁক গিলল! বেলকনির রেলিংটা আরও শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরল। অস্বস্তিতে ভুগতে লাগল সে৷ জবাবে কী বলবে তাই ভাবতে লাগল। পাশ থেকে তাশফিয়া তিথীকে খোঁচাতে লাগল! পিঞ্চ করে ক্ষুদে আওয়াজে বলল,,

“এই বল তুই কে। ফোনটা অযথা কানে ধরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

তৎক্ষনাৎ তিথী চোখজোড়া বুজে নিলো। জামার কাপড়টা মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। মনে সাহস সঞ্চার করে গড়গড় করে বলল,,

“আমি তিথী বলছি। আপনাকে সরি বলতেই ফোনটা করেছি। আসলে বিকেলের মিসবিহেভটার জন্য আমি সত্যিই খুব সরি। প্লিজ ফরগিভ মি ওকে? মন থেকে মাফ করে দিবেন কিন্তু। রাখছি এখন বায়।”

কম্পিত হাতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করল তিথী। কান থেকে ফোনটা সরিয়ে তৎক্ষণাৎ তাশফিয়াকে জড়িয়ে ধরল! থমথমে গলায় বলল,,

“আমারে শক্ত কইরা ধর বইন। মাথাটা ঘুরতাছে মনে হয়।”

তাশফিয়া বেকুব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তিথীর কর্মকাণ্ড তার নিরর্থক ঠেকল। মনে মনে আওড়ে বলল,,

“তিথীকে আবার ভূতে ধরল না তো?

কানে হাত দুটো চেপে ধরে মাহিন দাঁড়িয়ে রইল! মনে হলে যেনো চার সেকেন্ডের জন্য তার উপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল! সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে দেল। কানের পোকা একদম নাড়িয়ে দিলো। সম্বিত ফিরে পেতেই মাহিন কান থেকে হাত দুখানা সরিয়ে নিলো। তাজ্জব গলায় বলল,,

“এভাবে কে মাফ চায় ভাই?”

____________________________________

রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি। হলরুমের বাইরে এসে চাঁদ এই মাঝরাতে দোলনা দুলছে! পা দুটো সমান্তরালভাবে দুলিয়ে সে দোলনার দুপাশের লোহার বেড়িগুলোতে হাত দু’টো শক্তপোক্ত ভাবে চেপে ধরেছে। পা দ্বারা ঠেলে সে নিজেই দোলনায় দুলছে। কারো কোনো সাহায্যের প্রয়োজন পড়ছেনা। কোলাহলমুক্ত নিস্তব্ধ রাতের আকাশ। শীতল এবং মৃদুমন্দ হাওয়ার প্রভাবে চাঁদের উন্মুক্ত চুলগুলো হাওয়ার তালে তালে এদিক থেকে ওদিক উড়ুউড়ু করছে। চেহারায় দ্বিধাহীনভাবে দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ছে। এই মুহূর্তে মনটা তার বড্ড উদাসীন। আকাশের বাঁকা চাঁদের দিকে নজর তার। নির্বিকার নির্লিপ্ত চাহনি। মনে হচ্ছে যেনো একধ্যানে সে মহাভারত ভেবে ফেলছে। তার এই আকাশ-কুসুম ভাবনাচিন্তায় জায়মা এসে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই ব্যাঘাত ঘটালো! দোলনার বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে চাঁদের দিকে সে সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কী রে? এত রাতে তুই এখানে একা কী করছিস? মন টন খারাপ নাকি?”

চাঁদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মন্থর গলায় বলল,,

“মন খারাপ কিনা তাই বুঝার চেষ্টা করছি।”

“ওহ্ আই সি। মন খারাপ কিনা তা বুঝার জন্য তুই এই মাঝরাতে ভূতের মতো চুল খুলে এখানে বসে আছিস হ্যাঁ?”

“ইয়ার্কি করিস না তো। ভাল্লাগছেনা!”

“ভাল্লাগছেনা কেন সেটাই তো জানার চেষ্টা করছি। বল কী হয়েছে বল তো?”

“একটা জিনিস অনেকক্ষন ধরে ভাবলাম জানিস? শুধু মেয়েরা সুন্দর হলেই জ্বালা না। ছেলেরা সুন্দর হলেও জ্বালা। সিনিয়র আপুরাও এসব ছেলেদের লাইন মারে জানিস? ভাবা যায় এগুলা?”

“আরেহ্ বইন কী হইছে খোলসা করে একটু বলবি তো নাকি?”

দৃষ্টি ঘুরিয়ে চাঁদ পাশ ফিরে জায়মার দিকে তাকালো। এক হেচকা টানে জায়মাকে তার পাশে বসিয়ে দিলো। জায়মার চোখে চোখ রেখে হেয়ালী গলায় বলল,,

“জানিস? নূর ভাইয়াকে এক সিনিয়র আপু লাইন মারছে!”

“তো? লাইন মারলে তোর ক্ষতি কী? তোর কি জ্বলে?”

“ধ্যাত! আমার জ্বলব কেন? আমি তো জাস্ট কথার কথা বলছিলাম।”

“কথার কথা বাজে কথা। জানিস না? নূর ভাইয়াকে নিয়ে তোর এত ভাবতে হবেনা।”

“ভাবতে চাইনা আমি! তবুও ভাবতে হচ্ছে। মানুষটা বোধ হয় জাদু টোনা জানে জানিস? জাদুর কাঠির মতো কেমন আমায় টানে! কী থেকে কী হয়ে গেলাম আমি? এমনটা হওয়ার তো কথা ছিলনা।”

#চলবে…?